www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

তেঁতুল বীচির কারিশমা

কায়েস, সাত্তার, মেহদি, সুজন বরাবরই ছিলো ভালো ছাত্র। সাধারণ গৃহস্থ ঘরে জন্ম নিলেও মেধা ও নিষ্ঠায় কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। ইউসূফগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ে একাধারে দশটি বছর এই চার বন্ধু ছিলো লেখাপড়ায় রত্ন বিশেষ।

যেদিন বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে সেদিন অন্যান্যদের মাঝে আবেগ দুশ্চিন্তা কাজ করলেও এই চার বন্ধু মোটামুটি নিশ্চিত যে ১ম থেকে ৪র্থ স্থান পর্যন্ত এই চার বন্ধুর জন্য বরাদ্দ আছেই, তারপর যাকে যেখানে খুশী রাখুক তাতে ওদের কোন মাথা ব্যথা নেই। এবছর হয়তো সুজন ১ম হলো আর সাত্তার হলো ৪র্থ, অন্য দু’জন ২য় বা ৩য় তাতে কিছু যায় আসে না। আবার পরের বছরই হয়তো দেখা যাবে সুজন হয়েছে ৩য় আর সাত্তার হয়েছে ২য়।

এটা যেন অনেকটা আপোষেই চার বন্ধুতে এই ১ম, ২য়, ৩য় বা ৪র্থ হওয়াটা মেনে নিতো। এর ভিতরে কারো মধ্যে কোন ঈর্ষা কাজ করতো না। বরং ওরা এই ভেবে খুশি হতো যে, ১ম থেকে ৪র্থ - ঘুরে ফিরে তো আমরাই আছি তবে এখানে আর কাউকে ঢুকতে দেয়া যাবে না এমনই যেন ছিলো তাদের পণ।

এদের মধ্যে সাত্তার অবশ্য কিছুটা দুর্বল ও ফাঁকিবাজ প্রকৃতির ছিলো, তবু বন্ধুরা পরীক্ষায় তাকে অনেক প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে সাহায্য করতো। বিশেষ করে সুজন ছিলো বেশী বন্ধু বাৎসল ও খুব ভালো মনের মানুষ, তার আগ্রহেই সাত্তারকে সবাই এতটা প্রশ্রয় দিতো। ফলে অনেক সময় দেখা যেতো এই ফাঁকিবাজ সাত্তারই ১ম হয়ে বসে আছে। তাতেও কেউ মন খারাপ করতো না। গলায় গলায় ভাব বলতে যা বুঝায় সেরূপ - লেখাপড়া, খেলাধূলা, দূরন্তপনা সর্বত্রই এই চারের জুটিকে দেখা যেতো এক সাথে।

দূরন্ত কৈশোরের দশটি বছর এই চার বন্ধু একত্রে কাটিয়ে যখন এস.এস.সি পাশ করলো তখন দেখা গেল সাত্তার পেল ৩য় বিভাগ আর বাকী তিনজনই ২টি ১টি লেটার সহ ১ম বিভাগ। সাত্তারের দূর্ভাগ্যের জন্য বন্ধুরা সহানুভূতি জানালো বটে কিন্তু এটা তো আর স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা না যে খাতা দেখিয়ে বা প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে তাকে বন্ধুরা স্কুলের মতোই সাহায্য করতে পারতো! সেই থেকে কেমন করে যেন সবার অজান্তেই সত্তার অন্য তিনবন্ধু থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে গেলো।

এস.এস.সি পাশ করার পর সাত্তার আর লেখাপড়া করলো না এক উকিলের মুহুরীর সহকারী হয়ে মহকূমা সদরে কিছুদিন থেকে ছল চাতুরী ঠক্‌বাজীর কলা কৌশলগুলো বেশ রপ্ত করেছিলো। কিন্তু কোন কিছুতেই সুবিধা করতে না পেরে গ্রামের এক অবস্থাপন্ন কৃষকের মেয়ে বিয়ে করে কিছুদিন বেশ ভালই চলছিলো।

কিছুদিন পর তার শ্বশুরের মৃত্যু হলে শ্বশুরের নাবালক সন্তান ও তার সহায় সম্পদের মালিক হয়ে সে জড়িয়ে গেলো গ্রাম্য রাজনীতিতে। স্বভাবে ধুরন্ধর সাত্তার পরের সম্পত্তির কল্যাণে এখন গ্রাম্য রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সুবাদে হরেক রকম চাটুকার তার চারপাশে ভিড় করে থাকে। সামনেই আসছে চেয়ারম্যান ইলেকশন। সে মহা ধুমধামে আসন্ন চেয়ারম্যান হওয়ার যাবতীয় মহরত দিয়ে যাচ্ছে। এদিকে তার অসহায় বিধবা শাশুড়ি এখন মেয়ে জামাই’র উপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। জামাই’র কর্মকান্ড পছন্দ না হলেও কিছু বলতে পারে না। জামাই যা করছে তাতে সম্মতও হতে পারে না আবার বাঁধাও দিতে পারে না।

যদিও তার চেয়ারমম্যান হওয়ার তেমন কোন গুণ বা যোগ্যতা কোনটাই ছিল না তবু চাটুকারদের প্ররোচনায় ইলেকশনের জন্য সে পানির মত টাকা খরচ করতে লাগলো। ইলেক্‌শনের দিন নিশ্চিত ভরাডুবির ইঙ্গিত পেয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কেন্দ্র দখল করে ব্যালট্‌ বাক্স ছিনতাই করতে গিয়ে তার দলের কর্মী ধরা পড়লো, তাকে ছিনিয়ে আনতে গিয়ে দলের গুন্ডারা করলো খুন। আইনতঃ এসবের সম্পূর্ণ দায় তার, হুকুমের আসামী হয়ে তাই সে গেল জেলে। তাকে ছাড়িয়ে আনতে বিধবা শাশুড়ি প্রথম সুদে টাকা আনলো, তাতে ও কিছু হলো না। উকিলবাবু বললেন - "খুনের মামলা, ছাড়া তো পাবেই না এমন কি ফাঁসি ও হতে পারে। ফাঁসির দন্ড বাঁচিয়ে জেলের ঘানি পর্যন্ত পৌঁছাতে হলেও বহু টাকার প্রয়োজন”। তাই অসহায় শাশুড়ি বেশী বেশী টাকা নিয়ে জমিজমা এমন ভাবে বন্ধক দিলো যে এর চেয়ে বিক্রি করাও ছিলো ভালো।

উকিলবাবু কথা রেখেছেন, ফাঁসি হয়নি বটে; পাঁচটি বছর জেল খেটে তবে তাকে বাইরে আসতে হয়েছে। তার নিজের তিনটি সন্তান পাঁচটি শালা-শালি সব মিলিয়ে সংসারে এগারো জন মানুষের অন্নের কোন সংস্থান নেই। এদিকে বড় শালি দু’টির বিয়ের বয়েস পার হয়ে যাচ্ছে, গ্রাম্য সমাজে মানুষ এটাকে খুব নিন্দার চোখে দেখে। শাশুড়ি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেননি, এতদিন জামাই’র আশায় দিন গুনেছে। জামাই জেল থেকে বেরিয়ে এলে যা হয় করবে। সাত্তার জেল থেকে বেরিয়ে এলো বটে। কিন্তু এখন তার কিছুই করার নেই। শাশুড়িকে বুদ্ধি দিয়ে যাই কিছু সামান্য অনাবাদি জমি ছিল যেগুলো কেউই বন্ধক নেয়নি সেগুলো পানির দামে বেচে দিয়ে একটি শালির বিয়ে দিল বটে। অন্যটি এক বখাটে ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে। এতবড় পরিবারের ভরণ-পোষণ, এখন তার মাথার ’পরে পাহাড় প্রমাণ সমস্যা।

নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বলতে ভিটা বাড়ি ছাড়া নয় ভাইবোনে ভাগ করে যা পেয়েছে তা বাসেরও যোগ্য না বিক্রিরও যোগ্য না। কৃষি কাজ করবে তেমন জমি শ্বশুরেরও নাই নিজেরও নাই। আর জমি থাকলেও তার পক্ষে কৃষি কাজ করা সম্ভব ছিলো না, কারণ সে কৃষিকাজে অভ্যস্থও নয়। তার উপর স্বভাবে সে নিষ্কর্মা প্রকৃতির মানুষ। সুতরাং অর্থ কষ্ট এখন তার নিত্যসঙ্গী। কিছুদিন আদম-বেপারীর দালালের ফড়িয়া সেজে নানান জনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিদেশে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে গ্রামের কিছু উঠতি বয়েসী যুবক ছেলেকে সর্বশান্ত করেছে। এখন তাদের বিচার শালিসের ভয়েতে প্রায়ই থাকে সে গ্রাম ছাড়া হয়ে। এখন আর কেউ তাকে বিশ্বাস করে না, তাকে প্রশ্রয়ও দেয়না, বরং এড়িয়ে চলে।

গ্রামের খুব কম লোকই বাদ আছে যার কাছে সে ধার না করেছে। তার মধ্যে একজন তার ছেলেবেলার বন্ধু সুজন। আগেই বলেছি সুজন খুব সরল প্রকৃতির ভাল মানুষ। ভাল রেজাল্ট করলেও গরীব ঘরে জন্ম তাই লেখাপড়ায় বেশীদুর আগাতে পারে নি। এইচ.এস.সি পাশ করে কৃষিব্যাঙ্কে চাকরী হওয়াতে কোন রকম কায়ক্লেশে সসম্মানে দিন গুজরান করে চলেছে। সে সাত্তারের এমন দুরবস্থা আর এতটা পতনের কথা জানতো না। তাই কখনো সে গ্রামে এলে সাত্তার তার কাছে ধার চাইলে না করতো না, যা সম্ভব দিতো। অনেকদিন পর সুজন যখন বুঝতে পারলো; ধার বলে সাত্তারকে এতদিন যা দিয়ে এসেছে তা মোটেও ধার নয় একেবারেই স্বত্ত্বত্যাগ। ততদিনে অনেক টাকা দিয়ে ফেলেছে। সে মনকে সান্ত্বনা দেয় – কী আর করা, সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু। যাই হোক, নাহয় আর দেবো না। অবশ্য এরপর সাত্তার আর সুজনের মোকাবেলাও হয় না। কারণ সাত্তার যার কাছ থেকে যা নেয় তা কখনো ফিরিয়ে দেয় না। তাই কখনো সুজনকে গ্রামে আসতে দেখলেই সে অন্য পথে হাঁটে।

বন্ধুদের মধ্যে সবচে’ ভাল অবস্থানে আছে কায়েস - বেলতলীতে আরেক বন্ধুর সাথে পার্টনারে একটি বইয়ের দোকান দিয়েছিল এখন তা’ বেশ ভালই চলছে। সে বেশ ভালই আছে, প্রথম প্রথম সাত্তার তার কাছেও ধার-দেনার জন্যে আসতো। তবে কায়েসের এড়িয়ে যাবার সুযোগ ছিলো - ”দেখ দোস্ত, এটা আমার একক ব্যবসা নয়, বন্ধুর সাথে যৌথ ব্যবসা করি। আর যৌথ ব্যবসায় বিশ্বাসটাই বড় বিষয়, তার অনুমতি ছাড়া আমি একটি টাকাও খরচ করিনা। টাকাপয়সা কিছু নিতে হলে বন্ধুকে আগে জানাতে হয়। বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ অঙ্কের টাকা ছাড়া আমি নেইও না কারণ সংসার খরচের জন্য আমাকে ভাবতে হয়না, যা প্রয়োজন আমার বাবাই করেন। মনে কিছু নিস্‌ না দোস্ত, এসেছিস চা-নাস্তা খেয়ে যা, বন্ধুর অনুমতিও পরামর্শ ছাড়া হঠাৎ কোন টাকা আমার দিবার ক্ষমতা নাই”।

অপর দুই বন্ধুর মধ্যে মেহদীর ও একই অবস্থা, স্থানীয় ইউসূফগঞ্জ বাজারে মনোহরি দোকান দিয়ে কোন রকম দিন চালাচ্ছিল। সাত্তার তার অনটনে সংসারের নিত্য প্রয়োজন মিটাতে চাল, ডাল, তেল, নুন নিয়ে নিয়ে বাল্যবন্ধুর দোকানটাকে স্কুলজীবনের পরীক্ষার ফলের মতই সমানে ব্যবহার করে তাকে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে। এখন মেহদির অবস্থাও ভালো না তাই আর সে তার দোকানেও বড়বেশী যায়না। অথচ মেহদী এই দোকানটাকে দিয়েই ঘষে-মেজে কোন রকম চলছিলো, সাত্তার তাকে বলা যায় পথে বসিয়েছে। দোকানে এখন মাল-পত্র নেই অথচ পুঁজির অভাবে মালামালও উঠাতে পারছে না।

এদিকে সাত্তারের ছল-চাতুরী আর বাটপারীর সীমা এখন গ্রামান্তরে ছড়িয়ে গেছে। সে অবলীলায় এমন সব আকাশকুসুম মিথ্যা গল্প জুড়ে দেয় - যে শোনে তারই আক্কেল গুড়ুম হওয়ার যোগাড়। একমাত্র মেহদিই পারে না বাস্তবতাকে মেনে নিতে যে, সাত্তার যা বলে তা মিথ্যেকথা। তাহলে যে তার আশার সৌধটি ভেঙ্গে যায়, তাহলে যে তার আর বাঁচার কোন আশাই থাকে না! তাই সে বোকা সেজে হলেও বন্ধুর আশায় আস্থা রাখতে চায়। সাত্তারকে আজকাল বাড়িতে খুব কমই পাওয়া যায়, তাছাড়া তার আর এখন বাড়িতে থাকার উপায়ও নেই। সুতরাং প্রতি মাসেই নিয়ম করে প্রয়োজনে দোকান বন্ধ রেখে হলেও সে এখন আশার মরিচীকার পিছনে ঘুরে, সাত্তারের খোঁজে এগ্রাম সেগ্রাম চষে বেড়ায়; তার টাকা আদায় করতে, আর নতুন নতুন আশার বাণীতে উজ্জীবিত হয়ে ঘরে ফিরে।

প্রতিবারেই সাত্তার তাকে বড় বড় আশার বাণী শোনায়, লোভ দেখায় - ”আরে এই মক্কেলটা পাঠাতে পারলে তোর আর কয় টাকা? তোর টাকা তো দেবোই আমাকেও তো কিছু করে খেতে হবে, নাকি? ভাবছি মানুষকে দিয়ে থু’য়ে যা থাকবে সব টাকা তোকে দিয়ে তোর ব্যবসাতেই থিতু হয়ে বসে যাবো। এসব কথা শোনার পর মেহদী আশায় আরো বুক বাঁধে, আল্লা’র কাছে দোয়া করে যেন সাত্তার সত্যি সত্যি এবারে তার নতুন মক্কেলটিকে ঠিকমত বিদেশে পাঠাতে পারে। তাহলে সাত্তারও বাঁচবে সে নিজেও বাঁচবে। কারণ সাত্তার তো বলেছেই টাকা পেলে তার টাকা তো দিবেই উপরন্তু, তার ব্যবসার জন্য ও পুঁজি দিবে। তাই মেহদি সেই সুদিনের অপেক্ষায় এখনো সাত্তারের খোঁজে ঘুরে, কখনো দেখা পায় কখনো পায়না। দেখা পেলে সেই পুরোনো কথা, পুরোনো আশ্বাস।

এভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছরের পর বছর ঘুরে। মেহদির অবস্থা শোচনীয় থেকে আরো শোচনীয় হতে থাকে। দোকানের পূঁজি-পাট্টা যা ছিলো তার সিংহভাগই সাত্তারের কাছে আটকা পড়েছে। আর সামান্য যা তলানী ছিলো তা দিয়ে ব্যবসা তো চলছেই না দিনে দিনে পেটে ভেঙ্গে খেতে খেতে সেও আজ পুরোপুরি দেউলিয়ার খাতায় নাম লিখিয়েছে।

এখনো সে সাত্তারের আশা ছাড়তে পারে না। তাই সাত্তরের মঙ্গল কামনা করা ছাড়া উপায় নেই। তাই এখনো তার সাত্তারের খোঁজে নিয়মিত গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরা ছাড়া গতি নেই। এভাবে আর্থিক অনটনে দূর্বল হতে হতে মহাজনদের কাছে অনেক ধার বাকি পড়ে গেছে, অথচ একসময় মহাজনদের কাছে ভাল পার্টি হিসাবে তার বেশ কদর ছিলো। গঞ্জের মহাজনরা জানে; মেহদি ভাল ছেলে ইচ্ছা করে কারো টাকা মেরে খাওয়ার বদ্-মতলবে এমন করছে না অথচ দিন দিন তার ব্যবসা শ্রীহীন ও দূর্বল হয়ে পড়েছে। সুতরাং আর বাকী দিলে তাদের টাকার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। অতএব, টাকার জন্য ভয়াবহ চাপ না দিলেও নতুন করে আর কেউ বাকী দিতেও রাজি হয় না।

শেষ পর্যন্ত দোকানটি তার বন্ধই করতে হলো। বাজারে ব্যবসায়ী মহলেও তার বেশ সুনাম ছিল, সবাই তাকে ভাল ছেলে বলেই জানে। এছাড়া সবাই জানতো সাত্তার কিভাবে তাকে পথে বসিয়েছে। তাই সবাই তার প্রতি খুব সহানুভূতিশীলও ছিলো। তাই জীবিকার প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই সে এক দোকানে কর্মচারী হিসাবে চাকরি নিয়েছে। এতদিনে সাত্তারের আশা তার অনেকটাই স্থিমিত হয়ে এসেছে। এখন সে ভাবে - ”আহা, এই বোধটুকু যদি আরো আগে আসতো, আরো আগেই যদি সাত্তারের কাছে পাওনা টাকার মায়া ছেড়ে দিতে পারতাম। তাহলে আমার এমন করুণ পরিনতি হতো না। বড় আশায় না থেকে অন্তত নিজের অবশিষ্ট যা ছিলো সেই অনুযায়ী যদি কিছু করতাম তা হলেও এখন আমাকে অন্যের দোকানে চাকরী করতে হতো না”।

মেহদির যখন এই অবস্থা আর সাত্তারের আশার মরিচীকার আলোটাও ততদিনে নিভে গেছে। সাত্তারের কথা আর মনেও আনতে চায় না তখন একদিন তার মহাজন তাকে পাঠালো বেলতলী মহাজনের গদিতে দোকানের মালামাল কিনতে। নিজের ভাগ্যের কথা ভাবতে ভাবতে সে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে - একসময় এই গঞ্জেই মহজনদের গদিতে তার কত কদর ছিলো। তাকে নিয়ে মহাজনরা এক রকম কাড়াকাড়ি করতো। বাকীর প্রয়োজন না হলেও এক রকম জোর করে হলেও প্রয়োজনের চেয়ে বেশী মাল বাকিতে ধরিয়ে দিতো - "আরে নেন, নিয়ে যান, আগামী হাটে দাম বেড়ে যাবে, তখন আর এই দামে পাবেন না। তাছাড়া আপনি তো আর টাকা ঘুরাবেন না বা মেরেও খাবেন না। আরে, আমরা মানুষ চড়িয়ে খাই, মানুষ চিনি - কে আসল কে নকল”।

অথচ তার আজ মহাজনের গদিতে যেতেও ভয় করছে, লজ্জায় অপমানে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। কি মুখ নিয়ে এখন তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, তাদের পাওনা টাকা পরিশোধের কোন আশ্বাসই বা দিবে তাদের? সে তো কখনো এমন ছিলো না, কেন এমন হলো? বন্ধুকে বিশ্বাস করে উপকার করাই কি তার পাপ্‌ হলো? এমনি সময়ে কানে এলো, চা দোকান থেকে কেউ তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। মুখ ফিরাতেই সে সাত্তারকে দেখতে পেলো।

একবার ইচ্ছা হলো - ডাকুক সে আর গিয়ে কি করবে, সেই তো বড় বড় আশার বাণী শোনাবে। তা আর শুনে কি হবে, তার ভাগ্যে যা ছিলো তাতো হয়েছেই। আবার মনে একটু লোভও হলো, যাকে এত খুঁজেও পাই না, যে কিনা আমার দৃষ্টি থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে। তাকে তো এখন আমি দেখিনি অথচ সেই যখন নিজে থেকে ডাকছে, নিশ্চয় কোন শুভ সংবাদ আছে। কে জানে এতদিনে তার বোধহয় অবস্থার পরিবর্তণ হয়েছে।

মেহদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে যেতেই সাত্তার অন্য একজনকে তুলে দিয়ে তাকে খুব যত্ন করে বসালো। কুশলাদি জিজ্ঞাসাবাদের আগেই সাত্তার দোকানীকে হাঁক দিলো - "এই এখানে ভাল করে একবাটি মালাই দাও। তারপর ভাল করে গরুর দুধের চা দাও, আমাকেও এককাপ দিও”। মেহদি অবাক হচ্ছে - "সাত্তারের এই কি পরিবর্তণ, স্বপ্ন দেখছি নাতো? তাহলে সত্যি সাত্তারের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে”। মেহদি কাচুমাচু করে বলছে - "না ও সব লাগবে না, আর আমি তো চা খাইনা, তুমি জানই”। অথচ বাল্যকাল থেকেই এরা কেউ কাউকে ’তুমি’ বলে সম্বোধন করে না, আজ মেহদি অজান্তেই সম্মোহিতের মত ’তুমি’ করে বলছে।

সাত্তার আয়েস করে টুলের উপর পা’ তুলে বাবু হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলো - "তা এত ’তুমি তুমি’ করছিস যে বড়? আমার খোঁজ খবরও কিছু নিলি না? তুই তো জানিস না আমার আর সেই দিন নাই রে। এখন আমার আর ভাবনা নাই, তাই, মনে বড় শক্তি পাই। আমার একটা হিল্লে হয়েছে, তোদেরও টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কারো একটি পয়সাও মারবো না, একটু সবুর কর সবার পয়সাই পাই পাই করে বুঝিয়ে দেবো”। মেহদি নড়েচড়ে বসলো, হঠাৎ করেই মনের মধ্যে আশার আলোটা ধপ্‌ করে জ্বলে উঠলো - "তা হলে সত্যি বুঝি সাত্তারের অবস্থার পরিবর্তণ হয়েছে, তাই তার চাল চলন বদলে গেছে। টাকাটা বোধহয় এবার পাবো। হে আল্লাহ, তুমি বড় মেহেরবান, এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছো”।

ততক্ষণে দোকানী মালাই’র বাটি দিয়ে গেছে। সাত্তার বললো - ”নে, মালাই খা”।
মেহদি খুব কাচুমাচু হয়ে বসে আস্তে আস্তে চামুচে করে মালাই মুখে দিচ্ছে আর সাত্তরের দিকে সসম্ভ্রমে তাকাচ্ছে। অনেক ইতস্ততঃ করে বললো -”তা দোস্ত বলতো আমার টাকার কি ব্যবস্থা হলো, টাকাটা কবে পাবো? তুই তো জানিস না এই টাকার কারণে আমার জীবনে কি দূরবস্থা চলছে”।

”আরে পাগল ধৈর্য ধর, তুই আমার বাল্যবন্ধু না, প্রথম চালান বেচে তোর টাকাটাই তো সবার আগে দেবো” - সাত্তার খুব আস্থার সাথেই জবাব দিলো।

মেহদি বললো - "কিছুই বুঝতে পারছি না, কিসের চালান বিক্রি করে সবার আগে আমার টাকা দিবি। আমার যে আর ধৈর্য মানছেনা, দোস্ত একটু খুলে বল দেখি”।

সাত্তার খুব বিজ্ঞের মত জাবাব দিলো -”আরে, আজ সকালেই তো ভাল আর পুষ্ট দেখে পাঁচটা তেতুল বীচি বুনে আসলাম, হিসাব করে দেখলাম, তোদের সবাইকে দিয়ে থু’য়ে আমারও তো কিছু থাকা চাই, নাকি বলিস”।

মেহদির মালাই গলায় আটকে গেছে - "কি আবোল-তাবোল বকছিস্‌, মাথা মুন্ডু কিছুই যে বুঝতে পারছি না ছাই, হেঁয়ালী ছেড়ে সত্য কথাটা বলতো শুনি”।

”শুনবি, তবে শোন – আজ সকালেই তেঁতুল বীচি লাগিয়েছি আর কোন হেলাফেলা নয়, এখন থেকে ওগুলোর খুব যত্ন করবো, দেখতে দেখতে সেগুলো গাছ হবে, সে গাছ বড় হবে, ঠিকমতো যত্ন করতে পারলে সে গাছে ঝাঁকের ঝাঁক তেতুল ধরবে, সেই তেঁতুল পাঁকলে প্রথম চালানের তেঁতুল বেচেই সবার আগে তোর টাকা শোধ করে দেবো”।

এমন কথা শুনে মেহদি হাসবে না কাঁদবে নাকি রাগে ফেটে পড়বে তা বুঝতে পারছে না। সে মালাই’র বাটিটা রেখে বন্ধুর প্রহসনের জবাবে শুধু একটু হাসলো। এ হাসি কোন সুখের হাসি নয়, এই ছোট্ট হাসিটুকু যেন তার বুকফাঁটা আর্তনাদ।

সাত্তার খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো -”হ্যাঁ খুব তো টাকা পাবি না বলে অবিশ্বাস জন্মেছিলো। আজ টাকা পাওয়ার আশা হয়েছে তো, সামনে সুখের দিন! তাই এখন তো হাসবেই। হাসো বন্ধু হাসো”।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৮৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৬/১২/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • জাফর পাঠান ০৪/০১/২০১৫
    শিক্ষনীয় উপস্থাপনা । ভালো থাকুন সন্তত।
  • সুন্দর
  • হাহাহহাহাহা।
    আমার মনে হয় সাত্তার পাগল হয়ে গেছে। এম আই কারেক্ট?
  • আহমাদ সাজিদ ২৬/১২/২০১৪
    অনেক লম্বা। পড়ে সময় করে ধীরে ধীরে আবারো পড়তে হবে।
 
Quantcast