ঘনশ্যাম বউদি
ঘনশ্যাম বউদির সকাল থেকেই মেজাজ টা খাট্টা , তার অতি সাধের নতুন তোলা ঘরের পাশে কিনা বসাক বাবুরা পটি খানা তুলছে। ঘনশ্যাম বাবুকে বলা হলে উনি তার চিরাচরিত গম্ভির গলায় বললেন- ওরা ওদের জায়গায় পটি খানা করবে , না বাইজি ঘর করবে ? সেটা ওদের ব্যপার, আমাদের কথা শুনবে কেন?
বউদি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল – অত শখ করে ঘর তুললাম, পুব দিকে জানলা রাখলাম, আর ওরা কিনা জানলা গার্ড করে …। ওগো কিছু একটা করো। শেষের দিকে বউদির গলাটা প্রায় আর্তনাদের মত শোনাল।
ঘনশ্যাম বাবু শান্ত স্বরে বললেন – পুবের জানালাটা তাহলে বন্ধ রেখো।
তাহলে করলাম কেন? – বউদির গলায় কান্না আর রাগ মেশানো আওয়াজ।
ঘনশ্যাম বাবুর সোজাসাপটা উত্তর- এবার তাহলে মিস্ত্রি ডেকে বুজিয়ে ফেলো। দেখ, এ ব্যাপারে কিছু করা যাবেনা, ওদের জায়গা ওরা করতেই পারে , আমরা বাধা দেবার কে?
বউদি এবার একটু রাগত স্বরে বলল – তোমার দাড়া যদি কিছু হয়। আমি বল্টু কে বলব, ও কিছু একটা করবেই।
বল্টু হল ঘনশ্যাম বাবুর একমাত্র শালা। বয়স ২২-২৩, থিয়েটারে আভিনয় করে।
বল্টুর কথা শুনে ঘনশ্যাম বাবু আরো ঘন স্বরে বলল- দেখ বলে, শালা বলে কথা, তার ওপরে আবার অভিনয় টভিনয় করে, দেখ যদি কিছু করতে পারে।
ঘনশ্যাম বাবু সরকারি চাকুরে, অফিস থেকে লোণ নিয়ে একতলার ওপরে একটা ঘর তুলেছিলেন মাস তিনেক আগে, ঘরটা বসাক বাবুর ছাদের পাশে , যখন ঘরটা তোলা হয় তখন ছাদটা বেশ ফাঁকা ছিল, ঘনশ্যাম বাবু আর বউদি , দুজিনে মিলে বেশ বড় একটা জানালা রেখেছিলেন পুব দিক করে , বসাক বাবুর ছাদ বরাবর, পুবের খোলা আকাশ, ছাদের ওপাশে সারি সারি গাছ, সে এক মনোরম দৃশ্য।
কিন্তু বিধি বাম, মাস খানেক আগে থেকে ঠিক ওই পুব দিকের জানালা বরাবর বসাক বাবুরা ইট সিমেন্টের কাজ শুরু করায়, ঘনশ্যাম গিন্নির সন্দেহ হয়, পরে বসাক গিন্নি কে জিজ্ঞেস করায় আসল কথা টা বেরিয়ে আসে- তাদের নিচের বাথরুম টা নাকি বর্ষা কালে জলে ভেসে যায়, তাই ওরা উপর তলায় আরেকটা বানিয়ে রাখছে। বিপদে পরলে যাতে ব্যবহার করতে পারে।
ঘনশ্যাম বউদি বলল – কিন্তু আপনাদের ওই বাথরুমের পাশে একটা ঠাকুরের মন্দির আছে না। মন্দিরের পাশে বানানো কি উচিৎ?
বসাক গিন্নি মুখটা একটু বেঁকিয়ে বলল- আমরা ভাই বাথরুম থেকে চান করে তবেই ঠাকুর ঘরে ঢুকি। বসাক গিন্নি এর পর আর দাঁড়ান নি, কাজ আছে বলে চলে গেলেন।
ঘনশ্যাম বউদি মনে মনে বলল- আমরা যেন চান না করে পুজো দি। না, এদের বলে লাভ হবে না।
সেই থেকে মন টা খারাপ, অত শখের জানালা, অত সুন্দর গাছের সারি, শীতের সকালে সূর্যের আলো জানালা দিয়ে আসবে আহা, কত স্বপ্ন ছিল, সব কিনা ওই বাথরুমের জন্য আটকে যাবে…ভাবতেই চোখে জল চলে এলো।
বল্টু এলো বিকেলের দিকে, আজ তার অফ ডে। সব শুনে বলল- জামাইবাবু ঠিকই বলেছেন, ওদের জায়গা , সেখানে ওরা পটি খানা করুক বা বাইজি ঘর বানাক সেটা ওদের ব্যপার। আমরা কিছু করতে পারবোনা।
তুই কিছু কর ভাই, আমার স্বপ্নটা এভাবে অকালে মারা যাবে, আর আমি কিছু না করে শুধু দেখে যাবো?
