বই পরম বন্ধু
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, সাভারস্থ ‘বংশাই পাঠাগার’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে বক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল। যেহেতু অনুষ্ঠানটি ছিল পাাঠাগার সংক্রান্ত তাই বই পড়ার প্রয়োজনীয়তার উপর একটি প্রবন্ধ লিখে তা ই পাঠ করেছিলাম। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সেই প্রবন্ধটি আজ এখানে প্রকাশ করলাম।
----------------------------------------------------------
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর কর্মকাণ্ড এবং বিনোদনে লিপ্ত হওয়ার কারণে দিনে দিনে বই পড়ার চর্চা কমে আসছে। অথচ জীবন লালনে ও পরিচর্যায় যে বই পড়া কত প্রয়োজন তা বলে শেষ করার নয়। জীবন থেকে বইকে বাদ দেয়া মানে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় একটা প্রয়োজনকে বাদ দেয়া। পারতপক্ষে এবং সজ্ঞানে নিজের এই সর্বনাশ ডেকে আনা কারোরই কাম্য নয়। বই এমন এক সম্পদ যার সাথে পার্থিব কোনো সম্পদেরই তুলনা হয় না। পার্থিব সম্পদ হয়ত একদিন বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটি ভাল বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কখনও বিনষ্ট হয় না, তা চিরকাল হৃদয়ে জ্ঞানের প্রদীপটি জ্বালিয়ে রাখে।
জাগতিক সম্পর্কের মধ্যে যত আপন আছে যেমন; মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন আর বন্ধু-বান্ধব - সবাই জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বটে। কিন্তু সবার উপর মানুষের জীবনে পরম অত্যাবশ্যকীয় হ’ল বই। মানুষ কখনো না কখনো মা-বাবার আশীর্বাদ হারায়, ভাই-বোন দূরে সরে যায়, অনেক সময় বন্ধু-বান্ধবও পর হয়ে যায় এমন কী বিশ্বাসঘাতকতাও করে কিন্তু বই তথা বই থেকে আহরিত জ্ঞান মানুষকে ঋদ্ধ করে, সারাজীবন পথ দেখায়। বই হারিয়ে গেলেও এর জ্ঞান হারায় না। বই কখনো মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না। কাজেই বই পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারের কথা বলে শেষ করার নয়। তবু এই নিবন্ধে মোটাদাগে বই পড়ার কিছু উপকারীতা তুলে ধরছি:
১) বই পাঠে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়: বই পড়া নিয়ে প্রথমেই যে কথাটি বলতে হয়, তা হ’ল - বই জ্ঞানের আধার। তাই জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। একটা মানুষ যত বেশি বই পড়বে তার জ্ঞান তত বাড়বে। হাজারো অজানা তথ্যের গোলাঘর একটি বই; মানুষকে এর ভিতরে থাকা অসংখ্য তথ্যের সাথে পরিচিত করায়। আর সেইসব তথ্য বা জ্ঞান বরাবর মানুষকে সমৃদ্ধ করে, পাঠকের জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করে। সুতরাং নিষ্কলুষ জ্ঞানচর্চার জন্য বইপড়া অপরিহার্য।
২) বই পাঠে মানসিক উদ্দীপনা বাড়ে: সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সাহিত্যিক: কবি ও গবেষক প্রাবন্ধিক - Joseph Addison বলেছেন; ‘Reading is to the mind what exercise is to the body’ ৩০০ বছর পর আজ আধুনিক বিজ্ঞান এই কথাটির সত্যতা প্রমাণ করেছে। গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, বইপড়ার অভ্যাস মানুষকে “Dementia” এবং “Alzheimer’s” নামক দু’টি রোগ থেকে রক্ষা করে। ব্যায়াম যেমন শরীরকে সুস্থ রাখে তেমনি বইপড়ার মাধ্যমে মনকে সুস্থ ও আনন্দিত রাখা যায়। বই পড়ার ফলে মানব মস্তিষ্কে একজাতীয় উদ্দীপনা বা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সেই উত্তেজনাই মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে মস্তিষ্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সুস্থ থাকতে ও কর্মোদ্দীপনা বাড়াতে যেমন ব্যায়াম করা আবশ্যক তেমনি মস্তিষ্ককে সবল ও কর্মচঞ্চল রাখতে বই পড়াও বিশেষভাবে জরুরি। একটি ভালো বই যেমন মনশ্চক্ষু খুলে দেয় তেমনি জ্ঞান বুদ্ধিকে আরো শানিত ও বিকশিত করে মনের অন্ধকার কোণে আলো জ্বালাতে পারে।
৩) নিজের মধ্যে অন্যের অভিজ্ঞতা ধারণ করা: একটি বইতে লেখক তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও সাধনার নির্যাস লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন। একজন পাঠক সেই বই পাঠ করে খুব সহজেই লেখকের দীর্ঘ সাধনার লব্ধ জ্ঞানের অংশীদার হয়ে উঠেন। বহু বছরের সাধনা ও গবেষণার ফসল একটি বই সম্পন্ন করতে হয়ত লেখকের অনেক বছর লাগতে পারে কিন্তু একজন পাঠক মাত্র কয়েক ঘন্টায় তা পাঠ করে সেই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। বই পাঠে লেখকের অভিজ্ঞতা পাঠকের মাঝে সঞ্চারিত হয়। বইতে থাকা লেখক জীবনের নানান অভিজ্ঞতা ও গল্প-ঘটনা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাও পাঠককে প্রভাবিত করতে পারে।
৪) বই পাঠে মানসিক চাপ কমে: বই পড়ার মাধ্যমে আমরা মুহূর্তেই কোন অজানা জগতে পৌঁছে যেতে পারি। যা - আমাদেরকে নির্মম বাস্তবতা তথা সমাজ-সংসারের নানান দুঃখ-কষ্ট থেকে একটু হলেও রেহাই দেয়। বইপাঠে নিমগ্ন হতে পারলে খুব সহজেই বাস্তবতার অপ্রিয় বিষয়গুলো ভুলে থাকা যায়। ফলে, অপ্রিয় বাস্তবতার কারণে বেড়ে যাওয়া স্ট্রেস লেভেল অনেকটাই কমে গিয়ে মানসিক শান্তি স্বস্তি ফিরে আসে। গবেষণায় পাওয়া তথ্যানুযায়ী হাঁটা, কফি পান কিংবা গান শোনার মত কাজগুলো মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে কিন্তু বইপড়া তারো অনেক বেশি কার্যকর।
৫) আত্মবিশ্বাস বাড়ে: নতুন শব্দ এবং ভাষা শিখতেও বইপড়া আবশ্যক। বইপাঠে সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার থেকে শব্দ নিয়ে আমরা বাচনভঙ্গিকে আরো স্পষ্ট, সুন্দর ও তাৎপর্যমণ্ডিত কর তুলতে পারি। ব্যক্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন ভাল পাঠক বরাবর একজন ভাল সংযোগ রক্ষাকারী। প্রচুর বইপড়া ব্যক্তিটি অনায়েসেই অন্যের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বচ্ছন্দে আলোচনা করতে পারঙ্গম। এতে ব্যক্তিজীবন উন্নত হয় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
৬) স্মরণশক্তি বাড়ায়: একটি বই পড়তে থাকলে বইয়ের ভিতরে থাকা অগণিত তথ্য আপনা থেকেই পাঠকের মনে গেঁথে যায়। পঠিতব্য বইটির আঙ্গিক এবং উদ্দেশ্য, তাতে উল্লিখিত নানান চরিত্রের নাম, ইতিহাস, স্থান, কাল, কাহিনি-উপকাহিনি ইত্যাদির সবকিছুই মনে রাখতে হয়। তা নাহলে বইটির বিষয়াবলী পুরোপুরি উপলব্ধিতে আসবে না। আর এইসব তথ্য মনে রাখার দরুন মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়, স্বভাবতই স্মরণশক্তি বাড়ে। বইপড়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে নতুন চিন্তার সংযোগ বাড়ে, ফলে নতুন করে জানার আগ্রহও বাড়ে, তাই মনে রাখার ক্ষমতাও বাড়ে।
৭) কল্পনাশক্তি বাড়ায়: বইপড়া মানুষের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করে। একটি বইয়ে বিচিত্র জগতের নানান বর্ণনায় হরেক চিত্র থাকে। বইটি পড়ার মাধ্যমে সেই জগতের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ স্থাপিত হয়। বইয়ের ভিতরে থাকা নানান জগতের নানান চিত্র, নতুনভাবে পাঠকের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে। ফলে পাঠকের মনোজগতের কল্পনাশক্তিও বৃদ্ধি পায়। বইপড়া কখনো কখনো পাঠককে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কিংবা অবকাশ যাপনের আনন্দও দিয়ে থাকে। বইপড়ার মাধ্যমে ঘরে বসে আনায়েসেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাওয়া যায়। সশরীরে কোথাও না গিয়েও সেই স্থানের দৃশ্যাবলী পাঠকের মানসনেত্রে ফুটে উঠে। তাই, ঘরে বসেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। প্রাণ-মন প্রফুল্ল হয়।
৮) শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করে: একজন লেখক যখন বই লিখেন তিনি অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। নান্দনিক শব্দ ও ভাষার সুন্দর প্রয়োগে বইটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে তিনি প্রচুর গবেষণা করে থাকেন। বইপড়ার মাধ্যমে আমরা সেই শব্দগুলো সহজেই শিখে নিতে পারি। দেশি বিদেশি বিভিন্ন ভাষার বই পড়ে নতুন নতুন শব্দের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আমরা শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারি।
৯) লেখনীশক্তি বাড়ায়: নিয়মিত বই পড়ার ফলে ভাবনার চর্চা ও প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ে। সুন্দর কথা বলার মতই লেখনীর দক্ষতাও বাড়ে। বিভিন্ন লেখকের লেখনশৈলীর সঙ্গে পরিচয় ঘটার ফলে নিজস্ব লেখনীশক্তি বাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় নিজের লেখায়ও আপন স্বাতন্ত্রতা তৈরি হয়।
১০) একাগ্রতা বাড়ায়: রোজ নিয়ম করে বই পড়লে মনোনিবেশ ক্ষমতা বাড়ে। আধুনিক গবেষণায় পাওয়া যায় যে, ক্রমাগত ভার্চুয়াল জগতে বিচরণের ফলে যেমন মনের মনোযোগ ক্ষমতা কমতে থাকে তেমনি বহুমুখী কাজের চাপ বাড়তে থাকে। ফলে স্ট্রেস লেভেল বেড়ে গিয়ে মনের সৃজনশীল ক্ষমতা কমতে থাকে। তখন একটা গল্পের বই পড়লে মনোযোগ সেই বইয়ের ভিতরের জগতের সাথে যুক্ত হয়ে একাগ্রতাশক্তি বাড়ে।
