www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মুক্তি

----এক-----
সত্যিই আমি এই ঘটনার উত্তর আজও খুঁজে পাইনি, আমার নিজের একটা যুক্তি তক্কের মন আছে কিন্তু তা দিয়েও আমি এর জবাব পাইনি। কিছু লোকে বলে যে তাঁরা ভূত দেখেছে, আবার কেউ বলে অনুভব করেছে, আমি কিন্তু এটার কোনটাই করিনি, কিন্তু এমন একটা ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটেছে, সেটা যে ভৌতিক না অন্য কিছু , সত্যি বলতে পাঁচ বছর পরেও আমি এখনো তা বুঝতে উঠতে পারিনি।
আমি তখন সবে বারো ক্লাস পরীক্ষা দিয়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেরাচ্ছি ,সঙ্গে আমারই ক্লাসমেট দিপন। দিপনের বাড়ি আমাদের পাশের পাড়ায়, দিপনের বাবা মারা গেছেন অনেকদিন আগে বাড়িতে শুধু তার মা আর দাদা। দাদা বেশ একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি করে এবং তার বিয়ের কথাবার্তাও জোর কদমে চলছে।
আমি আর দিপন পাশাপাশি পাড়ায় থাকার সুবিধায় দুজনের মধ্যে বেশ একটা ঘন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, দুজন দুজনার বাড়িতে যাতায়াতও বেশ ছিল। পরীক্ষার পর লম্বা ছুটির মাঝে আমরা রোজ বিকালে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পরতাম, তখন এত গাড়ি ঘোড়ার উপদ্রব ছিলোনা, আমরা রোজ ঘণ্টা দুয়েক সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, এ পাড়া থেকে সে পাড়া , কত অজানা রাস্তা আমরা বার করেছি তার ইয়াত্তা নেই, জঙ্গল, খাল বিল, ফাঁকা মাঠ অতিক্রম করে আমরা ঘুরতাম, সে এক অনাবিল আনন্দের দিন ছিল।এভাবেই বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল।
এরই মধ্যে খবর পেলাম দিপনের দাদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এবং সেটা মাস খানেকের মধ্যেই, সে আরেক আনন্দের ব্যপার, কত কাজ, কত দায়িত্ত উফ , আমরা আরও কজন বন্ধু মিলে উৎসাহ নিয়ে বেশ হই চই করে কাঁটিয়ে দিলাম। যথাসময়ে দিপনের দাদার বিয়েও হয়ে গেলে ,তারা হানিমুন সেরে টেরে এর বাড়ি তার বাড়ি নিমন্তন্ন খেয়ে দেয়ে আরও মাস খানেক কেটে গেল।
দিপনের বাড়ি যাবার সুবাদের বউদির সাথে বেশ আলাপও হয়ে গেল,দিপনের বৌদি বেশ প্রান চঞ্চল স্বভাবের, দেওর হবার সুবাদে আমাদের সাথে বেশ জমেও গেল। দিন গুলো বেশ কাটছিল,এর মধ্যে আমরা একটা কম্পুউটার কোর্সে ভর্তি হয়েছি, সপ্তাহে চারদিন ক্লাস। আমি আর দিপন সান্ধ্য ভ্রমনের পরে ক্লাস করতে যেতাম, আর দু মাস বাকী ,তারপরেই ছুটি বিহীন জীবনের শুরু । এর পরেই সেই বিভীষিকাময় ঘটনাটা ঘটল।
বউদির বাবা হটাৎ মারা গেলেন, মারা যাওটা যদিও খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না , কারন উনি দীর্ঘ দিন ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। দিপন দুদিন বিকালে এলনা, বেশ বুঝলাম সে এখন ব্যস্ত বউদির বাড়ি নিয়ে । দিন দুই পর দিপন এলো, দিপন কে জিজ্ঞেস করলাম কিরে সব ঠিক ঠাক মিটেছেতো?
- তা মিটেছে, তবে বৌদি খুব ভেঙ্গে পরেছে, একমাত্র মেয়ে তো। দিপন উত্তর দিল।
- সেটাই স্বাভাবিক, আমি আস্তে করে বললাম।
- আমি আবার পরশু আসতে পারবো না , পরশু বউদির তিনদিনের কাজ আছে, আমাকেও যেতে হবে।দিপন বলল, দিপন কেও যেন একটু মনমরা লাগলো।

