বানভাসি হৃদয়ের কান্না
এক -
বৃষ্টিস্নাত কোন এক নিঝুম সন্ধ্যায় - কাকলি মুখর পাখিরা যখন কুলায় ফিরে, তুমিও ঘরমুখী। এমনি লগ্নে যদি কখনো দেখা হয়ে যায়, কী বলবে তুমি? জানতে চাইবে কেমন আছি? না কি, ঠুনকো ব্যস্ততায় মুখ ফিরিয়ে ট্যাক্সি ডাকতে উতলা হবে? অথবা - তোমার চিরায়ত ভব্যতা বজায় রেখে ছোট্ট এক টুকরো অস্ফুট হাসি...
সত্যিই তো! যাকে একবার ত্যাগ করেছ, তাকে কেন মনে রাখবে আর? হাজার কোটা শরতাকাশের বিচূর্ণ মেঘের মত - মনোভূমের ভাঙা মুকুরে জেগে আছে আজও বিক্ষিপ্ত স্মৃতির খণ্ডাংশ... আর আত্মা সাক্ষী, হৃদয়ের টান বলে কোন দিন বুঝি ছিল না কিছু? টান আমার একটা ছিল বটে; পতঙ্গের মত আগুনে আত্মাহুতি দেয়ার। কিন্তু তা কি ভেবেছিলাম; এই আহুতিই হবে আমার স্বপ্নের কবর?
শৈষবটি ছিল বেশ; বাবার বাড়িতে আদরে-আহ্লাদে বড় হয়েছি, যাকে বলে লাই পাওয়া - সে লাই আমিও পেয়ে এসেছি বরাবর। আর পাঁচটি স্বপ্নবাদী মানুষের মতই
স্বপ্নের মানুষটিকে ঘিরে স্বপ্নও বুনেছি ঢের। তবে কিনা, আমি ছিলাম আমার মতই তুমি তোমার মত। তুমি ছিলে বেতস পাতার পরিপাটিতে নিটোল বাস্তববাদী, আমি - খানিকটা উড়নচণ্ডি, একটু উদাসীনও। তাই বুঝি, তেলে জলে মিশ খায়নি কখনো!
... ব্যথাতুর জীবনের বোবা কান্নায় ভুগছি নিয়ত।
দুই -
স্বপ্নগুলো ভেবে ভেবে যখন শিহরিত হতে আমিও হতাম - কখন তুমি আমার হবে? স্বপ্নের সারথী - আমার বংশবদ; চলবে? ঠিক আমার স্বপ্নের পথটি বেয়ে। কিন্তু খরস্রোতা নদী যে তটিনীর আকাঙ্ক্ষা বোঝে না! তা কি জানতাম সেদিন? তাইতো আমার স্বভাবগত বৃত্ত-বলয়ের বাইরে ফিরে দেখার কোনও তাগিদ বোধ করিনি কখনো। যেমনটি ছিল আমাদের যৌথ পরিবারে; বাবা-মা আর ঘরভরা ভাই-বোন সবাই ছিল আমার একনিষ্ঠ অনুরক্ত - আমি ছিলাম সুখের পালে হাওয়া লাগা স্বপ্নের ভরা তরণী।
কথার ফাঁকে ফাঁকে তুমি স্বপ্নের জাল বুনতে আর সেসব স্বপ্নে আমাকে জড়াতে। আমারো স্বপ্ন ছিল তবে তা আমার মত করে। একান্ত স্বপ্ন বুঝি একটাই ছিল; আর তা হল তোমায় একচ্ছত্র দখলে পাওয়া, করায়ত্ব করা। বলো, তা কি আমার দোষ ছিল? কে না-চাইবে মিষ্টি আমের স্বাদ নিতে? আম যত মধুরই হোক, কেউ কি আঁটি সমেত খায়? আমিও বুঝি তেমনটিই চেয়েছিলাম? আঁটি ফেলে আমের মধু-রসটুকু...
আজ বুঝতে পারি, পতঙ্গ আগুনে আহুতি দেয় কেন? সে জানে না; আলোর ঔজ্জ্বলতা কেন তাকে টানে এত! চোখ ধাঁধানো আগুনের লেলিহান শিখা - যতই জীবনঘাতী হোক, পতঙ্গ কিন্তু ভালোবেসেই ঝাঁপ দেয়। যেমন আমিও ঝাঁপ দিয়েছিলাম, ভালোবেসেছিলাম; আগুনের আঁচে দগ্ধ হতে নয়, আগুনের প্রোজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হতে। কিন্তু নিটোল বাস্তবতায় - গনগনে আগুনের আঁচে আমাকে পুড়ে মরতে হল! জানি না - কেন? কোন সে অপরাধে?
তিন -
বিশ্বাস কর আর না-ই কর, তোমার সাথে কিন্তু প্রতারণা করিনি আমি। যদিও একটা সত্য অনেক পরে বোঝেছি; তোমার পরিপুষ্ট জীবনের নির্যাস আর যশ-খ্যাতির ভাগিদারই হতে চেয়েছিলাম। তবে, তা ঠিক আমার মত করেই। সেইসাথে ছিল বুঝি প্রেমহীন কিছু ভালোবাসাও ! কেন, এত চৌকষ দৃষ্টি তোমার তবু কি দেখ না - খ্যাতিমান সার্থক প্রবর যারা কতটা নির্ভরশীল তাদের দয়িতার 'পরে?
তোমার সুর, তোমার গান, কবিতার প্রতি নিটোল আসক্তি তার উপর তোমার মোহনীয় ব্যক্তিত্ব আর ছন্দোবদ্ধ গোছানো পারিপাট্যতা! যেন ছকে ফেলা সামরিক জীবন! - উফ্, কী বিভৎস মনোরম! সেসব যত না আমায় মোহিত করত তারো বেশি যেন শ্বাসরোধ করে দিতে চাইত। সততই সেসব আমায় অবজ্ঞার তীরে বিদ্ধ করত। কিছুতেই স্বস্তি পেতাম না কখনো।
একটা সময় এল যখন দুটি মন আর এক হয়ে কোন কিছুতেই বোঝা-পড়ার প্রয়োজন হত না বড়। তাই বুঝি কিছুতেই আমার সাহায্য চাওনি, নাওনি। নিজের প্রয়োজন মত সবকিছু নিজেই ম্যানেজ করে নিতে, গুছিয়ে নিতে! আমি খুব অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলাম, অপমান বোধ করতাম আর মনে মনে ঈর্ষার আগুনে জ্বলতাম। কেন জানি মনে হতো; পুরুষ মানুষ... এতো...?
চার -
এযুগেরই মেয়ে আমি, যুগের হাওয়ার বৈরী তো ছিলাম না! এযুগের মেয়েরা কী চায় জান তো? মনের মানুষটি তার উপর নির্ভর করুক, আস্থা বিশ্বাসে ভরসা রাখুক।
হয়তো আমিও তেমনই চাইতাম, তা কি দোষের ছিল? কেন তুমি আমার উপর একটু নির্ভর করবে না, ভরসা রাখবে না? আর নির্ভর না করা মানে তো - একজাতীয় আস্থাহীনতা! নয় কি? কিন্তু তোমার সময় বাস্তবতা বুঝি কোনদিনই আমাকে পড়তে পারেনি। কী জানি, হয়তো আমিও নই কখনো!
তোমার আচরণ, কর্মকাণ্ড, সবজানা মনোভাব আর অবলীলায় যেকোন কাজ নিজের মত করে ফেলার মত ব্যক্তিত্ব তাই কখনো মোহমুগ্ধ করেনি আমাকে। কষ্ট পেতাম, কিন্তু ভাল না-লাগলেও প্রকাশ করতাম না কিছু।
তোমার কাছে এলে, কেন জানি নিজেকে বড় নিস্প্রভ মনে হত। তাই, দূরে দূরে থাকটাই শ্রেয় মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু এই দূরে থাকা যে এভাবে তোমাকে আমার আঁচল মুক্ত করে ছিনিয়ে নিবে, এত দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে তা কি জানতাম সেদিন? সময়ের বিবরে চলে যাওয়া সেইসব দিনের কথা স্মরণ করে তাই আজও ব্যথাহত হই!
পাঁচ -
তুমি বুঝি ছিলে আগুনের সুপ্ত শিখা! তা না হলে, কাছাকাছি এলেই শরীর মনে কেন আগুনের আঁচ অনুভব করতাম? অনেক পরে হলেও আজ বুঝেছি - তোমাকে নয়, বুঝি ভালোবেসেছিলাম আগুনের জ্বলন্ত শিখাকেই। অথচ তার উত্তাপ সহনের মত যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল না বুঝি আমার! তাইতো সেই আঁচে কখনো উদ্দীপ্ত হইনি, ঝলসে গেছি! আমাকে যে এভাবে পুড়ে মরতে হবে তা কি জানতাম কোন দিনই?
সূর্য প্রভায় প্রদীপ্ত তোমার যেমন ছিল চাঁদের আসক্তি, আর আমার ছিল চাঁদির। দুই বিপরীত মেরুর চাহিদা-প্রাকার - যেন, তেল আর জল। তাইতো, দুইয়ে মিলে ঘর বানালেও সন্ধি হয়নি কোন দিনই। বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল। অনেক পরে যখন বোঝেছি - ততদিনে সবই শেষ; চলে গিয়েছ তুমি বাস্তু খুঁটি ছেড়ে বহু দূরে!
কী জানি এক বোবা অভিমানে ক্রমে ক্রমে নিজেকে আমা থেকে বিযুক্ত করে সরিয়ে নিয়েছিলে তুমি! আমি বুঝিনি! ভেবেছিলাম, এই টানাপোড়েন সাময়িক বিষয়। কতদিন আর ওভাবে চলতে পারবে? জগতের স্বাভাবিক নিয়মে ঠিক ফিরে আসবেই একদিন। তাই তোমার মানের পরিমাপ করতে যাইনি। অভিমান আমারো কম ছিল না! কিন্তু তোমার ঐ অভিমানের কাছে তা যে কী মূল্যহীন বুঝতে পারিনি তখনো।
ছয় -
ভালোবাসার মিঠেসুর কালে-ক্রমে কঠোরতায় রূপ পেল। প্রেম-রোমাঞ্চের কোমল ননীও যেন কটা স্বাদের শক্ত এক ফাঁপা পানিরের রূপ নিল। স্বপ্ন ভাঙ্গার দোষে একদা অভিযুক্তও হলাম। আস্থার ভূমিটি তখন চৈতি খরার ফাটলে মুখ-ব্যাদান। তুমি গান ছাড়লে, চিত্রকলা ত্যাগ করলে, কবিতাকে নির্বাসনে পাঠালে। আর এর সবই নাকি আমারই কারণে?
প্রেমের জন্যে শুনেছি, প্রিয়তমকে ভালোবেসে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করে, রাজাও ছাড়তে পারে রাজ সিংহাসন। আর তুমি কি-না ওইটুকুতেই নাচার হবে? তা যে বিশ্বাসে আসতে চায়নি কখনো। তাতেই আমার জেদ আরো গেল বেড়ে। ভাবনার বলয়টা যেন অতর্কিতেই মোড় নিল বৈরী স্রোতের অনুকূলে। আর সেই স্রোতে গা ছেড়ে দিয়ে আমরা অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমালাম...
আস্তে আস্তে যখন সবকিছু ফিরিয়ে নিচ্ছিলে - আস্থার মঞ্চটি আমার টলে টলে উঠছিল বারবার। ক্ষোভে অপমানে হিতাহীত ভুলে গিয়েছিলাম, নিজেকে মনে হত তোমার পথের কাঁটা। তেলে-জলের বৈরীত্বটা তখন যেন হোমানলের অদৃশ্য আঁচে রূপান্তরিত হল! আর সে আঁচের দহন ছিল এমনই অসহনীয় যে কেউ বুঝি আর কাউকে সয়ে নিতে পারছিলাম না। পরিণামে যা হবার তাই হল।
প্রেমে ও সুখে, যে প্রাচুর্যতা একদিন দিয়েছিলে সবই তার ফিরিয়ে নিলেও মনের ব্যথা-স্মৃতিগুলো ঠিকই রয়ে গেল। ফিরিয়েই নিবে যদি দিয়েছিলে কেন তবে? পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বিমূঢ় আমি রাগে, ক্ষোভে-দুঃখে তখন স্ফুটনোন্মুখ। হয়ে উঠলাম আরো দুর্বিনীত, আরো আগ্রাসী। তাই তো, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নিঃসঙ্গ আশ্রিতের মতই অনেকটা কাল বিভক্ত ছিলাম আরো।
সাত -
তোমার মুখে যেদিন শুনতে পেলাম; 'ভালোবাসতেও সুকোমল মন লাগে' আর আমার মন না-কি চুন-সুরকির ঢালাই! শোনে আমি রাগে-ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গেলাম।অপমানের জ্বালা হজম করতে কাজের ছল-ছুতোয় তোমার সাহচার্য এড়িয়ে চলতে থাকলাম। স্বভাবতই ডুবে থাকতাম নিত্যকর্মের অহেতুক ভিড়ে। তাই একই বাড়িতে থেকেও আমরা হয়ে উঠলাম দুই ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তুমি ডুব দিলে ভাব-জগতের অতিন্দ্রীয় সাগরে আর আমি ফুটন্ত তেলে সাঁতার কাটা মাছ!
পনেরটি বছর - আমার চোখে ঘুম নেই, মনে শান্তি নেই। নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে নিঃসীম শূন্যতাকে বুকে নিয়ে বেঁচে আছি। হাজারো ভিড় কোলাহলেও নিজেকে মনে হত বড় একা। আজ বুঝতে পারি; এতকাল তুমি আমার পাশেই ছিলে অথচ, তোমার ছায়াটুকুও পড়েনি চেখে!
তোমার সৃষ্টিশীল মেধা আর চারিত্রিক গুণাবলীতে কাউকে বিমুগ্ধ হতে দেখলে কেন এত জ্বালা অনুভব করতাম জানি না! তোমার সৃজনশীলতা আমায় দগ্ধ করত অবজ্ঞা করার মতই। আর ওই গাত্রদাহ জুড়াতে কী এক কুক্ষণে যে একদিন বলে ফেলেছিলাম; 'তোমার অহংকারের মূল - তোমার মেধা আর সম্পদ। তুমি অনেক চাঁদ আর চাঁদির মালিক, সেই গর্বে তোমার পা পড়তে চায় না মাটিতে'।
একথা শোনে - শুধু অসহায়ের মত বুক চাপড়ে ডুকরে কাঁদলে তুমি। যদিও কোন গূঢ়ার্থে বলিনি তবু মিথ্যে বলব না, এক সিংহপুরুষের অসহায় কান্নার দৃশ্যটা সেদিন তাকে জব্দ করতে পারার ছেলেমানুষি তৃপ্তি দিয়েছিল আমায়। হাস্যকর হলেও উপভোগ করেছিলাম বেশ।
আট -
হায় স্বপ্নের চাঁদি; যা - প্রতিটি মানুষের জীবনেই সুখ-ভোগের ঠিকানা, আভিজাত্যের চাবি-কাঠি। অর্থ-কড়ি, সোনা-দানায় যদিও আমার তেমন বিশেষ ঝোঁক ছিল না তাই বলে অর্থ-সম্পদের আশীর্বাদকে অস্বীকার করার মত বোকাও ছিলাম না নিশ্চয়! তবু অর্থ বিষয়ক একটি মাত্র খোঁচায় এত দ্রুত পর হয়ে গেলে? তুমিই বলো, এযুগে চাঁদ না হোক চাঁদি ছাড়া কি দুনিয়া চলে?
ওই চাঁদ আর চাঁদির জৌলুস কেন জানি আমাকে তেমন টানে না কখনোই। আমায় তুমি যত নির্বোধই ভাবো না কেন আমি কি এতই বোকা? তুমি বুঝতে ভুল করেছ; তোমার ওই চাঁদ এবং চাঁদির বৈভব কি আমার কাছেও কম উপভোগ্য ছিল? তবে সত্য বলতে কি, ওসবের কাছে বরাবর নিজেকে খুব নিস্প্রভ মনে হত আর ঈর্ষাটাও যেত বেড়ে।
তুমি কি বোঝতে পার না; 'টাকার গরমে অহংকারী' বলাটা কি আর আমার মনের কথা ছিল? নেহাতই তোমায় জব্দ করতে বলা। অমন কত কথাই তো তুমিও আমায় বলতে? সত্যি বলছি, সেই প্রথম বারের মত তোমায় জব্দ করতে পারায় মজাও পেয়েছিলাম বেশ। কিন্তু আমার সেই কথাতে যে করবী ফুলের বিষ লুকোনো ছিল তা কি জানতাম তখনো?
ক্রমে তুমি আমায় ছেড়ে, চাঁদি ছেড়ে শুধুই যে চাঁদের মোহে বিভোর হয়ে থাকবে তা কি জানতাম? শেষ পর্যন্ত তোমার কল্পনার চাঁদকেই যেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হত - সতীনের মতই লাগত। তোমার ওই ভাব-জগতের বিষয়াদি নিয়ে আমার যেমন কোন উৎসাহ ছিল না তেমনি কোন বৈরীত্বও ছিল না। কিন্তু জীবনের সবকিছু ছেড়ে কোন মানুষ যে ওতেই এমন বিভোর হয়ে থাকতে পারে তা কখনোই আমার অনুভবে ছিল না।
জান তো, তোমার ওই ভাব-জগৎ তথা চাঁদের আসক্তি - কোন দিনই ভাল লাগেনি আমার, এখনো না। তোমার ওই ছন্দ-পতনের জন্যে আমি আর কতটা দায়ি? যেমন বরাবর তুমি নিজের খেয়াল-খুশি মতই চল, তোমার কোন চলায় তো কখনোই বাঁধ সাধিনি আমি! জবাবদিহিতাও করতে যাইনি কোন দিন!
নয় -
তোমার পাকা ধানে তো মই দিইনি কখনোই? মনে হতো; ঘৃণা করছ আমায়, যৌক্তিক অযৌক্তিক অনুচ্চারিত শব্দের নিরর্থক পঙ্ক্তিমালায় বুঝি প্রতিনিয়তই অভিযুক্ত করছ আমাকে। না-বলা কথায় যেন থাকত কত অভিযোগের ডালা, সেই সাথে ড্যাম-কেয়ার মনোভাবে সুক্ষ্ণ অবজ্ঞার আভাস। জান তো, শত প্রেম-ভালোবাসা সত্ত্বেও সামান্য অবজ্ঞা অনেক দুর্বহ, ভারি।
কোন কাজেই আর সহযোগিতা চাইতে না আমার এমন কি, রোগ-যন্ত্রণায় ডুবেও যখন আমাকে এড়িয়ে যেতে, খুব অপমান বোধ করতাম আমি; কিসের এত অহংকার তোমার? তুমি না-হয় সবকিছুই পার, তাই বলে আমার ইচ্ছা-কর্মে বাঁধ সাধার অধিকার কে দিয়েছে তোমায়? তাই রাগে-ক্ষোভে আরো অন্ধ হয়ে হতাম।
অপ্রেমের জ্বালাও কম দগ্ধ করতো না আমাকে। প্রেম দিতে পারিনি বটে, নিইও তো নি! যতই প্রেমিক পুরুষ বলে দাবি কর নিজেকে, তোমার প্রেম আমায় স্পর্শ করেনি, ছুঁতে পারেনি। তাহলে তার ছাপ পড়েনি কেন আমাতে? কষ্ট হত খুব, শেষের দিকে নিজেকে হেয় মনে হত। আমার প্রতি তোমার ওই নির্বিকারত্বে অপমানিত বোধ করতাম নিজেকে।
কেউ বলেনি কোন দিন, তুমিও বলনি মুখ ফোটে, তবু মনে হত - আকারে ইঙ্গিতে আর তোমার বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে পরোক্ষভাবে আমাকে মানসিক রোগী বলেই বুঝি প্রমাণ করতে চাইতে নিয়ত। এই অনুভবের যে কী দাহ্যশক্তি - কীভাবে পুড়িয়ে মারে মানুষকে তা কি তুমি ভেবে দেখেছ কোন দিন?
দশ -
জান তো, মানসিক রোগীকে যদি কেউ তার স্বরূপটি বুঝতে দেয় - সে ক্ষেপে উঠে, তখন তার কষ্ট অনেক বেড়ে যায়, সে আরো দুর্বিনীত হয়ে উঠে। আমিও তেমনি হয়ে উঠেছিলাম বোধহয়! তোমাকে ভালোবাসার বদলে সব সময়ই ঈর্ষা করতাম, যা - কালক্রমে বুঝি ঘৃণায়ই রূপ নিয়েছিল, কিন্তু তোমাকে তা বুঝতে দিতাম না। শামুকের শক্ত খোলসে গুটিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। কেবল বুঝতে শিখেছিলাম, শেষাবধি তুমিও আমায় আর বুঝতে যেতে না।
তোমার ধাতব ভালোবাসার চৌম্বকিয় শক্তিতে অনেককেই আকৃষ্ট হতে দেখে ঈর্ষায় জ্বলতাম। অথচ আমার প্রতি যেন তা-ই রূপ পেয়েছিল অবজ্ঞা কিংবা করুণার ভিন্ন আদলে। তাই বুঝি দূরে সরে গেলেও আমায় মুছে ফেলনি, সাজিয়ে নাওনি নিজেকে নতুন করে! এই অবজ্ঞা কিংবা করুণা কি তবে তোমার ভালোবাসারই অন্য ছবি? কী জানি, স্থুল বোধে আমি - এত সুক্ষ্ম বিষয় ধরতে পারি না কখনোই।
কেমন করে যেন দুষ্ট একটা ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছিল আমার মনে। আর সে পরম নিষ্ঠায় তার ধ্বংসলীলাটি নীরবেই সংগঠিত করে চলছিল - আমি বুঝতে পারিনি। তুমি তো জানতে, কোনকিছু গভীরভাবে তলিয়ে দেখার মত চিন্তার গভীরতা কোন কালেই ছিল না আমার। কিন্তু কখন যে সেই ঘুণপোকাটি আমার স্বপ্ন-সাধের সৌধটিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল তা সাদা চোখে ধরা পাড়েনি।
সকলই যখন হলো সারা; রাগ-অভিমান, বাদ-বিসম্বাদ - তারপর ছুটি নিলে। বড় অবেলায় প্রেমের আঠা জলো হয়ে গেল, আমি ভেসে গেলাম বানের তোড়ে। ভাব দরিয়ায় জীবনডিঙা ভাসিয়ে তুমি লাপাত্তা হলে, আর আমি বানভাসি...
বৃষ্টিস্নাত কোন এক নিঝুম সন্ধ্যায় - কাকলি মুখর পাখিরা যখন কুলায় ফিরে, তুমিও ঘরমুখী। এমনি লগ্নে যদি কখনো দেখা হয়ে যায়, কী বলবে তুমি? জানতে চাইবে কেমন আছি? না কি, ঠুনকো ব্যস্ততায় মুখ ফিরিয়ে ট্যাক্সি ডাকতে উতলা হবে? অথবা - তোমার চিরায়ত ভব্যতা বজায় রেখে ছোট্ট এক টুকরো অস্ফুট হাসি...
সত্যিই তো! যাকে একবার ত্যাগ করেছ, তাকে কেন মনে রাখবে আর? হাজার কোটা শরতাকাশের বিচূর্ণ মেঘের মত - মনোভূমের ভাঙা মুকুরে জেগে আছে আজও বিক্ষিপ্ত স্মৃতির খণ্ডাংশ... আর আত্মা সাক্ষী, হৃদয়ের টান বলে কোন দিন বুঝি ছিল না কিছু? টান আমার একটা ছিল বটে; পতঙ্গের মত আগুনে আত্মাহুতি দেয়ার। কিন্তু তা কি ভেবেছিলাম; এই আহুতিই হবে আমার স্বপ্নের কবর?
শৈষবটি ছিল বেশ; বাবার বাড়িতে আদরে-আহ্লাদে বড় হয়েছি, যাকে বলে লাই পাওয়া - সে লাই আমিও পেয়ে এসেছি বরাবর। আর পাঁচটি স্বপ্নবাদী মানুষের মতই
স্বপ্নের মানুষটিকে ঘিরে স্বপ্নও বুনেছি ঢের। তবে কিনা, আমি ছিলাম আমার মতই তুমি তোমার মত। তুমি ছিলে বেতস পাতার পরিপাটিতে নিটোল বাস্তববাদী, আমি - খানিকটা উড়নচণ্ডি, একটু উদাসীনও। তাই বুঝি, তেলে জলে মিশ খায়নি কখনো!
... ব্যথাতুর জীবনের বোবা কান্নায় ভুগছি নিয়ত।
দুই -
স্বপ্নগুলো ভেবে ভেবে যখন শিহরিত হতে আমিও হতাম - কখন তুমি আমার হবে? স্বপ্নের সারথী - আমার বংশবদ; চলবে? ঠিক আমার স্বপ্নের পথটি বেয়ে। কিন্তু খরস্রোতা নদী যে তটিনীর আকাঙ্ক্ষা বোঝে না! তা কি জানতাম সেদিন? তাইতো আমার স্বভাবগত বৃত্ত-বলয়ের বাইরে ফিরে দেখার কোনও তাগিদ বোধ করিনি কখনো। যেমনটি ছিল আমাদের যৌথ পরিবারে; বাবা-মা আর ঘরভরা ভাই-বোন সবাই ছিল আমার একনিষ্ঠ অনুরক্ত - আমি ছিলাম সুখের পালে হাওয়া লাগা স্বপ্নের ভরা তরণী।
কথার ফাঁকে ফাঁকে তুমি স্বপ্নের জাল বুনতে আর সেসব স্বপ্নে আমাকে জড়াতে। আমারো স্বপ্ন ছিল তবে তা আমার মত করে। একান্ত স্বপ্ন বুঝি একটাই ছিল; আর তা হল তোমায় একচ্ছত্র দখলে পাওয়া, করায়ত্ব করা। বলো, তা কি আমার দোষ ছিল? কে না-চাইবে মিষ্টি আমের স্বাদ নিতে? আম যত মধুরই হোক, কেউ কি আঁটি সমেত খায়? আমিও বুঝি তেমনটিই চেয়েছিলাম? আঁটি ফেলে আমের মধু-রসটুকু...
আজ বুঝতে পারি, পতঙ্গ আগুনে আহুতি দেয় কেন? সে জানে না; আলোর ঔজ্জ্বলতা কেন তাকে টানে এত! চোখ ধাঁধানো আগুনের লেলিহান শিখা - যতই জীবনঘাতী হোক, পতঙ্গ কিন্তু ভালোবেসেই ঝাঁপ দেয়। যেমন আমিও ঝাঁপ দিয়েছিলাম, ভালোবেসেছিলাম; আগুনের আঁচে দগ্ধ হতে নয়, আগুনের প্রোজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হতে। কিন্তু নিটোল বাস্তবতায় - গনগনে আগুনের আঁচে আমাকে পুড়ে মরতে হল! জানি না - কেন? কোন সে অপরাধে?
তিন -
বিশ্বাস কর আর না-ই কর, তোমার সাথে কিন্তু প্রতারণা করিনি আমি। যদিও একটা সত্য অনেক পরে বোঝেছি; তোমার পরিপুষ্ট জীবনের নির্যাস আর যশ-খ্যাতির ভাগিদারই হতে চেয়েছিলাম। তবে, তা ঠিক আমার মত করেই। সেইসাথে ছিল বুঝি প্রেমহীন কিছু ভালোবাসাও ! কেন, এত চৌকষ দৃষ্টি তোমার তবু কি দেখ না - খ্যাতিমান সার্থক প্রবর যারা কতটা নির্ভরশীল তাদের দয়িতার 'পরে?
তোমার সুর, তোমার গান, কবিতার প্রতি নিটোল আসক্তি তার উপর তোমার মোহনীয় ব্যক্তিত্ব আর ছন্দোবদ্ধ গোছানো পারিপাট্যতা! যেন ছকে ফেলা সামরিক জীবন! - উফ্, কী বিভৎস মনোরম! সেসব যত না আমায় মোহিত করত তারো বেশি যেন শ্বাসরোধ করে দিতে চাইত। সততই সেসব আমায় অবজ্ঞার তীরে বিদ্ধ করত। কিছুতেই স্বস্তি পেতাম না কখনো।
একটা সময় এল যখন দুটি মন আর এক হয়ে কোন কিছুতেই বোঝা-পড়ার প্রয়োজন হত না বড়। তাই বুঝি কিছুতেই আমার সাহায্য চাওনি, নাওনি। নিজের প্রয়োজন মত সবকিছু নিজেই ম্যানেজ করে নিতে, গুছিয়ে নিতে! আমি খুব অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলাম, অপমান বোধ করতাম আর মনে মনে ঈর্ষার আগুনে জ্বলতাম। কেন জানি মনে হতো; পুরুষ মানুষ... এতো...?
চার -
এযুগেরই মেয়ে আমি, যুগের হাওয়ার বৈরী তো ছিলাম না! এযুগের মেয়েরা কী চায় জান তো? মনের মানুষটি তার উপর নির্ভর করুক, আস্থা বিশ্বাসে ভরসা রাখুক।
হয়তো আমিও তেমনই চাইতাম, তা কি দোষের ছিল? কেন তুমি আমার উপর একটু নির্ভর করবে না, ভরসা রাখবে না? আর নির্ভর না করা মানে তো - একজাতীয় আস্থাহীনতা! নয় কি? কিন্তু তোমার সময় বাস্তবতা বুঝি কোনদিনই আমাকে পড়তে পারেনি। কী জানি, হয়তো আমিও নই কখনো!
তোমার আচরণ, কর্মকাণ্ড, সবজানা মনোভাব আর অবলীলায় যেকোন কাজ নিজের মত করে ফেলার মত ব্যক্তিত্ব তাই কখনো মোহমুগ্ধ করেনি আমাকে। কষ্ট পেতাম, কিন্তু ভাল না-লাগলেও প্রকাশ করতাম না কিছু।
তোমার কাছে এলে, কেন জানি নিজেকে বড় নিস্প্রভ মনে হত। তাই, দূরে দূরে থাকটাই শ্রেয় মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু এই দূরে থাকা যে এভাবে তোমাকে আমার আঁচল মুক্ত করে ছিনিয়ে নিবে, এত দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে তা কি জানতাম সেদিন? সময়ের বিবরে চলে যাওয়া সেইসব দিনের কথা স্মরণ করে তাই আজও ব্যথাহত হই!
পাঁচ -
তুমি বুঝি ছিলে আগুনের সুপ্ত শিখা! তা না হলে, কাছাকাছি এলেই শরীর মনে কেন আগুনের আঁচ অনুভব করতাম? অনেক পরে হলেও আজ বুঝেছি - তোমাকে নয়, বুঝি ভালোবেসেছিলাম আগুনের জ্বলন্ত শিখাকেই। অথচ তার উত্তাপ সহনের মত যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল না বুঝি আমার! তাইতো সেই আঁচে কখনো উদ্দীপ্ত হইনি, ঝলসে গেছি! আমাকে যে এভাবে পুড়ে মরতে হবে তা কি জানতাম কোন দিনই?
সূর্য প্রভায় প্রদীপ্ত তোমার যেমন ছিল চাঁদের আসক্তি, আর আমার ছিল চাঁদির। দুই বিপরীত মেরুর চাহিদা-প্রাকার - যেন, তেল আর জল। তাইতো, দুইয়ে মিলে ঘর বানালেও সন্ধি হয়নি কোন দিনই। বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল। অনেক পরে যখন বোঝেছি - ততদিনে সবই শেষ; চলে গিয়েছ তুমি বাস্তু খুঁটি ছেড়ে বহু দূরে!
কী জানি এক বোবা অভিমানে ক্রমে ক্রমে নিজেকে আমা থেকে বিযুক্ত করে সরিয়ে নিয়েছিলে তুমি! আমি বুঝিনি! ভেবেছিলাম, এই টানাপোড়েন সাময়িক বিষয়। কতদিন আর ওভাবে চলতে পারবে? জগতের স্বাভাবিক নিয়মে ঠিক ফিরে আসবেই একদিন। তাই তোমার মানের পরিমাপ করতে যাইনি। অভিমান আমারো কম ছিল না! কিন্তু তোমার ঐ অভিমানের কাছে তা যে কী মূল্যহীন বুঝতে পারিনি তখনো।
ছয় -
ভালোবাসার মিঠেসুর কালে-ক্রমে কঠোরতায় রূপ পেল। প্রেম-রোমাঞ্চের কোমল ননীও যেন কটা স্বাদের শক্ত এক ফাঁপা পানিরের রূপ নিল। স্বপ্ন ভাঙ্গার দোষে একদা অভিযুক্তও হলাম। আস্থার ভূমিটি তখন চৈতি খরার ফাটলে মুখ-ব্যাদান। তুমি গান ছাড়লে, চিত্রকলা ত্যাগ করলে, কবিতাকে নির্বাসনে পাঠালে। আর এর সবই নাকি আমারই কারণে?
প্রেমের জন্যে শুনেছি, প্রিয়তমকে ভালোবেসে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করে, রাজাও ছাড়তে পারে রাজ সিংহাসন। আর তুমি কি-না ওইটুকুতেই নাচার হবে? তা যে বিশ্বাসে আসতে চায়নি কখনো। তাতেই আমার জেদ আরো গেল বেড়ে। ভাবনার বলয়টা যেন অতর্কিতেই মোড় নিল বৈরী স্রোতের অনুকূলে। আর সেই স্রোতে গা ছেড়ে দিয়ে আমরা অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমালাম...
আস্তে আস্তে যখন সবকিছু ফিরিয়ে নিচ্ছিলে - আস্থার মঞ্চটি আমার টলে টলে উঠছিল বারবার। ক্ষোভে অপমানে হিতাহীত ভুলে গিয়েছিলাম, নিজেকে মনে হত তোমার পথের কাঁটা। তেলে-জলের বৈরীত্বটা তখন যেন হোমানলের অদৃশ্য আঁচে রূপান্তরিত হল! আর সে আঁচের দহন ছিল এমনই অসহনীয় যে কেউ বুঝি আর কাউকে সয়ে নিতে পারছিলাম না। পরিণামে যা হবার তাই হল।
প্রেমে ও সুখে, যে প্রাচুর্যতা একদিন দিয়েছিলে সবই তার ফিরিয়ে নিলেও মনের ব্যথা-স্মৃতিগুলো ঠিকই রয়ে গেল। ফিরিয়েই নিবে যদি দিয়েছিলে কেন তবে? পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বিমূঢ় আমি রাগে, ক্ষোভে-দুঃখে তখন স্ফুটনোন্মুখ। হয়ে উঠলাম আরো দুর্বিনীত, আরো আগ্রাসী। তাই তো, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নিঃসঙ্গ আশ্রিতের মতই অনেকটা কাল বিভক্ত ছিলাম আরো।
সাত -
তোমার মুখে যেদিন শুনতে পেলাম; 'ভালোবাসতেও সুকোমল মন লাগে' আর আমার মন না-কি চুন-সুরকির ঢালাই! শোনে আমি রাগে-ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গেলাম।অপমানের জ্বালা হজম করতে কাজের ছল-ছুতোয় তোমার সাহচার্য এড়িয়ে চলতে থাকলাম। স্বভাবতই ডুবে থাকতাম নিত্যকর্মের অহেতুক ভিড়ে। তাই একই বাড়িতে থেকেও আমরা হয়ে উঠলাম দুই ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তুমি ডুব দিলে ভাব-জগতের অতিন্দ্রীয় সাগরে আর আমি ফুটন্ত তেলে সাঁতার কাটা মাছ!
পনেরটি বছর - আমার চোখে ঘুম নেই, মনে শান্তি নেই। নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে নিঃসীম শূন্যতাকে বুকে নিয়ে বেঁচে আছি। হাজারো ভিড় কোলাহলেও নিজেকে মনে হত বড় একা। আজ বুঝতে পারি; এতকাল তুমি আমার পাশেই ছিলে অথচ, তোমার ছায়াটুকুও পড়েনি চেখে!
তোমার সৃষ্টিশীল মেধা আর চারিত্রিক গুণাবলীতে কাউকে বিমুগ্ধ হতে দেখলে কেন এত জ্বালা অনুভব করতাম জানি না! তোমার সৃজনশীলতা আমায় দগ্ধ করত অবজ্ঞা করার মতই। আর ওই গাত্রদাহ জুড়াতে কী এক কুক্ষণে যে একদিন বলে ফেলেছিলাম; 'তোমার অহংকারের মূল - তোমার মেধা আর সম্পদ। তুমি অনেক চাঁদ আর চাঁদির মালিক, সেই গর্বে তোমার পা পড়তে চায় না মাটিতে'।
একথা শোনে - শুধু অসহায়ের মত বুক চাপড়ে ডুকরে কাঁদলে তুমি। যদিও কোন গূঢ়ার্থে বলিনি তবু মিথ্যে বলব না, এক সিংহপুরুষের অসহায় কান্নার দৃশ্যটা সেদিন তাকে জব্দ করতে পারার ছেলেমানুষি তৃপ্তি দিয়েছিল আমায়। হাস্যকর হলেও উপভোগ করেছিলাম বেশ।
আট -
হায় স্বপ্নের চাঁদি; যা - প্রতিটি মানুষের জীবনেই সুখ-ভোগের ঠিকানা, আভিজাত্যের চাবি-কাঠি। অর্থ-কড়ি, সোনা-দানায় যদিও আমার তেমন বিশেষ ঝোঁক ছিল না তাই বলে অর্থ-সম্পদের আশীর্বাদকে অস্বীকার করার মত বোকাও ছিলাম না নিশ্চয়! তবু অর্থ বিষয়ক একটি মাত্র খোঁচায় এত দ্রুত পর হয়ে গেলে? তুমিই বলো, এযুগে চাঁদ না হোক চাঁদি ছাড়া কি দুনিয়া চলে?
ওই চাঁদ আর চাঁদির জৌলুস কেন জানি আমাকে তেমন টানে না কখনোই। আমায় তুমি যত নির্বোধই ভাবো না কেন আমি কি এতই বোকা? তুমি বুঝতে ভুল করেছ; তোমার ওই চাঁদ এবং চাঁদির বৈভব কি আমার কাছেও কম উপভোগ্য ছিল? তবে সত্য বলতে কি, ওসবের কাছে বরাবর নিজেকে খুব নিস্প্রভ মনে হত আর ঈর্ষাটাও যেত বেড়ে।
তুমি কি বোঝতে পার না; 'টাকার গরমে অহংকারী' বলাটা কি আর আমার মনের কথা ছিল? নেহাতই তোমায় জব্দ করতে বলা। অমন কত কথাই তো তুমিও আমায় বলতে? সত্যি বলছি, সেই প্রথম বারের মত তোমায় জব্দ করতে পারায় মজাও পেয়েছিলাম বেশ। কিন্তু আমার সেই কথাতে যে করবী ফুলের বিষ লুকোনো ছিল তা কি জানতাম তখনো?
ক্রমে তুমি আমায় ছেড়ে, চাঁদি ছেড়ে শুধুই যে চাঁদের মোহে বিভোর হয়ে থাকবে তা কি জানতাম? শেষ পর্যন্ত তোমার কল্পনার চাঁদকেই যেন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হত - সতীনের মতই লাগত। তোমার ওই ভাব-জগতের বিষয়াদি নিয়ে আমার যেমন কোন উৎসাহ ছিল না তেমনি কোন বৈরীত্বও ছিল না। কিন্তু জীবনের সবকিছু ছেড়ে কোন মানুষ যে ওতেই এমন বিভোর হয়ে থাকতে পারে তা কখনোই আমার অনুভবে ছিল না।
জান তো, তোমার ওই ভাব-জগৎ তথা চাঁদের আসক্তি - কোন দিনই ভাল লাগেনি আমার, এখনো না। তোমার ওই ছন্দ-পতনের জন্যে আমি আর কতটা দায়ি? যেমন বরাবর তুমি নিজের খেয়াল-খুশি মতই চল, তোমার কোন চলায় তো কখনোই বাঁধ সাধিনি আমি! জবাবদিহিতাও করতে যাইনি কোন দিন!
