৩০ এপ্রিল ১৯০৮ এবং
"ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যাঁরা,
জীবনের জয়গান।
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা,
দেবে কোন বলিদান।"
ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বাংলার সার সবুজ দামাল-কামাল যুবমানসে প্রাণের বন্যা বইয়ে দেওয়া কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর "ক্ষুদিরামের মা" প্রবন্ধে লিখেছেন,
"আঠারো মাসের পরে
জনম নেব মাসির ঘরে, মা গো,
চিনতে যদি না পার মা
দেখবে গলায় ফাঁসি "
না। আমরা বর্তমান প্রজন্ম চিনতে পারিনি। চিনতে পারিনি ক্ষুদিরামকে। তা`ই আজও তিনি, তাঁর মহান আত্মত্যাগ আমাদের অজানাই থেকে গেলো। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সু-সন্তান যুগপুরুষ সবার অন্তরের নেতাজী তাঁকে চিনে ছিলেন ঠিকই। তাইতো একেবারেই শিশু বয়সে, উড়িষ্যার খবরের কাগজে প্রকাশ পাওয়া ক্ষুদিরামের "ফাঁসির ছবি" সংগ্রহ করে পরম শ্রদ্ধায়, মমতায়, যত্নে বুকের মাঝে আগলে রেখেছিলেন। ১৯১১ সালের ১১ই আগস্ট রাভেনশ কালিজিয়েট স্কুলে সহপাঠীদের উদ্বুব্ধ করতে পেরেছিলেন নগ্ন পায়ে, স্কুলে আসতে ও অনশন পালন করতে। কী গভীরতম ভাব ও ভাবনা! মোটেই হালকা পলকা নয়। এই অসীম গভীরতম ভাব ও ভাবনাই সুভাষ চন্দ্র বসুকে "নেতাজি সুভাষ"- এ উত্তরণ করে।
ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির পর পরই একটা গান, "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি / হাসি হাসি পড়বো ফাঁসি/ দেখবে ভারতবাসী" বাংলার আকাশে- বাতাসে আলোড়ন তুলেছিল তা' আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। "পীতাম্বর দাস'' মতান্তরে ''মুকুন্দ দাস '' যিনিই এই গানের রচয়িতা হন'না কেন, এই গানই যে তৎকালীন ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনে যুবকদের মনে উন্মাদনা সৃষ্টি করে, যার ফলেই 'কানাইলাল', 'ভগৎ সিং', 'মাস্টারদা সূর্য সেন', 'সুভাষ বসু'দের মতো বিপ্লবী নেতার জন্ম হয়, তা' বললে কোনই অত্যুক্তি হবেনা।
এখন বিষয় হ'ল কে এই ক্ষুদিরাম? কেনই বা তাঁর ফাঁসি? জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায়। এই জেলার (বর্তমানের পশ্চিম মেদিনীপুর) 'কেশপুর' থানার অন্তর্গত মৌবনী (হাবিবপুর) গ্রামে ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম। বিপ্লবের রক্তে রাঙা এই গ্রামের জল-হাওয়া- মাটিতে ক্ষুদিরামের বড় হয়ে ওঠা। ১৯০২ ও ১৯০৩ সালে বিপ্লবী অরবিন্দ (পরবর্তী কালে ঋষি অরবিন্দ) ও সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করেন ও প্রকাশ্যে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। আকৃষ্ট হন ক্ষুদিরাম। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন অবিভক্ত বাংলা ও আসাম প্রদেশে ঝড় তোলে। নিজের পথ খুঁজে নিতে ও স্থির সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি ক্ষুদিরাম। তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় সামিল হন। ছাত্র ক্ষুদিরাম বিপ্লবী 'গুপ্ত সমিতির' সভ্য হয়ে শুরু করেন বিপ্লবী কর্মকান্ড। তাঁর কর্মদক্ষতা আর দেশমায়ের প্রতি অগাধ ভক্তিতে অচিরেই আর এক বিপ্লবী 'বারীন্দ্র কুমার ঘোষ'এর নজরে পড়েন। বিপ্লবী জীবনের শুরুতেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, রাজ্ নারায়ণ বসু, হেমচন্দ্র দাস কানুনগো, সত্যেন বোস প্রভৃতি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন ও তাঁদের ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ তাঁর মনে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য স্বাধীনতার আকাঙ্খায় বিপ্লবের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে দেয়। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিপ্লবী কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে ১৬ বছর বয়সে প্রথম হাতে বোমা তুলে নেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। এই সময়েই আলিপুরের প্রেসিডেন্সি বিচারালয়ের মুখ্য বিচারক ছিলেন কুখ্যাত 'কিংসফোর্ড'। তিনি বিপ্লবীদের কঠোরতম সাজা দিতেন। এমনকি চরমতম শারীরিক নির্যাতনের হুকুম দিতেন। বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি অত্যাচারী কিংসফোর্ডের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। 'বই-বোমা' দিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ও পরিকল্পনা বার্থ্য হয়। ইতিমধ্যেই অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে ব্রিটিশ সরকার বিহারের মুজাফ্ফরপুরে বদলি করে। বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। নতুন করে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুকে।
এই প্রেক্ষিতেই ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী মুজাফ্ফরপুরে আসেন। সময়টা ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী মুজাফ্ফরপুরের মতিঝিল এলাকায় একটা ধর্মশালায় থাকতে শুরু করেন ও কিংসফোর্ডের গতিবিধির উপর সজাগ দৃষ্টি রাখেন। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ১৯০৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল। রাত আট টা। ইউরোপিয়ান ক্লাব হাউস থেকে কিংসফোর্ডের বাংলো পর্যন্ত যে রাস্তা তার মাঝে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম ও তাঁর সাথী প্রফুল্ল চাকী।
কিংসফোর্ডের মতো অবিকল একটি সাদা ফিটন গাড়ি কাছে আসা মাত্রই, গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়েন। ধোঁয়ায় ভরে যায় চারিদিক। নিঁখুত পরিকল্পনায় হামলা করার পর দুই বিপ্লবী নায়ক ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী ছুটতে থাকেন। তাঁরা জানতেননা যে ওই গাড়িতে অত্যাচারী কিংসফোর্ড ছিলেননা। তাঁদের বোমার আঘাতে দুজন নিরপরাধী বিদেশিনী নিহত হন।
গ্রেপ্তার হন ক্ষুদিরাম বসু। ১লা মে তাঁকে নিয়ে আসা হয়। ২রা মে দৈনিক স্টেটসমেন লিখল, "একটা ছেলেকে দেখবার জন্য স্টেশনে ভিড় জমে যায়। ১৮ অথবা ১৯ বছরের একটা কিশোর হলেও তাঁকে রীতিমত দূঢ় দেখাচ্ছিল।" এই দূঢ়তাই ক্ষুদিরামের জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাইতো তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় ভুল স্বীকার করতে বললে, তিনি বলেন, "আমি স্বীকার যে আমি ভুল করেছি, কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে পারিনি। আমাকে মুক্তি দিলে কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে আমি আর ভুল করবোনা।" ২১ মে ১৯০৮, তাঁর বিচার, বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা, শুরু হয়। সমগ্র পশ্চিম বাংলার কোনোও আইনজীবী তাঁর পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। পূর্ব বাংলার রংপুর বারের উকিল সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ক্ষুদিরামের পক্ষে এগিয়ে আসেন। বিচারের পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকা সত্বেও আইন ব্যবস্থাকে থোড়াই কেয়ার করে ব্রিটিশ বিচারক ব্রিচক্রফট সহ লাথুনীপ্রসাদ এবং জানকিপ্রসাদ নামীয় দুজন ভারতীয় বিচারক ক্ষুদিরামকে মৃত্যু দণ্ড দেন। কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করা হয়। কলকাতা হাইকোর্টও নিম্ন আদালতের রায়কে বহাল রাখে। ১৯০৮ সালের ১১ ই অগাস্ট অত্যন্ত সন্তর্পনে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। অবসান হয় এক মহান বিপ্লবী জীবনের। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন। ক্ষুদিরাম আত্মাহুতির মধ্যদিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যান সমগ্র দেশকে। জাতিকে। কাতারে- কাতারে কিশোর- যুবক বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হন। আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অকুতোভয় বিপ্লবীকে তাই বলতে শোনা যায়, "ক্ষুদিরামের আত্মা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে।"
আপাত বিচারে ক্ষুদিরামের লক্ষ্য সফল হয়নি। পারেননি তিনি কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমুলে অকালেই আবেগে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। কোনো বড় ভূমিকাই রেখে যেতে পারেননি। তাহলে আমরা কেন স্মরণ করবো ক্ষুদিরাম কে? প্রকৃত অর্থেই ১৯০৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর ছোঁড়া বোমা ভারতের ঘুমিয়ে থাকা পৌরুষকে জাগিয়ে দেয়। স্থবির জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্খায় উদ্বেলিত করে। শুধু বাংলা প্রদেশেই নয়, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র এমনকি সমগ্র ভারতবর্ষে বিপ্লবী আদোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। ৩০ শে এপ্রিলই ক্ষুদিরাম বসুকে 'ক্ষুদিরাম' এ পরিণত করে। আমারা পায় মহান বিপ্লবী "নেতাজি" কে।
স্বাধীনোত্তর ভারতে আশা করারই ছিল যে এই সব মহান বিপ্লবীদের জীবন আদর্শ চর্চা হবে। যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে ক্ষুদিরাম সহ অগ্নিযুগের, "লক্ষ পরানে না জানে শঙ্কা/না রাখে কাহারো ঋণ / জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য / চিত্ত ভাবনাহীন" বিপ্লবীদের। কিন্তু তা হয়নি! স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী জহরলাল নেহেরু গান্ধীজীর অহিংস ধারার পরিপন্থী হ্ওয়ায়; ক্ষুদিরাম বসুর মর্মর মূর্তির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে অস্বীকার করেন। সেটা ছিল ১৯৪৯ সাল। আজও সেই একই মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। আজও শিক্ষায়, চেতনায়, শিক্ষা-পাঠক্রমে এঁরা সন্ত্রাসী! আজকের প্রজন্ম আগুনঝরা সেদিনের বিপ্লবীদের জীবন চর্চা ও অনুশীলনে প্রেরণা পায়না। পায়না পথের দিশা। বড় ব্যথায় কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, "নিজের ছেলেকে যখন আদর করে চব্য- চোষ্য- লেহ্য- পেয় যাবতীয় সামগ্রী খাওয়াও, নিবিড় স্নেহে বুকে চেপে ধরে শুয়ে ঘুম পাড়াও, তখন কি এই মাতৃহীন ক্ষুদিরামের কথা তোমাদের বুকে কাঁটার মতো বেঁধে না ? তোমাদের এতো স্নেহ এতো মায়া কি অনুশোচনায়, লজ্জায় সংকুচিত হয়ে ওঠে না ? বলো মা , উত্তর দাও।"
কবি নজরুল বাংলার মায়েদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, "আমারা এসেছি আমাদের দাবি নিয়ে আমাদের ক্ষুদিরামকে ফিরিয়ে নিতে .......... ক্ষুদিরাম গেছে, কিন্তু সে ঘরে ঘরে জন্ম নিয়ে এসেছে কোটি কোটি ক্ষুদিরাম হয়ে। তোমরা চিনতে পারছনা, তোমরা মায়ায় আবদ্ধ। ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও আমাদের ক্ষুদিরামকে। ওরা ঘরের নয়, ওরা বনের, ওরা দেশের।"
কবি নজরুলের আকুতি বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের বর্তমান কিশোর-যুবকরা ক্ষুদিরামকে জীবনের আদর্শ করতে পারেনি। ৩০ এপ্রিল ১৯০৮ একটা বোমা জাগিয়ে দিয়েছিলো সমগ্র দেশ, জাতিকে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্তির এতো বছর পরেও আমারা, বর্তমান প্রজন্ম, তাঁর জীবন ও শিক্ষাকে চর্চা ও অনুশীলন করতে পারিনি। পারিনি আমাদের প্রজন্মকে সেই শিক্ষা্য়-দীক্ষায় বড়় করতে। তা যদি পারতাম তা'হলে দেশে আজকের অসহনীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি হতনা। ইতিহাসের এ এক বিরাট ট্র্যাজেডি! আমরা শুধু এই বলে সাহিত্যের আঙিনায় নিজেদের প্রকাশ করেছি,
"ওরা বীর,
ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে,
গুলি-বন্দুক-বোমার আগুনে,
আজও রোমাঞ্চকর।"
জীবনের জয়গান।
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা,
দেবে কোন বলিদান।"
ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বাংলার সার সবুজ দামাল-কামাল যুবমানসে প্রাণের বন্যা বইয়ে দেওয়া কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর "ক্ষুদিরামের মা" প্রবন্ধে লিখেছেন,
"আঠারো মাসের পরে
জনম নেব মাসির ঘরে, মা গো,
চিনতে যদি না পার মা
দেখবে গলায় ফাঁসি "
না। আমরা বর্তমান প্রজন্ম চিনতে পারিনি। চিনতে পারিনি ক্ষুদিরামকে। তা`ই আজও তিনি, তাঁর মহান আত্মত্যাগ আমাদের অজানাই থেকে গেলো। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সু-সন্তান যুগপুরুষ সবার অন্তরের নেতাজী তাঁকে চিনে ছিলেন ঠিকই। তাইতো একেবারেই শিশু বয়সে, উড়িষ্যার খবরের কাগজে প্রকাশ পাওয়া ক্ষুদিরামের "ফাঁসির ছবি" সংগ্রহ করে পরম শ্রদ্ধায়, মমতায়, যত্নে বুকের মাঝে আগলে রেখেছিলেন। ১৯১১ সালের ১১ই আগস্ট রাভেনশ কালিজিয়েট স্কুলে সহপাঠীদের উদ্বুব্ধ করতে পেরেছিলেন নগ্ন পায়ে, স্কুলে আসতে ও অনশন পালন করতে। কী গভীরতম ভাব ও ভাবনা! মোটেই হালকা পলকা নয়। এই অসীম গভীরতম ভাব ও ভাবনাই সুভাষ চন্দ্র বসুকে "নেতাজি সুভাষ"- এ উত্তরণ করে।
ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির পর পরই একটা গান, "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি / হাসি হাসি পড়বো ফাঁসি/ দেখবে ভারতবাসী" বাংলার আকাশে- বাতাসে আলোড়ন তুলেছিল তা' আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। "পীতাম্বর দাস'' মতান্তরে ''মুকুন্দ দাস '' যিনিই এই গানের রচয়িতা হন'না কেন, এই গানই যে তৎকালীন ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনে যুবকদের মনে উন্মাদনা সৃষ্টি করে, যার ফলেই 'কানাইলাল', 'ভগৎ সিং', 'মাস্টারদা সূর্য সেন', 'সুভাষ বসু'দের মতো বিপ্লবী নেতার জন্ম হয়, তা' বললে কোনই অত্যুক্তি হবেনা।
এখন বিষয় হ'ল কে এই ক্ষুদিরাম? কেনই বা তাঁর ফাঁসি? জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায়। এই জেলার (বর্তমানের পশ্চিম মেদিনীপুর) 'কেশপুর' থানার অন্তর্গত মৌবনী (হাবিবপুর) গ্রামে ১৮৮৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম। বিপ্লবের রক্তে রাঙা এই গ্রামের জল-হাওয়া- মাটিতে ক্ষুদিরামের বড় হয়ে ওঠা। ১৯০২ ও ১৯০৩ সালে বিপ্লবী অরবিন্দ (পরবর্তী কালে ঋষি অরবিন্দ) ও সিস্টার নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করেন ও প্রকাশ্যে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। আকৃষ্ট হন ক্ষুদিরাম। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন অবিভক্ত বাংলা ও আসাম প্রদেশে ঝড় তোলে। নিজের পথ খুঁজে নিতে ও স্থির সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি ক্ষুদিরাম। তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় সামিল হন। ছাত্র ক্ষুদিরাম বিপ্লবী 'গুপ্ত সমিতির' সভ্য হয়ে শুরু করেন বিপ্লবী কর্মকান্ড। তাঁর কর্মদক্ষতা আর দেশমায়ের প্রতি অগাধ ভক্তিতে অচিরেই আর এক বিপ্লবী 'বারীন্দ্র কুমার ঘোষ'এর নজরে পড়েন। বিপ্লবী জীবনের শুরুতেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, রাজ্ নারায়ণ বসু, হেমচন্দ্র দাস কানুনগো, সত্যেন বোস প্রভৃতি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন ও তাঁদের ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ তাঁর মনে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য স্বাধীনতার আকাঙ্খায় বিপ্লবের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে দেয়। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিপ্লবী কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে ১৬ বছর বয়সে প্রথম হাতে বোমা তুলে নেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। এই সময়েই আলিপুরের প্রেসিডেন্সি বিচারালয়ের মুখ্য বিচারক ছিলেন কুখ্যাত 'কিংসফোর্ড'। তিনি বিপ্লবীদের কঠোরতম সাজা দিতেন। এমনকি চরমতম শারীরিক নির্যাতনের হুকুম দিতেন। বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি অত্যাচারী কিংসফোর্ডের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। 'বই-বোমা' দিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সে চেষ্টা ও পরিকল্পনা বার্থ্য হয়। ইতিমধ্যেই অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে ব্রিটিশ সরকার বিহারের মুজাফ্ফরপুরে বদলি করে। বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। নতুন করে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসুকে।
এই প্রেক্ষিতেই ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী মুজাফ্ফরপুরে আসেন। সময়টা ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী মুজাফ্ফরপুরের মতিঝিল এলাকায় একটা ধর্মশালায় থাকতে শুরু করেন ও কিংসফোর্ডের গতিবিধির উপর সজাগ দৃষ্টি রাখেন। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ১৯০৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল। রাত আট টা। ইউরোপিয়ান ক্লাব হাউস থেকে কিংসফোর্ডের বাংলো পর্যন্ত যে রাস্তা তার মাঝে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম ও তাঁর সাথী প্রফুল্ল চাকী।
কিংসফোর্ডের মতো অবিকল একটি সাদা ফিটন গাড়ি কাছে আসা মাত্রই, গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়েন। ধোঁয়ায় ভরে যায় চারিদিক। নিঁখুত পরিকল্পনায় হামলা করার পর দুই বিপ্লবী নায়ক ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকী ছুটতে থাকেন। তাঁরা জানতেননা যে ওই গাড়িতে অত্যাচারী কিংসফোর্ড ছিলেননা। তাঁদের বোমার আঘাতে দুজন নিরপরাধী বিদেশিনী নিহত হন।
গ্রেপ্তার হন ক্ষুদিরাম বসু। ১লা মে তাঁকে নিয়ে আসা হয়। ২রা মে দৈনিক স্টেটসমেন লিখল, "একটা ছেলেকে দেখবার জন্য স্টেশনে ভিড় জমে যায়। ১৮ অথবা ১৯ বছরের একটা কিশোর হলেও তাঁকে রীতিমত দূঢ় দেখাচ্ছিল।" এই দূঢ়তাই ক্ষুদিরামের জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। তাইতো তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় ভুল স্বীকার করতে বললে, তিনি বলেন, "আমি স্বীকার যে আমি ভুল করেছি, কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে পারিনি। আমাকে মুক্তি দিলে কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে আমি আর ভুল করবোনা।" ২১ মে ১৯০৮, তাঁর বিচার, বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা, শুরু হয়। সমগ্র পশ্চিম বাংলার কোনোও আইনজীবী তাঁর পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। পূর্ব বাংলার রংপুর বারের উকিল সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী, কুলকমল সেন ক্ষুদিরামের পক্ষে এগিয়ে আসেন। বিচারের পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকা সত্বেও আইন ব্যবস্থাকে থোড়াই কেয়ার করে ব্রিটিশ বিচারক ব্রিচক্রফট সহ লাথুনীপ্রসাদ এবং জানকিপ্রসাদ নামীয় দুজন ভারতীয় বিচারক ক্ষুদিরামকে মৃত্যু দণ্ড দেন। কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করা হয়। কলকাতা হাইকোর্টও নিম্ন আদালতের রায়কে বহাল রাখে। ১৯০৮ সালের ১১ ই অগাস্ট অত্যন্ত সন্তর্পনে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। অবসান হয় এক মহান বিপ্লবী জীবনের। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন। ক্ষুদিরাম আত্মাহুতির মধ্যদিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যান সমগ্র দেশকে। জাতিকে। কাতারে- কাতারে কিশোর- যুবক বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হন। আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অকুতোভয় বিপ্লবীকে তাই বলতে শোনা যায়, "ক্ষুদিরামের আত্মা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে।"
আপাত বিচারে ক্ষুদিরামের লক্ষ্য সফল হয়নি। পারেননি তিনি কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমুলে অকালেই আবেগে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। কোনো বড় ভূমিকাই রেখে যেতে পারেননি। তাহলে আমরা কেন স্মরণ করবো ক্ষুদিরাম কে? প্রকৃত অর্থেই ১৯০৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর ছোঁড়া বোমা ভারতের ঘুমিয়ে থাকা পৌরুষকে জাগিয়ে দেয়। স্থবির জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্খায় উদ্বেলিত করে। শুধু বাংলা প্রদেশেই নয়, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র এমনকি সমগ্র ভারতবর্ষে বিপ্লবী আদোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। ৩০ শে এপ্রিলই ক্ষুদিরাম বসুকে 'ক্ষুদিরাম' এ পরিণত করে। আমারা পায় মহান বিপ্লবী "নেতাজি" কে।
স্বাধীনোত্তর ভারতে আশা করারই ছিল যে এই সব মহান বিপ্লবীদের জীবন আদর্শ চর্চা হবে। যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে ক্ষুদিরাম সহ অগ্নিযুগের, "লক্ষ পরানে না জানে শঙ্কা/না রাখে কাহারো ঋণ / জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য / চিত্ত ভাবনাহীন" বিপ্লবীদের। কিন্তু তা হয়নি! স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী জহরলাল নেহেরু গান্ধীজীর অহিংস ধারার পরিপন্থী হ্ওয়ায়; ক্ষুদিরাম বসুর মর্মর মূর্তির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে অস্বীকার করেন। সেটা ছিল ১৯৪৯ সাল। আজও সেই একই মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। আজও শিক্ষায়, চেতনায়, শিক্ষা-পাঠক্রমে এঁরা সন্ত্রাসী! আজকের প্রজন্ম আগুনঝরা সেদিনের বিপ্লবীদের জীবন চর্চা ও অনুশীলনে প্রেরণা পায়না। পায়না পথের দিশা। বড় ব্যথায় কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, "নিজের ছেলেকে যখন আদর করে চব্য- চোষ্য- লেহ্য- পেয় যাবতীয় সামগ্রী খাওয়াও, নিবিড় স্নেহে বুকে চেপে ধরে শুয়ে ঘুম পাড়াও, তখন কি এই মাতৃহীন ক্ষুদিরামের কথা তোমাদের বুকে কাঁটার মতো বেঁধে না ? তোমাদের এতো স্নেহ এতো মায়া কি অনুশোচনায়, লজ্জায় সংকুচিত হয়ে ওঠে না ? বলো মা , উত্তর দাও।"
কবি নজরুল বাংলার মায়েদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, "আমারা এসেছি আমাদের দাবি নিয়ে আমাদের ক্ষুদিরামকে ফিরিয়ে নিতে .......... ক্ষুদিরাম গেছে, কিন্তু সে ঘরে ঘরে জন্ম নিয়ে এসেছে কোটি কোটি ক্ষুদিরাম হয়ে। তোমরা চিনতে পারছনা, তোমরা মায়ায় আবদ্ধ। ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও আমাদের ক্ষুদিরামকে। ওরা ঘরের নয়, ওরা বনের, ওরা দেশের।"
কবি নজরুলের আকুতি বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের বর্তমান কিশোর-যুবকরা ক্ষুদিরামকে জীবনের আদর্শ করতে পারেনি। ৩০ এপ্রিল ১৯০৮ একটা বোমা জাগিয়ে দিয়েছিলো সমগ্র দেশ, জাতিকে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্তির এতো বছর পরেও আমারা, বর্তমান প্রজন্ম, তাঁর জীবন ও শিক্ষাকে চর্চা ও অনুশীলন করতে পারিনি। পারিনি আমাদের প্রজন্মকে সেই শিক্ষা্য়-দীক্ষায় বড়় করতে। তা যদি পারতাম তা'হলে দেশে আজকের অসহনীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি হতনা। ইতিহাসের এ এক বিরাট ট্র্যাজেডি! আমরা শুধু এই বলে সাহিত্যের আঙিনায় নিজেদের প্রকাশ করেছি,
"ওরা বীর,
ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে,
গুলি-বন্দুক-বোমার আগুনে,
আজও রোমাঞ্চকর।"
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সিন্ধু সেঁচে মুক্তা-আব্দুল কাদির মিয়া ১৭/১০/২০২০Shundor
-
পি পি আলী আকবর ১১/০৮/২০২০ভালো
-
ফয়জুল মহী ১০/০৮/২০২০খুব চমৎকার কথাগুলো খুবই ভালো লাগলো