www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দিন বদলের গল্প

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মর্নিয়া ইউনিয়ন। ইউনিয়নের একটা ছোট্ট গ্রাম শেখপাড়া। গ্রামের প্রান্তে হাতে গোণা কয়েকটা দোকান নিয়ে একটা  বাজার। শনি আর বুধবার দূরের ও আশপাশের গ্রামগুলো থেকে বেশকিছু ভাসমান দোকানদার এখানে এসে জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে। ছোট বাজারটিকে তখন একটা হাটের মতো লাগে। বাজারের পশ্চিম দিকের কোণায় জব্বার মিয়ার মুদি দোকান। জব্বার মিয়ারা আগে মুদির দোকানদার ছিলেন না, তাঁর বাবা ছোটখাটো একজন জমিদার ছিলেন। মর্নিয়া ইউনিয়নে অনেক জমিদারের বাস ছিলো। তাঁদের অনেকের নামের আগেই ‘শেখ’ শব্দটা ছিলো বলেই এই পাড়াটির নাম হয়ে গেলো শেখপাড়া।কালক্রমে অনেকেই দেশান্তরী হয়েছেন। নিজের ইচ্ছায় নয়, ভাগ্যদোষে। যে তিস্তাকে পুঁজি করে তাঁরা সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন, প্রতাপশালী জমিদার বনেছিলেন, সেই তিস্তায় তাঁদেরকে পথে বসিয়ে ছেড়েছে, দেশান্তরী করেছে। তিস্তার ভাঙ্গনে কপাল ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে তাঁদের। ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে তিস্তার ক্ষুধার্ত পেটে। তাঁরা প্রায় সবাই অন্য স্থানে ঠাঁই নিয়েছেন। কেউ কেউ মারাও গেছেন বলেন শোনা যায়। তিস্তাও মরে গেছে। এখানে তিস্তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না আর। তিস্তা যাদেরকে ফকির বানিয়ে ছেড়েছে তাঁদের কাউকে কাউকে এখনও দেখা যায়। তিস্তা নদীও দেশান্তরী হয়েছে। নদী সড়ে যেতে যেতে লালমনিরহাটের দিকে চলে গেছে। এখন যেটুকু তিস্তা আছে সেটুকু চিকন খালের মত। সবাই মরা তিস্তা বলে। মরা তিস্তা বর্ষাকালে কিছু সময়ের জন্য জেগে উঠে। বর্ষা শেষ হতে না হতেই শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। শুকনো চরগুলোতে আবার বসতবাড়ি গড়ে উঠে। হাভাতে মানুষগুলো তিস্তার বুক চিঁরে যা আবাদ করতে পারে তাই খেয়ে দিন কাঁটায়।

বছর ত্রিশ আগের কথা। জব্বার মিয়ার বয়স তখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। হাল্কা পাতলা গড়ন। জমিদারি চলে গেছে, জমিদারি ভাবও নেই। গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘ঘিউ (ঘি) দিয়া খাইচেন ভাত, ঘিউ ঘিউ গোন্ধায় (গন্ধ বের হয়) হাত’। সর্বশান্ত জমিদারদের যে কয়েকজন উত্তরসুরিকে পাওয়া যাবে তাঁদের হাত দিয়ে ঘিয়ের গন্ধতো দূরের কথা, ভালো তরকারির গন্ধটাও তেমন একটা পাওয়া যায় না। জব্বার মিয়া কিছুদিন অসুখে ভুগেছিলেন। এ যেন খোঁড়ার পায়ে ফোঁড়া। যা কিছু জায়গা জমি ছিলো বসতভিটা ছাড়া সব বিক্রি করে দিতে হলো। চিকিৎসাটা ঠিকমতো হলোনা। সুচিকিৎসার অভাবে শুঁকিয়ে গেলেন অনেক। সুচিকিৎসা করানোর মতো অত টাকা কোথায় পাবেন? ঘাড় বেঁকে গেছে। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে হাঁটেন। মানুষ হিসেবে অনেক সৎ। গ্রামের সবাই মান্য করে। জব্বার ভাই বলে ডাকে সবাই। বাবারা ‘জব্বার ভাই’ বলে ডাকে, সেটা শুনে শুনে ছেলে, নাতিপুতি সবাই ‘জব্বার ভাই’ বলেই ডাকে। জব্বার মিয়া ব্যাপারটা খুব উপভোগ করেন মনে হয়। মাঝে মাঝে শুধরে দেবারও চেষ্টা করেন।
‘ঐ তুই মোক ভাই কইস ক্যানে? জানিস ন্যা, তোর বাপও মোক ভাই কয়া ডাকায়?’
‘জানো তো, তা কী হইচে? আব্বাও কয়, মুইও কইম। হইছে? তোমার পোশাউক আর না পোশাউক, মুই ‘ভাই’ কয়া ডাকাইম। হইছে?’
জব্বার মিয়া কথা বাড়ান না। মুচকি হাসেন। খরিদ্দারদের সওদা দেন। টাকা রাখার বাক্স নেই। বস্তার নিচে টাকা রাখেন। বস্তা তুলেই বাকি টাকা ফেরত দেন খরিদ্দারকে।  
জন্মগতভাবে জব্বার মিয়ার দুই হাতে ছয়টি করে মোট বারোটি আংগুল। লোকে বলতো জব্বার মিয়া অনেক বড় ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। হাতের এই আঙ্গুলগুলো নাকি আল্লাহ্‌র নিয়ামত। জব্বার মিয়ার মালেক জমিদার খুশি হয়ে পাঁচটা গরু, দশটা ছাগল জবাই করে সারা গ্রামের মানুষকে খাইয়েছিলেন। জব্বার মিয়া আফসোস করে সেই আঙ্গুলগুলোর দিকে তাকান। চোখের পানিতে সেই আঙ্গুলগুলো ভিজে যায়। লুঙ্গিতে মোছেন সে পানি। খরিদ্দার চলে আসলে লুঙ্গি দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলেন। উনি বুঝতে পেরেছেন কতো বড় কপাল নিয়ে তিনি এই দুনিয়ায় এসেছিলেন।
আগে জব্বার মিয়ার দোকানটা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। বলতে গেলে তাঁর দোকানটাই সবচেয়ে বেশী চলতো। সওদাপাতিতে ঠাঁসা থাকতো দোকানটা। তাঁকে দেখে আরও অনেকে মুদির দোকান দিয়ে বসে। ছোট কয়েকটা দোকান আস্তে আস্তে বাজারে রূপ নিলো। জব্বার মিয়া বাকি সব ব্যবসায়ীর কাছে আদর্শ ছিলেন। এক স্ত্রী জয়নব বিবি আর ছেলে শামসুলকে নিয়ে ছোট সংসার তাঁর। জমিদারী না থাকলেও জব্বার মিয়ার সুখের অভাব ছিলো না। মাছ-মাংস হয়তো সবসময় থাকতো না, কিন্তু গ্রামের অন্য অনেকের মতো ভাতের অভাব ছিলো না।  
তিস্তা সড়ে যাবার পর বিত্তবান কয়েকজন মানুষ শেখপাড়ায় এসে বসতবাড়ি গড়ে তুললেন। এখানে আলাদা কোন আকর্ষণে তাঁরা আসেন নি। সর্বশান্ত মানুষগুলো তাদের বসতভিটা ছাড়া বাকি যে জায়গা-জমি ছিলো সেগুলো বিক্রি করে দিলে বাইরে থেকে এরা এসে সেগুলো কিনে নেন। কেউ কেউ বিড়ির কারখানাও খুলে ব্যবসা শুরু করলেন। কিছু লোকের দুবেলা না হোক, অন্ততঃ একবেলা খাবার জোগারের একটা সুযোগ এলো। সেরকম এক বিত্তশালী পরিবারের ছেলে বুলবুল। বাবুল মিয়ার একমাত্র ছেলে। বয়স দশ বছরের মত হবে তখন। অনেক চঞ্চল। বয়সের তুলনায় দীর্ঘকায় চেহারা। বাড়ি থেকে কিছু কিনে আনতে বললে এক দৌড়ে জব্বার মিয়ার দোকানে চলে যেতো সে। বাবুল মিয়ার চা পানের অভ্যাস ছিলো বেশ প্রকট। নিজেই ছেলেকে জব্বার মিয়ার দোকানে পাঠাতেন চা-চিনি কিনে আনার জন্য।
জব্বার মিয়ার দোকানে নিয়মিত যাওয়া আসার সুবাদে জব্বার মিয়ার প্রতি বুলবুলের মধে একটা ভালোবাসা জন্মে। জব্বার মিয়াকে খুব শ্রদ্ধা করে সে। জব্বার মিয়াও বুলবুলকে খুব স্নেহ করতেন। বিত্তশালী পরিবারের ছেলে হলেও ওর মধ্যে কোনো অহংকার ছিলো না। আদব-কায়দা ছিলো বেশ ভালো। অসম দুজন মানুষের মধ্যে একটা নিবিড় সখ্যতা গড়ে উঠে। নিছক ক্রেতা বিক্রেতার সম্পর্ক নয়।
জব্বার মিয়ার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠে বুলবুল। পড়াশুনাতেও বেশ ভালো ছিলো ছেলেটা। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় ঢাকায় চলে গেলো সে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। ছুটি পেলেই গ্রামে চলে আসতো। বাড়িতে ব্যাগ রেখেই বাজারে চলে যেতো। জব্বার মিয়ার সাথে দেখা করতো, কথা বলতো। জব্বার মিয়াও দেশ, রাজনীতি ও ঢাকা সম্পর্কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতো। প্রত্যেক বিকেলে জব্বার মিয়ার সাথে বুলবুলের এক নির্মল আড্ডা শুরু হয়ে যায়। জব্বার মিয়ার ছেলেও তখন দোকানে বসতো। ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। সন্তানও আছে তার ঘরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেলো বুলবুল। লন্ডন  মেট্রোপলিটান বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস করে পরবর্তীতে ডক্টরেট ডিগ্রীও নিয়ে নেয় সে। অনেকদিন পর দেশে ফিরেছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট নিয়েছেন বাবুল মিয়া। ওখানেই থাকেন স্ত্রীসহ। বাবার অনুমতি নিয়ে বুলবুল গ্রামে এসেছে। গ্রামে তাদেরও একটা বিড়ির কারখান ছিলো। বিড়ির কারখানাগুলো এখন আর চলে না। বিড়ির উপর সরকার যেভাবে ট্যাক্স চাপিয়ে দিয়েছে তা সামলিয়ে কারখানা চালানো সম্ভভ নয়। বিড়ির দাম বাড়াতে হয়। সেই দামে কেউ বিড়ি খেতে চায় না, সিগারেট খায়। গ্রামে এখন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। শিক্ষিত মানুষেরা বিড়ি সিগারেটের বিপক্ষে। গ্রামের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলের দিকে বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলো বুলবুল। অনেক অচেনা লাগছে নিজের অনেকদিনের চেনা জায়গাটা। বুলবুল এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে। আশে পাশে যারা দেখছে তাদের মধ্যেও কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘তোমরা কায় বাহে? তোমাক তো চিনবার পারনো না।’
যারা চিনতে পারে তারাও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আল্লাহ! তোমরা বুলবুল নোওয়ান? তোমরা বাবুল ভাই’র বেটা নোওয়ান?’  
‘হুম, চাচা। আমি বুলবুল।’
অন্য একজন বলে উঠে, ‘ও আল্লাহ্‌! দ্যাকো ক্যানে হামার বুলবুল ক্যামন সাইব হয়া গেইছে। চিনায় যাই না।’  
‘হ্যাঁ রে, মেলা ন্যাকাপড়া কচ্ছেতো’, আরেকজন বলে।
বুলবুল সবাইকে সালাম দেয়। একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘তা বাবা, তোমরা কোনদিন আইনেন? তোমার বাপ-মাও আসছে কি?’
‘না, চাচা, আমি একাই এসেছি। গ্রাম দেখতে এসেছি।’
গ্রাম দেখা যতোটা না কারণ তার চেয়ে বড় বেশী কারণ হচ্ছে এক সময়ের প্রাণের মানুষ জব্বার মিয়াকে দেখা। বুলবুলের দুচোখ যেনো জব্বার মিয়াকেই খুঁজছে। যে স্থানটিতে জব্বার মিয়ার দোকান ছিলো সেখানে কোনো দোকানই নাই এখন। বুলবুলের মনে খটকা লাগলো। জব্বার চাচা কোথায়? ভাবছে সে।
বুলবুল কাউকে জিজ্ঞেস করছে না। নিজেই খুঁজছে। কোথায় যাবে মানুষটা। আশেপাশেই হয়তো আছে। সাত-আট বছরের মতো হবে তাঁদের দুজনার মধ্যে শেষবার দেখা হয়েছিলো। বুলবুল নিজেই এখন পরিপূর্ণ যুবক। বিয়েও হয়ে গেছে। ফুটফুটে ছেলে সন্তান আছে একটা। স্ত্রী সন্তানকে গ্রামে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো বুলবুল। ওর মা রাজী হন নি। বুলবুলকেই দুদিনের মধেই ঢাকায় ফিরে যেতে বলেছেন। বুলবুল অবশ্য জব্বার মিয়ার সাথে দেখা করে, গ্রামটা একটু দেখেই চলে যাবে ঠিক করেছে। সেই জব্বার মিয়াকেই তো দেখা যাচ্ছে না। আগে এই গ্রামের অলিগলিতে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতো। কৌতূহলী বুলবুল একটা গলির মুখে যেতেই কেউ একজন তাকে দেখে লুকিয়ে পড়লো। বুলবুল লোকটার কাছে চলে গেলো। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে লোকটা। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতে একটা থালা। থালার মধ্যে কয়েকটা টাকাও আছে।
‘জব্বার চাচা!’
নিজের প্রিয় মানুষটাকে এই অবস্থায় দেখে বেশ কিছুক্ষণ হতচকিত বুলবুল ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। জব্বার মিয়ার মুখের দিকে চেয়ে কী যেনো ভাবতে থাকে সে। হয়তো ফেলে আসা মধুর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। জব্বার মিয়ার ডান হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছো, চাচা?’
জব্বার মিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কি অদ্ভুত! গ্রামের অনেক মানুষই বুলবুলকে চিনতে পারলো না। বৃদ্ধ জব্বার মিয়া দূর থেকে দেখেই চিনতে পেরেছে! জব্বার মিয়ার মাথাটা বুলবুলের বুকে গিয়ে লাগে। বুলবুল মাথাটায় হাত বুলায়।
‘আমাকে তুমি এত সহজে চিনতে পারলে?’
‘পাবান্নো ক্যানে? হামার ছাওয়াক হামরা চিনবার পাবান্নই?’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেন জব্বার মিয়া।
বুলবুল জব্বার মিয়ার হাত ধরে বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে দুজনের মধ্যে কথা চলতে থাকে। বুলবুল জিজ্ঞেস করে কিভাবে এরকম হলো, কেনো একসময়য়ের আত্ম-নির্ভরশীল, মর্যাদাবান মানুষটা আজ ভিক্ষার থালা হাতে নিয়ে অলিতে গলিতে ঘুরছে। জব্বার মিয়া সব খুলে বলতে থাকে। জব্বার মিয়ার দুঃখের কথা কেউ শুনতে চায় না। এখন একজন মানুষ এসেছে যাকে তিনি এতোদিনের জমানো সব কথা খুলতে বলতে চাইছেন যেন। জব্বার মিয়ার স্ত্রী মারা গেছেন বছর ছয় আগে। ছেলে শামসুল অসুস্থ হয়ে পড়লে ছেলের বউ বিরক্ত হয়ে সন্তানসহ তার বাপের বাড়ি চলে গেছে। ছেলের চিকিৎসা করাতে করাতে দোকান, বসতভিটার প্রায় সব অংশ বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন আছে বলতে সেই অসুস্থ সন্তান আর থাকার একটা ঘর। ছেলের চিকিৎসা আর করাতে পারছেন না। ভিক্ষা করে দুবেলার খাবার যোগার করছেন। নিজেরও বয়স হয়ে গেছে অনেক। হয়তো তিনিও তার স্ত্রীর পথ ধরতে যাচ্ছেন। শরীরের অবস্থা দেখে তাই মনে হয়। বুলবুলের দুচোখ অশ্রুতে ছলছল করে উঠে। সে কিছু টাকা দিতে গেলে জব্বার মিয়া সঙ্কোচ করে, ‘ভিক্ষা দিবান্নাকচেন, বাবা?’
বুলবুল লজ্জা বোধ করে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। জব্বার মিয়াকে বাজারের এক দোকানে চা নাস্তা খাইয়ে বাড়িতে রেখে আসে সে। শামসুল মিয়ার সাথেও কথা বলে কিছুক্ষণ। বুলবুল বাড়ি চলে যায়। রাতে আবার জব্বার মিয়ার বাড়িতে যেয়ে অনেকক্ষণ কথা বলে দুজন মিলে। শামসুল মিয়া বিছানায় শুয়ে জব্বার মিয়া ও বুলবুলের কথা শুনে। রাতে ঢাকা থেকে ফোন আসে। বুলবুলের ছেলে অসুস্থ। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে জব্বার মিয়ার সাথে একবার দেখা করতে চাইলো বুলবুল। এত সকালে বৃদ্ধ মানুষটাকে ঘুম থেকে উঠানো ঠিক হবে না, ভাবে সে। রাতেই সে টিকেট কাউন্টারে ফোন করে গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলো। ব্যাগ গুছিয়ে সোজা বেড়িয়ে পড়ে রংপুর শহরের পথে। রিক্সাও নেই। হারাগাছ ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হবে। হাঁটা শুরু করে বুলবুল। ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়। বাবুল মিয়ার সাথে জব্বার মিয়াকে নিয়ে কথা হয়। জব্বার মিয়াকে একটা দোকান করে দেবে বলে ঠিক করে বুলবুল। বাবুল মিয়া সায় দেন। ঢাকায় এসেই ছেলেকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে বুলবুল। ছেলে সুস্থ হয়ে উঠতে প্রায় সপ্তাহখানেক লেগে যায়। সপ্তাহের শেষ দিকে হাজার দশেক টাকা নিয়ে বুলবুল রংপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। দুপুর বেলা নাগাদ সে শেখপাড়ায় পৌঁছায়। আজ নিজেদের গাড়িতে এসেছে। আজ সাথে করে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে এসেছে। একটা ভালো কাজের সাক্ষী হতে চেয়েছে স্ত্রী শাহানা। বুলবুল খুশি মনেই নিয়ে এসেছে ওদের। বাড়ির সামনে আসতেই অন্যরকম দৃশ্য চোখে পড়ে। আজ তো শুক্রবার নয়, তবে এত মানুষ কেনো নামাজ পড়তে যাচ্ছে? বুলবুলের কৌতূহল হয়। গাড়ি থেকে নেমে একজন জিজ্ঞেস করে সে।
‘এই যে ভাই, এত মানুষ নামাজ পড়তে যাচ্ছে আজ! মসজিদে মিলাদ নাকি?’
‘আরে না। জব্বার ফকিরক চেনেন?’
‘জব্বার চাচা?’
‘হ্যাঁ, জব্বার ফকির, চেনেন?’
বুলবুল বুঝতে পারে, তার প্রিয় জব্বার চাচাই গ্রামের মানুষের কাছে এখন জব্বার ফকির। জব্বার মিয়ার নাম শুনতেই আগ্রহটা কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। শাহানা ছেলেকে নিয়ে গাড়ি থেকে বের হলেন। বুলবুল নিজেই জিজ্ঞেস কর ঐ লোকটাকে, ‘হ্যাঁ ভাই, জব্বার ফকির, চিনি। কী হয়েছে ওনার?’
‘মারা গ্যাইচে। একন ওনার জানাজা। হামরা জানাজাত যাবান্নাকচি।’
বুলবুল নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে কি তার সব ইচ্ছে, সব স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে গেলো? স্ত্রী-সন্তানের সামনেই নিঃশব্দে কেঁদে ফেলে সে। গাড়ির উপরে হাত চাপড়াতে থাকে। শাহানা হাতটা ধরে ফেলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, ‘তোমাকে যে জব্বার চাচার কথা বলেছিলাম। ইনি সেই জব্বার চাচা। উনি আর নেই, শাহানা। এভাবে চলে গেলো লোকটা?’
জব্বার মিয়া হয়তো আরও অনেকদিন বেঁচে থাকতেন। দরিদ্রের কষাঘাতে শেষে মৃত্যুকেই বরণ করে নিলেন। বুলবুলের মাথার মধ্যে এ চিন্তাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে। জব্বার মিয়ার দাফন হয়ে গেলে শামসুলের হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয় বুলবুল। তবে এবার তার মাথার মধ্যে অন্যরকম চিন্তা। গ্রামের কাউকে এভাবে মরতে দেবে না সে। অভাব থাকতে দেবে না এই গ্রামে। যে গ্রামে সে বড় হয়েছে, যে গ্রামে তার নাড়ি পোতা হয়েছে, সেই গ্রামের অন্তহীন দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতেই হবে তাকে।
ঢাকা পৌঁছে সে ভাবতে থাকে এ নিয়ে। গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলোর অবস্থার পরিবর্তন করতে একটা উপায় বের করতেই হবে। অবশেষে অনেক ভাবনা, চিন্তা, গবেষণা আর অগ্রজ চিন্তাবিদদের পরামর্শে বেড়িয়ে আসলো এক নতুন ধরণের ক্ষুদ্র ব্যবসার উপায়। এ যেন আলোক ঝলমলে এক নতুন দিগন্ত। এ ব্যবসা শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য নয়, সমাজসেবার জন্যেও। নতুন এই ব্যবসার নাম দেয়া হলো ‘দিগন্ত’। পরের মাসেই কয়েকজন লোক নিয়ে বুলবুল তার গ্রামে চলে এলো। গ্রামের কিছু মানুষকে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। প্রশিক্ষিত মানুষগুলো অন্যদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলো। একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলো। কয়েকজনকে মেশিন কিনে দেয়া হলো। এখন সেখানে প্রায় প্রতি ঘরে স্ন্যাক্স, ক্যান্ডি, বেভারেজ, ডেইরীসহ হরেক রকম খাদ্য তৈরি হচ্ছে। গ্রামের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটেছে। বুলবুলের মুখের না-বলা ভাষা বুঝে মনে হয় জব্বার মিয়া হয়তো শেষবারের আলোচনায় তাকে এরকম কিছু করতে বলেছিলো।
বছর তিনেক পর এই গ্রামেই সম্বর্ধনা দেয়া হচ্ছে বুলবুলকে। প্রত্যেকটি গ্রামে যদি কয়েকজন শিক্ষিত তরুণ যুবক এভাবে এগিয়ে আসে তাহলে দারিদ্র বলে আর কিছু থাকবে না। বক্তব্যের শেষে খোলা আকাশের দিকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে বুলবুল। হয়তো তার প্রিয় জব্বার চাচার আত্মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আমি পেরেছি জব্বার চাচা, আমরা পেরেছি। তুমি দেখো, আমরা পেরেছি।’
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৮৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/০১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast