বিভ্রান্তি ( দ্বিতীয় অংশ )
৬...
আমি অবাক হয়ে কাব্যর দিকে তাকিয়ে আছি। কাব্য এখনও নির্ভাবনায় পুলিশের গাড়ির মধ্যে সিটের উপর বসে আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ওর ঘুম পেয়েছে। যেকোন সময় সিটের উপর শুয়ে ঘুমিয়েও পড়তে পারে। কেন জানি মনে হলো কাব্য ঝিমুচ্ছে। মনে হয় ভুলই দেখেছি। কাব্য গাড়ি থেকে নেমে অল্প দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা আবুল পুলিশের দিকে হাঁটা ধরলো। কাছে গিয়েই পুলিশের সাথে কথা বলা শুরু করলো। আমি গাড়ির মধ্যে থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
: আবুল ভাই, কেমন আছেন?
: কি চাই?
: মুখ গোমড়া করে আছেন কেন? একটা সিগারেট হবে?
: না নাই।
আবুল এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কাব্য একটা কুঁচে মুরগি।
কাব্যও কুঁচে মুরগির মত মাথা নিচের দিক দিয়ে আবার আমার সামনে এসে বসলো।
: শূন্য, নিকশ কি আইবো?
: আওনের তো কথা।
: দশ মিনিট তো পার অইয়া গেল। আর ব্যাটারা এভাবে অপেক্ষা করতেছে ক্যান। হালাগোরে মতলব কি! অন্য আসামীর নামে চালান কইরা দিব নাকি।
: কপালে যদি থাকে তুমি কি করবা? নিকশরে না ডাইকা যদি পাঁচ ইঞ্চিরে ডাকতাম তাইলে থানায় রাত্রীযাপনটা দারুন অইতো।
: পাঁচ ইঞ্চিডা আবার কেডা?
: আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। দেখতে ছোট বইলা পাঁচ ইঞ্চি কইয়া ডাকতাম। হালায় ঘুমাইলে কিছু টের পায় না। পাছায় কষে লাথি মারলেও টের পায় না। থানার মশা গুলো বলে বাঘের মত। খুব শখ ছিল হালায় থানায় কেমনে ঘুমায় দেখুম। প্রথমেই যদি ওরে ফোন দিতাম তাইলে বেশ অইতো।
: শূন্য, ব্যাটার ভাব দেহো। এমন ভাবে আইতেছে যেন শ্বশুর বাড়ি দাওয়াত খাইতে যাইতেছে।
নাক বরাবর সামনে তাকিয়ে দেখি, নিকশ। হেলে ঢুলে আসছে। মনে হচ্ছে গুন গুন করে গানও গাইতেছে।
উলালা উলালা
মুরি খাইয়া যায় বেলা
উলালা উলালা
কেউ আমারে মাইরালা।
এই টাইপের গান মনে হয়। এমন ভাবে মাথা ঝাকাচ্ছে মনে হয় মাজারে কিছু কাল সময় দিয়েছে। বেশ কাছে এসে নিকশ মাথা তুলে সোজা আমাদের উপর চোখ ফেললো। পা তুলতে গিয়েই থেমে পড়লো। আমাদের পুলিশের গাড়িতে আর পাশে একজন পুলিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিকশ সন্দিহান চোখে তাকিয়েই থাকলো কিন্তু আগে বাড়লো না। আমি আর কাব্য আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নামলাম। আমাদের নামার মধ্যে হয়তো এমন কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল যা আবুলকে সন্দিহান করে তুললো।
কাব্য আমার পাশ থেকে মোলায়েম কন্ঠে নিকশরে বললো, 'আয় বন্ধু আয়।'
কাব্যর কথা শুনে নিকশ দুই পা পিছিয়ে গেল। ওর চেহারাটা দেখতে হয়েছে ছাগলের মত।
কাব্যও দুই পা এগিয়ে দুই হাত সামনে বাড়ায়ে বললো, 'কি হলো, আয়।'
আমি আবুলকে বন্ধুর সাথে কথা বলছি এমন ভাব করে বললাম, 'ঐ ব্যাটাই। ও এখন দৌড়ানোর পায়তারা কষতাছে। চলেন ওরে ধইরা আনি।'
আবুলের মুখ থেকে কোন উত্তর শোনার আগেই নিকশ ভোঁ দৌড় দিল। আমিও নিকশের পিছে পিছে দৌড় দিলাম। আমার দেখাদেখি কাব্যও দৌড় দিল। পিছনে তাকায়ে দেখি আবুলও দৌড়ায়।
উষ্ট্রা খেয়ে পড়তে পড়তে পড়লাম না। একটু দৌঁড়ানোতেই দেখি হাঁপিয়ে গেছি। নাক মুখ দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ বের হচ্ছে। নাহ, বাসায় গিয়ে এবার দৌঁড়ের প্র্যাকটিস করতেই হবে। মুহূর্তে কাব্য আমাকে পিছে ফেলে নিকশের বেশ কাছে চলে গেল। কতক্ষন দৌড়াইছি জানি না। চোখে অন্ধকার দেখছি। সামনেই দেখছি ফুটপাতের উপর নিকশ বসে থেকে হাঁপাচ্ছে। একটু পিছনেই কাব্য। পরিশ্রমে ওর জিভ বের হয়ে পড়ছে। আমি রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়েই জিভ বের করে হাঁপাতে থাকলাম। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে শেষে রাস্তাতেই বসে পড়লাম। বসার সাথে সাথেই প্রাইভেট কারের হর্ণ কানের পর্দা প্রায় ফাঁটিয়ে দিল। তবুও বসেই থাকলাম। একটু পর গাড়িটা পাশ ঘেঁষে যাওয়ার সময় থেমে গ্লাসটা নামিয়ে দিয়ে এক ভদ্রমহিলা মাথা বের করে দিয়ে অভদ্রের মত স্টুপিড বলে গালি দিল।
প্রতুত্তরে আমি মাথা কাত করে মিষ্টি করে একটা হাসি ফিরিয়ে দিলাম। মনে হলো মহিলার মুখে কেউ আগুন ধরিয়ে দিলো। মুহূর্তে মুখখানা লাল টকটকে হয়ে গেল। ঝট করে মুখ ঘুরিয়েই গাড়ি নিয়া হুঁস করে চলে গেল। আমিও দাঁত কেলিয়ে উঠে পড়লাম। উঠেই নিকশ আর কাব্যর মাঝে গিয়া বসেই নিকশকে বললাম, 'নিকশ, কেমন আছিস বন্ধু?'
নিকশ আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, 'এত ভাল কোনদিনও ছিলাম না। একখান কুকাকুলা আর এক বাটি মুরি অইলে তোর পাছায় লাথি মারার কথা ভুইলা যামু।'
: আহ দারুন কথা কইছোস বন্ধু কিন্তু টেকা কই পামু। সব টেকা তো রিমু লইয়া গেছে।
: আর ফাইজলামি করোনের দরকার নাই। শর্টকাটে কাব্যর থাইকা ঘটনা শুনছি।
: ও।
: মাংস দিয়া ভাত। রান্না মনে হয় এতক্ষনে শেষ হইয়া গেছে। ছোট ভাইদের আমার ভাগের খাওয়াটা খাইতে বইলা আসলাম। মনে মনে ভাবছিলাম রিমুর হ্যান্ডব্যাগটা আজ ফক্কা করে দেব। আর এখন কপাল খামচাইতে মন চাইতেছে। হায়রে কপাল!
: এহন ভাইবা আর কি অইবো। আপাতত এহান থাইকা উঠি। কাব্য, খোঁজ লওতো কেন্দ্রহীন বৃত্ত এহন কই।
কাব্য কান থেকে মোবাইল রেখে বললো, সিটি হসপিটালে।
: ওরে কও সব রোগের চিকিৎসা জানে এমন একটা ডাক্তারের রুমে ঢোকার জন্য যেন একটা টিকিট কাটে।
: কেন!
: ভিক্ষা করার ট্রেনিং লমু ডাক্তারের কাছ থেকে। ভিক্ষার টেকা দিয়া নিকশরে একবাটি কুকাকুলা আর এক বোতল মুরি কিনা দিমু। কি বলিস নিকশ?
আমার কথা শুনে কাব্য দাঁত বেরর করে কেলাতে কেলাতে বৃত্তের সাথে কথা বলতে শুরু করলো আর নিকশ হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিকশের হাঁ করা মুখের উপরেই উঠে দাঁড়ালাম। সিটি হসপিটালে যেতে হবে।
৭...
সিটি হসপিটাল। ডাক্তারের রুমের সামনে ডাক্তারের পি.এস আমাদের চারজনকে আটকিয়ে দিল। একসাথে চারজনকে ঢুকতে দিবে না। নিকশ অনেক অনুনয় বিনয় করতেছে তাও ঢুকতে দিচ্ছে না। অনুনয় করার কারন সম্ভবত একই প্রজাতি বলে। নিকশ ডাক্তার হতে যাচ্ছে আর এরা তো হয়েই আছে। বৃত্ত অবশ্য অনুনয়ের ধার দিয়াও গেল না। সরাসরি বললো, 'যাইতে দিবেন না কেরে?'
: আমি কি যেতে মানা করেছি!
: তাইলে সড়ে দাঁড়ান। আমরা ঢুকুম।
: দুই জনের বেশি ঢোকা যাবে না।
: কেন?
: নিয়ম নাই।
: উকে। তাইলে এহানেই দাঁড়াইয়া থাকুম। ডাক্তাররে এহানেই আইতে কন।
: যার সমস্যা তার সাথে একজন গেলেই তো হয়।
'সমস্যা চারজনেরই; পাশ থেকে কাব্য বলে উঠলো।
: মানে?
'মানে, একই সমস্যাই চার জন আক্রান্ত। বহুত প্যাচাল পাড়ছেন। এহন আপনি সরেন; এই বলে কাব্য অনেকটা ধাক্কা দিয়েই বেচারাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকলো। তারপর আমরাও ঢুকলাম। নিকশের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সিস্টেমটা ওর ভাল লাগে নাই।
ডাক্তারের ডেস্কের সামনে মাত্র দুইটা চেয়ার্। আমি আর নিকশ বসলাম। বৃত্ত স্বাভাবিক ভাবে গিয়ে রোগিকে যে বেডের উপরে শুইয়ে পরীক্ষা করে সেখানে বসলো আর, কাব্য দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। আমাদের ভাব ভঙ্গি অনেকটা চাঁদাবাজদের মত। ডাক্তারও কেমন যেন সন্দেহ নিয়ে আমাদের চারজনকে দেখছে। ডাক্তারের চোখ কাব্যের উপর স্থির হতেই কাব্য বত্রিশখানা দাঁত বের করে মোলায়েম ভাবে হেসে দিল। কাব্যর হাসি দেখে ডাক্তার অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অপ্রস্তুত ভাব দূর করার জন্যেই শান্তশিষ্ঠ নিকশকে তাড়াতাড়ি করে বললো, 'চারজন কেন?'
আমি বললাম, 'যথেষ্ট কারন আছে।'
: মানে!
: আমি শূন্য। আপনার সাথে কথা কমু এই জন্য আমি। ও হইলো অসমাপ্ত কাব্য, ও কু অর্থাৎ কুত্তা জাতি তথা সমস্ত প্রানীকুলের উপর বিশেষ জ্ঞান রাখে। এ হইলো নিকশ আলো। ডাক্তারি পড়তেছে। আপনি প্রেসক্রিপশানে দুই নাম্বার ঔষুধ দেন কিনা এইটা দেখবো। আর ও হইলো কেন্দ্রহীন বৃত্ত। আপনার জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তি কারন, আমাদের কাছে কোন টাকা নাই। ওই পেমেন্ট করবো।
আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বৃত্ত বললো, 'দোস্ত, আমার কাছে তো কোন টাকা নাই।'
: ও। আচ্ছা, সমস্যা নাই। ব্যবস্থা কইরা ফেলমুনি।
ডাক্তারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, সে কিছু ল্যাংটা পাগলদের দেখছে যাদের শরীরে মানুষের গু। মনে হয় যেকোন সময় গু ওয়ালা শরীর নিয়া কোলাকুলি করার জন্য তার দিকে ছুটে যাবে আর সাথে সাথে উনি ডেস্কের নিচে পালাবে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ডাক্তারের চেহারা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। আপন মনে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে একটা প্যাড টেনে নিয়ে কি যেন লেখা শুরু করলো। আমি অবাক হয়ে ডাক্তারের কর্মকান্ড দেখতেছি। এ তো ব্রিলিয়ান্ট ডাক্তার্। সমস্যা না শুনেই ঔষুধ দেয়।
আমি চোখ ঘুরিয়ে সব কিছু দেখতে দেখতে ডেস্কের উপর নেম প্লেটের উপর চোখ আটকে গেল। ডাক্তারের নাম অয়ন চৌধুরী।
হঠাৎ করে আমি কথা বলে উঠতেই ডাক্তার চমকে আমার দিকে তাকালো।
: অলন স্যার্?
: জ্বী!
: হা হয়ে যাওয়ার কিছু নাই। আমার ভাগ্নের নাম অয়ন। ওর মা ওকে খেপানোর জন্য অলন বলে ডাকে। আপনার নাম অয়ন তো তাই আপনারে এট্টু খেপাইলাম। আপনি খেপছেন?
আগ্রহ নিয়ে আমি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছি দেখি ডাক্তার খেপে উঠে তেড়েমেড়ে আসে কিনা। কিন্তু ডাক্তার আমাকে হতাশ করে দিয়ে এমন ভাবে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলো যেন আমরা পুরাই পাগল হয়ে গেছি এ ব্যাপারে এই মাত্র সে পুরোপুরি শিওর হলো। তবে আমি তার শিওর হওয়া ভাবটাকে কোন আমল না দিয়েই আরেকটা সম্মোধনে চমকে দিলাম।
: ওদন স্যার, আপনি কি বিজি?
ডাক্তার আমার দিকে হাবার মত তাকিয়ে আছে দেখে আমি মিষ্টি করে হেসে বললাম, 'খেপানোর জন্য ওদন হচ্ছে ওর দ্বিতীয় নাম। আপনার পছন্দ হয়েছে স্যার?'
গলা খঁকারি দিয়ে ডাক্তার এমন ভাবে কথা বলা শুরু করলো যেন এই মাত্র আমরা রুমে ঢুকছি।
: কার কি সমস্যা?
: মাত্র দুটো সমস্যা। চারজনই এই সমস্যার আওতায় আছি।
: সমস্যা গুলো কি?
: ভিক্ষা সমস্যা আর অনুভূতি সমস্যা।
'মানে; ডাক্তার আবার গাধায় রূপান্তরিত হয়েছে।
: আমরা ভিক্ষা করবো। প্রচলিত পদ্ধতিতেই কিন্তু আমরা নবিস। আপনি যেভাবে সাহায্য করবেন সেটা হলো, আপনি এমন একটা ঔষুধ দিবেন যে ঔষুধ খাওয়ার পর আমাদের কেউ একজন মরার মত পইড়া থাকবে। কোন প্রকার সাইট এফেক্ট ছাড়াই ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে থাকবে। কোন ডাক্তারেরও সাধ্য যেন না হয় পালস বোঝার্। তারপর রাস্তায় দেহটা শোয়াইয়া দিয়া আমরা ভিক্ষা করুম। পকেটে একটাও টাকা নাই। ভিক্ষার টাকা দিয়া কুকাকুলা আর মুরি খামু।
: ও মাই গড! হাউ ম্যাডনেস!
: আর অনুভূতির সমস্যাটা কু বিশেষজ্ঞ কাব্য কইবে।
কাব্য আমার পিছনে এসে দাঁড়ালো। চেয়ারের হাতলের উপর হাত রেখে বলা শুরু করলো।
: অলনের চাইতে ওদন নামটা আমার পছন্দ হইছে। আমি আপনারে ওদন স্যার বলেই ডাকবো। ওদন স্যার, আমরা কু-পান স্টাইলে চা পান করে চারপেয়ে জন্তুদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। কু মানে হলো কুত্তা। কুত্তার প্রথম অক্ষর কু নিয়ে বানিয়েছি কু-পান। চাইলে আপনি বিলাই এর টা নিয়া বানাইতে পারেন বি-পান, শিয়ালেরটা দিয়া শি-পান। যদি কোন জন্তুর নামের প্রথম অক্ষর গু থাকে তাইলে বলতে পারেন গু-পান।
আমি লক্ষ্য করলাম কাব্যর কথা শুনে ডাক্তারের চোখ মুখ কুঁচকে যাচ্ছে। ওদিকে কাব্য বলেই যাচ্ছে। ওর জ্ঞানের বহর দেখে আমি আবারো তাজ্জব হয়ে গেলাম।
: আমরা এই ভাবে পান করে ওদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেছি। সিরাম মজা পাইছি কিন্তু সব চারপেয়ে জন্তু তো কুত্তা বিলাইয়ের মত কইরা পানি পান করে না। হাতির মত যদি নাক দিয়া পান করতে যাই তাইলে তো সমস্যা। কি উপায়ে নাক দিয়া পান করলে সমস্যা অইবো না এইডা আপনে কন?
কথাটা বলেই কাব্য বত্রিশটা দাঁত বের করে কেলাতে শুরু করলো।
ঐদিকে ডাক্তারের মুখে কোন রা শব্দ নাই। হা হয়ে যাওয়া অবস্থাতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু নিকশ বসেই আছে। নিকশ ডাক্তাররে উদ্দেশ্য করে বললো, 'ঔষুধ দেন নয়তো ৪০০ টাকা দেন। আর আপনার ভিজিট ফ্রি খাইলাম। ফকিরদের কাছ থেকে আবার কিসের ভিজিট নিবেন।'
ডাক্তার এবার কাব্যর মুখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিকশের মুখের উপরে রাখলো। গাধার স্বরে বললো, 'কি!'
: বাসায় মাংশ রান্না হচ্ছে আর এখানে আমি না খেয়ে বসে আছি। ক্ষুদায় পেট চো চো করছে। ঔষুধ না দিলে ভিক্ষা করুম কেমনে? তাই আপনিই দেন।
ডাক্তারের কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে। বুঝলাম ডাক্তার একটা শিক্ষিত গাধা। শিক্ষত গাধার সামনে থাকতে আর ভাল লাগছে না। চার জনই বের হয়ে আসার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালাম অবশ্য নিকশকে জোর করে আনা হচ্ছে। দরজার কাছে চলে এসেছি প্রায়, এই সময় বৃত্ত আবার ঘুরে গিয়ে ডাক্তারের ডেস্কের সামনে গিয়ে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললো, 'আচ্ছা ওদন স্যার, একখান মদ্দা কতা কইবার চাই। তা অইলো, কোন কুত্তা যদি মানুষের অনুভূতি নিতে চায় তাহলে কোন উপায়ে কুত্তা চেষ্টা করবে? এটা ভাইবা রাখবেন। কাল আইসা জাইনা যামু।'
কথাটা বলেই বৃত্ত আমাদের সাথে যোগ দিল। আমরা আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম। রাস্তা জুড়ে চারজন হাঁটতেছি। পেটে প্রচন্ড ক্ষুদা। ইচ্ছে হচ্ছে সত্যি সত্যিই ভিক্ষা করি।
হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়লো। পিছন থেকে এক মেয়ে বলে উঠলো, 'ভাইয়ারা সাইট দেন নয়তো জোরে হাঁটেন। মেয়েরাও তো এর চেয়ে জোরে হাঁটে।'
কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমি পিছনে তাকালাম বেয়াদপগুলোর চেহারা দেখার জন্য। দেখে মনে হচ্ছে কলেজ পড়ুয়া কিছু বালিকা। এমন বালিকারা যাই বলে তাই ভাল লাগে। মন চায় আরো কথা শুনি। কিন্তু এখন মন চাচ্ছে ধরে থাপড়াই। ইভটিজিং এর ভয়ে ইচ্ছাটাকে মাটি চাপা দিলাম। এমনিতেই পেটে ক্ষুদা তার উপর পৌরুষত্বে আঘাত। আর সওয়া যায় না। ক্ষুদাকে ভুলে জোরে পা চালালাম। কিছুদূর যেতেই বৃত্ত বলে উঠলো, 'মাইয়াটা কি কইলো।'
ওর কথা শুনে আমার চান্দি গরম হয়ে গেল। ব্যাটায় কয় কি! হালারে পোলা থেকে মেয়ে বানিয়ে দিয়ে গেল আর এখন বলছে, মাইয়াটা কি কইলো?
বাঁশ দিয়ে কিছু একটা বলতে চাওয়ার আগেই বৃত্ত ঘুরে মেয়ে দুইটার দিকে হাঁটা ধরলো। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, সম্মান ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। বেটা ছেলে।
ঘটনা বোঝার জন্য আমরা দাঁড়ালাম।
অবাক হয়ে আমরা বৃত্তের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বৃত্তের ব্রেক ফেল মারছে। দূর্ঘটনা ঘটতে বাধ্য।
নাহ! অবশেষে ব্রেক কষছে কিন্তু মনে হচ্ছে একেবারে নাকের উপরে গিয়ে ব্রেক আটকিছে। একদম পিছনে দাঁড়িয়ে আছি বলে ঠিকমত বোঝাও যাচ্ছে না। তারপরেও বৃত্তের সকল কর্মকান্ড দেখতে পাচ্ছি।
বৃত্ত মেয়েগুলোর সামনে দাঁড়িয়েই ইয়া বড় একটা ধমক মেরে বসলো। মেয়েগুলো পুরা আঁতেল হয়ে গেছে। মুখে রা শব্দটাও আর নাই। একে অপরের মুখের দিকে তাকানোর কথাও ভুলে গেছে। তাদের মুখে কথা ফোঁটার আগেই বৃত্ত ফিরতি পথ ধরলো। বৃত্তের চেহারাটা একদম স্বাভাবিক। কি অমায়িক লাগছে ছেলেটাকে আর ঐ দিকে মেয়েগুলো এখনও তালগাছের মত দাঁড়িয়েই আছে।
কোন কথা না বলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। আস্তে আস্তে ধরনের হাঁটা। এই ভাবে হাঁটলেও এখন আর কোন সমস্যা নেই। তালগাছ দৌড়ায় না। দৌড়ালে হয়তো দৌঁড় দিয়ে এসে বলতো, 'ঐ মিয়ারা, কত বার জোরে হাঁটনের কথা কওন লাগে। শাড়ি পড়ছেন নাকি যে হাঁটতে পারেন না? হি হি হি হি।'
ভাগ্য ভাল যে, তালগাছ দৌড়ায় না।
নিকশের পকেটে ফোন বাঁজছে।
নিকশ কিছুক্ষন কথা বলেই ফোনটা রেখে দিয়ে আমাদের বললো, 'চলো।'
'কই; কাব্য বললো।
: মুরি থুক্কু রিমু ফোন দিছে। টেডি বিয়ার মার্কেটের সামনে বিন্তে খালারে নিয়া দাঁড়াইয়া আছে। আমারে যাইতে বললো। তোমরা গেলে চলো।
'মুরি কি এহানে আছে যে জিভ কাইটা রিমু কইতে হবে। ওর সামনে একবার মুরি কমু আর পিছনে নিরানব্বই বার মুরি কমু। শতকরার হিসাব মিইলা গেছে; আমি অতি স্বাভাবিক ভাবে বললাম।
বৃত্ত বললো, 'ক্যান যাইতে কইছে?'
: ওখানে আমার একজন বান্ধবির বিউটি পার্লার আছে। খালা এমনিতেই সুন্দর তারপরেও সপ্তাহে দুই বার বিউটি পার্লারে যানই। আমি যামু বান্ধবির সাথে খালারে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
'খালার নাম কি শুধু বিন্তে; অবাকের সাথে বললাম।
'নাহ। লতা বিন্তে; আমাদের বেটাছেলে বৃত্ত বললো।
'ও। সুন্দর নাম। মিরাকেল ভাবে মুরিই তাহলে খাওয়াচ্ছে আমাদের; আমি আপন মনে বললাম।
টেডি বিয়ার মার্কেটের দিকে হাঁটছি আমরা চার জন। রিমু আর তার সাঁজুগুজু খালার কাছে। এই বার বুঝি সিঁকে ছিঁড়লো কপালে।
চলবে...
আমি অবাক হয়ে কাব্যর দিকে তাকিয়ে আছি। কাব্য এখনও নির্ভাবনায় পুলিশের গাড়ির মধ্যে সিটের উপর বসে আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ওর ঘুম পেয়েছে। যেকোন সময় সিটের উপর শুয়ে ঘুমিয়েও পড়তে পারে। কেন জানি মনে হলো কাব্য ঝিমুচ্ছে। মনে হয় ভুলই দেখেছি। কাব্য গাড়ি থেকে নেমে অল্প দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা আবুল পুলিশের দিকে হাঁটা ধরলো। কাছে গিয়েই পুলিশের সাথে কথা বলা শুরু করলো। আমি গাড়ির মধ্যে থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
: আবুল ভাই, কেমন আছেন?
: কি চাই?
: মুখ গোমড়া করে আছেন কেন? একটা সিগারেট হবে?
: না নাই।
আবুল এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কাব্য একটা কুঁচে মুরগি।
কাব্যও কুঁচে মুরগির মত মাথা নিচের দিক দিয়ে আবার আমার সামনে এসে বসলো।
: শূন্য, নিকশ কি আইবো?
: আওনের তো কথা।
: দশ মিনিট তো পার অইয়া গেল। আর ব্যাটারা এভাবে অপেক্ষা করতেছে ক্যান। হালাগোরে মতলব কি! অন্য আসামীর নামে চালান কইরা দিব নাকি।
: কপালে যদি থাকে তুমি কি করবা? নিকশরে না ডাইকা যদি পাঁচ ইঞ্চিরে ডাকতাম তাইলে থানায় রাত্রীযাপনটা দারুন অইতো।
: পাঁচ ইঞ্চিডা আবার কেডা?
: আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। দেখতে ছোট বইলা পাঁচ ইঞ্চি কইয়া ডাকতাম। হালায় ঘুমাইলে কিছু টের পায় না। পাছায় কষে লাথি মারলেও টের পায় না। থানার মশা গুলো বলে বাঘের মত। খুব শখ ছিল হালায় থানায় কেমনে ঘুমায় দেখুম। প্রথমেই যদি ওরে ফোন দিতাম তাইলে বেশ অইতো।
: শূন্য, ব্যাটার ভাব দেহো। এমন ভাবে আইতেছে যেন শ্বশুর বাড়ি দাওয়াত খাইতে যাইতেছে।
নাক বরাবর সামনে তাকিয়ে দেখি, নিকশ। হেলে ঢুলে আসছে। মনে হচ্ছে গুন গুন করে গানও গাইতেছে।
উলালা উলালা
মুরি খাইয়া যায় বেলা
উলালা উলালা
কেউ আমারে মাইরালা।
এই টাইপের গান মনে হয়। এমন ভাবে মাথা ঝাকাচ্ছে মনে হয় মাজারে কিছু কাল সময় দিয়েছে। বেশ কাছে এসে নিকশ মাথা তুলে সোজা আমাদের উপর চোখ ফেললো। পা তুলতে গিয়েই থেমে পড়লো। আমাদের পুলিশের গাড়িতে আর পাশে একজন পুলিশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিকশ সন্দিহান চোখে তাকিয়েই থাকলো কিন্তু আগে বাড়লো না। আমি আর কাব্য আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নামলাম। আমাদের নামার মধ্যে হয়তো এমন কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল যা আবুলকে সন্দিহান করে তুললো।
কাব্য আমার পাশ থেকে মোলায়েম কন্ঠে নিকশরে বললো, 'আয় বন্ধু আয়।'
কাব্যর কথা শুনে নিকশ দুই পা পিছিয়ে গেল। ওর চেহারাটা দেখতে হয়েছে ছাগলের মত।
কাব্যও দুই পা এগিয়ে দুই হাত সামনে বাড়ায়ে বললো, 'কি হলো, আয়।'
আমি আবুলকে বন্ধুর সাথে কথা বলছি এমন ভাব করে বললাম, 'ঐ ব্যাটাই। ও এখন দৌড়ানোর পায়তারা কষতাছে। চলেন ওরে ধইরা আনি।'
আবুলের মুখ থেকে কোন উত্তর শোনার আগেই নিকশ ভোঁ দৌড় দিল। আমিও নিকশের পিছে পিছে দৌড় দিলাম। আমার দেখাদেখি কাব্যও দৌড় দিল। পিছনে তাকায়ে দেখি আবুলও দৌড়ায়।
উষ্ট্রা খেয়ে পড়তে পড়তে পড়লাম না। একটু দৌঁড়ানোতেই দেখি হাঁপিয়ে গেছি। নাক মুখ দিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ বের হচ্ছে। নাহ, বাসায় গিয়ে এবার দৌঁড়ের প্র্যাকটিস করতেই হবে। মুহূর্তে কাব্য আমাকে পিছে ফেলে নিকশের বেশ কাছে চলে গেল। কতক্ষন দৌড়াইছি জানি না। চোখে অন্ধকার দেখছি। সামনেই দেখছি ফুটপাতের উপর নিকশ বসে থেকে হাঁপাচ্ছে। একটু পিছনেই কাব্য। পরিশ্রমে ওর জিভ বের হয়ে পড়ছে। আমি রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়েই জিভ বের করে হাঁপাতে থাকলাম। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে শেষে রাস্তাতেই বসে পড়লাম। বসার সাথে সাথেই প্রাইভেট কারের হর্ণ কানের পর্দা প্রায় ফাঁটিয়ে দিল। তবুও বসেই থাকলাম। একটু পর গাড়িটা পাশ ঘেঁষে যাওয়ার সময় থেমে গ্লাসটা নামিয়ে দিয়ে এক ভদ্রমহিলা মাথা বের করে দিয়ে অভদ্রের মত স্টুপিড বলে গালি দিল।
প্রতুত্তরে আমি মাথা কাত করে মিষ্টি করে একটা হাসি ফিরিয়ে দিলাম। মনে হলো মহিলার মুখে কেউ আগুন ধরিয়ে দিলো। মুহূর্তে মুখখানা লাল টকটকে হয়ে গেল। ঝট করে মুখ ঘুরিয়েই গাড়ি নিয়া হুঁস করে চলে গেল। আমিও দাঁত কেলিয়ে উঠে পড়লাম। উঠেই নিকশ আর কাব্যর মাঝে গিয়া বসেই নিকশকে বললাম, 'নিকশ, কেমন আছিস বন্ধু?'
নিকশ আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, 'এত ভাল কোনদিনও ছিলাম না। একখান কুকাকুলা আর এক বাটি মুরি অইলে তোর পাছায় লাথি মারার কথা ভুইলা যামু।'
: আহ দারুন কথা কইছোস বন্ধু কিন্তু টেকা কই পামু। সব টেকা তো রিমু লইয়া গেছে।
: আর ফাইজলামি করোনের দরকার নাই। শর্টকাটে কাব্যর থাইকা ঘটনা শুনছি।
: ও।
: মাংস দিয়া ভাত। রান্না মনে হয় এতক্ষনে শেষ হইয়া গেছে। ছোট ভাইদের আমার ভাগের খাওয়াটা খাইতে বইলা আসলাম। মনে মনে ভাবছিলাম রিমুর হ্যান্ডব্যাগটা আজ ফক্কা করে দেব। আর এখন কপাল খামচাইতে মন চাইতেছে। হায়রে কপাল!
: এহন ভাইবা আর কি অইবো। আপাতত এহান থাইকা উঠি। কাব্য, খোঁজ লওতো কেন্দ্রহীন বৃত্ত এহন কই।
কাব্য কান থেকে মোবাইল রেখে বললো, সিটি হসপিটালে।
: ওরে কও সব রোগের চিকিৎসা জানে এমন একটা ডাক্তারের রুমে ঢোকার জন্য যেন একটা টিকিট কাটে।
: কেন!
: ভিক্ষা করার ট্রেনিং লমু ডাক্তারের কাছ থেকে। ভিক্ষার টেকা দিয়া নিকশরে একবাটি কুকাকুলা আর এক বোতল মুরি কিনা দিমু। কি বলিস নিকশ?
আমার কথা শুনে কাব্য দাঁত বেরর করে কেলাতে কেলাতে বৃত্তের সাথে কথা বলতে শুরু করলো আর নিকশ হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিকশের হাঁ করা মুখের উপরেই উঠে দাঁড়ালাম। সিটি হসপিটালে যেতে হবে।
৭...
সিটি হসপিটাল। ডাক্তারের রুমের সামনে ডাক্তারের পি.এস আমাদের চারজনকে আটকিয়ে দিল। একসাথে চারজনকে ঢুকতে দিবে না। নিকশ অনেক অনুনয় বিনয় করতেছে তাও ঢুকতে দিচ্ছে না। অনুনয় করার কারন সম্ভবত একই প্রজাতি বলে। নিকশ ডাক্তার হতে যাচ্ছে আর এরা তো হয়েই আছে। বৃত্ত অবশ্য অনুনয়ের ধার দিয়াও গেল না। সরাসরি বললো, 'যাইতে দিবেন না কেরে?'
: আমি কি যেতে মানা করেছি!
: তাইলে সড়ে দাঁড়ান। আমরা ঢুকুম।
: দুই জনের বেশি ঢোকা যাবে না।
: কেন?
: নিয়ম নাই।
: উকে। তাইলে এহানেই দাঁড়াইয়া থাকুম। ডাক্তাররে এহানেই আইতে কন।
: যার সমস্যা তার সাথে একজন গেলেই তো হয়।
'সমস্যা চারজনেরই; পাশ থেকে কাব্য বলে উঠলো।
: মানে?
'মানে, একই সমস্যাই চার জন আক্রান্ত। বহুত প্যাচাল পাড়ছেন। এহন আপনি সরেন; এই বলে কাব্য অনেকটা ধাক্কা দিয়েই বেচারাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকলো। তারপর আমরাও ঢুকলাম। নিকশের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সিস্টেমটা ওর ভাল লাগে নাই।
ডাক্তারের ডেস্কের সামনে মাত্র দুইটা চেয়ার্। আমি আর নিকশ বসলাম। বৃত্ত স্বাভাবিক ভাবে গিয়ে রোগিকে যে বেডের উপরে শুইয়ে পরীক্ষা করে সেখানে বসলো আর, কাব্য দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। আমাদের ভাব ভঙ্গি অনেকটা চাঁদাবাজদের মত। ডাক্তারও কেমন যেন সন্দেহ নিয়ে আমাদের চারজনকে দেখছে। ডাক্তারের চোখ কাব্যের উপর স্থির হতেই কাব্য বত্রিশখানা দাঁত বের করে মোলায়েম ভাবে হেসে দিল। কাব্যর হাসি দেখে ডাক্তার অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অপ্রস্তুত ভাব দূর করার জন্যেই শান্তশিষ্ঠ নিকশকে তাড়াতাড়ি করে বললো, 'চারজন কেন?'
আমি বললাম, 'যথেষ্ট কারন আছে।'
: মানে!
: আমি শূন্য। আপনার সাথে কথা কমু এই জন্য আমি। ও হইলো অসমাপ্ত কাব্য, ও কু অর্থাৎ কুত্তা জাতি তথা সমস্ত প্রানীকুলের উপর বিশেষ জ্ঞান রাখে। এ হইলো নিকশ আলো। ডাক্তারি পড়তেছে। আপনি প্রেসক্রিপশানে দুই নাম্বার ঔষুধ দেন কিনা এইটা দেখবো। আর ও হইলো কেন্দ্রহীন বৃত্ত। আপনার জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তি কারন, আমাদের কাছে কোন টাকা নাই। ওই পেমেন্ট করবো।
আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বৃত্ত বললো, 'দোস্ত, আমার কাছে তো কোন টাকা নাই।'
: ও। আচ্ছা, সমস্যা নাই। ব্যবস্থা কইরা ফেলমুনি।
ডাক্তারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, সে কিছু ল্যাংটা পাগলদের দেখছে যাদের শরীরে মানুষের গু। মনে হয় যেকোন সময় গু ওয়ালা শরীর নিয়া কোলাকুলি করার জন্য তার দিকে ছুটে যাবে আর সাথে সাথে উনি ডেস্কের নিচে পালাবে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ডাক্তারের চেহারা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। আপন মনে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে একটা প্যাড টেনে নিয়ে কি যেন লেখা শুরু করলো। আমি অবাক হয়ে ডাক্তারের কর্মকান্ড দেখতেছি। এ তো ব্রিলিয়ান্ট ডাক্তার্। সমস্যা না শুনেই ঔষুধ দেয়।
আমি চোখ ঘুরিয়ে সব কিছু দেখতে দেখতে ডেস্কের উপর নেম প্লেটের উপর চোখ আটকে গেল। ডাক্তারের নাম অয়ন চৌধুরী।
হঠাৎ করে আমি কথা বলে উঠতেই ডাক্তার চমকে আমার দিকে তাকালো।
: অলন স্যার্?
: জ্বী!
: হা হয়ে যাওয়ার কিছু নাই। আমার ভাগ্নের নাম অয়ন। ওর মা ওকে খেপানোর জন্য অলন বলে ডাকে। আপনার নাম অয়ন তো তাই আপনারে এট্টু খেপাইলাম। আপনি খেপছেন?
আগ্রহ নিয়ে আমি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছি দেখি ডাক্তার খেপে উঠে তেড়েমেড়ে আসে কিনা। কিন্তু ডাক্তার আমাকে হতাশ করে দিয়ে এমন ভাবে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলো যেন আমরা পুরাই পাগল হয়ে গেছি এ ব্যাপারে এই মাত্র সে পুরোপুরি শিওর হলো। তবে আমি তার শিওর হওয়া ভাবটাকে কোন আমল না দিয়েই আরেকটা সম্মোধনে চমকে দিলাম।
: ওদন স্যার, আপনি কি বিজি?
ডাক্তার আমার দিকে হাবার মত তাকিয়ে আছে দেখে আমি মিষ্টি করে হেসে বললাম, 'খেপানোর জন্য ওদন হচ্ছে ওর দ্বিতীয় নাম। আপনার পছন্দ হয়েছে স্যার?'
গলা খঁকারি দিয়ে ডাক্তার এমন ভাবে কথা বলা শুরু করলো যেন এই মাত্র আমরা রুমে ঢুকছি।
: কার কি সমস্যা?
: মাত্র দুটো সমস্যা। চারজনই এই সমস্যার আওতায় আছি।
: সমস্যা গুলো কি?
: ভিক্ষা সমস্যা আর অনুভূতি সমস্যা।
'মানে; ডাক্তার আবার গাধায় রূপান্তরিত হয়েছে।
: আমরা ভিক্ষা করবো। প্রচলিত পদ্ধতিতেই কিন্তু আমরা নবিস। আপনি যেভাবে সাহায্য করবেন সেটা হলো, আপনি এমন একটা ঔষুধ দিবেন যে ঔষুধ খাওয়ার পর আমাদের কেউ একজন মরার মত পইড়া থাকবে। কোন প্রকার সাইট এফেক্ট ছাড়াই ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে থাকবে। কোন ডাক্তারেরও সাধ্য যেন না হয় পালস বোঝার্। তারপর রাস্তায় দেহটা শোয়াইয়া দিয়া আমরা ভিক্ষা করুম। পকেটে একটাও টাকা নাই। ভিক্ষার টাকা দিয়া কুকাকুলা আর মুরি খামু।
: ও মাই গড! হাউ ম্যাডনেস!
: আর অনুভূতির সমস্যাটা কু বিশেষজ্ঞ কাব্য কইবে।
কাব্য আমার পিছনে এসে দাঁড়ালো। চেয়ারের হাতলের উপর হাত রেখে বলা শুরু করলো।
: অলনের চাইতে ওদন নামটা আমার পছন্দ হইছে। আমি আপনারে ওদন স্যার বলেই ডাকবো। ওদন স্যার, আমরা কু-পান স্টাইলে চা পান করে চারপেয়ে জন্তুদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। কু মানে হলো কুত্তা। কুত্তার প্রথম অক্ষর কু নিয়ে বানিয়েছি কু-পান। চাইলে আপনি বিলাই এর টা নিয়া বানাইতে পারেন বি-পান, শিয়ালেরটা দিয়া শি-পান। যদি কোন জন্তুর নামের প্রথম অক্ষর গু থাকে তাইলে বলতে পারেন গু-পান।
আমি লক্ষ্য করলাম কাব্যর কথা শুনে ডাক্তারের চোখ মুখ কুঁচকে যাচ্ছে। ওদিকে কাব্য বলেই যাচ্ছে। ওর জ্ঞানের বহর দেখে আমি আবারো তাজ্জব হয়ে গেলাম।
: আমরা এই ভাবে পান করে ওদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেছি। সিরাম মজা পাইছি কিন্তু সব চারপেয়ে জন্তু তো কুত্তা বিলাইয়ের মত কইরা পানি পান করে না। হাতির মত যদি নাক দিয়া পান করতে যাই তাইলে তো সমস্যা। কি উপায়ে নাক দিয়া পান করলে সমস্যা অইবো না এইডা আপনে কন?
কথাটা বলেই কাব্য বত্রিশটা দাঁত বের করে কেলাতে শুরু করলো।
ঐদিকে ডাক্তারের মুখে কোন রা শব্দ নাই। হা হয়ে যাওয়া অবস্থাতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু নিকশ বসেই আছে। নিকশ ডাক্তাররে উদ্দেশ্য করে বললো, 'ঔষুধ দেন নয়তো ৪০০ টাকা দেন। আর আপনার ভিজিট ফ্রি খাইলাম। ফকিরদের কাছ থেকে আবার কিসের ভিজিট নিবেন।'
ডাক্তার এবার কাব্যর মুখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিকশের মুখের উপরে রাখলো। গাধার স্বরে বললো, 'কি!'
: বাসায় মাংশ রান্না হচ্ছে আর এখানে আমি না খেয়ে বসে আছি। ক্ষুদায় পেট চো চো করছে। ঔষুধ না দিলে ভিক্ষা করুম কেমনে? তাই আপনিই দেন।
ডাক্তারের কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে। বুঝলাম ডাক্তার একটা শিক্ষিত গাধা। শিক্ষত গাধার সামনে থাকতে আর ভাল লাগছে না। চার জনই বের হয়ে আসার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালাম অবশ্য নিকশকে জোর করে আনা হচ্ছে। দরজার কাছে চলে এসেছি প্রায়, এই সময় বৃত্ত আবার ঘুরে গিয়ে ডাক্তারের ডেস্কের সামনে গিয়ে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললো, 'আচ্ছা ওদন স্যার, একখান মদ্দা কতা কইবার চাই। তা অইলো, কোন কুত্তা যদি মানুষের অনুভূতি নিতে চায় তাহলে কোন উপায়ে কুত্তা চেষ্টা করবে? এটা ভাইবা রাখবেন। কাল আইসা জাইনা যামু।'
কথাটা বলেই বৃত্ত আমাদের সাথে যোগ দিল। আমরা আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম। রাস্তা জুড়ে চারজন হাঁটতেছি। পেটে প্রচন্ড ক্ষুদা। ইচ্ছে হচ্ছে সত্যি সত্যিই ভিক্ষা করি।
হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়লো। পিছন থেকে এক মেয়ে বলে উঠলো, 'ভাইয়ারা সাইট দেন নয়তো জোরে হাঁটেন। মেয়েরাও তো এর চেয়ে জোরে হাঁটে।'
কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমি পিছনে তাকালাম বেয়াদপগুলোর চেহারা দেখার জন্য। দেখে মনে হচ্ছে কলেজ পড়ুয়া কিছু বালিকা। এমন বালিকারা যাই বলে তাই ভাল লাগে। মন চায় আরো কথা শুনি। কিন্তু এখন মন চাচ্ছে ধরে থাপড়াই। ইভটিজিং এর ভয়ে ইচ্ছাটাকে মাটি চাপা দিলাম। এমনিতেই পেটে ক্ষুদা তার উপর পৌরুষত্বে আঘাত। আর সওয়া যায় না। ক্ষুদাকে ভুলে জোরে পা চালালাম। কিছুদূর যেতেই বৃত্ত বলে উঠলো, 'মাইয়াটা কি কইলো।'
ওর কথা শুনে আমার চান্দি গরম হয়ে গেল। ব্যাটায় কয় কি! হালারে পোলা থেকে মেয়ে বানিয়ে দিয়ে গেল আর এখন বলছে, মাইয়াটা কি কইলো?
বাঁশ দিয়ে কিছু একটা বলতে চাওয়ার আগেই বৃত্ত ঘুরে মেয়ে দুইটার দিকে হাঁটা ধরলো। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, সম্মান ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। বেটা ছেলে।
ঘটনা বোঝার জন্য আমরা দাঁড়ালাম।
অবাক হয়ে আমরা বৃত্তের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বৃত্তের ব্রেক ফেল মারছে। দূর্ঘটনা ঘটতে বাধ্য।
নাহ! অবশেষে ব্রেক কষছে কিন্তু মনে হচ্ছে একেবারে নাকের উপরে গিয়ে ব্রেক আটকিছে। একদম পিছনে দাঁড়িয়ে আছি বলে ঠিকমত বোঝাও যাচ্ছে না। তারপরেও বৃত্তের সকল কর্মকান্ড দেখতে পাচ্ছি।
বৃত্ত মেয়েগুলোর সামনে দাঁড়িয়েই ইয়া বড় একটা ধমক মেরে বসলো। মেয়েগুলো পুরা আঁতেল হয়ে গেছে। মুখে রা শব্দটাও আর নাই। একে অপরের মুখের দিকে তাকানোর কথাও ভুলে গেছে। তাদের মুখে কথা ফোঁটার আগেই বৃত্ত ফিরতি পথ ধরলো। বৃত্তের চেহারাটা একদম স্বাভাবিক। কি অমায়িক লাগছে ছেলেটাকে আর ঐ দিকে মেয়েগুলো এখনও তালগাছের মত দাঁড়িয়েই আছে।
কোন কথা না বলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। আস্তে আস্তে ধরনের হাঁটা। এই ভাবে হাঁটলেও এখন আর কোন সমস্যা নেই। তালগাছ দৌড়ায় না। দৌড়ালে হয়তো দৌঁড় দিয়ে এসে বলতো, 'ঐ মিয়ারা, কত বার জোরে হাঁটনের কথা কওন লাগে। শাড়ি পড়ছেন নাকি যে হাঁটতে পারেন না? হি হি হি হি।'
ভাগ্য ভাল যে, তালগাছ দৌড়ায় না।
নিকশের পকেটে ফোন বাঁজছে।
নিকশ কিছুক্ষন কথা বলেই ফোনটা রেখে দিয়ে আমাদের বললো, 'চলো।'
'কই; কাব্য বললো।
: মুরি থুক্কু রিমু ফোন দিছে। টেডি বিয়ার মার্কেটের সামনে বিন্তে খালারে নিয়া দাঁড়াইয়া আছে। আমারে যাইতে বললো। তোমরা গেলে চলো।
'মুরি কি এহানে আছে যে জিভ কাইটা রিমু কইতে হবে। ওর সামনে একবার মুরি কমু আর পিছনে নিরানব্বই বার মুরি কমু। শতকরার হিসাব মিইলা গেছে; আমি অতি স্বাভাবিক ভাবে বললাম।
বৃত্ত বললো, 'ক্যান যাইতে কইছে?'
: ওখানে আমার একজন বান্ধবির বিউটি পার্লার আছে। খালা এমনিতেই সুন্দর তারপরেও সপ্তাহে দুই বার বিউটি পার্লারে যানই। আমি যামু বান্ধবির সাথে খালারে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
'খালার নাম কি শুধু বিন্তে; অবাকের সাথে বললাম।
'নাহ। লতা বিন্তে; আমাদের বেটাছেলে বৃত্ত বললো।
'ও। সুন্দর নাম। মিরাকেল ভাবে মুরিই তাহলে খাওয়াচ্ছে আমাদের; আমি আপন মনে বললাম।
টেডি বিয়ার মার্কেটের দিকে হাঁটছি আমরা চার জন। রিমু আর তার সাঁজুগুজু খালার কাছে। এই বার বুঝি সিঁকে ছিঁড়লো কপালে।
চলবে...
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মঞ্জুর হোসেন মৃদুল ০৬/১১/২০১৪অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়ার সৌভাগ্য হল। বেশ ভাল লাগল।
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ০৬/১১/২০১৪কতদিন না থুক্কু কত পর্ব....................?