আত্মহত্যা - একটি সামাজিক ব্যাধি
আজকাল পত্রিকা খুললে প্রায়ই কোন না কোন আত্মহত্যার খবর চোখে পড়ে। ইভ টিজিং, ধর্ষণ এসব ভয়ংকর কারণ থেকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, কিংবা ফ্যামিলির কারও উপর অভিমান করেও অনেকে আত্মহত্যা করছে। কেউ বা নিজে আত্মহত্যার আগে তার শিশু সন্তানদেরও হত্যা করছে নির্দ্বিধায়। ক'দিন আগে প্রথম আলোয় পড়লাম বাবার উপর অভিমান করে এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছে। আজ প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ঢুকতেই চোখে পড়লো "মেয়েটির কষ্ট কেউ বুঝলো না" শিরোনামে আরেক আত্মহত্যার কাহিনী। ফ্যামিলি মেয়েটিকে কর্মজীবী হোস্টেলে থাকতে দিতে রাজি হয়নি, এবং এ নিয়ে বিতন্ডায় তার মা কাকা-কাকীর সামনেই রেগে তাকে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে বলেছে। অতএব দড়ির বদলে কেরোসিনের আগুনে মনের জ্বালা নিভিয়েছে হাসিনা ফেরদৌস নামের এই অভিমানী মেয়েটি। অত্যন্ত দুঃখজনক পরণতি। এবং সংবাদের মন্তব্যে দেখলাম বেশিরভাগ পাঠকই মেয়েটির ফ্যামিলিকে এজন্য বকাঝকা করছে। ফ্যামিলি তার দায়ভার এড়াতে পারে না অবশ্যই। কিন্তু এজন্য কার দায়ভার সবচেয়ে বেশি, ফ্যামিলির, নাকি মেয়েটির নিজের?
আমি মেয়ে না। ছেলে হওয়ার পরেও আমার ফ্যামিলি থেকে আমাকে হোস্টেলে যেতে দেয়া হয়নি এক সময়। কিন্তু তাই বলে অভিমান করে আত্মহত্যার কথা কখনও চিন্তা করিনি। ফ্যামিলির আরও অনেক অনুশাসনই বলবৎ ছিলো আমাদের সব ভাই-বোনের উপর। কোথায় যাই বলে যেতে হবে, কাদের সাথে মেলামেশা করি জানাতে হবে, সন্ধ্যার আগে অবশ্যই বাড়ি ফিরতে হবে, টেলিফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যাবে না ইত্যাদি নানা রকম নিয়ম। অনেক সময় নিয়মের কড়াকড়িতে বিরক্ত হয়েছি, অভিযোগও কম দেইনি। কিন্তু এতটুকু চিন্তা মাথায় ছিলো যে এই দুনিয়ায় ফ্যামিলির এই মানুষগুলোই আমার সবচেয়ে আপন। আমার ক্ষতির জন্য তারা এসব নিয়ম আমার উপর ফলাচ্ছে না। এবং ফ্যামিলির এতোসব নিয়মের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি বলেই মনে হয় এখন সুন্দর এমন একটা জীবন পেয়েছি, যেখানে আঁচড়ের দাগ প্রায় নেই বললেই চলে।
দূর্ভাগ্য যে দিনে দিনে আমরা অতি মাত্রায় আত্মসচেতন হয়ে গেছি। "কেউ কারে নাহি হারি, সমানে সমান" মনোভাব সবার। কেউ কোন স্থানেই নিজেকে অন্য কারও থেকে ছোট হিসাবে দেখতে নারাজ। মেয়ে হলে এটা "নারী অধিকার", ছেলে হলে "আমি নিচু হবো কেন", এমনকি সন্তান হলেও বাবা-মা-কে নিজের অধিকার আদায়ের উপরে স্থান দিতে পারি না। নিজের অধিকার কড়ায়-গন্ডায় আদায় করতে গিয়ে সুখ পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে বসেছি। বিভিন্ন অধিকারের দাবি-দাওয়ার শেষে আত্মহত্যাটাকেই একমাত্র পথ বলে বেছে নিচ্ছি। আবার এর দায়ভারটাও চাপাচ্ছি অন্যদের উপরেই।
ছোটবেলা থেকেই আমরা পড়ে এসেছি আমাদের প্রথম মৌলিক চাহিদা হচ্ছে খাদ্য। কিন্তু আমি বলবো জীব মাত্রেই তার প্রধান চাহিদা হলো "বেঁচে থাকা"। শুধু মানুষ না, প্রতিটি জীবই প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার যুদ্ধে নিয়ত। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান থেকে নিয়ে অন্যান্য সব চাহিদার উৎপত্তি। ফুটপাথের পঙ্গু ভিখারীটি পর্যন্ত তার জীবনের সব দুর্দশা নিয়েই বেঁচে থাকার যুদ্ধ করে যায় প্রতিটি দিন। প্রতিদিন চেষ্টা করে আরেকটু ভালভাবে বাঁচতে। মানুষের লাথি-গুতো খাবার পরেও কয়েক মন অভিমান বুকে বেঁধে সে জীবনের কাছে মাথা নত করে না। কঠোর বাস্তবতা জীবনের কাছে হার মানতে শেখায় না। হার মানতে শেখায় অতিমাত্রায় কল্পনাবিলাসিতা, অলসতা এবং বাস্তববিমুখিতা। জীবনটা যার কাছে খেলাঘর, বিরক্ত হয়ে গেলে সেই খেলা সে পন্ড করতেই পারে। অথচ খেলাশেষে কোথায় যাবে সেই গন্তব্য সম্পর্কে কোন ধারণা দূরে থাক, এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেও তাদের কাউকে আগ্রহী দেখা যায় না। অনেকের মাঝেই তাই আজ "কাটা হেরি ক্ষান্ত" হবার প্রবনতা, কাটার আঘাত সহ্য করে "কমল তুলিতে" অনেকেই নারাজ। আর এটা দিন দিন এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। এবং এর মূলে আছে কোন কিছু ছাড় দিতে না পারা, নিজের ইচ্ছের বাইরে কোন কিছু মেনে না নিতে পারার মানসিকতা। না, আমি বলছি না অন্যায়কে মেনে নিতে হবে। বরং যথাযথভাবে এর প্রতিবাদ জানাতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু সব ন্যায় অন্যায়ের হিসাব নিজের স্বার্থ দিয়ে বিচার করলে হবে না। ক্ষেত্রবিশেষে সমষ্টির স্বার্থে ব্যাক্তিস্বার্থকে ছাড় দিতে হবে। পরিস্থিতির পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে, না পারলে ক্ষেত্রবিশেষে পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে হবে। এবং কোথায় ছাড় দেয়া উচিত, কোথায় দেয়া যাবে না এব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সেজন্য নিজের অধিকারের পাশাপাশি অন্যের অধিকার সম্পর্কেও শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার। সর্বোপরি যুদ্ধে পিঠটান দেয়া না, যুদ্ধের মোকাবিলা করেই সুখ অর্জনের মানসিকতা তৈরি করতে হবে আমাদের।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।