www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নীলিমার কান্না

১৪ ফেব্রুয়ারি আসলেই নীলিমার মুখে পৃথিবীর সব দুঃখ, অনুশোচনা, অনুতাপ এসে ভর করে। সারা মুখ শ্রাবণের কালো মেঘে ছেয়ে যায়। সে মেঘ বৃষ্টি হয়ে অনবরত ঝরতে শুরু করে। দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে নীলিমা। একটু পরপর কেউ না কেউ এসে দরজায় কড়া নেড়ে যায়। নীলিমা নীরবে কাঁদে। কারও ডাকে সাড়া দেয় না।
‘নিলি, ঐ নিলি, দরজা খোল। বাইরে আয়।’
একমাত্র বড় বোন নিশিতা। নীলিমাকে ‘নিলি’ বলেই ডাকেন তিনি। ছোট বোনের জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছু জানেন। নীলিমাকে বোঝেন। আর কেউ বুঝেনা নীলিমাকে। নিশিতা বুঝেন। বড় বোনটার প্রতি নীলিমার অগাধ শ্রদ্ধা, অসীম ভালোবাসা। মা-বাবা-ভাই যখন ‘ছি! ছি!’ ‘দূর দূর’ করে তাড়িয়ে দিয়েছে নীলিমাকে, বড় বোন নিশিতাই পাশে দাঁড়িয়েছে তখন। সেদিন সব হারিয়ে নীলিমা যখন বাসায় ফিরে রুমে একা একা লুকিয়ে কেঁদেছে, তার দুচোখ দেখে সব ধরে ফেলেছেন নিশিতা। জীবনের বড় ধাক্কাটা খাওয়ার পর নীলিমা গলগল করে সব বলে দিয়েছিলো তাঁকে। যখন সব জানতে পারলেন তখন তাঁর আর কিছু করবার ছিল না।
নীলিমা দরজা খুলে না। অঝোরে কাঁদে। কান্নাই তার জীবনের একমাত্র কাজ। ইহকালে পাপের শাস্তি। যে ভুল সে করেছে তা শুধু ভুল নয়, পাপ। এরজন্য আমৃত্যু কাঁদতে হবে তাকে।
‘লক্ষ্মী বোন আমার। দরজাটা খোল। খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে নে সোনা।’
নীলিমা ভালো করেই বুঝে, সে সোনা নয়, সে একটা কলঙ্কিত অকেজো মূল্যহীন পদদলিত মুদ্রা, মানুষের পায়ের আঘাতে গড়াগড়ি খেতে খেতে যার শেষ আশ্রয় রাস্তার পাশের নর্দমা। আজ সারাদিন না খেয়ে থাকবে সে। পানি পর্যন্ত মুখে দেবে না। বাইরে বের হবে না। কারও মুখোমুখি হবার মুখ নেই তার। বাইরে থেকে নিশিতা একের পর এক ডেকেই চলেছেন। নীলিমা সাড়াশব্দহীন। কিছুক্ষণ আগেও ওর কান্নার শব্ধ নিশিতার কান পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। এখন সে শব্দও বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে না আর। অন্য সব দিনেই নীলিমাকে নিয়ে নিশিতার টেনশন হয়। নিজের জীবনের প্রতি অনেক ঘৃণা ছিলো নীলিমার। বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলেছেন নিশিতা। এই দিনটা আসলেই নিশিতার টেনশন খুব বেড়ে যায়। সময় গড়াতে গড়াতে সে টেনশন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। নীলিমা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো। নিশিতার কারণেই সেটাও সম্ভব হয়নি। ডাক্তার হাসপাতাল করে বোনটাকে বাঁচিয়েছেন তিনি। তিন পাতা স্লিপিং পিল খেলে কেউ বাঁচে! নীলিমা বেঁচেছে। নিশিতাই বাঁচিয়েছেন