কিন্তু দিপন একদিন আসবে না বলে এলনা পরপর চারদিন, পঞ্চম দিনে আমি ওকে ফোন করলাম,
-কিরে কি খবর?
দিপন একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ভালো না।
আমি বললাম- কেন? কি হয়েছে।
দিপন বলল- কিছু বুঝতে পারছিনা ভাই, সব কিছু যেন ঘেঁটে যাচ্ছে, তুই পারলে একবার আমাদের বাড়ি আয়।
কিছু যে একটা হয়েছে ভালোরকম, তা দিপনের কথাতেই বুঝলাম, আমি সেদিন বিকালে দিপনের বাড়ি গেলাম।
দিপনদের বাড়িটা একতলা, সামনে বারান্দা, আর ভিতরে তিনটে বড় ঘর আর একটা রান্না ঘর আছে, দিপন বারান্দায় বেশ উদাস মুখে বসে আছে, বারান্দার বাইরে আমি বেশ কয়েকটা চটি জুতো দেখে বুঝলাম ভিতরে কিছু লোকজনও আছে।
বারান্দায় উঠে আমি দিপনের পাশে গিয়ে বসলাম, বাড়িটা কেমন থমথমে লাগছে , আর ভিতর দিয়ে বেশ ফিসফাস কথা ভেসে আসছে। আমি আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম- দিপন কি হয়েছে?
দিপন আমার দিকে ফিরে একটু উদাস স্বরে বলল- পলু তুই ভূত বিশ্বাস করিস?
আমি বললাম- বিশ্বাস করিনা বটে , তবে একটু ভয় পাই। কেন বলতো?
দিপন বলল , মনে হচ্ছে বউদিকে ভূতে ধরেছে।
আমি চমকে উঠলাম ,বললাম – কেন কি হয়েছে?
দিপন এবার আমায় যা বলল তাতে আমি বেশ ভয়ার্ত আর অবাক হয়ে গেলাম।
দিপন ,তার বৌদি আর দাদা গেছিলো বউদির বাড়িতে সেই তিনদিনের কাজ করাতে। সেদিন বৌদি সকাল থেকেই উপস করে ছিল, সেটাই নাকি নিয়ম, তারপর বেলা বারোটা নাগাদ বৌদি পূজায় বসে। পুজার সময় যজ্ঞ হচ্ছিল আর সেটা চলতে চলতে বৌদি হটাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। দীপনরা ভেবেছিল দীর্ঘক্ষণ উপসের জন্যই এই কাণ্ড। তাঁরা ডাক্তার নিয়ে এসে বউদির জ্ঞান ফেরায়। কিন্তু বউদির জ্ঞান ফেরত আসার পর থেকেই বৌদি বেশ অস্বাভাবিক আচরন শুরু করে, পূজার পুরহিতকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়, পূজার সব জিনিস পত্র ফেলে দিয়ে বেশ অস্বাভাবিক ভাবে চিৎকার করতে করতে আবার অজ্ঞান হয়ে পরে। বউদির এহেন আচরন দেখে বাড়ির লোক বেশ ঘাবড়ে গেছিল। আবার জ্ঞান ফিরিয়ে বউদিকে নিয়ে যাওয়া হয় উপরের ঘরে বিশ্রামের জন্য। বৌদিকে বিছানায় শুইয়ে দীপনরা নীচে চলে আসে। তার কিছুক্ষণ পরে বৌদির মা শরবতের গ্লাস নিয়ে উপড়ে ওঠে আর তারও কিছুক্ষণ পর দীপনরা বউদির মায়ের একটা আর্ত চীৎকার পেয়ে সবাই মিলে উপড়ে যায়, এরপর দিপনের কথামত-
আর গিয়ে যা দৃশ্য দেখলাম ভাই তা আমার সারাজীবন মনে থাকবে-
দেখি বৌদি শোওয়ার ওই ভারী খাটটা এক হাতে তুলে দাড়িয়ে আছে, মাথার চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে , কপালের সিঁদুর টা লেপটে আছে সে এক ভয়ানক দৃশ্য, আর বৌদির মা এক কোণে শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে ঠক ঠক কোড়ে কাঁপছেন যেন সামনে মেয়ে দাঁড়িয়ে নেই অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বৌদি আমাদের দেখেই এক প্রচণ্ড চীৎকার করে বোলে ঊঠলো – আমি এসে গেছি, আর আমার সন্তানদের চিন্তা নেই , ওদের মুক্তি দিয়েই আমি যাব। তারপর সে এক ভয়ঙ্কর হাসি, ওই হাসি যে আমার বৌদি হাঁসতে পারে আমি না দেখলে তা বিশ্বাস করতাম না। ওরকম গলা, ওরকম চীৎকার আমি এর আগে কখনো শুনিনি।
যেন ওটা বৌদির নয়, অন্য কেউ কথা বলছে, আর যে খাট বৌদি এক হাতে ধরে তুলে আছে , সেটা আমি , তুই দুজনে মিলেও তুলতে পারবোনা। আমরা এবার সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেলাম।
দাদা এবার বৌদির উদ্দেশ্যে বলল-কী হচ্ছে সুমনা, একী করছ তুমি?
বৌদি এবার দাদার দিকে এক ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল- দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে, তোরা পুরুষ মানুষ রা সব ভণ্ড, দূর হ।
দাদা এবার এগিয়ে গিয়ে বৌদির গালে কষিয়ে এক চড় মাড়লো, বৌদির ওই চড়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে খাটটা ছেড়ে দিল আর খাটটা নীচে পড়লো একটা বিকট আওয়াজ কোরে, আর বৌদিও হটাত মাথা ঘুরে অজ্ঞান হোয়ে বিছানায় পরে গেল।
আমরা আবার সবাই ধরাধরি কোরে বউদিকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বৌদির মা হাঊহাঊ করে কাঁদতে লাগলো, আমাদের সাথে থাকা লোকজনের মধ্যে এবার একটা গুঞ্জন শুরু হোলো – সুমনাকে ভূতে ধরেছে।
আমার দাদার ভূতে বিশ্বাস নেই, তাই সে একটু প্রতীবাদ করার চেষ্টা করলো বটে কিন্তু তার আগেই বৌদির কাকা মশাই বৌদির মাকে চাপা গলায় বলল- বৌদি আমি যা ভয় করেছিলাম তাই হোলো অবশেষে। আমি বারবার বলেছিলাম ওদের গালুডি যেতে দিও না, এবার বোঝো।
আমরা সবাই তাকালাম বৌদির কাকাবাবুর দিকে। আমি ভাবতে লাগলাম এর সাথে গালুডির কি সম্পর্ক।
কাকাবাবু বোলতে লাগলেন – এ কোন ডাক্তারের কাজ নয়, এ হোলো মারীর কাজ। ওকেই ডাকতে হবে।
আমি হাঁ কোরে কথা গুলো শুনছিলাম, মারী কথাটা শুনে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো – মারী ! মারী আবার কী?
দীপন বলল- আমীও তখন বুঝিনি, কিন্তু যখন বৌদির কাকাবাবু একজনকে সঙ্গে নিয়ে কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকলেন তখন দেখলাম ইনি একজন সাধু গোছের লোক, একধরণের ওঝাও বলতে পারিস। বউদির বাপের বাড়ির গুরুদেবের শিষ্য । তাঁর পড়নে সাধুদের মতন গেরুয়া পোশাক, মুখে কাচা পাকা দাঁড়ি, দেখলে ভয় ভক্তি দুটোই আসে , তিনি ধীর পায়ে উপরে উঠে এলেন, সঙ্গে আমি, দাদা, বউদির কাকা বাবু । বউদির মা অসুস্থ হয়ে নিচে নেমে গিয়ে চুপ করে বসেছিলেন।


-----দুই------

মারী গিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন, বৌদি তখনও ঘুমিয়ে আছে, মারী গিয়ে বসলেন বউদির পায়ের কাছে সাথে আমি আর বউদির কাকাবাবু, দাদা বসলো বউদির শিয়রে, দাদাকে দেখে মনে হোল বউদিকে যেন সে কোন এক অচেনা চোখে দেখছে।
কাকাবাবু মারীকে সব খুলে বলল ,সকাল থেকে এখনো পর্যন্ত যা যা হয়েছে, মারী গম্ভির মুখে সব শুনলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না, আমি দেখলাম মারী বউদিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরীপ করছেন, নজর টা আমার কাছে খুব একটা ভাল লাগলো না, মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে কাকা বাবুকে বললেন – বাড়িতে গঙ্গাজল আছে?
কাকাবাবু উঠে গঙ্গাজল নিয়ে এলেন, মারী সেটা নিয়ে হাতের তালুতে একটু ঢেলে , বার তিনেক কপালে ঠেকিয়ে আমাদের অবাক করে গঙ্গাজল টা আমাদের দিকে ছিটিয়ে দিলেন। এবার আরও অবাক হবার পালা, দেখলাম বৌদি উঠে বসলো, এবং উঠেই সেই অস্বাভাবিক চিৎকার – তোরা কেউই আটকাতে পারবি না , আমি আমার সন্তানদের এখান থেকে নিয়ে যাবোই , তাদের আমি মুক্তি দেবোই। তারপরে আমাদের চোখের সামনেই এক লাফে বৌদি খাট থেকে ঘরের মেঝেতে বসে পড়লো।
মারী এবার উঠে দারিয়ে তার সামনে গিয়ে বসলো, বউদির চোখটা আমার কাছে একটু ঘোলাটে লাগলো, মাথার চুল গুল পুরোই খোলা, সেই চেনা বউদিকে আমার একটু বেশিই অস্বাভাবিক লাগছিল।
মারী বউদিকে জিজ্ঞেস করলো – তুমি কে?
বৌদি মারীর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ , তারপর তাকাল আমার দিকে, তারপর দাদার দিকে, দাদা ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
বৌদি আরও মিনিট পাঁচেক চুপ করে রইল।
মারী আবার জিজ্ঞেস করলো- কে তুমি? উত্তর দাও। এবারে মারীর গলাটা বেশ জোরে শোনালো।
বৌদি এবার যে স্বরে উত্তর টা দিল তাতে আমি বেশ চমকে গেলাম, এক অদ্ভুত গলার গম্ভির স্বরে বলল- আমি ৭০৯।
মারী পাল্টা জিজ্ঞেস করলো- কোথা থেকে এসেছ?
বৌদি বলল গালুডি।
কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম, দাদাও হয়তো চমকে উঠেছিল, কারন মাস খানেক আগে দাদা বৌদি গালুডি গেছিল তাদের হানিমুনে। আর এ ব্যাপারে কাকাবাবুর সাবধান বানীটাও আমার মনে পরে গেল।
মারী আবার জিজ্ঞেস করলো- তোমার এখানে আসার কারন কি?
এবার বউদির উত্তরে আমরা সবাই চমকে উঠলাম, বৌদি বলল- এখানে আমি আমার সন্তানদের মুক্তির জন্য এসেছি, তাঁরা দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে এই বাড়িতে বন্দী, আমি তাদের এবার মুক্তি দেব, মুক্তি।
মারি এবার বলল-তোমার সন্তান রা এখন কোথায়?
বৌদি সেই অদ্ভুত স্বরে বলে চলল – তারা এই বাড়ীতেই বন্দী আছে গত পঁচিশ বছর ধরে, আমি একে একে তাদের আমার কাছে টানব আর আমি এই শরীর দিয়েই তাদের মুক্তি দেওয়াবো।
মারী আর কিছু না বলে বউদির মুখে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিল আর আমাদের অবাক করে দিয়ে বৌদি আবার জ্ঞান হারাল।
মারী এবার আমাদের দিকে চেয়ে বলল- একে বিছানায় শুয়ে দাও। আমরা ধরাধরি করে বউদিকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম।
মারি এবার কাকাবাবুর দিকে চেয়ে বললেন – সমস্যা খুব গভীর, আমার মনে হয় এর শরীরে জিন ঢুকেছে, আর তার থেকে আরও বড় বিপদ হোল এ এক এক করে আরও জিন এর শরীরে প্রবেশ করাচ্ছে, আমাদের হাতে সময় খুব কম, এখনি কিছু একটা করতে না পারলে খুব বড়সড় বিপদ ঘোটে যেতে পারে।
কাকা বাবুর মুখটা বেশ ফ্যকাশে হয়ে গেল, আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম, কিন্তু দাদা দেখি এবার রেগে আর মাথা গরম করে বলল- এ সব বুজ্রুকি, আমরা ভাল ডাক্তার দেখাবো, আজকের যুগে দাড়িয়ে আমি এসব বিশ্বাস করিনা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল- দিপন তুই একটা ট্যাক্সি ডাক, আমি বউদিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
আমি একটু ইতস্তত ভাবে কাকাবাবুর দিকে আর মারীর দিকে চাইলাম।
কাকাবাবু দাদাকে দেখিয়ে মারীকে বলল- এ অয়ন, সুপরনার বর।
মারি দাদার দিকে তাকিয়ে বলল- দাদাবাবু, আমি আপনাকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে কোন বাঁধা দেবনা, কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি এ কোন ডাক্তার বদ্দির কাজ নয়, এরকম কেস আমি অনেক দেখেছি , ডাক্তার কিচ্ছু করতে পারেনি, আর বলতে খারাপ লাগলেও অনেক ক্ষেত্রে রুগি কিন্তু বাঁচেনি।
দাদা আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারল না, চেঁচিয়ে বলল- আর যাই হোক , আমি আমার বউকে আপনাদের হাতে ছাড়বো না, বলে আমাকে ধমকের সুরে বলল- কিরে যা ডেকে নিয়ে আয়।
কাকাবাবু এবার মারীর দিকে চেয়ে বলল- সুপর্ণার ওপর এখন আমাদের থেকে ওর বরের অধিকার বেশী, তবে তাই হোক ডাক্তারের কাছেই যাওয়া যাক।


----তিন-----


আমি ট্যাক্সি ডেকে আনলাম, বউদির তখনো কোন সেন্স আসেনি দেখে আমরা ডাক্তারের চেম্বারের বদলে নিয়ে গেলাম কাছের এক নার্সিং হোমে, তারা বউদিকে ভর্তি করে স্যালাইন চালু করে দিল।
আমরা ডাক্তারের সাথে কথা বললাম, ডাক্তার বলল শরীরে জল খুবই কমে গেছে আর ব্লাড প্রেশারটাও কম, আমরা আজকে রেখে সব ঠিক থাকলে কাল ছেড়ে দেবো।
আমরা বউদির অস্বাভাবিক আচরনের কথা আর বললাম না।
পরদিন সকালে গিয়ে দেখলাম বৌদি বেশ স্বাভাবিক এবং সুস্থ, দাদা একেবারে বউদিকে ডিসচার্জ করিয়ে বাড়ি নিয়ে চলে এসছে কাল বিকালে।
দিপন এবার একটু দম নিলো , এতক্ষণ ধরে একনাগারে সে আমাকে এই ঘটনা বলে একটু হাঁপিয়ে গেছিল।
আমি বললাম , তাহলে তো সব ঠিকই হয়ে গেছে।
দিপন বলল কাল রাত পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল, আজ সকালে বৌদি বলল খিদে পেয়েছে, পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক কারন বৌদি গত দুদিন প্রায় কিছুই খায়নি, মা বউদিকে লুচি বানিয়ে দিচ্ছিল, খাওয়ার সময় আমরা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম, যে বৌদি আগে চারটের বেশী লুচি খেতে পারতোনা, সেই বৌদি আজ এক এক করে প্রায় পঞ্চাশ খানা লুচি খেয়ে ফেলেছে আর বউদির খাওয়ার ধরণ দেখে আমরা বেশ চমকে উঠেছিলাম , সে এক অদ্ভুত দৃশ্য তুই না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবিনা, তারপর আর না দেওয়াতে বউদির সেকি গগনভেদি চিৎকার, মাকে ধাক্কা মারছে, দাদাকে ধাক্কা মারছে , ঘরদোর ভাংচুর করছে, দেখে মনে হচ্ছে পুরো উন্মাদ ,আমরা তাড়াতাড়ি লোকাল ডাক্তার ডেকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছি।
দিপন এবার একটু উদাস মনে বলল - আমার এখন দৃঢ় বিশ্বাস বউদিকে ভূতেই ধরেছে।
আমি এবার বললাম তোর বউদি কি এখনো ঘুমাচ্ছে?
দিপন বলল হ্যাঁ।
আমি বললাম চ, একবার তোর বউদির ঘর থেকে ঘুরে আসি। আমার বউদিকে দেখার খুব ইচ্ছা হোল, কেন হোল তা জানিনা।
আমি আর দিপন বউদির ঘরে ঢুকে দেখলাম, বৌদি বিছানায় ঘুমিয়ে আছে, মাথার চুলগুলো এলোমেলো, চোখমুখে একটা ক্লান্তির ছাপ, মাত্র দেরমাস হোল বিয়ে হয়েছে বিয়ের সময়ের সেই ফুটফুটে মিষ্টি বউয়ের মুখটা এই কদিনে একেবারে ঝলসে গেছে।
আমি দীপনকে জিজ্ঞেস করলাম- তোর দাদা কোথায়?
দিপন বলল – সাইক্রিয়াটিস্তের কাছে গেছে, দাদার এখনো বদ্ধ ধারণা যে বউদির মাথায় সমস্যা হয়েছে।
আমি বললাম আমারও তাই মনে হয় দিপন।
দিপন বলল – পলু পাগলের গায়ে এত জোর, এরকম রাক্ষসের মতন খাওয়া দাওয়া, গলার স্বরে এত পরিবর্তন, আমার বিশ্বাস হয়না।
আমার ইচ্ছে ছিল বউদির সাথে একটু কথা বলার, কিন্তু ঘুমোচ্ছে দেখে আমি বেরিয়ে চলে এলাম।

সেদিন বিকালে এবার আমার চোখের সামনে সে এক বিভীষিকা ময় ঘটনা ঘটল। আমি বাড়ীতেই ছিলাম, বিকালে দিপন ফোন করলো, পলু তাড়াতাড়ি একবার আয়, বৌদি কেমন করছে, আমি আর মা বাড়িতে একা, দাদা বাড়ি নেই।
আমি সাইকেল চাপিয়ে ছুটলাম, গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার বুক শুকিয়ে গেল,
দিপনের বাড়ির একতলার ছাদে যে সিঁড়ির ঘর , সেটাতে কোন পাঁচিল নেই,বৌদি কোন এক ফাঁকতালে সেই ছাদে উঠে পরেছে , আর সেই সিঁড়ির ছাদে গিয়ে পা ঝুলিয়ে খিল খিল করে এক অদ্ভুত ভাবে হাসছে আর নিচে দিপন আর দিপনের মা ঠকঠক করে কাঁপছে।
আমি বউদির এই রুপ দেখে পুরো দিশাহারা হয়ে গেলাম, এ কে বৌদি না অন্য কেউ? আমি এক অস্ফুট স্বরে শুধু একবার চিৎকার করে বললাম- বৌদি নিচে নেমে এসো, ওরকম ভাবে ঝুল্লে নিচে পরে যাবে যে।
আমার কথা বউদির কানে গেলো কিনা জানিনা, বৌদি আরও ঝুঁকে গেলো চিলেকোঠার ছাদের ধারে, ওখান থেকে নিচে পরলে বউদিকে আর আস্ত পাওয়া যাবে না আমি জানি।
আমরা তখন আরও দিশেহারা, এমন সময় দিপনের দাদা বাড়ি এল , এসে সোজা সে চলে গেলো চিলেকোঠার ছাদের উপর, একটানে বউদিকে ধরে মাঝখানে নিয়ে এল।
বৌদি তখন এক অস্বাভাবিক স্বরে বলছে- মুক্তি , মুক্তি চাই , না হলে কাউকে ছাড়বো না, সব শেষ হয়ে যাবে, দাদাকে উপরে উঠতে দেখে আমি আর দীপনও চিলেকোঠার ছাদে উঠলাম।
আমরা তিনজনে সে এক যুদ্ধ করে, কসরত করে অতিকষ্টে বউদিকে নিচে নামিয়ে আনলাম।
দাদা এবার বলল আর না, আজই একে হাসপাতালেই ভর্তি করে দেবো, বাড়িতে রাখা অসম্ভব।
আমরা একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে বউদিকে প্রায় পাঁজাকোলা করে ট্যাক্সিতে নিয়ে তুললাম, বউদির সেই একভাবে চিৎকার আর হুঙ্কার দিয়ে চলেছে – মুক্তি চাই , মুক্তি , না হলে সব শেষ।
এসব দেখে ট্যাক্সি চালক কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল, আমরা শুধু বললাম, মাথায় সমস্যা আছে, এক্ষুনি হাঁসপাতালে নিয়ে যেতে হবে বলেই ট্যাক্সির ভিতরে ঢুকে বসলাম।
আমি সামনে আর বউদিকে নিয়ে দিপন আর তার দাদা পিছনের সিটে।
বউদির সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে তার সাথে সেই হুঙ্কার।
ট্যাক্সি চালক এবার বলে বসলো- আপনারা নেমে যান, আমি যাবো না। আমরা তাকে অনেক অনুরোধ করলাম, কিন্তু তিনি ট্যাক্সির স্টার্ট বন্ধ করে চাবি নিয়ে নেবে গেলেন।
ততোক্ষণে বৌদি একটু নিস্তেজ হয়ে পরেছিল আর আমরাও হাল ছেড়ে দিয়ে তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনলাম।
দিপনের মা পুরো ঘটনাটা লক্ষ্য করছিলেন, এতক্ষণ কোন কথা বলেননি, এবার মুখ খুললেন- অয়ন আমার কিন্তু এটা আর স্বাভাবিক ঠেকছে না, তুই সুপর্ণার বাড়িতে খবর দে।
দিপনের দাদাকে দেখে মনে হোল , তার নিজের ওপরে ভরসা অনেক কমে গেছে, তাকেও কেমন একটা অস্বাভাবিক লাগছে।

----চার------

সে রাতে বউদির মা আর কাকাবাবু এলেন, বউদিকে ইঞ্জেকশন দিয়ে আবার ঘুম পাড়ানো হয়েছে। দিপনের দাদা আর মার সাথে বউদির মা আর কাকাবাবু এক লম্বা আলোচনায় বসলেন, আমি আর দিপন বারান্দায় ছিলাম, কিছু কথা ভিতর থেকে ভেসে আসছিল আর আমরা আমাদের মতন আলোচনা করছিলাম।
আমি দীপনকে বললাম, দেখ তুই যা বললি আর আমি যা দেখলাম, তাতে এটাই প্রমান করে যে বউদির আচার আচরন একদম স্বাভাবিক নয়, এবং কিছু ঘটনা তুই যুক্তি তক্ক দিয়েও বুঝতে পারবিনা, কোন স্বাভাবিক মেয়ে খান পঞ্চাশেক লুচি খেতে পারবেনা, একহাতে অমন ভারি খাট তুলতে পারেনা, একা একা ছাদের চিলেকোঠায় চলে যেতে পারেনা – দিপন আমার মনে হচ্ছে বউদির ওপর কোন অশরীরী আত্মাই ভর করেছে।
দিপন চুপ করে শুনে বলল- আমি তোর সাথে একমত, কিন্তু দাদা একদম মানতে চাইছে না।
এর মিনিট দশেকের মধ্যে দিপনের বাড়ির সাথে বউদির বাড়ির আলোচনা শেষ হোল, এবং কাকাবাবুর কথা মত আবার আমাদের সেই মারীর কাছেই যেতে হবে, তবে এবার আমাদের যেতে হবে , মারী এখানে আসবে না।
কাকাবাবু মারীকে ফোন করে জেনে নিল যে আজ রাত বারোটায় বউদিকে বিয়ের বেশে নিয়ে আসতে হবে, কোথায় নিয়ে যেতে হবে সেটা যাবার এক ঘণ্টা আগে জানিয়ে দেওয়া হবে।
আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম, বিয়ের বেশে কেন যেতে হবে এর উত্তর আমার মাথায় এলনা।
রাত এগারোটার একটু পরে বউদির কাকাবাবু একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে চলে এলেন, তার আগে বউদিকে বিয়ের সাজে সাজানো হোল, বউদিকে সাজাতে কিন্তু সেরকম একটা বেগ পেতে হলনা, শরীরের ধকল হোক বা ঘুমের ইঞ্জেকশন , বউদিকে বেশ ক্লান্ত লাগছিল।
বউদির কাকা, দিপনের দাদা , দিপন আর আমি বউদিকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম,রাত বারোটা বলে হয়তো বউদির চোখে তখন ঘুমের রেশ, আমাদের এবার খুব একটা অসুবিধা হলনা বউদিকে গাড়িতে তুলতে।
শহরের রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল, রাতের কোলকাতা, অনেক ফাঁকা অনেক নির্জন আমরা কেউ কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকলাম, গাড়ি ছুটছে, আমি একবার বউদির দিকে তাকালাম, দেখলাম বৌদি একেবারে ঝিমিয়ে বসে রয়েছে, দেখে মনেই হচ্ছে না এই বউদিই আজ বিকালে ওরকম একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে।
প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো এমন এক জায়গায় যেখানে আমি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম, চারপাশে সব মেয়েরা দাড়িয়ে আছে এবং তাদের পোশাক আশাক দেখে আমার কোন এক কালে শোনা শহরের কোন এক নিষিদ্ধ পল্লীর কথা মনে করিয়ে দিল। বউদির কাকাবাবুকে দেখলাম ফোনে একটু উত্তেজিত ভাবে কাউর সাথে কথা বলতে- এই জায়গায় আমি আমার ভাইজিকে নিয়ে কি করে যাব?
ওপাশ থেকে কি উত্তর এল তা আমার জানা সম্ভব নয়, কাকাবাবু দেখলাম শুধু হ্যাঁ আর না বলে মাথা নাড়ছেন।
গাড়ি আরও একটু ভিতরে ঢুকল, একটা গলির সামনে এসে দারিয়ে গেল, কাকাবাবু বললেন এখান থেকে আমাদের হেঁটে যেতে হবে, গাড়ি আর ভিতরে যাবে না। তখন রাত বারোটা বেজে গেছে, চারপাশে শুধু রাস্তার আলো জ্বলছে, কয়েকটা রাস্তার কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে, কোন কোন বাড়ির ঘরের আলো খুব ক্ষীণ ভাবে জ্বলছে, বৌদি কে ধরে ধরে দিপনের দাদা হাঁটতে লাগলো। কাকা বাবু সামনে আর আমি ,দিপন পিছনে।
এভাবে মিনিট কুড়ি হাঁটার পর আমরা এক পুরনো দিনের বাড়ির সামনে এলাম, দেখলাম একজন গেরুয়া বসনের পোশাকের লোক দাঁড়িয়ে আছেন। দিপন আমাকে চুপিচুপি বলল – ইনি হলেন সেই মারী, যিনি বউদির বাড়ি গিয়েছিলেন।
আমরা ঘরের ভিতরে ঢুকলাম, ভিতরটা পুরো অন্ধকার, মারীর হাতে শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছে। আমার বুকটা একটু কেঁপে উঠলো, ভূতে বিশ্বাস করি বা না করি এই পরিবেশে মনের মধ্যে একটা অজানা অচেনা আতঙ্ক চলে এল।
মারী আমাদের নিয়ে উপরে উঠলেন, উপরে ওঠার সিঁড়িটা বেশ সরু। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাদিকে একটা ঘর দেকতে পেলাম, মারী সেই ঘরের ভিতরে ঢুকে আমাদের বলল ভিতরে আসুন।
ভিতরে গিয়ে আমরা একটু চমকে গেলাম, ঘরটা বেশ ছোট, ঘরের মাঝখানে আরেকজন বসে আছেন আর তার চারপাশে একটা ফুলের মালার গণ্ডি। ফুলের মালার গণ্ডির মধ্যে সমান দূরত্বে একটা করে মোট চারটে মোমবাতি জ্বলছে। ঘরে শুধু এই মোমবাতিরই আলো। লোকটাকে আলো আঁধারের মাঝে ভালো করে দেখা গেলনা, এমন সময় মারী সামনে বসা লোকটাকে বললেন- গুরুদেব ইনারা এসে গেছেন।
বোঝা গেল, ইনি গুরুদেব, গুরদেব চোখ খুললেন- বললেন বোসো।
আমরা বসার জায়গা খুঁজছিলাম, তখন ছোট মারি বললেন- আপনারা এই মেঝেতেই বসুন।
আমরা ফুলের গণ্ডির পাশে বসলাম, গুরুদেবের ঠিক সামনে বৌদিকে ধরে দাদা বসলো, দুই পাশে কাকাবাবু আর দিপন। আর আমি একটু তফাৎ রেখে বসলাম পিছনের দিকে।
মারী হয়তো তার গুরুদেবকে সব বলে রেখেছিলেন, তাই গুরুদেব সরাসরি বউদিকে উদ্দেশ্য করে বললেন- তোমার নাম তো ৭০৯, কি চাও তুমি?
বৌদি কোন উত্তর দিলনা।
গুরুদেব তার সামনে রাখা পাত্র থেকে জল নিয়ে মুখের সামনে একটু বিড়বিড় করে বউদির দিকে ছুরে বললেন – বল এবার কি চাস?
বৌদি এবার উত্তর দিল- মুক্তি। আমার সন্তানের মুক্তি।
গুরুদেব বলল- তারা কোথায়?
বৌদি এবার আস্তে কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল-
আমার সন্তানরা এই মেয়েটির বাড়িতে বন্দী আজ পঁচিশ বছর ধরে, তাঁরা মুক্তির জন্য ছটফট করছে আমি তাদের মা হয়ে মুক্তি দিতে পারিনি, এবারে তাদের মুক্তি আমি দেবোই , আমি তাদের মুক্তি না দিয়ে এখান থেকে যাবো না।
গুরুদেব এবার জিজ্ঞেস করলেন- মুক্তির জন্য তুই কি চাস?
এবার বৌদি যে কথাটি বলল তাতে আমরা সত্যই ভয় পেয়ে গেলাম, বৌদি বলল- আমার সন্তানদের একটা রক্ত মাংসের শরীর চাই, কিন্তু তাদের সেই ক্ষমতা নেই যে তারা সেটা নিজেরাই জোগাড় করে , সেই ক্ষমতা একমাত্র আমারই আছে , কারন আমি তাদের মা।
এবার বৌদি এক অদ্ভুত ভাবে হেঁসে উঠলো আর বলল- তুইও আমার কিছু করতে পারবিনা, সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে বউদির সেই অস্বাভাবিক হাঁসি আমাদের এক অজানা আতঙ্ক আর ভয়ে পুরো কুঁকড়ে দিল।
গুরুদেব আবার একটু মন্ত্রপ্রুত জল ছেটাতে বৌদি আবার আচ্ছন্নর মত হয়ে গেল।
গুরুদেব এবার কাকাবাবুর দিকে চেয়ে বললেন- তোমাদের বাড়িতে এমন কোন ঘটনা আছে কি যা এর কথা কে সমর্থন করে।
কাকাবাবু এবার মুখ খুললেন, তার ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে তিনি যা বললেন সেটা আমাদের কাছে কল্পনাতীত ছিল, কাকাবাবু শুরু করলেন-
সে আজ থেকে বছর পঁচিশ আগের ঘটনা, বড়দা মানে সুপর্ণার বাবা বন্ধুদের সাথে একবার গালুডি ঘুরতে গেছিল, সেখানে গিয়ে তাঁরা একটা খুব বাজে ঘটনার মধ্যে পরে, দাদার বন্ধুদের একজন রাত্রে বেলায় নেশা করে এলাকার এক আদিবাসি মেয়েকে জোর করে ধর্ষণ করে আর সেটা জানাজানি হতেই আদিবাসি লোকেরা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে যায় আর দাদার পুরো দলকে আটকে রাখে।
ওরা দাদাদের দুটো শর্ত দিয়েছিলো, হয় মেয়েটিকে বিয়ে করো না হলে মৃত্যু বরন করো। কিন্তু দাদার যে বন্ধুটি এই অপকর্ম টি করেছিল ,সে বলেছিল আমি মরব তাও ভালো কিন্তু বিয়ে করতে পারবো না।
কিন্তু এতে দাদাদের অন্য বন্ধুরা খুব অসহায় হয়ে গেছিল , কারন শুধু একজনের জন্য চারজনকে মরতে হবে, তা দেখে দাদা এগিয়ে আসে আর বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য, আর ঠিক তার পরদিনই সেই আদিবাসী মেয়ের সাথে দাদার বিয়ে হয় আর তারপর দাদা সেই মেয়েটিকে নিয়ে চলে আসে। এসে আমাদের বলে বাড়ির কাজের জন্য মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে।
আদিবাসী মেয়েটি দেখতে তেমন আহামরি না হলেও তার সারা শরীরে যৌবন যেন ঠিকরে পরছিল, বাবা মাকে দেখলাম ব্যপারটা সেরকম ভাবে মেনে নেয়নি, ঘরে দু দুটো জোয়ান ছেলে আছে , আর এই মেয়ের যা যৌবন, তা যে কোন ছেলেকে কাবু করে ফেলতে পারে।
দাদার সাথে বাবা মার আর আমার দীর্ঘক্ষণ কথা বার্তা হোল, দাদা শুধু বলল মেয়টির বাবা তার প্রান বাচিয়েছে আর তাদের খুব অভাবের সংসার তাই তাকে দাদার সাথে কলকাতায় পাঠিয়েছে যাতে সে ঠিকমতন খেতে পরতে পারে।