১১) জটিল চিন্তার জট ছাড়ায়: বই পড়ার আর একটি উপকারিতা হলো এর মাধ্যমে জটিল বিষয়াদির ভাবনাও সহজ হয়ে উঠে, জটিল চিন্তার জট সহজে ছাড়ে। অঙ্ক করা, পাজ্ল গেম খেলা কিংবা গোয়েন্দা উপন্যাসে চিত্রিত রহস্য উদঘাটনের চিন্তা মনকে নানান সমাধানের ইঙ্গিত করে। ফলে মস্তিষ্ক আরো তেজোদ্দীপ্ত হয় এবং চিন্তার ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ে।
১২) মানসিক প্রশান্তি আনে: পছন্দের যেকোন বইপাঠে মন শান্ত হয়, প্রশান্তি আসে। বিশেষ করে ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক চেতনার বই মনে বেশি প্রশান্তি আনে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বই পড়লে রক্তচাপ অনেকটাই কমে যায়। বইপাঠ তখন হতাশায় লিপ্ত মনকে প্রশান্তির পথ দেখায়।
১৩) সহানুভূতি বোধ বাড়ে: সহানুভূতিপূর্ণ মানসিকতার জন্য বইপড়া উত্তম। স্বভাবগত ভাবেই মানুষের মন খুব অনুভূতিপ্রবণ। কল্পনানির্ভর বই হলেও বিধৃত চরিত্রের সুখ-দুঃখের সাথে পাঠকের অনুভূতির নিবিড় একাত্মবোধ গড়ে উঠে। অপরের সুখ-দুঃখেও তার মন প্রভাবিত হয়। বাস্তব জীবনে তাই এসব মানুষ বেশ সহানুভূতিপ্রবণ হৃদয়ের হয়ে থাকেন।
১৪) আত্মসম্মানবোধ তৈরি করে: ‘Books are the mirrors of the soul’ বৃটিশ ঔপন্যাসিক ও প্রবন্ধিক Virginia Woolf যেমন বলেছেন; বই আত্মার দর্পন। একটি বইতে লেখকের আত্মগত দর্শন ও মতামতের প্রকাশ ঘটে যা - পাঠককেও প্রভাবিত করে। চলমান সমাজে সংঘটিত ঘটনাবলীর বিশ্লেষণাত্মক উপস্থাপন থেকে মানবিক গুণাবলীর মূল্যটুকু মনের দর্পনে ধরা পড়ে। নিজের মধ্যেও আত্মসম্মানবোধ প্রখর হয়। তাই নিজের প্রতি সম্মান জানাতে পারা ব্যক্তিটি সহজেই অন্যের প্রতিও সম্মান জানাতে পারে।
১৫) সংলাপের দক্ষতা বাড়ে: বক্তৃতা কিংবা নাটক সিনেমা থেকেও সংলাপের দক্ষতা বাড়ে তবে একথা অনস্বীকার্য যে, যথোপযুক্ত শব্দের যথার্থ প্রয়োগ একমাত্র বইপড়ার মাধ্যমেই ভাল শেখা যায়। আর বাস্তব জীবনে কথায় কিংবা লিখনে সেসবের যথোপযুক্ত প্রয়োগে যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানো যায়। অন্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যুক্তিযুক্ত শব্দ প্রয়োগে আলোচনার উৎকর্ষতাও বাড়ে।
১৬) ভাল ঘুম হতে সাহায্য করে: অনেকেরই নানান কারণে ঘুমের সমস্যা হয়। ঘুমানোর আগে একটা ভাল বই পড়তে থাকলে মস্তিষ্ককের কোষগুলো সুস্থির হয় আর শান্তভাবে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে থাকে। তখন সহজেই ঘুম চলে আসে। মস্তিষ্কে প্রশান্তির ফলে গাঢ় ঘুম হওয়ার প্রবণতাও তৈরি হয়। সুতরাং প্রযুক্তিনির্ভর সোশ্যাল মিডিয়ার এডিকশন থেকে বাঁচতে বইপড়া একটি অন্যতম পন্থাও হতে পারে।
সবশেষে একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মানুষের জীবনে বই এক পরম বন্ধু। অপরাপর বিষয় বা বস্তু থেকে প্রাপ্ত উপকার ক্ষয় হয়ে যেতে পারে কিন্তু বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান চিরঅক্ষয়। সুতরাং বই হোক জীবনের নিত্য দোসর।
----------------------------------------------------------
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর কর্মকাণ্ড এবং বিনোদনে লিপ্ত হওয়ার কারণে দিনে দিনে বই পড়ার চর্চা কমে আসছে। অথচ জীবন লালনে ও পরিচর্যায় যে বই পড়া কত প্রয়োজন তা বলে শেষ করার নয়। জীবন থেকে বইকে বাদ দেয়া মানে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় একটা প্রয়োজনকে বাদ দেয়া। পারতপক্ষে এবং সজ্ঞানে নিজের এই সর্বনাশ ডেকে আনা কারোরই কাম্য নয়। বই এমন এক সম্পদ যার সাথে পার্থিব কোনো সম্পদেরই তুলনা হয় না। পার্থিব সম্পদ হয়ত একদিন বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটি ভাল বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কখনও বিনষ্ট হয় না, তা চিরকাল হৃদয়ে জ্ঞানের প্রদীপটি জ্বালিয়ে রাখে।
জাগতিক সম্পর্কের মধ্যে যত আপন আছে যেমন; মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন আর বন্ধু-বান্ধব - সবাই জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বটে। কিন্তু সবার উপর মানুষের জীবনে পরম অত্যাবশ্যকীয় হ’ল বই। মানুষ কখনো না কখনো মা-বাবার আশীর্বাদ হারায়, ভাই-বোন দূরে সরে যায়, অনেক সময় বন্ধু-বান্ধবও পর হয়ে যায় এমন কী বিশ্বাসঘাতকতাও করে কিন্তু বই তথা বই থেকে আহরিত জ্ঞান মানুষকে ঋদ্ধ করে, সারাজীবন পথ দেখায়। বই হারিয়ে গেলেও এর জ্ঞান হারায় না। বই কখনো মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না। কাজেই বই পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারের কথা বলে শেষ করার নয়। তবু এই নিবন্ধে মোটাদাগে বই পড়ার কিছু উপকারীতা তুলে ধরছি:
১) বই পাঠে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়: বই পড়া নিয়ে প্রথমেই যে কথাটি বলতে হয়, তা হ’ল - বই জ্ঞানের আধার। তাই জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির জন্য বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। একটা মানুষ যত বেশি বই পড়বে তার জ্ঞান তত বাড়বে। হাজারো অজানা তথ্যের গোলাঘর একটি বই; মানুষকে এর ভিতরে থাকা অসংখ্য তথ্যের সাথে পরিচিত করায়। আর সেইসব তথ্য বা জ্ঞান বরাবর মানুষকে সমৃদ্ধ করে, পাঠকের জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করে। সুতরাং নিষ্কলুষ জ্ঞানচর্চার জন্য বইপড়া অপরিহার্য।
২) বই পাঠে মানসিক উদ্দীপনা বাড়ে: সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সাহিত্যিক: কবি ও গবেষক প্রাবন্ধিক - Joseph Addison বলেছেন; ‘Reading is to the mind what exercise is to the body’ ৩০০ বছর পর আজ আধুনিক বিজ্ঞান এই কথাটির সত্যতা প্রমাণ করেছে। গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, বইপড়ার অভ্যাস মানুষকে “Dementia” এবং “Alzheimer’s” নামক দু’টি রোগ থেকে রক্ষা করে। ব্যায়াম যেমন শরীরকে সুস্থ রাখে তেমনি বইপড়ার মাধ্যমে মনকে সুস্থ ও আনন্দিত রাখা যায়। বই পড়ার ফলে মানব মস্তিষ্কে একজাতীয় উদ্দীপনা বা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সেই উত্তেজনাই মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে মস্তিষ্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সুস্থ থাকতে ও কর্মোদ্দীপনা বাড়াতে যেমন ব্যায়াম করা আবশ্যক তেমনি মস্তিষ্ককে সবল ও কর্মচঞ্চল রাখতে বই পড়াও বিশেষভাবে জরুরি। একটি ভালো বই যেমন মনশ্চক্ষু খুলে দেয় তেমনি জ্ঞান বুদ্ধিকে আরো শানিত ও বিকশিত করে মনের অন্ধকার কোণে আলো জ্বালাতে পারে।
৩) নিজের মধ্যে অন্যের অভিজ্ঞতা ধারণ করা: একটি বইতে লেখক তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও সাধনার নির্যাস লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেন। একজন পাঠক সেই বই পাঠ করে খুব সহজেই লেখকের দীর্ঘ সাধনার লব্ধ জ্ঞানের অংশীদার হয়ে উঠেন। বহু বছরের সাধনা ও গবেষণার ফসল একটি বই সম্পন্ন করতে হয়ত লেখকের অনেক বছর লাগতে পারে কিন্তু একজন পাঠক মাত্র কয়েক ঘন্টায় তা পাঠ করে সেই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। বই পাঠে লেখকের অভিজ্ঞতা পাঠকের মাঝে সঞ্চারিত হয়। বইতে থাকা লেখক জীবনের নানান অভিজ্ঞতা ও গল্প-ঘটনা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাও পাঠককে প্রভাবিত করতে পারে।
৪) বই পাঠে মানসিক চাপ কমে: বই পড়ার মাধ্যমে আমরা মুহূর্তেই কোন অজানা জগতে পৌঁছে যেতে পারি। যা - আমাদেরকে নির্মম বাস্তবতা তথা সমাজ-সংসারের নানান দুঃখ-কষ্ট থেকে একটু হলেও রেহাই দেয়। বইপাঠে নিমগ্ন হতে পারলে খুব সহজেই বাস্তবতার অপ্রিয় বিষয়গুলো ভুলে থাকা যায়। ফলে, অপ্রিয় বাস্তবতার কারণে বেড়ে যাওয়া স্ট্রেস লেভেল অনেকটাই কমে গিয়ে মানসিক শান্তি স্বস্তি ফিরে আসে। গবেষণায় পাওয়া তথ্যানুযায়ী হাঁটা, কফি পান কিংবা গান শোনার মত কাজগুলো মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে কিন্তু বইপড়া তারো অনেক বেশি কার্যকর।
৫) আত্মবিশ্বাস বাড়ে: নতুন শব্দ এবং ভাষা শিখতেও বইপড়া আবশ্যক। বইপাঠে সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার থেকে শব্দ নিয়ে আমরা বাচনভঙ্গিকে আরো স্পষ্ট, সুন্দর ও তাৎপর্যমণ্ডিত কর তুলতে পারি। ব্যক্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন ভাল পাঠক বরাবর একজন ভাল সংযোগ রক্ষাকারী। প্রচুর বইপড়া ব্যক্তিটি অনায়েসেই অন্যের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বচ্ছন্দে আলোচনা করতে পারঙ্গম। এতে ব্যক্তিজীবন উন্নত হয় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
৬) স্মরণশক্তি বাড়ায়: একটি বই পড়তে থাকলে বইয়ের ভিতরে থাকা অগণিত তথ্য আপনা থেকেই পাঠকের মনে গেঁথে যায়। পঠিতব্য বইটির আঙ্গিক এবং উদ্দেশ্য, তাতে উল্লিখিত নানান চরিত্রের নাম, ইতিহাস, স্থান, কাল, কাহিনি-উপকাহিনি ইত্যাদির সবকিছুই মনে রাখতে হয়। তা নাহলে বইটির বিষয়াবলী পুরোপুরি উপলব্ধিতে আসবে না। আর এইসব তথ্য মনে রাখার দরুন মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়, স্বভাবতই স্মরণশক্তি বাড়ে। বইপড়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে নতুন চিন্তার সংযোগ বাড়ে, ফলে নতুন করে জানার আগ্রহও বাড়ে, তাই মনে রাখার ক্ষমতাও বাড়ে।
৭) কল্পনাশক্তি বাড়ায়: বইপড়া মানুষের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করে। একটি বইয়ে বিচিত্র জগতের নানান বর্ণনায় হরেক চিত্র থাকে। বইটি পড়ার মাধ্যমে সেই জগতের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ স্থাপিত হয়। বইয়ের ভিতরে থাকা নানান জগতের নানান চিত্র, নতুনভাবে পাঠকের উপলব্ধিতে ধরা পড়ে। ফলে পাঠকের মনোজগতের কল্পনাশক্তিও বৃদ্ধি পায়। বইপড়া কখনো কখনো পাঠককে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কিংবা অবকাশ যাপনের আনন্দও দিয়ে থাকে। বইপড়ার মাধ্যমে ঘরে বসে আনায়েসেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাওয়া যায়। সশরীরে কোথাও না গিয়েও সেই স্থানের দৃশ্যাবলী পাঠকের মানসনেত্রে ফুটে উঠে। তাই, ঘরে বসেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। প্রাণ-মন প্রফুল্ল হয়।
৮) শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করে: একজন লেখক যখন বই লিখেন তিনি অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। নান্দনিক শব্দ ও ভাষার সুন্দর প্রয়োগে বইটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে তিনি প্রচুর গবেষণা করে থাকেন। বইপড়ার মাধ্যমে আমরা সেই শব্দগুলো সহজেই শিখে নিতে পারি। দেশি বিদেশি বিভিন্ন ভাষার বই পড়ে নতুন নতুন শব্দের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আমরা শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারি।
৯) লেখনীশক্তি বাড়ায়: নিয়মিত বই পড়ার ফলে ভাবনার চর্চা ও প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ে। সুন্দর কথা বলার মতই লেখনীর দক্ষতাও বাড়ে। বিভিন্ন লেখকের লেখনশৈলীর সঙ্গে পরিচয় ঘটার ফলে নিজস্ব লেখনীশক্তি বাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় নিজের লেখায়ও আপন স্বাতন্ত্রতা তৈরি হয়।
১০) একাগ্রতা বাড়ায়: রোজ নিয়ম করে বই পড়লে মনোনিবেশ ক্ষমতা বাড়ে। আধুনিক গবেষণায় পাওয়া যায় যে, ক্রমাগত ভার্চুয়াল জগতে বিচরণের ফলে যেমন মনের মনোযোগ ক্ষমতা কমতে থাকে তেমনি বহুমুখী কাজের চাপ বাড়তে থাকে। ফলে স্ট্রেস লেভেল বেড়ে গিয়ে মনের সৃজনশীল ক্ষমতা কমতে থাকে। তখন একটা গল্পের বই পড়লে মনোযোগ সেই বইয়ের ভিতরের জগতের সাথে যুক্ত হয়ে একাগ্রতাশক্তি বাড়ে।
১১) জটিল চিন্তার জট ছাড়ায়: বই পড়ার আর একটি উপকারিতা হলো এর মাধ্যমে জটিল বিষয়াদির ভাবনাও সহজ হয়ে উঠে, জটিল চিন্তার জট সহজে ছাড়ে। অঙ্ক করা, পাজ্ল গেম খেলা কিংবা গোয়েন্দা উপন্যাসে চিত্রিত রহস্য উদঘাটনের চিন্তা মনকে নানান সমাধানের ইঙ্গিত করে। ফলে মস্তিষ্ক আরো তেজোদ্দীপ্ত হয় এবং চিন্তার ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ে।
১২) মানসিক প্রশান্তি আনে: পছন্দের যেকোন বইপাঠে মন শান্ত হয়, প্রশান্তি আসে। বিশেষ করে ধর্মীয় কিংবা আধ্যাত্মিক চেতনার বই মনে বেশি প্রশান্তি আনে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বই পড়লে রক্তচাপ অনেকটাই কমে যায়। বইপাঠ তখন হতাশায় লিপ্ত মনকে প্রশান্তির পথ দেখায়।
১৩) সহানুভূতি বোধ বাড়ে: সহানুভূতিপূর্ণ মানসিকতার জন্য বইপড়া উত্তম। স্বভাবগত ভাবেই মানুষের মন খুব অনুভূতিপ্রবণ। কল্পনানির্ভর বই হলেও বিধৃত চরিত্রের সুখ-দুঃখের সাথে পাঠকের অনুভূতির নিবিড় একাত্মবোধ গড়ে উঠে। অপরের সুখ-দুঃখেও তার মন প্রভাবিত হয়। বাস্তব জীবনে তাই এসব মানুষ বেশ সহানুভূতিপ্রবণ হৃদয়ের হয়ে থাকেন।
১৪) আত্মসম্মানবোধ তৈরি করে: ‘Books are the mirrors of the soul’ বৃটিশ ঔপন্যাসিক ও প্রবন্ধিক Virginia Woolf যেমন বলেছেন; বই আত্মার দর্পন। একটি বইতে লেখকের আত্মগত দর্শন ও মতামতের প্রকাশ ঘটে যা - পাঠককেও প্রভাবিত করে। চলমান সমাজে সংঘটিত ঘটনাবলীর বিশ্লেষণাত্মক উপস্থাপন থেকে মানবিক গুণাবলীর মূল্যটুকু মনের দর্পনে ধরা পড়ে। নিজের মধ্যেও আত্মসম্মানবোধ প্রখর হয়। তাই নিজের প্রতি সম্মান জানাতে পারা ব্যক্তিটি সহজেই অন্যের প্রতিও সম্মান জানাতে পারে।
১৫) সংলাপের দক্ষতা বাড়ে: বক্তৃতা কিংবা নাটক সিনেমা থেকেও সংলাপের দক্ষতা বাড়ে তবে একথা অনস্বীকার্য যে, যথোপযুক্ত শব্দের যথার্থ প্রয়োগ একমাত্র বইপড়ার মাধ্যমেই ভাল শেখা যায়। আর বাস্তব জীবনে কথায় কিংবা লিখনে সেসবের যথোপযুক্ত প্রয়োগে যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানো যায়। অন্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যুক্তিযুক্ত শব্দ প্রয়োগে আলোচনার উৎকর্ষতাও বাড়ে।
১৬) ভাল ঘুম হতে সাহায্য করে: অনেকেরই নানান কারণে ঘুমের সমস্যা হয়। ঘুমানোর আগে একটা ভাল বই পড়তে থাকলে মস্তিষ্ককের কোষগুলো সুস্থির হয় আর শান্তভাবে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে থাকে। তখন সহজেই ঘুম চলে আসে। মস্তিষ্কে প্রশান্তির ফলে গাঢ় ঘুম হওয়ার প্রবণতাও তৈরি হয়। সুতরাং প্রযুক্তিনির্ভর সোশ্যাল মিডিয়ার এডিকশন থেকে বাঁচতে বইপড়া একটি অন্যতম পন্থাও হতে পারে।
সবশেষে একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মানুষের জীবনে বই এক পরম বন্ধু। অপরাপর বিষয় বা বস্তু থেকে প্রাপ্ত উপকার ক্ষয় হয়ে যেতে পারে কিন্তু বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান চিরঅক্ষয়। সুতরাং বই হোক জীবনের নিত্য দোসর।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১২/০৪/২০২১ভালো লিখেছেন।
-
এম এম হোসেন ২৩/০৩/২০২১সত্য প্রকাশ
-
আশরাফুল হক মহিন ২০/০৩/২০২১Nice post
-
নাসরীন আক্তার রুবি ১৯/০৩/২০২১সুচিন্তিত উপস্থাপন
-
আশরাফুল হক মহিন ১৯/০৩/২০২১Nice
-
এম এম হোসেন ১৩/০৩/২০২১Nice post
-
আশরাফুল হক মহিন ১৩/০৩/২০২১nice..
-
সাখাওয়াত হোসেন ১৩/০৩/২০২১দারুণ লিখেছেন ভাইয়া
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ১১/০৩/২০২১Good.
-
ফয়জুল মহী ১১/০৩/২০২১শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা অবিরত I