তাকে। নীলিমা ছোটবেলা থেকেই বেশ সহজসরল। সেই সারল্যের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে। একেবারে করায়গণ্ডায়। সারল্য কারও দোষ হতে পারে না, নিশিতা বলেন। মা-বাবা-ভাইকে বুঝিয়েছেন অনেক, কাউকে ভালোবাসা, বিশ্বাস করা কোন দোষের কাজ হতে পারে না। নীলিমা রাফিদকে বিশ্বাস করেছিলো। শুধু বিশ্বাস বললে ভুল হবে, অন্ধবিশ্বাস ছিলো সেটা। এই দুর্বলতার কারণেই অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। নিশিতা পাশে না থাকলে নীলিমাকে আজ মাটিতে মিশে কঙ্কাল হয়ে কবরের ভিতর পড়ে থাকতে হতো। সেখানেও কম শাস্তি পেতে হতো না তাকে। সে যা করেছে তার জন্য বিধাতাও ক্ষমা করবে না।
নিশিতার দুচোখে পানি চলে এসেছে। চোখের সামনে আদরের ছোট বোনটা তুষের আগুণের মতো জ্বলবে, কষ্ট পাবে, বড় বোন হয়ে সেটা সহ্য করা যায় না। বুক ফেঁটে কান্না আসে। কান্নায় কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। তারপরেও দরজায় অনবরত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছেন।
‘ঐ নিলি, কী হলো রে? চুপ কেনো তুই? কোন সাড়া দিচ্ছিস না কেনো? দরজা খোল। খেয়ে নে। না হলে মা কিন্তু বকাবকি শুরু করবে।’
নিশিতার কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পান জোবায়দা বেগম। বোনকে নিয়ে নিশিতার এরকম আদিখ্যেতা একদম পছন্দ হচ্ছে না তাঁর। একটু এগিয়ে এসে নিশিতাকে বকাঝকা শুরু করেন তিনি।
‘ওকে নিয়ে এরকম করিস না তো। না খেলে নাই। ও বেঁচেইবা আছে কেনো? তুই ওকে আর লাই দিস না, নিশি। আমার কিন্তু একদম ভালো লাগে না।’
‘কী হলো? চিৎকার করছো কেনো? কী হয়েছে? এই নিশির মা। কী হয়েছে?’
প্যারালাইজড হয়ে তিনবছরের মত সময় বিছানায় পড়ে রয়েছেন নোমান সাহেব। স্ত্রীর চিৎকার শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। ডাক্তার বলেছে তাঁকে উত্তেজিত না হতে। প্রথমবার মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক পাঁচবছর আগে, তিন বছর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যখন নীলিমার দুর্ঘটনা জানতে পারলেন, উত্তেজনাকে সামলাতে পারলেন না। বুকের বামপাশে হাত চেপে ধরে হঠাৎ করে ড্রয়িংরুমে সোফার উপরে পড়ে গেলেন। পুরো ফ্ল্যাটে কান্নার রোল পড়ে গেলো। নোমান সাহেবের হার্ট অ্যাটাকের কারণে নীলিমার দুর্ঘটনার কথাটা পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে আড়াল করে রাখা গিয়েছিলো। নোমান সাহেবকে টানা একমাস হাসপাতালে রাখা হলো। হার্টের অবস্থার উন্নতি হলো বটে, শরীরের অবনতি ঠেকানো গেলো না। শরীরের নিচের অংশ একেবারে অবশ হয়ে গেলো। হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করার সামর্থ্য নেই তাঁর। অগত্যা বাসায় নিয়ে আসা হলো তাঁকে। দিন-রাত বিছানায় শুয়ে থাকেন তিনি। ছোট মেয়ের মুখ দেখেন না। বড় মেয়ে আর স্ত্রীই সেবাশুশ্রূষা করছে। একমাত্র ছেলে পড়াশুনা শেষ না করেই চাকুরীতে ঢুকে পড়েছে। নোমান সাহেবের অফিস থেকে গ্রাচুইটি হিসেবে যা আসে তা দিয়ে সংসার চলে না। আরমানকে বাধ্য হয়েই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। নিশিতার বিয়ের বয়স হয়েছে অনেক আগেই। তাঁকে বিয়ে দিতে পারছেন না। এসব ভেবে হঠাৎ হঠাৎ ডুকরে ডুকরে কাঁদেন তিনি। নীলিমার ব্যাপারটা আরও বেশী করে কাঁদায় তাঁকে। ছোট বেলা থেকেই নীলিমা বাকি দুই ভাইবোনের চেয়ে অনেক বেশী মেধাবী। প্রাথমিক ও জেএসসিতে মেধাবৃত্তি পেয়েছে। ক্লাশ নাইনের ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ক্লাশ টেনে উঠেছিলো। ক্লাশ টেনে উঠেই নীলিমার আচার-আচরণে পরিবর্তন এলো। কোচিং-এর নাম করে বাইরে যাওয়া, দেরী করে বাসায় ফেরা, মাকে সাথে নিয়ে বাইরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করা- অন্য সবার মত নোমান সাহেবের কাছেও ভালো ঠেকতো না। তিনি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় আর নিশিতা-আরমান ভার্সিটিতে থাকার কারণে জোবায়দা বেগমকেই বেশী সহ্য করতে হয়েছে নীলিমার অদ্ভুত সব আচরণ।
নোমান সাহেব চিৎকার শুরু করলে থামেন না। আজ একেবারে থামছেনই না। নিশিতা খাবারের প্লেটটা টেবিলে রেখে বাবার কাছে ছুটে গেলেন।
‘বাবা, চিৎকার করছো কেনো? ডাক্তার তো তোমাকে উত্তেজিত হতে মানা করেছে।’
‘সন্তান কুসন্তান হয়ে গেলে কোন বাবা উত্তেজিত না হয়ে পারে?’
‘বাবা, কিছু হয় নি তো। তুমি থামো। ঔষধ খেয়েছো?’
‘না।’
‘ওমা! না কেনো? ঔষধ না খেলে চলবে, বাবা?’
‘কী হবে ঔষধ খেয়ে? আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাস কেনো? আমি বাঁচতে চাইনা রে, নিশি।’
‘বাবা, প্লিজ, তুমি আর কথা বলো না, প্লিজ।’
নিশিতাকে খুব ভালোবাসেন নোমান সাহেব। মেয়ে তো নয়, যেন মা। অসুস্থ্য হবার পর থেকে মেয়ে না, যেন মায়ের মতোই যত্ন আত্তি করেছে। নিশিতার মুখের দিকে চেয়ে চুপ করলেন নোমান সাহেব। জোবায়দা বেগম স্বল্পভাষী। একেবারে বাধ্য না হলে চিৎকার চেঁচামেচি করেন না। নিশিতার উপর খুব নির্ভর করেন। নিশিতা না হলে অসুস্থ্য স্বামীকে সামলাতে পারতেন কি করে, মাঝে মাঝে ভাবেন।
নীলিমা দরজা খোলেনি। এখনও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে অশ্রু শুকিয়ে গেছে প্রায়। অথচ রাফিদ বারবার বলতো নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও নীলিমাকে সুখে রাখবে সে। নীলিমাকে জীবনে চোখের জল ফেলতে দেবে না। মিথ্যে, সব মিথ্যে। নীলিমা যখন ক্লাশ নাইনের শেষ দিকে, রাফিদ প্রপোজ করে বসলো। ছেলেটা সুদর্শন, স্মার্ট। প্রথম কয়েকদিন নীলিমা রাফিদকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। রাফিদ হাল ছাড়ার পাত্র ছিলো না। এমন ভাব দেখিয়েছে যে নীলিমা ভাবতে বাধ্য হয়েছে এই ছেলেটাই তার কাছে পৃথিবীর সবথেকে ভালো ছেলে। ক্লাশ নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতেই নীলিমা আবার প্রপোজাল পেলো রাফিদের কাছ থেকে। নীলিমার কাছে ফোন ছিলো না। ক্লাশ টেনে ওঠার পর মা-বোনকে বুঝিয়ে একটা ফোন ম্যানেজ করে। কয়েকদিন ফোনে কথা বলার পর রাফিদের প্রেমে পড়ে গেলো সে। তারপর থেকেই নীলিমার আচরণের পরিবর্তন। মাকে ছাড়া যে মেয়েটা স্কুল, কোচিং-এ যেতো না, সেই মেয়েই একা একা স্কুল, কোচিং-এ যাবার বাহানা করতো। ক্লাশ বাঙ্ক করে রাফিদের সাথে দেখা করতো, ঘুরতো। সবাই খুব বিশ্বাস করতো বলেই একটু অজুহাতেই কাজ হয়ে যেতো। রাফিদের অমায়িক ব্যবহার নীলিমাকে খুব সহজেই বশ করে ফেললো কিছুদিনের মধ্যেই। নীলিমার বিশ্বাস ছিলো এরকম একটা হীরের টুকরো ছেলেকে তার পরিবার মেনে নেবে। সময় হলে সবাইকে সব বলে দেবে সে। রাফিদের সাথে করা প্রত্যেকটি সাক্ষাৎ সম্পর্কে দু-চারটি লাইন ব্যক্তিগত ডায়ারিতে লিখে রেখেছিলো নীলিমা।
ক্লাশ টেনের ক্লাশ শুরু হয়ে গেলো। জানুয়ারির ১৫ তারিখ। দিনটাতে একটু বেশী কুয়াশা পরছিলো। সেদিন স্কুল শেষে নীলিমার কোচিং ছিলো। মাকে আসতে মানা করে দিয়েছিলো আগেই। এক বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টি হবে কেএফসিতে। সেখানে অন্যদের সাথে যোগ দেবে সে। সেই বান্ধবীর মাকে দিয়ে নিজের মাকে আগেই ফোন দিয়ে জানিয়েছে ব্যাপারটা। পার্টি শেষ হলেই বান্ধবীর গাড়িতে করে মেয়ে বাসায় ফিরবে, এরকম নিশ্চয়তায় জোবায়দা বেগম নীলিমাকে সেদিনের জন্য একটু ছাড় দিলেন। নীলিমা কোচিং-এ গেলো না। বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতেও যোগ দিলো না। রাফিদের সাথে আগেই সব ঠিক করা ছিলো। নীলিমাকে নিয়ে রাফিদ ধানমন্ডি ৩২ এ চলে গেলো। সেখান থেকে ধানমন্ডি ৮ নম্বর সেতুর কাছে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ধানমন্ডি লেকের পাশে বসে পড়ে দুজন মিলে। রাফিদের গায়ে ছিলো একটা মোটা শাল। নীলিমার গায়ে পুলওভার ছিলো। শীতটা বেশীই পরছিলো সেদিন। সন্ধ্যা নামো নামো অবস্থা। নীলিমাকে একটু ঘনিষ্ঠ করে শালটা দিয়ে কাছে টেনে নিলো রাফিদ। নীলিমা বাঁধা দিলো না। রাফিদ তাকে খুব কেয়ার করে, এটা তার জানা ছিলো। রাফিদের কাঁধে মাথাটা রেখে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকলো নীলিমা। হঠাৎ করে নীলিমার মাথায় বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। নিজের শরীরের উপরের অংশে একটা হাত অনুভব করলো সে। বিদ্যুৎ গতিতে শালটা সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নীলিমা।
‘রাফিদ! ছি! তুমি এরকম!’
রাফিদ কিছু বলার আগেই নীলিমা সেখান থেকে চলে যায়। রিক্সায় করে সোজা বাসায় যায় সে। বাসায় কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। জোবায়দা বেগম পার্টি সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করলেও তার কোনটারই উত্তর দেয় না নীলিমা। ‘আমি খুব টায়ার্ড, আম্মু’ বলে নিজের রুমে চলে যায় নীলিমা। পরপর তিনদিন রাফিদের সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি সে। ফোন সুইচড অফ করে রেখেছিলো। নীলিমার বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে নীলিমার সাথে যোগাযোগ করে রাফিদ। চতুর্থ দিনে নীলিমা ফোন অন করলে রাফিদের সাথে তার কথা হয়। রাফিদ অনেক কান্নাকাটি করে। ক্ষমা চায় নীলিমার কাছে। নীলিমা রাফিদকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসতো। রাফিদকে ক্ষমা না করে পারলো না সে। পরের কিছুদিন যে কয়বার রাফিদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, রাফিদকে ঠিক ফেরেশতার মতো মনে হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ। ভ্যালেন্টাইন’স ডে। জোবায়দা বেগম মেয়ের সাথে স্কুলে এসেছেন। স্কুল ছুটি হলেই তিনি মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে যান, আর কোচিং থাকলে সেখানেও মেয়ের সাথে যান তিনি। নীলিমা সুযোগ খুজছিলো রাফিদের সাথে দেখা করার। মা সাথে থাকায় সে সুযোগ মিলছিলো না। নীলিমাকে রসায়ন শিক্ষকের বাসায় দিয়ে স্বামীর জন্য কিছু ঔষধ কিনতে চলে যান জোবায়দা বেগম। ‘এই সুযোগ!’ ভাবলো নীলিমা। শিক্ষককে কী একটা বলে বাইরে চলে আসে সে। বাইরে আসবার সময় বান্ধবী লোপাকে কানে কানে বলে আসে, ‘মাকে বলিস রুবাবা অসুস্থ্য হয়ে পড়লে তাকে সাথে করে বাসায় পৌঁছে দিতে গেছি আমি। সেখান থেকে বাসায় ফিরবো। মাকে বাসায় যেতে বলিস। মা যেন আমার জন্য চিন্তা না করে।’
আধঘণ্টার মতো সময় পর জোবায়দা বেগম রসায়ন শিক্ষকের বাসায় চলে গিয়ে অন্য কয়েকজন অভিভাবকের সাথে গল্প করেন। তাদের মধ্যেই একজন জোবায়দা বেগমকে বলে দেন যে নীলিমা বাইরে গেছে। জোবায়দা বেগম শিক্ষকের সাথে কথা বলেন। লোপা তখন সেইখানে ছিলো। সে জোবায়দা বেগমকে নীলিমার শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো বলে দিলো। মেয়ে স্কুলে ফোন নিয়ে আসে না, জোবায়দা বেগম এটা জানেন। মেয়েকে বিশ্বাস করেন অনেক। মেয়ে নিশ্চয়ই সত্যি কথাই বলেছে। তারপরেও কিছুটা টেনশন হচ্ছিলো তাঁর। টেনশন নিয়েই বাসায় ফিরলেন। একা ফিরেছেন বলে বাসায় সবাই জিজ্ঞেস করলো নীলিমা কোথায়। তিনি যা জেনেছিলেন সেটাই বলে দেন সবাইকে। এর মধ্যে নীলিমা ফোন করে বাসায়। জানিয়ে দেয়, কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাসায় ফিরছে।
ধানমন্ডি লেকের পাশে জাহাজবাড়ির কাছে অপেক্ষা করছিলো রাফিদ। নীলিমা সরাসরি সেখানে চলে যায়। কিছুক্ষণ কথা বলার পর রাফিদের ফোন বেজে ওঠে। সংবাদ আসে, তার এক বন্ধু অসুস্থ্য। নীলিমা রাফিদের সেই বন্ধুকে চেনে। রাফিদের অনুরোধে নীলিমা তাকে দেখতে যায়। মোহাম্মদপুর শেখেরটেকে রাফিদের অসুস্থ্য বন্ধু আহনাফের বাসা। রিক্সায় করে সরাসরি সেখানে চলে যায় দুজন মিলে। আগে থেকেই সব ঠিক করা ছিলো হয়তো। বাসার সিকিউরিটি গার্ডও তাদের আহনাফদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিলো অনায়াসে। কলিং বেল চাপতেই আহনাফ নিজেই দরজা খুলে দিলো। নীলিমা চমকে গেলো খুব। রাফিদের চোখের দিকে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীলিমা।
‘কি রে, অসুস্থ্য শরীর নিয়ে তুই দরজা খুলতে এসেছিস!’ অভিনয় করে কথাটা বললো রাফিদ। নীলিমা রাফিদের অভিনয় ধরতেই পারলো না।
‘আরে দোস্ত, আব্বু-আম্মু একটা জরুরি কারণে বাইরে চলে গেলো। মনে করলাম, ফোন করে তোদের আসতে মানা করি। তোরা হয়তো অর্ধেক রাস্তা এসে পড়েছিস, এই ভেবে ফোন করলাম না।’
‘ঠিকই করেছিস। তুই অসুস্থ্য। আমরা খবর পেয়েও দেখতে আসবো না? তোর আব্বু-আম্মু নেই তো কী হয়েছে? কী বলো, নীলিমা? ওকে না দেখে চলে যাবো?’
‘নাহ, চলে যাবো কেনো? আপনি এখন কেমন আছেন আহনাফ ভাইয়া?’ আহনাফের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নীলিমা।
‘বাইরে থাকবে? ভিতরে আসবে না?’
‘তাইতো! অসুস্থ্য মানুষের সাথে এভাবে কথা বলা ঠিক না, নীলিমা। চলো, ভিতরে চলো।’
রাফিদের সাথে ভিতরে যায় নীলিমা। আহনাফ ওর শোবার রুমে চলে যায়। বিছানায় শুয়ে পড়ে। সেখানেই আসতে বলে রাফিদ আর নীলিমাকে। একটু ইতঃস্তত বোধ করলেও রাফিদের অনুরোধে আহনাফের রুমে যায় নীলিমা। সেখানে কিছুক্ষণ কথা হয় আহনাফের সাথে। আহনাফও পাকা অভিনেতা। নীলিমা সত্যিই ভাবলো যে আহনাফ অসুস্থ্য। বাসায় আর কেউ ছিলো না। আহনাফ বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলো। রাফিদ-নিলিমাকে কিছু খেতে দিতে চাইলো সে। আহনাফকে বাঁধা দেয় রাফিদ।
‘কিছু খেতে হবে না। আমরা তোকে দেখতে এসেছি। পরে একদিন এসে খাবো।’
‘কী যে বলিস! নীলিমা এসেছে। ও কিছু না খেয়ে যাবে, সেটা কেমন দেখায়?’
‘ঠিক আছে, ভাইয়া। আমরা আবার আসবো। আপনি তাড়াতাড়ি সেরে উঠেন,’ নীলিমা বলে।
আহনাফ কারও কথাই শুনতে চাইলো না। সে কিছু একটা তৈরি করে খাওয়াবেই। এরকম দেখে আহনাফকে থামিয়ে নিজেই রান্না ঘরে চলে গেলো রাফিদ। জুস বানিয়ে নিয়ে এলো সে।
আহনাফ খেতে না চাইলে রাফিদ নীলিমার হাতে জুসের একটা গ্লাস ধরিয়ে দিলো। নীলিমাও খেতে চাইলো না। আহনাফের অনুরোধে জুসের গ্লাসে চুমুম দেয় সে। রাফিদ অন্য একটা গ্লাসের জুস খেয়ে ফেলে।
আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিলো। জুসটা শেষ না করেই গ্লাসটা রেখে দিলো নীলিমা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মাথাটা ভারী হয়ে আসে। রাফিদের বুকে মাথা ঢলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে নীলিমা। ঘুম যখন ভেঙ্গে গেলো তখন সব শেষ। চোখ খুলে দেখে আহনাফের রুমেই আহনাফের বিছানায় শুয়ে আছে সে। আহনাফ নেই। সামনে রাফিদ বসে আছে। নির্বাক হয়ে গেছে নীলিমা। শরীরের বিশেষ স্থানে হাত দিয়ে তরলজাতীয় কিছু অনুভব করে সে। হাত বের করে দেখে আঙ্গুলে রক্ত লেগে গেছে। মুহূর্তেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছে। দুহাতে মুখ ঢেকে কান্না শুরু করে নীলিমা।
‘যা হবার হয়ে গেছে। এ নিয়ে কোনো কথা বলবে না। চলো, বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি,’ নীলিমার মুখ থেকে হাত টেনে ধরে কথাটা বলে রাফিদ। লজ্জায়-ঘৃনায় রাফিদের দিকে তাকালো না নীলিমা। বিছানা থেকে নেমে পড়ে সে। পোশাকটা ঠিক করে স্কুল ব্যাগটা নিয়ে বাইরে আসতে শুরু করলে রাফিদ পিছন থেকে টেনে ধরে।
‘ডোন্ট টাচ মি। ইউ চিটার। তুমি মানুষ! তুমি একটা পশু। ছাড়ো আমাকে,’ চিৎকার করে ওঠে নীলিমা।
আহনাফকে দেখতে পেলো না নীলিমা। সব আগে থেকেই পরিকল্পিত, বুঝতে পারলো সে। কাঁদতে কাঁদতে বাইরে বেড়িয়ে আসে সে। রাফিদ পিছনে পিছনে হাঁটা শুরু করে। নীলিমার পায়ের গতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বাসার বাইরে এসে রিক্সা নেয় সে। হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত আটটার মতো বেজে গেছে। মুখে রুমাল চেপে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় পৌঁছায় নীলিমা। রিক্সা থেকে নেমে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। দরজা বন্ধ করে নিঃশব্দে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে নীলিমা। দরজায় অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও নীলিমার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বাসার অন্যরা ভয় পেয়ে যায়। কী হলো নীলিমার? একে অপরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
‘দরজা ভেঙ্গে ফেল, আরমান,’ ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন নোমান সাহেব।
দরজা ভেঙ্গে দেখা যায় নীলিমা ঘুমন্ত অবস্থায় চিৎপটাং হয়ে বিছানার উপর পড়ে আছে। নিশিতা নীলিমার মুখে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করেন। নীলিমা কোনো সাড়াই দিচ্ছে না। বিছানার উপর ছড়িয়ে থাকা স্লিপিং পিলের খালি পাতাগুলোর দিকে নজর যায় নিশিতার। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় নীলিমাকে। নিশিতার বুকে মাথা গুঁজে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে সে। বোনের কাছ থেকে নিজের সর্বস্ব হারানোর কথা লুকাতে পারেনি সে। নিশিতার কাছ থেকে পরিবারের অন্যরা সবকিছু জানতে পারেন। রাফিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলেন নোমান সাহেব। নীলিমা মামলা করতে দেয়নি। অন্যরাও নীলিমার কথায় রাজী হলেন। রাফিদকে ভুলে গেছে নীলিমা। খুব ঘৃণা করে সে রাফিদকে। রাফিদও আর যোগাযোগ করেনি। তারপর তিনবছর চলে গেছে। আগের মতো কেউ কাছে আসে না নীলিমার। কারও কাছে যাবার মতো মুখ নেই তার। যতোদিন বেঁচে থাকবে, কেঁদেই বাঁচবে সে।
আজও ১৪ ফেব্রুয়ারি। অন্ধবিশ্বাসের প্রেমে কাঁদতে হয়। কাঁদছে নীলিমা। বালিশে মুখ গুঁজিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।

(অভ্রতে টাইপিং-এর কারণে অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুল বানানের জন্য আমি দুঃখিত।)
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৫৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১১/০২/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast