www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ধ্রুব


রাত প্রায় দেড়টা তখন। মৃতের মতো ঘুমাচ্ছে ধ্রুব। জগত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় গাঢ় এক অন্ধকারে তলিয়ে আছে সে। ক'দিন যাবতই ভার্সিটিতে সেমিনারের প্রেজেন্টেশন নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত সময় কাটছে। নানারকম কাজের শেষে মাঝরাতে কোনমতে একবার বিছানায় গিয়ে পড়লে বেশিক্ষণ আর হুশ থাকে না। চারপাশের সবকিছু শুন্য হতে হতে দ্রুত মিলিয়ে যায়। অনুভূতিহীন এক অতল সময়ে ডুব দেয় সে। কিন্তু হঠাৎ কোথায় যেন ছেদ পড়লো নিরবিচ্ছিন্নতায়। অবসন্ন শরীর জাগতে না চাইলেও আড়ষ্টভাবে সচেতনতা ফিরে আসছে। কোথায় যেন খুবই পরিচিত এক গানের সুর বেজে চলেছে। ঘুম পুরোপুরি ভাঙ্গার আগেই অবচেতনে হাত চলে গেলো বালিশের ওপাশে রাখা সেলফোনের উপর। ফোন কানে লাগিয়ে কন্ঠের অতল থেকে বেরিয়ে এলো ঘুমে জড়ানো একটি শব্দ,

- "হ্যাল্লো"।

- "ধ্রুব! কোথায় তুমি?? কতোক্ষণ যাবৎ তোমায় ফোন করছি! ধরো না কেন?"
ওপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে প্রায় চেচিয়ে উঠে এক মেয়ে কন্ঠ।

ধ্রুব-র ঘুম তখনও ঠিকমতো ভাঙ্গেনি।
- "হ্যাঁ, বলো তমু। কি হয়েছে?"

তমা তখন প্রায় ক্ষেপে আছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে এদিকে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে, আর তার প্রেমিক কিনা ঐদিকে আরামে ঘুমাচ্ছে! একটুও কেয়ার করে না তাকে ধ্রুব!! অতএব কন্ঠের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেলো এবার।

- "তুমি ঘুমাচ্ছো!?! কেমনে পারো তুমি বল তো? আমি সেই তখন থেকে মাথার যন্ত্রনায় অস্থির! কোথায় আমার সাথে কথা বলে আমার মাথার ব্যাথা একটু কমাবে। আর তুমি কিনা ঘুমাচ্ছো মনের সুখে!"

- "মাথার ব্যাথাটা বেড়েছে?"
ধ্রুব ততোক্ষণে মোটামুটি সজাগ হয়ে গেছে। চিন্তাভাবনা কাজ করা শুরু করেছে। তবে ঠিক কি করবে তা বুঝে পাচ্ছে না।

- "মাথা ব্যাথার কথা আর মনে করাবে না তো। এমনিতেই ব্যাথার জ্বালায় বাঁচি না! অন্য কিছু নিয়ে কথা বলো।"

- "তাহলে তুমি একটা টপিক নিয়ে শুরু করো, আমি কথা বলছি।" এখনও ধ্রুবর কন্ঠ অনেকটা ঘুমে জড়ানো।

- "আরেহ! আমাকে কেন টপিক খুঁজে বের করতে হবে? তুমি একটা ভাল টপিক খুঁজে বের করতে পারো না?"

- "উমমম... ঠিক আছে। চলো আমরা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলি।" ধ্রুব তমার সবচেয়ে পছন্দের টপিক নিয়ে শুরু করলো। "২০১৪ সালে আমরা বিয়ে করবো। আমি পড়ালেখা শেষ করে দুই বছরে ভাল একটা চাকরীতে জয়েন করবো। আর তুমিও অনার্স শেষ করে ফেলবে ততোদিনে..."

- "উফফ!! ভবিষ্যতের কিছু শুনতে আর ভাল লাগছে না। এটা করবো, সেটা করবো... উফফ!!! আর না। অন্য কিছু নিয়ে কথা বলো। কোন কাজের কথা আর শুনতে চাই না।"

- "ওকে। আমাদের প্রথম দেখার দিনটি মনে পড়ে? ভার্সিটির ক্যাম্পাসে উল্টোদিকে ফিরে ছুটতে ছুটতে আমার গায়ে এসে ধাক্কা খেলে? তারপর..."

- "এসব শুনতে আর ভাল্লাগছে না ধ্রুব! অন্য কিছু বলো।" তমার কন্ঠে প্রচন্ড বিরক্তি।

এবার ধ্রুব বেশ অসহায় বোধ করে। কি নিয়ে কথা বলবে খুঁজে পায় না কিছুতেই। যেটা নিয়েই সে বলতে যাবে, সেটাই এখন তমার পছন্দ হবে না। অসহায় বোধটা ধিরে ধিরে বিরক্তিতে রূপ নেয়, সেখান থেকে চাপা রাগ। ফোন কানে লাগিয়ে ধ্রুব চুপ করে শুয়ে থাকে।

- "কি হলো, কথা বলছো না কেন??"

- "কি নিয়ে কথা বলবো? যেটা বলবো সেটাই তোমার পছন্দ হবে না। তার চেয়ে তুমি বরং ঘুমানোর চেষ্টা করো, কিংবা ওষুধ খাও। আমারও ঘুমানো দরকার। তুমি তো জানোই যে সাত সকালে উঠেই আমাকে আবার দৌড় দিতে হবে প্রেজেন্টেশনের পেপার নিয়ে।"

- "তুমি এভাবে বলতে পারলে? তোমার ঘুমটাই বড়? আর আমি কিছুই না?! তুমি জানো আমি কেমন অসুস্থ। আমার মাথা ব্যাথা দেখেও তোমার মধ্যে কোন দয়া হয় না? কেন তুমি এরকম ধ্রুব? কেন তুমি আমাকে একটুও ভালবাসো না?" শুরু হয় তমার কান্না।

নিত্যনৈমিত্তিক অভিযোগ, ধ্রুব কেন তমাকে ভালবাসে না। শুনতে শুনতে ধ্রুব-র রাগও বাড়তে থাকে। তমার কান্না মনে তেমন একটা দাগ কাটতে পারে না। নিয়মিত তাকেই কেন ভালবাসার প্রমান দিয়ে যেতে হবে? তার কোন কথা বা কাজ তমার পছন্দ না হলেই এক কথা, "তুমি আমাকে ভালবাস না"। আর তমা যা-ই করে সেটাই সে ধ্রুবকে ভালবাসে বলেই নাকি করে। এই যে এখন এভাবে তমা মেজাজ দেখাচ্ছে, তার কারণও হচ্ছে ধ্রুব-র প্রতি তার গভীর ভালবাসা। ধ্রুব-র পক্ষ থেকে কোনরকম অমনোযোগ সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না, আর তারই বহিঃপ্রকাশ হলো এই রাগ-ক্ষোভ। এক্ষেত্রে একই যুক্তি প্রয়োগ করে এটা বলা যাবে না যে তমা ধ্রুবকে ভালবাসে না।

অতএব এবার ধ্রুব রাগে বিস্ফোরিত হয়।

- "দেখো তমা, যথেষ্ট হয়েছে! আমি তোমার সাথে ফোনে কথা বললে যদি তোমার মাথা ব্যাথা কমতো তাহলেও এক কথা ছিলো। অনর্থক ফোনে ঝগড়া করে করে বরং তোমার ব্যাথা আরও বাড়ছে। এধরণের কথাবার্তার কোন দরকার নেই। তারচেয়ে তুমি ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো, আমিও এখন ঘুমাবো। গুডনাইট।"

আরও কিছুক্ষণ বাক-বিতন্ডার পর দু'জনই খটাশ করে ফোন রেখে দেয়। ধ্রুব আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঝগড়া শেষে শরীর-মন দু'টোই ক্লান্ত। তবে এবার যেন আর ঠিকমতো ঘুমটা আসতে চায় না। চোখ বন্ধ করলেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বিছানায় কুঁকড়ে কিভাবে কাঁদছে এখন তমা। এখনও তমার উপর যথেষ্ট বিরক্ত সে। কিন্তু এটাও সে ভালমতোই জানে যে তমা তাকে আসলেই খুব ভালবাসে। মেয়েটার ঝাল একটু বেশিই। ইমোশনও অতিমাত্রায় বেশি। সমস্যা হলো যে একটা পর্যায়ের পর সে নিজেও তার রাগ আর ধরে রাখতে পারে না। আর যখন তার বিস্ফোরণ হয়, তখন শুধু কথাতেই ছুরির চেয়েও বেশি ধার চলে আসে। ইমোশন আসলেই খুব খারাপ জিনিষ। এর আঘাতটা কাছের লোকগুলোই বেশি পায়।

ঘন্টাখানেক পর এবার ধ্রুব তমাকে ফোন দেয়। কিন্তু কয়েকবার ফোন করার পরেও ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরলো না। তখন সে এস এম এস পাঠালো, "তমু, ফোন ধরো।" আরও দুই মিনিট পর ধ্রুব আবারও ফোন দিলো। এবার কিছুক্ষণ রিং শেষে ওপাশ থেকে তমার কান্নাভেজা কন্ঠ পাওয়া গেলো।

- "হ্যাল্লো।"

- "তমু? এখনও মাথা ব্যাথা আছে?"

- "হু..."

- "ওষুধ খেয়েছো?"

- "না।"

- "ঠিক আছে, এখন ওষুধ খাও তাহলে।"

- "খাব না!"

- "খাও বলছি!"

- "কেন খাব? তোমার কথা আমি শুনি না! যাও, তুমি গিয়ে ঘুমাও।"

- "তুমি ওষুধ খাও। তারপরে আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।"

তমা ওপাশ থেকে বিড়বিড় করতে থাকে। এপাশ থেকে ধ্রুব আরও একটু কড়া গলায় বলে উঠেঃ

- "যাও বলছি! ওষুধ খেয়ে এসো!!"

তমা বিছানা থেকে উঠে সাইড টেবিলে গ্লাসে পানি ঢালছে শুনতে পায় ধ্রুব। ওষুধ খাচ্ছে, আর তখনও বিড়বিড় করে যাচ্ছে তমাঃ

- "কেন আমি তোমার কথা শুনবো? তুমি আমার কে? আমি ওষুধ খাই না। তুমি বললেই আমি খাব নাকি?"

বলতে বলতেই ওষুধ খেয়ে আবার বিছানায় ফিরে তমা। ধ্রুব বলে,

- "এখন চুপচাপ শুয়ে থাকো। কোন কথা বলবে না। ফোনটা মাথার পাশে রাখো। আমি লাইনে আছি।"

- "আমি তোমার কথা শুনি না। যাও, তুমি নিজে গিয়ে ঘুমাও।" বলতে বলতেই তমা বালিশের উপর ফোন রেখে পাশেই শুয়ে পড়ে।

ধ্রুবও কানে ফোন ধরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ওপাশ থেকে তমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। একটু পরপর ঘুমের মাঝেই তমা কি যেন বিড়বিড় করে বলে, আবার চুপ হয়ে যায়। এক আধবার ঘুম থেকে চমকে উঠে বলে, "ধ্রুব তুমি আছো?" এপাশ থেকে ধ্রুব বলে, "হ্যাঁ, আছি। তুমি ঘুমাও।"

মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। একা রুমে শুয়েও ধ্রুব-র মনে হয় এই মুহুর্তে সে একা না। এই তো পাশেই তমা শুয়ে আছে। ইচ্ছে হয় তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে। তমার চুলের ঘ্রাণ পায় সে স্পষ্ট। মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরতে থাকে। অদ্ভুত এক স্বপ্নের আবেশে ধিরে ধিরে কখন যেন ধ্রুব নিজেও ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৯৬৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৩/০৯/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রাসেল আল মাসুদ ১৩/০৯/২০১৩
    গল্পটা পড়ে ভাল লাগলো। কল্পনার এতটুকুও অত্যুক্তি নেই, সব মনে হচ্ছিল স্বচ্ছ বাস্তব।
  • ওয়াহিদ ১৩/০৯/২০১৩
    Golpo Porte Porte Ami Onno Ek Jogote Ami Hariye Gelam....
  • Înšigniã Āvî ১২/০৯/২০১৩
    দুর্দান্ত.....
 
Quantcast