www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মায়া’র সাথে বৃষ্টিবিলাস

- হ্যালো, হ্যালো।
- বলো, শুনছি।
- তুমি কোথায়?
- তুমি কোথায়?
- আমি বাসট্যান্ডে। আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন? কতক্ষন হলো আমি দাঁড়িয়ে আছি, সেই দিকে তোমার খেয়াল আছে?
মায়ার কন্ঠ থেকে পরিষ্কার রাগ, উদ্বিগ্ন ভেসে আসছে। গলাটা কেঁপে যাচ্ছে। মেয়েটা এত চিন্তা করে আমাকে নিয়ে যে মাঝে মাঝে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়। ভালবাসা জিনিসটা গভীরভাবে অনুভব করতে পারি। ভালবাসার জগতে নগন্য একজন মানুষ এমন একজনকে খুঁজে পেয়েছে যে ওকে ভালবাসায় পরিপূর্ণ করে তুলেছে। মায়া’র উদ্বিগ্ন ভাবটা আর বাড়াতে চাচ্ছি না। জোর পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কারন আমি জানি এরই মধ্যে ওর দুই চোখে পানি চলে এসেছে। এত ভাল, মানুষ বাসে কিভাবে! মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে যাই।
- আর একটু অপেক্ষা করো, আমি এসে গেছি প্রায়।
- তোমার জন্য আরো ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে পারবো তাতে কোন সমস্যা নাই। সমস্যা হলো তুমি ফোন রিসিভ করলা না কেন এতক্ষন। কতবার কল দিয়েছি তোমাকে তুমি জানো?
- জানি। সতেরো বার।
- আচ্ছা আসো আগে তারপর তোমার সাথে বোঝাপড়া আছে আমার।

মোহাম্মাদপুর বাসট্যান্ড। একটু খুঁজতেই মায়া’কে পেয়ে গেলাম। একটু আগেই সম্ভবত গোসল করেছে। চুল গুলো ভেঁজা। মায়া’কে দেখে হিমুর কথা মনে পড়ে গেল। মায়া যে জামাটা পড়েছে তার তিনটি অংশ বাদ দিয়ে পুরোটাই হলুদ। কাচা হলুদ বর্ণ। গলার সামনের অংশটুকু, হাতার কব্জির দিকের বর্ডার আর জামার সামনের দিকের নিচের ঝালরটুকু লাল। অবশ্য যে ওড়নাটা পরেছে সেটাও লাল টকটকে। কাঁধের ব্যাগটা কালো। কপালের টিপটা কালো, কানের দুলটা সাদা। তারপরেও কেন যেন মায়া’কে মেয়ে হিমু মেয়ে হিমু বলে ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি মায়া’র কাছে যেতেই মায়া’র চোখে জল এবং তীব্র ভর্ৎসনা দেখতে পেলাম। এই দুইটা জিনিস এক সাথে কিভাবে চোখে ধারন করে রেখেছে এটাই বুঝতে পারলাম না। মায়া আমাকে হাত ধরে টেনে একটা খোলামত জায়গায় নিয়ে এসে বললো, ‘বলো, কি হয়েছিল। এত বার ফোন দিলাম ধরলা না কেন?’
- আমি আসলে একটা ডিসপেনসারিতে গিয়েছিলাম ঔষুধ কিনতে। ঔষুধ কিনে তোমার কাছে নিশ্চিন্তমনে আসছিলাম। পথিমধ্যে এসে মনে হলো তোমাকে একটা ফোন দিয়ে শুনি তুমি এখন কোথায় কিন্তু পকেটে হাত দিয়েই বুঝতে পারলাম আমার পকেট ফাঁকা। মোবাইল নেই। ঐ সময় হঠাৎ করে মনে হলো, মোবাইলটা ঔষুধের দোকানে রেখে এসেছি। আমি আবার ছুটলাম, দোকানে গেলাম এবং কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দোকানদার আমাকে দেখে বললো, এই বয়সে এমন ভুলো মন হলে চলে। লোক ভালো, তাই মোবাইলটা পেলাম। তাকে ধন্যাবাদ দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকাতেই দেখি সতেরোবার কল দিয়েছ তুমি।
- বুঝলাম ফোনটা রেখে এসেছ কিন্তু ঐ লোকটাই বা কেমন, এত বার ফোন বাঁজলো অথচ ধরলো না। কলটা রিসিভ করলেই তো বরং সে মোবাইলের কথা বলতে পারতো।
- সাইলেন্ট ছিল।
- সাইলেন্ট করে রাখছো কেন। আর তোমার মোবাইলটা ওখানে বের করার কি দরকার ছিল, হ্যাঁ?
- আচ্ছা বাবা ভুল হয়েছে। মাফ চাইছি। এবার বলো কোথায় যাবো আমরা।
- তুমি জানো আমি কত চিন্তায় ছিলাম?
- চিন্তায় ছিলে কেন? এখান থেকে এখানে আসবো এতেই এত চিন্তা করো!
- তোমার নিজের প্রতি কোন খেয়াল থাকে। বাইরে বের হলেই তো দূর্ঘটনা ঘটিয়ে বসো। তোমাকে নিয়ে সব সময় আমার চিন্তায় থাকতে হয়।
- বিয়ের পরে যখন চাকরি করবো তখন কি করবা শুনি। আমার সাথে সাথে অফিসে যাবা?
- দাঁত বের করে হাসছো কেন। তোমাকে চাকরি করতে হবে না। আমিই চাকরি করবো। তুমি ঘরে বসে থাকবে আর গল্প লিখবে।
- হা হা হা। কারো সামনে বলো না তাহলে আমার আর সম্মান থাকবে না।
- হয়েছে হয়েছে। এবার রিক্সা নাও।
- কোথায় যাবো যেন আমরা?
- বছিলা ব্রিজ।

******** ********

ব্রিজটা অনেক লম্বা। ব্রিজের উপরে উঠলাম। মানুষ হাঁটবে যে অংশটা দিয়ে সেই অংশটা দিয়ে আমি মায়া’র হাত ধরে হাঁটছি। ব্রিজের নিচে নদীর পানিটা কুচকুচে কালো। দেখলেই গা শিউড়ে ওঠে। ব্রিজের মাঝামাঝিতে চলে আসলাম। প্রচূর বালি বাহী নৌকা ব্রীজের নিচ দিয়ে যাওয়া আসা করছে। দৃশ্যটা অসাধারন। ব্রিজের রেলিং ধরে ডানদিকে তাকালাম। নদীর কিনারায় একটা বাড়ির পিছনে বিশাল একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখতে পেলাম। গাছটায় যেন আগুন ধরেছে। এখন আর মায়া’কে হিমুর মত মনে হচ্ছে না। ও শরীরটা ওড়না দিয়ে এমন ভাবে জ়ড়িয়ে নিয়েছে যে এখন মায়া’র দিকে তাকিয়েও মনে হচ্ছে যে মায়া’র শরীরেও আগুন ধরেছে। কৃষ্ণচূড়ার গাছ আর মায়া’র মাঝে যেন কোন পার্থক্য নেই। ক্যামেরার অভাব অনুভব করা শুরু করলাম। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো এটা ভেবে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলাম। মায়া’কে সুন্দর একটা পোজ নিতে বলে এক ক্যাপচারে ব্রিজের নিচে দিয়ে যাওয়া নৌকা, কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুন লাগা মুগ্ধকর দৃশ্য আর মায়া’কে ফ্রেমে ধারন করলাম। বেশ কিছু ছবি তুললাম।
খুব ভাল লাগছে আমার। মায়া আমার কাঁধে মাথা রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। গল্প করতে করতে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেল। হঠাৎ করেই আকাশে মেঘ ধরে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করলো। একটু পরেই বাতাস বইতে থাকলো। আমরা তাড়াতাড়ি ফেরার জন্যে পথ ধরেই বিপদে পড়ে গেলাম। এলোমেলো বাতাস বওয়ার কারনে ব্রিজের উপরকার বালি গুলো চোখে মুখে ঝাপটা মারতে শুরু করলো। মুহূর্তের মধ্যে আমার আর মায়া’র মুখের উপর বালির একটা পাতলা স্তর পড়ে গেল। চুলের মধ্যে, কানের মধ্যে, জামার মধ্যে বালি ঢুকে অস্বস্তিকর একটা অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল। বাধ্য হয়ে মায়া’র ওড়না দিয়ে দুই জনই মাথা, চোখ ঢেকে হাঁটা শুরু করলাম। সামনে একটা রিক্সা পেতেই উঠে বসলাম। সাথে সাথেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রিক্সা ওয়ালা মামা রিক্সার হুড উঠাইয়া দিতে চাইলে মায়া হুড ওঠাতে মানা করলো। আমরা ভিঁজতে থাকলাম। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত শরীর থেকে বালি ধুঁয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। মায়া আমার কানে কানে বললো, ‘তুমি আমার ঠোঁটে একটা চুমু খাবে।’
- বালি খেতে পারবো না।
- বালি নেই তো। বৃষ্টিতে ধুঁয়ে গেছে সব।
মায়ার দিকে তাকালাম। গভীর দৃষ্টিতে তাকালাম। দুই জনের দৃষ্টিতেই নেশা নেশা ভাব। মায়া আমার শরীরের উপর এলিয়ে পড়লো। এটা বাংলাদেশ। তারপরেও এই দেশে অনেক কিছুই হয়। নির্জন রাস্তায় চাইলেই আমি মায়া’র ঠোঁটে চুমু খেতে পারতাম কিন্তু বিবেক বাঁধা দিল। আমি মায়া’কে পাঁজরের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। বাতাসে মায়া’র ভেঁজা চুল আমার মুখের উপর এসে পড়ছে। আহ! কি যে শান্তি তা একমাত্র আমিই বুঝতে পারছি। আমি আঙ্গুল দিয়ে মায়া’র ঠোঁট’টা ছুঁয়ে দিলাম। মায়া থর থর করে কেঁপে উঠলো। আরো একটু আমার দিকে সরে এসে বসলো।

বাসস্ট্যান্ডে এসে রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মেটালাম তারপর মায়া’র হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সবার অবাক করা দৃষ্টির সামনে দিয়ে আমরা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাঁটতেই থাকলাম। আমি মায়া’কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মায়া, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
- জানি না। যতক্ষন বৃষ্টি থাকবে ততক্ষন আমরা হাঁটবো।
- যদি বৃষ্টি না ছাড়ে?
- আমরাও থামবো না।
চুপচাপ আমি আর মায়া হাঁটছি। কেন যেন হঠাৎ করে কথা ফুরিয়ে গেল। একটু পরেই মায়া দাঁড়িয়ে পড়ে ধিরলয়ে বললো, ‘শোন।’
- বলো।
- তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো কোনদিন?
মায়া করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমার উত্তরের উপরেই অনেক কিছু নির্ভর করছে। আমি একটু হাসলাম আর হাতটা আগের চেয়ে একটু জোরে চেপে ধরলাম।
আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটার সাথে সাথেই আমার কেন জানি মনে হলো, মায়া কাঁদছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
কাঁদছে, কাঁদুক। এই কান্না সুখের কান্না। এই কান্না প্রিয় মানুষকে সারা জীবনের জন্য পাওয়ার আনন্দের কান্না। এমন বৃষ্টি ঘন মুহূর্তেই বুঝি এমন কান্নার সন্ধান মানুষ পায়।
মায়া কাঁদছে আর আমার মুখে তৃপ্তির হাসি লেগে আছে।
অঝোর ধারা বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমরা হাঁটছি। হঠাৎ করে শুনতে পেলাম মায়া গুন গুন করে গান গাচ্ছে। গানের কথা বুঝতে পারলাম না তবে সুরটা অনেক চেনা চেনা মনে হচ্ছে। রবীন্দ্র সঙ্গীতের মত। বৃষ্টির বেগ আরেকটু বাড়লো। আমার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসিটা যেন আরেকটু প্রসারিত হলো।
সম্ভবত আশে-পাশের মানুষদের দৃষ্টিতেও অবাক হওয়ার ভাবটাও একটু বেড়ে গেছে।

********* ******** *********
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৬৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩০/০৯/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast