ভারতে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের কার্যকারণ
বর্তমান ভারতের দিকে তাকালে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় তা হলো মুসলমান বিরোধী সাম্প্রদায়িক মিথ্যা ইতিহাসকে খুব উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। ইতিহাস বইয়ের পৃষ্ঠা বলুন কিংবা সিনেমা, নাটকের কাহিনি বলুন সেখানে মূলত দেখানো হয় মুসলমান রাজারা বিশেষ করে মুঘল সম্রাটরা ভারত শাসনের সময় তাদের উপর শুধু অত্যাচার নির্যাতনই করেননি, পাশাপাশি অনেক হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছেন কিংবা হিন্দু নারীদের জোরপূর্বক বিবাহ করে তাদের গর্ভে মুসলমান সন্তান পয়দা করেছেন। প্রশ্ন হল তাদের এই প্রচারের ঐতিহাসিক সত্যতা কতটুকু? ইতিহাস কি বলছে-
ইতিহাস বলছে- মুসলমান শাসকেরা বহু বছর ধরে ভারত শাসন করেছেন বটে কিন্তু এই মুসলমান শাসকেরা কখনই হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুবিধাজনক অবস্থানটি নষ্ট করতে চাননি, তাঁদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টাও করেননি। মুসলমান শাসকদের সেনাবাহিনী বা রাজসভায় পদাধিকারী হিসাবে কাজ করার জন্য হিন্দুদের ধর্মত্যাগ করার প্রয়োজন হয়নি। মোগল সেনাবাহিনীতে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের চমৎকার সব বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, মুসলমান আধিকারিকেরা আল্লার নামে শপথ নিচ্ছেন, আর হিন্দুরা বিষ্ণুর নামে।
এই ধর্মীয় বহুত্বের স্বীকৃতি ছিল সাধারণ ভাবে মোগলদের ঘোষিত নীতি, ষোড়শ দ্বিতীয়ার্ধে সম্রাট আকবরের হাত ধরে যার সূচনা হয়। রোমের কাম্পো দে’ফিয়োরি-তে জোর্দানো ব্রুনোকে যখন ধর্মদ্রোহের অপরাধে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, আকবর তখন আগ্রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার গুরুত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। অনেক হিন্দু ইতিহাসবিদ মোগল শাসনের শেষ পর্যায়ে, বিশেষত সম্রাট আরঙ্গজেবের আমলের ‘সাম্প্রদায়িক' চরিত্র নিয়ে কঠোর মন্তব্য করন। অথচ আরঙ্গজেবের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত এবং রাজসভায় বহুসংখ্যক হিন্দু ছিল। তাহলে যারা সাম্প্রদায়িক মিথ্যা ইতিহাস লিখছেন তার কারন কি? এর কারণ হল, ভারতে অসন্তোষ ও হিংসা ছড়াতে, এবং ধর্মীয় বিভাজন পোক্ত করতে মুসলমান-বিরোধী সাম্প্রদায়িক ইতিহাস কট্টরপন্থী হিন্দু দলগুলোকে দারুণভাবে সাহায্য করছে।
মোগল পূর্ব যুগের কি অবস্থা? ষোড়শ শতকে মোগল আগ্রাসনের আগেই বাংলার মুসলমান শাসকেরা (আফগানিস্তানের পাঠান) সেনাবাহিনী ও রাজসভায় হিন্দুদের গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। হিন্দু সমাজের উঁচু স্তর থেকে ইসলামে ধর্মান্তর বিশেষ হয়নি। বাংলায় ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকেও উচ্চ শ্রেণির মুসলমান তত আসেননি। ‘আশরফ’রা অবশ্যই ছিলেন, যাঁরা নিজেদের খাইবার পাস-এর পশ্চিম থেকে আসা জনগোষ্ঠীর বংশধর— ফারসি, আরবি বা তুর্কি সাম্রাজ্যের মতো মুসলমান-প্রধান ভূমির সন্তান— বলে দাবি করতেন। কিন্তু, তাঁদের অনুপ্রবেশ প্রচুর সংখ্যায় ঘটেনি। বেশির ভাগ ধর্মান্তরই (চতুর্দশ শতক থেকে যার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য) ঘটেছিল সমাজের অসচ্ছল অংশ থেকে, মূলত হিন্দু সমাজের স্বচ্ছন্দ গণ্ডির বাইরে। এ-কথা স্পষ্ট করে বলা যায় না যে, যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা সকলেই হিন্দু, কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা হিন্দু সমাজের সঙ্গে বিশেষ সম্পৃক্ত ছিলেন না। আর তারা ধর্মান্তরিত হয়েছিল যত না চাপে পরে তার চেয়ে বেশি স্বেচ্ছায়।
ব্রিটিশ আমলে, তার প্রথম পর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই, হিন্দু- মুসলমান বিভাজন বাড়ে। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস- এর ‘কর্নওয়ালিস কোড' নামে পরিচিত এক ঘোষণার ফলে, রাষ্ট্রের হাতে ভূস্বামীরা কতখানি রাজস্ব তুলে দেবেন তা ‘চিরস্থায়ী ভাবে নির্ধারিত হয়। এর ফলে তাঁরা রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ পান, সঙ্গে মালিকানার নিশ্চয়তা। এই সুরক্ষিত ভূস্বামীদের অধিকাংশই হিন্দু, এবং এর একটি অংশ জমির খাজনার ওপর নির্ভর করেই জীবনযাপন শুরু করেন, যদিও তাঁরা বাস করতেন অন্যত্র, জমি চাষাবাদও করতেন না। যাঁরা জমিদারদের খাজনা দিতেন এবং নানা ভাবে অত্যাচারিত হতেন, তাঁদের বেশির ভাগই মুসলমান। অথচ ভারতে বর্তমান প্রচারনার বড় অংশজুড়ে দেখা যাচ্ছে ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মূলে রয়েছে হিন্দুদের উপর মুসলমান শাসকদের জুলুম অত্যাচার।
এই মিথ্যা প্রচারণা কেন করা হচ্ছে? এই মিথ্যা প্রচারণার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ধর্মীয় বিভাজন পোক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা চরিতার্থ করা। তবে আশার কথা হল ভারতের প্রগতিশীল মানুষেরা এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক ভারত বিনির্মানে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যার ফল খানিকটা দৃশ্যমান।
তথ্যসূত্রঃ হোম ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড এবং আইডেন্টিটি এন্ড ভায়োলেন্স: দি ইলিউশন অব ডেস্টিনি-অমর্ত্য সেন; বেঙ্গল ডিভাইডেডঃ হিন্দু কমিউনালিজম এন্ড পার্টিশন-জয়া চ্যাটার্জি; হু আর দ্যা বেঙ্গলি মুসলিমস, ইসলাম এন্ড ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি- রিচার্ড ইটন।
ইতিহাস বলছে- মুসলমান শাসকেরা বহু বছর ধরে ভারত শাসন করেছেন বটে কিন্তু এই মুসলমান শাসকেরা কখনই হিন্দু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুবিধাজনক অবস্থানটি নষ্ট করতে চাননি, তাঁদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টাও করেননি। মুসলমান শাসকদের সেনাবাহিনী বা রাজসভায় পদাধিকারী হিসাবে কাজ করার জন্য হিন্দুদের ধর্মত্যাগ করার প্রয়োজন হয়নি। মোগল সেনাবাহিনীতে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের চমৎকার সব বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, মুসলমান আধিকারিকেরা আল্লার নামে শপথ নিচ্ছেন, আর হিন্দুরা বিষ্ণুর নামে।
এই ধর্মীয় বহুত্বের স্বীকৃতি ছিল সাধারণ ভাবে মোগলদের ঘোষিত নীতি, ষোড়শ দ্বিতীয়ার্ধে সম্রাট আকবরের হাত ধরে যার সূচনা হয়। রোমের কাম্পো দে’ফিয়োরি-তে জোর্দানো ব্রুনোকে যখন ধর্মদ্রোহের অপরাধে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, আকবর তখন আগ্রায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার গুরুত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। অনেক হিন্দু ইতিহাসবিদ মোগল শাসনের শেষ পর্যায়ে, বিশেষত সম্রাট আরঙ্গজেবের আমলের ‘সাম্প্রদায়িক' চরিত্র নিয়ে কঠোর মন্তব্য করন। অথচ আরঙ্গজেবের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত এবং রাজসভায় বহুসংখ্যক হিন্দু ছিল। তাহলে যারা সাম্প্রদায়িক মিথ্যা ইতিহাস লিখছেন তার কারন কি? এর কারণ হল, ভারতে অসন্তোষ ও হিংসা ছড়াতে, এবং ধর্মীয় বিভাজন পোক্ত করতে মুসলমান-বিরোধী সাম্প্রদায়িক ইতিহাস কট্টরপন্থী হিন্দু দলগুলোকে দারুণভাবে সাহায্য করছে।
মোগল পূর্ব যুগের কি অবস্থা? ষোড়শ শতকে মোগল আগ্রাসনের আগেই বাংলার মুসলমান শাসকেরা (আফগানিস্তানের পাঠান) সেনাবাহিনী ও রাজসভায় হিন্দুদের গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন। হিন্দু সমাজের উঁচু স্তর থেকে ইসলামে ধর্মান্তর বিশেষ হয়নি। বাংলায় ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকেও উচ্চ শ্রেণির মুসলমান তত আসেননি। ‘আশরফ’রা অবশ্যই ছিলেন, যাঁরা নিজেদের খাইবার পাস-এর পশ্চিম থেকে আসা জনগোষ্ঠীর বংশধর— ফারসি, আরবি বা তুর্কি সাম্রাজ্যের মতো মুসলমান-প্রধান ভূমির সন্তান— বলে দাবি করতেন। কিন্তু, তাঁদের অনুপ্রবেশ প্রচুর সংখ্যায় ঘটেনি। বেশির ভাগ ধর্মান্তরই (চতুর্দশ শতক থেকে যার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য) ঘটেছিল সমাজের অসচ্ছল অংশ থেকে, মূলত হিন্দু সমাজের স্বচ্ছন্দ গণ্ডির বাইরে। এ-কথা স্পষ্ট করে বলা যায় না যে, যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা সকলেই হিন্দু, কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা হিন্দু সমাজের সঙ্গে বিশেষ সম্পৃক্ত ছিলেন না। আর তারা ধর্মান্তরিত হয়েছিল যত না চাপে পরে তার চেয়ে বেশি স্বেচ্ছায়।
ব্রিটিশ আমলে, তার প্রথম পর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকেই, হিন্দু- মুসলমান বিভাজন বাড়ে। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস- এর ‘কর্নওয়ালিস কোড' নামে পরিচিত এক ঘোষণার ফলে, রাষ্ট্রের হাতে ভূস্বামীরা কতখানি রাজস্ব তুলে দেবেন তা ‘চিরস্থায়ী ভাবে নির্ধারিত হয়। এর ফলে তাঁরা রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ পান, সঙ্গে মালিকানার নিশ্চয়তা। এই সুরক্ষিত ভূস্বামীদের অধিকাংশই হিন্দু, এবং এর একটি অংশ জমির খাজনার ওপর নির্ভর করেই জীবনযাপন শুরু করেন, যদিও তাঁরা বাস করতেন অন্যত্র, জমি চাষাবাদও করতেন না। যাঁরা জমিদারদের খাজনা দিতেন এবং নানা ভাবে অত্যাচারিত হতেন, তাঁদের বেশির ভাগই মুসলমান। অথচ ভারতে বর্তমান প্রচারনার বড় অংশজুড়ে দেখা যাচ্ছে ভারতের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মূলে রয়েছে হিন্দুদের উপর মুসলমান শাসকদের জুলুম অত্যাচার।
এই মিথ্যা প্রচারণা কেন করা হচ্ছে? এই মিথ্যা প্রচারণার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ধর্মীয় বিভাজন পোক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা চরিতার্থ করা। তবে আশার কথা হল ভারতের প্রগতিশীল মানুষেরা এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক ভারত বিনির্মানে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যার ফল খানিকটা দৃশ্যমান।
তথ্যসূত্রঃ হোম ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড এবং আইডেন্টিটি এন্ড ভায়োলেন্স: দি ইলিউশন অব ডেস্টিনি-অমর্ত্য সেন; বেঙ্গল ডিভাইডেডঃ হিন্দু কমিউনালিজম এন্ড পার্টিশন-জয়া চ্যাটার্জি; হু আর দ্যা বেঙ্গলি মুসলিমস, ইসলাম এন্ড ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি- রিচার্ড ইটন।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ০৯/০৭/২০২৩খুবই মূল্যবান একটি লেখা।ভালো লাগলো।
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ০৬/০৭/২০২৩দারুণ
-
বোরহানুল ইসলাম লিটন ০৫/০৭/২০২৩সুন্দর বলেছেন!
-
মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন ০৩/০৭/২০২৩তথ্যসহ সচেতনতামূলক প্রবন্ধ ভাল হয়েছে।
-
অর্ঘ্যদীপ চক্রবর্তী ০৩/০৭/২০২৩👍