www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ভাষা দৈন্যতার পরিনতি - দুই

আজ থেকে প্রায় তিনযুগ আগে – গত শতাব্দীর আশির দশকের কথা। কর্মোপলক্ষে রাজিব সাহেব প্রথমবারের মতো দক্ষিণ-কোরিয়া গেছেন। সে দেশের কৃষ্টি-সভ্যতা আর খাবার-দাবারের সাথে তাঁর বিন্দুমাত্র পরিচয়ও নেই। তখনো পর্যন্ত বাঙালীরা ভাগ্যান্বেষণে সে দেশে গিয়ে পৌঁছায়ওনি। বাঙালীর ঘরে জন্ম নিয়ে আজন্ম যেসব খাবার দাবারে তিনি অভ্যস্থ তার কোন বালাই নেই ওখানে। স্বদেশে তখন ঢাকা চট্টগ্রাম শহরের দু’চারটে অভিজাত রেস্তোরায় কতিপয় অবস্থাপন্ন ভাগ্যবান কেবল শখের বাঙনীজ খাবারের স্বাদ অল্পঅল্প নিতে শুরু করেছেন মাত্র।(বাঙনীজ হল – বাঙালী প্রক্রিয়ার তৈরী চায়নীজ খাবারের স্বদেশী সংস্করণ, ওটাকে বাঙনীজই বলা যায়। কারণ, সত্যিকারের চায়নীজ খাবার এদেশে বসে কোন বাঙালীর পক্ষে খাওয়া দূরে থাক, নাক পর্যন্ত এর গন্ধ পৌঁছালেই আর বমি ঠেকাতে পারবে না)।

কোরিয়ায় পৌঁছে রেঁস্তোরাগুলোর খাবারের তালিকা দেখে তো রাজিব সাহেবের চক্ষু ছানাবড়া! রেঁস্তোরাগুলোতে শুকরের মাংশের পাশাপাশি অহরহই শিয়াল, কুকুর, সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, কাঁকড়ার কাঁচা ডিম, লবন দেয়া কাঁচা মাছ, শামুক-গুগলী ইত্যাদি সিদ্ধ কিংবা অর্ধসিদ্ধ পরিবেশন হচ্ছে। ছোট কাপের এক কাপ পরিমান সামান্য কয়টা আঁঠালো ভাত দুই কাঠির (চপ্‌স্টিক) সাহায্যে খায় বটে। নানান ধরণের কাঁচা শাক-পাতা (একটি পাতা তো দেখতে অবিকল আমাদের দেশী - হুল ফুটানো চুৎরা পাতার মতই) সহযোগে ওই অল্প ক’টি ভাত তারা খুব মজা করেই খায় যা কোন অবস্থাতেই বাঙালী রসনার উপযোগী নয় (বাঙালীর জন্য ওই ভাতের পরিমানটি খুবই হাস্যকর ও রসিকতারই শামিল)। সেই সাথে হারাম হালালের একটা আজন্ম সংস্কার তো রয়েছেই।

প্রথম প্রথম সেদেশী প্রিন্সিপল তাঁকে ভোজন করাতে সাথে নিয়ে বিভিন্ন রেঁস্তোরায় যেতেন। খুব আন্তরীক ভাবেই খুঁজে খুঁজে স্থানীয় ভালো ভালো রেঁস্তোরায় নিয়ে গিয়ে অনেক ধৈর্যের সাথে তাঁর পছন্দ ও চাহিদার কথা জানতে চাইতেন। তিনি কি খেতে পছন্দ করেন বা কী হলে তাঁর ভালো হয় ইত্যাদি। কিন্তু এত্তোসব খাবারের কোনটিতেই রাজিব সাহেবের সামান্য আগ্রহও নেই দেখে কোরিয়ান ভদ্রলোক কোন ভাবেই বুঝতে পারলেননা যে, আসলে রাজিব সাহেবের সমস্যা কোথায়? হারাম হালাল বা রুচির ব্যপারটাই বা কী বস্তু? বরং ভদ্রলোক বুঝাতে চাইলেন যে, ”এদেশের সব রেঁস্তোরাই কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত এবং স্বাস্থ্যসম্মত। এখানে খেলে তার স্বাস্থ্য ঝুঁকির কোন কারণ নেই। আমরা সবাই এরচে’ও সাধারণ রেঁস্তোরায় অহরহই খাচ্ছি, আমাদের কোন অসুবিধা হয়না” - ইত্যাদি। এতো চেষ্টা করেও কোন অবস্থাতেই রাজিব সাহেবের মর্জি বুঝতে না পেরে ভদ্রলোক হতাশ হলেন। শেষ পর্যন্ত ব্যপারটা রাজিব সাহেবের উপরই ছেড়ে দিলেন।

আতএব, সমস্যা এখন রাজিব সাহেবের একান্তই নিজের। বিপাকে পড়ে বেচারা নিজের অসহায় অবস্থার কথা ভাবছেন; হায়, এসব খাওয়ার কথা চিন্তা করলে আর দৃশ্য দেখলেও যে পেটের নাড়ি-ভূঁড়ি সব বের হয়ে আসতে চায় একথা কোরিয়ান ভদ্রলোককে তিনি বুঝাবেন কি করে? কাজেই, রাজিব সাহেবের মতো ভেতোবাঙালীর আর বুঝতে বাকী রইল না যে, এদেশে যে ক’দিন আছেন কপালে আর খাবার নেই। কাজেই রুটি, কলা, ফলের রস আর দুধই ভরসা (ওঁয়াক, তাও আবার পাস্তুরীত কাঁচা দুধ)! বাপের জন্মেও এমন বরফ-ঠান্ডা কাঁচা দুধ তিনি খাননি, কেউ খায় বলেও শুনেন নি। তবু প্রাণের দায়ে দোকান থেকে রুটি, কলা, চিপস্‌, বিস্কুট ইত্যাদির সাথে বাধ্য হয়েই এক প্যাকেট ‘ফ্রোজেন’ দুধও তিনি হোটেলে নিয়ে আসেন।

রুটি, কলা, চিপস্, বিস্কুটে কি আর ভেতোবাঙালীর পেটপূজা হয়? সারাদিনের খাটা খাটুনি সেই সাথে পেটের ক্ষুধা - মাঝরাতে রাজিব সাহেবকে আরো অস্থির করে তুলল। চোখে ঘুম আসছেনা, পেট জ্বলছে। রুটি কলা চিপস্‌ও আর খেতে ইচ্ছা করছেনা অথচ ঘরে খাবার বলতে আছে কেবল পাস্তুরীত কাঁচা দুধ। জ্বাল দেয়া গরম দুধ ছাড়া যে এমন বরফ-ঠান্ডা কাঁচা দুধও খাওয়া যায় তা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। বাধ্য হয়েই তিনি চিন্তা করলেন, এমন বরফ-ঠান্ডা কাঁচা দুধ যেহেতু এরা খায়, নিশ্চয়ই এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ নয়। এসব ভেবেচিন্তে তিনি কাগজের ’টেট্রাপ্যাকে’র দুধের প্যাকেটটি হাতে নিলেন; নাক-কান বুঁজে কোন রকম গিলে ফেলবেন।

দুধের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে রাজিব সাহেব দেখলেন; প্যাকেটের গায়ে বাঁটসহ উলানের ছবির একাংশ আর ইংরেজী অক্ষরে লিখা – ‘Mio Milk’ (মিঁউ মিল্ক)। তাঁর তো মাথা ঘুরে গেল; ”আমাদের দেশে ’মিঁউ’ বলতে তো ঠিক বিড়ালকেই বোঝানো হয়! এখানেও কি তাই? আমাদের দেশে যেমন বাবা-মাকে ‘আব্বা-আম্মা’ বলে ডাকা হয়! মজার ব্যপার যে, এখানেও ওরা ঠিক একই শব্দে, একই উচ্চারণেই বাবা-মাকে ডাকে। তবে কি এটা বিড়ালের দুধ? কিন্তু বিড়ালের দুধ বাজারজাত হয় - এমন কথাও তো শুনিনি কোনদিন। যে দুধই বাজারজাত হয় তার ডেইরী খামার থাকে। গরুর খামার, শুকরের খামার এমন কি ছাগল-ভেড়ার খামারের কথাও জানি কিন্তু কুকুর বিড়ালের ডেইরী খামারের কথা তো শুনিনি কখনো। আবার বিড়ালের দুধ বাজারজাত হয় তাও যে ধারণার অতীত?

তাহলে কি এটা শুকরের দুধ? ইংরেজীতেই যখন লেখা - গরুর দুধ হলে তো ‘Cow Milk’-ই লিখতে পারতো! যেমন গরু ইংরেজী Cow আবার গরুর মাংশ ইংরেজী Beaf ছাগল ইংরেজী Goat আবার ছাগলের মাংশ Mutton তেমনি শুকর ইংরেজী Pig, শুকরের মাংশ Pork আবার Ham বলেও জানি। কি জানি; ইংরেজী ভাষার এত মার প্যাঁচ কিছু বুঝিনা। তবে ‘Mio Milk’ মানে আর যা ই হোক মোটেই গরুর দুধ নয় - হয় বিড়ালের দুধ না হয় শুকরের? সুতরাং দুধও আর খাওয়া হলনা।

এসব ভেবে রাজিব সাহেবের মাথাটাই খারাপ হওয়ার যোগাড়। সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকাল বেলা তাঁর কোরিয়ান প্রিন্সিপলের সাথে দেখা হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন ‘Mio Milk’ মানে কি? কোরিয়ান ভদ্রলোক জবাব দিলেন – “কেন? গরুর দুধ”! ভদ্রলোককে দুধের প্যাকেটটি দেখিয়ে রাজিব সাহেব জানতে চাইলেন; ইংরেজীতেই যদি লিখা হল তাহলে ‘Cow Milk’ না লিখে ‘Mio Milk’ লিখা কেন? ভদ্রলোক হেসে জবাব দিলেন; ইংরেজীর আদলে যা দেখছেন ওটা আসলে ইংরেজী নয়, কোরিয়াতে আমরা রোমান আক্ষরও ব্যবহার করে থাকি। ওটাকে আপনি ইংরেজী বলে ভেবেছেন। কোরিয়ান ভাষায় Mio হল গরু আর Milk শব্দটা ইংরেজী (কোরিয়ান-ইংরেজী) মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আসলে ‘Mio Milk’ মানে - গরুর দুধ। রাজিব সাহেব অতি কষ্টে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে গেলেন। হায়রে; ভাষার দূর্বোধ্যতার জন্য তিনি কি না শেষ পর্যন্ত দুধটাকেও নিষিদ্ধ মনে করে খাননি তাই রাতটা আরো বেশী কষ্টে কেটেছে। একথা এই কোরিয়ান ভদ্রলোককে জানানো যেমন লজ্জার তেমনি বিব্রতকরও বটে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৪৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/১২/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রেনেসাঁ সাহা ০৫/১২/২০১৪
    বেশ মজার।
    • অনিরুদ্ধ বুলবুল ০৫/১২/২০১৪
      শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
      লেখা কই? খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে?
      লেখাপড়া ভাল চলছে তো?
      • রেনেসাঁ সাহা ০৫/১২/২০১৪
        লেখা দিয়েছি। আপনি পড়েওছেন। ব্যস্ততা নেই খুব একটা, কখনই থাকে না ওটি।
        • অনিরুদ্ধ বুলবুল ০৬/১২/২০১৪
          হুমম, 'আমার একটা মা আছে' (একজন নয়),
          আমি বলি - আমার এক একটা মা ছিল.....
          কবিতাটি আমার খুব ভাল লেগেছিল।

          ভাল থেকো। প্রাতঃশুভেচ্ছা -
  • আবিদ আল আহসান ০৩/১২/২০১৪
    সুন্দর হয়েছে
  • অগ্নিপক্ষ ০২/১২/২০১৪
    আমি রাজিব সাহেবকে অষ্টপাশ এবং জলদানো খাওয়ার নেমন্তন্ন জানালাম। আমাদের পাড়ায় একটা সি-ফুড রেঁস্ত্র আছে যেখানে খুব টেস্টি অক্টোপাস এবং স্কুইড পাওয়া যায়।
    • অনিরুদ্ধ বুলবুল ০২/১২/২০১৪
      আপনার আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। মনে আছে নিশ্চয়ই; রাজিব সাহেব এত অসহায় অবস্থায় পড়েও সংস্কারের বশে নির্দোষ দুধটুকু পর্যন্ত খান নি। এখন তিনি আপনার প্রস্তাবিত খাবার খাবেন কি না জেনে নিবেন।

      শুভেচ্ছা নিবেন।
  • মাসুম মুনাওয়ার ০২/১২/২০১৪
    নুতুন চিন্তা
  • ০১/১২/২০১৪
    smile
  • রূপক বিধৌত সাধু ০১/১২/২০১৪
    সুন্দর!
  • আবিদ আল আহসান ০১/১২/২০১৪
    waoooo
 
Quantcast