জানালা বন্ধ করে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই রে- বল্টু এক্টু উদাস হয়ে বলল।
এবার ঘনশ্যাম বউদি বেশ দার্শনিকের মতন বলে উঠলো- আমার জীবনে সব স্বপ্ন এভাবেই বন্ধ কেন হয়রে বল্টু? ছোট বেলায় ভেবেছিলুম, ভাল খেলোয়াড় হব, হলোনা, মেয়েদের নাকি খেলাধুলা করলে বিয়ে হয়না। বেশ স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো। পরে ভাবলুম ডাক্তার , প্রফেসর বা নিদেন পক্ষে একটা ইস্কুল টিচার হব, হলাম কিনা ঘনশ্যাম বউদি। ভাই তুই কিছু একটা কর এবার।
বল্টু এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলল-দেখ ওরা যেটা করছে, সেটা হল শৌচাগার, আর এখন এটা বানানোর জন্য সরকার টাকা দেয় , যেটা ওরা নিজেদের গ্যাঁটের টাকা খরচা করে করছে।। ঐযে দেখিস না বিদ্যা বালানের এড। ছার দিদি, এ স্বপ্ন তোর আর সফল হলনা, কি আর করবি বল?
বল্টুর কাছ থেকে কোন সমাধান না পেয়ে আর মুষড়ে পড়লো ঘনশ্যাম বউদি। ঘুম থেকে উঠে খোলা আকাশের স্বপ্ন , স্বপ্ন ই থেকে যাবে?
রাতে ঘনশ্যাম বাবুকে আবার বলল- হ্যাঁগো , কিছুই কি করা যাবে না, তুমি একবার বসাকদাকে বলনা, ওদের তো একটা শৌচাগার আছে?
ঘনশ্যাম বাবু অফিস থেকে এসে খবর দেখছিলেন, কিন্তু যখন দেখলেন বউ তার পাশে এসেছে, তখন টিভির সাউন্ড অফ করে খবর দেখছিলেন। শৌচাগার কথাটা শুনে এবার বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন- হটাত এত সাধু ভাষায় কথা বলছ- শৌচাগার ? এ জিনিস টা বাধা দেওয়া কিন্তু এখন আইনত আপরাধ। সরকার, সমাজ সবাই এখন এর পক্ষে । তুমি ,আমি বা বল্টু কিছুই করতে পারবো না, বরঞ্ছ তুমি একটা কাজ করতে পারো, ওই পুবের জানালাটা তুমি একটা বেশ ভাল ছবি দিয়ে আটকে দাও। ছবিতে একটা সমুদ্রের ওপর দিয়ে সূর্য ওঠার ফ্রেম দাও, দেখবে কিছুটা হলেও তোমার কষ্ট কমবে।
ঘনশ্যাম বউদির আর ভালো লাগলো না, টিভির ঘর থেকে উঠতে উঠতে বলল- ওদের তো একটা শৌচাগার আছে, আমিতো আর শৌচাগারের বিরুধ্বে নই।
রাতে ঘনশ্যাম বউদি স্বপ্ন দেখল- বসাক বাবুরা শৌচাগার আর করছে না, বসাক গিন্নি , ঘনশ্যাম বউদিকে বলল- তোমার এই স্বপ্ন সফল করতে আমি তোমার দাদাকে বলে ওটা ভেঙ্গে ফেলছি, এখন তুমি ঘুম থেকে উঠলেই পুবের খোলা আকাশ, গাছ, পালা সব দেখবে, আর বুক ভোরে নিঃশ্বাস নেবে, তারপর যখন তোমার ঘরে নতুন আতিথি আসবে, তুমি তাকে নিয়ে পুবের রোদ্রে বসে তেল মাখাবে, ও আকাশ তোমার, ওদিক টা আমি আর কিছু হতেই দেবনা।
ঘনশ্যাম বউদির এবার ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো, বিছানায় উঠে বসলো, ঘনশ্যাম বাবু এখন গভীর ঘুমে , একটুখানি খোলা পুবের আকাশ , আর সেটা কিনা ওরা কেঁড়ে নেবে?
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে, ভোরের দিকে ঘনশ্যাম বউদি ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘুমটা ভাঙল বেশ বেলায়, আজ রবিবার, কিন্তু সে সকালে সাধারনত ভোর ছটা বাজার আগেই উঠে যায়, কিন্তু আজ নটা বেজে গেলো, ঘুম থেকে উঠে সকালের টুকটাক কাজ সারতে সারতে আবিষ্কার করলো , কর্তা তার বাড়ি নেই। কিন্তু কর্তা গেলো কোথায়? বাজার তো কাল রাতেই করে এনেছে।
ভাবতে ভাবতে বল্টুর ফোন এলো- দিদি, জামাই বাবু আমার সাথে আছে, আজ দুপুরে আমার একটা শো আছে , স্পেশাল , দেখে বিকেলে যাবে।
ঠিক আছে বলে ঘনশ্যাম বউদি ফোন টা রেখে দিল। নতুন ঘরটায় গেলো , ঘরটায় দুটো জানালা, একটা দক্ষিণে আর একটা পুবে, প্রথমে ঠিক করেছিল, দুটোই বড় জানালা করবে , কিন্তু দক্ষিণের দিক টা অতটা ওপেন ছিলনা, তাই ওটা ছোট করে পুবের টা বড় করে দিল। ঘনশ্যাম বউদি পুবের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো- এখনো সবটা গাত্নি হয়নি, এখনো নীল আকাশ দেখা যায়, দেখা যায় গাছ পালা...বাতাস।দেখতে দেখতে চোখ দিয়ে আবার জল চলে এলো, আর কয়েকদিন পর সব আড়াল হয়ে যাবে। মনে পরে গেলো কাল রাতের স্বপ্নের কথা, নতুন অতিথির কথা- না তার আর কোন স্বপ্ন পুরন হবার নয়। পোড়া কপাল তার।
দুপুরের রান্না বান্না সেরে ঘনশ্যাম বউদি টিভি চালিয়ে বসে ছিলেন, এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ, বউদি উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই অবাক- বসাক বউদি এসেছে, ঘনশ্যাম বউদির মনে পড়ে গেলো কাল রাতের স্বপ্ন , সত্যি হবে নাকি...?
ঘনশ্যাম বউদি বেশ হাসিমুখে বলল- আসুন, আসুন বউদি আসুন। বসাক বউদি তার থেকে বেশ বড়, উনার এক ছেলে , এক মেয়ে। ছেলে চাকরি করে ব্যঙ্গালরে আর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, বেশ ঝারা হাত পা বউদির।
না ভাই, আমার আজ একটু তাড়া আছে, শোন, তুমি তো জানো, তোমার বসাকদা একটু নাম কীর্তন ভালবাসেন, তা আজ বিকালে আমার বাড়িতে একটু নাম কীর্তন আছে , তুমি ভাই কর্তা কে নিয়ে যেও। একা থাক ছেলে পুলে নেই, গেলে পরে মনটা ভাল লাগবে।
ঘনশ্যাম বউদির মুখটা ফ্যকাশে হয়ে গেল, তার বিয়ের তিন বছর হয়ে গেছে , কোন ছেলে পুলে এখন হয়নি, ফ্যকাশে মুখে বলল – ঠিক আছে। কিন্তু কর্তা মনে হয় যেতে পারবে না, আসলে উনি একটু আমার ভায়ের সাথে বেড়িয়েছেন।
বসাক বউদি এবার একটু ফিসফিস করে বললেন- স্বামিকে কিন্তু বেশী কাছ ছাড়া করবে না, ছেলে পুলে না হলে স্বামির মন কিন্তু বাড়ির বাইরে চলে যায়।
বসাক বউদি চলে গেলো। ঘনশ্যাম বউদির মনটা খারাপ হয়ে গেলো, সত্যি তাঁর কোন স্বপ্ন পূরণ হবার নয়।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘনশ্যাম বউদি একটা ভাত ঘুম দিল, আর ঘুমটা ভাঙ্গলো বসাক বাবুর বাড়ির কীর্তনের আওয়াজে। ধরপর করে উঠে বসলো। বেশ জোরে জোরে খোল করতাল বাজছে , একবার মনে হল যাবে , আবার ভাবল না , গেলে আবার সবাই একটু বাঁকা চোখে দেখবে, ছেলে পুলে না হলে যে সমাজের কি ক্ষতি হয় কে জানে?
হটাত মনে হল ঘনশ্যাম বাবুর কথা, বসাক বউদির কথা কি সত্যি ? মানুষটার কি বাইরের দিকে মন চলে গেছে, মনটা ভার হয়ে গেল, ভারি রাগ হল মানুষটার অপর , না ফোন করবে না , যখন আসার আসুক।
মনটা আরো খারাপ হওয়াতে , ঘনশ্যাম বউদি ভাবলো না একবার ঘুরেই আসি , বসে থেকে শুধু ভুল ভাল চিন্তা, এরথেকে ঠাকুরে নাম কীর্তন শোনা ভালো।
কীর্তন টা হছে ছাদে , সেই ছাদ যেখানে শৌচাগার করছে বসাক বাবুরা, বেশ তিপ্পল টাঙ্গিয়ে কীর্তনের আসর বসেছে, আসলে বসাক বাবু এককালে ঢোল বাজাতেন , এখন আর বাজান না তবে মাঝে মাঝে কীর্তন দেন ছাদে।
তিনজন কীর্তনিয়া, মাঝের জন বোধ হয় সবার গুরু বা এদের মাথা,বেশ বড় বড় দাঁড়ি, বেশ ঠাকুরের কথ কথা বলছেন আর ঢোল বাজাচ্ছেন, একজন গান গাইছেন, বেশ গলা, বসাক বাবুও ঢোল বাজাচ্ছেন।
ঘনশ্যাম বউদি চোখ বুজে , একমনে কীর্তনের গান শুনছিলেন, কিন্তু মনটা তার সেই পুবের জানালা, সেখান থকে বসাক বাবুর শৌচাগার থেকে তার ছেলে পুলে...।না ঠাকুরের প্রতি মন আজ তার নেই, মনটা বড় ভারী তার।
হটাত ঠাকুর দেবতার কথ কথার মাঝে , একটু অন্যরকম কথা তাঁর কানে এলো, আস্তে করে চোখটা খুললেন - সেই গুরু দেবের কথা মনে হল, গলার স্বর টা একটু চেনা লাগছে-
ছাদটা বড় অপবিত্র লাগছে বসাক বাবু,
বসাক বাবু ঢোল থামিয়ে বললেন কেন, কেন গুরুদেব?
-আমি বেশ বুঝতে পারছি , এতক্ষণ ধরে কীর্তন করলাম কিন্তু আমাদের কারো মনে শান্তি এলনা, এত দেবতার স্বরন করলাম, কিন্তু কেউ তোর ছাদের ত্রি সীমানায় এলো না। তোর ছাদ অপবিত্র হয়ে গেছে রে।।অপবিত্র।
বসাক বাবুর বউ মেয়েদের সাড়িতে ছিলেন , এগিয়ে এসে বললেন , কিন্তু গুরুদেব আমরা তো বেশ মন প্রান দিয়ে পুজ করে আসছি, কোন অভক্তি নেই।
উঁহু , কিছু একটা এখানে আছে বা হচ্ছে, যার জন্য তোর এই কীর্তন সম্পূর্ণ হলনা, ঘোর পাপ, ঘোর পাপ।
বসাক বাবু এবার একটু গুরুদেবের কাছে ঘেঁষে এসে বললেন, বাবা আমি এখানে একটা শৌচাগার বানাচ্ছি, ওই কোনার দিক করে, তাতে কি কিছু হতে পারে?
গুরুদেব এবার বেশ উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন- ঘোর পাপ , ঘোর পাপ, ওরে, তুই যেখানে দেবতার পুজা করিস, তাঁর পাশে তুই শৌচাগার বানাচ্ছিস? ওরে ভগবান কে ভয় কর? তোর তো অমঙ্গল নিশ্চিত।
বসাক গিন্নি এবার হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন- বাবা কি হবে এবার?
গুরু দেব এবার বেশ গম্ভির স্বরে বললেন- ভেঙ্গে ফেল, ভেঙ্গে ফেল, তার পর আবার কীর্তন পালা দিয়ে জায়গাটা পবিত্র কর...
ঘনশ্যাম বউদি শেষ কথা টা তে এবার পরিষ্কার বুঝলেন – এটা তাঁর কর্তা না হয়ে পারে না, এ গলা তার বহুদিনের চেনা। কিন্তু এ গুরু দেবের বেশভূষায় তিনি প্রথমে ধরতে পারেননি, এমন কি পাশে যে বল্টু , নামাবলি গায়ে বসে, এতক্ষণে সে তার আপন ভাই কে চিনতে পারল।
না তার জন্য তার বর যখন এত দূর যেতে পারে, তাতে তার ভালবাসায় সন্দেহ করা মানে –ঘোর পাপ।
বউদি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল – অত শখ করে ঘর তুললাম, পুব দিকে জানলা রাখলাম, আর ওরা কিনা জানলা গার্ড করে …। ওগো কিছু একটা করো। শেষের দিকে বউদির গলাটা প্রায় আর্তনাদের মত শোনাল।
ঘনশ্যাম বাবু শান্ত স্বরে বললেন – পুবের জানালাটা তাহলে বন্ধ রেখো।
তাহলে করলাম কেন? – বউদির গলায় কান্না আর রাগ মেশানো আওয়াজ।
ঘনশ্যাম বাবুর সোজাসাপটা উত্তর- এবার তাহলে মিস্ত্রি ডেকে বুজিয়ে ফেলো। দেখ, এ ব্যাপারে কিছু করা যাবেনা, ওদের জায়গা ওরা করতেই পারে , আমরা বাধা দেবার কে?
বউদি এবার একটু রাগত স্বরে বলল – তোমার দাড়া যদি কিছু হয়। আমি বল্টু কে বলব, ও কিছু একটা করবেই।
বল্টু হল ঘনশ্যাম বাবুর একমাত্র শালা। বয়স ২২-২৩, থিয়েটারে আভিনয় করে।
বল্টুর কথা শুনে ঘনশ্যাম বাবু আরো ঘন স্বরে বলল- দেখ বলে, শালা বলে কথা, তার ওপরে আবার অভিনয় টভিনয় করে, দেখ যদি কিছু করতে পারে।
ঘনশ্যাম বাবু সরকারি চাকুরে, অফিস থেকে লোণ নিয়ে একতলার ওপরে একটা ঘর তুলেছিলেন মাস তিনেক আগে, ঘরটা বসাক বাবুর ছাদের পাশে , যখন ঘরটা তোলা হয় তখন ছাদটা বেশ ফাঁকা ছিল, ঘনশ্যাম বাবু আর বউদি , দুজিনে মিলে বেশ বড় একটা জানালা রেখেছিলেন পুব দিক করে , বসাক বাবুর ছাদ বরাবর, পুবের খোলা আকাশ, ছাদের ওপাশে সারি সারি গাছ, সে এক মনোরম দৃশ্য।
কিন্তু বিধি বাম, মাস খানেক আগে থেকে ঠিক ওই পুব দিকের জানালা বরাবর বসাক বাবুরা ইট সিমেন্টের কাজ শুরু করায়, ঘনশ্যাম গিন্নির সন্দেহ হয়, পরে বসাক গিন্নি কে জিজ্ঞেস করায় আসল কথা টা বেরিয়ে আসে- তাদের নিচের বাথরুম টা নাকি বর্ষা কালে জলে ভেসে যায়, তাই ওরা উপর তলায় আরেকটা বানিয়ে রাখছে। বিপদে পরলে যাতে ব্যবহার করতে পারে।
ঘনশ্যাম বউদি বলল – কিন্তু আপনাদের ওই বাথরুমের পাশে একটা ঠাকুরের মন্দির আছে না। মন্দিরের পাশে বানানো কি উচিৎ?
বসাক গিন্নি মুখটা একটু বেঁকিয়ে বলল- আমরা ভাই বাথরুম থেকে চান করে তবেই ঠাকুর ঘরে ঢুকি। বসাক গিন্নি এর পর আর দাঁড়ান নি, কাজ আছে বলে চলে গেলেন।
ঘনশ্যাম বউদি মনে মনে বলল- আমরা যেন চান না করে পুজো দি। না, এদের বলে লাভ হবে না।
সেই থেকে মন টা খারাপ, অত শখের জানালা, অত সুন্দর গাছের সারি, শীতের সকালে সূর্যের আলো জানালা দিয়ে আসবে আহা, কত স্বপ্ন ছিল, সব কিনা ওই বাথরুমের জন্য আটকে যাবে…ভাবতেই চোখে জল চলে এলো।
বল্টু এলো বিকেলের দিকে, আজ তার অফ ডে। সব শুনে বলল- জামাইবাবু ঠিকই বলেছেন, ওদের জায়গা , সেখানে ওরা পটি খানা করুক বা বাইজি ঘর বানাক সেটা ওদের ব্যপার। আমরা কিছু করতে পারবোনা।
তুই কিছু কর ভাই, আমার স্বপ্নটা এভাবে অকালে মারা যাবে, আর আমি কিছু না করে শুধু দেখে যাবো?
জানালা বন্ধ করে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই রে- বল্টু এক্টু উদাস হয়ে বলল।
এবার ঘনশ্যাম বউদি বেশ দার্শনিকের মতন বলে উঠলো- আমার জীবনে সব স্বপ্ন এভাবেই বন্ধ কেন হয়রে বল্টু? ছোট বেলায় ভেবেছিলুম, ভাল খেলোয়াড় হব, হলোনা, মেয়েদের নাকি খেলাধুলা করলে বিয়ে হয়না। বেশ স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো। পরে ভাবলুম ডাক্তার , প্রফেসর বা নিদেন পক্ষে একটা ইস্কুল টিচার হব, হলাম কিনা ঘনশ্যাম বউদি। ভাই তুই কিছু একটা কর এবার।
বল্টু এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলল-দেখ ওরা যেটা করছে, সেটা হল শৌচাগার, আর এখন এটা বানানোর জন্য সরকার টাকা দেয় , যেটা ওরা নিজেদের গ্যাঁটের টাকা খরচা করে করছে।। ঐযে দেখিস না বিদ্যা বালানের এড। ছার দিদি, এ স্বপ্ন তোর আর সফল হলনা, কি আর করবি বল?
বল্টুর কাছ থেকে কোন সমাধান না পেয়ে আর মুষড়ে পড়লো ঘনশ্যাম বউদি। ঘুম থেকে উঠে খোলা আকাশের স্বপ্ন , স্বপ্ন ই থেকে যাবে?
রাতে ঘনশ্যাম বাবুকে আবার বলল- হ্যাঁগো , কিছুই কি করা যাবে না, তুমি একবার বসাকদাকে বলনা, ওদের তো একটা শৌচাগার আছে?
ঘনশ্যাম বাবু অফিস থেকে এসে খবর দেখছিলেন, কিন্তু যখন দেখলেন বউ তার পাশে এসেছে, তখন টিভির সাউন্ড অফ করে খবর দেখছিলেন। শৌচাগার কথাটা শুনে এবার বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন- হটাত এত সাধু ভাষায় কথা বলছ- শৌচাগার ? এ জিনিস টা বাধা দেওয়া কিন্তু এখন আইনত আপরাধ। সরকার, সমাজ সবাই এখন এর পক্ষে । তুমি ,আমি বা বল্টু কিছুই করতে পারবো না, বরঞ্ছ তুমি একটা কাজ করতে পারো, ওই পুবের জানালাটা তুমি একটা বেশ ভাল ছবি দিয়ে আটকে দাও। ছবিতে একটা সমুদ্রের ওপর দিয়ে সূর্য ওঠার ফ্রেম দাও, দেখবে কিছুটা হলেও তোমার কষ্ট কমবে।
ঘনশ্যাম বউদির আর ভালো লাগলো না, টিভির ঘর থেকে উঠতে উঠতে বলল- ওদের তো একটা শৌচাগার আছে, আমিতো আর শৌচাগারের বিরুধ্বে নই।
রাতে ঘনশ্যাম বউদি স্বপ্ন দেখল- বসাক বাবুরা শৌচাগার আর করছে না, বসাক গিন্নি , ঘনশ্যাম বউদিকে বলল- তোমার এই স্বপ্ন সফল করতে আমি তোমার দাদাকে বলে ওটা ভেঙ্গে ফেলছি, এখন তুমি ঘুম থেকে উঠলেই পুবের খোলা আকাশ, গাছ, পালা সব দেখবে, আর বুক ভোরে নিঃশ্বাস নেবে, তারপর যখন তোমার ঘরে নতুন আতিথি আসবে, তুমি তাকে নিয়ে পুবের রোদ্রে বসে তেল মাখাবে, ও আকাশ তোমার, ওদিক টা আমি আর কিছু হতেই দেবনা।
ঘনশ্যাম বউদির এবার ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো, বিছানায় উঠে বসলো, ঘনশ্যাম বাবু এখন গভীর ঘুমে , একটুখানি খোলা পুবের আকাশ , আর সেটা কিনা ওরা কেঁড়ে নেবে?
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে, ভোরের দিকে ঘনশ্যাম বউদি ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘুমটা ভাঙল বেশ বেলায়, আজ রবিবার, কিন্তু সে সকালে সাধারনত ভোর ছটা বাজার আগেই উঠে যায়, কিন্তু আজ নটা বেজে গেলো, ঘুম থেকে উঠে সকালের টুকটাক কাজ সারতে সারতে আবিষ্কার করলো , কর্তা তার বাড়ি নেই। কিন্তু কর্তা গেলো কোথায়? বাজার তো কাল রাতেই করে এনেছে।
ভাবতে ভাবতে বল্টুর ফোন এলো- দিদি, জামাই বাবু আমার সাথে আছে, আজ দুপুরে আমার একটা শো আছে , স্পেশাল , দেখে বিকেলে যাবে।
ঠিক আছে বলে ঘনশ্যাম বউদি ফোন টা রেখে দিল। নতুন ঘরটায় গেলো , ঘরটায় দুটো জানালা, একটা দক্ষিণে আর একটা পুবে, প্রথমে ঠিক করেছিল, দুটোই বড় জানালা করবে , কিন্তু দক্ষিণের দিক টা অতটা ওপেন ছিলনা, তাই ওটা ছোট করে পুবের টা বড় করে দিল। ঘনশ্যাম বউদি পুবের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো- এখনো সবটা গাত্নি হয়নি, এখনো নীল আকাশ দেখা যায়, দেখা যায় গাছ পালা...বাতাস।দেখতে দেখতে চোখ দিয়ে আবার জল চলে এলো, আর কয়েকদিন পর সব আড়াল হয়ে যাবে। মনে পরে গেলো কাল রাতের স্বপ্নের কথা, নতুন অতিথির কথা- না তার আর কোন স্বপ্ন পুরন হবার নয়। পোড়া কপাল তার।
দুপুরের রান্না বান্না সেরে ঘনশ্যাম বউদি টিভি চালিয়ে বসে ছিলেন, এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ, বউদি উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই অবাক- বসাক বউদি এসেছে, ঘনশ্যাম বউদির মনে পড়ে গেলো কাল রাতের স্বপ্ন , সত্যি হবে নাকি...?
ঘনশ্যাম বউদি বেশ হাসিমুখে বলল- আসুন, আসুন বউদি আসুন। বসাক বউদি তার থেকে বেশ বড়, উনার এক ছেলে , এক মেয়ে। ছেলে চাকরি করে ব্যঙ্গালরে আর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, বেশ ঝারা হাত পা বউদির।
না ভাই, আমার আজ একটু তাড়া আছে, শোন, তুমি তো জানো, তোমার বসাকদা একটু নাম কীর্তন ভালবাসেন, তা আজ বিকালে আমার বাড়িতে একটু নাম কীর্তন আছে , তুমি ভাই কর্তা কে নিয়ে যেও। একা থাক ছেলে পুলে নেই, গেলে পরে মনটা ভাল লাগবে।
ঘনশ্যাম বউদির মুখটা ফ্যকাশে হয়ে গেল, তার বিয়ের তিন বছর হয়ে গেছে , কোন ছেলে পুলে এখন হয়নি, ফ্যকাশে মুখে বলল – ঠিক আছে। কিন্তু কর্তা মনে হয় যেতে পারবে না, আসলে উনি একটু আমার ভায়ের সাথে বেড়িয়েছেন।
বসাক বউদি এবার একটু ফিসফিস করে বললেন- স্বামিকে কিন্তু বেশী কাছ ছাড়া করবে না, ছেলে পুলে না হলে স্বামির মন কিন্তু বাড়ির বাইরে চলে যায়।
বসাক বউদি চলে গেলো। ঘনশ্যাম বউদির মনটা খারাপ হয়ে গেলো, সত্যি তাঁর কোন স্বপ্ন পূরণ হবার নয়।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘনশ্যাম বউদি একটা ভাত ঘুম দিল, আর ঘুমটা ভাঙ্গলো বসাক বাবুর বাড়ির কীর্তনের আওয়াজে। ধরপর করে উঠে বসলো। বেশ জোরে জোরে খোল করতাল বাজছে , একবার মনে হল যাবে , আবার ভাবল না , গেলে আবার সবাই একটু বাঁকা চোখে দেখবে, ছেলে পুলে না হলে যে সমাজের কি ক্ষতি হয় কে জানে?
হটাত মনে হল ঘনশ্যাম বাবুর কথা, বসাক বউদির কথা কি সত্যি ? মানুষটার কি বাইরের দিকে মন চলে গেছে, মনটা ভার হয়ে গেল, ভারি রাগ হল মানুষটার অপর , না ফোন করবে না , যখন আসার আসুক।
মনটা আরো খারাপ হওয়াতে , ঘনশ্যাম বউদি ভাবলো না একবার ঘুরেই আসি , বসে থেকে শুধু ভুল ভাল চিন্তা, এরথেকে ঠাকুরে নাম কীর্তন শোনা ভালো।
কীর্তন টা হছে ছাদে , সেই ছাদ যেখানে শৌচাগার করছে বসাক বাবুরা, বেশ তিপ্পল টাঙ্গিয়ে কীর্তনের আসর বসেছে, আসলে বসাক বাবু এককালে ঢোল বাজাতেন , এখন আর বাজান না তবে মাঝে মাঝে কীর্তন দেন ছাদে।
তিনজন কীর্তনিয়া, মাঝের জন বোধ হয় সবার গুরু বা এদের মাথা,বেশ বড় বড় দাঁড়ি, বেশ ঠাকুরের কথ কথা বলছেন আর ঢোল বাজাচ্ছেন, একজন গান গাইছেন, বেশ গলা, বসাক বাবুও ঢোল বাজাচ্ছেন।
ঘনশ্যাম বউদি চোখ বুজে , একমনে কীর্তনের গান শুনছিলেন, কিন্তু মনটা তার সেই পুবের জানালা, সেখান থকে বসাক বাবুর শৌচাগার থেকে তার ছেলে পুলে...।না ঠাকুরের প্রতি মন আজ তার নেই, মনটা বড় ভারী তার।
হটাত ঠাকুর দেবতার কথ কথার মাঝে , একটু অন্যরকম কথা তাঁর কানে এলো, আস্তে করে চোখটা খুললেন - সেই গুরু দেবের কথা মনে হল, গলার স্বর টা একটু চেনা লাগছে-
ছাদটা বড় অপবিত্র লাগছে বসাক বাবু,
বসাক বাবু ঢোল থামিয়ে বললেন কেন, কেন গুরুদেব?
-আমি বেশ বুঝতে পারছি , এতক্ষণ ধরে কীর্তন করলাম কিন্তু আমাদের কারো মনে শান্তি এলনা, এত দেবতার স্বরন করলাম, কিন্তু কেউ তোর ছাদের ত্রি সীমানায় এলো না। তোর ছাদ অপবিত্র হয়ে গেছে রে।।অপবিত্র।
বসাক বাবুর বউ মেয়েদের সাড়িতে ছিলেন , এগিয়ে এসে বললেন , কিন্তু গুরুদেব আমরা তো বেশ মন প্রান দিয়ে পুজ করে আসছি, কোন অভক্তি নেই।
উঁহু , কিছু একটা এখানে আছে বা হচ্ছে, যার জন্য তোর এই কীর্তন সম্পূর্ণ হলনা, ঘোর পাপ, ঘোর পাপ।
বসাক বাবু এবার একটু গুরুদেবের কাছে ঘেঁষে এসে বললেন, বাবা আমি এখানে একটা শৌচাগার বানাচ্ছি, ওই কোনার দিক করে, তাতে কি কিছু হতে পারে?
গুরুদেব এবার বেশ উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন- ঘোর পাপ , ঘোর পাপ, ওরে, তুই যেখানে দেবতার পুজা করিস, তাঁর পাশে তুই শৌচাগার বানাচ্ছিস? ওরে ভগবান কে ভয় কর? তোর তো অমঙ্গল নিশ্চিত।
বসাক গিন্নি এবার হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন- বাবা কি হবে এবার?
গুরু দেব এবার বেশ গম্ভির স্বরে বললেন- ভেঙ্গে ফেল, ভেঙ্গে ফেল, তার পর আবার কীর্তন পালা দিয়ে জায়গাটা পবিত্র কর...
ঘনশ্যাম বউদি শেষ কথা টা তে এবার পরিষ্কার বুঝলেন – এটা তাঁর কর্তা না হয়ে পারে না, এ গলা তার বহুদিনের চেনা। কিন্তু এ গুরু দেবের বেশভূষায় তিনি প্রথমে ধরতে পারেননি, এমন কি পাশে যে বল্টু , নামাবলি গায়ে বসে, এতক্ষণে সে তার আপন ভাই কে চিনতে পারল।
না তার জন্য তার বর যখন এত দূর যেতে পারে, তাতে তার ভালবাসায় সন্দেহ করা মানে –ঘোর পাপ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শেলি ০২/০৫/২০১৭মজা পেলাম
-
ঐশিকা (প্রজীতা) বসু ২৬/০৯/২০১৬একটা মূল্যবোধ থেকে লেখা গল্প। ভাল লাগল পড়ে।
-
ফয়জুল মহী ২৫/০৯/২০১৬সুন্দর লেখায় আনুগত্যসূচক অভিবাদন আপনাকে
-
পরশ ২৫/০৯/২০১৬সুন্দর
-
সোলাইমান ২৪/০৯/২০১৬nice
-
পরশ ২৩/০৯/২০১৬সুন্দর হয়েছে
-
দেবব্রত সান্যাল ২০/০৯/২০১৬বসাক বাবুরা তাদের গুরুদেবকে চেনেন না ? লেখায় অনেক ভাষা আর বানানের ভুল আছে। শুধরে নিন।