স্মৃতিতে ৭১ (স্বাধীনতা)
১৯৭১ সাল, ক্লাশ টু’তে উঠেছি। বয়স সঠিক নাহলেও এখনকার টু'র ছা্ত্রদের চেয়ে বেশীই হবে। ঘটনা সম্পূর্ণ না বলে শেষ সপ্তাহের কথা বলি । জামালপুর হানাদারমুক্ত হওয়ার দুইদিন আগ থেকে কেমন যেন বিভিন্ন বাদ্য বাজার মত " ঠুল-ঠাল, ফুট-ফাট, দ্রুম-দ্রাম, কেচর-মেচর " নানা প্রকার ভয়ানক শব্দ পাওয়া যেত। চারিদিক থেকে মুক্তিবাহিনী এবং মধুপুর রোডে কাদের বাহিনীর স্বসশ্র আক্রমন পাকবাহিনীদের পালানোর রা্স্তা বন্ধ করে দিল। আমাদের কেপ্টেন ফেরদৌস ভাই সকল পোলাপানদের আরো সতর্কতার সহিত গেরিলা ট্রেনিং দিতে লাগলেন। শীতের খসখসে ঘাসের ঘর্ষনে হাটু এবং কনুই এর ঘা আরো বেড়ে গেল । বলা ভাল যে ফেরদৌস ভাই সকল ছেলেদের চেয়ে বয়সে বড় এবং স্বাস্থবান ছিল। তার উদ্দ্যোগেই সে সময় আমরা গ্রামের সকল ছোট ছেলেরা মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিলাম । বাঁশ, কলার ডাটার রাইফেল কাধেঁ ঝুলিয়ে কুচকাওয়াজ করেছি, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলেছি । তবে আমাদের মনোবল সত্যিকারের মুক্তিবাহিনীর চেয়ে আরও সুদৃঢ় ছিল।
বাড়ীরপাশে বংশী নদী, অনেকটা ছোট খালের মত। শুধু বর্ষাকালে পানি থাকে। নদীর উৎপত্তিস্থল এখানেই, ঝিনাই নদীর শাখা। জামালপুর টু সরিষাবাড়ী রেল ও সড়ক পথের উপর এনদীর দুটো পুল আছে। বিভেদের পার্থক্য পুলের দুই প্রান্ত। উত্তর প্রান্তে পাকহানাদারদের দোসর বদরবাহিনীর ক্যাম্প আর এপ্রান্তে আমরা। প্রতি রাতেই যুদ্ধ হয়, চলে প্রচন্ড গুলাগুলি। প্রথমে একটি ফাঁকা গুলি, সাথে সাথে বাড়ীর সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। আমি, মা, ভাবী, বড় দুই ভাই আর আমার বাবা বাড়ীতে থাকি। আমরা চার ভাই, বড় ভাই বিবাহিত এবং ভাবি সন্তান সম্ভবা, তাই মা বড় ভাইকে যুদ্ধে যেতে দেয়নি। মেঝো ভাই সরাসরি যুদ্ধে গেছে, সেজো আর আমি সবার ছোট বাড়ীতেই থাকি।
আমাদের বাড়ী পুলের অতিনিকটবর্তী রেললাইনের পাশে থাকায় থুব বিপদে ছিলাম। গুলি মাথার উপর দিয়ে শো শো করে গিয়ে ক্যাম্পে পড়ে, আল-বদরের লোকেরা পেরেউঠেনা। আজ থেকে দুই সপ্তাহ আগের একরাতের কথা। গুলির শব্দে আমি মা আর ভাবি নিরাপদে যেতে না পেরে ঘরের খাটের নীচে আশ্রয় নিলাম। ঘরের সকল কাঁথা ও চটের ছালা পরতে পরতে বিছিয়ে তার নিচে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম। মা বিশ্বাস করতো যে কাঁথা ভেদ করে গুলি শরীরে ঢুকতে পারবে না । কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বিপত্তি ঘঠলো, বিকট শব্দে মাইন বিস্ফোড়নের সাথে সাথে আমাদের ঘরের চাল ফুটো করে মাচার হাড়ি ভেংগে একটি অংশ আমার মাথায় আঘাত করে। তৎক্ষনাত ভাবলাম, এই বুঝি মরণ আমার, মাথায় হাত বুলালাম, না কিছু হয়নি।
সকালে দেখলাম ক্যাম্প মুক্তিবাহিনীর আয়ত্বে, মস্তক বিহীন একজন আলবদর পড়ে আছে পাকা ধানের ক্ষেতে, অন্যরা পালিয়েছে। সেদিন থেকে আমরা এলাকায় মুক্তভাবে চলাফেরা করছি। আজ সকালে দুটো জংগি বিমান আমাদের মাথার উপরদিয়ে উড়ে যায় । জামালপুর শহরে পি টি আইয়ে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্পে শক্তিশালি বোমা নিক্ষেপ করে। চেয়ে চেয়ে দেথেছি সেই বিমানের রুদ্রশ্বাস ডিগবাজি। বোমার সে ভারি শব্দের সাথে বিজয়ের আহবান শুনেছি। এখন বৈচিত্রময় কামান, মর্টার, শেল, মেশিনগানের গুলির শব্দ যেন বিজয়ের বাজনা বাজাইতেছে।১০ ই ডিসেম্বর বেলা যতই গড়াইতেছে অস্ত্রের ঝনঝনানী ততই বাড়িতে লাগিল।
সূর্য অস্ত যাও্য়ার পর দেখাগেল নতুন আরেক খেলা। যেন চারিদিক থেকে আগুনের কুন্ডলী শহরের মাঝে নিক্ষিপ্ত হইতেছে। কোনদিক হইতে বৃষ্টির মত, আবার কোনদিক হইতে উল্কাপাতের মত একাধারে পড়িতেছে। আমাদের বাড়ি হতে এই দৃশ্যগুলি দেখিতে দেখিতে রাত গভীর হয়েগেল, তবুও দেখার আকাংখা কমে না। পূবের আকাশ ফর্সা হওয়ার আগেই নিস্তব্ধতা নেমে এল। দেড় হাজার পাকসেনা নিহত হলো এবং হাজার সেনা বিভিন্ন পথে পালাতে লাগলো। পরদিন জামালপুরে মানুষের ঢল নামলো, রাস্তার দু’ধারে পাকসেনাদের মৃতদেহ, ছিন্নভিন্ন, পুড়ে জ্বলসানো, ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। পলাতক সেনাদের ধরে গ্রামের মানুষ ইচ্ছেমত হত্যা করেছে। কোন কোন স্থানে গুলিতে গ্রামের নিরীহ জনতার মৃত্যু জামালপুর মুক্তদিবসের মর্যাদাকে আরও বৃদ্ধি করেছে। ১১ ডিসেম্বর জামালপুরের মানুষ বুকভরে মুক্ত বাতাস নিল।
মেঝো ভাই তার সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে বাড়ী ফিরে এল। অনেকের কাছে মেশিনগান, এস এল আর, রাইফেল, আরো আছে ডিনামাইট, গ্রেনেড সহ গুলাবারুদ। যুদ্ধাস্ত্র গুলো বিজয়ে চকচক করিতেছে । আমার অপলক দৃষ্টিতে মেঝোভাইয়ের বন্ধু আমাকে ডেকে নিলেন। বললেন,-
গুলি করবে ?
আমার চোখ ঝলকানি খেল, বাহিরে নিয়ে রাইফেল আকাশের পানে তাক করে আমাকে বললেন,-
টিগার ধরে টা্ন দাও।
কলার ডাটাদিয়ে বনানো রাইফেলে অনেক গুলি করেছি, বাঁশের চোঙ্গায় মালেরগুটা বা শীমের পাতা কচলিয়ে ভরে বন্দুক ফুটিয়েছি কিন্তু আজ আমার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না। চোখবুজে দিলাম টান, গগনবিদারী শব্দে কম্পিতহলাম। হৃদয়ের শিহরণ জানানদিল; আমার গুলিতে অদৃশ্য শেষ শত্রু পরাজিত হলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষুদে বীর মুক্তিযুদ্ধাদের সারিতে আমিও একজন ।
ফেরদৌস ভাই সহ আমাদের গ্রামের খেলার সাথীরাও ।
বাড়ীরপাশে বংশী নদী, অনেকটা ছোট খালের মত। শুধু বর্ষাকালে পানি থাকে। নদীর উৎপত্তিস্থল এখানেই, ঝিনাই নদীর শাখা। জামালপুর টু সরিষাবাড়ী রেল ও সড়ক পথের উপর এনদীর দুটো পুল আছে। বিভেদের পার্থক্য পুলের দুই প্রান্ত। উত্তর প্রান্তে পাকহানাদারদের দোসর বদরবাহিনীর ক্যাম্প আর এপ্রান্তে আমরা। প্রতি রাতেই যুদ্ধ হয়, চলে প্রচন্ড গুলাগুলি। প্রথমে একটি ফাঁকা গুলি, সাথে সাথে বাড়ীর সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। আমি, মা, ভাবী, বড় দুই ভাই আর আমার বাবা বাড়ীতে থাকি। আমরা চার ভাই, বড় ভাই বিবাহিত এবং ভাবি সন্তান সম্ভবা, তাই মা বড় ভাইকে যুদ্ধে যেতে দেয়নি। মেঝো ভাই সরাসরি যুদ্ধে গেছে, সেজো আর আমি সবার ছোট বাড়ীতেই থাকি।
আমাদের বাড়ী পুলের অতিনিকটবর্তী রেললাইনের পাশে থাকায় থুব বিপদে ছিলাম। গুলি মাথার উপর দিয়ে শো শো করে গিয়ে ক্যাম্পে পড়ে, আল-বদরের লোকেরা পেরেউঠেনা। আজ থেকে দুই সপ্তাহ আগের একরাতের কথা। গুলির শব্দে আমি মা আর ভাবি নিরাপদে যেতে না পেরে ঘরের খাটের নীচে আশ্রয় নিলাম। ঘরের সকল কাঁথা ও চটের ছালা পরতে পরতে বিছিয়ে তার নিচে আমরা হামাগুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম। মা বিশ্বাস করতো যে কাঁথা ভেদ করে গুলি শরীরে ঢুকতে পারবে না । কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বিপত্তি ঘঠলো, বিকট শব্দে মাইন বিস্ফোড়নের সাথে সাথে আমাদের ঘরের চাল ফুটো করে মাচার হাড়ি ভেংগে একটি অংশ আমার মাথায় আঘাত করে। তৎক্ষনাত ভাবলাম, এই বুঝি মরণ আমার, মাথায় হাত বুলালাম, না কিছু হয়নি।
সকালে দেখলাম ক্যাম্প মুক্তিবাহিনীর আয়ত্বে, মস্তক বিহীন একজন আলবদর পড়ে আছে পাকা ধানের ক্ষেতে, অন্যরা পালিয়েছে। সেদিন থেকে আমরা এলাকায় মুক্তভাবে চলাফেরা করছি। আজ সকালে দুটো জংগি বিমান আমাদের মাথার উপরদিয়ে উড়ে যায় । জামালপুর শহরে পি টি আইয়ে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্পে শক্তিশালি বোমা নিক্ষেপ করে। চেয়ে চেয়ে দেথেছি সেই বিমানের রুদ্রশ্বাস ডিগবাজি। বোমার সে ভারি শব্দের সাথে বিজয়ের আহবান শুনেছি। এখন বৈচিত্রময় কামান, মর্টার, শেল, মেশিনগানের গুলির শব্দ যেন বিজয়ের বাজনা বাজাইতেছে।১০ ই ডিসেম্বর বেলা যতই গড়াইতেছে অস্ত্রের ঝনঝনানী ততই বাড়িতে লাগিল।
সূর্য অস্ত যাও্য়ার পর দেখাগেল নতুন আরেক খেলা। যেন চারিদিক থেকে আগুনের কুন্ডলী শহরের মাঝে নিক্ষিপ্ত হইতেছে। কোনদিক হইতে বৃষ্টির মত, আবার কোনদিক হইতে উল্কাপাতের মত একাধারে পড়িতেছে। আমাদের বাড়ি হতে এই দৃশ্যগুলি দেখিতে দেখিতে রাত গভীর হয়েগেল, তবুও দেখার আকাংখা কমে না। পূবের আকাশ ফর্সা হওয়ার আগেই নিস্তব্ধতা নেমে এল। দেড় হাজার পাকসেনা নিহত হলো এবং হাজার সেনা বিভিন্ন পথে পালাতে লাগলো। পরদিন জামালপুরে মানুষের ঢল নামলো, রাস্তার দু’ধারে পাকসেনাদের মৃতদেহ, ছিন্নভিন্ন, পুড়ে জ্বলসানো, ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। পলাতক সেনাদের ধরে গ্রামের মানুষ ইচ্ছেমত হত্যা করেছে। কোন কোন স্থানে গুলিতে গ্রামের নিরীহ জনতার মৃত্যু জামালপুর মুক্তদিবসের মর্যাদাকে আরও বৃদ্ধি করেছে। ১১ ডিসেম্বর জামালপুরের মানুষ বুকভরে মুক্ত বাতাস নিল।
মেঝো ভাই তার সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে বাড়ী ফিরে এল। অনেকের কাছে মেশিনগান, এস এল আর, রাইফেল, আরো আছে ডিনামাইট, গ্রেনেড সহ গুলাবারুদ। যুদ্ধাস্ত্র গুলো বিজয়ে চকচক করিতেছে । আমার অপলক দৃষ্টিতে মেঝোভাইয়ের বন্ধু আমাকে ডেকে নিলেন। বললেন,-
গুলি করবে ?
আমার চোখ ঝলকানি খেল, বাহিরে নিয়ে রাইফেল আকাশের পানে তাক করে আমাকে বললেন,-
টিগার ধরে টা্ন দাও।
কলার ডাটাদিয়ে বনানো রাইফেলে অনেক গুলি করেছি, বাঁশের চোঙ্গায় মালেরগুটা বা শীমের পাতা কচলিয়ে ভরে বন্দুক ফুটিয়েছি কিন্তু আজ আমার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না। চোখবুজে দিলাম টান, গগনবিদারী শব্দে কম্পিতহলাম। হৃদয়ের শিহরণ জানানদিল; আমার গুলিতে অদৃশ্য শেষ শত্রু পরাজিত হলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষুদে বীর মুক্তিযুদ্ধাদের সারিতে আমিও একজন ।
ফেরদৌস ভাই সহ আমাদের গ্রামের খেলার সাথীরাও ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জে এস সাব্বির ২১/১২/২০১৫
-
নির্ঝর ২০/১২/২০১৫ভাল লাগলো
-
নূরুল ইসলাম ১৭/১২/২০১৫প্রিয় এডমিন মহোদয়, আমার লেখা একটি প্রবন্ধ আপনার বরাবরে পেশ করেছি। বেশ কয়েকদিন হলো প্রকাশিত না হওয়ায় উদ্ধেগের কারণ। আশাকরি আমাকে ঋণি করবেন। ধন্যবাদ।
যাই হোক ,ব্লগে স্বাগতম ।নিয়মিত পাঠক হিসেবে নিয়মিত লেখার আহ্বান ।