মেয়ের জন্য জামাই বাছাই
শ্রী মোহন্ত ছিলেন চম্পানগরের বিক্রমশালী রাজা। কর্মে-হুকুমে-মেজাজে একশো ভাগ রাজা ছিলেন তিনি। মননে ও মানসিকতায় ছিলেন সৃজনশীল, মায়াময় ও স্নেহময়। সুলোচনা হলেন রাজা শ্রী মোহন্তের একমাত্র স্ত্রী। সে-সূত্রে সুলোচনা হলেন চম্পানগরের রাণী। রূপে, গুণে রাণী সুলোচনার খ্যাতি চম্পানগর ছাড়িয়ে অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। রাজা মোহন্ত ও রাণী সুলোচনার একমাত্র কন্যা, চম্পানগরের একমাত্র যুবরাজ্ঞী ত্রিভুবন সুন্দরী। জন্মের পরপরই মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে পিতা রাজা মোহন্ত এই নাম রাখেন। রাজা শ্রী মোহন্তের কাছে ত্রিভুবন বলতে এই মেয়েই। নিজের জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসেন মেয়েকে। মেয়ের ব্যাপারে পান থেকে চুন খসলেই রাজা মোহন্তের কাছ থেকে কেউ ক্ষমা পায় না। হাকিম নড়বে, রাজা মোহন্তের হুকুম নড়বে না।
ত্রিভুবন সুন্দরীর গুণ যেমন গগণস্পর্শী, রূপও তেমন সর্বব্যাপী। ত্রিভুবনের রূপ না দেখেই কতো পুরুষ যে দিওয়ানা হয়েছে তার শেষ নেই। রাজা শ্রী মোহন্তের একমাত্র কন্যা বলে কথা! যার তার হাতে কি সেই মেয়েকে সমর্পণ করা যায়? গত ফাগুণে ত্রিভুবন আঠারোতে পা দিয়েছে। রাজা শ্রী মোহন্ত মেয়ের জন্য সুযোগ্য পাত্র খুঁজছেন। ইতিমধ্যে যতো সব যুবরাজ এসেছে তাদের কাউকেই পছন্দ হয়নি রাজা মোহন্তের। যুবরাজ্ঞী ত্রিভুবন আগেই বলে দিয়েছে বাবা রাজা মোহন্তের সিদ্ধান্তই হবে তার সিদ্ধান্ত। এরকম পিতাপরায়ণ মেয়ে পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি মিলবে না। রাজা মোহন্ত সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তার মেয়ের জামাই হবে সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী।
একদিন চার তরুণ চম্পানগরে এলো। চারজনই ছিলো এক এক রাজ্যের যুবরাজ। তারা রাজদরবারে এলো। রাজা মোহন্ত তাদের সমাবেশ কক্ষে ডেকে পাঠালেন। তিনি জানতে চাইলেন তরুণেরা তাঁর রাজ্যে কেনো এসেছে। চার তরুণ একসাথে বললো, ‘আমরা যুবরাজ্ঞীর পাণি প্রার্থনা করতে এসেছি।’ রাজা মোহন্ত চার তরুণকেই আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। চার তরুণকেই শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী মনে হলো রাজা মোহন্তর কাছে। কিছুক্ষণ ভেবে রাজা মোহন্ত চার তরুণের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘দেখো, তোমরা চারজনই শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র, বুদ্ধিমান ও শক্তসমর্থ। দেখতেও সুদর্শন। কিন্তু আমি তো আমার একটি মাত্র মেয়েকে চার ছেলের কাছে সমর্পণ করতে পারি না। আমার শুধু একজন সুযোগ্য জামাই চাই। তোমরা আমাকে একটু সময় দাও। আমি ভেবে দেখি কী করা যায়।’
রাজা মোহন্ত তাঁর পেয়াদাকে বললেন চার তরুণকে অতিথি কক্ষে নিয়ে যেতে, সেখানে তাদের জন্য ভোজন ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে। পেয়াদা চারজনকে নিয়ে গেলো। রাজা মোহন্ত খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। চার তরুণকেই তাঁর মনে ধরেছে। কাকে রেখে কাকে বাছাই করবেন, বুঝে উঠে পারছেন না। তিনি তাঁর একজন বিশ্বস্ত উপদেষ্টা বলবীর সিংকে ডেকে পাঠালেন। বলবীরের সাথে কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর কিছু একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন।
রাজা শ্রী মোহন্ত তাঁর পেয়াদাকে দিয়ে চার তরুণকে ডেকে পাঠালেন। সবাই রাজদরবারের মূল কক্ষে হাজির হলো। রাজা মোহন্ত তাঁর অন্যান্য উপদেষ্টাদেরকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবাই চলে এলে মূল কক্ষ ভরে গেলো। রাজা মোহন্ত চার যুবরাজকে একটু দূরে একসাথে দাঁড়াতে বললেন। এরপর তাদের চারজনের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘শোনো, যুবকেরা। তোমরা চারজনই কোনো না কোনো রাজার পুত্র। অর্থাৎ তোমরা প্রত্যেকেই একজন যুবরাজ। ধরো, তোমরা কোনো রাজার পুত্র অর্থাৎ কোনো যুবরাজ নও। আমার মেয়েকে বিয়ে করলে। তোমার নিজের শিক্ষা, শক্তি ও শ্রম দিয়ে আমার মেয়ের সাথে সংসার করতে হবে। আমি এখন তোমাদেরকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করবো তোমাদের এমন কি গুণ আছে যা দ্বারা তোমরা নিজেরা নিজেদের মেধা ও পরিশ্রম দ্বারা একটা সংসারকে সুখে-শান্তিতে চালনা করতে পারবে। অথবা এমন কোনো গুণ আছে কিনা যা তোমাদের অন্য সবার থেকে আলাদা করে রাখে। আলাদা করে চেনায়। ’
রাজা মোহন্ত প্রথমে চণ্ডীগড়ের যুবরাজ পরমব্রতকে আহ্বান জানালেন। পরমব্রত রাজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।
‘বলো হে, যুবক, তোমার কি বিশেষ কোনো গুণ আছে?’ রাজা মোহন্ত জিজ্ঞেস করলেন।
‘জী আছে,’ অত্যন্ত নম্রভাবে উত্তর দিলো যুবরাজ পরমব্রত।
‘বলো তাহলে, কী তোমার সেই বিশেষ গুণ।’
‘আমি মসৃণ কাপড় বুনতে পারি। আমি এটা স্বেচ্ছায় শিখেছি। আমি আমার বুনন করা কাপড় বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করবো।’
‘সেই অর্থে তুমি কী কী করবে?’ রাজা মোহন্ত জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি কিছু অর্থ বিধাতার রাস্তায় খরচ করবো, কিছু ব্রাহ্মণদেরকে দেবো, কিছু দেবো ভিক্ষুকদের আর বাকিটা আমার জন্য রেখে দেবো। আমার জন্য জমাকৃত অর্থ আমার স্ত্রী ও সংসারের জন্য ব্যয় করবো।’
‘আচ্ছা। খুব ভালো।’
রাজা মোহন্ত এবার দ্বিতীয় যুবরাজকে তাঁর সম্মুখে দাঁড়াতে বললেন। উড়িষ্যার যুবরাজ মোহন বীর রাজা মোহন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাজা মোহন্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘যুবক। এবার তুমি বলো, তোমার এমন কি বিশেষ গুণ আছে যা তোমাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে?’
‘সম্মানিত রাজা, আমি পশু-পাখির ভাষা জানি,’ যুবরাজ মোহন বীর উত্তর করলো।
‘ও আচ্ছা! খুব ভালো,’ রাজা মোহন্ত মাথা নেড়ে বললেন।
এরপর পালা এলো বিহারের যুবরাজ দেবরাজের। যুবরাজ দেবরাজ ধীর পায়ে রাজা মোহন্তর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাজা মোহন্ত যথারীতি প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘হে যুবক, বিহারের যুবরাজ, তুমি বলো, তোমার কি বিশেষ কোনো গুণ আছে?’
‘জী, জনাব, আমি সকল ধর্মগ্রন্থ পড়েছি। সেগুলো সম্পর্কে আমার অগাধ জ্ঞান রয়েছে,’ যুবরাজ দেবরাজ মার্জিত কণ্ঠে উত্তর দিলো।
সর্বশেষে বাংলার যুবরাজ অসীমকে রাজার সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। যুবরাজ অসীম রাজা মোহন্তের সামনে অবনত চোখে দাঁড়িয়ে পড়লো। রাজা মোহন্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলার যুবরাজ, অসীম, তুমি বলো তো দেখি, তোমার বিশেষ কোনো গুণ আছে কি না।’
‘মহারাজ, আমি কাউকে চোখে না দেখে, শুধু তার কণ্ঠ শুনেই তাকে তীরবিদ্ধ করতে পারি। তার কাছে যাবার প্রয়োজনও পড়ে না আমার,’ যুবরাজ অসীম আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিলো।
রাজা মোহন্ত এবার চার যুবরাজকে তাঁর আসন থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। পেয়াদা তাদেরকে নিয়ে গেলেন এবং দাঁড়াতে বললেন। চারজনই অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে দাঁড়িয়ে পড়লো। রাজা মোহন্ত আবার দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। চার তরুণেরই বিশেষ বিশেষ গুণ রয়েছে। রাজা মোহন্ত এবার তাঁর সকল উপদেষ্টার সাথে পরামর্শ করলেন।
‘বলুন, বলবীর সিং, এদের মধ্যে কাকে আপনার কাছে অধিকতর যোগ্য মনে হয়?’
‘প্রভু, আপনি হয়তো জানেন, হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন জাতের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন কিছু বিশেষ বিশেষ গুণ থাকে। এই যেমন, যারা কাপড় বুনে তারা শূদ্রা বর্ণের, যারা পশুপাখির ভাষা জানে তারা সাধারণত বৈশ্য জাতের হয়, আবার যারা ধর্ম গ্রন্থ পড়ে ও জানে তারা সাধারণত ব্রাহ্মণ হয়। আর আপনি নিশ্চয়ই শূদ্রা, বৈশ্য বা ব্রাহ্মণ জাতের কাউকে আপনার মেয়েজামাই বানাবেন না।’
‘হুম, আপনি ঠিকই বলেছেন, বলবীর সিং। আমি তো এ সকল জাতের কারো সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারি না,’ রাজা মোহন্ত মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন।
‘প্রভু, অথচ দেখুন, চতুর্থ জন অর্থাৎ বাংলার যুবরাজ অসীম অস্ত্র চালাতে জানে। আর যারা অস্ত্র চালাতে জানে তারা তো ক্ষত্রীয় জাতের হয়। আর আপনিও হচ্ছেন ক্ষত্রীয় জাতের। সুতরাং আপনার মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র হলো বাংলার যুবরাজ অসীম,’ বলবীর বললেন।
‘আপনি যথার্থই বলেছেন, বলবীর সিং। ধন্যবাদ আপনাকে। আমি আমার মেয়ের জন্য সুযোগ্য পাত্র পেয়ে গেছি!’ রাজা মোহন্ত আনন্দিত হয়ে বললেন।
রাজা মোহন্তের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাকি তিন যুবরাজকে যার যার রাজ্যে ফিরে যেতে বলা হলো। যুবরাজ অসীমের পিতামাতাকে রাজা শ্রী মোহন্তের দরবারে আমন্ত্রণ জানানো হলো। যুবরাজ অসীম ও যুবরাজ্ঞী ত্রিভুবন সুন্দরীর বিয়ের ব্যবস্থা করা হলো। গোটা চম্পানগরে আনন্দ ও আলোকের বন্যা বয়ে গেলো।
(ঘটনা ও চরিত্রের কিছুটা পরিবর্তন করে বেতাল পঞ্চবিংশতি অবলম্বনে রচিত।)
ত্রিভুবন সুন্দরীর গুণ যেমন গগণস্পর্শী, রূপও তেমন সর্বব্যাপী। ত্রিভুবনের রূপ না দেখেই কতো পুরুষ যে দিওয়ানা হয়েছে তার শেষ নেই। রাজা শ্রী মোহন্তের একমাত্র কন্যা বলে কথা! যার তার হাতে কি সেই মেয়েকে সমর্পণ করা যায়? গত ফাগুণে ত্রিভুবন আঠারোতে পা দিয়েছে। রাজা শ্রী মোহন্ত মেয়ের জন্য সুযোগ্য পাত্র খুঁজছেন। ইতিমধ্যে যতো সব যুবরাজ এসেছে তাদের কাউকেই পছন্দ হয়নি রাজা মোহন্তের। যুবরাজ্ঞী ত্রিভুবন আগেই বলে দিয়েছে বাবা রাজা মোহন্তের সিদ্ধান্তই হবে তার সিদ্ধান্ত। এরকম পিতাপরায়ণ মেয়ে পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি মিলবে না। রাজা মোহন্ত সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তার মেয়ের জামাই হবে সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী।
একদিন চার তরুণ চম্পানগরে এলো। চারজনই ছিলো এক এক রাজ্যের যুবরাজ। তারা রাজদরবারে এলো। রাজা মোহন্ত তাদের সমাবেশ কক্ষে ডেকে পাঠালেন। তিনি জানতে চাইলেন তরুণেরা তাঁর রাজ্যে কেনো এসেছে। চার তরুণ একসাথে বললো, ‘আমরা যুবরাজ্ঞীর পাণি প্রার্থনা করতে এসেছি।’ রাজা মোহন্ত চার তরুণকেই আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। চার তরুণকেই শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী মনে হলো রাজা মোহন্তর কাছে। কিছুক্ষণ ভেবে রাজা মোহন্ত চার তরুণের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘দেখো, তোমরা চারজনই শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র, বুদ্ধিমান ও শক্তসমর্থ। দেখতেও সুদর্শন। কিন্তু আমি তো আমার একটি মাত্র মেয়েকে চার ছেলের কাছে সমর্পণ করতে পারি না। আমার শুধু একজন সুযোগ্য জামাই চাই। তোমরা আমাকে একটু সময় দাও। আমি ভেবে দেখি কী করা যায়।’
রাজা মোহন্ত তাঁর পেয়াদাকে বললেন চার তরুণকে অতিথি কক্ষে নিয়ে যেতে, সেখানে তাদের জন্য ভোজন ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে। পেয়াদা চারজনকে নিয়ে গেলো। রাজা মোহন্ত খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। চার তরুণকেই তাঁর মনে ধরেছে। কাকে রেখে কাকে বাছাই করবেন, বুঝে উঠে পারছেন না। তিনি তাঁর একজন বিশ্বস্ত উপদেষ্টা বলবীর সিংকে ডেকে পাঠালেন। বলবীরের সাথে কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর কিছু একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন।
রাজা শ্রী মোহন্ত তাঁর পেয়াদাকে দিয়ে চার তরুণকে ডেকে পাঠালেন। সবাই রাজদরবারের মূল কক্ষে হাজির হলো। রাজা মোহন্ত তাঁর অন্যান্য উপদেষ্টাদেরকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সবাই চলে এলে মূল কক্ষ ভরে গেলো। রাজা মোহন্ত চার যুবরাজকে একটু দূরে একসাথে দাঁড়াতে বললেন। এরপর তাদের চারজনের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘শোনো, যুবকেরা। তোমরা চারজনই কোনো না কোনো রাজার পুত্র। অর্থাৎ তোমরা প্রত্যেকেই একজন যুবরাজ। ধরো, তোমরা কোনো রাজার পুত্র অর্থাৎ কোনো যুবরাজ নও। আমার মেয়েকে বিয়ে করলে। তোমার নিজের শিক্ষা, শক্তি ও শ্রম দিয়ে আমার মেয়ের সাথে সংসার করতে হবে। আমি এখন তোমাদেরকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করবো তোমাদের এমন কি গুণ আছে যা দ্বারা তোমরা নিজেরা নিজেদের মেধা ও পরিশ্রম দ্বারা একটা সংসারকে সুখে-শান্তিতে চালনা করতে পারবে। অথবা এমন কোনো গুণ আছে কিনা যা তোমাদের অন্য সবার থেকে আলাদা করে রাখে। আলাদা করে চেনায়। ’
রাজা মোহন্ত প্রথমে চণ্ডীগড়ের যুবরাজ পরমব্রতকে আহ্বান জানালেন। পরমব্রত রাজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।
‘বলো হে, যুবক, তোমার কি বিশেষ কোনো গুণ আছে?’ রাজা মোহন্ত জিজ্ঞেস করলেন।
‘জী আছে,’ অত্যন্ত নম্রভাবে উত্তর দিলো যুবরাজ পরমব্রত।
‘বলো তাহলে, কী তোমার সেই বিশেষ গুণ।’
‘আমি মসৃণ কাপড় বুনতে পারি। আমি এটা স্বেচ্ছায় শিখেছি। আমি আমার বুনন করা কাপড় বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করবো।’
‘সেই অর্থে তুমি কী কী করবে?’ রাজা মোহন্ত জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি কিছু অর্থ বিধাতার রাস্তায় খরচ করবো, কিছু ব্রাহ্মণদেরকে দেবো, কিছু দেবো ভিক্ষুকদের আর বাকিটা আমার জন্য রেখে দেবো। আমার জন্য জমাকৃত অর্থ আমার স্ত্রী ও সংসারের জন্য ব্যয় করবো।’
‘আচ্ছা। খুব ভালো।’
রাজা মোহন্ত এবার দ্বিতীয় যুবরাজকে তাঁর সম্মুখে দাঁড়াতে বললেন। উড়িষ্যার যুবরাজ মোহন বীর রাজা মোহন্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাজা মোহন্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘যুবক। এবার তুমি বলো, তোমার এমন কি বিশেষ গুণ আছে যা তোমাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে?’
‘সম্মানিত রাজা, আমি পশু-পাখির ভাষা জানি,’ যুবরাজ মোহন বীর উত্তর করলো।
‘ও আচ্ছা! খুব ভালো,’ রাজা মোহন্ত মাথা নেড়ে বললেন।
এরপর পালা এলো বিহারের যুবরাজ দেবরাজের। যুবরাজ দেবরাজ ধীর পায়ে রাজা মোহন্তর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাজা মোহন্ত যথারীতি প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘হে যুবক, বিহারের যুবরাজ, তুমি বলো, তোমার কি বিশেষ কোনো গুণ আছে?’
‘জী, জনাব, আমি সকল ধর্মগ্রন্থ পড়েছি। সেগুলো সম্পর্কে আমার অগাধ জ্ঞান রয়েছে,’ যুবরাজ দেবরাজ মার্জিত কণ্ঠে উত্তর দিলো।
সর্বশেষে বাংলার যুবরাজ অসীমকে রাজার সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। যুবরাজ অসীম রাজা মোহন্তের সামনে অবনত চোখে দাঁড়িয়ে পড়লো। রাজা মোহন্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলার যুবরাজ, অসীম, তুমি বলো তো দেখি, তোমার বিশেষ কোনো গুণ আছে কি না।’
‘মহারাজ, আমি কাউকে চোখে না দেখে, শুধু তার কণ্ঠ শুনেই তাকে তীরবিদ্ধ করতে পারি। তার কাছে যাবার প্রয়োজনও পড়ে না আমার,’ যুবরাজ অসীম আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিলো।
রাজা মোহন্ত এবার চার যুবরাজকে তাঁর আসন থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। পেয়াদা তাদেরকে নিয়ে গেলেন এবং দাঁড়াতে বললেন। চারজনই অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে দাঁড়িয়ে পড়লো। রাজা মোহন্ত আবার দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। চার তরুণেরই বিশেষ বিশেষ গুণ রয়েছে। রাজা মোহন্ত এবার তাঁর সকল উপদেষ্টার সাথে পরামর্শ করলেন।
‘বলুন, বলবীর সিং, এদের মধ্যে কাকে আপনার কাছে অধিকতর যোগ্য মনে হয়?’
‘প্রভু, আপনি হয়তো জানেন, হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন জাতের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন কিছু বিশেষ বিশেষ গুণ থাকে। এই যেমন, যারা কাপড় বুনে তারা শূদ্রা বর্ণের, যারা পশুপাখির ভাষা জানে তারা সাধারণত বৈশ্য জাতের হয়, আবার যারা ধর্ম গ্রন্থ পড়ে ও জানে তারা সাধারণত ব্রাহ্মণ হয়। আর আপনি নিশ্চয়ই শূদ্রা, বৈশ্য বা ব্রাহ্মণ জাতের কাউকে আপনার মেয়েজামাই বানাবেন না।’
‘হুম, আপনি ঠিকই বলেছেন, বলবীর সিং। আমি তো এ সকল জাতের কারো সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারি না,’ রাজা মোহন্ত মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন।
‘প্রভু, অথচ দেখুন, চতুর্থ জন অর্থাৎ বাংলার যুবরাজ অসীম অস্ত্র চালাতে জানে। আর যারা অস্ত্র চালাতে জানে তারা তো ক্ষত্রীয় জাতের হয়। আর আপনিও হচ্ছেন ক্ষত্রীয় জাতের। সুতরাং আপনার মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র হলো বাংলার যুবরাজ অসীম,’ বলবীর বললেন।
‘আপনি যথার্থই বলেছেন, বলবীর সিং। ধন্যবাদ আপনাকে। আমি আমার মেয়ের জন্য সুযোগ্য পাত্র পেয়ে গেছি!’ রাজা মোহন্ত আনন্দিত হয়ে বললেন।
রাজা মোহন্তের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাকি তিন যুবরাজকে যার যার রাজ্যে ফিরে যেতে বলা হলো। যুবরাজ অসীমের পিতামাতাকে রাজা শ্রী মোহন্তের দরবারে আমন্ত্রণ জানানো হলো। যুবরাজ অসীম ও যুবরাজ্ঞী ত্রিভুবন সুন্দরীর বিয়ের ব্যবস্থা করা হলো। গোটা চম্পানগরে আনন্দ ও আলোকের বন্যা বয়ে গেলো।
(ঘটনা ও চরিত্রের কিছুটা পরিবর্তন করে বেতাল পঞ্চবিংশতি অবলম্বনে রচিত।)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মুহাম্মদ রুমান ৩১/০১/২০১৭nice
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ২৯/০১/২০১৭ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে মনে পড়ে!
-
আব্দুল হক ২৯/০১/২০১৭সুন্দর