---পাঁচ-----------
বাবা মার হাজার আপত্তি সত্ত্বেও দাদার জেদের কাছে আমরা একরকম হেরে গেলাম, কিন্তু বাবা মা মেয়েটিকে ঘরের অন্দরমহলে ঢোকার অনুমুতি দিল না।
ঠিক হোল সিঁড়ির ঘরের বাইরের দিক করে ওর থাকার ব্যবস্থা হবে , ওর পাশেই ছোট করে বাথরুম করে দেওয়া হোল, যাতে চান টান সব ওখানেই করে, আর খাওয়াদাওয়া আমাদের ঘর থেকেই যাবে।
এভাবেই মাস খানেক চলল, মেয়েটি পারত পক্ষে ঘর থেকে বেরই না, দাদা সকালে অফিস যাবার আগে তার ঘরে দিনের খাবার দিয়ে আসতো।
এভাবেই মাস খানেক কেটে গেল, মাঝে মাঝে আমি দেখতাম মেয়েটিকে , মেয়েটির নাম ছিল রেখা, আমাদের বাড়ির সামনের উঠানে ঘুরতে আর কানে আসতো একটা গুন গুন গানের আওয়াজ, ওই রকম ভাবে তাকে একঘরে করে রাখলেও তার মনের আনন্দ দেখে আমি অবাকই হয়েছিলাম।
কদিন পরে রেখার আনন্দের কারন যেন আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারলাম।
দাদা অফিস থেকে আসতো রাত আটটার পর, আমি সাধারনত তার আগেই চলে আসতাম, কিন্তু একদিন আমার আসতে একটু দেরী হোল, আমি বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দাদা সেই সিঁড়ির ঘর থেকে বেড়িয়ে উপরে উঠে গেল। রাতে সাধারনত দাদা ওই ঘরে যেত না, আমার মনে একটা কৌতূহল হোল, এবং ঘটনাটা আমি পরপর তিনদিন দেখলাম, আমি আরও কৌতূহলী হয়ে একদিন রাতে দাদার ওই সিঁড়ির তলার ঘরে ঢুকতে দেখে আমি পিছু নিলাম এবং তারপরের ঘটনা প্রমান করে দিল দাদার সাথে ওই মেয়েটির শারীরিক সম্পর্ক আছে, কিন্তু আমি তখনকার মতন ঘটনাটা চেপে গেলাম।
এভাবে মাস সাতেক চলে গেল, এর মধ্যে আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে দাদা ওই ঘরে যাওয়াটা একদম কমিয়ে দিয়েছে। মেয়েটিকেও আগের মতন আর আমি বাইরে দেখতে পেতাম না।

আমি একদিন দাদা কে রেখার কথা জিজ্ঞেস করলাম, দাদা শুধু উত্তরে বলল , রেখার শরীর খারাপ।
আমি বললাম – ডাক্তার দেখাবি না?
দাদা বলল – তার দরকার নেই, আমি ডাক্তার কে বলে ওষুধ নিয়ে এসেছি।
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
সত্যি কথা বলতে মেয়েটির সঙ্গে আমাদের মানে আমি , বাবা আর মার কোন সম্পর্কই ছিল না, মেয়েটি যেন আমাদের বাড়ির এক ভাড়াটে।
এর পর আরও মাস তিনেক যাবার পর মেয়েটিকে আবার আমাদের বাড়ির বাগানে আবিষ্কার করলাম , কিন্তু মেয়েটিকে একটু মনমরা লাগলো আর সেই আগের চেহারাটাও নেই।
মাস খানেক পরে আমাকে অবাক করে দিয়ে দাদাকে দেখলাম আবার মেয়েটির ঘরে রাতে যেতে আসতে। আমি মনে মনে ভাবলাম তারমানে মেয়েটির শরীর খারাপের জন্য দাদা এতদিন যায়নি, আমার মনে হোল এবার একবার বাবা মাকে ঘটনাটা জানাতে হবে ।
কিন্তু আমার আর তা বলতে হয়নি, কারন তার আগেই একটা কাণ্ড ঘটলো।
একদিন আমার রাতে আস্তে একটু দেরি হয়েছিল, তা আমি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে শুনলাম মেয়েটি কাঁদছে, ফোঁপানো কান্না, শুনে আমি একটু থমকে গেলাম,মিনিট পাঁচেক দাঁড়ালাম , কিন্তু কান্না থামলো না। আমি অনেক ভেবে, কি হয়েছে জানতে মেয়েটির ঘরে ঢুকলাম, আর ঢুকেই চমকে গেলাম, দাদা বিছানায় বসে আর মেয়েটি অর্ধ নগ্ন ভাবে বিছানার এক কোনে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ঘরটায় আলো আছে কিন্তু তার ক্ষমতা কম, ঘরটা একটু মায়াময়ী লাগলো, আমাকে দেখে দাদা ধড়মড় করে উঠে বসলো, আর মেয়েটিরও কান্না বন্ধ হয়ে গেল। আমি আর দাঁড়ালাম না, বেরিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম।
সেই রাতে দাদা আমার ঘরে এসে সব খুলে বলল, মেয়েটির সাথে যে দাদার বিয়ে হয়েছে তাও জানাল আর তার যেটা বলল তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
দাদার সাথে যে মেয়েটির শারীরিক সম্পর্ক আছে সেটা আমি জানতাম আর দাদাও নাকি জানত যে ব্যাপারটা আমি ধরে ফেলেছি, কিন্তু যেহেতু আমাদের সামনা সামনি এই নিয়ে কোন ঘটনা ঘটেনি তাই সেও ব্যাপারটা চেপে গেছিল, কিন্তু যেটা আমাকে বিস্মিত করেছিল তা হলো,
এর আগে যখন মেয়েটিকে একদমই ঘরের বাইরে দেখা যেতনা সে বার মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পরেছিল আর দাদা আমাদের অবর্তমানে কোন এক ডাক্তারকে ডেকে বাচ্চাটাকে পেটের মধ্যেই নষ্ট করে, তারপর লোক জানাজানির ভয়ে সেটা বার করে ওই সিঁড়ির ঘরের মধ্যে মাতি খুঁড়ে চাপা দিয়ে দেয়। সে বার রেখা মনের মধ্যে দুঃখ চেপে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিল কিন্তু দাদা আবার সেই একই ভুল করে আর এবারো রেখার পেটে বাচ্ছা চলে আসে। আর এবার বড় ঘটনা হোল মেয়েটি বাচ্চাটিকে জন্ম দিতে চাইছে কিন্তু দাদা একদমই নারাজ।
আমি সব শুনে বললাম, তুই বাবা মাকে বলে দে যে ও তোর বউ, আর তারপর তোর বাচ্ছা নিতে কোন অসুবিধে হবে না।
দাদা রেগে গিয়ে বলল পাগল,আমি নেহাত বাধ্য হয়েছিলাম বলে ওকে বিয়ে করেছিলাম, ভেবেছিলাম এখানে কয়েকমাস রেখে ওকে আবার ওদের দেশে পাঠিয়ে দেব, কিন্তু ও মেয়ে যাবেই না আর তুই তো জানিস আমি শিলা কে ভালবাসি আর আমরা দু বছরের মধ্যেই বিয়ে করবো। শিলা হচ্ছে সুপর্ণার মা, ওদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারটা আমি জানতাম।
কিন্তু যদি এই প্ল্যান হয় তাহলে দাদা মেয়েটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক করলো কেন? আমি রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করার আগেই দাদা বলল- আমি চাইনি রে ওর পেটে বাচ্ছা আসুক , ওই আমাকে বলেছিল একটা বাচ্ছা আসলে ও তাকে নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম তাই প্রথমবার বাচ্ছা নষ্ট করে ফেলি কিন্তু এবার সে অনড়, বচ্ছা সে জন্ম দেবেই।
দাদা বিষণ্ণ মুখে আমার খাটে বসে রইল। আমিও ভাবতে লাগলাম কি করা যায়, যতই হোক এক আদিবাসী মেয়েকে দাদার বউ হিসাবে মেনে নেওয়া যায় না।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর দাদা বলল ভেবেছিলাম হাসপাতালে ভর্তি করে দি , ওখান থেকে ওর দেশে পাঠিয়ে দেব কিন্ত আমি ওর গর্ভে আমার সন্তান চাইনা।
আমি বললাম কেন?
না ,পরে এটা নিয়ে আরও বড় ঝামেলা হতে পারে, ওর বাড়ির লোক এখানে এসে গোলমাল পাকাতে পারে ওরা খুব একটা সুবিধের লোক নয়।
আমি ব্যপারটা ভেবে দেখলাম ঠিকই , যারা আটকে রেখে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বিয়ে দিতে পারে তাদের হিংস্রতা অনেক বেশী হয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম তালে এবার কি করবি?
দাদা অস্ফুট স্বরে বলল- বাচ্ছা নষ্ট করা ছারা আর কোন উপায় নেই।
আমি আঁতকে উঠে বললাম আবার?
দাদা এবার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল- আর কোন সমাধান আমার কাছে নেই।
বউদির কাকাবাবু একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন-
এবার পুরো ঘটনাটার সাক্ষী রইলাম আমি, রেখাকে না জানিয়ে , ওষুধ দিয়ে দিয়ে ওর পেটের বাচ্চাটাকে নষ্ট করা হোল, তারপর ডাক্তার ডেকে বলা হোল ওর পেটের বাচ্ছা টা বেঁচে নেই। উফ সে এক ভয়ানক ব্যপার। রেখা সে কি বুকফাটা কান্না , দেখে আমারও চোখে জল চলে এসেছিল।
মেয়েটি যেন এবার পুরো নিথর হয়ে গেল, আর চেহারাটা হয়ে গেল কঙ্কালসার ।
কদিন পর আমি দাদা কে বললাম- আমার মনে হয় তোর মেয়েটিকে এবার বাপের বাড়ি রেখে আসা উচিৎ।
দাদা বলল- সেটা আমি রেখা কে বলে ছিলাম কিন্তু সে এখন অন্য কথা বলছে, সে তার বাচ্ছাদের ছেড়ে কোথাও যাবেনা।
আমি চমকে বললাম- মানে?
দাদা বলল- রেখার মনে হয় বাচ্ছারা ওর সাথেই আছে। সে নাকি রোজ বাচ্ছাদের সাথে খেলাধুলা করে, তাদের গান শোনায়।
আমি বললাম এ আবার হয় নাকি।
দাদা বলল- হয় যে না সেও আমিও জানি কিন্তু ওকে বোঝাবে কে? তুই একবার বলে দেখ।

আমি আর দাদা রেখার ঘরে গেলাম, ওকে বোঝানোর জন্য। কিন্তু রেখা কে দেখে মনে হোল সে এখন আর সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে নয়, কঙ্কালসার চেহারায় তাকে আর মানুষের পর্যায় ফেলা যায়না, তাকে দেখে আমার ভয়ও হোল আবার বেদনাও হোল।
আমি তাকে বললাম- তুমি কদিন বাড়ি থেকে ঘুরে এসো, তোমার শরীর ,মন সব ঠিক হয়ে যাবে।
রেখা আমার দিকে না তাকিয়ে এক অস্ফুট স্বরে বলল- না , সে গেলে তার বাচ্ছাদের কষ্ট হবে।
আমি বললাম- কোথায় , কোথায় তোমার বাচ্ছা?
সে ঘরের এক কোনায় আঙ্গুল দিয়ে দেখাল আর অস্ফুট স্বরে বলল- দেখতে পাচ্ছ না , ওরা কেমন করে খেলা করছে, কেমন করে আমার দিকে চেয়ে আছে আর আমাকে মা মা বলে দাকছে...দেখ ভাল করে ওরা আমার সাথে , এই ঘরেই আছে, ওদের ছেড়ে আমি কি করে যাই, আমি তো ওদের মা।
আমি ভাল করে ঘরের কোনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না, কিন্তু রেখার কথায় এমন একটা মন খারাপ করা স্বর ছিল যে আমি কিছু না বলে চুপ করে গেলাম।
এবার দাদা বলে উঠলো- কিন্তু রেখা তোমার তো শরীর খারাপ, তুমি এই বদ্ধ ঘরে একা থেকে কি করবে , আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে এর থেকে তোমার বাড়ি চলো সেখানেই তুমি ভাল থাকবে।
রেখা এবার যা বলল তা শোনার জন্য আমরা কেউই বোধহয় প্রস্তুত ছিলাম না, রেখা বলল- ঠিক আছে আমি যাবো কিন্তু আমার সাথে আমার বাচ্চাগুলোরও যাবার ব্যবস্থা করতে হবে, ওদের ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবোনা।
দাদা এবার কিছুটা রাগ মিশ্রিত গলায় বলল- ওরা কেউ নেই ওখানে, ওরা জন্মই নেয়নি এই পৃথিবীতে, তোমাকে আমি কালকেই দিয়ে আসব।
এ কথা বলে দাদা বেরিয়ে চলে গেল। আমি রেখার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম- তুমি বাড়ি যাও, ওখানে কিছুদিন থাকো, তারপর না হয় আবার আসবে, শেষের কথাটা বলার সময় আমার গলার স্বরটা একটু কেঁপে গেলো কারন ওটা যে হওার নয় সেটা বোধহয় এই আদিবাসী মেয়েটিও বুঝেছিল।আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
সেদিন দাদার সাথে আবার কথা হোল, আমি দাদা কে বললাম- দেখ মেয়েটি তার মানসিক সঙ্কুলন হারিয়েছে এবং সেটা খুব স্বাভাবিক, একটা অন্ধকার ঘরে সে একা থাকে, তার চোখের সামনে তার বাচ্ছা নষ্ট হয়েছে , তাদের আবার ওই ঘরের মধ্যেই কবর দেওয়া হয়েছে, ওঘরে থাকলে যে কেউই হয় পাগল হয়ে যাবে না হলে মারা যাবে। তুই এক কাজ কর দাদা , রেখা কে নিয়ে কাল সকালেই বেরিয়ে পর।
সেদিন রাতে ওকে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিলাম আর মাঝরাতে দুজনে মিলে একটা গাড়ি ঠিক করে রেখাকে ঘুমন্ত অবস্থায় গাড়িতে তুলে নিলাম।
রাস্তার মাঝে রেখার জ্ঞান এসেছিল, আমাদের দেখে অদ্ভুদ ভাবে চুপ করে গেছিল, যখন আমরা রেখাকে বাড়িতে নামিয়ে আসি তখন রেখা দাদার হাত ধরে খুব কেঁদেছিল আর বলেছিল আমার বাচ্ছারা তোমার কাছে রইল, তুমি পারলে ওদের মুক্তি দিও।

-----ছয়------
দাদা রেখা কে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসার মাস দুয়েক পর খবর এলো রেখা মারা গেছে। দাদাকে দেখে মনে হোল সে একসাথে দুঃখ আর আনন্দ দুটোই পেয়েছে, আমার কিন্তু মনটা যেন একটু খারাপি হোল, যতই হোক মেয়েটির মৃত্যু আমি কামনা করিনি।
কাকাবাবু আবার দম নিলেন , কিছুক্ষণ সব চুপচাপ । তারপর আবার শুরু করলেন-
এরপর গুরুদেব বাড়িতে কতগুলো খারাপ , ভাল মিশিয়ে ঘটনা ঘটল, মা হটাৎ করে চারদিনের জ্বরে মারা গেলেন, মারা যাবার আগের দিন মা জ্বরের ঘোরে বলেছিল তার মাথার শিয়রে নাকি দুটো শিশু বসে হাসছে আর কাঁদছে , আর তাঁর পায়ের নিচ থেকে নাকি একটা মেয়েলি কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমরা এটাকে নিয়ে আর পরে মাথা ঘামাইনি।

এর বছর খানেক পরে দাদার বিয়ে হোল, খুব ধুমধাম করে আর আমরাও আস্তে আস্তে রেখার কথা ভুলতে লাগলাম, কিন্তু রেখা যে সহজে আমাদের ছেড়ে যাবার নয় সেটা বুঝলাম দাদার বিয়ের মাস তিনেক পর।
দাদা তখনও অফিস থেকে আসেনি, বৌদি আর বাবা উপরে বসে গল্প করছিল, রাত তখন আটটা বেজে গেছে, হটাৎ করে লোডশেডিং , বাবা গেল অন্য ঘর থেকে মোমবাতি আনতে ,এমন সময় নিচে কলিংবেলের আওয়াজ, বৌদি ভাবলো হয় আমি না হয় দাদা এসেছে, বৌদি নিচে গিয়ে দরজা খুললো কিন্তু দেখল কেউ নেই, চারিদিকে অন্ধকার দেখে বৌদি একটু ভয়ই পেয়ে গেল, বার তিনেক কে কে বলল, কিন্তু কোন উত্তর নেই, এমন সময় ঘটল এক মারাত্মাক ঘটনা, বৌদি শুনতে পেল সিঁড়ির ওই ঘর থেকে শিশুদের কান্নার আওয়াজ, বৌদি খুব ভয় পেয়ে গেছিল, কান্নার আওয়াজ টা নাকি আস্তে আস্তে তার খুব কাছে চলে এসেছিল, বৌদি খুব ভয় পেয়ে জোরে চিৎকার করে উঠেছিল, আর সেটা শুনে বাবা দৌড়ে নামতে গিয়ে অন্ধকার সিঁড়িতে পরে যায় আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আর সেই জ্ঞান কোনদিন ফেরেনি , প্রায় চারদিন হাঁসপাতালে থেকে বাবা মারা যায়।
আমরা তারপর পুজ আচ্চা করে সিঁড়ির ঘরটায় ভাল করে তালা মেরে একটা কাঠের পার্টিশন দিয়ে দি, যাতে সিঁড়ির দিয়ে উঠা নামার সময় ওই ঘর আর দেখা না যায়।
কাকাবাবু এবার সুপর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল , এর একবছর পর সুপর্ণা হয়, আর এই দীর্ঘ দিন ধরে আমরা কেউ কিছু দেখিনি , শুনিনি, কিন্তু সুপর্ণার বাবার কাজের দিন থেকে শুরু এলো আমাদের বিভীষিকাময় দিন।
কাকাবাবু একটু থেমে বললেন – আমি বেশ বুঝতে পারছি , সুপর্ণার শরীরে এ রেখাই প্রবেশ করেছে আর সে চায় তার জন্ম না নেওয়া বাচ্ছাদের মুক্তি। ওদের হানিমুনের প্রোগ্রাম শুনেই আমি অনেক বার বলেছিলাম গালুডি না যেতে , কিন্তু নিয়তি, এবার কি হবে গুরুদেব।
গুরুদেব কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন, আমি মোবাইলে দেখলাম এখন রাত আড়াইটে, সব ঘটনা যেন আমার কাছে একটা সিনেমার মতন লাগল, কিছুটা বিশ্বাস করলাম, কিছুটা না, কেন করলাম তাও জানিনা আবার কেন করলাম না তাও না।
মিনিট দশেক সব চুপচাপ থাকার পর গুরুদেব বললেন- রেখার আত্মাই সুপর্ণার শরীরে, ও চায় ওই সিঁড়ির ঘর থেকে ওর জন্ম না নেওয়া বাচ্ছাদের মুক্তি, ও চায় ওদের কাছে পেতে, কিন্তু এই চাওয়া পাওয়ার টানে এই মেয়েটির জীবন যে বিপন্ন, যদি মেয়েটি তার বাচ্ছাদের পায় তাহলেও সুপর্ণাকে মেরেই সে মুক্তি পাবে, কারন সে চায় তাঁর সন্তানের মতন , সুপর্ণারও মৃত্যু।

কাকাবাবু বললেন – কোন কি উপায় নেই?
গুরুদেব বলল- মেয়েটির শরীরে ওই আত্মা পুরো কব্জা করে ফেলেছে, আমি এখানে কিছুই করতে পারবো না , আমাদের আগে মেয়েটির শরীর থেকে ওই আত্মাকে মুক্ত করতে হবে তারপর তোমাদের বাড়ি গিয়ে ওই জন্ম না নেওয়া শিশুর মুক্তি।
তুমি সামনের অমাবস্যায় একে নিয়ে দেওঘরে আসো, ওখানেই যা হবার হবে।
আমি দিপনের দিকে চাইলাম, গুরুদেব আবার বলে উঠলেন, তোমরা এখন একে বাড়ি নিয়ে যাও, কাল সকালে আমার লোক গিয়ে ঠিকানা দিয়ে আসবে।
আমরা সেই ভোর রাতে বাড়ি ফিরে এলাম।

পরদিন দিপনের বাড়ি গিয়ে জানলাম, দিপনের দাদা রাজি নয় কিন্তু দিপনের মা আর বউদির মায়ের পরামর্শ অনুযায়ী বৌদি যাবে , তবে দিপনের দাদা যাবে না, যাবে বউদির মা আর বউদির কাকাবাবু।

এর একমাস পর খবর এলো বৌদি নাকি পুরো ঠিক হয়ে গেছে, সামনের সপ্তাহে বাড়ি আসবে। আমি দীপনকে জিজ্ঞেস করলাম , কি করে ঠিক হোল?
দিপন বলল , জানিনা রে, শুনলাম ওখানে নাকি বড় পূজো হয়, সেখানে বউদিকে নাকি দিন পনেরো উপোষ করে কাটাতে হয়েছিল।
বৌদি ফিরে আসার পর আমি দেখা করতে গেছিলাম, বউদিকে সেই আগের মতই লাগছে, কোন রেশ নেই চোখে মুখে সেই অভিশপ্ত ঘটনার, দেখে আমার ভাল লাগলো, দীপনকে আড়ালে জিজ্ঞেস করলাম- হ্যাঁরে বৌদি কিছু বলল? দিপন আমাকে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলে বলল বাইরে আয়।
বাইরে বেরিয়ে বলল- বউদির কিচ্ছু মনে নেই, তবে শুনেছি পুরো ঘটনাটা নাকি রেকর্ডিং করেছে পরে আমাদের সিডি করে পাঠাবে আর একটা কথা বলেছে বউদির আপাতত বাপের বাড়ি যাওয়া যাবে না আর সামনের পূজোয় গুরুদেব আসবেন আর উনি এসে যতদিন না বউদিদের ওই সিঁড়ির ঘরটা শুদ্ধ করবেন , ততদিন বউদির ওই বাড়ি যাওয়া চলবেনা।

তারপর আরও বছর দুই কেটে গেল, দীপন অন্য কলেজে আর আমি অন্য কলেজে ভর্তি হওয়ায় দুজনের মধ্যে যোগাযোগ অনেকটাই কমে গেছিল। যদিও খবর পেয়েছিলাম যে বৌদি ভালো আছে , বউদির একটা ফুটফুটে ছেলেও হয়েছে আর সেই গুরুদেব এসে নাকি সিঁড়ির ঘরও শুদ্ধ করে দিয়েছে।

আমি আর কোন ভিডিও দেখিনি, আমি এখনো মাঝে মাঝে সেই ঘটনা নিয়ে চিন্তা করি , অনেক প্রশ্ন আসে মনে , যেমন নিচে সিঁড়ির ঘোরে এত ঘটনা ঘটলো অথচ বউদির ঠাকুমারা কিছু বুঝতে পারলেন না কেন? আবার রেখার নাম ৭০৯ কেন হোল, দীপনদের গুরুদেব সেই নিষিদ্ধ পল্লীতে কেন থাকতেন আর সত্যই কি এরকম কোন অতৃপ্ত আত্মা মুক্তির জন্য ঘুরে বেড়ায় আর সব থেকে বড় প্রশ্ন হোল পঁচিশ বছর পর গালুডিতে বউদিকে রেখার আত্মা চিনল কি করে?...আমি এখনো এই সব ঘটনার উত্তর খুজে পাইনি।

---------শেষ---------------------------
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৬৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৪/১০/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • শাহ আজিজ ১৫/১০/২০১৬
    একটা রহস্যময় ঘটনার বর্ণনা হয়েছে কিন্তু গল্প হয়ে ওঠেনি । আরও লিখুন এবং বড় লেখকদের বই পড়ুন ।
    • সুকান্ত ১৬/১০/২০১৬
      ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য। আপনার উপদেশ আমি অবশ্যই মনে রাখবো। আমার পাতায় গিয়ে যদি অন্য লেখাগুলো দেখেন তাহলে আমি বাধিত থাকবো।
  • পরশ ১৫/১০/২০১৬
    গল্প্টা বেশ বড়
  • সোলাইমান ১৫/১০/২০১৬
    Nice
  • ভূতোরে পরিবেশ প্রায়
  • ভূতের গল্প
 
Quantcast