www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মানসিক রোগের চিকিৎসায় সরকারের নজরদারি জরুরি

মানসিক রোগ মরণব্যাধি নয়, তবে খুব দীর্ঘস্থায়ী একটি জটিল রোগ। মনের রোগই হলো মানসিক রোগ। দেহে যেমন বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি মানুষের মনেও রোগ হয়ে থাকে, যা সরাসরি মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। দেহের রোগ দেখা যায়, বোঝা যায়। কিন্তু মনের রোগ দেখা যায় না, অনেক ক্ষেত্রে বোঝাও যায় না। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগ সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। এমনকি অধিকাংশ শিক্ষিত লোকেরও মানসিক রোগ সম্পর্কে ধারণা নেই।

এখন প্রশ্ন হলো, মানসিক রোগের চিকিৎসার দায়ভার কে বহন করবেÑ পরিবার, সমাজ, রোগী, নাকি রাষ্ট্র? প্রশ্নটি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অনেক জটিল।
মানসিক রোগের চিকিৎসার দায়ভার কার, এ প্রসঙ্গে প্রথমে আসি পরিবারের কাছে। সাধারণত আমাদের দেশের একজন মানুষের ভালো-মন্দ প্রাথমিকভাবে দেখভাল করে পরিবার। তাই নিশ্চয়ই মানসিক রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসার দায়ভার পরিবারের। কিন্তু আমাদের গ্রামীণ সমাজের পরিবার মানসিক রোগ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। গ্রামীণ পরিবারের কোনো সদস্য মানসিকভাবে অসুস্থ হলে পরিবার তাকে ভূতে ধরেছে বলে মনে করে বিভিন্ন ওঝা বা কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। ওঝা বা কবিরাজরা তাবিজ-কবজ, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি দিয়ে রোগীকে আরও অসুস্থ করে তোলে। ফলে রোগীর মানসিক রোগের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। তাহলে রোগী কি পরিবার থেকে সুচিকিৎসা পেল? আবার পরিবার যদি অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল থাকে, তাহলে রোগীর চিকিৎসার দায়ভার কে নেবে? আবার এমনটাও দেখা যায়, অনেকে পারিবারিক নির্যাতনের কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। যে পরিবারের নির্যাচনের কারণে মানসিক রোগী হয়, সেই পরিবারের কাছ থেকে কি আদৌ সুচিকিৎসা আশা করা যায়? নিশ্চয়ই আশা করা যায় না। তাহলে তার চিকিৎসার দায়ভার কে নেবে সমাজ, মানসিক রোগী নিজে, নাকি রাষ্ট্র?

এবার আসি সমাজ প্রসঙ্গে। মানসিক রোগের অন্যতম একটি কারণ হলো সমাজের মানুষের দ্বারা নিগৃহীত হওয়া। আবার একজন মানুষ অসুস্থ হলে সে লজ্জা ও ভয়ের কারণে সমাজের বাইরে থাকে। সমাজের অনেক লোকজন তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, মজা করে, উপহাস করে। প্রত্যেক ব্যক্তিরই সমাজে একটা আত্মসম্মান বোধ আছে, হোক সে দরিদ্র কিংবা রোগী, তাই সে তার আত্মসম্মান বোধের কারণে সমাজের কাছেও চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাইতে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। তাছাড়া সমাজের খুব কম সংখ্যক লোকেরই মানসিক রোগ সম্পর্কে ধারণা আছে। তাই সমাজের অধিকাংশ লোক মানসিক রোগীকে নেতিবাচক দৃষ্টি দেখে থাকে। সমাজের অনেক লোক মানসিক রোগীকে পাগল হিসেবে আখ্যায়িত করে, তার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে থাকে। যার কারণে রোগীর মানসিক চাপ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। যা সত্যিই ন্যক্কারজনক ঘটনা। তাহলে এ অচেতন সমাজ থেকে কি কখনও মানসিক রোগের সুচিকিৎসা আশা করা যায়? নিশ্চয়ই যায় না। তাহলে রোগীর চিকিৎসার ব্যয়ভার কে বহন করবে?
এবার আসি মানসিক রোগের চিকিৎসা গ্রহণ ও মানসিক রোগী নিজে কতটা সক্ষম সেই প্রশ্নে। মূলত একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে অসুস্থ হলে তার সর্বপ্রথম যে সমস্যা দেখা দেয়, সেটি হলো অর্থনৈতিক সমস্যা। কেননা রোগী যদি কোনো কর্মস্থলে থাকেন, তাহলে সেখানে তার দায়িত্বের অবহেলার কারণে তাকে ওই কর্মটি ত্যাগ করতে বা সাময়িক প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয় অথবা রোগী তার সমস্যার কারণে নিজ থেকেই কর্মটি ছেড়ে দেন। কেননা একজন মানসিক রোগীর পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কোনো কাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অবশ্য একথা বলে রাখা ভালো যে, আমাদের দেশে অনেক লোক আছেন, যারা বিভিন্ন স্তরে উচ্চপর্যায়ে চাকরি করেন; কিন্তু তারা মানসিক রোগী। আর তারা এটি লজ্জা ও চাকরি হারানোর ভয়ে প্রকাশ করেন না। আবার অনেকে জানেন না যে, তারা মানসিক রোগী। তাহলে একটু ভেবে দেখা যাক, একজন মানসিক রোগী কর্মকর্তার কাছ থেকে জনগণ কেমন সেবা পেতে পারে? এক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যার ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে।

মূলত সমাজ মানসিক রোগকে নেতিবাচক ও উপহাসের চোখেই বিবেচনা করে থাকে। তাছাড়া একজন মানসিক রোগী নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কেননা মানসিক রোগীর মনোজগতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাহলে রোগীর নিজ থেকে চিকিৎসা নেয়া অসম্ভবই বটে। এবার আসি সরকার বা রাষ্ট্র প্রসঙ্গে। মূলত ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব মতে, অধিক জনসংখ্যা দেশের বোঝা; কিন্তু জনসংখ্যাকে যদি সম্পদে রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে তা কখনও বোঝা হতে পারে না। কিন্তু একথা সত্য যে, একজন মানসিক রোগী পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের বোঝা। তাই এ বোঝাকে সুস্থ করে সম্পদে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব সরকারের তথা রাষ্ট্রের। কেননা একজন মানসিক রোগী যদি কোনো ধরনের অপরাধ করে থাকে, তাহলে তার বিচার করার অধিকার রাষ্ট্রের আছে। তাই রাষ্ট্র যদি বিচার করার অধিকার রাখে, তাহলে নিশ্চয়ই একজন মানসিক রোগীর চিকিৎসার জন্য সব দায়ভার রাষ্ট্রেরই নেয়া উচিত।
এ কাজটি সরকার বা রাষ্ট্র কীভাবে করতে পারে? প্রথমেই রাষ্ট্র যেটি করতে পারে, তা হলো মানসিক রোগ সম্পর্কে নানামুখী প্রচারণা চালানো। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে মানসিক রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত সংযোজন করা। সরকারিভাবে আমাদের দেশের উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে মানসিক রোগের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। যেটি দেশের জন্য চরম লজ্জার ও দুঃখজনক।

এমনকি বিভাগীয় পর্যায়েও মানসিক রোগের তেমন ভালোমানের কোনো সরকারি চিকিৎসা পাওয়া যায় না। তাই সরকারের উচিত, প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মানসিক রোগ বিভাগ খোলা এবং একজন করে হলেও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেয়া। আমাদের দেশে মানসিক রোগের দুইটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। তবে এ দুইটি বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসা পদ্ধতি কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ। পাবনায় অনেক মানসিক রোগীর সঙ্গে অসদাচরণ ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের ঘটনা পত্রপত্রিকা মারফতে জানা গেছে, যা বাংলাদেশ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কলঙ্কময় ও নিন্দনীয় একটি অধ্যায়। অথচ মানসিক রোগীর সঙ্গে অসদাচরণ করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। তাছাড়া এ দুইটি বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিবেশ একেবারেই নিম্নমানের। এহেন পরিবেশে অনেক মানসিক রোগীর রোগ আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাই থেকে যায়। যেটি রোগীর সুস্থতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায়। তাই মানসিক রোগের পরিবেশের দিকে সরকারের সুনজর দেয়া উচিত। কেননা সুন্দর পরিবেশই হতে পারে রোগীর সুস্থ হওয়ার অন্যতম হাতিয়ার বা মাধ্যম।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৫৫৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/০৮/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast