পটকাভীতি
আসাদউল্লাহ সাহেবের কনিষ্ঠ কন্যার বিয়ে। আত্মীয়-স্বজনে ভরে গেছে বাড়ির প্রতিটি ঘর, উঠোনও খালি নেই। বাড়ির বাইরে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। সেখানেও মানুষ কম নয়। স্পিকারে ফুল ভলিউমে গান বাজছে। সব বিয়ের গান। কিছু মহিলা বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে বাজানো গানের সাথে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন। কেউ কেউ শুধু ঠোঁট নাড়াচ্ছেন। সমাজ বলে কথা! গানের কথার সাথে ঠোঁট না মিললেও সমস্যা নেই। কেউ কেউ জোর করেই ঠোঁট মেলাচ্ছে। মনে হচ্ছে অন্য কোন গান মিলছে তাদের ঠোঁটে, হয়তো কোন গানই মিলছে না। এ সময় সেটা লক্ষ্য করতে যাবে কে? সবাই আনন্দে মশগুল। বিয়ের মূল অনুষ্ঠান শুরু হতে হতে মধ্যরাত হয়ে যেতে পারে। বরযাত্রী আসেনি এখনও। তাতেই এতো মানুষ! বরযাত্রী আসলে তো ঠিকমত দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যাবে না।
‘এই চলো না, ঐ দিকে একটু ঘুরে আসি,’ প্যান্ডেলের নিচে একটি চেয়ারে বসে থাকা স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেন হোসনে আরা।
‘তুমি যাও।’
‘তোমাকে রেখে একা একা যাবো! ভালো দেখাবে?’
‘বসার জায়গা হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে সেটা ভালো দেখাবে বুঝি?’
‘দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যা কী?’
‘সমস্যা আছে।’
‘কী সমস্যা?’
‘নিজের থেকে অন্যদেরকে বড় মনে হয়।’
‘বসে থাকলেতো তোমাকে আরও ছোট লাগে। কেন যে এই রকম বাঁটু লোকটাকে আমি বিয়ে করতে গেলাম!’
‘আমাকে কখনও বাঁটু বলবা না, আগেই বলছিলাম না?’
‘একশোবার বলবো, হাজারবার বলবো। তুমি বাঁটু, তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী বাঁটু, তোমার বাপ বাঁটু, তোমার মা বাঁটু, তোমার বউ বাঁটু।’
‘হাহাহাহা।’
‘হাসছো কেনো?’
‘আমার বউ বাঁটু মানেতো তুমিও বাঁটু।’
‘আমি বাঁটু না। তুমি কি যাবা?’
‘না, বললাম তো।’
‘ধ্যাত! যাবো না তাহলে। মনে হচ্ছে আর কোথাও বসার জায়গা নেই? তুমি আর টুকির মধ্যে কোন তফাৎ নেই।’
টুকি হলো হোসনে আরার ননদের মেয়ে। টুকির ডেলিভারির পর টুকির মা ক্লিনিকেই মারা যায়। তারপর থেকে টুকি জাহিদের পরিবারেই থাকছে। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও পরিবারে সন্তান আসার কোনো লক্ষণ না থাকায় টুকিয়েই দত্তক নেন হোসনে আরা। টুকি অনেক জেদি। বিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেছেন তিনি। টুকি আসে নি। ফেসবুকে ঢুকলে ওকে অন্য কোথাও সরানো যায় না। হোসনে আরা বিরক্ত কিন্তু তেমন কিছু বলেন না। টুকিকে খুব আদর করেন। এইটুকুন মেয়ের ফেসবুকে অনেক বন্ধু। আজ শুক্রবার। শুক্রবারে ও পড়তে বসে না। ফেসবুকে সময় দেয়। বন্ধুদের সাথে তেমনটাই চুক্তি। সামিনা আছে বাসায়। বাসার একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বুয়া। সেই টুকিকে দেখেশুনে রাখবে। আর কী কী করতে হবে হোসনে আরা সব বলে দিয়ে এসেছেন।
‘তুমি সব সময় আমাকে টুকির সাথে তুলনা করো। যখন তখন তুলনা! ইহা কিন্তু ভালো না,’ জাহিদ বললেন।
হোসনে আরা কিছু বললেন না। স্বামীর পাশের চেয়ারটাতে বসলেন তিনি। বসতেই না বসতেই কে যেন তাঁর বাম পায়ের আঙুলে পারা দিয়ে চলে গেলো।
‘উফ!’ হোসনে আরা আঁতকে উঠলেন যেনো।
‘কী হলো?’ অন্যমনস্ক জাহিদ চমকে উঠলেন।
‘পায়ে পারা দিলো কে যেনো।’
‘পায়ে পারা দিলো আর আমি কিছুই টের পেলাম না!’
‘মরণ! আমার পায়ে পারা দিলে তুমি টের পাবে কি করে?’
‘ওহ তাই তো। কোন অনুষ্ঠানে গেলে পায়ে পারা খাওয়া ভালো।’
‘কেউ তোমার পায়ে পারা দিয়ে যাবে আর সেটা ভালো?’
‘হুম। এর মাধ্যমে তুমি বুঝতে পারো যে তুমি অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত আছো এবং জীবিত আছো।’
‘যত্তসব!’ হোসনে আরা বিরক্ত হলেন।
‘হ্যালো ভাই, আপনারা বুঝি বিয়েতে এসেছেন?’ এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন জাহিদকে।
বিয়ে বাড়িতেই বসে আছেন, এটা দেখেও একজন লোক কিভাবে এরকম অদ্ভুত বোকার মতো প্রশ্ন করতে পারেন জাহিদ সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। সরাসরি উত্তর দেবেন না, ঠিক করলেন।
‘জি না। আমরা স্টেডিয়ামে এসেছি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে।’
‘ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ক্রিকেট খেলে! হা হা হা। হাসালেন ভায়া।’
‘হাসি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।’
‘যথার্থই বলেছেন। তো পাশে বুঝি আপনার স্ত্রী?’
হতচকিত জাহিদ এবার যার পর নাই বিরক্ত হলেন।
‘না। উনি তো আপনার স্ত্রী।’
‘এই কী বলছো এসব! আমি ওনার স্ত্রী হতে যাবো কেনো?’ রেগে ক্ষেপে হোসনে আরা চেয়ার থেকে উঠে পড়েছেন।
‘তাহলে আপনি কার স্ত্রী?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি এই লোকের স্ত্রী,’ স্বামীকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন হোসনে আরা।
‘আপনি কেমন স্বামী ভাই? নিজের স্ত্রীকেই চিনতে পারছেন না!’
‘আপনার মতো লোকজন সামনে আসলে কার স্মৃতিশক্তি ঠিক থাকে বলুন।’
ভদ্রলোক এবার নিজ থেকেই চলে গেলেন। নিজেকে অপমানিত বোধ করলেন মনে হলো।
‘এই সোমা!’ উত্তেজনায় চিৎকার করলেন হোসনে আরা।
‘এই কে সোমা?’ জাহিদ জিজ্ঞেস করলেন তাঁর স্ত্রীকে।
‘আরে, আমার বান্ধবী সোমা। এই সোমার কথা তোমাকে কত্তবার বলেছি! ভুলে গেছো?’
জাহিদ মনে করতে পারলেন না। তাঁর স্ত্রী তাকে কখনও কোনো সোমার কথা বলেনি, নিশ্চিত তিনি। তাও স্ত্রীকে হতাশ করতে চাইলেন না।
‘ওমা! এই বুঝি সেই সোমা?’
‘হ্যাঁ গো, হ্যাঁ।’
সোমা হোসনে আরার ডাক শুনতে পেরেছেন। বান্ধবীর ডাক বলে কথা! তা নাহলে কি কেউ এই শব্দময় পরিবেশেও অন্য কারো ডাক শুনতে পারে?
‘কি রে হোসনে আরা! তুইও এসেছিস! উনি বুঝি আমার দুলাভাই?’
জাহিদ অবাক হলেন, ‘ইশ! এমনভাবে বলছে যেন আমি শুধু এই মহিলারই দুলাভাই।’
‘হুম। এই এ হচ্ছে আমার বান্ধবী সোমা। তোমাকে যার কথা অনেক অনেকবার বলেছি।’ স্বামীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন হোসনে আরা।
‘আপনি সেই সোমা! আপনার কথা কত্ত শুনেছি আপনার বান্ধবীর কাছে। চব্বিশ ঘন্টা শুধু আপনার কথাই বলে। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করেও বলে।’
‘হাহাহাহা, তোর সাহেব তো দেখি অনেক মজার, হোসনে আরা।’
‘ঐ আর কি! তা তুই একাই এসেছিস নাকি?’
‘নাহ রে, সেও এসেছে।’
‘তা দুলাভাই কোথায়?’
‘আমি বাচ্চাকে বাসার ভিতরে রেখে আসতে গিয়েছিলাম। ওতো এখানটাতেই ছিলো। ওকে খুঁজতে খুঁজতে তো এই দিকে এলাম। যাই হোক তোদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। ভালো লাগলো। কতদিন পর দেখা তাই না রে?’
‘হুম। তোর বেবি!’
‘হ্যাঁ রে। অনেকবছর পর বেবি নিয়েছি।’
‘কংগ্র্যাচুলেশানস রে। কত বছর বয়স?’
‘থ্যাংকস। কত বছর না। মাত্র পাঁচ মাস। আমি আসি রে? আবার দেখা হবে।’
‘আচ্ছা। দেখা করিস কিন্তু।’
‘ওকে, আসি দুলাভাই। আপনি কিন্তু অনেক মজার মানুষ।’
জাহিদ মুচকি হাসি দিলেন। সোমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, ‘আপনি বুঝলেন, আপনার বান্ধবী বুঝলো না এতোদিনেও।’ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার বান্ধবী খুব সুন্দর।’
‘এই চোখকে সামলাও।’
জাহিদ তাঁর স্ত্রীর চোখদুটি ঢেকে ধরতে গেলে হোসনে আরা হাতদুটি ধরে ফেলেন।
‘আমার চোখ না, তোমার চোখকে সামলাতে বলেছি।’
‘ওহ।’
সোমা তাঁর স্বামীকে খুঁজে পেয়েছেন।
তুমি ছিলে কোথায় আর এখন তোমাকে পেলাম কোথায়? কেনো যে আমাকে এভাবে ভোগাও তা একমাত্র তুমিই জানো।
‘আমার মনে হয়.........’
আরেফিন কথা শেষ করার আগেই সোমা বাঁধা দিলেন।
‘কী মনে হয় তোমার? তোমারতো আবার সারাক্ষণ শুধু এটা সেটা মনে হতেই থাকে।’
‘আমি বলছিলাম কী, আমাদের বোধ হয় না আসলেই ভালো হতো।’
আরেফিন রহমান সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন। বিয়ে বাড়িতে তো যেতেই চান না। বিয়ে বাড়িতে যে পটকা ফোটানো হয়, আতশবাজি হয়, সেগুলো তিনি সহ্য করতে পারেন না। ভালো লাগেনা তাঁর কাছে পটকার শব্দ আর আতশবাজির আগুণের ফুলকা। এটা বিয়ের অনুষ্ঠান পটকাবাজি, আতসবাজিতো হবেই হবে। আরেফিন খুব ভালো করেই জানেন এসব পটকাবাজি, আতসবাজি খুব ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
আসাদউল্লাহ্ সাহেবের বড় মেয়ে রুমা সোমার কলেজ জীবনের বান্ধবী। তাঁর দাওয়াতেই এখানে এসেছেন সোমা। রুমার অনুরোধেই স্বামী-সন্তানসহ আসতে হয়েছে। দিন পনের আগে দাওয়াত পেয়েছেন। স্বামী আরেফিন রহমান শুরু থেকেই দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। স্ত্রীর জোরাজোরিতে শেষমেশ আসতেই হলো। সোমা পটকা ফুটানো, আতসবাজি খুব পছন্দ করেন। স্বামীর অনিচ্ছার কারণেই বাড়ির কোন অনুষ্ঠানে এগুলোর আয়োজন করতে পারেন না। আজ চান্স ছাড়বেন না মনে হচ্ছে। প্যান্ডেলের পাশে নানা বয়সের কিছু মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। এখন আতসবাজি আর পটকা ফুটানো শুরু হবে। ছেলেমতো কেউ একজন এসে সোমাকে বললো, ‘আন্টি, আপনি নাকি আতসবাজি দেখবেন, পটকা ফোটাবেন?’
‘হুম রে বাবা, কে বললো তোমাকে?’
‘ঐ যে, আম্মু, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মুই তো আপনাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো যে আপনাকে ডাকতে।’
‘ওহ! শর্মিলি? তুমি যাও। আমরা আসছি।’
বাচ্চারা চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। দু একটা পটকা বাজতে শুরু করেছে। দুমদুম করে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। দুপদাপ লাফাতে লাগলো আরেফিনের হৃদপিণ্ড। স্ত্রীর হাত ধরে বললেন, ‘আমি এই জন্যেই আসতে চাইনি। না আসলে বোধ হয় ভালো হতো, সোমা।’
‘এই এক কথা আর কতো বার বলবে বলোতো?’
সোমা সত্যিই অনেক বিরক্ত হয়ে গেছেন। উৎসব উপভোগ করার আয়োজন, ভয় পাবার নয়। সোমা এটা আরেফিনকে বোঝাতেই পারেন না। স্ত্রীর ক্ষোভে থতমত খেয়ে গেলেন আরেফিন। আর কিছু বললেন না। এমনিতেই এখানে আসার পর থেকে মনটা থমথমে হয়ে আছে, সোমার ধমক থমথমে মনটাকে একেবারে চুপসিয়ে দিলো।
উপরের ঘরে অক্ষরকে ঘুম পারিয়ে রেখে এসেছেন সোমা। অনেকক্ষণ চলে গেছে। ছেলেটা ঠিকমত ঘুমোচ্ছেতো? সোমা ভাবলেন। এদিকে পটকা ফুটছে। আতসবাজিও চলছে। সোমা সেটা মিস করতে চাইলেন না। স্বামীকে এভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে ভালো লাগলো না তাঁর। শেষমেশ তাঁকেই বললেন উপরে যেয়ে অক্ষরকে দেখে আসতে। মাথা নেড়ে সায় জানালেন আরেফিন। উপরের কোন রুমে অক্ষরকে শুইয়ে রাখা হয়েছে সেটা আরেফিন জানেন না। একটু এগিয়ে গিয়ে তাই আবার ফিরে আসলেন। দূর থেকে জিজ্ঞেস করলে সোমা শুনতে পারবেন না। দুমদুম করে পটকা ফুটছে। তার চেয়ে ঢের বেশী শব্দে চিৎকার করছে ছোট ছেলেমেয়েগুলো। কিছু মহিলাও বাচ্চাদের সাথে তাল মেলাচ্ছেন। আরেফিন সোমার কাছাকাছি গিয়ে সোমার কান বরারর মুখটা রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন রুমে?’
‘ঘুমে? ও বাচ্চা ঘুমাচ্ছে? ওকে, ভালো, ঘুমাক।’
‘তুমি এইখানে থাকো। একটু এনজয় করো। তোমারো ভালো লাগবে। অতীতের ঘটনা নিয়ে এখনও ভয়-ডর থাকলে চলবে?’
সোমার কথায় আরেফিন বিরক্ত হলেন। কিছু করার নেই। সোমার আনন্দে কখনও ভাটা পড়তে দেননি তিনি। সোমার কথার উপর কথাও বলেন না। কথায় কথা বাড়ে। সোজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘অক্ষরকে যে রুমে শুইয়ে রেখে এসেছো সেই রুমটা উপরের কোথায়?’
‘ওহ,তুমিও যে না! এই কথাটা এতক্ষণ পর জিজ্ঞেস করছো? উপরের গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তো বলে দিতো। উপর তলার সিঁড়ির ডানদিকের বাড়তি রুমটাতেই অক্ষর আছে। যাও দেরী করো না। যে শব্দ হচ্ছে। বেবির ঘুমটাই ভেঙ্গে গেলো কিনা। যাআআআআআআআআআআও।’
এরকম বুক কাঁপানো শব্দে অক্ষরের ঘুম ভাঙলো কিনা, বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে কিনা সেটা সোমা নিজে দেখতে গেলো না, এটা আরেফিনকে একটু ভাবালো। সোমা অক্ষরের আদর যত্নে অবহেলা করে না, তবে আজ কেনো? আরেফিন সত্যিই অবাক হলেন। ওপর তলায় শব্দের তীব্রতা এরকম হবে না হয়তো; অক্ষর হয়তো নিরাপদেই ঘুমাচ্ছে, আরেফিন ভাবলেন।
‘ঠিক আছে, আমি তাহলে বেবিকে দেখে আসি,’ সোমার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।
সোমা খেয়ালও করলেন না হয়তো। আরেফিন যখন ওপরতলার দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন, সোমা পিছন ফিরে তাকালেন। সোমা ভালো করেই জানেন তাঁর স্বামী আতসবাজি, পটকাবাজি একদমই পছন্দ করেন না। এগুলো থেকে অনেকদূরে থাকেন। আজকের পটকাবাজিও আরেফিন একদম সহ্য করতে পারছেন না, সোমা সেটা বুঝেছেন। স্বামীর এই পটকাভীতিটা দূর করবার চেষ্টা করেন। আজকেও তাই করছেন। সে চেষ্টায় কাজ হচ্ছে না, বুঝতে পেরেছেন। তাই হয়তো ইচ্ছে করেই নিজে অক্ষরকে দেখতে না যেয়ে আরেফিনকেই পাঠালেন। তাছাড়া এরকম মুহূর্তগুলো উপভোগ করার জন্য। সোমা সেটাই করছেন।
আরেফিন উপরে যেতে যেতে কয়েকবার পিছনে তাকালেন। সোমা সত্যিই অনেক উপভোগ করছে পটকা ফুটানো আর আতসবাজি। ‘ও যখন সত্যিই খুব উপভোগ করছে, করুক না,’ ভাবলেন তিনি।
দোতলায় উঠার সিঁড়ির পাশেই বিশাল বড় রান্না ঘর। আসাদউল্লাহ সাহেব বাড়ি বানিয়েছেন একখানা! কি বিশাল বিশাল রুম। শোবার কক্ষগুলো অন্য স্বাভাবিক বাড়ির ড্রয়িং রুমের মতই বড়। রান্না ঘর থেকে সুগন্ধ আসছে। এখন নিশ্চিত পোলাও রান্না হচ্ছে। খাবারের প্রতি এক ধরণের বাতিক আছে আরেফিনের। প্রায় সময় তিনি নিজেই রান্না করেন। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনগুলোতে রান্না ঘরে সোমার চেয়ে তাঁকেই দেখা যায় বেশী। আরেফিনের রান্নার হাত খারাপ নয়। সোমাও মজা করে আরেফিনের রান্না গলধঃকরণ করেন। রান্না ঘর থেকে রুমার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। রন্ধনশিল্পী হিসেবে রুমার খ্যাতি আছে। কোন এক টিভি চ্যানেলে রান্নার অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন তিনি। কোন চ্যানেল, আরেফিন মনে করতে পারছেন না এই মুহূর্তে। সোমা সেই অনুষ্ঠানের একনিষ্ঠ দর্শক। রান্না শিখতে টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে হবে? এটাতো ক্রিয়েটিভিটির ব্যাপার, আরেফিন নিজে নিজে বললেন। রুমা নিজেই যখন তদারকি করছেন রান্না খুব ভালো হবে, ভাবলেন তিনি। এসব ভাবতে ভাবতেই কিছুটা সময় চলে গেছে। আরেফিন আর দেরী করলেন না। তাড়াতাড়ি করে ডানদিকের বাড়তি রুমটিতে ঢুকে পড়লেন। রুমে অক্ষর ছাড়া আর কেউ নেই। বাচ্চাটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে দেখে খুব ভালো লাগলো আরেফিনের। বাইরের পটকা ফোটার সব্দ অক্ষরের ঘুমে বাঁধার সৃষ্টি করেনি তাহলে। বাড়তি রুম হলেও কোন ছোটখাটো রুম নয় এটিও। দুটা বিশাল পালঙ্ক আছে। অন্যান্য কিছু আসবাবও আছে। সম্ভবত বাড়িতে কোন অতিথি এলে এখানে থাকতে দেয়া হয়। একটি পালঙ্কে অক্ষর ঘুমাচ্ছে। দুইদিকে দুইটা কোলবালিশ রাখা হয়েছে। একটা পাতলা কাঁথা দেয়া হয়েছে অক্ষরের শরীরের উপর। বাচ্চাটা কত আরামে ঘুমাচ্ছে! ঘুমন্ত অক্ষরের মুখটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন আরেফিন। ফিসফিস করে বললেন, ‘ঐ পচা, পটকার আওয়াজে তোমার ভয় পেয়ে কাজ নেই। তুমিতো বীরপুরুষ। প্রিন্স অব ফিয়ারলেসনেস।’ অক্ষরের কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। অক্ষর নড়লও না একটু। সত্যিই খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। বাচ্চার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন আরেফিন। বাইরে থেকে আতসবাজির আলো এ রুমেও ঢুকছে। প্রতিটি আলোকপুচ্ছ আরেফিনের হৃদয়ে কাঁপুনি তুলছে। এসব পটকাবাজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বাইরে বের হবেন না, আরেফিন ঠিক করলেন। জানালাটা একটু ভিড়িয়ে দিলেন। অক্ষরের দিকে তাকিয়েই আছেন। নিষ্পাপ শিশুটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কোন এক ভাবনার জগতে হারিয়ে যান। হঠাৎ করে কেউ একজন রুমে ঢুকে। আরেফিনের সম্ভিত ফিরে আসে।
‘আংকেল,’ খুশি গলায় বললো একটি ছেলে
‘তুমি কে?’ আরেফিন আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলেন
‘আমি হিমেল।’
‘তুমি কার ছেলে?’
‘আপনি রুপাকে চেনেন?’
‘হুম, চিনি, তুমি বুঝি রুপার ছেলে?’
‘জী আংকেল।’
‘আমি তোমার আম্মুর বান্ধবীর.........’
আরেফিনের কথা শেষ না হতেই হিমেল নিজেই বাকিটা বলে দিলো।
‘আমি জানি। সোমা আন্টিই আমাকে পাঠালেন। আপনি নিচে যাবেন না? বাগানে আতসবাজি চলছে। পটকাও ফুটছে। ঐ দেখেছেন আবার ফুটলো?’
এই হিমেলকে সম্ভবত দুই বছর আগে সর্বশেষ দেখেছিলেন আরেফিন। রুমা স্বামীসহ বেড়াতে গিয়েছিলেন সোমার বাড়িতে। হিমেল তখন বারো-তেরো বছর বয়সী ছিলো। দুবছরে হিমেল অনেক বড় হয়ে গেছে। বয়সের চেয়ে বেশী লম্বা হয়ে গেছে। ছেলেটার সামনে নিজেকে কেমন যেনো বোকা-বোকা লাগলো আরেফিনের।
‘আংকেল আপনি এখানে কেনো?’
সবাই যখন বাইরে আনন্দ করছে, তখন আরেফিনের মতো একজন মানুষ এভাবে রুমে বসে থাকবে, এটা হিমেলের কাছে ঠিক লাগলো না। আরেফিন সেটা বুঝতে পারলেন। হিমেলের প্রশ্নে অনেকটা থতমত খেয়ে গেলেন তিনি।
‘অ-অ-অক্ষরকে দেখতে এসেছিলাম।’
‘ওর এখানে কোন সমস্যা হবে না, আংকেল। এখানে কেউ ডিস্টার্ব করতে আসে না। আপনি চলেন। এখানে থাকলে পটকা ফোটানো দেখবেন কি করে? আতসবাজির মজা পাবেন না তো।’
ছেলেটা কত চঞ্চল! ঠিক মায়ের মতো। রুপাও অনেক চঞ্চল। হিমেলের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন আরেফিন।
‘কী হলো, আংকেল? যাবেন না? চলুন।’
হিমেল নিজে থেকেই দরজাটা মেলে ধরে আছে। বুঝা যাচ্ছে, বাইরে যে পটকাবাজি-আতসবাজি চলছে হিমেল তার একটুও মিস করতে চাচ্ছে না। উপর তলায় আসার কারণে সে ইতিমধ্যে কিছুটা আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। আরেফিন বুঝলেন সেটা। ছেলেটাকে তাই নিরাশ করলেন না। যে জিনিসটা খুব অপছন্দ করেন সেটার কাছেই যেতে হচ্ছে বলে বেশ খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। কিশোর হিমেলের সেটা খেয়াল করার বয়স নয়। ফ্যাকাসে মুখেই হাসলেন আরেফিন।
‘হুম, চলো।’
হিমেলের পিছু পিছু নিচে চলে গেলেন আরেফিন। করার কিছুই নেই। এভাবে রুমের ভিতর অক্ষরের পাশে বসে থাকলেও কেউ যদি রুমে আসে তাহলে বিভিন্ন প্রশ্ন করবে। হিমেল পিছনে তাকালো না। খুব দ্রুত হেঁটে আতসবাজিতে যোগ দিলো। নিজেও কয়েকটা পটকা নিয়ে ফুটানো শুরু করলো। সোমা এখনও সেখানেই আছে। হিমেল সম্ভবত আরেফিনের নিচে আসা সম্পর্কে সোমাকে বলেছে। সোমা পিছনে তাকালে আরেফিন তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন তিনিও সেখানে উপস্থিত। সোমা মুচকি হেসে আরেফিনকে তাঁর কাছে যেতে বললেন। আরেফিন সোমার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটা হাত সোমার কাঁধের উপর রেখে মৃদু চাপ দিলেন।
‘বাচ্চার কী খবর?’ প্রশ্ন করলেন সোমা।
‘ভালোই আছে। ঘুমাচ্ছে। এখন যে রকম শব্দ হচ্ছে, ওর ঘুম না ভাঙলেই হয়।’
‘অতো ভেবেনাতো। ঘুম ভাঙবেনা। তুমি এনজয় করো।’
সোমা খুব ভালো করেই জানেন, আরেফিন এসব একেবারেই এনজয় করেন না বরং এর থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকতে পারলেই স্বস্তি বোধ করেন। তারপরেও সবার সাথে তাল মেলাতেই হয়তো আরেফিনকে এ আতসবাজি এনজয় করতে বললেন। ‘দুমদুম’ করে ততক্ষণে আরও কিছু পটকা ফুটলো। পটকাগুলো আরেফিনের বুক বিদ্ধ করলো বলে মনে হলো। আরেফিন এসব অহেতুক আয়জনের প্রতিবাদ করতে চাইলেন। অন্ততঃ সোমাকে তাঁর এই প্রতিবাদের কথা জানাতে চাইলেন। পারলেন না। তাঁর প্রতিবাদের ইচ্ছেকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে একের পর এক পটকা ফুটতে লাগলো। আতসগুলো শো শো করে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। সাঁঝের আকাশ যেনো ঝলসে যাচ্ছে। আগুণের ফুলকিগুলো তীরের মতো করে নিচে নামছে। সবাই উল্লাসে চিৎকার করছে। সোমাও সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছেন। পটকার শব্দের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে সোমার চিৎকার, অন্য সবার চিৎকার। সব শব্দ এক হয়ে আরেফিনের কানের ভিতর দিয়ে সোজা বুকে আঘাত করছে। এরকম অবস্থায় নিজেকে কাহিল মনে করলেন আরেফিন। সত্যি আর সহ্য হচ্ছে না তাঁর। সোমা আর পিছন ফিরে তাকাচ্ছেন না। আরেফিনের দিকে আর কোন খেয়ালই নেই তাঁর।
‘সোমা এতো নিষ্ঠুর কেনো?’ আরেফিন ভাবলেন।
এরকম পটকা আর আতসবাজিতে উপস্থিত থেকে আরেফিন নিশ্চয়ই অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। স্বামীর এই সাহসিকতার বিন্দুমাত্র মূল্য দিচ্ছেন না সোমা। একের পর এক পটকা বেজে চলেছে। আতসবাজি চলছে। একটা করে রকেট উড়ে যাচ্ছে আকাশে আর সোনালী, রুপালী, নীল, লাল, সবুজ শিসগুলো ছুঁড়ে এসে পড়ছে মাথার উপর। ফটাফট শব্দে ফাটছে এগুলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে ছোট ছেলেমেয়েগুলো। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে আইবুড়োগুলো। সবার মুখে যেনো বিস্ময়ের গগনবিদারী ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। চিৎকার করার পর একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। আতসবাজির আলোয় চারদিক আরও আলোকিত হচ্ছে। পটকার শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছে যে এটা একটা বিয়ে বাড়ি। তাও আবার আসাদউল্লাহ সাহেবের কনিষ্ঠ মেয়ের বিয়ে। লাউড স্পিকারে বাজছে গান। গান বাজছে কারও কারও ঠোঁটে। পরিস্থিতি অনেক আগেই আরেফিনের সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। আচমকা একটা পটকা কামানের গোলার মতো বিকট শব্দে ফুটে চারদিকে আগুণের ফুলকি ছড়িয়ে দিলো। সে আওয়াজে কেঁপে উঠলো সব কজন মানুষ। চিৎকার ছেড়ে নীরব হয়ে গেলো প্রত্যেকে। থতমত বোকাটে মুখগুলোতে মুহূর্তেই হাসি ফুটলো।
আরেফিন হাসলেন না, বিরক্ত হলেন। আগের চেয়ে আরও বেশী বিরক্ত তিনি। স্ত্রীর কাছ থেকে ছিটকে সড়ে গিয়ে সটান দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলেন। দুহাতে কান চেপে ধরে রাখলেন। একের পর এক রোমান ক্যান্ডেল ছোঁড়া হচ্ছে আকাশে। সোনালী ফোয়ারাগুলো নিচের দিকে ঢলে পড়ছে। আরেফিন চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কটু গন্ধের ধোঁয়া বাতাসে ভাসছে। আরেফিনের নাকে-মুখেও লাগছে সে ধোঁয়া। হঠাৎ কেউ একজন তাঁর পিঠে হাত দিলেন। চোখ না খুলেই আরেফিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’
‘আচ্ছা ভাই, আপনি আমার মিসেস কে দেখেছেন?’
এতো শব্দের মধ্যে আরেফিন সে প্রশ্ন ঠিকমতো শুনতে পেলেন না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আপনি?’ আরেফিনের চোখ তখনও বন্ধ। যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর।
‘হোসনে আরাকে দেখেছেন?’
‘দেখছেন না আমার চোখ বন্ধ?’
‘হুম, তা দেখতে পাচ্ছি। অনেকে চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। মনের চোখ দিয়ে দেখে।’
‘জী না। আমার মনে কোনো চোখ নেই। আপনি যার খোঁজে এসেছেন তাঁকেই খুঁজুন।’
‘আপনার স্ত্রী আপনার কাছে আছে তো? বিয়ে বাড়িয়ে স্ত্রী হাতবদল হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।’
‘আমার স্ত্রী সেরকম নয়।’
‘আমার স্ত্রীও সেরকম নয়। তবুও বড় ভয় হয়। দুটা নয়, চারটা নয়। ঐ একটা মাত্র স্ত্রী আমার। সে না থাকলে আমার কী হবে! টুকির কী হবে?’
‘টুকিটা কে?’
‘টুকি হচ্ছে আমার ছোট বোনের একমাত্র মেয়ে। জন্মের পর থেকেই......। ধুর, আপনি আপনাকে এতোসব কথা বলতে যাবো কেনো? আচ্ছা ভায়া, আপনি কি চোখ খুলবেন না?’
‘না।’
‘চোখ বন্ধ করে রাখা ভালো। চোখের বিশ্রাম হয়। আপনার শরীরের যে কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের চেয়ে চোখ খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আমি কি আপনার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি?’
‘থাকুন। নিষেধ করেছে কে?’
‘না। তা কেউ করেনি। কিন্তু এভাবে এখানে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকা কি নিরাপদ?’
‘চোখ খুলে যা দেখবেন তাতেও তো বড় বিপদ।’
‘তা যথার্থই বলেছেন।’
দুচোখ বন্ধ করে আরেফিনের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন জাহিদ। স্ত্রীকে খোঁজার জন্য এদিকে এসেছেন। সেটা ভুলে গেলেন। পটকা ফুটছে। আতসবাজি চলছে। আগের চেয়ে আরও বেশী। গান বাজছে। আগের চেয়ে আরও বেশী শব্দে। আবার একটা পটকা কামানের গোলার মতো তোপধ্বনি দিলো। আরেফিন দু’কান সজোরে চেপে ধরে রেখেছেন। চমকে উঠলেন জাহিদ। এই শব্দে তাঁর মনে হলো তিনি বিশেষ কোনো কারণে এদিকে এসেছেন।
‘আচ্ছা, ভায়া। আমি এদিকে এসেছি কেনো?’
‘আপনার স্ত্রীকে খুঁজতে এসেছেন।’
‘ধন্যবাদ। স্ত্রীকে হাতছাড়া করবেন না কখনও। বিশেষ করে বিয়ে বাড়িতে। একেবারে বগলদাবা করে রাখবেন। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে।’
‘আসি ভায়া?’
‘উদ্ধার করুন।’
‘কাকে?’
‘আপনার স্ত্রীকে?’
‘জী জী। হোসনে আরা.........হোসনে আরা। কেনো এভাবে আমাকে করো পাগলপারা?’
স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে চলে গেলেন জাহিদ। আরেফিন ঠায় দাঁড়িয়েই আছেন। সোমার কোনো সাড়া নেই। আতসবাজিতে মশগুল তিনি। ছোট বেলার ভয়ানক স্মৃতিগুলো ঘুরে ফিরে আসছে আরেফিনের মনে। যে স্মৃতিগুলো ভুলে যেতে চান একেবারে সেগুলোই আবার মনের গহীনটাকে বিদ্ধ করে বাইরে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে যেনো।
আরেফিনের বয়স যখন হিমেলের মতো ছিল, চৌদ্দ কি পনেরো হবে, তখনই ঘটলো তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়ানক দুর্ঘটনাটা। মিরপুর বাঙলা কলেজের পাশেই বাড়ি। শবে বরাতের রাত। পাড়ার সব বন্ধু এক হয়ে অলিতেগলিতে হৈচৈ করছিলো। তারপর সবাই মিলে আরেফিনের বাবার শেডে জড়ো হয়। সকালে চকবাজার থেকে এক বাক্স পটকা কিনে আনে সব বন্ধুরা মিলে। এক বাক্সে ত্রিশটা পটকা। ওগুলো দিয়ে তিনটা বড় মাপের বাজি বানানোর ইচ্ছা ছিলো সব বন্ধুর। আরেফিন একটা ছুরি দিয়ে পটকাগুলো চিঁরে বারুদ ঢালেন একটা পাত্রে। আর তাঁর এক বন্ধু শামিম তা নাড়তে থাকে।
কাজ শেষ হয়ে গেলে বিশালাকারের পটকা তিনটা দেখে সব বন্ধুর চোখ জুড়িয়ে যায়।
‘এই পটকা দ্যাইখা তো হরতালের পিকেটাররাও ভয় পাইয়া যাইবো রে, আরেফিন,’ আরেফিনের দিকে তাকিয়ে অতি আনন্দে কথাটা বলে শামিম।
‘হ রে, ঠিক কইছোস। আমরা...’
আরেফিনের কথা শেষ হতে না হতেই তাঁদের আরেক বন্ধু মিল্টন শামিমকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে ওঠে।
‘ঐ ঐ, করোস কী? করোস কী? না না!’
শামিমের হাতে একটা দিয়াশলাইয়ের বাক্স দেখে চিৎকার করে ওঠে মিল্টন। কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। শামিম চেয়েছিলো পাত্রে পড়ে থাকা সামান্য বারুদে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে আগুণ লাগাবে। দুর্ভাগ্য, যখন সে বারুদ নাড়ছিলো তখন কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বারুদ কণা বাতাসে ভেসে ওঠে। ওরা কেউ খেয়াল করেনি। শামিম দেয়াশলাইয়ের কাঁঠি জ্বালানো মাত্রই বারুদ-কণায় আগুণ ধরে যায়। দাউ দাউ করে আগুণ জ্বলে ওঠে।
প্রথম বিস্ফোরণে দরজা ভেঙ্গে বাইরে উড়ে গিয়ে পড়ে শামিম। আরেফিনের দুর্ভাগ্য। আনন্দের জন্য বড় বড় যে তিনটি পটকা তৈরি করেছিলো সব বন্ধুরা মিলে সেগুলোই বড় বিপদের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। পটকাগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। সবাই কমবেশি আহত হয়েছিলো। শামিমের অবস্থা ছিলো সবচেয়ে খারাপ। এক সপ্তাহ লড়াই করে শেষে মৃত্যুর কছে হার মানে সে। দু’দিন বাদে হাসপাতালে জ্ঞান ফেরে আরেফিনের। উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন তিনি। হাত, পা আর পিঠ বিশ্রীভাবে পুড়ে যায়। ‘জানে বেঁচে গেছে ছেলেটা। এটাই তো অনেক,’ ডাক্তার বলেছিলেন।
হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে অন্যরকম মানুষে পরিণত হন আরেফিন। আগের চঞ্চলতা, চটুলতা আর নেই। বাড়িতেই থাকতে চাইতো না যে ছেলেটা সেই ঘরের কোণ ছেড়ে বাইরে যেতে চান না আর। কেমন লাজুক আর জড়সড় হয়ে পড়েন তিনি। গায়ের জামা খুলতে রাজি হতেন না কোনমতেই। সুতির মোজা পরে হাত পায়ের পোড়া দাগ ঢাকার চেষ্টা করেন। সেই ঘটনার পর থেকে মেয়েদের সাথে সহজে মিশতে পারতেন না। এক বিয়ে বাড়িতে সোমার সাথে পরিচয় হয় তাঁর। কথা বলবেন না বলবেন করে কথা হয় সোমার সাথে। ভালো লেগে যায় সোমাকে। প্রথম দেখাতেই সোমার প্রেমে পড়ে যান আরেফিন। সোমাই তাঁর জীবনে প্রথম নারী। চুটিয়ে প্রেম করেন কয়েক বছর। বিয়ে হয় দুই পরিবারের সম্মতিতেই। বিয়ের আগেই নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা সোমাকে বলে দেন আরেফিন। অতি ভালোবাসার কাছে পুড়ে যাওয়া কিছু ক্ষত বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। তারপর সোমা অনেক চেষ্টা করেছেন আরেফিনের এই আতসবাজি-পটকাবাজিভীতি দূর করার জন্য। কিন্তু পারেন নি।
‘এই তুমি এখানে দাঁড়িয়ে!’ আরেফিনের হাত টেনে ধরে বললেন সোমা।
একটু পর দু’কান থেকে হাত নামিয়ে নিলেন আরেফিন। এপাশ ওপাশ তাকালেন। ‘সোমা গেলো কোথায়?’ নিজে নিজে জিজ্ঞেস করলেন। পটকার শব্দ কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেছে। উপর থেকে বাচ্চার কান্না আরেফিনের কানে আসছে। হন্তদন্ত হয়ে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন তিনি।
রান্না ঘরের পাশ কাটিয়েই শুনতে পেলেন সোমার কণ্ঠ, ‘এই যে আব্বু, বাবু সোনা, আমি এসে পড়েছি। দেখো, আম্মু এসে গেছে।’
আরেফিন আরও এগিয়ে গেলেন। উপরতলার বাড়তি রুমটার কাছে যেতেই একটু থমকে দাঁড়ালেন। সোমার কথা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে রুমে আরও কেউ আছে। বাচ্চার কান্না চলছে।
‘বাচ্চাটা ভয় পেয়েছে রে সোমা।’
কথাটা রুমা বলছে বলে মনে হলো। ‘ওর বাপেই তো অনেক ঘাবড়ে গেছে দেখলাম,’ একই কণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারিত হলো।
‘কাঁদে না, কাঁদে না, আব্বু, সোনা আমার,’ রুমা বললো।
‘ছোটবেলায় পটকা ফুটাতে যেয়ে অল্পের জন্য ওর বাবা প্রাণে বেঁচে গেছে...... ওকে,’ কথা বলতে বলতে বিরতি নিলেন সোমা। ‘লোকটার কাণ্ডকীর্তি দেখলে আমার লজ্জায় মাথা কাঁটা যায়। অনেক চেষ্টা করলাম। মানুষটাকে সাহসী বানাতে পারলাম না।’
‘এটুকুতেই এই দশা!’ অন্য কেউ বললো।
‘বিদেশে হরহামেশা এরকম উৎসব হয়। বিদেশে গেলে উনি কী করতেন?’ রুমা বললেন।
‘শুধু পটকা-আতসবাজিতেই নয়, তাঁর সব কিছুতেই ভয়,’ শান্ত স্বরে কথা বলছেন সোমা।
‘সব কিছুতেই মানে?’ কেউ একজন জিজ্ঞেস করলো সোমাকে।
‘পানি, কুকুর, উঁচু জায়গা, ড্রাইভিং, হাইওয়ে, অতীত, ভবিষ্যৎ- সব কিছুতেই ভয়। মানে ও এখনও ছেলেমানুষই রয়ে গেছে রে, রুমা।’
‘তাই তো দেখছি রে,’ সায় দিলেন রুমা।
‘এক্কেবারে মায়ের আঁচল ধরা খোকার মতো।’ কথাগুলো বলতে বলতে কান্না শুরু করলেন সোমা। ‘আমি এখন কাকে সামলাবো? বাচ্চাকে নাকি বাচ্চার বাপকে?’
‘আমি বুঝতে পারিনি রে, সোমা। সরি, কিছু মনে করিস না,’ রুমা বললেন।
‘আমার মনে হয় কী জানো সোমা, তুমি ওনাকে ভালো কোনো মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত,’ অন্য কেউ সোমার উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সোমা। বাইরে থেকেই সেটা বুঝতে পারলেন আরেফিন।
‘সে কি আর নিয়ে যাইনি ভেবেছো?’ সোমা বললেন। ‘আমি অনেক সহ্য করেছি, আর পারছি না।’
সোমার কণ্ঠস্বর আগের চেয়ে সংযত মনে হলো। সবাই চুপ হয়ে গেছে। কারও কথা শোনা যাচ্ছে না আর।
সোমার কথাই শোনা গেলো, ‘আমি ঠিক করেছি আলাদা হয়ে যাবো।’
দু’চোখ বুঝে এলো আরেফিনের। পায়ের জোর ক্রমশ কমে যাচ্ছে যেনো। মনে হচ্ছে পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানগুলো নতুন করে পুড়তে শুরু করেছে। কানে বাজছে সেই চিৎকার ‘না না!’। মাথার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে যেনো। মনে হচ্ছে চারদিকে দুমদুম করে পটকা ফুটছে। দু’কান চেপে ধরে নিচের তলার দিকে হাঁটা শুরু করলেন আরেফিন। অতীতের সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি খুব বেশী করে আঁকড়ে ধরেছে তাঁকে। মাথার ভেতর কানে তালা লাগানো শব্দ চলছে আর আলোর চোখ ধাঁধানো ঝলকানি। পটকা ফুটেই চলেছে একটার পর আরেকটা, তারপর আরও একটা।
‘এই চলো না, ঐ দিকে একটু ঘুরে আসি,’ প্যান্ডেলের নিচে একটি চেয়ারে বসে থাকা স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেন হোসনে আরা।
‘তুমি যাও।’
‘তোমাকে রেখে একা একা যাবো! ভালো দেখাবে?’
‘বসার জায়গা হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে সেটা ভালো দেখাবে বুঝি?’
‘দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যা কী?’
‘সমস্যা আছে।’
‘কী সমস্যা?’
‘নিজের থেকে অন্যদেরকে বড় মনে হয়।’
‘বসে থাকলেতো তোমাকে আরও ছোট লাগে। কেন যে এই রকম বাঁটু লোকটাকে আমি বিয়ে করতে গেলাম!’
‘আমাকে কখনও বাঁটু বলবা না, আগেই বলছিলাম না?’
‘একশোবার বলবো, হাজারবার বলবো। তুমি বাঁটু, তোমার চৌদ্দগোষ্ঠী বাঁটু, তোমার বাপ বাঁটু, তোমার মা বাঁটু, তোমার বউ বাঁটু।’
‘হাহাহাহা।’
‘হাসছো কেনো?’
‘আমার বউ বাঁটু মানেতো তুমিও বাঁটু।’
‘আমি বাঁটু না। তুমি কি যাবা?’
‘না, বললাম তো।’
‘ধ্যাত! যাবো না তাহলে। মনে হচ্ছে আর কোথাও বসার জায়গা নেই? তুমি আর টুকির মধ্যে কোন তফাৎ নেই।’
টুকি হলো হোসনে আরার ননদের মেয়ে। টুকির ডেলিভারির পর টুকির মা ক্লিনিকেই মারা যায়। তারপর থেকে টুকি জাহিদের পরিবারেই থাকছে। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও পরিবারে সন্তান আসার কোনো লক্ষণ না থাকায় টুকিয়েই দত্তক নেন হোসনে আরা। টুকি অনেক জেদি। বিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেছেন তিনি। টুকি আসে নি। ফেসবুকে ঢুকলে ওকে অন্য কোথাও সরানো যায় না। হোসনে আরা বিরক্ত কিন্তু তেমন কিছু বলেন না। টুকিকে খুব আদর করেন। এইটুকুন মেয়ের ফেসবুকে অনেক বন্ধু। আজ শুক্রবার। শুক্রবারে ও পড়তে বসে না। ফেসবুকে সময় দেয়। বন্ধুদের সাথে তেমনটাই চুক্তি। সামিনা আছে বাসায়। বাসার একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বুয়া। সেই টুকিকে দেখেশুনে রাখবে। আর কী কী করতে হবে হোসনে আরা সব বলে দিয়ে এসেছেন।
‘তুমি সব সময় আমাকে টুকির সাথে তুলনা করো। যখন তখন তুলনা! ইহা কিন্তু ভালো না,’ জাহিদ বললেন।
হোসনে আরা কিছু বললেন না। স্বামীর পাশের চেয়ারটাতে বসলেন তিনি। বসতেই না বসতেই কে যেন তাঁর বাম পায়ের আঙুলে পারা দিয়ে চলে গেলো।
‘উফ!’ হোসনে আরা আঁতকে উঠলেন যেনো।
‘কী হলো?’ অন্যমনস্ক জাহিদ চমকে উঠলেন।
‘পায়ে পারা দিলো কে যেনো।’
‘পায়ে পারা দিলো আর আমি কিছুই টের পেলাম না!’
‘মরণ! আমার পায়ে পারা দিলে তুমি টের পাবে কি করে?’
‘ওহ তাই তো। কোন অনুষ্ঠানে গেলে পায়ে পারা খাওয়া ভালো।’
‘কেউ তোমার পায়ে পারা দিয়ে যাবে আর সেটা ভালো?’
‘হুম। এর মাধ্যমে তুমি বুঝতে পারো যে তুমি অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত আছো এবং জীবিত আছো।’
‘যত্তসব!’ হোসনে আরা বিরক্ত হলেন।
‘হ্যালো ভাই, আপনারা বুঝি বিয়েতে এসেছেন?’ এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন জাহিদকে।
বিয়ে বাড়িতেই বসে আছেন, এটা দেখেও একজন লোক কিভাবে এরকম অদ্ভুত বোকার মতো প্রশ্ন করতে পারেন জাহিদ সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। সরাসরি উত্তর দেবেন না, ঠিক করলেন।
‘জি না। আমরা স্টেডিয়ামে এসেছি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে।’
‘ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ক্রিকেট খেলে! হা হা হা। হাসালেন ভায়া।’
‘হাসি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।’
‘যথার্থই বলেছেন। তো পাশে বুঝি আপনার স্ত্রী?’
হতচকিত জাহিদ এবার যার পর নাই বিরক্ত হলেন।
‘না। উনি তো আপনার স্ত্রী।’
‘এই কী বলছো এসব! আমি ওনার স্ত্রী হতে যাবো কেনো?’ রেগে ক্ষেপে হোসনে আরা চেয়ার থেকে উঠে পড়েছেন।
‘তাহলে আপনি কার স্ত্রী?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি এই লোকের স্ত্রী,’ স্বামীকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন হোসনে আরা।
‘আপনি কেমন স্বামী ভাই? নিজের স্ত্রীকেই চিনতে পারছেন না!’
‘আপনার মতো লোকজন সামনে আসলে কার স্মৃতিশক্তি ঠিক থাকে বলুন।’
ভদ্রলোক এবার নিজ থেকেই চলে গেলেন। নিজেকে অপমানিত বোধ করলেন মনে হলো।
‘এই সোমা!’ উত্তেজনায় চিৎকার করলেন হোসনে আরা।
‘এই কে সোমা?’ জাহিদ জিজ্ঞেস করলেন তাঁর স্ত্রীকে।
‘আরে, আমার বান্ধবী সোমা। এই সোমার কথা তোমাকে কত্তবার বলেছি! ভুলে গেছো?’
জাহিদ মনে করতে পারলেন না। তাঁর স্ত্রী তাকে কখনও কোনো সোমার কথা বলেনি, নিশ্চিত তিনি। তাও স্ত্রীকে হতাশ করতে চাইলেন না।
‘ওমা! এই বুঝি সেই সোমা?’
‘হ্যাঁ গো, হ্যাঁ।’
সোমা হোসনে আরার ডাক শুনতে পেরেছেন। বান্ধবীর ডাক বলে কথা! তা নাহলে কি কেউ এই শব্দময় পরিবেশেও অন্য কারো ডাক শুনতে পারে?
‘কি রে হোসনে আরা! তুইও এসেছিস! উনি বুঝি আমার দুলাভাই?’
জাহিদ অবাক হলেন, ‘ইশ! এমনভাবে বলছে যেন আমি শুধু এই মহিলারই দুলাভাই।’
‘হুম। এই এ হচ্ছে আমার বান্ধবী সোমা। তোমাকে যার কথা অনেক অনেকবার বলেছি।’ স্বামীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন হোসনে আরা।
‘আপনি সেই সোমা! আপনার কথা কত্ত শুনেছি আপনার বান্ধবীর কাছে। চব্বিশ ঘন্টা শুধু আপনার কথাই বলে। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করেও বলে।’
‘হাহাহাহা, তোর সাহেব তো দেখি অনেক মজার, হোসনে আরা।’
‘ঐ আর কি! তা তুই একাই এসেছিস নাকি?’
‘নাহ রে, সেও এসেছে।’
‘তা দুলাভাই কোথায়?’
‘আমি বাচ্চাকে বাসার ভিতরে রেখে আসতে গিয়েছিলাম। ওতো এখানটাতেই ছিলো। ওকে খুঁজতে খুঁজতে তো এই দিকে এলাম। যাই হোক তোদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। ভালো লাগলো। কতদিন পর দেখা তাই না রে?’
‘হুম। তোর বেবি!’
‘হ্যাঁ রে। অনেকবছর পর বেবি নিয়েছি।’
‘কংগ্র্যাচুলেশানস রে। কত বছর বয়স?’
‘থ্যাংকস। কত বছর না। মাত্র পাঁচ মাস। আমি আসি রে? আবার দেখা হবে।’
‘আচ্ছা। দেখা করিস কিন্তু।’
‘ওকে, আসি দুলাভাই। আপনি কিন্তু অনেক মজার মানুষ।’
জাহিদ মুচকি হাসি দিলেন। সোমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, ‘আপনি বুঝলেন, আপনার বান্ধবী বুঝলো না এতোদিনেও।’ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার বান্ধবী খুব সুন্দর।’
‘এই চোখকে সামলাও।’
জাহিদ তাঁর স্ত্রীর চোখদুটি ঢেকে ধরতে গেলে হোসনে আরা হাতদুটি ধরে ফেলেন।
‘আমার চোখ না, তোমার চোখকে সামলাতে বলেছি।’
‘ওহ।’
সোমা তাঁর স্বামীকে খুঁজে পেয়েছেন।
তুমি ছিলে কোথায় আর এখন তোমাকে পেলাম কোথায়? কেনো যে আমাকে এভাবে ভোগাও তা একমাত্র তুমিই জানো।
‘আমার মনে হয়.........’
আরেফিন কথা শেষ করার আগেই সোমা বাঁধা দিলেন।
‘কী মনে হয় তোমার? তোমারতো আবার সারাক্ষণ শুধু এটা সেটা মনে হতেই থাকে।’
‘আমি বলছিলাম কী, আমাদের বোধ হয় না আসলেই ভালো হতো।’
আরেফিন রহমান সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন। বিয়ে বাড়িতে তো যেতেই চান না। বিয়ে বাড়িতে যে পটকা ফোটানো হয়, আতশবাজি হয়, সেগুলো তিনি সহ্য করতে পারেন না। ভালো লাগেনা তাঁর কাছে পটকার শব্দ আর আতশবাজির আগুণের ফুলকা। এটা বিয়ের অনুষ্ঠান পটকাবাজি, আতসবাজিতো হবেই হবে। আরেফিন খুব ভালো করেই জানেন এসব পটকাবাজি, আতসবাজি খুব ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
আসাদউল্লাহ্ সাহেবের বড় মেয়ে রুমা সোমার কলেজ জীবনের বান্ধবী। তাঁর দাওয়াতেই এখানে এসেছেন সোমা। রুমার অনুরোধেই স্বামী-সন্তানসহ আসতে হয়েছে। দিন পনের আগে দাওয়াত পেয়েছেন। স্বামী আরেফিন রহমান শুরু থেকেই দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। স্ত্রীর জোরাজোরিতে শেষমেশ আসতেই হলো। সোমা পটকা ফুটানো, আতসবাজি খুব পছন্দ করেন। স্বামীর অনিচ্ছার কারণেই বাড়ির কোন অনুষ্ঠানে এগুলোর আয়োজন করতে পারেন না। আজ চান্স ছাড়বেন না মনে হচ্ছে। প্যান্ডেলের পাশে নানা বয়সের কিছু মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। এখন আতসবাজি আর পটকা ফুটানো শুরু হবে। ছেলেমতো কেউ একজন এসে সোমাকে বললো, ‘আন্টি, আপনি নাকি আতসবাজি দেখবেন, পটকা ফোটাবেন?’
‘হুম রে বাবা, কে বললো তোমাকে?’
‘ঐ যে, আম্মু, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মুই তো আপনাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো যে আপনাকে ডাকতে।’
‘ওহ! শর্মিলি? তুমি যাও। আমরা আসছি।’
বাচ্চারা চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। দু একটা পটকা বাজতে শুরু করেছে। দুমদুম করে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। দুপদাপ লাফাতে লাগলো আরেফিনের হৃদপিণ্ড। স্ত্রীর হাত ধরে বললেন, ‘আমি এই জন্যেই আসতে চাইনি। না আসলে বোধ হয় ভালো হতো, সোমা।’
‘এই এক কথা আর কতো বার বলবে বলোতো?’
সোমা সত্যিই অনেক বিরক্ত হয়ে গেছেন। উৎসব উপভোগ করার আয়োজন, ভয় পাবার নয়। সোমা এটা আরেফিনকে বোঝাতেই পারেন না। স্ত্রীর ক্ষোভে থতমত খেয়ে গেলেন আরেফিন। আর কিছু বললেন না। এমনিতেই এখানে আসার পর থেকে মনটা থমথমে হয়ে আছে, সোমার ধমক থমথমে মনটাকে একেবারে চুপসিয়ে দিলো।
উপরের ঘরে অক্ষরকে ঘুম পারিয়ে রেখে এসেছেন সোমা। অনেকক্ষণ চলে গেছে। ছেলেটা ঠিকমত ঘুমোচ্ছেতো? সোমা ভাবলেন। এদিকে পটকা ফুটছে। আতসবাজিও চলছে। সোমা সেটা মিস করতে চাইলেন না। স্বামীকে এভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে ভালো লাগলো না তাঁর। শেষমেশ তাঁকেই বললেন উপরে যেয়ে অক্ষরকে দেখে আসতে। মাথা নেড়ে সায় জানালেন আরেফিন। উপরের কোন রুমে অক্ষরকে শুইয়ে রাখা হয়েছে সেটা আরেফিন জানেন না। একটু এগিয়ে গিয়ে তাই আবার ফিরে আসলেন। দূর থেকে জিজ্ঞেস করলে সোমা শুনতে পারবেন না। দুমদুম করে পটকা ফুটছে। তার চেয়ে ঢের বেশী শব্দে চিৎকার করছে ছোট ছেলেমেয়েগুলো। কিছু মহিলাও বাচ্চাদের সাথে তাল মেলাচ্ছেন। আরেফিন সোমার কাছাকাছি গিয়ে সোমার কান বরারর মুখটা রেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন রুমে?’
‘ঘুমে? ও বাচ্চা ঘুমাচ্ছে? ওকে, ভালো, ঘুমাক।’
‘তুমি এইখানে থাকো। একটু এনজয় করো। তোমারো ভালো লাগবে। অতীতের ঘটনা নিয়ে এখনও ভয়-ডর থাকলে চলবে?’
সোমার কথায় আরেফিন বিরক্ত হলেন। কিছু করার নেই। সোমার আনন্দে কখনও ভাটা পড়তে দেননি তিনি। সোমার কথার উপর কথাও বলেন না। কথায় কথা বাড়ে। সোজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘অক্ষরকে যে রুমে শুইয়ে রেখে এসেছো সেই রুমটা উপরের কোথায়?’
‘ওহ,তুমিও যে না! এই কথাটা এতক্ষণ পর জিজ্ঞেস করছো? উপরের গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তো বলে দিতো। উপর তলার সিঁড়ির ডানদিকের বাড়তি রুমটাতেই অক্ষর আছে। যাও দেরী করো না। যে শব্দ হচ্ছে। বেবির ঘুমটাই ভেঙ্গে গেলো কিনা। যাআআআআআআআআআআও।’
এরকম বুক কাঁপানো শব্দে অক্ষরের ঘুম ভাঙলো কিনা, বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে কিনা সেটা সোমা নিজে দেখতে গেলো না, এটা আরেফিনকে একটু ভাবালো। সোমা অক্ষরের আদর যত্নে অবহেলা করে না, তবে আজ কেনো? আরেফিন সত্যিই অবাক হলেন। ওপর তলায় শব্দের তীব্রতা এরকম হবে না হয়তো; অক্ষর হয়তো নিরাপদেই ঘুমাচ্ছে, আরেফিন ভাবলেন।
‘ঠিক আছে, আমি তাহলে বেবিকে দেখে আসি,’ সোমার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।
সোমা খেয়ালও করলেন না হয়তো। আরেফিন যখন ওপরতলার দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন, সোমা পিছন ফিরে তাকালেন। সোমা ভালো করেই জানেন তাঁর স্বামী আতসবাজি, পটকাবাজি একদমই পছন্দ করেন না। এগুলো থেকে অনেকদূরে থাকেন। আজকের পটকাবাজিও আরেফিন একদম সহ্য করতে পারছেন না, সোমা সেটা বুঝেছেন। স্বামীর এই পটকাভীতিটা দূর করবার চেষ্টা করেন। আজকেও তাই করছেন। সে চেষ্টায় কাজ হচ্ছে না, বুঝতে পেরেছেন। তাই হয়তো ইচ্ছে করেই নিজে অক্ষরকে দেখতে না যেয়ে আরেফিনকেই পাঠালেন। তাছাড়া এরকম মুহূর্তগুলো উপভোগ করার জন্য। সোমা সেটাই করছেন।
আরেফিন উপরে যেতে যেতে কয়েকবার পিছনে তাকালেন। সোমা সত্যিই অনেক উপভোগ করছে পটকা ফুটানো আর আতসবাজি। ‘ও যখন সত্যিই খুব উপভোগ করছে, করুক না,’ ভাবলেন তিনি।
দোতলায় উঠার সিঁড়ির পাশেই বিশাল বড় রান্না ঘর। আসাদউল্লাহ সাহেব বাড়ি বানিয়েছেন একখানা! কি বিশাল বিশাল রুম। শোবার কক্ষগুলো অন্য স্বাভাবিক বাড়ির ড্রয়িং রুমের মতই বড়। রান্না ঘর থেকে সুগন্ধ আসছে। এখন নিশ্চিত পোলাও রান্না হচ্ছে। খাবারের প্রতি এক ধরণের বাতিক আছে আরেফিনের। প্রায় সময় তিনি নিজেই রান্না করেন। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনগুলোতে রান্না ঘরে সোমার চেয়ে তাঁকেই দেখা যায় বেশী। আরেফিনের রান্নার হাত খারাপ নয়। সোমাও মজা করে আরেফিনের রান্না গলধঃকরণ করেন। রান্না ঘর থেকে রুমার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। রন্ধনশিল্পী হিসেবে রুমার খ্যাতি আছে। কোন এক টিভি চ্যানেলে রান্নার অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন তিনি। কোন চ্যানেল, আরেফিন মনে করতে পারছেন না এই মুহূর্তে। সোমা সেই অনুষ্ঠানের একনিষ্ঠ দর্শক। রান্না শিখতে টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখতে হবে? এটাতো ক্রিয়েটিভিটির ব্যাপার, আরেফিন নিজে নিজে বললেন। রুমা নিজেই যখন তদারকি করছেন রান্না খুব ভালো হবে, ভাবলেন তিনি। এসব ভাবতে ভাবতেই কিছুটা সময় চলে গেছে। আরেফিন আর দেরী করলেন না। তাড়াতাড়ি করে ডানদিকের বাড়তি রুমটিতে ঢুকে পড়লেন। রুমে অক্ষর ছাড়া আর কেউ নেই। বাচ্চাটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে দেখে খুব ভালো লাগলো আরেফিনের। বাইরের পটকা ফোটার সব্দ অক্ষরের ঘুমে বাঁধার সৃষ্টি করেনি তাহলে। বাড়তি রুম হলেও কোন ছোটখাটো রুম নয় এটিও। দুটা বিশাল পালঙ্ক আছে। অন্যান্য কিছু আসবাবও আছে। সম্ভবত বাড়িতে কোন অতিথি এলে এখানে থাকতে দেয়া হয়। একটি পালঙ্কে অক্ষর ঘুমাচ্ছে। দুইদিকে দুইটা কোলবালিশ রাখা হয়েছে। একটা পাতলা কাঁথা দেয়া হয়েছে অক্ষরের শরীরের উপর। বাচ্চাটা কত আরামে ঘুমাচ্ছে! ঘুমন্ত অক্ষরের মুখটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন আরেফিন। ফিসফিস করে বললেন, ‘ঐ পচা, পটকার আওয়াজে তোমার ভয় পেয়ে কাজ নেই। তুমিতো বীরপুরুষ। প্রিন্স অব ফিয়ারলেসনেস।’ অক্ষরের কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। অক্ষর নড়লও না একটু। সত্যিই খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। বাচ্চার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন আরেফিন। বাইরে থেকে আতসবাজির আলো এ রুমেও ঢুকছে। প্রতিটি আলোকপুচ্ছ আরেফিনের হৃদয়ে কাঁপুনি তুলছে। এসব পটকাবাজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বাইরে বের হবেন না, আরেফিন ঠিক করলেন। জানালাটা একটু ভিড়িয়ে দিলেন। অক্ষরের দিকে তাকিয়েই আছেন। নিষ্পাপ শিশুটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কোন এক ভাবনার জগতে হারিয়ে যান। হঠাৎ করে কেউ একজন রুমে ঢুকে। আরেফিনের সম্ভিত ফিরে আসে।
‘আংকেল,’ খুশি গলায় বললো একটি ছেলে
‘তুমি কে?’ আরেফিন আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলেন
‘আমি হিমেল।’
‘তুমি কার ছেলে?’
‘আপনি রুপাকে চেনেন?’
‘হুম, চিনি, তুমি বুঝি রুপার ছেলে?’
‘জী আংকেল।’
‘আমি তোমার আম্মুর বান্ধবীর.........’
আরেফিনের কথা শেষ না হতেই হিমেল নিজেই বাকিটা বলে দিলো।
‘আমি জানি। সোমা আন্টিই আমাকে পাঠালেন। আপনি নিচে যাবেন না? বাগানে আতসবাজি চলছে। পটকাও ফুটছে। ঐ দেখেছেন আবার ফুটলো?’
এই হিমেলকে সম্ভবত দুই বছর আগে সর্বশেষ দেখেছিলেন আরেফিন। রুমা স্বামীসহ বেড়াতে গিয়েছিলেন সোমার বাড়িতে। হিমেল তখন বারো-তেরো বছর বয়সী ছিলো। দুবছরে হিমেল অনেক বড় হয়ে গেছে। বয়সের চেয়ে বেশী লম্বা হয়ে গেছে। ছেলেটার সামনে নিজেকে কেমন যেনো বোকা-বোকা লাগলো আরেফিনের।
‘আংকেল আপনি এখানে কেনো?’
সবাই যখন বাইরে আনন্দ করছে, তখন আরেফিনের মতো একজন মানুষ এভাবে রুমে বসে থাকবে, এটা হিমেলের কাছে ঠিক লাগলো না। আরেফিন সেটা বুঝতে পারলেন। হিমেলের প্রশ্নে অনেকটা থতমত খেয়ে গেলেন তিনি।
‘অ-অ-অক্ষরকে দেখতে এসেছিলাম।’
‘ওর এখানে কোন সমস্যা হবে না, আংকেল। এখানে কেউ ডিস্টার্ব করতে আসে না। আপনি চলেন। এখানে থাকলে পটকা ফোটানো দেখবেন কি করে? আতসবাজির মজা পাবেন না তো।’
ছেলেটা কত চঞ্চল! ঠিক মায়ের মতো। রুপাও অনেক চঞ্চল। হিমেলের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন আরেফিন।
‘কী হলো, আংকেল? যাবেন না? চলুন।’
হিমেল নিজে থেকেই দরজাটা মেলে ধরে আছে। বুঝা যাচ্ছে, বাইরে যে পটকাবাজি-আতসবাজি চলছে হিমেল তার একটুও মিস করতে চাচ্ছে না। উপর তলায় আসার কারণে সে ইতিমধ্যে কিছুটা আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। আরেফিন বুঝলেন সেটা। ছেলেটাকে তাই নিরাশ করলেন না। যে জিনিসটা খুব অপছন্দ করেন সেটার কাছেই যেতে হচ্ছে বলে বেশ খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। কিশোর হিমেলের সেটা খেয়াল করার বয়স নয়। ফ্যাকাসে মুখেই হাসলেন আরেফিন।
‘হুম, চলো।’
হিমেলের পিছু পিছু নিচে চলে গেলেন আরেফিন। করার কিছুই নেই। এভাবে রুমের ভিতর অক্ষরের পাশে বসে থাকলেও কেউ যদি রুমে আসে তাহলে বিভিন্ন প্রশ্ন করবে। হিমেল পিছনে তাকালো না। খুব দ্রুত হেঁটে আতসবাজিতে যোগ দিলো। নিজেও কয়েকটা পটকা নিয়ে ফুটানো শুরু করলো। সোমা এখনও সেখানেই আছে। হিমেল সম্ভবত আরেফিনের নিচে আসা সম্পর্কে সোমাকে বলেছে। সোমা পিছনে তাকালে আরেফিন তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন তিনিও সেখানে উপস্থিত। সোমা মুচকি হেসে আরেফিনকে তাঁর কাছে যেতে বললেন। আরেফিন সোমার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটা হাত সোমার কাঁধের উপর রেখে মৃদু চাপ দিলেন।
‘বাচ্চার কী খবর?’ প্রশ্ন করলেন সোমা।
‘ভালোই আছে। ঘুমাচ্ছে। এখন যে রকম শব্দ হচ্ছে, ওর ঘুম না ভাঙলেই হয়।’
‘অতো ভেবেনাতো। ঘুম ভাঙবেনা। তুমি এনজয় করো।’
সোমা খুব ভালো করেই জানেন, আরেফিন এসব একেবারেই এনজয় করেন না বরং এর থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকতে পারলেই স্বস্তি বোধ করেন। তারপরেও সবার সাথে তাল মেলাতেই হয়তো আরেফিনকে এ আতসবাজি এনজয় করতে বললেন। ‘দুমদুম’ করে ততক্ষণে আরও কিছু পটকা ফুটলো। পটকাগুলো আরেফিনের বুক বিদ্ধ করলো বলে মনে হলো। আরেফিন এসব অহেতুক আয়জনের প্রতিবাদ করতে চাইলেন। অন্ততঃ সোমাকে তাঁর এই প্রতিবাদের কথা জানাতে চাইলেন। পারলেন না। তাঁর প্রতিবাদের ইচ্ছেকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে একের পর এক পটকা ফুটতে লাগলো। আতসগুলো শো শো করে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। সাঁঝের আকাশ যেনো ঝলসে যাচ্ছে। আগুণের ফুলকিগুলো তীরের মতো করে নিচে নামছে। সবাই উল্লাসে চিৎকার করছে। সোমাও সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছেন। পটকার শব্দের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে সোমার চিৎকার, অন্য সবার চিৎকার। সব শব্দ এক হয়ে আরেফিনের কানের ভিতর দিয়ে সোজা বুকে আঘাত করছে। এরকম অবস্থায় নিজেকে কাহিল মনে করলেন আরেফিন। সত্যি আর সহ্য হচ্ছে না তাঁর। সোমা আর পিছন ফিরে তাকাচ্ছেন না। আরেফিনের দিকে আর কোন খেয়ালই নেই তাঁর।
‘সোমা এতো নিষ্ঠুর কেনো?’ আরেফিন ভাবলেন।
এরকম পটকা আর আতসবাজিতে উপস্থিত থেকে আরেফিন নিশ্চয়ই অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। স্বামীর এই সাহসিকতার বিন্দুমাত্র মূল্য দিচ্ছেন না সোমা। একের পর এক পটকা বেজে চলেছে। আতসবাজি চলছে। একটা করে রকেট উড়ে যাচ্ছে আকাশে আর সোনালী, রুপালী, নীল, লাল, সবুজ শিসগুলো ছুঁড়ে এসে পড়ছে মাথার উপর। ফটাফট শব্দে ফাটছে এগুলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে ছোট ছেলেমেয়েগুলো। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে আইবুড়োগুলো। সবার মুখে যেনো বিস্ময়ের গগনবিদারী ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। চিৎকার করার পর একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। আতসবাজির আলোয় চারদিক আরও আলোকিত হচ্ছে। পটকার শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছে যে এটা একটা বিয়ে বাড়ি। তাও আবার আসাদউল্লাহ সাহেবের কনিষ্ঠ মেয়ের বিয়ে। লাউড স্পিকারে বাজছে গান। গান বাজছে কারও কারও ঠোঁটে। পরিস্থিতি অনেক আগেই আরেফিনের সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। আচমকা একটা পটকা কামানের গোলার মতো বিকট শব্দে ফুটে চারদিকে আগুণের ফুলকি ছড়িয়ে দিলো। সে আওয়াজে কেঁপে উঠলো সব কজন মানুষ। চিৎকার ছেড়ে নীরব হয়ে গেলো প্রত্যেকে। থতমত বোকাটে মুখগুলোতে মুহূর্তেই হাসি ফুটলো।
আরেফিন হাসলেন না, বিরক্ত হলেন। আগের চেয়ে আরও বেশী বিরক্ত তিনি। স্ত্রীর কাছ থেকে ছিটকে সড়ে গিয়ে সটান দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলেন। দুহাতে কান চেপে ধরে রাখলেন। একের পর এক রোমান ক্যান্ডেল ছোঁড়া হচ্ছে আকাশে। সোনালী ফোয়ারাগুলো নিচের দিকে ঢলে পড়ছে। আরেফিন চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কটু গন্ধের ধোঁয়া বাতাসে ভাসছে। আরেফিনের নাকে-মুখেও লাগছে সে ধোঁয়া। হঠাৎ কেউ একজন তাঁর পিঠে হাত দিলেন। চোখ না খুলেই আরেফিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’
‘আচ্ছা ভাই, আপনি আমার মিসেস কে দেখেছেন?’
এতো শব্দের মধ্যে আরেফিন সে প্রশ্ন ঠিকমতো শুনতে পেলেন না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আপনি?’ আরেফিনের চোখ তখনও বন্ধ। যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর।
‘হোসনে আরাকে দেখেছেন?’
‘দেখছেন না আমার চোখ বন্ধ?’
‘হুম, তা দেখতে পাচ্ছি। অনেকে চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। মনের চোখ দিয়ে দেখে।’
‘জী না। আমার মনে কোনো চোখ নেই। আপনি যার খোঁজে এসেছেন তাঁকেই খুঁজুন।’
‘আপনার স্ত্রী আপনার কাছে আছে তো? বিয়ে বাড়িয়ে স্ত্রী হাতবদল হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।’
‘আমার স্ত্রী সেরকম নয়।’
‘আমার স্ত্রীও সেরকম নয়। তবুও বড় ভয় হয়। দুটা নয়, চারটা নয়। ঐ একটা মাত্র স্ত্রী আমার। সে না থাকলে আমার কী হবে! টুকির কী হবে?’
‘টুকিটা কে?’
‘টুকি হচ্ছে আমার ছোট বোনের একমাত্র মেয়ে। জন্মের পর থেকেই......। ধুর, আপনি আপনাকে এতোসব কথা বলতে যাবো কেনো? আচ্ছা ভায়া, আপনি কি চোখ খুলবেন না?’
‘না।’
‘চোখ বন্ধ করে রাখা ভালো। চোখের বিশ্রাম হয়। আপনার শরীরের যে কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গের চেয়ে চোখ খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আমি কি আপনার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি?’
‘থাকুন। নিষেধ করেছে কে?’
‘না। তা কেউ করেনি। কিন্তু এভাবে এখানে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকা কি নিরাপদ?’
‘চোখ খুলে যা দেখবেন তাতেও তো বড় বিপদ।’
‘তা যথার্থই বলেছেন।’
দুচোখ বন্ধ করে আরেফিনের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন জাহিদ। স্ত্রীকে খোঁজার জন্য এদিকে এসেছেন। সেটা ভুলে গেলেন। পটকা ফুটছে। আতসবাজি চলছে। আগের চেয়ে আরও বেশী। গান বাজছে। আগের চেয়ে আরও বেশী শব্দে। আবার একটা পটকা কামানের গোলার মতো তোপধ্বনি দিলো। আরেফিন দু’কান সজোরে চেপে ধরে রেখেছেন। চমকে উঠলেন জাহিদ। এই শব্দে তাঁর মনে হলো তিনি বিশেষ কোনো কারণে এদিকে এসেছেন।
‘আচ্ছা, ভায়া। আমি এদিকে এসেছি কেনো?’
‘আপনার স্ত্রীকে খুঁজতে এসেছেন।’
‘ধন্যবাদ। স্ত্রীকে হাতছাড়া করবেন না কখনও। বিশেষ করে বিয়ে বাড়িতে। একেবারে বগলদাবা করে রাখবেন। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে।’
‘আসি ভায়া?’
‘উদ্ধার করুন।’
‘কাকে?’
‘আপনার স্ত্রীকে?’
‘জী জী। হোসনে আরা.........হোসনে আরা। কেনো এভাবে আমাকে করো পাগলপারা?’
স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে চলে গেলেন জাহিদ। আরেফিন ঠায় দাঁড়িয়েই আছেন। সোমার কোনো সাড়া নেই। আতসবাজিতে মশগুল তিনি। ছোট বেলার ভয়ানক স্মৃতিগুলো ঘুরে ফিরে আসছে আরেফিনের মনে। যে স্মৃতিগুলো ভুলে যেতে চান একেবারে সেগুলোই আবার মনের গহীনটাকে বিদ্ধ করে বাইরে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে যেনো।
আরেফিনের বয়স যখন হিমেলের মতো ছিল, চৌদ্দ কি পনেরো হবে, তখনই ঘটলো তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়ানক দুর্ঘটনাটা। মিরপুর বাঙলা কলেজের পাশেই বাড়ি। শবে বরাতের রাত। পাড়ার সব বন্ধু এক হয়ে অলিতেগলিতে হৈচৈ করছিলো। তারপর সবাই মিলে আরেফিনের বাবার শেডে জড়ো হয়। সকালে চকবাজার থেকে এক বাক্স পটকা কিনে আনে সব বন্ধুরা মিলে। এক বাক্সে ত্রিশটা পটকা। ওগুলো দিয়ে তিনটা বড় মাপের বাজি বানানোর ইচ্ছা ছিলো সব বন্ধুর। আরেফিন একটা ছুরি দিয়ে পটকাগুলো চিঁরে বারুদ ঢালেন একটা পাত্রে। আর তাঁর এক বন্ধু শামিম তা নাড়তে থাকে।
কাজ শেষ হয়ে গেলে বিশালাকারের পটকা তিনটা দেখে সব বন্ধুর চোখ জুড়িয়ে যায়।
‘এই পটকা দ্যাইখা তো হরতালের পিকেটাররাও ভয় পাইয়া যাইবো রে, আরেফিন,’ আরেফিনের দিকে তাকিয়ে অতি আনন্দে কথাটা বলে শামিম।
‘হ রে, ঠিক কইছোস। আমরা...’
আরেফিনের কথা শেষ হতে না হতেই তাঁদের আরেক বন্ধু মিল্টন শামিমকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে ওঠে।
‘ঐ ঐ, করোস কী? করোস কী? না না!’
শামিমের হাতে একটা দিয়াশলাইয়ের বাক্স দেখে চিৎকার করে ওঠে মিল্টন। কিন্তু ততোক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। শামিম চেয়েছিলো পাত্রে পড়ে থাকা সামান্য বারুদে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে আগুণ লাগাবে। দুর্ভাগ্য, যখন সে বারুদ নাড়ছিলো তখন কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বারুদ কণা বাতাসে ভেসে ওঠে। ওরা কেউ খেয়াল করেনি। শামিম দেয়াশলাইয়ের কাঁঠি জ্বালানো মাত্রই বারুদ-কণায় আগুণ ধরে যায়। দাউ দাউ করে আগুণ জ্বলে ওঠে।
প্রথম বিস্ফোরণে দরজা ভেঙ্গে বাইরে উড়ে গিয়ে পড়ে শামিম। আরেফিনের দুর্ভাগ্য। আনন্দের জন্য বড় বড় যে তিনটি পটকা তৈরি করেছিলো সব বন্ধুরা মিলে সেগুলোই বড় বিপদের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। পটকাগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। সবাই কমবেশি আহত হয়েছিলো। শামিমের অবস্থা ছিলো সবচেয়ে খারাপ। এক সপ্তাহ লড়াই করে শেষে মৃত্যুর কছে হার মানে সে। দু’দিন বাদে হাসপাতালে জ্ঞান ফেরে আরেফিনের। উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন তিনি। হাত, পা আর পিঠ বিশ্রীভাবে পুড়ে যায়। ‘জানে বেঁচে গেছে ছেলেটা। এটাই তো অনেক,’ ডাক্তার বলেছিলেন।
হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে অন্যরকম মানুষে পরিণত হন আরেফিন। আগের চঞ্চলতা, চটুলতা আর নেই। বাড়িতেই থাকতে চাইতো না যে ছেলেটা সেই ঘরের কোণ ছেড়ে বাইরে যেতে চান না আর। কেমন লাজুক আর জড়সড় হয়ে পড়েন তিনি। গায়ের জামা খুলতে রাজি হতেন না কোনমতেই। সুতির মোজা পরে হাত পায়ের পোড়া দাগ ঢাকার চেষ্টা করেন। সেই ঘটনার পর থেকে মেয়েদের সাথে সহজে মিশতে পারতেন না। এক বিয়ে বাড়িতে সোমার সাথে পরিচয় হয় তাঁর। কথা বলবেন না বলবেন করে কথা হয় সোমার সাথে। ভালো লেগে যায় সোমাকে। প্রথম দেখাতেই সোমার প্রেমে পড়ে যান আরেফিন। সোমাই তাঁর জীবনে প্রথম নারী। চুটিয়ে প্রেম করেন কয়েক বছর। বিয়ে হয় দুই পরিবারের সম্মতিতেই। বিয়ের আগেই নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা সোমাকে বলে দেন আরেফিন। অতি ভালোবাসার কাছে পুড়ে যাওয়া কিছু ক্ষত বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি। তারপর সোমা অনেক চেষ্টা করেছেন আরেফিনের এই আতসবাজি-পটকাবাজিভীতি দূর করার জন্য। কিন্তু পারেন নি।
‘এই তুমি এখানে দাঁড়িয়ে!’ আরেফিনের হাত টেনে ধরে বললেন সোমা।
একটু পর দু’কান থেকে হাত নামিয়ে নিলেন আরেফিন। এপাশ ওপাশ তাকালেন। ‘সোমা গেলো কোথায়?’ নিজে নিজে জিজ্ঞেস করলেন। পটকার শব্দ কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেছে। উপর থেকে বাচ্চার কান্না আরেফিনের কানে আসছে। হন্তদন্ত হয়ে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন তিনি।
রান্না ঘরের পাশ কাটিয়েই শুনতে পেলেন সোমার কণ্ঠ, ‘এই যে আব্বু, বাবু সোনা, আমি এসে পড়েছি। দেখো, আম্মু এসে গেছে।’
আরেফিন আরও এগিয়ে গেলেন। উপরতলার বাড়তি রুমটার কাছে যেতেই একটু থমকে দাঁড়ালেন। সোমার কথা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে রুমে আরও কেউ আছে। বাচ্চার কান্না চলছে।
‘বাচ্চাটা ভয় পেয়েছে রে সোমা।’
কথাটা রুমা বলছে বলে মনে হলো। ‘ওর বাপেই তো অনেক ঘাবড়ে গেছে দেখলাম,’ একই কণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারিত হলো।
‘কাঁদে না, কাঁদে না, আব্বু, সোনা আমার,’ রুমা বললো।
‘ছোটবেলায় পটকা ফুটাতে যেয়ে অল্পের জন্য ওর বাবা প্রাণে বেঁচে গেছে...... ওকে,’ কথা বলতে বলতে বিরতি নিলেন সোমা। ‘লোকটার কাণ্ডকীর্তি দেখলে আমার লজ্জায় মাথা কাঁটা যায়। অনেক চেষ্টা করলাম। মানুষটাকে সাহসী বানাতে পারলাম না।’
‘এটুকুতেই এই দশা!’ অন্য কেউ বললো।
‘বিদেশে হরহামেশা এরকম উৎসব হয়। বিদেশে গেলে উনি কী করতেন?’ রুমা বললেন।
‘শুধু পটকা-আতসবাজিতেই নয়, তাঁর সব কিছুতেই ভয়,’ শান্ত স্বরে কথা বলছেন সোমা।
‘সব কিছুতেই মানে?’ কেউ একজন জিজ্ঞেস করলো সোমাকে।
‘পানি, কুকুর, উঁচু জায়গা, ড্রাইভিং, হাইওয়ে, অতীত, ভবিষ্যৎ- সব কিছুতেই ভয়। মানে ও এখনও ছেলেমানুষই রয়ে গেছে রে, রুমা।’
‘তাই তো দেখছি রে,’ সায় দিলেন রুমা।
‘এক্কেবারে মায়ের আঁচল ধরা খোকার মতো।’ কথাগুলো বলতে বলতে কান্না শুরু করলেন সোমা। ‘আমি এখন কাকে সামলাবো? বাচ্চাকে নাকি বাচ্চার বাপকে?’
‘আমি বুঝতে পারিনি রে, সোমা। সরি, কিছু মনে করিস না,’ রুমা বললেন।
‘আমার মনে হয় কী জানো সোমা, তুমি ওনাকে ভালো কোনো মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত,’ অন্য কেউ সোমার উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সোমা। বাইরে থেকেই সেটা বুঝতে পারলেন আরেফিন।
‘সে কি আর নিয়ে যাইনি ভেবেছো?’ সোমা বললেন। ‘আমি অনেক সহ্য করেছি, আর পারছি না।’
সোমার কণ্ঠস্বর আগের চেয়ে সংযত মনে হলো। সবাই চুপ হয়ে গেছে। কারও কথা শোনা যাচ্ছে না আর।
সোমার কথাই শোনা গেলো, ‘আমি ঠিক করেছি আলাদা হয়ে যাবো।’
দু’চোখ বুঝে এলো আরেফিনের। পায়ের জোর ক্রমশ কমে যাচ্ছে যেনো। মনে হচ্ছে পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানগুলো নতুন করে পুড়তে শুরু করেছে। কানে বাজছে সেই চিৎকার ‘না না!’। মাথার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে যেনো। মনে হচ্ছে চারদিকে দুমদুম করে পটকা ফুটছে। দু’কান চেপে ধরে নিচের তলার দিকে হাঁটা শুরু করলেন আরেফিন। অতীতের সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি খুব বেশী করে আঁকড়ে ধরেছে তাঁকে। মাথার ভেতর কানে তালা লাগানো শব্দ চলছে আর আলোর চোখ ধাঁধানো ঝলকানি। পটকা ফুটেই চলেছে একটার পর আরেকটা, তারপর আরও একটা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
দীপঙ্কর বেরা ১৭/১২/২০১৬
-
মানসূর আহমাদ ১৭/১২/২০১৬ভালোই...... শুধু বিয়ের গল্প লিখেন নাকি?
-
রাবেয়া মৌসুমী ১৫/১২/২০১৬ভালো হয়েছে।
দারুণ