মাঁয়া পাখি
জাকিয়া, এইতো সেদিন তুমি চলে গেলে! অথচ কি আশ্চর্য এ খবরটিতেও আমার চোঁখে একফোটা জল আসেনি! তুমি ভাবতে পারো, কতটা নির্লিপ্ততায় ডুবে গেছে এ মন!
এ ছোট্ট প্রয়াস তুমি এবং তোমার মেজ বৌমার প্রতি উৎসর্গ করলাম।
.......................................................................
মাঁয়া পাখি
সেপ্টেম্বরের শেষ। সবেমাত্র নতুন চাকরীতে জয়েন্ট করেছি। বেতন বেশ ভালো। এখানকার শহুরে পরিবেশে একা খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মনে আরেকটি বিষয় কাজ করছিল ক'দিন ধরে। ভাবছি পাশাপাশি কিছু করতে হবে, এমনকিছু যা সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা কিছুটা লাঘব করবে।
একদিন অফিস শেষে গেলাম ডেভিড স্কুলে। সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। এখনও ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে উঠেনি। বিজ্ঞাপনের ঠিকানা অনুযায়ী মেইন রোড থেকে পাশের গলি ধরে একটু ভিতরে দু'মিনিট হাটলেই স্কুলটি। বেশ সুনাম হয়েছে। আবার নিন্দুকেরা বলে, ছাত্র-ছাত্রীরা নাকি শুধু ইংরেজি-ই শিখেছে, বাংলা পড়তেও পারেনা লিখতেও পারেনা!
বড় গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বেশ ভাল লাগল। ইটপাতা রাস্তা, দু'পাশে নানা জাতের ফুলগাছ। সাজানো গোছানো, ছিমছাম। একপাশে মাঝারি সাইজের একটি ফলবাগান। একটু হাটতেই দক্ষিণ পাশে মূল স্কুল ভবনটির সাথে শিক্ষকদের জন্য আলাদা অফিস বিল্ডিং।
সামনে এগুতেই একজন মাঝবয়সী মহিলাকে দেখলাম, চোঁখে চশমা, হাতে লম্বা ট্যালি খাতা। ওনার পোষাকটা কিছুটা মিশনারি চার্চের নান্-দের মতো।
আমাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন:
Hello son, can I help you?
- Of course, Mam. I'm here for the circular published in newspaper yesterday. You need a part-time teacher for teaching Bengali in school?
Yes. Please come with me. By the way, I'm Margareta Mathews, Principal of the school.
-Hello mam. I'm Nilu.
আধ্ঘন্টাখানেক আলোচনা করার পর সবকিছু পাকা হয়ে গেল। আপাতত Guest Teacher হিসেবে সান্ধ্যকালীন শিফট-এ ক্লাস, দু'টি করে ক্লাস নিতে হবে।
স্কুল থেকে বের হয়ে বেশ খুশি খুশি লাগছে। আনমনে শিস বাজাতে বাজাতে মেইন রোডের দিকে হাটছিলাম। ইতোমধ্যে বড়রাস্তার হ্যালোজেন লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। আজ রাস্তায় যানবাহনের ভিড় নেই। হুশহাস করে পাশে দিয়ে চলে যাচ্ছে বাসগুলো। ফুটপাথ দিয়ে হাটার সময় ভাবছিলাম মহল্লার ক্লাবে একবার যাব কি না! ক্লাবঘরের পাঠাগারে বসা যেত, চাই কি পার্টি পেলে দু'এক গেম ক্যরম ও খেলা যেত!
হঠাৎ পাশের অন্ধকার গলি থেকে কিশোর বয়েসি দু'জন ছেলে বেরিয়ে এলো, হাতে ছোরা!
বয়স বড়জোর ১৩/১৪! লিকলিকে শরীর! ওদের একজন ধমকে উঠে বলল : "যা আছে সব দিয়ে দাও!"
ফুটপাথ প্রায় জনশুন্য! অগত্যা মুঠো পাকিয়ে একজনের গালে লাগিয়ে দিলাম, ঠাস্.. ঠাস্...! মুহূর্তেই পড়ে গেল সে ফুটপাথের উপর, হাত থেকে ছিটকে পড়ল ছোরা, পাশের ড্রেনে! এসব দেখে অপরজন উল্টো ঘুরেই দিল ছুট! যেন দৌড়ে সে অলিম্পিক স্বর্ণ জয় করবে!
ধরে নিয়ে গেলাম ক্লাবে। জেরা করলাম। ড্রাগ এডিক্টেড। যখন জানলাম সে ক্লাস এইট-এ পড়ে, বেশ অবাক হলাম। আজই প্রথম সে রাস্তায় নেমেছে বাড়তি ড্রাগের নেশার টাকা যোগাতে। বাসার নম্বর নিয়ে ফোন করলাম, ফ্যমিলি মেম্বার কেউ এসে ওকে নিয়ে যেতে বললাম।
একটু আগের আনন্দটুকু কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। সন্ধ্যার আবছায়া আলো-আঁধারিতে হঠাৎই চোঁখে জল চলে এলো।
ভাবলাম, আর নয়, এবার ঘরে ফিরব।
শহরে থাকা হয় একটি মেসবাড়িতে। মাঝে মাঝে যাই আমার জঙ্গলমহলে। কিছু সময় একা থাকব বলে। বিজনে নিজের সঙ্গে একা। বেশ ভাল লাগে।
শহরের বাহিরে বাসস্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাসে এক ঘন্টার পথ, এরপর ছোট্ট পাহাড়ি বাজারটিকে বায়ে রেখে ফুট ওভারব্রিজ পেরিয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এর এরিয়ার ভেতর দিয়ে পাকদণ্ডি পথ বেয়ে কয়েক মিনিট হাটলেই টিলার মাথায় আমার ছোট্ট ডেরা, আমার জঙ্গলমহল।
ফুট ওভারব্রিজটির কাছে আসতেই ওটাকে কেমন অপরিচিত মনে হল! আজ যেন অনেক বেশি উঁচু! ঠোট উল্টিয়ে, কাঁধ ঝাকি দিয়ে বললাম: "বোধহয় ঠিকই আছে!"
উপরে উঠতে লাগলাম, অনেকটা মই এর মত!অনেক খাঁড়া, ধাপগুলো সরু ও ছোট। নিচে তাকালেই গা ছমছম করছিল, নিয়নের আবছায়া আলোয় বাস- ট্রাকের হেডলাইট অশরিরী দানবের জলন্ত চোখের মতো জ্বলজ্বল করছিল। দেখলাম নিচের দিক থেকে একটি মেয়েও উপরে উঠছে। সে ও ওপারে যাবে। মনে মনে বললাম: " এই... যাহ! prestigious issue! এখন ভয় পেলে তো চলে না!"
ইতোমধ্যেই, মেয়েটি পাশে এসে দাড়িয়েছে। তার দিকে চাইতেই সে হালকা করে হাসল। শুধু চোঁখ দুটিতে হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। প্রত্যুত্তরে আমিও হালকা নড করলাম।
ওভারব্রিজটি পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম ফরেস্ট এরিয়ায়।
লাল এঁটেল মাটির সোঁদা গন্ধ, কিছুটা ভেজা, হয়ত একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। শাল, সেগুন, জঙ্গলি ঝোপঝাড়ে বন্যফুলের সুবাস, দূর্বাঘাস। বুকভরে শ্বাস টেনে নিলাম। আহ্! এ যে আমার চিরচেনা....
এদিক ওদিক চাইতেই আরও দু'একজনকে দেখতে পেলাম। কয়েকটি যুগলবন্দীও রয়েছে- হাত ধরে পাশাপাশি হাটছে।
মেয়েটিকে দেখলাম একটি ছেলের সাথে পাশাপাশি হাটছে আর গল্প করছে।
আমি আমার পথ ধরলাম।
উচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা। এখানে ওখানে ছোপ ছোপ কাঁদা। ঘাসগুলোর মাথায় শিশিরের মতো ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি জমে আছে। বেশ অনেকদূর পরপর একটি করে ল্যাম্পপোষ্ট। হলদেটে আলো খুব একটা অন্ধকার তাড়াতে পাড়েনি।
আলো -আঁধারির এ মোহময় পরিবেশ ভালোই লাগছিল। আনমনে হাটছিলাম। কখনো একা একাই হাসছি, আবার কখনো গম্ভির হয়ে উঠছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কেউ একজন পাশে থাকলে জীবনটা নেহাত মন্দ হতো না! আবার পরক্ষনেই মনে হচ্ছে- নাহ্! এইতো বেশ আছি! ভাবনাহীন, নিশ্চিন্ত জীবন, মুক্ত বিহঙ্গের আকাশ ছোয়া স্বাধীনতা! আহ্......!
রাস্তার বাঁক ঘুরতেই সামনের ল্যাম্পপোষ্টটির নিচে সেই মেয়েটিকে দেখলাম, আবার! পাশে বসা পূর্বের ঐ যুবকটি। কিছুটা কৌতুহলমিশ্রিত আকর্ষন আর কিছুটা সৌজন্যতা রক্ষার খাতিরে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি মেয়েটির কাছে পৌছার পূর্বেই পাশে বসা যুবকটি মেয়েটির কানে কানে কিছুএকটা বলে উঠে গেল। কাছে পৌছুতেই মেয়েটি মিষ্টি করে হাসল।
বলল: কেমন আছেন?
-ভালো আছি।
এরপর কোনো ভনিতা না করেই বললাম: "আপনার কাছে আমার একটি স্বীকারোক্তি আছে। আপনাকে এর পুরোটাই শুনতে হবে!"
মেয়েটি অবাক চোঁখে তাকালো। প্রথমবারের মতো মেয়েটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম। এক কথায় সুন্দরী বলতে যা বোঝায় মেয়েটিকে কোনোভাবেই তা বলা যাবেনা! তবে, কিছু একটা রয়েছে যা অনেককেই আকৃষ্ট করবে। কিন্তু সেই "কিছু একটা" যে কি তা কিছুতেই উদ্ধার করতে পারলাম না!
মেয়েটি অপলক তাকিয়ে আছে আমার চোঁখে। আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম: "আমি আপনার সাথে অভিনয় করেছি! আসলে আমি খুব ভিতু মানুষ। আপনার সামনে সাহসী হবার অভিনয় করেছি!"
মেয়েটি কিছুটা অবাক হয়ে বলল-"কখন?"
বললাম: "ঐ যে, যখন ওভারব্রিজ পার হচ্ছিলাম!"
"কিভাবে?"
আমি যেন আবার ফিরে গেলাম সেই ঝুলন্ত ব্রিজে, সেই ভৌতিক পরিবেশে, সেই হলদেটে আবছায়া আলোয় দোদুল্যমান বিভিষিকার উপর!
মেয়েটি তখনো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল- "কিভাবে!"
বললাম: "এই যে আমি ব্রিজে রশি ধরে দাড়িয়ে আছি! ভাবটা যেন, এসব উচ্চতা আমার কাছে কিছুই না! এ আমি এক দৌড়ে পাড় হয়ে যেতে পারি!"
মেয়েটি হো হো করে হেসে উঠল।
কিন্তু আমি প্রচন্ড ভয়ে দুলছি! হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে! ব্রিজের অনেক নিচের ব্যস্ত রোড এখন শুনশান! অনেক অনেক নিচে আবছায়া অস্পষ্ট আলোর রেশ! কে যেন বারবার বলছে -"কি হলো! আপনি কাঁপছেন কেন?" হাত ধরে কে যেন ঝাকুনি দিচ্ছে! আমি শুনতে পাচ্ছি কল্পনার ব্রিজে দাড়ানো মেয়েটি বলছে- নিচে লাফ দেন! দেখেন, কিছুই হবেনা! আপনিতো সত্যি সত্যিই এখন ব্রিজে নেই!
বিশ্বাস হচ্ছিল না ওর কথা! কিন্তু হঠাত কি যে হলো! কোথা থেকে একগাছি দড়ি হাতে জড়িয়ে লাফ দিলাম! একি! আমিতো দড়িতে ঝুলছি! হায় আল্লাহ, এখন কি হবে! আমি কি মরে যাচ্ছি! এ সুন্দর পৃথিবী, সুন্দর মানুষ সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি!
মাথার চুলে কার যেন স্পর্শে ঘোর কেটে গেল। "ফিরে আসুন! কল্পনার রাজ্য থেকে ফিরে আসুন!"
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। ভাবছিলাম, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি!
দেখলাম, আমার বাম হাতটি মেয়েটির দু'হাতের মাঝে ধরা। ঠোট টিপে হাসছিল।
সে আমার হাত ছাড়ল না! অনেকক্ষন ধরে রাখল। আমরা পাশাপাশি বসে অনেক গল্প করলাম। বলল, ওর নাম -মায়া।
আমি -নিলু।
মায়া বলল, তুমি কোথায় থাক?
-এই তো সামনে। ঐ শালবন পেরিয়ে সামনের টিলার উপর আমার একটা ছোট্ট কুটির আছে।
ও বলল- তুমি কি সবসময় এখানে আস?
বললাম- নাহ্... মাঝে মাঝে, যখন শহুরে পরিবেশের যান্ত্রিকতা থেকে পালাতে ইচ্ছে করে, তখন।
তুমি?
ওহ... আমি এখানেই থাকি। ছোট বেলা থেকেই এখানে, বড় হয়েছি, স্বপ্ন দেখেছি, জীবন সাজিয়েছি.... এখানেই।
কিন্তু তুমি আজ শহরে গিয়েছিলে?
ও হাসল.... বলল, " তোমার খোজে "।
আমি বললাম- যাহ্... তা কি করে হয়! আজকের আগে তুমি তো আমায় চিনতেই না!
মায়া কিছুই বলল না, শুধু হাসল। হাসলে ওকে দেখতে বেশ লাগে। সমস্ত হাসি উছ্লে পরে ওর দু'চোঁখ দিয়ে।
রাত কতটা হয়েছে বুঝতে পারিনি। ঘড়ি পড়া বাদ দিয়েছি ক'দিন হলো। মাঝে মাঝে এমন হয়। তখন কোন বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে ইচ্ছে করে না। মাঝ আকাশে পূর্ণ চাঁদ। অন্ধকার অনেকটায় কেটে গেছে।
হঠাৎ মনে পড়তেই বললাম- মায়া, তুমি বাড়ি যাবেনা!
ও উদাশ চোঁখে তাকিয়ে রইল। - " যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছি, সেদিন থেকেই নিজেকে বেঁধেছি তোমাতে! তোমার ঠিকানাই যে আমার ঠিকানা!"
আমি ওর হেঁয়ালীমাখা কথা কিছুই বুঝলাম না। আর, নতুন করে বুঝতেও চাইলাম না!
ও বললঃ "মা চলে গেলেন গত বছর, সেই থেকে একা! প্রথম যেদিন তোমায় দেখলাম- শালবনে, ভরা পূর্ণিমায়, তুমি চন্দ্রাহত পাগলের মত ইতিউতি ঘুরছিলে! আর কাকে যেন খুজছিলে! তোমাকে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল! মনে হল, তুমি আমাকেই খুজছো!"
আমি অবাক হয়ে ওর চোঁখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর কালো হরিনে বান ডেকেছে। কিছুই বললাম না। আমার বাম হাতে ওর ডান হাত আরও বেশি শক্ত হয়ে জড়িয়ে রইল।
ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হল হঠাৎই। ও বলল- আরে! আমার কণ্ঠাহাড়! এই যা, ঐ ছেলেটি নিয়ে পালিয়েছে!
আমার দিকে তাকিয়ে মায়া যেন অভিযোগ করছিল! আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।বললাম- ছেলেটি কে?
মায়া বললঃ চিনি না! আমি শুধু ওর সাহায্য চেয়েছিলাম, যাতে তোমার কাছে আসতে পারি! শুনেছি jealous -র মাধ্যমে ভালোবাসা তৈরী করা যায়! কথাটি বলেই ও লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল।
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।
বৃষ্টির তেজ বাড়ছিল। দুজনেই ভিজে গেছি! ভেজা মায়া-কে আরো অনেক বেশি মায়াবী লাগছিল।
শেষ রাত, অন্ধকার হয়ে রয়েছে চারিপাশ। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। কুটিরে ফিরেছি মাঝরাতের কিছু পর। দুজনেই ভিজে একশা।
বাড়তি কোনো কাপড় নেই! ভেজা কাপড়েই বসে আছি দুজনে। খড়ের চালায় অবিরাম বৃষ্টির ফোটা, দু'চারটে নাম না জানা রাতপাখিদের হঠাৎ হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দ ছাড়া পথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই। মায়ার চোঁখ দুটো লাল। কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলাম। প্রচন্ড জ্বরে ওর শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ও হাসছে, ঠিক যেন শতযুগের জমানো কান্না!
ও দূর্বল কণ্ঠে বললঃ " বড় সাধ ছিল আমার কণ্ঠাহার তোমায় দেব! কিন্তু..... "
আমি ওর মুখে হাতচাপা দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলাম। বললামঃ "তুমি, ভিজে কাপড় খুলে কাঁথার নিচে শুয়ে পড়, তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। আমি বাহিরে যাচ্ছি। তোমার হলে ডেকো। মাথায় পানি দিতে হবে।"
মায়া আমার হাত জড়িয়ে ধরল। আমি হালকা চাপ দিয়ে ওকে অভয় দিলাম।
কিছুক্ষন পর ঘরে এসে দেখি মায়া শুয়ে পড়েছে, চোঁখ বন্ধ। জ্বর অনেক বেড়েছে। আমি কপালে হাত রাখতেই যেন কটু কেঁপে উঠল। জোর করে চোখ খোলার চেষ্টা করছে। নিষেধ করলাম, বললাম "ঘুমাও"।
মাটির পাতিলে জল ভরে ওর মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলাম। ভোরের দিকে জ্বর কমে এলো।
ও চোঁখ খুলল। লাজুক হেসে বললঃ আমার খুব শীত করছে! বিছানার এক পাশে সরে গিয়ে ঈশারায় আমাকে আহ্বান জানালো।
ঘুমে জড়িয়ে আসছিল দুটি চোঁখ। কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়লাম একমাত্র আচ্ছাদনটির নিচে! দু'হাতে জড়িয়ে রইলাম আমার সোনাপাখিকে!
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো।
চোঁখ খুলে পাশে চাইতেই দেখি মায়া নেই! কাঁথা সরিয়ে দেখি বালিশে শুয়ে আছে একটি মৃত পাখি! সোনালি পালক, চোঁখ দুটিতে এমন মায়া... আহা... এমনটি কেউ কখনো দেখেনি! দু'হাতের তালুতে মরে পড়ে আছে আমার ছোট্ট মায়া পাখি!
আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম! অগোছালো এলোমেলো আমি ছুটে গেলাম হাসপাতালে। কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন- "এখানে পশুপাখির চিকিৎসা হয়না! তুমি বাপু তোমার মরা পাখিটা নিয়ে পক্ষী হাসপাতালে যাও।"
আমি দ্রুত ছুটলাম! আবছায়া ভাবে কানে এলো, কে যেন পিছন থেকে বলছে " পাগলটার পাগলামি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে!"
রাস্তায় বেড়িয়ে আসতেই একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমার পিছু নিল! ওরা বরাবরই আমার পিছু নেয়! নিলুয়া পাগল........ নিলুয়া পাগল বলে খ্যাঁপায়! আমি কিছু মনে করি না। ওরা তো অবুঝ শিশু। বলুক্ না একটু পাগল! কিন্তু বড় ভদ্র, সভ্য মানুষেরা যখন আমাকে পাগল বলে তখন আমার খুব রাগ হয়! চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, " আমি নিলুয়া পাগল নই, আমি নিলু... আমি নিলু!"
ওহ্ হো অনেক দেরী হয়ে গেছে! দু'মাস চেষ্টার পর পক্ষী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের এ্যপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি! দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে! আমার মায়া পাখির আজ অপারেশন!!!
আপনারা ওর জন্য দোয়া করবেন!
...............ছাতনী, আদমদিঘী, বগুড়া
...........................১০.০৯.২০১৬
এ ছোট্ট প্রয়াস তুমি এবং তোমার মেজ বৌমার প্রতি উৎসর্গ করলাম।
.......................................................................
মাঁয়া পাখি
সেপ্টেম্বরের শেষ। সবেমাত্র নতুন চাকরীতে জয়েন্ট করেছি। বেতন বেশ ভালো। এখানকার শহুরে পরিবেশে একা খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মনে আরেকটি বিষয় কাজ করছিল ক'দিন ধরে। ভাবছি পাশাপাশি কিছু করতে হবে, এমনকিছু যা সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা কিছুটা লাঘব করবে।
একদিন অফিস শেষে গেলাম ডেভিড স্কুলে। সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। এখনও ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে উঠেনি। বিজ্ঞাপনের ঠিকানা অনুযায়ী মেইন রোড থেকে পাশের গলি ধরে একটু ভিতরে দু'মিনিট হাটলেই স্কুলটি। বেশ সুনাম হয়েছে। আবার নিন্দুকেরা বলে, ছাত্র-ছাত্রীরা নাকি শুধু ইংরেজি-ই শিখেছে, বাংলা পড়তেও পারেনা লিখতেও পারেনা!
বড় গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বেশ ভাল লাগল। ইটপাতা রাস্তা, দু'পাশে নানা জাতের ফুলগাছ। সাজানো গোছানো, ছিমছাম। একপাশে মাঝারি সাইজের একটি ফলবাগান। একটু হাটতেই দক্ষিণ পাশে মূল স্কুল ভবনটির সাথে শিক্ষকদের জন্য আলাদা অফিস বিল্ডিং।
সামনে এগুতেই একজন মাঝবয়সী মহিলাকে দেখলাম, চোঁখে চশমা, হাতে লম্বা ট্যালি খাতা। ওনার পোষাকটা কিছুটা মিশনারি চার্চের নান্-দের মতো।
আমাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন:
Hello son, can I help you?
- Of course, Mam. I'm here for the circular published in newspaper yesterday. You need a part-time teacher for teaching Bengali in school?
Yes. Please come with me. By the way, I'm Margareta Mathews, Principal of the school.
-Hello mam. I'm Nilu.
আধ্ঘন্টাখানেক আলোচনা করার পর সবকিছু পাকা হয়ে গেল। আপাতত Guest Teacher হিসেবে সান্ধ্যকালীন শিফট-এ ক্লাস, দু'টি করে ক্লাস নিতে হবে।
স্কুল থেকে বের হয়ে বেশ খুশি খুশি লাগছে। আনমনে শিস বাজাতে বাজাতে মেইন রোডের দিকে হাটছিলাম। ইতোমধ্যে বড়রাস্তার হ্যালোজেন লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। আজ রাস্তায় যানবাহনের ভিড় নেই। হুশহাস করে পাশে দিয়ে চলে যাচ্ছে বাসগুলো। ফুটপাথ দিয়ে হাটার সময় ভাবছিলাম মহল্লার ক্লাবে একবার যাব কি না! ক্লাবঘরের পাঠাগারে বসা যেত, চাই কি পার্টি পেলে দু'এক গেম ক্যরম ও খেলা যেত!
হঠাৎ পাশের অন্ধকার গলি থেকে কিশোর বয়েসি দু'জন ছেলে বেরিয়ে এলো, হাতে ছোরা!
বয়স বড়জোর ১৩/১৪! লিকলিকে শরীর! ওদের একজন ধমকে উঠে বলল : "যা আছে সব দিয়ে দাও!"
ফুটপাথ প্রায় জনশুন্য! অগত্যা মুঠো পাকিয়ে একজনের গালে লাগিয়ে দিলাম, ঠাস্.. ঠাস্...! মুহূর্তেই পড়ে গেল সে ফুটপাথের উপর, হাত থেকে ছিটকে পড়ল ছোরা, পাশের ড্রেনে! এসব দেখে অপরজন উল্টো ঘুরেই দিল ছুট! যেন দৌড়ে সে অলিম্পিক স্বর্ণ জয় করবে!
ধরে নিয়ে গেলাম ক্লাবে। জেরা করলাম। ড্রাগ এডিক্টেড। যখন জানলাম সে ক্লাস এইট-এ পড়ে, বেশ অবাক হলাম। আজই প্রথম সে রাস্তায় নেমেছে বাড়তি ড্রাগের নেশার টাকা যোগাতে। বাসার নম্বর নিয়ে ফোন করলাম, ফ্যমিলি মেম্বার কেউ এসে ওকে নিয়ে যেতে বললাম।
একটু আগের আনন্দটুকু কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। সন্ধ্যার আবছায়া আলো-আঁধারিতে হঠাৎই চোঁখে জল চলে এলো।
ভাবলাম, আর নয়, এবার ঘরে ফিরব।
শহরে থাকা হয় একটি মেসবাড়িতে। মাঝে মাঝে যাই আমার জঙ্গলমহলে। কিছু সময় একা থাকব বলে। বিজনে নিজের সঙ্গে একা। বেশ ভাল লাগে।
শহরের বাহিরে বাসস্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাসে এক ঘন্টার পথ, এরপর ছোট্ট পাহাড়ি বাজারটিকে বায়ে রেখে ফুট ওভারব্রিজ পেরিয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এর এরিয়ার ভেতর দিয়ে পাকদণ্ডি পথ বেয়ে কয়েক মিনিট হাটলেই টিলার মাথায় আমার ছোট্ট ডেরা, আমার জঙ্গলমহল।
ফুট ওভারব্রিজটির কাছে আসতেই ওটাকে কেমন অপরিচিত মনে হল! আজ যেন অনেক বেশি উঁচু! ঠোট উল্টিয়ে, কাঁধ ঝাকি দিয়ে বললাম: "বোধহয় ঠিকই আছে!"
উপরে উঠতে লাগলাম, অনেকটা মই এর মত!অনেক খাঁড়া, ধাপগুলো সরু ও ছোট। নিচে তাকালেই গা ছমছম করছিল, নিয়নের আবছায়া আলোয় বাস- ট্রাকের হেডলাইট অশরিরী দানবের জলন্ত চোখের মতো জ্বলজ্বল করছিল। দেখলাম নিচের দিক থেকে একটি মেয়েও উপরে উঠছে। সে ও ওপারে যাবে। মনে মনে বললাম: " এই... যাহ! prestigious issue! এখন ভয় পেলে তো চলে না!"
ইতোমধ্যেই, মেয়েটি পাশে এসে দাড়িয়েছে। তার দিকে চাইতেই সে হালকা করে হাসল। শুধু চোঁখ দুটিতে হাসির আভাস দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। প্রত্যুত্তরে আমিও হালকা নড করলাম।
ওভারব্রিজটি পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম ফরেস্ট এরিয়ায়।
লাল এঁটেল মাটির সোঁদা গন্ধ, কিছুটা ভেজা, হয়ত একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। শাল, সেগুন, জঙ্গলি ঝোপঝাড়ে বন্যফুলের সুবাস, দূর্বাঘাস। বুকভরে শ্বাস টেনে নিলাম। আহ্! এ যে আমার চিরচেনা....
এদিক ওদিক চাইতেই আরও দু'একজনকে দেখতে পেলাম। কয়েকটি যুগলবন্দীও রয়েছে- হাত ধরে পাশাপাশি হাটছে।
মেয়েটিকে দেখলাম একটি ছেলের সাথে পাশাপাশি হাটছে আর গল্প করছে।
আমি আমার পথ ধরলাম।
উচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা। এখানে ওখানে ছোপ ছোপ কাঁদা। ঘাসগুলোর মাথায় শিশিরের মতো ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি জমে আছে। বেশ অনেকদূর পরপর একটি করে ল্যাম্পপোষ্ট। হলদেটে আলো খুব একটা অন্ধকার তাড়াতে পাড়েনি।
আলো -আঁধারির এ মোহময় পরিবেশ ভালোই লাগছিল। আনমনে হাটছিলাম। কখনো একা একাই হাসছি, আবার কখনো গম্ভির হয়ে উঠছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কেউ একজন পাশে থাকলে জীবনটা নেহাত মন্দ হতো না! আবার পরক্ষনেই মনে হচ্ছে- নাহ্! এইতো বেশ আছি! ভাবনাহীন, নিশ্চিন্ত জীবন, মুক্ত বিহঙ্গের আকাশ ছোয়া স্বাধীনতা! আহ্......!
রাস্তার বাঁক ঘুরতেই সামনের ল্যাম্পপোষ্টটির নিচে সেই মেয়েটিকে দেখলাম, আবার! পাশে বসা পূর্বের ঐ যুবকটি। কিছুটা কৌতুহলমিশ্রিত আকর্ষন আর কিছুটা সৌজন্যতা রক্ষার খাতিরে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি মেয়েটির কাছে পৌছার পূর্বেই পাশে বসা যুবকটি মেয়েটির কানে কানে কিছুএকটা বলে উঠে গেল। কাছে পৌছুতেই মেয়েটি মিষ্টি করে হাসল।
বলল: কেমন আছেন?
-ভালো আছি।
এরপর কোনো ভনিতা না করেই বললাম: "আপনার কাছে আমার একটি স্বীকারোক্তি আছে। আপনাকে এর পুরোটাই শুনতে হবে!"
মেয়েটি অবাক চোঁখে তাকালো। প্রথমবারের মতো মেয়েটিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম। এক কথায় সুন্দরী বলতে যা বোঝায় মেয়েটিকে কোনোভাবেই তা বলা যাবেনা! তবে, কিছু একটা রয়েছে যা অনেককেই আকৃষ্ট করবে। কিন্তু সেই "কিছু একটা" যে কি তা কিছুতেই উদ্ধার করতে পারলাম না!
মেয়েটি অপলক তাকিয়ে আছে আমার চোঁখে। আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম: "আমি আপনার সাথে অভিনয় করেছি! আসলে আমি খুব ভিতু মানুষ। আপনার সামনে সাহসী হবার অভিনয় করেছি!"
মেয়েটি কিছুটা অবাক হয়ে বলল-"কখন?"
বললাম: "ঐ যে, যখন ওভারব্রিজ পার হচ্ছিলাম!"
"কিভাবে?"
আমি যেন আবার ফিরে গেলাম সেই ঝুলন্ত ব্রিজে, সেই ভৌতিক পরিবেশে, সেই হলদেটে আবছায়া আলোয় দোদুল্যমান বিভিষিকার উপর!
মেয়েটি তখনো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল- "কিভাবে!"
বললাম: "এই যে আমি ব্রিজে রশি ধরে দাড়িয়ে আছি! ভাবটা যেন, এসব উচ্চতা আমার কাছে কিছুই না! এ আমি এক দৌড়ে পাড় হয়ে যেতে পারি!"
মেয়েটি হো হো করে হেসে উঠল।
কিন্তু আমি প্রচন্ড ভয়ে দুলছি! হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে! ব্রিজের অনেক নিচের ব্যস্ত রোড এখন শুনশান! অনেক অনেক নিচে আবছায়া অস্পষ্ট আলোর রেশ! কে যেন বারবার বলছে -"কি হলো! আপনি কাঁপছেন কেন?" হাত ধরে কে যেন ঝাকুনি দিচ্ছে! আমি শুনতে পাচ্ছি কল্পনার ব্রিজে দাড়ানো মেয়েটি বলছে- নিচে লাফ দেন! দেখেন, কিছুই হবেনা! আপনিতো সত্যি সত্যিই এখন ব্রিজে নেই!
বিশ্বাস হচ্ছিল না ওর কথা! কিন্তু হঠাত কি যে হলো! কোথা থেকে একগাছি দড়ি হাতে জড়িয়ে লাফ দিলাম! একি! আমিতো দড়িতে ঝুলছি! হায় আল্লাহ, এখন কি হবে! আমি কি মরে যাচ্ছি! এ সুন্দর পৃথিবী, সুন্দর মানুষ সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি!
মাথার চুলে কার যেন স্পর্শে ঘোর কেটে গেল। "ফিরে আসুন! কল্পনার রাজ্য থেকে ফিরে আসুন!"
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। ভাবছিলাম, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি!
দেখলাম, আমার বাম হাতটি মেয়েটির দু'হাতের মাঝে ধরা। ঠোট টিপে হাসছিল।
সে আমার হাত ছাড়ল না! অনেকক্ষন ধরে রাখল। আমরা পাশাপাশি বসে অনেক গল্প করলাম। বলল, ওর নাম -মায়া।
আমি -নিলু।
মায়া বলল, তুমি কোথায় থাক?
-এই তো সামনে। ঐ শালবন পেরিয়ে সামনের টিলার উপর আমার একটা ছোট্ট কুটির আছে।
ও বলল- তুমি কি সবসময় এখানে আস?
বললাম- নাহ্... মাঝে মাঝে, যখন শহুরে পরিবেশের যান্ত্রিকতা থেকে পালাতে ইচ্ছে করে, তখন।
তুমি?
ওহ... আমি এখানেই থাকি। ছোট বেলা থেকেই এখানে, বড় হয়েছি, স্বপ্ন দেখেছি, জীবন সাজিয়েছি.... এখানেই।
কিন্তু তুমি আজ শহরে গিয়েছিলে?
ও হাসল.... বলল, " তোমার খোজে "।
আমি বললাম- যাহ্... তা কি করে হয়! আজকের আগে তুমি তো আমায় চিনতেই না!
মায়া কিছুই বলল না, শুধু হাসল। হাসলে ওকে দেখতে বেশ লাগে। সমস্ত হাসি উছ্লে পরে ওর দু'চোঁখ দিয়ে।
রাত কতটা হয়েছে বুঝতে পারিনি। ঘড়ি পড়া বাদ দিয়েছি ক'দিন হলো। মাঝে মাঝে এমন হয়। তখন কোন বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে ইচ্ছে করে না। মাঝ আকাশে পূর্ণ চাঁদ। অন্ধকার অনেকটায় কেটে গেছে।
হঠাৎ মনে পড়তেই বললাম- মায়া, তুমি বাড়ি যাবেনা!
ও উদাশ চোঁখে তাকিয়ে রইল। - " যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছি, সেদিন থেকেই নিজেকে বেঁধেছি তোমাতে! তোমার ঠিকানাই যে আমার ঠিকানা!"
আমি ওর হেঁয়ালীমাখা কথা কিছুই বুঝলাম না। আর, নতুন করে বুঝতেও চাইলাম না!
ও বললঃ "মা চলে গেলেন গত বছর, সেই থেকে একা! প্রথম যেদিন তোমায় দেখলাম- শালবনে, ভরা পূর্ণিমায়, তুমি চন্দ্রাহত পাগলের মত ইতিউতি ঘুরছিলে! আর কাকে যেন খুজছিলে! তোমাকে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল! মনে হল, তুমি আমাকেই খুজছো!"
আমি অবাক হয়ে ওর চোঁখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর কালো হরিনে বান ডেকেছে। কিছুই বললাম না। আমার বাম হাতে ওর ডান হাত আরও বেশি শক্ত হয়ে জড়িয়ে রইল।
ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হল হঠাৎই। ও বলল- আরে! আমার কণ্ঠাহাড়! এই যা, ঐ ছেলেটি নিয়ে পালিয়েছে!
আমার দিকে তাকিয়ে মায়া যেন অভিযোগ করছিল! আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।বললাম- ছেলেটি কে?
মায়া বললঃ চিনি না! আমি শুধু ওর সাহায্য চেয়েছিলাম, যাতে তোমার কাছে আসতে পারি! শুনেছি jealous -র মাধ্যমে ভালোবাসা তৈরী করা যায়! কথাটি বলেই ও লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল।
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।
বৃষ্টির তেজ বাড়ছিল। দুজনেই ভিজে গেছি! ভেজা মায়া-কে আরো অনেক বেশি মায়াবী লাগছিল।
শেষ রাত, অন্ধকার হয়ে রয়েছে চারিপাশ। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। কুটিরে ফিরেছি মাঝরাতের কিছু পর। দুজনেই ভিজে একশা।
বাড়তি কোনো কাপড় নেই! ভেজা কাপড়েই বসে আছি দুজনে। খড়ের চালায় অবিরাম বৃষ্টির ফোটা, দু'চারটে নাম না জানা রাতপাখিদের হঠাৎ হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দ ছাড়া পথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই। মায়ার চোঁখ দুটো লাল। কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলাম। প্রচন্ড জ্বরে ওর শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ও হাসছে, ঠিক যেন শতযুগের জমানো কান্না!
ও দূর্বল কণ্ঠে বললঃ " বড় সাধ ছিল আমার কণ্ঠাহার তোমায় দেব! কিন্তু..... "
আমি ওর মুখে হাতচাপা দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলাম। বললামঃ "তুমি, ভিজে কাপড় খুলে কাঁথার নিচে শুয়ে পড়, তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। আমি বাহিরে যাচ্ছি। তোমার হলে ডেকো। মাথায় পানি দিতে হবে।"
মায়া আমার হাত জড়িয়ে ধরল। আমি হালকা চাপ দিয়ে ওকে অভয় দিলাম।
কিছুক্ষন পর ঘরে এসে দেখি মায়া শুয়ে পড়েছে, চোঁখ বন্ধ। জ্বর অনেক বেড়েছে। আমি কপালে হাত রাখতেই যেন কটু কেঁপে উঠল। জোর করে চোখ খোলার চেষ্টা করছে। নিষেধ করলাম, বললাম "ঘুমাও"।
মাটির পাতিলে জল ভরে ওর মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলাম। ভোরের দিকে জ্বর কমে এলো।
ও চোঁখ খুলল। লাজুক হেসে বললঃ আমার খুব শীত করছে! বিছানার এক পাশে সরে গিয়ে ঈশারায় আমাকে আহ্বান জানালো।
ঘুমে জড়িয়ে আসছিল দুটি চোঁখ। কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়লাম একমাত্র আচ্ছাদনটির নিচে! দু'হাতে জড়িয়ে রইলাম আমার সোনাপাখিকে!
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো।
চোঁখ খুলে পাশে চাইতেই দেখি মায়া নেই! কাঁথা সরিয়ে দেখি বালিশে শুয়ে আছে একটি মৃত পাখি! সোনালি পালক, চোঁখ দুটিতে এমন মায়া... আহা... এমনটি কেউ কখনো দেখেনি! দু'হাতের তালুতে মরে পড়ে আছে আমার ছোট্ট মায়া পাখি!
আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম! অগোছালো এলোমেলো আমি ছুটে গেলাম হাসপাতালে। কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন- "এখানে পশুপাখির চিকিৎসা হয়না! তুমি বাপু তোমার মরা পাখিটা নিয়ে পক্ষী হাসপাতালে যাও।"
আমি দ্রুত ছুটলাম! আবছায়া ভাবে কানে এলো, কে যেন পিছন থেকে বলছে " পাগলটার পাগলামি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে!"
রাস্তায় বেড়িয়ে আসতেই একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমার পিছু নিল! ওরা বরাবরই আমার পিছু নেয়! নিলুয়া পাগল........ নিলুয়া পাগল বলে খ্যাঁপায়! আমি কিছু মনে করি না। ওরা তো অবুঝ শিশু। বলুক্ না একটু পাগল! কিন্তু বড় ভদ্র, সভ্য মানুষেরা যখন আমাকে পাগল বলে তখন আমার খুব রাগ হয়! চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, " আমি নিলুয়া পাগল নই, আমি নিলু... আমি নিলু!"
ওহ্ হো অনেক দেরী হয়ে গেছে! দু'মাস চেষ্টার পর পক্ষী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের এ্যপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি! দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে! আমার মায়া পাখির আজ অপারেশন!!!
আপনারা ওর জন্য দোয়া করবেন!
...............ছাতনী, আদমদিঘী, বগুড়া
...........................১০.০৯.২০১৬
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ১৪/১১/২০১৭মুগ্ধকর
-
মোঃ ফাহাদ আলী ১৩/১১/২০১৭অনেক সুন্দর হইছে
-
কামরুজ্জামান সাদ ১৩/১১/২০১৭গল্পটাতে একটা বিষাদের সুর আছে।নিলুয়া পাগলকে সুন্দর উপস্থাপন করেছেন।
-
মধু মঙ্গল সিনহা ১২/১১/২০১৭সুন্দর
-
সোলাইমান ১১/১১/২০১৭ভাল উপস্থাপনা।