www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

যাদুর থলে

আঠারো বছরের ছেলে রতন। গরীব পিতামাতার একমাত্র ‘রত্ন’ বলতে এই রতনই। টানাটানির সংসার সামলিয়ে রতনকে টেনেটুনে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানোর পর হাল ছেড়ে দেয় রতনের বাবা। রতনও দেখলো কলেজে যেতে চাইলে ওর সামর্থ্যহীন বাবার চিন্তা শুধু বাড়বেই না, দেহ থেকে শ্বাসটুকুই শেষবারের মতো বেরিয়ে যাবে হয়তো। রতনের চিন্তা তার ভবিষ্যৎ লেখাপড়া নয়। সে চিন্তা করতে শুরু করলো কিভাবে পরিবাবের হাল ধরা যায়। সংসার থেকে দারিদ্র্য দূর করা যায়। সুযোগও আসলো। সেনাবাহিনীতে যোগ দিলো সে। সাধারণ সৈনিক। বেতন তেমন নয়, তবে গরীব পিতামাতার চিন্তা কমানোর জন্য সেটাইবা কম কিসে?

এক বছর ট্রেনিং শেষে রতনকে আরও কিছু সৈন্যসহ অনেকদূরে সীমান্তরক্ষার দায়িত্ব দেয়া হলো। রতন প্রথমে বৃদ্ধ পিতা-মাতার কথা চিন্তা করে সৈনিকের চাকুরি ছেড়ে দিতে চাইলো। ওর বাবা রাজি হলো না। বৃদ্ধ পিতা ছেলেকে বোঝালো, দেশের সীমান্ত রক্ষার কাজ শুধু একটা চাকুরি বা কাজ নয়, একটি নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্ব। রতন ওর বাবার কথা ফেলতে পারলো না। বৃদ্ধ পিতামাতা চোখের জলে ছেলেকে বিদায় জানালো।

দেখতে দেখতে কয়েক বছর চলে গেলো। সৈনিকের কাজ করে অনেক দূরে থাকা বৃদ্ধ পিতামাতার সঙ্গে দেখা করা হয়ে উঠে না রতনের। ছুটিও পাওয়া যায় না। এদিকে মা-বাবার জন্য তার মন আনচান করতে করতে একটা অসহ্য মাত্রায় এসে দাঁড়িয়েছে। রতন সিদ্ধান্ত নিলো। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিলো সে। বয়সে এখনও যুবক, পেশীতে শক্তিও আছে অনেক। পিতামাতার জীবনের শেষ দিনগুলোতে পাশে থেকে তাদের সেবা করে সন্তানের যথার্থ দায়িত্ব পালন করবে সে। সব কিছু গুছিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করলো রতন।

পথ অনেক দূর। পাহাড়, উপত্যকার পথে গাড়ি-ঘোড়াও চলে না। পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পার করছে রতন। সৈনিকদের দীর্ঘ পথ হাঁটার প্রশিক্ষণ থাকে। রতনের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। অনেকদিন পর পিতামাতাকে দেখতে পাবে সেই খুশিতে কষ্টকে আর কষ্ট মনে হচ্ছে না। বাড়ি পৌঁছাতে কয়েকদিন লেগে যাবে। দিন শেষে কোনো একটা সরাইখানায় রাত কাটিয়ে সাতসকালে আবার হাঁটা শুরু। সাথে রাখা খাবার আর পানির পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে।

একদিন রতন তার কাছে থাকা শেষ রুটিটা খেতে যাচ্ছে আর সেই মুহূর্তে একজন ভিক্ষুক তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
‘আমি দুদিন ধরে কিছু খাইনি, বাবা। হাঁটতেও পারছিনে। আমাকে কিছু খাবার দেবে, বাবা। আমার জীবনটা বাঁচাও, বাবা।’
রতনের করুণা হলো ভিক্ষুকের উপর। মুখের কাছে নেয়া রুটিটা ভিক্ষুকের হাতে দিয়ে দিলো। পানির বোতল থেকে পানি খেতে দিলো।
ভিক্ষুক রুটি আর পানি খেয়ে চলে গেলো। যাবার সময় রতনকে আশীর্বাদ করলো, ‘আল্লাহ্‌ তোমার মঙ্গল করবে, বাবা। তুমি অনেক সুখে থাকবে, বাবা।’

ঐদিন রতনকে রাত কাটাতে হয় একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে। কেউ থাকে না সেই বাড়িতে। বাড়ির লোক জন বাড়িটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সন্ধ্যা নামলেই বিভিন্ন প্রেতাত্মা, ভুত, পেত্নী বাড়িটিতে এসে ঢুকতো। বাড়ির বাসিন্দাদেরকে নানাভাবে বিরক্ত করতো। হত্যা করার ভয় দেখাতো। শেষে বাধ্য হয়েই বাড়ির বাসিন্দারা অন্যত্র চলে গেছে। ফাঁকা বাড়িটি আসতে আসতে আরও ভুত, পেত্নীতে ভরে গেলো। এখন রাত হলেই ওই বাড়িতে ভুত-পেত্নির আসর বসে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ভুত-পেত্নির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। নাচ-গান আর মদ্যপান চলতে থাকে। থাকার মতো আর কোনো জায়গাও মিললো না রতন বাধ্য হয়েই সেই বাড়িতেই উঠে। ক্লান্ত শরীর। খাবারও পড়েনি মুখে। শুধু কয়েক ঢোক পানি গিলে কি আর ক্ষুধা থামানো যায়? তাড়াতাড়ি ঘুমালে ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলে থাকা যাবে। রতন একটা ঘরের কোণায় চাঁদর বিছিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিলো। আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে এলো। রতনের দুচোখ মুদে আসছে। হথাৎ করে কিছু আওয়াজ কানে আসতে থাকলো। রতন প্রথমে ঘুমের ঘোরে খুব একটা খেয়াল করলো না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একদল প্রেতাত্মা এসে তাকে চারদিক হতে ঘুরে ফেললো। প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে চিৎকার করতে থাকলো। রতন উঠে বসে পড়লো। দুচোখ কচলাতে কচলাতে মাথা উঁচু করে সামনে-ডানে-বামে-পিছনে তাকালো। সৈনিকেরা সহজে ভয় পায় না। রতনও ভয় পেলো না।
‘এই তুমি এখানে কী করছো? এটা আমাদের রাজ্য। এখানে মানুষের কোনো জায়গা নেই। তুমি তৈরি হও, হে যুবক। আমরা তোমাকে হত্যা করবো। আজ তুমিই হবে আমাদের আনন্দের উৎস। হাহাহাহাহাহা...............’
রতন কোনো সাড়া দিলো না। ওর চারদিকে প্রেতাত্মাগুলো বিভিন্ন রূপ নিয়ে নাচতে নাচতে চক্রাকারে ঘুরছে। রতন চিন্তা করতে থাকলো, কী করা যায়। চারপাশ থেকে গগণ বিদারী আওয়াজ আসছে, ‘তৈরি হও, হে যুবক। আমরা তোমাকে খুন করে ফেলবো।’
কিছুক্ষণ ভেবে রতন বললো, ‘ঠিক আছে, তোমরা আমাকে হত্যা করতে পারো।’
‘হাহাহাহাহা। তাই নাকি, যুবক?’ আফ্রিকান আদিবাসীদের সাজে যে প্রেতাত্মাগুলো নাচছে তাদের মধ্য থেকে একজন বললো।
‘জী। কিন্তু..................।’
‘কিন্তু! কিন্তু কী?’ এক মহিলা প্রেতাত্মা আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলো।
‘তোমরা আমাকে হত্যা করতে চাচ্ছো। হত্যা করো। আমি তোমাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাচ্ছি। কিন্তু আমার একটা ছোট আশা আছে।’
‘ছোট আশা! ঠিক আছে, বলো। আমরা কাউকে হত্যা করলে তার শেষ আশা থাকলে সেটা পুরণ করি। তোমারটাও করবো। হে যুবক, তুমি বলো, তোমার শেষ আশাটা কী?’ প্রেতাত্মাদের সর্দার জিজ্ঞেস করলো।

রতন ভাবলো, এটাই সুযোগ। কিছু একটা করতে হবে যাতে এদেরকেও শেষ করা যায়, নিজের জীবনটাও বাঁচে। এদের হাত থেকে আমার মতো অন্য কারো জীবন বাঁচাতে হলে এদেরকেই মেরে ফেলতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
কিছুক্ষণ ভাবলো সে। এবার চালাকি করে বললো, ‘আমি শুনেছি, তোমরা নাকি অনেক বড় হতে পারো?’
‘হ্যাঁ, পারি।’
‘আবার নাকি অনেক ছোটও হতে পারো?’
‘হ্যাঁ, পারি। কিন্তু তাতে হয়েছেটা কী? তুমি আমাদের সময় নষ্ট করতেছো, যুবক। তোমার শেষ আশাটা কী, সেটা বলো তাড়াতাড়ি।’ খুব কালো মতো একজন বললো।
রতন আর দেরি করলো না। আসল কথাটা বলে ফেললো।
‘তোমরা এখন বড় আছো। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তোমরা কতো ছোট হতে পারো সেটা আমি দেখিনি। আমার শেষ আশা, তোমরা কতো ছোট হতে পারো সেটাই দেখবো।’
‘হাহাহাহা, বলে কী, যুবক! এটাই নাকি ওর শেষ আশা। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। তুমি কঠিন কিছু করতে বলো।’ সর্দার বললো।
‘না না। ধন্যবাদ। আমার কিছু চাই না। আমি তোমাদের আচরণে মুগ্ধ। তোমরা শুধু আমার এই আশাটা পূর্ণ করো।’
‘ঠিক আছে। তুমি বলো, তুমি আমাদেরকে কতোটুকু ছোট দেখতে চাও?’
‘তোমরা কি এমনটা ছোট হতে পারবে যে সবাই মিলে একটা থলের ভিতর ঢুকতে পারবে। আর সেই থলের ভিতর নাচতে গাইতে পারবে। পারবে এতোটা ছোট হতে?’
‘এটা খুবই সাধারণ একটা কাজ। অবশ্যই পারবো। বলো, তুমি কখন দেখতে চাও?’
‘এখনি। এখনি দেখতে চাই, জনাব।’
‘কিন্তু আমাদের কাছে কোনো থলে নেই এখন,’ এক মহিলা প্রেতাত্মা বললো।
‘আমার কাছে আছে। বের করবো?’
‘হ্যাঁ, বের করো,’ সর্দার বললো।
রতন তাড়াতাড়ি করে তার সাথে থাকা একটা থলে বের করে। ওটার মুখটা খুলে ধরে।
‘তোমরা এখন সবাই খুব ছোট হয়ে একসাথে এই থলের ভিতর ঢুকতে পারবে?’
‘আবার জিগায়! পারবো মানে! এখনি পারবো।’
‘তাহলে ঢুকোতো দেখি।’
‘ইকির বিকির ভুতের ছা, সব্বাই ছোটা হয়ে যা’ এই স্লোগান দিতে দিতে প্রেতাত্মারা সবাই মিলে মাছির মতো ছোট হয়ে থলের ভিতর ঢুকলো।
রতনও থলের মুখটা ভালো করে খুলে ধরে যাতে সব প্রেতাত্মাই ঠিকমতো ঢুকতে পারে। যেই মুহূর্তে সবাই ঢুকে পড়ে সেই মুহূর্তে রতনও থলের মুখতা বন্ধ করে ফেলে।
‘এই যুবক, এই যুবক, দেখলে তো আমরা কতো ছোট হতে পারি? দেখলে তো, সবাই একসাথে থলের ভিতর ঢুকে পড়েছি? এই যুবক, দেখলে তো?’
থলের ভিতর থেকে ভুতের সর্দার একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। রতন আর দেরি না করে ওর সাথে রাখা একটা শক্ত দড়ি বের করলো। সেটা দিয়ে থলের খোলা মুখটা খুব শক্ত করে বেঁধে দিলো। ভিতর থেকে অনবরত সমস্বরে চিৎকার চলছে, ‘এই যুবক, কী হলো? কথা বলছো না কেনো? আমরা অনেক ছোট হতে পারি, অনেক ছোট। তুমি দেখলে তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখলাম তো,’ রতন সাড়া দিলো।
‘তাহলে কি এবার আমরা বের হবো?’
‘না, না। আর একটু থাকো।’
‘আর একটু! কিন্তু কেনো? এখানে অনেক গরম লাগছে। আমরা বের হয়ে আসি?’
‘না। এখনি না। চুপ করে বসে থাকো ওখানে।’
রতন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো। এই শয়তানগুলো অনেক মানুষকে জ্বালিয়েছে। কতো মানুষকে যে হত্যা করেছে, কে জানে? এবার এদেরকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে যাতে এরা আর কখনও মানুষকে বিরক্ত বা হত্যা করার সাহস না দেখায়। থলের ভিতরে যেভাবে চিৎকার হচ্ছে তা রতনের কানে যেনো একটা করে ককটেল ফোঁটাচ্ছে। রতন আর সহ্য করতে পারছে না। কিছু একটা করা দরকার। এখনই করা দরকার। কিছুক্ষণ ভেবে রতন একটা পথ বের করলো। সে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো। তখনও সন্ধ্যার মতোই আছে। রাত হয়নি তেমন। রতন কাঁধের উপর থলেটা নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। থলের মুখটা খুব সাবধানে ধরে রেখেছে সে। দড়ির বাঁধনটা যেখানে থলের সেই স্থানটা দুহাত দিয়ে চেপে ধরে রতন হাঁটছে। কোনো জনমানুষের দেখা মিলছে না। রতনের চিন্তা বেরে যাচ্চে। এতোগুলো প্রেতাত্মাকে এভাবে থলের মধ্যে নিয়ে কতোক্ষণইবা সামলাতে পারবে সে? বেশ খানিকটা পথ হেঁটে রতনের ভয় দূর হয়ে গেলো। বাজারের মতো একটা জায়গা দেখা যাচ্ছে। প্রদীপের আলো জ্বলছে। রতন দ্রুত হেঁটে সেখানে গেলো। সত্যিই সেটা একটা ছোটখাটো বাজার। রতন একজনকে জিজ্ঞেস করলো সেখানে কোনো কামারের দোকান আছে কিনা। লোকটা হাত ইশারা করে দেখিয়ে দিলো। রতন কামারের দোকানে গিয়ে কামারের সামনে থলেটা রাখলো। থলের ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে। কৌতূহলী লোকজন কামারের দোকানের চারপাশে ভীর করে দাঁড়ালো।
‘এই যে ভাই, এই থলের ভিতর কি? থলের ভিতর থেকে এরকম আওয়াজ আসছে কেনো?? উপস্থিত লোকজনদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলো।
‘বলছি, ভাই, সব বলছি,’ রতন সবাইকে শান্ত করলো। এরপর সে কামারের কাছে গিয়ে বসলো। কামারকে সব খুলে বললো।
সবাই একসাথে বলা শুরু করলো, ‘ওহ, তাহলে এইগুলাই হচ্ছে সেই ভুত পেত্নী! এদের কারণে জমির ওর বাড়ি ছেড়েছে।’
কেউ কেউ বললো, ‘এদের শাস্তি পাওয়া উচিত। খুব শাস্তি পাওয়া উচিত।’
‘আমি তো এদের শাস্তি দেবার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছি,’ রতন বললো।
রতনের কথা শুনে থলের ভিতরে ভুত-পেত্নীগুলো কান্না শুরু করলো।
‘হে যুবক, তুমি আমাদের শাস্তি দেবে মানে! আমরা তোমার শেষ আশা পূর্ণ করলাম। আর তুমি আমাদের শাস্তি দেবে?’ ভুতের সর্দার বললো।
রতন তাদের কথায় কান দিলো না। সে কামারকে বললো খুব দ্রত কিছু একটা করার জন্য। কামার থলেটা নিলো। দোকানের মেঝের মাঝামাঝি রাখলো। থলের ভিতর থেকে আগের চেয়ে বেশী জোরে ভীত প্রেতাত্মাদের চিৎকার আসছে। আর বাইরে উপস্থিত লোকজন চিৎকার করছে। রতন লোকদেরকে শান্ত হতে বললো। এবার কামার তার দোকানের সবচেয়ে বড় হাতুড়িটা হাতে নিলো। উপস্থিত লোকজন আবার একসাথে চিৎকার করতে শুরু করলো, ‘মারো, মারো, মারো।’ আর থলের ভিতর থেকে সমস্বরে অনুরোধ আসছে, ‘মেরো না, আমাদেরকে ছেড়ে দাও। মেরো না আমাদের।’ কামারও তাদের অনুরোধে কর্ণপাত করলো না। সে তার শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে থলের উপর একের পর এক হাতুড়ি পেটাতে থাকলো। উপস্থিত লোকেরা আনন্দে চিৎকার করতে থাকলো, ‘মারো, মারো, মেরে ফেলো শয়তানগুলোকে।’ ওদের চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে ওরা যেনো মনের ভিতর পুষে রাখা অনেকদিনের প্রতিশোধ-ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ করছে। থলের ভিতর থেকেও সমস্মরে কান্নার আওয়াজ আসছে, ‘দয়া করে আমাদের মেরো না। দয়া করে আমাদেরকে ছেড়ে দাও।’ কামার দমাদম করে করে হাতুড়ি পিটিয়েই ছলেছে। হাতুড়ির আঘাতের পরিমাণ যতোই বাড়ছে প্রেতাত্মাদের কান্নার আওয়াজ ততোই কমছে। একটা সময় ওদের কান্নার আওয়াজ খুব ক্ষীণ হয়ে এলো। রতন কামারকে থামিয়ে দিলো। ওদের মধ্যে তখনও কেউ প্রাণে বেঁচে আছে কিনা সেটা জানার আগ্রহ হলো রতনের।
‘এই তোমরা আছো নাকি নেই?’ রতন জিজ্ঞেস করলো।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছি। দয়া করে আমাদেরকে ছেড়ে দাও।’
এবার মাত্র কয়েকজনের কণ্ঠ শোনা গেলো। সাথে সাথে কামার আবার হাতুড়ি পেটাতে শুরু করতে যাচ্ছিলো। রতন তাকে থামিয়ে দিলো।
‘দাঁড়ান। আমি ওদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি।’
‘ওদের সাথে আবার কিসের কথা? মেরে ফেলো ওদের,’ উপস্থিত কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললেন।
রতন তাদেরকে শান্ত হতে বললো। রতন প্রেতাত্মাদের সাথে কথা বলা শুরু করলো।
‘এই তোমরা আর কখনও মানুষকে বিরক্ত করবে? ক্ষতি করবে মানুষের?’
