হিজড়া সম্প্রদায়কে নিয়ে কিছু কথা
জীবনে চলার পথে অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়, গড়ে ওঠে সখ্যতা। একেক সময় একেক রকম ভালোবাসা অনুভব করলেও আজ শেয়ার করব অন্যরকম ভালোবাসা। সাম্প্রতিক সময়ে একজন হিজড়ার সাথে ছবি উঠে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল। অনেকের নাক সিটকানো মতামত জানার পর মনে হল যে হিজড়া সম্প্রদায়কে নিয়ে সকলকে অবগত করা দরকার। আমরা সব সময় না জেনেও সব জান্তা হয়ে যাই। মনে হয় যে পয়দা হবার আগে সবকিছু জেনে তারপর পয়দা হয়েছি। আমি যা জানি অন্য কেউ আর জানে না। আমি যাহা বলি তাহাই সঠিক। প্রিয় ফেসবুক বন্ধুগণ এমন ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
একসময় হিজড়া দেখলে আমিও ভয় পেতাম। তাদের সম্পর্কে অনেক রকমের ভ্রান্তিকর তথ্য শুনেছি। তাই আমার প্রবল ইচ্ছা জাগল গভীরে গিয়ে জানার। অনেকের সাথে কথা বলার পর তাদের জীবন যাত্রা সম্পর্কে জানলাম। এই জনগোষ্ঠীর প্রতি আমার একটা অন্যরকম ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। যখন আপনি কোন গোষ্ঠীর প্রতি গভীর দৃষ্টি দিবেন তখন আপনার ধারনাগুলো পাল্টে যাবে।
২০১৭ সাল থেকে আমি তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি। আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। আমার মেসে রান্না করার কাজ করতো তিনজন হিজড়া। রান্নাঘরে যখন খাবার আনতে যাই তখন দেখি অনেকেই তাদের সাথে বাজে আচরণ করে। তারা সবকিছু সহ্য করে হাসিমুখে মেনে নেয়। কয়েকদিন থাকার পর হঠাৎ একদিন মনে হলো তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার। সুযোগ তৈরি করে নিলাম একজনের সাথে বসে গল্প করার। আমাকে কথা বলতে দেখে অনেকে আড়চোখে দেখছিল। তখন তিনি আমাকে বললেন চলেন রান্নাঘরে না থেকে আমার রুমে গিয়ে বসে কথা বলি।
আমার প্রশ্নগুলো শুনে তিনি হাসছিলেন। হাসতে হাসতে অনেক কথা হলো। তারপর যখন আমি আরো গভীরে যাওয়া শুরু করলাম তখন কান্না শুরু করে দিলেন। গল্পের সাথে সাথে তার চোখের জল দেখে আমারও খুব খারাপ লাগছিল। মাঝেমধ্যে থেমে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম এবং জোর করছিলাম আমাকে যেন তিনি তার জীবনের এই ঘটনাগুলো বলেন। তিনি যখন পরিবার-পরিজন ছেড়ে বাইরে চলে আসার ঘটনাগুলো আমাকে বলছিলেন। অজান্তেই আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। হিজড়া সন্তান বাড়িতে থাকায় নাকি পরিবারের অন্য সবার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। তাই তাকে বাধ্য করা হয়েছে ঘরবাড়ি ছাড়তে। বিদায়ের সময় আবার এলাকাবাসী মায়াও দেখাইছে!
এরপর গ্রাম ছেড়ে যখন শহরে এসেছেন।কোথাও ঠাঁই হচ্ছিলো না। কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে হতাশ হয়ে ফেরেন। কোনো বাসার মালিক তাকে বাসা ভাড়া দিতেও রাজি হননি। পরে আরো অন্য হিজড়াদের শরণাপন্ন হয়ে একজন হিজড়ার বাসায় আশ্রয় মেলে। সেখানে ১০/১২ জন হিজড়া থাকতেন। আশেপাশের লোকজন তাদের সহ্য করতে পারতেন না। সবাই জোট হয়ে এসে সবাইকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। শুধুমাত্র হিজড়া হবার কারণেই এত দুর্দশা। সবকিছু শোনার পর মনে হল হিজড়া এই সমাজে নিপীড়িত নির্যাতিত একটা সম্প্রদায়।
আমরাই তাদের জীবিকা নির্বাহের পথের কাঁটা। আবার আমরাই নানান কথা শোনাই তাদের। তারা নানান পেশার সাথে যুক্ত হতে চায়। কিন্তু আমরা তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করি। তারা যখন বাস কিংবা ট্রেনে দুই টাকার জন্য কারো কাছে হাত পাতেন, তাদেরকে বাধ্য করি আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করতে। যখন কোন দোকানের সামনে গিয়ে দুই টাকার বায়না করেন সেখানেও তাদেরকে বাধ্য করি খারাপ আচরণ করতে। তারা আসলে কারো সাথে খারাপ আচরণ করতে চায় না। টাকা দেয়ার ছলে কেউ হাত ধরে টান দেই কেউবা পরিধেয় কাপড়। আবার কেউবা তাদের দেখামাত্র খারাপ ভাষা ব্যবহার করি। তবে কেউ তাদের জীবনকে নিয়ে উপলব্ধি করিনা বা করার চেষ্টা করি না।
আমরা কেউ কি জানার চেষ্টা করেছি, একজন হিজড়া নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে কেন বাইরে জীবন যাপন করছেন? তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে কিভাবে ভবঘুরে জীবন পার করছেন? কেন মানুষের কাছে হাত পাতেন? আমরা সেটা জানার চেষ্টা করি না। তবে তাদের ব্যাপারে যেকোনো নেগেটিভ কথা বলতে মুখে একবার বাধে না। আমরা পুরুষরা নিজেদের পুরুষ মনে করি আর হিজড়াদেরকে মানুষ মনে করি না। কিন্তু বাস্তবতায় বিবেচনা করলে দেখা যাবে তারাই সঠিক আর আমরা কাপুরুষ!
আমরা যারা হিজরা সম্প্রদায়ের লোকজনকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করি এটা একটা ভুল ধারণা। মানুষের লিঙ্গ হয় নারী অথবা পুরুষ, এর বাইরে কিছু নেই। সমাজে যারা হিজড়া হিসেবে পরিচিত, তারা অভ্যন্তরীণভাবে নারী অথবা পুরুষ হয়ে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারণ করা এখন খুব সহজ। তাহলে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ কেন বলা হবে? তাদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ বলে, নারী ও পুরুষের মূল স্রোত থেকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। একজন মানুষকে যদি তার আল্লাহ প্রদত্ত লিঙ্গ পরিচয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে সেটি হবে ওই মানুষের প্রতি অন্যদের অন্যায়।
শারীরিক নানা ত্রুটি নিয়ে মানুষের জন্ম হয়। লিঙ্গ ত্রুটিও একটি রোগ। এ রোগের কারণে যদি তাকে বর্জন করা হয়। তার মূল লিঙ্গ স্বীকার না করা হয়। তাহলে তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চনা করা হবে। সুতরাং হিজড়া সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নয়, তাদের নিজস্ব লিঙ্গ হিসেবেই পরিচয় দিয়ে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসতে হবে। তবে কারা আসল হিজড়া আর কারা কৃত্রিম সেটাও খুঁজে বের করে কৃত্রিম হিজড়াদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা দরকার। এবং যারা বাস্তবেই জন্মগত হিজড়া। অর্থাৎ বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নর-নারী মিশ্রিত। তাদের আলামত ও পরীক্ষার মাধ্যমে মূল লিঙ্গ পরিচয় উদ্ঘাটন করে সেই পরিচয়ে তাদের পরিচিত হতে সহায়তা করা দরকার।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। অন্য একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপমতে এ সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। বৈষম্য দূর করতে ও সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর আগে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হিজড়াদেরকে হয় নারী নয়তো পুরুষ লিঙ্গ বেছে নিতে হতো।
হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজে এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা সহ অনেক দিক থেকে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার। সাম্প্রতিক সময়ে একজন হিজড়ার সাথে ছবি উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করি। চেনা অচেনা অনেক মানুষের মন্তব্য দেখে মনে হল তাদের অবহেলিত জীবন যাপন সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ধর্ম পালনের উপর। যেন হিজড়া হওয়ার কারণে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে তারা মুক্ত। ধর্মের বিধানাবলি মনেহয় কেবল পুরুষ ও নারীর জন্যই প্রদত্ত, তাদের জন্য নয়।
অথচ, ইসলাম হিজড়াদেরকে গুরুত্বহীন মনে করেনা বিধায় ইসলামী শরীয়ত মিরাছ তথা সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য পরিস্কার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ইসলামি শরীয়া অনুযায়ী হিজড়া সন্তান তারা মা- বাবার সম্পত্তির ভাগ পাবে। এবং উত্তরাধিকার সম্পদে তারা নারী হিসেবে পাবে নাকি পুরুষ হিসেবে পাবে সেটা ইসলামী শরীয়াত নিশ্চিত করেছে। এবং ইসলামী শরীয়ত ও তাদেরকে মিরাছ ও বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষ বা মহিলা হিসাবে চিন্থিত করে তাদের উপর সাধারণ পুরুষ বা মহিলা হুকুম আরোপ করে থাকে। অর্থাৎ এক হিজড়া বিপরীতধর্মী অন্য হিজড়ার সাথে বা সাধারণ কোনো মানুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে শরীয়ত সমর্থিত সহবাসের বৈধ পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে হবে।
একজন মানুষ হিসেবে আপনার আমার করণীয় কি? হিজড়াদেরও সম্মানের চোখে দেখতে হবে। তারাও তো মানুষ। মানুষ মাত্রই সম্মানের পাত্র। সূরা বনী ইসরাঈলের ৭০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতালা বলেছেন, ‘বাস্তবিকপক্ষে আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি।’ অতএব মানুষ হিসাবে একজন হিজড়াকে ঘৃণার চোখে দেখা, তুচ্ছ ভাবার কোনো অবকাশ ইসলামে নেই।
একই বাবা-মার ঘরে দুই ভাই কি একে অপরকে ঘৃণা করতে পারে? আদম সন্তান হিসেবে একজন মুসলিম যেমন আমার ভাই, তেমনি একজন হিজড়াও আমার ভাই কিংবা বোন। হিজড়া হওয়ার পেছনে তার কোনো হাত নেই, এটি একটি রোগ; হরমোনজনিত সমস্যা। কোনো রোগীকে কি তার রোগের কারণে ঘৃণা করা যায়? এছাড়াও আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার মানদণ্ড নারী বা পুরুষ হওয়া নয়। যে মোত্তাকি সে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান। এ মর্যাদা একজন হিজড়ারও হতে পারে। সুতরাং হিজড়াকে হিজড়া হওয়ার কারণে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
অনেককে দেখা যায়-হিজড়াদের সঙ্গে বিদ্রুপ করতে। উপহাস করতে। এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ, উপহাস না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ইমানের পর মন্দ নাম কতই-না নিকৃষ্ট! আর যারা তওবা করে না, তারাই তো জালেম।’ সুরা হুজুরাত: ১১
#nurnobifulkuri
18 November 2024
একসময় হিজড়া দেখলে আমিও ভয় পেতাম। তাদের সম্পর্কে অনেক রকমের ভ্রান্তিকর তথ্য শুনেছি। তাই আমার প্রবল ইচ্ছা জাগল গভীরে গিয়ে জানার। অনেকের সাথে কথা বলার পর তাদের জীবন যাত্রা সম্পর্কে জানলাম। এই জনগোষ্ঠীর প্রতি আমার একটা অন্যরকম ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে। যখন আপনি কোন গোষ্ঠীর প্রতি গভীর দৃষ্টি দিবেন তখন আপনার ধারনাগুলো পাল্টে যাবে।
২০১৭ সাল থেকে আমি তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি। আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। আমার মেসে রান্না করার কাজ করতো তিনজন হিজড়া। রান্নাঘরে যখন খাবার আনতে যাই তখন দেখি অনেকেই তাদের সাথে বাজে আচরণ করে। তারা সবকিছু সহ্য করে হাসিমুখে মেনে নেয়। কয়েকদিন থাকার পর হঠাৎ একদিন মনে হলো তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জেনে নেওয়া দরকার। সুযোগ তৈরি করে নিলাম একজনের সাথে বসে গল্প করার। আমাকে কথা বলতে দেখে অনেকে আড়চোখে দেখছিল। তখন তিনি আমাকে বললেন চলেন রান্নাঘরে না থেকে আমার রুমে গিয়ে বসে কথা বলি।
আমার প্রশ্নগুলো শুনে তিনি হাসছিলেন। হাসতে হাসতে অনেক কথা হলো। তারপর যখন আমি আরো গভীরে যাওয়া শুরু করলাম তখন কান্না শুরু করে দিলেন। গল্পের সাথে সাথে তার চোখের জল দেখে আমারও খুব খারাপ লাগছিল। মাঝেমধ্যে থেমে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম এবং জোর করছিলাম আমাকে যেন তিনি তার জীবনের এই ঘটনাগুলো বলেন। তিনি যখন পরিবার-পরিজন ছেড়ে বাইরে চলে আসার ঘটনাগুলো আমাকে বলছিলেন। অজান্তেই আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। হিজড়া সন্তান বাড়িতে থাকায় নাকি পরিবারের অন্য সবার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। তাই তাকে বাধ্য করা হয়েছে ঘরবাড়ি ছাড়তে। বিদায়ের সময় আবার এলাকাবাসী মায়াও দেখাইছে!
এরপর গ্রাম ছেড়ে যখন শহরে এসেছেন।কোথাও ঠাঁই হচ্ছিলো না। কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে হতাশ হয়ে ফেরেন। কোনো বাসার মালিক তাকে বাসা ভাড়া দিতেও রাজি হননি। পরে আরো অন্য হিজড়াদের শরণাপন্ন হয়ে একজন হিজড়ার বাসায় আশ্রয় মেলে। সেখানে ১০/১২ জন হিজড়া থাকতেন। আশেপাশের লোকজন তাদের সহ্য করতে পারতেন না। সবাই জোট হয়ে এসে সবাইকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। শুধুমাত্র হিজড়া হবার কারণেই এত দুর্দশা। সবকিছু শোনার পর মনে হল হিজড়া এই সমাজে নিপীড়িত নির্যাতিত একটা সম্প্রদায়।
আমরাই তাদের জীবিকা নির্বাহের পথের কাঁটা। আবার আমরাই নানান কথা শোনাই তাদের। তারা নানান পেশার সাথে যুক্ত হতে চায়। কিন্তু আমরা তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করি। তারা যখন বাস কিংবা ট্রেনে দুই টাকার জন্য কারো কাছে হাত পাতেন, তাদেরকে বাধ্য করি আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করতে। যখন কোন দোকানের সামনে গিয়ে দুই টাকার বায়না করেন সেখানেও তাদেরকে বাধ্য করি খারাপ আচরণ করতে। তারা আসলে কারো সাথে খারাপ আচরণ করতে চায় না। টাকা দেয়ার ছলে কেউ হাত ধরে টান দেই কেউবা পরিধেয় কাপড়। আবার কেউবা তাদের দেখামাত্র খারাপ ভাষা ব্যবহার করি। তবে কেউ তাদের জীবনকে নিয়ে উপলব্ধি করিনা বা করার চেষ্টা করি না।
আমরা কেউ কি জানার চেষ্টা করেছি, একজন হিজড়া নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে কেন বাইরে জীবন যাপন করছেন? তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে কিভাবে ভবঘুরে জীবন পার করছেন? কেন মানুষের কাছে হাত পাতেন? আমরা সেটা জানার চেষ্টা করি না। তবে তাদের ব্যাপারে যেকোনো নেগেটিভ কথা বলতে মুখে একবার বাধে না। আমরা পুরুষরা নিজেদের পুরুষ মনে করি আর হিজড়াদেরকে মানুষ মনে করি না। কিন্তু বাস্তবতায় বিবেচনা করলে দেখা যাবে তারাই সঠিক আর আমরা কাপুরুষ!
আমরা যারা হিজরা সম্প্রদায়ের লোকজনকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করি এটা একটা ভুল ধারণা। মানুষের লিঙ্গ হয় নারী অথবা পুরুষ, এর বাইরে কিছু নেই। সমাজে যারা হিজড়া হিসেবে পরিচিত, তারা অভ্যন্তরীণভাবে নারী অথবা পুরুষ হয়ে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারণ করা এখন খুব সহজ। তাহলে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ কেন বলা হবে? তাদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ বলে, নারী ও পুরুষের মূল স্রোত থেকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। একজন মানুষকে যদি তার আল্লাহ প্রদত্ত লিঙ্গ পরিচয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে সেটি হবে ওই মানুষের প্রতি অন্যদের অন্যায়।
শারীরিক নানা ত্রুটি নিয়ে মানুষের জন্ম হয়। লিঙ্গ ত্রুটিও একটি রোগ। এ রোগের কারণে যদি তাকে বর্জন করা হয়। তার মূল লিঙ্গ স্বীকার না করা হয়। তাহলে তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চনা করা হবে। সুতরাং হিজড়া সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নয়, তাদের নিজস্ব লিঙ্গ হিসেবেই পরিচয় দিয়ে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসতে হবে। তবে কারা আসল হিজড়া আর কারা কৃত্রিম সেটাও খুঁজে বের করে কৃত্রিম হিজড়াদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা দরকার। এবং যারা বাস্তবেই জন্মগত হিজড়া। অর্থাৎ বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নর-নারী মিশ্রিত। তাদের আলামত ও পরীক্ষার মাধ্যমে মূল লিঙ্গ পরিচয় উদ্ঘাটন করে সেই পরিচয়ে তাদের পরিচিত হতে সহায়তা করা দরকার।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। অন্য একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপমতে এ সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। বৈষম্য দূর করতে ও সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর আগে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হিজড়াদেরকে হয় নারী নয়তো পুরুষ লিঙ্গ বেছে নিতে হতো।
হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমান কাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজে এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা সহ অনেক দিক থেকে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার। সাম্প্রতিক সময়ে একজন হিজড়ার সাথে ছবি উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করি। চেনা অচেনা অনেক মানুষের মন্তব্য দেখে মনে হল তাদের অবহেলিত জীবন যাপন সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ধর্ম পালনের উপর। যেন হিজড়া হওয়ার কারণে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে তারা মুক্ত। ধর্মের বিধানাবলি মনেহয় কেবল পুরুষ ও নারীর জন্যই প্রদত্ত, তাদের জন্য নয়।
অথচ, ইসলাম হিজড়াদেরকে গুরুত্বহীন মনে করেনা বিধায় ইসলামী শরীয়ত মিরাছ তথা সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য পরিস্কার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ইসলামি শরীয়া অনুযায়ী হিজড়া সন্তান তারা মা- বাবার সম্পত্তির ভাগ পাবে। এবং উত্তরাধিকার সম্পদে তারা নারী হিসেবে পাবে নাকি পুরুষ হিসেবে পাবে সেটা ইসলামী শরীয়াত নিশ্চিত করেছে। এবং ইসলামী শরীয়ত ও তাদেরকে মিরাছ ও বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষ বা মহিলা হিসাবে চিন্থিত করে তাদের উপর সাধারণ পুরুষ বা মহিলা হুকুম আরোপ করে থাকে। অর্থাৎ এক হিজড়া বিপরীতধর্মী অন্য হিজড়ার সাথে বা সাধারণ কোনো মানুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে শরীয়ত সমর্থিত সহবাসের বৈধ পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে হবে।
একজন মানুষ হিসেবে আপনার আমার করণীয় কি? হিজড়াদেরও সম্মানের চোখে দেখতে হবে। তারাও তো মানুষ। মানুষ মাত্রই সম্মানের পাত্র। সূরা বনী ইসরাঈলের ৭০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতালা বলেছেন, ‘বাস্তবিকপক্ষে আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি।’ অতএব মানুষ হিসাবে একজন হিজড়াকে ঘৃণার চোখে দেখা, তুচ্ছ ভাবার কোনো অবকাশ ইসলামে নেই।
একই বাবা-মার ঘরে দুই ভাই কি একে অপরকে ঘৃণা করতে পারে? আদম সন্তান হিসেবে একজন মুসলিম যেমন আমার ভাই, তেমনি একজন হিজড়াও আমার ভাই কিংবা বোন। হিজড়া হওয়ার পেছনে তার কোনো হাত নেই, এটি একটি রোগ; হরমোনজনিত সমস্যা। কোনো রোগীকে কি তার রোগের কারণে ঘৃণা করা যায়? এছাড়াও আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার মানদণ্ড নারী বা পুরুষ হওয়া নয়। যে মোত্তাকি সে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান। এ মর্যাদা একজন হিজড়ারও হতে পারে। সুতরাং হিজড়াকে হিজড়া হওয়ার কারণে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
অনেককে দেখা যায়-হিজড়াদের সঙ্গে বিদ্রুপ করতে। উপহাস করতে। এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদাররা, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ, উপহাস না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ইমানের পর মন্দ নাম কতই-না নিকৃষ্ট! আর যারা তওবা করে না, তারাই তো জালেম।’ সুরা হুজুরাত: ১১
#nurnobifulkuri
18 November 2024
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ০৫/০১/২০২৫
-
মোঃ সোহেল মাহমুদ ০৫/০১/২০২৫সুন্দর লিখেছেন।
অনেক অনেক শুভকামনা রইলো