ভাষা দৈন্যতার পরিনতি - তিন
শতবর্ষ আগের কথা। এদেশে তখন বৃটিশের রাজত্ব। কৃষিনির্ভর পল্লীর গ্রামগুলো ছিল নেহায়েত গন্ডগ্রাম। স্থানান্তরে মানুষের যাতায়াত ছিল খুবই সীমিত। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে লোকে বুঝত নৌকা আর দূর দূরান্তের জন্যে স্টিমার। আশপাশের দশ বিশটি গ্রাম ঘিরেই ছিল মানুষের বিচরণ আর তা’ও হয় পা’য়ে হেঁটে না হয় গরুর গাড়িতে চড়ে। অবস্থাপন্ন বা বনেদী পরিবারের ভাগ্যবানেরা কখনো ঘোড়া বা পাল্কিতেও যাতায়াত করত। গ্রামের সাধারণ মানুষের পরিচিত চৌহদ্দির বাইরে যাওয়ার যেমন প্রয়োজন হত না তেমনি সাহস এবং সামর্থ্যও ছিল না। গ্রামে লেখাপড়ার তেমন কোন সুযোগ তো ছিলই না।
ইংরেজ শাসক বা স্থানীয় জমিদার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যা ও দু’একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল সে গুলোতে মূলতঃ হিন্দু পরিবারের ছেলে-মেয়েরাই লেখাপড়া করত। মুসলমানরা তাদের ছেলেমেয়েদের সেসব স্কুলে পাঠানোর কথা চিন্তাও করতে পারত না। আর ওই সব গ্রন্ডগ্রামের মেয়েদের তো সে সময় লেখাপড়ার প্রশ্নই ছিল না। বিশেষ করে মুসলমানরা ইংরেজের স্কুলে লেখাপড়া করা বা ইংরেজী শেখাকে পাপ্ কাজ বলেই জ্ঞান করত। সঙ্গত কারণেই তৎকালীন মুসলমানরা লেখা-পড়া, ব্যবসা-বানিজ্য ও সরকারী চাকরীর সুযোগ থেকে ছিল একেবারেই বঞ্চিত।
মুসলমানরা তখন তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে বড়জোর স্থানীয় মসজিদের প্রাতঃকালীন মক্তবে ’কায়দা, আমপাড়া’ মুখস্ত করানো আর নামাজের তালিম নেয়াকেই উত্তম লেখাপড়া বলে বিবেচনা করত। অবশ্য কেউ কেউ ধৈর্য্য ধরে আরো কিছুদিন কোরানশরিফ পড়া ও মুখস্ত করে হাফেজ হওয়া অথবা দু’চারটি হাদিস সহ ধর্মীয় মাসালা-মাসায়েল জানাকেই সর্ব্বোচ্য শিক্ষা হিসাবে জ্ঞান করত। মুসলমান সমাজ এদরকে সম্মানসূচক খেতাব দিয়ে - মোল্লা বা মুন্শী বলে মানত। পরবর্তীতে এরাই মসজিদের ইমাম, মক্তবের হুজুর বা সমাজের ধর্মীয় নেতার ভূমিকা পালন করত।
সত্যিকার অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় শিক্ষিত এখনকার মত আলেম তখন গ্রাম্য সমাজে বলতে গেলে ছিলই না। আর এসব অর্ধশিক্ষিত মুন্শী বা মোল্লা সাহেবরা ফতোয়া দিতেন, ধর্মীয় বিধান দিতেন, বিচার সালিশ করতেন। তখনকার গ্রামের অর্থনীতি ছিলো পুরোপুরি বিনিময় প্রথার উপর নির্ভরশীল। বিনিময় করার মত যথার্থ পণ্য না মিললে তবেই সীমিত ক্ষেত্রে মুদ্রার বিকল্প হিসাবে এক জাতীয় কড়ির প্রচলন ছিল। বৃটিশ শাসনামলে বৃটিশরাজ (তৎকালীন বৃটেনের রাণী) মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি খোদাই করা ধাতব মুদ্রার প্রচলন করলে এক শ্রেণীর ধর্মীয় হুজুর তো ফতোয়াই দিয়ে বসলেন - "নাছারা আওরত; বৃটিশ রাণীর মাথাওয়ালা টাকা কাছে রাখা গোনাহের কাজ, এই টাকা সাথে নিয়ে নামাজ পড়লে তা’ও দুরস্ত হবে না”।
এখনকার দিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব্বোচ্য ডিগ্রীর চেয়েও তখনকার দিনের দেওবন্দের আলেম হওয়া ছিলো অতি গৌরবের বিষয়। গোটা পরগনা জুড়েও এমন আলেম দু’একজন ছিলেন না। এই যখন অবস্থা তখন গ্রামের এক সঙ্গতি সম্পন্না বিধবা তার একমাত্র ছেলেকে বড় আলেম বানাবেন বলে স্থির করলেন। সে অনুযায়ী বিধবা বড় শখ করে একমাত্র ছেলেকে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়তে পাঠালেন। হিন্দি ভাষা অধ্যূষিত ভারতের দেওবন্দে লেখাপড়ার মাধ্যম ছিল উর্দ্দূ। সুতরাং বিধবার একমাত্র ছেলে বহুদিন দেওবন্দে থেকে উর্দ্দূ মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে বড় আলেম হয়ে পাঁগড়ি লাভ করল। (পাঁগড়ি হল; এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে সমাবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে যে টুপি প্রদান করা হয় তারই অনুরূপ স্বীকৃতি বিশেষ)।
বহুদিন পর বিধবার ছেলে মায়ের আশা পূরণ করে দেওবন্দ থেকে বড় আলেম হয়ে পাঁগড়ি নিয়ে দেশে ফিরেছে। চারিদিকে রব পড়ে গেছে, বহু দূর-দূরান্ত থেকে দলেদলে লোকজন ছুটে আসছে দেওবন্দ পাশ এতবড় একজন আলেমকে দেখে পূণ্য লাভ করতে। বিধবার এতদিনের স্বপ্ন-সাধ পূরণ হয়েছে, ছেলে আজ এতবড় আলম হয়ে ফিরে এসেছে যা ইতোপূর্বে এদেশে আর কেউ চিন্তাও করতে পারে নি। সঙ্গতঃ কারণেই ছেলের গর্বে ও তৃপ্তিতে মায়ের বুক ভরে উঠেছে।
আত্মীয় পড়শিদের মাঝে মায়ের মর্যাদা অনেক বেড়ে গেছে। বিধবা বড় তৃপ্তিভরে সবাইকে বলছেন - ”বাছা আমার অনেক জ্ঞানী হয়ে ফিরেছে, উর্দ্দূ ছাড়া কথাই বলে না। আহা ! ছেলের মুখের কথা কী সুন্দর। আমার ছেলে বেহেশ্তি ভাষায় কথা বলে, শুনলেও পূণ্য হয়। আহা, কী সুললিত জবানী, কান জুড়িয়ে যায়, কলিজা ঠান্ডা হয়, কি বল তোমরা” - আত্মীয় প্রতিবেশীরাও বিমোহিত হয়ে তা’ সমর্থন করেন।
বহুদিন পর বিধবা তার ছেলেকে কাছে পেয়েছেন। ছেলের নানান খোঁজ-খবরই মা জানতে চান - ”এতদিন কেমন ছিলে বাবা, কি খেয়েছ, কি পড়েছ, মায়ের কথা মনে পড়ত কি” ইত্যাদি। ছেলে মাতৃভাষাতেই মায়ের সাথে কথোপকথন করছিল তাতে মা ক্ষুন্ন হয়ে ছেলেকে বললেন, ”বাবা তুমি বেহেশ্তি ভাষা শিখেছ, তা শুনলেও যে সোয়াবের কাজ। আমি এতবড় আলেমের মা, আমাকেও ওই ভাষা শিখাও, তা’ না হলে এত কষ্ট আর সাধনায় যা শিখে এসেছ তা’ আমি বুঝব কি করে ? কাজেই এখন থেকে বেশী বেশী করে তোমার শেখা বেহেশ্তি ভাষাতেই আমার সাথে কথা বলবে”।
এতদিন পর বুকের মানিককে কাছে পেয়েছে, মায়ের মন ছেলের জন্য কত আঁকুপাকু করছে। কতদিন কাছে বসে ছেলেকে ভালমন্দ নিজের হাতে খাওয়াতে পারেন না। সুতরাং মা অনেক শখ করে ছেলের জন্য নানান রকম খাবার - পিঠা, পায়েশ, মন্ড, ঘন্ট কোন কিছুই তৈরী করতে বাদ রাখেন নি। ছেলে বাড়ি আসা অবধি লোকজনে বাড়ি থৈ-থৈ করছে, ছেলেকে ভাল করে খাওয়াবেন দূরে থাক তাকে কাছেই পাচ্ছেন না। এতে মা কষ্ট পেলেও খুব গর্বই বোধ করছেন।
বেশ রাতে সব লোকজন চলে যাবার পর ছেলে ঘরে এসে মাকে বলছে - ”মা বড্ড ক্ষিধা পেয়েছে, কত দিন তোমার হাতে খাইনা, আজ আমাকে তোমার হতে খাইয়ে দাও”। মা ও তা’ই চাইছিলেন তাই বললেন - ”বাবা আমি তোমাকে আজ সেই ছেলেবেলার ছোট্ট শিশুটির মত খাইয়ে দেব, কিন্তু আমার ইচ্ছা তুমি আর আমার সাথে উর্দ্দূ ছাড়া কথা বলবে না। তোমার সাথে কথা বলে বলে আমিও ওই বেহেশ্তি ভাষাখানা শিখে নেব”।
ছেলে বলল - "মা, তুমি তো উর্দ্দূ জাননা, আমি উর্দ্দূতে কথা বললে তুমি বুঝবে কি করে”?
মা জবাব দিলেন - "আরে বাবা আমার ছেলে এতবড় আলেম হ’লেও আমি তো তোর মা’ই আছি, সেই ছোট্ট শিশুটি যখন ছিলি তখন কি তুই কথা বলতে পারতিস, তখন আমি তোর কথা বুঝতাম কি করে? সুতরাং যা বলছি তা করবে, এখন থেকে শুধু উর্দ্দূতেই আমার সাথে কথা বলবে, কেমন? ”
ছেলে লজ্জিত হ'য়ে মায়ের কোল ঘেষে খেতে বসল।
মা খুব যত্ন করে সেই ছোট্ট শিশুটির মত করে আপন হাতে ছেলেকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন। ছেলের মুখের খাবার শেষ করার ফুরসত নাই, মা স্নেহের আতিশয্যে ক্রমাগত ছেলের মুখে গ্রাসের পর গ্রাস খাবার দিয়েই চলেছেন। মুখে খাবার জমে যাচ্ছে, মুখ ভর্ত্তি খাবার নিয়ে ছেলে কথাও বলতে পারছে না। অথচ এ পর্যন্ত যা’ গিলেছে তা’র সবই বুকে আটকে আছে, নিচে নামছে না। ছেলে দমও ফেলতে পারছে না।
তাই ছেলে বার বার মাথা নেড়ে আর গ্রাস দিতে মানা করছে। কিন্তু মায়ের তখন সেই ছোট্ট শিশুটির কথাই মনে পড়ছে - ছেলেবেলায় সে মুখে খাবার জমিয়ে রেখে এভাবেই মাথা নেড়ে মানা করত। আজও ছেলে সেই শিশুটিই রয়ে গেছে, তেমনি বুঝি দুষ্টুমি করছে, মাথা ঝাঁকিয়ে মুখে খাবার দিতে মানা করছে। মা তাই অন্য কিছু না ভেবে ছেলের মুখে গ্রাসের পর গ্রাস খাবার দিয়েই যাচ্ছেন।
ছেলে অতি কষ্টে ঢুক গিলে মাকে বলছে,”উম্মি মুঁজে আব্ দিজিঁয়েজি, মুঁজে আব্ দিজিঁয়ে”, মা তো খুশিতে গদগদ, ছেলে আমার সাথে উর্দ্দূ বলছে। এটাকে ছেলের উর্দ্দূ ভাষায় দুষ্টামী ভেবে মা খুব মজা পাচ্ছেন - ”পাগল ছেলে আর কি, আমার সাথে সেই ছোট্ট শিশুটির মতই দুষ্টামি করছ” তাই আবারো ছেলের মুখে খাবার দিয়েই যাচ্ছেন।
হায়রে মাতৃস্নেহ আর তার বেহেশ্তি ভাষা ভক্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলের বুকে খাবার আটকে ফাঁস লেগে তার শেষ নিঃশ্বাসটুকু ও বন্ধ হয়ে গেল, দেখতে দেখতে মায়ের কোলেই দেওবন্দের পাঁগড়িধারী ছেলের মৃত্যু হল।
---------------------------------------------------------
কৈফিয়তঃ উদ্ধৃত রচনাটি নেহায়েতই ছেলেবেলায় শোনা একটা প্রতীকি গল্প মাত্র। এর সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই বা কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার কোন ইচ্ছাও নেই। তারপরও যদি কেউ আহত বোধ করেন আমি বিনীত ক্ষমা প্রার্থী।
ইংরেজ শাসক বা স্থানীয় জমিদার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যা ও দু’একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল সে গুলোতে মূলতঃ হিন্দু পরিবারের ছেলে-মেয়েরাই লেখাপড়া করত। মুসলমানরা তাদের ছেলেমেয়েদের সেসব স্কুলে পাঠানোর কথা চিন্তাও করতে পারত না। আর ওই সব গ্রন্ডগ্রামের মেয়েদের তো সে সময় লেখাপড়ার প্রশ্নই ছিল না। বিশেষ করে মুসলমানরা ইংরেজের স্কুলে লেখাপড়া করা বা ইংরেজী শেখাকে পাপ্ কাজ বলেই জ্ঞান করত। সঙ্গত কারণেই তৎকালীন মুসলমানরা লেখা-পড়া, ব্যবসা-বানিজ্য ও সরকারী চাকরীর সুযোগ থেকে ছিল একেবারেই বঞ্চিত।
মুসলমানরা তখন তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে বড়জোর স্থানীয় মসজিদের প্রাতঃকালীন মক্তবে ’কায়দা, আমপাড়া’ মুখস্ত করানো আর নামাজের তালিম নেয়াকেই উত্তম লেখাপড়া বলে বিবেচনা করত। অবশ্য কেউ কেউ ধৈর্য্য ধরে আরো কিছুদিন কোরানশরিফ পড়া ও মুখস্ত করে হাফেজ হওয়া অথবা দু’চারটি হাদিস সহ ধর্মীয় মাসালা-মাসায়েল জানাকেই সর্ব্বোচ্য শিক্ষা হিসাবে জ্ঞান করত। মুসলমান সমাজ এদরকে সম্মানসূচক খেতাব দিয়ে - মোল্লা বা মুন্শী বলে মানত। পরবর্তীতে এরাই মসজিদের ইমাম, মক্তবের হুজুর বা সমাজের ধর্মীয় নেতার ভূমিকা পালন করত।
সত্যিকার অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় শিক্ষিত এখনকার মত আলেম তখন গ্রাম্য সমাজে বলতে গেলে ছিলই না। আর এসব অর্ধশিক্ষিত মুন্শী বা মোল্লা সাহেবরা ফতোয়া দিতেন, ধর্মীয় বিধান দিতেন, বিচার সালিশ করতেন। তখনকার গ্রামের অর্থনীতি ছিলো পুরোপুরি বিনিময় প্রথার উপর নির্ভরশীল। বিনিময় করার মত যথার্থ পণ্য না মিললে তবেই সীমিত ক্ষেত্রে মুদ্রার বিকল্প হিসাবে এক জাতীয় কড়ির প্রচলন ছিল। বৃটিশ শাসনামলে বৃটিশরাজ (তৎকালীন বৃটেনের রাণী) মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি খোদাই করা ধাতব মুদ্রার প্রচলন করলে এক শ্রেণীর ধর্মীয় হুজুর তো ফতোয়াই দিয়ে বসলেন - "নাছারা আওরত; বৃটিশ রাণীর মাথাওয়ালা টাকা কাছে রাখা গোনাহের কাজ, এই টাকা সাথে নিয়ে নামাজ পড়লে তা’ও দুরস্ত হবে না”।
এখনকার দিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব্বোচ্য ডিগ্রীর চেয়েও তখনকার দিনের দেওবন্দের আলেম হওয়া ছিলো অতি গৌরবের বিষয়। গোটা পরগনা জুড়েও এমন আলেম দু’একজন ছিলেন না। এই যখন অবস্থা তখন গ্রামের এক সঙ্গতি সম্পন্না বিধবা তার একমাত্র ছেলেকে বড় আলেম বানাবেন বলে স্থির করলেন। সে অনুযায়ী বিধবা বড় শখ করে একমাত্র ছেলেকে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়তে পাঠালেন। হিন্দি ভাষা অধ্যূষিত ভারতের দেওবন্দে লেখাপড়ার মাধ্যম ছিল উর্দ্দূ। সুতরাং বিধবার একমাত্র ছেলে বহুদিন দেওবন্দে থেকে উর্দ্দূ মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে বড় আলেম হয়ে পাঁগড়ি লাভ করল। (পাঁগড়ি হল; এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে সমাবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে যে টুপি প্রদান করা হয় তারই অনুরূপ স্বীকৃতি বিশেষ)।
বহুদিন পর বিধবার ছেলে মায়ের আশা পূরণ করে দেওবন্দ থেকে বড় আলেম হয়ে পাঁগড়ি নিয়ে দেশে ফিরেছে। চারিদিকে রব পড়ে গেছে, বহু দূর-দূরান্ত থেকে দলেদলে লোকজন ছুটে আসছে দেওবন্দ পাশ এতবড় একজন আলেমকে দেখে পূণ্য লাভ করতে। বিধবার এতদিনের স্বপ্ন-সাধ পূরণ হয়েছে, ছেলে আজ এতবড় আলম হয়ে ফিরে এসেছে যা ইতোপূর্বে এদেশে আর কেউ চিন্তাও করতে পারে নি। সঙ্গতঃ কারণেই ছেলের গর্বে ও তৃপ্তিতে মায়ের বুক ভরে উঠেছে।
আত্মীয় পড়শিদের মাঝে মায়ের মর্যাদা অনেক বেড়ে গেছে। বিধবা বড় তৃপ্তিভরে সবাইকে বলছেন - ”বাছা আমার অনেক জ্ঞানী হয়ে ফিরেছে, উর্দ্দূ ছাড়া কথাই বলে না। আহা ! ছেলের মুখের কথা কী সুন্দর। আমার ছেলে বেহেশ্তি ভাষায় কথা বলে, শুনলেও পূণ্য হয়। আহা, কী সুললিত জবানী, কান জুড়িয়ে যায়, কলিজা ঠান্ডা হয়, কি বল তোমরা” - আত্মীয় প্রতিবেশীরাও বিমোহিত হয়ে তা’ সমর্থন করেন।
বহুদিন পর বিধবা তার ছেলেকে কাছে পেয়েছেন। ছেলের নানান খোঁজ-খবরই মা জানতে চান - ”এতদিন কেমন ছিলে বাবা, কি খেয়েছ, কি পড়েছ, মায়ের কথা মনে পড়ত কি” ইত্যাদি। ছেলে মাতৃভাষাতেই মায়ের সাথে কথোপকথন করছিল তাতে মা ক্ষুন্ন হয়ে ছেলেকে বললেন, ”বাবা তুমি বেহেশ্তি ভাষা শিখেছ, তা শুনলেও যে সোয়াবের কাজ। আমি এতবড় আলেমের মা, আমাকেও ওই ভাষা শিখাও, তা’ না হলে এত কষ্ট আর সাধনায় যা শিখে এসেছ তা’ আমি বুঝব কি করে ? কাজেই এখন থেকে বেশী বেশী করে তোমার শেখা বেহেশ্তি ভাষাতেই আমার সাথে কথা বলবে”।
এতদিন পর বুকের মানিককে কাছে পেয়েছে, মায়ের মন ছেলের জন্য কত আঁকুপাকু করছে। কতদিন কাছে বসে ছেলেকে ভালমন্দ নিজের হাতে খাওয়াতে পারেন না। সুতরাং মা অনেক শখ করে ছেলের জন্য নানান রকম খাবার - পিঠা, পায়েশ, মন্ড, ঘন্ট কোন কিছুই তৈরী করতে বাদ রাখেন নি। ছেলে বাড়ি আসা অবধি লোকজনে বাড়ি থৈ-থৈ করছে, ছেলেকে ভাল করে খাওয়াবেন দূরে থাক তাকে কাছেই পাচ্ছেন না। এতে মা কষ্ট পেলেও খুব গর্বই বোধ করছেন।
বেশ রাতে সব লোকজন চলে যাবার পর ছেলে ঘরে এসে মাকে বলছে - ”মা বড্ড ক্ষিধা পেয়েছে, কত দিন তোমার হাতে খাইনা, আজ আমাকে তোমার হতে খাইয়ে দাও”। মা ও তা’ই চাইছিলেন তাই বললেন - ”বাবা আমি তোমাকে আজ সেই ছেলেবেলার ছোট্ট শিশুটির মত খাইয়ে দেব, কিন্তু আমার ইচ্ছা তুমি আর আমার সাথে উর্দ্দূ ছাড়া কথা বলবে না। তোমার সাথে কথা বলে বলে আমিও ওই বেহেশ্তি ভাষাখানা শিখে নেব”।
ছেলে বলল - "মা, তুমি তো উর্দ্দূ জাননা, আমি উর্দ্দূতে কথা বললে তুমি বুঝবে কি করে”?
মা জবাব দিলেন - "আরে বাবা আমার ছেলে এতবড় আলেম হ’লেও আমি তো তোর মা’ই আছি, সেই ছোট্ট শিশুটি যখন ছিলি তখন কি তুই কথা বলতে পারতিস, তখন আমি তোর কথা বুঝতাম কি করে? সুতরাং যা বলছি তা করবে, এখন থেকে শুধু উর্দ্দূতেই আমার সাথে কথা বলবে, কেমন? ”
ছেলে লজ্জিত হ'য়ে মায়ের কোল ঘেষে খেতে বসল।
মা খুব যত্ন করে সেই ছোট্ট শিশুটির মত করে আপন হাতে ছেলেকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন। ছেলের মুখের খাবার শেষ করার ফুরসত নাই, মা স্নেহের আতিশয্যে ক্রমাগত ছেলের মুখে গ্রাসের পর গ্রাস খাবার দিয়েই চলেছেন। মুখে খাবার জমে যাচ্ছে, মুখ ভর্ত্তি খাবার নিয়ে ছেলে কথাও বলতে পারছে না। অথচ এ পর্যন্ত যা’ গিলেছে তা’র সবই বুকে আটকে আছে, নিচে নামছে না। ছেলে দমও ফেলতে পারছে না।
তাই ছেলে বার বার মাথা নেড়ে আর গ্রাস দিতে মানা করছে। কিন্তু মায়ের তখন সেই ছোট্ট শিশুটির কথাই মনে পড়ছে - ছেলেবেলায় সে মুখে খাবার জমিয়ে রেখে এভাবেই মাথা নেড়ে মানা করত। আজও ছেলে সেই শিশুটিই রয়ে গেছে, তেমনি বুঝি দুষ্টুমি করছে, মাথা ঝাঁকিয়ে মুখে খাবার দিতে মানা করছে। মা তাই অন্য কিছু না ভেবে ছেলের মুখে গ্রাসের পর গ্রাস খাবার দিয়েই যাচ্ছেন।
ছেলে অতি কষ্টে ঢুক গিলে মাকে বলছে,”উম্মি মুঁজে আব্ দিজিঁয়েজি, মুঁজে আব্ দিজিঁয়ে”, মা তো খুশিতে গদগদ, ছেলে আমার সাথে উর্দ্দূ বলছে। এটাকে ছেলের উর্দ্দূ ভাষায় দুষ্টামী ভেবে মা খুব মজা পাচ্ছেন - ”পাগল ছেলে আর কি, আমার সাথে সেই ছোট্ট শিশুটির মতই দুষ্টামি করছ” তাই আবারো ছেলের মুখে খাবার দিয়েই যাচ্ছেন।
হায়রে মাতৃস্নেহ আর তার বেহেশ্তি ভাষা ভক্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলের বুকে খাবার আটকে ফাঁস লেগে তার শেষ নিঃশ্বাসটুকু ও বন্ধ হয়ে গেল, দেখতে দেখতে মায়ের কোলেই দেওবন্দের পাঁগড়িধারী ছেলের মৃত্যু হল।
---------------------------------------------------------
কৈফিয়তঃ উদ্ধৃত রচনাটি নেহায়েতই ছেলেবেলায় শোনা একটা প্রতীকি গল্প মাত্র। এর সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই বা কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার কোন ইচ্ছাও নেই। তারপরও যদি কেউ আহত বোধ করেন আমি বিনীত ক্ষমা প্রার্থী।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সায়েম খান ২৬/১২/২০১৪সত্যিই মর্মান্তিক একটি গল্প, তবে শিক্ষামূলক।
-
সুদীপ্তবিশ্বাস ০৭/১২/২০১৪ভাল লাগল
-
জমাতুল ইসলাম পরাগ ০৭/১২/২০১৪কবির কবিতাই আমাকে খুব বেশি মুগ্ধ করে।
তবুও বলছি, গল্পের মূল বিষয় উপস্থাপন করতে যেয়ে প্রেক্ষাপটকে খানিকটা দীর্ঘায়িত করেছেন বৈকি।
Dont mind dear poet. I just mention my view. -
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ০৭/১২/২০১৪লেখাটা পড়ে কি মন্তব্য করবো বুঝতে পারছি না। তবে আসলে কি মায়ের ভালোবাসা আর ছেলের মায়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাষ
না আমি জানি না.........................