নয় -
তোমার পাকা ধানে তো মই দিইনি কখনোই? মনে হতো; ঘৃণা করছ আমায়, যৌক্তিক অযৌক্তিক অনুচ্চারিত শব্দের নিরর্থক পঙ্ক্তিমালায় বুঝি প্রতিনিয়তই অভিযুক্ত করছ আমাকে। না-বলা কথায় যেন থাকত কত অভিযোগের ডালা, সেই সাথে ড্যাম-কেয়ার মনোভাবে সুক্ষ্ণ অবজ্ঞার আভাস। জান তো, শত প্রেম-ভালোবাসা সত্ত্বেও সামান্য অবজ্ঞা অনেক দুর্বহ, ভারি।
কোন কাজেই আর সহযোগিতা চাইতে না আমার এমন কি, রোগ-যন্ত্রণায় ডুবেও যখন আমাকে এড়িয়ে যেতে, খুব অপমান বোধ করতাম আমি; কিসের এত অহংকার তোমার? তুমি না-হয় সবকিছুই পার, তাই বলে আমার ইচ্ছা-কর্মে বাঁধ সাধার অধিকার কে দিয়েছে তোমায়? তাই রাগে-ক্ষোভে আরো অন্ধ হয়ে হতাম।
অপ্রেমের জ্বালাও কম দগ্ধ করতো না আমাকে। প্রেম দিতে পারিনি বটে, নিইও তো নি! যতই প্রেমিক পুরুষ বলে দাবি কর নিজেকে, তোমার প্রেম আমায় স্পর্শ করেনি, ছুঁতে পারেনি। তাহলে তার ছাপ পড়েনি কেন আমাতে? কষ্ট হত খুব, শেষের দিকে নিজেকে হেয় মনে হত। আমার প্রতি তোমার ওই নির্বিকারত্বে অপমানিত বোধ করতাম নিজেকে।
কেউ বলেনি কোন দিন, তুমিও বলনি মুখ ফোটে, তবু মনে হত - আকারে ইঙ্গিতে আর তোমার বুদ্ধিদীপ্ত আচরণে পরোক্ষভাবে আমাকে মানসিক রোগী বলেই বুঝি প্রমাণ করতে চাইতে নিয়ত। এই অনুভবের যে কী দাহ্যশক্তি - কীভাবে পুড়িয়ে মারে মানুষকে তা কি তুমি ভেবে দেখেছ কোন দিন?
দশ -
জান তো, মানসিক রোগীকে যদি কেউ তার স্বরূপটি বুঝতে দেয় - সে ক্ষেপে উঠে, তখন তার কষ্ট অনেক বেড়ে যায়, সে আরো দুর্বিনীত হয়ে উঠে। আমিও তেমনি হয়ে উঠেছিলাম বোধহয়! তোমাকে ভালোবাসার বদলে সব সময়ই ঈর্ষা করতাম, যা - কালক্রমে বুঝি ঘৃণায়ই রূপ নিয়েছিল, কিন্তু তোমাকে তা বুঝতে দিতাম না। শামুকের শক্ত খোলসে গুটিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। কেবল বুঝতে শিখেছিলাম, শেষাবধি তুমিও আমায় আর বুঝতে যেতে না।
তোমার ধাতব ভালোবাসার চৌম্বকিয় শক্তিতে অনেককেই আকৃষ্ট হতে দেখে ঈর্ষায় জ্বলতাম। অথচ আমার প্রতি যেন তা-ই রূপ পেয়েছিল অবজ্ঞা কিংবা করুণার ভিন্ন আদলে। তাই বুঝি দূরে সরে গেলেও আমায় মুছে ফেলনি, সাজিয়ে নাওনি নিজেকে নতুন করে! এই অবজ্ঞা কিংবা করুণা কি তবে তোমার ভালোবাসারই অন্য ছবি? কী জানি, স্থুল বোধে আমি - এত সুক্ষ্ম বিষয় ধরতে পারি না কখনোই।
কেমন করে যেন দুষ্ট একটা ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছিল আমার মনে। আর সে পরম নিষ্ঠায় তার ধ্বংসলীলাটি নীরবেই সংগঠিত করে চলছিল - আমি বুঝতে পারিনি। তুমি তো জানতে, কোনকিছু গভীরভাবে তলিয়ে দেখার মত চিন্তার গভীরতা কোন কালেই ছিল না আমার। কিন্তু কখন যে সেই ঘুণপোকাটি আমার স্বপ্ন-সাধের সৌধটিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল তা সাদা চোখে ধরা পাড়েনি।
সকলই যখন হলো সারা; রাগ-অভিমান, বাদ-বিসম্বাদ - তারপর ছুটি নিলে। বড় অবেলায় প্রেমের আঠা জলো হয়ে গেল, আমি ভেসে গেলাম বানের তোড়ে। ভাব দরিয়ায় জীবনডিঙা ভাসিয়ে তুমি লাপাত্তা হলে, আর আমি বানভাসি...
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আবু সাইদ লিপু ১৩/০৮/২০১৮আহারে!!
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০১/০৭/২০১৮অনেক ভাল লাগল।
অনেক ধন্যবাদ। -
দীপক কুমার বেরা ২৯/০৬/২০১৮খুব ভালো লাগলো। অনেক শুভকামনা।
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ২৭/০৬/২০১৮ভালো লাগলো।