‘ না, না, না। এই যে আমরা কানে ধরছি, আমরা আর কখনও মানুষের কোনো ক্ষতি করবো না। তাদেরকে বিরক্ত করবো না। দয়া করে আমাদেরকে ছেড়ে দাও।’
‘তোমাদেরকে বিশ্বাস করবো কেনো? এখন এমনটা বলছো। ছেড়ে দেবার পর যদি আবার আগের মতো কাজ করো?’ রতন জিজ্ঞেস করলো।
‘না, না, করবো না। ভুত দেবরাজের কসম করে বলছি, আমরা আর কখনও মানুষের কোনো ক্ষতি করবো না। আমরা এ দেশ থেকে চিরদিনের মতো চলে যাবো। অনেক দূরে চলে যাবো।’
‘যেখানেই যাও, সেখানেও মানুষের কোনো ক্ষতি করবে?’ কামার জিজ্ঞেস করলো।
‘না, ওয়াদা করছি, আমরা যেখানেই যাই না কেনো, যেখানেই থাকি না কেনো, মানুষের কোনো ক্ষতি আমরা করবো না। দয়া করে আমাদের ছেড়ে যাও। দয়া করে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও, আমরা তোমাকে একটা অবাক করা জিনিস উপহার দেবো।’
‘লোভ দেখানো হচ্ছে!’ উপস্থিত লোকেদের কেউ কেউ বললো।
‘না, না, লোভ দেখানো নয়। সত্যি বলছি। তোমরা আমাদেরকে ছেড়ে দিয়ে যে দয়া দেখাচ্ছো এটা হচ্ছে তারই এক ছোট প্রতিদান, উপহার।’
রতন সবাইকে শান্ত থাকতে বলে থলেটা নিজের কাছে নিলো। দড়ির বাঁধনটা খুলে দিলো।
‘সবাই এখনই এ দেশ ছেড়ে চলে যাও। তোমাদের মধ্যে শুধু একজন তোমাদের প্রতিজ্ঞা মতো সেই উপহার নিয়ে ফিরে আসবে,’ রতন বললো।
সাথে সাথে সবগুলো প্রেতাত্মা উড়ে চলে গেলো। মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো সবাই। উপস্থিত অনেকেই রতনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওদেরকে ছেড়ে দিয়ে কাজটা কি ঠিক করলেন ভাই? ওরা ওদের ওয়াদা রাখবে না। আবার হয়তো কোথাও গিয়ে ঠিকই ক্ষতি করবে মানুষের।’
‘একটু ধৈর্য ধরেন। দেখি কী হয়,’ রতন বললো।
কিছুক্ষণ পরেই একটা ছোট আকারের প্রেতাত্মা ক্ষুদে মানুষের রূপ নিয়ে তাদের কাছে ফিরে আসলো। সবাই অবাক হয়ে গেলো, ‘ওরে বাবা! শয়তানগুলো তাদের কথা রেখেছে দেখছি!’
রতনের সামনে এসে প্রেতাত্মাটি দাঁড়ালো।
‘এই নাও। এটা হচ্ছে একটা থলে।’
‘হুম। এটা একটা সাধারণ থলে। এটা তো দেবার কথা ছিলো না। তোমরা তো আমাকে বিস্ময়কর এক উপহার দিতে চেয়েছিলে। তোমরা তো তোমাদের কথা রাখলে না। উল্টো মজা করলে আমাদের সাথে!’ রতন বললো।
‘না, না। মজা করি নি। এটাই হচ্ছে এক বিস্ময়কর উপহার। এক যাদুর থলে। তুমি যখনই যা চাইবে তখনই সেই জিনিসে এই থলে ভরে যাবে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি এখনই তার প্রমাণ পেতে পারো।’
রতনও দেরি করলো না। সে প্রমাণ করে নিতে চাইলো। থলেটার মুখ উন্মুক্ত করে সে বললো, ‘এখনই এখানে উপস্থিত লোকেদের জন্য খাবার ও পানীয়তে থলেটা ভরিয়ে দাও।’
সাথে সাথে বিভিন্ন খাবার, ফলমূল ও পানীয়তে থলেটা ভরে গেলো। সবাই অবাক হলো। খুশির বন্যা বয়ে গেলো সবার মাঝে। মানুষরূপি প্রেতাত্মার সামনেই রতন উপস্থিত সবার মাঝে খাবার, ফলমূল ও পানীয় বন্টন করলো।
‘এবার বিশ্বাস হলো তো?’
‘হুম। বিশ্বাস হলো। কিন্তু তোমরা তোমাদের দেয়া অন্য কথাগুলোও রাখবে তো?’ রতন বললো।
‘হুম রাখবো। আমরা কথা দিলে সে কথা রাখি।’
‘তাহলে তুমি এবার যেতে পারো,’ প্রেতাত্মাকে সবাই একসাথে বিদায় জানালো।
ততোক্ষণে কামাদের দোকানের সামনে পরিত্যাক্ত বাড়িটির মালিক এসে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি লোক মারফৎ সব কথা শুনে এখানে চলে এসেছেন। রতনের হাত ধরে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। কোলাকুলি করলেন রতনের সাথে। ওই রাতটা তার বাড়িতে থাকবার জন্য রতনকে অনুরোধ করলেন। রতন ভদ্রলোকের অনুরোধ ফেলতে পারলো না। সে লোকটির সাথে তাঁর বাড়িতে চলে গেলো। সেই রাতে খুব ভালো ঘুম হলো তার। রাতের খাবারটাও হয়েছে মনে রাখবার মতো। খুব সকাল সকাল ভদ্রলোক ও তাঁর পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রতন নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো। কয়েকদিনের মধ্যেই সে বাড়ি পৌঁছালো। অনেকদিন পর ছেলেকে দেখে দেখে রতনের মা আনন্দের কান্না শুরু করলো। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই রতনের মা আরও জোরে কান্না শুরু করলো। ততোক্ষণে রতনদের পাড়াপ্রতিবেশীরা এসে উপস্থিত হয়েছে সেখানে। তাদের মধ্যেই একজন বললো যে রতনের বাবা আজ কয়েক মাস হলো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। রতনের দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। যার জন্য তার বাড়ি ফিরে আসা সেই মানুষটাই কিনা পৃথিবীতে নেই আর! রতনের গ্রামের লোকজন তাদের মতোই গরীব। একবেলার খাবার যোগার করতেই হিমশিম খেতে হয়। রতন নিজেকে সামলে নিলো। সময় নিয়ে সবাইকে তার অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বললো। রতন ভাবলো তার কাছে থাকা যাদুর থলের সাহায্যেই সে তার নিজের পরিবার ও গ্রামের সবার দারিদ্র দূর করবে, সবার মুখে হাসি ফোঁটাবে।
রতন যাদুর থলে বের করলো। থলের মুখটা খুলে প্রসারিত করে দিলো।
‘এই যাদুর থলে, এখনই তুমি প্রচুর সোনাদানায় ভরে উঠো,’ থলেকে উদ্দেশ্য করে রতন বিড়বিড় করে কথাটা বললো।
সাথে সাথে যাদুর থলে সোনাদানায় ভরে গেলো। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে আনন্দে চিৎকার করতে শুরু করলো। রতন গ্রামের সবার মাঝে সোনাদানা ভাগ করে দিলো। নিজের মায়ের কাছেও কিছু দিলো। গ্রামবাসীরা যার যার ভাগের সোনাদান বিক্রি করে চাষাবাদ বা ব্যবসা শুরু করলো। রতনও ব্যবসা শুরু করলো। ইচ্ছে করলেই সে তার প্রয়োজন মতো যাদুর থলের কাছে এটা ওটা চাইতে পারতো। কিন্তু সে পরিশ্রম করতে চাইলো। রতন একটা বড় বাড়ি তৈরি করলো। বিয়ে করলো। রতনের পরিবারে সুখ ফিরে এলো। সুখ ফিরে এলো পুরো গ্রামে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৫৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/০১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast