www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অন্নদাশঙ্কর রায় শ্রদ্ধাঞ্জলী

অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২) ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি, চিন্তাবিদ। উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁ ঐতিহ্যের শেষ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অভিহিত। ওড়িশার দেশীয় রাজ্য ঢেঙ্কানালের এক শাক্ত পরিবারে অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্ম। তাঁর পিতা নিমাইচরণ রায় ও মা হেমনলিনী দেবী। তাঁর পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার কোতরং গ্রামে। কর্মসূত্রে তাঁরা ওড়িশার ঢেঙ্কানালে বসবাস শুরু করেন।

জমিদার হিসেবে অন্নদাশঙ্করের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন প্রজাহিতৈষী, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী। তাঁদের পরিবারে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হতো। পিতামহ শ্রীনাথ রায়, পিতা নিমাইচরণ রায় ও কাকা হরিশচন্দ্র রায়-এঁরা সবাই ছিলেন সাহিত্যরসিক এবং শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে নিমাইচরণ ‘শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত’ অনুবাদ করেন ওড়িয়া ভাষায়। হেমনলিনী ছিলেন বৈষ্ণব ভাবাদর্শে বিশ্বাসী এবং কটকের বিখ্যাত পালিত পরিবারের সন্তান। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিশ্র পরিবেশে কেটেছে অন্নদাশঙ্করের শৈশব।

অন্নদাশঙ্করের শিক্ষাজীবন আরম্ভ হয় ঢেঙ্কানালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯২১ সালে ঢেঙ্কানাল হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করেন এবং ভর্তি হন তৎকালীন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কটক র‌্যাভেন্শ কলেজে। ১৯২৩ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৫ সালে তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। এমএ (ইংরেজিতে) শ্রেণিতে পড়াকালীন ১৯২৭ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় আই.সি.এস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে প্রশিক্ষণের জন্য ইংল্যান্ড যান। সেখানে তিনি লন্ডনের ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ’, ‘কিংস কলেজ’, ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’, ‘লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ’-এ পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরই ফাঁকে ঘুরে বেড়ান সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ। ফলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে তাঁর সাহিত্যে।

প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে ১৯২৯ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগ দেন। ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় আঠারো বছরের মধ্যে তিনি নয় বছর পশ্চিমবঙ্গে এবং নয় বছর পূর্ববঙ্গে বিভিন্ন পদে নিয়োজিত ছিলেন। অবিভক্ত বঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, নদীয়া, ত্রিপুরা, মেদিনীপুর, হুগলি এবং হাওড়ায় তিনি নিযুক্ত ছিলেন কখনো শাসন বিভাগে, কখনো বিচার বিভাগে যথাক্রমে ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ হিসেবে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তিনি উচ্চতর পর্যায়ের ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের (আই.এ.এস) সদস্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ও বিচার বিভাগে কাজ করেন। রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৫০ সালে পদত্যাগ পত্র দেন এবং ১৯৫১ সালে তিনি বিচার বিভাগের সচিব পদ থেকে অব্যাহতি পান।

চাকরি ছাড়ার পর অন্নদাশঙ্কর রায় শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালির আত্মদান তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। পরের বছর ১৯৫৩ সালে তিনি এক ঐতিহাসিক ‘সাহিত্য মেলা’র আয়োজন করেন শান্তিনিকেতনে। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই সাহিত্য মেলায় যোগ দেন কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শামসুর রাহমান, কায়সুল হক এবং আরো অনেকে। অন্নদাশঙ্করের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে নিয়মিত ‘সাহিত্য সভা’ হতো এবং সেখানে আশ্রমের সাহিত্য রসিকদের সমাবেশ ঘটত। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বহু পন্ডিত তাঁর বাড়িতে অতিথি হয়ে আসতেন। নানা দেশের নানা ভাষার মানুষের সমাগমে সেখানে এক আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল তৈরি হতো। শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে অন্নদাশঙ্কর বিশ্বভারতীর কর্মসমিতির সদস্য ছিলেন। ষাট দশকের শেষ দিকে পারিবারিক কারণে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অন্নদাশঙ্কর রায় ২০ বছর বয়সে ওড়িয়া সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম কবিতা ওড়িয়া ভাষায় রচিত। কম বয়সে প্রভা নামে ওড়িয়া ভাষায় হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের করেন। বাংলা, ইংরেজি, ওড়িয়া, সংস্কৃত, হিন্দি-সব ভাষায় পারদর্শী হলেও বাংলাকেই তিনি সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। বাড়ির ও কলেজের গ্রন্থাগারে তিনি ভারতীয় এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন। স্কুলে তিনি শিশু, সন্দেশ, মৌচাক, সবুজপত্র, প্রবাসী, মডার্ন রিভিউ প্রভৃতি পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। তেরো বছর বয়সে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত পত্রিকার গ্রাহক হন এবং সে পত্রিকায় লেখা ছাপেন।

প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র ছিল তাঁর লেখক হয়ে ওঠার প্রেরণা। সবুজপত্র পত্রিকার দুই প্রধান লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমথ চৌধুরীর জীবনদর্শন ও শিল্পাদর্শ অন্নদাশঙ্করের সাহিত্য-মানস গঠনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। অন্যদিকে টলস্টয়কেও তিনি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। টলস্টয়ের সত্যের প্রতি অনুরাগ এবং রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যপ্রীতি তাঁকে আকৃষ্ট করে। ১৬ বছর বয়সে টলস্টয়ের গল্প ‘তিনটি প্রশ্ন’ তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন এবং তা প্রবাসী পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯২০ সালে। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত মৌলিক রচনার বিষয় ছিল নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা, যা ভারতী পত্রিকায় ছাপা হয়। এ ধরনের বিষয় নিয়ে তিনি ওড়িয়া ভাষায়ও লেখেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের ওপর যে প্রবন্ধ লেখেন, তা রবীন্দ্রনাথকেও আলোড়িত করে। অন্নদাশঙ্করের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ তারুণ্য ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হয় বিচিত্রা পত্রিকায়। তবে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা পথে প্রবাসে ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমেই তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান করে নেন। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত দুই বছর উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘পথে প্রবাসে’। একই সময় মৌচাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ইউরোপের চিঠি’। অন্নদাশঙ্কর রায় কোনো গোষ্ঠীভুক্ত লেখক ছিলেন না। তবে সম্পাদকদের অনুরোধে কল্লোল, কালিকলম, পরিচয় প্রভৃতি পত্রিকার জন্য লেখেন। কলে­াল, কালিকলম যুগের সাহিত্যিক এবং বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও শিখা গোষ্ঠীর প্রতিভূদের সঙ্গেও তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল।

দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রায় সত্তর বছর ধরে তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, ছড়া, কবিতা, নাটক, পত্রসাহিত্য, আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রভৃতি লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ২২টি। এর মধ্যে প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস আগুন নিয়ে খেলা (১৯৩০)। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্যিক উপন্যাস তাঁর ছয় খন্ডে প্রকাশিত সত্যাসত্য ছয়টি নামে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে- যার যেথা দেশ (১৯৩২), অজ্ঞাতবাস (১৯৩৩), কলঙ্কবতী (১৯৩৪), দুঃখমোচন (১৯৩৬), মর্ত্যের স্বর্গ (১৯৪০), অপসরণ (১৯৪২)। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উপন্যাস অসমাপিকা (১৯৩১), পুতুল নিয়ে খেলা (১৯৩৩), না (১৯৫১), কন্যা (১৯৫৩), তিন খন্ডে প্রকাশিত রত্ম ও শ্রীমতী (১ম-১৯৫৬, ২য়-১৯৫৮, ৩য়-১৯৭২), সুখ (১৯৬১), বিশল্যকরণী (১৯৬৭), তৃষ্ণার জল (১৯৬৯), রাজঅতিথি (১৯৭৮) এবং চার খন্ডে রচিত ও প্রকাশিত ক্রান্তদর্শী (১ম-১৯৮৪, ২য়-১৯৮৫, ৩য়-১৯৮৫, ৪র্থ-১৯৮৬)। ছয় খন্ডে রচিত সত্যাসত্য বাংলায় মননশীল উপন্যাস রচনায় এক স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে। এ উপন্যাসের বিশাল পরিসরে রূপায়িত হয়েছে আধুনিক যুগের জটিল জীবন-সমস্যা, সামাজিক, দার্শনিক, রাজনৈতিক মতবাদ ও তত্ত্ব, দাম্পত্য সম্পর্কের আধুনিক ধারণা এবং দেশ-কালের বৃহত্তর আবহ। তাঁর বিশ্ববীক্ষা, সভ্যতার বিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা ও মানবতাবাদী চিন্তাভাবনা রবীন্দ্রনাথেরই উত্তরাধিকার। এই ধারাতেই রচিত হয় ক্রান্তদর্শী। চার খন্ডে সম্পূর্ণ এই মহাকাব্যিক উপন্যাস একটি বিশেষ সময়ের ঘটনাপ্রবাহকে ধারণ করে আছে- দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু থেকে আগস্ট বিপ্লব, পঞ্চাশের মন্বন্তর, ব্রিটিশ ও কংগ্রেস-মুসলিম রাজনীতি, দাঙ্গা, দেশভাগ ও ব্রিটিশের প্রস্থান এবং হিন্দু মহারাষ্ট্রবাদীর হাতে মহাত্মা গান্ধীর নিধন। বাংলায় এপিক উপন্যাসের পথিকৃৎ অন্নদাশঙ্কর। রঁম্যা রঁলার জঁ ক্রিস্তফ্ থেকে তিনি এপিক উপন্যাসের ধারণা লাভ করেন। তিনি বড় মাপের উপন্যাস লিখেছেন যাকে বলা হয় মনোলিথিক আঙ্গিকের। তবে বৃহৎ উপন্যাসমালার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু ছোটগল্পও লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থগুলো: প্রকৃতির পরিহাস (১৯৩৪), দুকান কাটা ১৯৪৪, হাসনসখী (১৯৪৫), মনপবন (১৯৪৬), যৌবনজ্বালা (১৯৫০), কামিনীকাঞ্চন (১৯৫৪), রূপের দায় (১৯৫৮), গল্প (১৯৬০), কথা (১৯৭১), কাহিনী (১৯৮০), শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৮৪) এবং গল্পসমগ্র (১৯৯৯)।

অন্নদাশঙ্করের সাহিত্যসৃষ্টি বৈচিত্র্যপূর্ণ। কেবল আঙ্গিকে নয়, ভাববৈচিত্র্যেও তাঁর রচনা কালোত্তীর্ণ। বহুমুখী ভাবানুভূতি তাঁর রচনার বিশেষত্ব। বিষয়বৈচিত্র্যে তাঁর রচনা সমৃদ্ধ। ইতিহাস, সাহিত্যতত্ত্ব, দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমকালীন বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ তাঁর গদ্যের বিষয়। প্রবন্ধসাহিত্যে অন্নদাশঙ্কর ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সার্থক উত্তরসূরি। তবে রবীন্দ্রযুগের লেখক হলেও তাঁর স্টাইল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তা, আদর্শবাদ ও শুভবুদ্ধির প্রতীক। দেশভাগ, দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল আজীবন সোচ্চার। কল্পনা ও যুক্তি, প্রেম ও বিবেক, স্বদেশ ভাবনা, বিশ্বচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতার সমন্বয় তাঁর প্রবন্ধসমূহ। তাঁর উলে­খযোগ্য প্রবন্ধ: তারুণ্য (১৯২৮), আমরা (১৯৩৭), জীবনশিল্পী (১৯৪১), ইশারা (১৯৪৩), বিনুর বই (১ম পর্ব-১৯৪৪), জীয়ন কাঠি (১৯৪৯), দেশকালপাত্র (১৯৪৯), প্রত্যয় (১৯৫১), নতুন করে বাঁচা (১৯৫৩), আধুনিকতা (১৯৫৩), সাহিত্যে সংকট (১৯৫৫), কণ্ঠস্বর (১৯৫৬), রবীন্দ্রনাথ (১৯৬২), প্রবন্ধ (১৯৬৪), খোলা মন ও খোলা দরজা (১৯৬৭), আর্ট (১৯৬৮), গান্ধী (১৯৭০), প্রাণ রক্ষা ও বংশ রক্ষার অধিকার (১৯৭০), শুভোদয় (১৯৭২), বাংলার রেনেসাঁস (১৯৭৪), শিক্ষার সংকট (১৯৭৬), কাঁদো প্রিয় দেশ (১৯৭৬), প্রেম ও বন্ধুতা (১৯৭৬), লালন ও তাঁর গান (১৯৭৮), চিত্ত যেথা ভয়শূন্য (১৯৭৮), বাংলাদেশে (১৯৭৯), সাতকাহন (১৯৭৯), টলস্টয় (১৯৮০), স্বাধীনতার পূর্বাভাস (১৯৮০), জাতিবৈর (১৯৮১), শিক্ষার ভবিষ্যৎ (১৯৮১), সংহতির সংকট (১৯৮৪), সংস্কৃতির বিবর্তন (১৯৮৪), শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ (১৯৮৬), যুক্তবঙ্গের স্মৃতি (১৯৯০), যেন ভুলে না যাই (১৯৯২), বিনুর বই (১ম ও ২য় পর্ব একত্রে-১৯৯৩), সাহিত্যিকের জবানবন্দী (১৯৯৬), সেতুবন্ধন (১৯৯৬), নববই পেরিয়ে (১৯৯৬), বিদগ্ধ মানস (১৯৯৭), মুক্তবঙ্গের স্মৃতি (১৯৯৮), জীবন যৌবন (১৯৯৯), রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী ও সবুজপত্র (১৯৯৯), নতুন করে ভাবা (১৯৯৯), সাহিত্যে সংকট ও অন্যান্য (২০০০), আমার কাছের মানুষ (২০০১), শতাব্দীর মুখে (২০০১), আমার ভালোবাসার দেশ (২০০১) প্রভৃতি। পরিণত বয়সে এসে তাঁর প্রবন্ধে সৃষ্টিশীলতা, শিল্পকলা ও সৌন্দর্যচেতনার পাশাপাশি যুক্ত হয় নৈতিকতা, ন্যায়বোধ, যুক্তিবাদ ও বিবেকবোধ।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাংলা ছড়াসম্ভার বিষয়বৈচিত্র্যে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ এবং পরে বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে তিনি ছড়া লেখা আরম্ভ করেন। সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় থেকে শুরু করে প্রাণীজগতের ক্ষুদ্র জীবজন্তুও স্থান পেয়েছে তাঁর ছড়ায়। তীব্র শ্লেষে, স্নিগ্ধ পরিহাসে, আবার কখনো নিখাদ কৌতূকে তিনি মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের অসঙ্গতিগুলি তুলে ধরেন ছড়ার মাধ্যমে। একসময়ের ছেলেভুলানো ছড়াকে তিনি উপেক্ষিত স্তর থেকে উন্নীত করেন অভিজাত সাহিত্যের শৈল্পিক স্তরে। তাঁর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছড়া: ‘খোকা ও খুকু’ (১৯৪৭)। এতে সুর দিয়েছেন বিখ্যাত সুরকার সলীল চৌধুরী। দেশবিভাগ জনিত বেদনা তীর্যকভাবে প্রকাশ পেয়েছে এই ছড়ায়- ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে/খুকুর পরে রাগ করো,/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ভারত ভেঙে ভাগ করো। তার বেলা?’ তাঁর বেশ কিছু ছড়া প্রতিষ্ঠিত সুরকারদের সুরে এভাবে জনপ্রিয় গানে রূপ পেয়েছে। তাঁর শেষ ছড়াটি সুরজিৎ দাসগুপ্ত লিখে রাখেন। ২০০২ সালে সন্দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ‘ঐরাবত’ নামে তা প্রকাশিত হয়। তিনিই বাংলায় প্রথম লিমেরিক রচনা করেন। আধুনিক বাংলা ছড়ায় যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তার সূত্রপাত করেন অন্নদাশঙ্কর। তাঁর বিখ্যাত ছড়ার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে: উড়কি ধানের মুড়কি (১৯৪২), রাঙা ধানের খৈ (১৯৫০), ডালিম গাছে মৌ (১৯৫৮), শালি ধানের চিঁড়ে (১৯৭২), আতা গাছে তোতা (১৯৭৪), হৈ রে বাবুই হৈ (১৯৭৭), ক্ষীর নদীর কূলে (১৯৮০), হট্টমালার দেশে (১৯৮০), ছড়াসমগ্র (১ম সং. ১৯৮১), রাঙা মাথায় চিরুনি (১ম সং. ১৯৮৫), বিন্নি ধানের খই (১৯৮৯), কলকাতা পাঁচালী (১৯৯২), ছড়াসমগ্র (২য় পরিবর্ধিত সং. ১৯৯৩), সাত ভাই চম্পা (১৯৯৪), যাদু এ তো বড় রঙ্গ (১৯৯৪),) খেয়াল খুশির ছড়া (১৯৯৭), দোল দোল দুলুনি (১৯৯৮), (২০০২) ইত্যাদি।

এছাড়া ১৯২২ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে তিনি ওড়িয়া ভাষায় ১৪টি কবিতা, ২২টি প্রবন্ধ, স্বপ্ন নামে একটি গল্প এবং কয়েকটি চিঠিপত্র লিখেছেন। তাঁর এসব রচনা ‘উৎকল সাহিত্য’, ‘সহকার’, ‘সবিতা’ প্রভৃতি পত্রিকায় এবং পরবর্তী সময়ে সবুজ অক্ষর (১৯৬৬) শিরোনামের পুস্তকে প্রকাশিত হয়। ‘সবুজদল’ নামে একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্নদাশঙ্কর যুক্ত ছিলেন। ওড়িয়া সাহিত্যের ‘সবুজ যুগ’ অধ্যায়ে তাঁর নামও অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া বাসন্তী (১৯৩১) নামের ওড়িয়া উপন্যাসের আদি তিনটি অধ্যায় তাঁর রচিত। ওড়িয়া ভাষায় অন্নদাশঙ্করের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃত ও আলোচিত হয়।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের ইংরেজি রচনার মধ্যে উলে­খযোগ্য: Bengali Literature (1942) Flight and Pursuit (1968), Yes, I Saw Gandhi (1976), Companion on the Road কবিতার অনুবাদ- (1976), A Writer Speaks (1977) Woman and Other Stories গল্পের অনুবাদ- (1977), An Outline of Indian Culture 1978 Aspects of Indian Culture (1983), In Restrospect (1989), Tolstoy Goethe and Tagore (1999), Selected Short Stories (গল্পের অনুবাদ-1999)। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ক অসংখ্য ভাষণের মধ্যে কিছুসংখ্যক গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় (১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১), যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (২৯ ডিসেম্বর ১৯৭৮), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন (৭ এপ্রিল ১৯৮৯), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় (৯ মে ১৯৮৯), কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে (৭ মে ১৯৯৪) দেওয়া তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতাগুলি ইংরেজিতে প্রদত্ত এবং তিনি এর বাংলা অনুবাদ করেননি, অন্য কেউ অনুবাদ করুক তাও চাননি।

আমেরিকার টেকসাসের বিদুষী তরুণী অ্যালিস ভার্জিনিয়া ওর্নডর্ফ ১৯৩০ সালে ভারতে আসেন ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ে গবেষণার জন্য। লেখক ভবানী মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে অ্যালিসের সঙ্গে অন্নদাশঙ্করের পরিচয় ঘটে এবং পরে তাঁরা বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। সে সময় অন্নদাশঙ্কর ‘লীলাময় রায়’ ছদ্মনামে লিখতেন। রবীন্দ্রনাথ অ্যালিসের নতুন নামকরণ করেন ‘লীলা রায়’। অন্নদাশঙ্করের জীবনে লীলা রায়ের প্রভাব ব্যাপক। বহু ভাষায় পারদর্শী লীলা রায় নিজেও সাহিত্যিক এবং অনুবাদক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। কর্মসূত্রে পূর্ববঙ্গে অতিবাহিত করার সময় এখানকার সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ভূমিব্যবস্থা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর সম্যক ধারণা গড়ে ওঠে। বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ও সমমর্মিতা আজীবন অটুট ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অন্নদাশঙ্কর দু’বার এদেশে আসেন সরকারের অতিথি হিসেবে - প্রথমবার ১৯৭৪ সালে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯৬ সালে।

অন্নদাশঙ্কর রায় সাহিত্য আকাদেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ফেলো ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমির জন্মকাল ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি ছিলেন এর আজীবন সভাপতি ও পথিকৃৎ। সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পুরস্কারে ভূষিত করে ১৯৭৯ সালে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রদান করে দেশিকোত্তম সম্মান। বর্ধমান, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি প্রদান করে। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬২), আনন্দ পুরস্কার (দুইবার-১৯৮৩, ১৯৯৪), বিদ্যাসাগর পুরস্কার, শিরোমণি পুরস্কার (১৯৯৫), রবীন্দ্র পুরস্কার, নজরুল পুরস্কার, বাংলাদেশের জেবুন্নিসা পুরস্কার।

তাঁর মৃত্যুদিন আজ।(মৃত্যু: ২৮ অক্টোবর ২০০২।)

মৃত্যুদিনে পরম শ্রদ্ধেয় এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক ও বিনম্র শ্রদ্ধা।
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
কৃতজ্ঞতা, তথ‍্যসূত্র ও সৌজন‍্যঃ শাহীদা আখতার, বাংলাপিডিয়া, ফেসবুক
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৫৫২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/১০/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast