নাকফুল
বিয়ের পর একমাস পার হয়নি এখনও। ময়নাকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না একদম। বয়সটা একটু কম হলে লজেন্স, পুতুল হাতে ধরিয়ে দিয়ে থামিয়ে রাখা যেত। আলতা-চুড়িতে আর কাজ হচ্ছে না। মোতালেব চেষ্টার কমতি করছে না।
‘ওরে আমার ময়না, কথা কেনো কয়না? ময়না, ময়না, ময়না।’
ময়না হাসে না একটুও। একটুতেই চটে যায়। কারণ লাগে না তার এই রাগের। কতটা বদলে গেছে সে! মোতালেব হাত ধরে। ময়না হাত ফসকে বের হয়ে যায়।
‘তুমি আমার গায়ে হাত দিবা না কইলাম।’
‘হায় হায়! আমার পরাণপাখি কয় কী! আমার বিয়া করা বউরে আমি ধরতে পারুম না। মাইনষে হুনলে হাসবো না?’
‘মাইনষে হাসলে আমার কী, আমার কী? তুমি আমার গায়ে হাত দিবা না, বাছ।’
‘ও আমার ময়না। বুকে আইতে চায় না। ও আমার ময়না।’
হনহন করে ঘরের বাইরে চলে যায় ময়না।
‘এরাম করবা না। আমার সহ্য হয় না।’
মোতালেব হাল ছাড়ে না।
‘ওহ আমার ময়না, এমন কথা কয় না।’
মেয়েটা বিয়ের আগে মোতালেব বলতে পাগল ছিল। মোতালেবকে দেখলেই বলতো, ‘মতু ভাই, আই লাভ ইউ।’
‘তুমি এই আই লাভ ইউ কথা শিখছো কই থাইকা, আমার ময়না?’
‘ওমা কী কও এইটা? সিনেমা, টিভিতে। নাইকা নাইওকরে জড়াই ধইরা এই কথাখান কয়।’
‘ও মোর টুকটুকি! তা তুমি তো আমারে জড়াই ধইরা কও না। খালি মতু ভাই, মতু ভাই করো। আমি কইছি না, আমার নাম মোতালেব, মতু না।’
‘ঐ একই কথা। আমার কাছে তোমারে মতু ডাকতে ভালো লাগে।’
দুই ঠোঁটের মাঝখানে ওড়নার পাড়টা চিবিয়ে ধরে কথাগুলো বলে সে। চোখে মুখে লজ্জা স্পষ্ট। মোতালেবকে খুব ভালোবাসে। লজ্জাটা সামাল দিতে হয়।
‘আইচ্ছা, মতুই ডাকো। কই আমারে তো জড়াই ধরলা না। একবার জড়াই ধইরা তোমার সুন্দর কথাখান আরেক একবার কওতো দেখি, আমার পরাণ পাখি ময়না।’
‘কোন কথাখান?’
‘ঐ যে, ঐ কথাখান।’
‘ঐ যে আবার কোন কথাখান?’
‘সিনেমায় নাইকা নাইওকরে জড়াই ধইরা আদর কইরা যে কথা খান কয়, ঐ কথাখান।’
‘তুমি মোটা। আটার বস্তা। তোমারে জড়াই ধরুম ক্যামনে?’
‘হায় খোদা! তুমি কী কইলা এইটা! আমি আটার বস্তা?’
‘হ, একখান না, দুইখান বস্তা একসাথে।’
‘থাউক, আমারে আর জড়াই ধরন লাগবো না। আমি যাইগা।’
মোতালেবের একটু অভিমান হয়। ময়না মজা পেয়ে দাঁত বের করে হাসে। কিশোরী ময়নার হাসি মোতালেবের মান ভাঙ্গাতে বেশী সময় নেয় না। মোতালেব হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় ময়নাকে। ময়না ধরা দেয় না। হাসতে হাসতে বাড়ির পথে দৌড়ে পা বাড়ায়।
‘মতু, আই লাভ ইউ।’
ক্লাশ টু পাশ মোতালেব আই লাভ ইউ-এর কী জবাব দিতে হয় জানে না। ইংরেজি বুঝে না। আই লাভ ইউ বুঝে। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ময়নার নিষ্পাপ মুখটার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকে। ময়না অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে আগের জায়গাতেই। চোখের আড়ালে গেলে ময়না তার মনের ভিতর আরও বেশী তোলপাড় শুরু করে।
‘আই লাভ ইউ, ময়না। আমার ময়না পাখি। তুমি বিহালে এইহানে আইসো। কথা আছে।’
ময়নার কানে পৌঁছায় না এ কথা। বিদ্যুৎ গতিতে চলে যায় সে। প্রতিদিন সকাল সকাল মোতালেব শেখের চাতালে যায় কাজ করতে। মক্তবের পাশের রাস্তায় এসে অপেক্ষা করে ময়না। মোতালেবকে একনজর না দেখলে ভালো লাগে না। একটু কথা বললে ভালো লাগে, মন শান্ত হয়। নাহলে মন আনচান আনচান করে। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। মা বকে। মায়ে বাপরেও বকে।
‘তোমার মাইয়ার যে কী হইছে আইজকাল। আমি বুঝবার পারতাছি না। তুমি সামলাও। অহন বাগে না আইলে পরে ঠেলা বুঝবা।’
ময়নার বাপ মেয়েকে খুব আদর করেন। স্ত্রীর কথায় কান দেন না। এইটুকু মেয়ে। তাকে বাগে আনার কী আছে। যেমন ইচ্ছে তেমন করুক। পড়াশুনাটা ঠিকমত করলেই হলো।
মোতালেব চাতালের কাজ শেষে এই রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফেরে। ময়না স্কুল শেষে বাড়ি যায় না। রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। ময়নাকে দেখেই মোতালেব খুশিতে ‘ময়না, ময়না’ করতে থাকে।
‘স্কুলে গেছিলা?’
‘হ।’
‘বাড়িত যাও নাই?’
‘না।’
‘আমার লাইগা খাড়ায় আছো? আমারে না দ্যাখলে বুঝি ভালা লাগে না?’
‘ঢং।’
ময়না লজ্জা পায়। মোতালেব সেটা ভালো করেই বুঝে। এই মেয়ে প্রেম বুঝে কিনা জানে না সে। মোতালেবের মায়া আছে তার প্রতি, এটা বুঝে।
‘ময়না।’
‘হুম-ম-ম।’
‘ওহ ময়না।’
‘কী হইলো? ময়না ময়না করো ক্যান খালি? কী কইবা কও?’
‘তোমারে আমি খুব ভালোবাসি।’
‘হ জানি। আমার লাইগা আইজ কিছু আনো নাই?’
‘আনছি তো, আমার ময়না পাখি।’
‘দেহি দেহি, কী আনছো দেহি।’
‘খাড়াও, খাড়াও, দেহাইতাছি।
মোতালেব পকেট থেকে কানের দুল বের করে। ময়না হাত থেকে সেটা ছোঁ মেরে নেয়। ডান হাত বাম হাত করে বাজিয়ে দেখে ওজন আছে কিনা। এই দুলের কথা সে অনেক আগেই মোতালেবকে বলেছিল। মোতালেব তার কথা রেখেছে। ময়নার খুশির বাঁধ যেনো ভেঙ্গে গেলো।
‘তুমি আমারে এতো ভালোবাসো, মতু ভাই?’
‘হ, ম্যালা ভালোবাসি তোমারে। দুল পছন্দ হইছে?’
‘হ। অনেক পছন্দ হইছে। ম্যালা দিন আগে চাইছিলাম। কিন্যা দিলা আইজ!’
‘টাকা আছিলো না। ব্যাপারীর নিকট টাকা জমাইছিলাম। আইজ সেইটা দিয়া কিন্যা আনছি। দুল জোড়া পরো। আমি দেহি।’
‘অহন না। কাইলকা দেইখো।’
‘আইজ পরলে কি হয়। পরো না, ময়না আমার।’
ময়না কানের পুরাতন দুল জোড়া খুলে। নতুন জোড়া পরে নেয়। খুব মানিয়েছে। আয়না নেই কাছে। নিজের চোখে দেখতেও পারছে না। অগত্যা মোতালেবকেই বলতে হলো।
‘এই মতু ভাই।’
মোতালেব বুঝতে পারে ময়না জানতে চাইছে নতুন দুল জোড়ায় তাকে দেখতে কেমন লাগছে। মোতালেব ময়নার হাত ধরে একটু আড়ালে যায়।
‘কী হইলো? টানতাছো ক্যান?’
‘এই দিকে আসো। মানুষ যাইতাছে ঐদিক দিয়া।’
‘মানুষ গেলে আমার কী?’
‘কেউ দেইখা ফালাইলে তোমার বাপেরে কইয়া দিবো।’
‘ও বুজছি। অহন কওতো আমারে ক্যামন লাগতাছে?’
‘এক্কেরে শাবনুরের লাহান।’
‘হাছা? না বানাই বানাই কইতাছো?’
‘হাছা। আমার ময়নার কছম।’
‘আইচ্ছা। কিন্তু.........।’
‘কিন্তু কী?’
‘আমার অপু বিশ্বাসের লাহান সাজবার ইচ্ছা করে।’
‘সাজো। তোমারে মানা করছে ক্যাডা?’
‘কিন্তু আমার যে নাকফুল নাই। নাকফুল পরলে আমারে অপু বিশ্বাসের মতন লাগবো। তুমি দেইখা নিও।’
‘আমি তোমারে নাকফুলও দিমু, ময়না।’
‘কবে দিবা?’
‘বিয়াতেই দিমু।’
‘বিয়া করবা কবে?’
‘বিয়া!’
বিয়ের কথা শুনে মোতালেবের মাথায় বাজ পড়ে যেন। বাপ-মা মরে এতিম করে গেছে। তেমন কিছু রেখে যায় নি। আছে বলতে একটা ছোট বসত ভিটা। ঘরের পিছনে এক শতাংশ জমি। শাকসবজি ফলে। শেখের চাতালে কাজ করে যা জোটে চাল-ডাল কিনতেই পকেট ফাঁকা। দূরসম্পর্কের চাচির ঘরে খায় সে। মাসের শেষে চাচিকে মাসোয়ারা না ধরে দিলেও হয় না। মোতালেবের জন্য এই বৃদ্ধ চাচি তো আর কম কিছু করেনি। টানাটানির সংসারে ময়নারে নিয়ে এলে ঠিকমত সংসার চলবে কিভাবে? ভাবতে থাকে মোতালেব।
‘কী হইলো? কইলা না তো আমারে কবে বিয়া করবা।’
‘হু-ম-ম-ম, করুম। তুমি জানি কয় ক্লাশ পাশ দিছো?’
‘সাত ক্লাশ। এই বছর জেএসসি দিমু।’
‘ও আমার ময়না, ম্যালা লেহাপড়া করছো দেহি। তোমার বাপে তো আমার লগে তোমারে বিয়া দিবো না।’
‘আমি বিয়া করুম। আব্বার কী? আব্বায় তো তোমারে বিয়া করতাছে না। আমি করমু। তুমি আমারে নাকফুল দিবা?’
‘হ দিমু তো। কছম কাটলাম না?’
‘হ। তুমি আব্বারে কও, তুমি আমারে বিয়া করতে চাও।’
‘তোমার বাপে আমারে কোপাইবো।’
‘ক্যান? কোপাইবো ক্যান? আমার বুঝি বিয়া করতে ইচ্ছা করে না?’
‘খুব ইচ্ছা করে, ময়না?’
‘হ, খুব। তোমার করে না?’
‘হ করে তো। আমি তো মুক্ষো। আমারে বিয়া করবা?’
‘মুক্ষো তো কী হইছে? তুমি আমারে কত্ত কিছু কিইন্যা দাও। আব্বায় দেয় না। মুকুল চাচার মাইয়া রুপালী কত সাইজা গুইজা স্কুলে আহে। আমি সাজমু না, কও? আব্বারে কইছি নাকফুল কিন্যা দিতে। আমারে বকা দিছে। তুমি আমারে বিয়া করবা, নাকফুল দিবা। আমি তোমারেই বিয়া করুম।’
‘ক্যামনে করবা? তোমার কসাই বাপে তো তোমারে বিয়া দিবো না। আমার লগেতো দিবোই না। তাইলে?’
‘পালামু তোমার লগে।’
‘পালাইবা!’
‘হ। কতজনই তো পালাইয়া বিয়া করে। আমার স্কুলের মল্লিকা পালাই বিয়া করলো না? ওর একটা পোলা হইছে। কি সুন্দর দ্যাখতে!’
‘তোমার বাপে খুইজা বাইর করবো। চাপাতি দিয়া আমাগো দুইজনরে টুকরা টুকরা করবো। এক্কেরে কিমা বানাইবো। বুঝলা?’
‘কোন বাপ তার নিজের মাইয়ারে কাটতে পারে?’
‘তোমারে না কাটলেও আমারে ছাইড়া দিবো না।’
‘তুমি কও যে আমারে বিয়া করবা না, তাইলেই তো হয়। এত চালাকি করো ক্যান? আমারে নাকফুল কিন্যা দিতে পারবা না, তাই বিয়াও করবা না। হাছা কইছি না?’
‘ওরে ময়না! আমার বুকখান কাইটা দেহাই? তুই অহনও বুঝলি না আমি তোরে কত ভালোবাসি।’
‘তাইলে কাইলকাই চলো।’
‘কই?’
‘পালামু।’
‘কাইলকাই!’
‘হ, কাইল। পালাইবা কিনা, হ্যাইডা কও।’
এই কয়দিনে ময়না বিয়ে পাগল না নাকফুল পাগল হয়ে গেছে মোতালেব ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এটা বুঝতে পারে যে এই মেয়েকে আর থামানো যাবে না। ওর কথামতো না পালালে হয়তো আর কথাই বলবে না। মোতালেবের মাথা কাজ করে না, হাতগুলো কেঁপে উঠে। ময়নার গালে হাত রেখে বলে, ‘আইচ্ছা, কাইলকাই পালামু। তুমি কিছু কাপড় চোপড় নিয়া ডিরেক্ট বকশীবাজার চইলা যাবা।’
‘আইচ্ছা। তুমি আইবা তো?’
‘আমু। সাবধানে বাড়িত থাইকা বাইর হইবা। ধরা পড়লে তোমার বাপে তোমার আস্ত রাখবো না।’
‘তুমি চিন্তা কইরো না। আমারে কেউ দেইখবার পারবো না।’
বাজারে বাপের গোস্তের দোকানের সামনে ময়না দাঁড়িয়ে আছে। কাঁক ডাকতে শুরু করেনি তখনও। কোন দোকান খোলে নাই। মোতালেব সত্যিই অনেক অবাক হয়ে যায়। ময়নাকে দেখে বুকটা কেঁপে উঠে। কত বিশ্বাস করে সে ঘর ছেড়ে এসেছে। এরকম অস্থির মেয়েকে ঘরে রাখতে পারবে তো? মোতালেব ভাবে। এখন আর এসব ভেবে লাভ কী। পিছনে ফিরে তাকানোর সময় সুযোগ কোনটিই নেই। ময়নার হাত ধরে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলো মোতালেব।
‘কই যাইবা?’
‘আগে চলো তো।’
‘বিয়া করবা না আমারে?’
‘করুম তো। কয়বার কমু আর?’
‘নাকফুল দিবা তো?
মোতালেব কথা বলে না। ময়না দাঁড়িয়ে যায়। মোতালেবের মুখের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবে।
‘কী হইলো? খাড়াই পরলা যে?’
‘যামু না তোমার লগে।’
‘ক্যান? কী হইলো আবার?’
‘তুমি আমারে নাকফুল দিবা না।’
‘ক্যাডায় কইলো?’
‘আমি বুঝবার পারছি।’
‘ক্যামনে?’
‘আমি জিগাইলাম, তুমি নাকফুল দিবা কিনা, তুমি জবাব দিলানা তো।’
‘ওহ আল্লাহ্! এই মাইয়ারে আমি ক্যামনে বুঝাই? তোমারে নাকফুল দিমু বইলাই তো বিয়া করতাছি। তুমি না গেলে নাকফুল দিমু ক্যামনে? যাইবা না?’
‘হাছা? দিবা তো?’
‘হ হাছা। তোমার কছম কাটছি না? এই যাও, আবার তোমার কছম। আমার পরাণ পাখি ময়নার কছম।’
‘হইবো না।’
‘ক্যান?’
‘তুমি তোমার মরা মাও-বাপের কছম কাইটা কও, আমারে নাকফুল দিবা?’
‘আইচ্ছা, আমার মরা মাও-বাপের কছম। হইছে এইবার?’
‘বারো আনা সোনার নাকফুল। দিবা তো?’
‘হ রে ময়না, তাই দিমু। এইবার চলো। দেরী হইলে লোকে ধইরা ফালাইবো।’
‘চলো। ’
নিজে একা হলে কোন সমস্যা ছিলো না কিন্তু ময়নাকে নিয়ে খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে যায় মোতালেব। শহরে যেয়ে বাসে করে সোজা মুন্সিগঞ্জ। দূর সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে ওঠে। সেখানেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। ততক্ষণে গ্রামে শোরগোল পড়ে গেছে। ময়না আর মোতালেবকে পাওয়া যাচ্ছে না। মোতালেব মোবাইলে তার চাচি আর ময়নার বাড়িতে খবর পাঠায়। প্রথম দিকে হুমকি ধামকি দিলেও দিন বিশেক পর ময়নার বাপ এ বিয়ে মেনে নেয়। অবশ্য মেনে নেয়া বলতে মোতালেব আর ময়না নিজেদের গ্রামে ফিরতে পেরেছে। ময়না এখনও বাপের বাড়ি যেতে পারেনি, বাপের বাড়ি থেকেও কেউ নিতে আসেনি। ময়নার মা মাঝে মাঝে এটা সেটা পাঠিয়ে দেয় মেয়ের কাছে। নিজের সংসারেই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে সেরকম সাহায্য করার ক্ষমতা তার নেই। নাকফুল দিতে পারেনি বলে বিয়ের পিড়ি থেকেই উঠে পড়েছিলো ময়না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিয়েটা পার করা গেছে। গ্রামে আসার পর থেকে আবার শুরু সেই নাকফুলের বায়না।
আজ বায়নার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে ময়না। ময়না মানেই বুঝি বায়না আর বায়না? মোতালেব ভাবে। দেরী হয়ে যাচ্ছে। কাজে যেতে হবে। দেরী করে চাতালে গেলে ম্যানেজারের ঝাড়ি গিলতে হয়। হজম হয় না, বুকে বেঁধে যায়। আজ নির্ঘাত আরও বেশী ঝাড়ি শুনতে হবে। গেলা যাবে কিনা সেটাই কথা। ময়নাকে সামাল দিতেই সকাল পার হয়ে যাচ্ছে।
‘ময়না, ও ময়না, আমার কথা হুনবানা?’
‘কইলাম না, আমার লগে কথা বলবা না?’
‘তুমি আর কয়টা দিন ধইরযো ধরো সোনা, আমি তোমার জন্য ভালো একখান নাকফুল বানাই আনমু।’
‘তোমারে আমি বিশ্বাস করি না। তুমি বিয়ার আগে কইছিলা বিয়ার সময় নাকফুল দিবা। দাও নাই। বিয়ার সময় হগগোলে মিলা কইলা বিয়ার দুই তিন পর নাকফুল কিন্যা দিবা তুমি। দ্যাও নাই তো। তুমি একটা মিথ্যুক, চামার। মরা মাও-বাপের কছম খাইছিলা না? তোমার মরা মাও-বাপ কবরে শান্তি পাইবো না, কইলাম।’
মোতালেব এবার নিজেকেই সামাল দিতে পারে না। মরা মা-বাবাকে নিয়ে ময়নার মুখে এরকম কথা শুনে মাথায় আগুন ধরে গেলো।
‘শালি! তুই আমার মরা মা-বাপ নিয়া কতা কছ!’
ময়নার চুল ধরে টেনে ধরে মোতালেব। মুখে কয়েকটা চর কষে দেয়। মাথায় আগুন ধরে গেছে।
‘ওরে, মাইরা ফালাইলো রে।’
ময়নার গলা যেন আকাশ পর্যন্ত পৌঁছালো।
আশপাশের বাড়ি থেকে সবাই ছুটে এলো। মোতালেবের বৃদ্ধ চাচি খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ে এলো। বেচারির এক পা ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। ব্যথায় বিছানায় পরে থাকার মত অবস্থা। তাতে চলবে কী করে? শরীরের এই অবস্থা নিয়েই ঘরের সব কাজ করতে হয়। মোতালেবের জন্য আগে রান্না করতে হতো। ময়না আসার পর আর রান্না করতে হচ্ছে না। ময়না নিজেই ঘর সামলাচ্ছে। দৌড়ে এসে দেখে ময়না কাঁদছে। মোতালেবের নাম করে গালি দিচ্ছে। তুই-তুকারি করে যা মুখে আসছে তাই বলছে। মোতালেব আবার ক্ষেপে যায়। ময়নাকে মারার জন্য একটা লাকড়ি হাতে নেয় সে।
‘ময়না!’
‘ঐ থাম। শক্তি দেখাইতাছস?’ মোতালেবের চাচি জমিলা বেওয়া থামিয়ে দেয় তাকে। মোতালেব ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে মাথার চুল টানে। জমিলা ময়নার মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
‘কী হইছে রে, মা। এমন করছ ক্যান?’
‘ওহ অহন আমার দোষ?’
‘আমি কি কইছি যে তোর দোষ? মোতালেবের দোষ। ও তোরে মারছে।’
‘শয়তান একটা! আমারে কইছিলো নাকের ফুল কিন্যা দিবো। অহন নাকফুলের কথা কইলেই মাথা বিগড়া যায়। আমার গায়ে হাত তুলছোস না! আব্বারে কইয়া দিমু। তোরে হাসুয়া দিয়া কাইটা ধলেশ্বরীতে ভাসাই দিবো। দেইখা নিস।’
‘দে, তোর বাপরে কইয়া দে। তোর বাপতো কসাই না জল্লাদ।’ মোতালেব বসে থাকা অবস্থাতেই জবাব দেয়।
‘তুই কথা কইবি না। কইছি না চুপ কইরা বইয়া থাকতে? ঐ তোর চাতালে যাইতে হইবো না?’ জমিলা জিজ্ঞেস করে।
‘যামু না। কার লাইগা কাম করুম? আমার কেউ নাই। আমি না খাইয়া থাকুম। কাম করন লাগবো না আমার।’
‘আমি কইতাছি, তুই অহনি যাবি।’ জমিলা এমনভাবে কথাটা বললো যেন সে মোতালেবকে আদেশ করলো। মোতালেব অনড় থাকে।
‘কী হইলো? উঠছ না ক্যান? আমার কথা কানে যায় না? যা, চাতালে যা।’
এবার আর জমিলার কথা ফেলতে পারলো না মোতালেব। জমিলা মোতালেবের জন্য কম কিছু করেনি। এতিম মোতালেব ছোটবেলা থেকে এই চাচির কাছেই মানুষ হয়েছে। নাহলে কবেই বানের জলে ভেসে যেত। মোতালেব ঘরের ভিতর ঢুকলো। ঘাড়ের গামছা আর কী যেন একটা নিয়ে পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বাইরে বের হয় সে। যাবার সময় বলে, ‘চাচি ওরে কইয়া দাও, আইজকাই ওর নাকের ফুল বাড়িত আইবো। না আইলে আমার লাশ আইবো। কইয়া দাও, শালিরে।’
মোতালেব বাইরে চলে যায়। জমিলা ময়নাকে বুঝাতে থাকে। ময়না শান্ত হয়। আশপাশের বাড়ি থেকে যারা এ দৃশ্য দেখতে এসেছিলো তারাও কী সব কানাঘুষা করতে করতে যে যার বাড়িতে চলে যায়। শুধু একজন মোতালেবের ঘরের পিছনে লুকিয়ে থাকে। সে হলো আকরাম মুন্সী। মোতালেবের দূর সম্পর্কের ভাই। পাশেই বাড়ি। দুই বিয়ে করেছে। আগের বউ একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাপের চলে গেছে অনেক দিন হয়েছে। ছোট বউকে নিয়ে বর্তমান সংসার। গ্রামের মেয়ে-মহিলারা তাকে ভালো চোখে দেখেনা। আকরাম মুন্সীর স্বভাবে খুঁত আছে। মেয়ে-মহিলা দেখলে আড় চোখে তাকানোরস্বভাব জাত অভ্যাস তার। সে লুকিয়ে লুকিয়ে ময়নার দিকে নজর রাখে। ময়না কাপড় গোছাচ্ছে। একটা কাপড়ের পুঁটলি বেঁধে ফেলেছে। আকরাম মুন্সী ময়নার গতিবিধি লক্ষ্য করছে। ময়না এপাশ ওপাশ তাকিয়ে ঘরের পিছনদিক দিয়ে বের হয়। আকরাম মুন্সীকে সে দেখতে পায় না। হাঁটতে হাঁটতে ময়না রাস্তায় এসে পড়েছে। কেউ দেখতে পাচ্ছে কিনা খেয়াল করলো। আকরাম পিছু পিছু হাঁটা শুরু করেছে। ময়না পিছন ফিরে তাকালেই সে নিজেকে আড়াল করছে। একটু পর ময়না দেখতে পায় তাকে। আকরামকে দেখেই দ্রুত হাঁটতে শুরু করে ময়না। আকরাম আর লুকোচুরি খেলতে চায় না। এতদিনের লুকিয়ে রাখা সাধনা এবার পূরণ করতেই হবে। এখনই সুযোগ। ময়না আর পিছনে তাকায় না। পিছনে বিপদ বেশী, লাভ নেই। আকরাম পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। ময়নার পিছনে গিয়ে আসতে করে ময়নার নাম ধরে ডাকে।
‘ময়না ভাবি, ও ময়না ভাবি।’
মোতালেব বয়সে অনেক ছোট, অথচ তার স্ত্রীকে ‘ভাবি’ বলে ডাকা আকরামের একটা মতলব।
‘কী হইছে? আপনে আমার পিছে পিছে আসতাছেন ক্যান?’
‘কই যাইতাছো তুমি?’
‘জাহান্নামে।
‘ঐ দ্যাখো, ভাবি কয় কী! এইডা তো জাহান্নামের পথ না।’
‘তাইলে কিয়ের পথ?’
‘এইডা তো তোমার বাপের বাড়ি যাওনের পথ। মোল্লাটারি।’
‘হ, বাপের বাড়ি যাইতাছি। আপনি যান গা। আমারে যাইতে দ্যান।’
‘বাপের বাড়ি যাইবা?’
‘হ।’
‘ভাবি, এই কাম কইরো না।’
‘ক্যান? আমার বাপের বাড়ি আমি যামু। আপনের সমস্যাটা কী কোন দেহি।’
‘ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথা হুনো।’
ময়না হাঁটতে থাকে। আকরাম পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলে।
‘কী কথা?’
‘তোমার বাপে কি তোমার বিয়া মাইনা নিছে?’
‘না।’
‘তাইলে তুমি যে বাপের বাড়ি যাইতাছো। তোমার বাপে কি তোমার আস্ত রাখবো মনে করতাছো?’
‘যা ইচ্ছা করুক। মারুক, কাটুক। আমি তাও যামু।
‘ভাবি, হুনো হুনো। মোতালেব তোমারে নাকফুল দেয়নাই বইলাইতো তুমি বাপের বাড়ি যাইতাছো। হাছা নি?’
‘হ্যায় আমারে মারছে।’
‘দ্যাখছি তো আমি। আহা রে, ময়না ভাবির সোনার লাহান শরিলডারে মাইরা ক্যামন তামা বানাই দিছে, পশুডা, চামারডা।’
‘এই জন্যি তো বাপের বাড়ি যাইতাছি। আমি আর কোনদিনও হ্যার কাছে আমু না। হ্যার মুখ পর্যন্ত দ্যাখমু না। কইলাম।’
‘আমি তো কইতাছি না, তুমি ঐ শুয়ারের মুখ আর দ্যাখো।’
‘তাইলে? আমি আব্বার কাছেই যামু। পা ধইরা কান্নাকাটি করমু। মাপ চামু। মায় আছে। আব্বারে সামাল দিবো। মাইয়ার কান্দনে বাপ মা মাপ না কইরা পারে? আপনেই কন, আকরাম ভাই।’
‘তুমি যত সহজ ভাবতাছো তত সহজ না গো, ময়না ভাবি। তোমার বাপের হাতে চাপাতি থাকে। ওইটা দিয়া সোজা কোপ দিয়া তোমার মুণ্ডুটা ধর থাইকা আলাদা কইরা ফালাইবো। তুমি দ্যাইখা নিও।’
ময়নার বুকের ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু হয়। বাপের বাড়ি যাবে কি যাবে না, ভাবে সে। ময়নাকে চিন্তাগ্রস্ত করতে পেরে আকরাম মনে মনে নিজেকে একধাপ সফল মনে করে। তার ঔষধে কাজ হচ্ছে। এইবার বড় টোপটা ফেলতে হবে। মাছ বড়শির কাছে এসে লাফালাফি করছে মনে হচ্ছে। আকরাম আরও আগ্রাসী হয়ে উঠে। ময়নাকে তার অনেক মনে ধরেছে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে ময়নাকে তার চাই-ই চাই। মনের কথাটা আর আটকাতে পারলো না সে।
‘ময়না ভাবি, কিছু মনে না করো যদি, আমি একখান কথা কই তোমারে?’
‘হ, কন।’
‘সোনার নাকফুল চাও তো?’
‘হ, চাই। মতু দিলো না, মিথ্যাবাদী।’
‘আমি যদি তোমারে হীরার নাকফুল দেই, নিবা?’
‘হীরার নাকফুল!’
‘হ, খাঁটি হীরার। আমেরিকার হীরা।’
হীরা কোথা থেকে আসে, আকরাম সেটা জানেনা। ময়নাতো জানার কথাই না। আকরাম একটা দেশের নাম বলে দিলো আর কি। ময়নার মনে ধরেছে আকরামের প্রস্তাব। কিন্তু আকরামের কাছ থেকে সে নাকফুল নিতে যাবে কেনো? আকরাম তো তার কিছু হয় না। ময়না ভাবে। নাকফুলের প্রতি তার যেমন আগ্রহ, আকরামের প্রতি তার তেমনই বিরক্তি।
‘আপনার কাছ থাইকা আমি নাকফুল নিমু ক্যান? আপনে আমারে নাকফুল দিবেন ক্যান? আমি আপনার কী লাগি?’
‘ইশি রে! কী কথাখান কইলা গো, ময়না ভাবি। তুমি হইলা গিয়া আমাগো মোতালেবের বউ। আমার ভাবি। আমি তোমার দেওর লাগি না? কও, লাগিনা?’
‘হ, লাগেন। আমি তাও নিমু না। আপনার বউ আছে। হ্যার হাত গলাতো ফাঁকাই দেহি। কোনো গয়নাগাটি নাই। নিজের বউরে দ্যান গিয়া। আমার লাগবো না।’
‘ও ভাবি, তুমি দ্যাহো নাই। ওরে অনেক গয়না কিন্যা দিছি। হ্যায়তো ক্যান্সারের রুগী। কোন দিন যে মইরা যায়।’
‘রুগী! আমি তো তারে মরদের লাহাইন হাঁটা চলা করতে দ্যাহি। হ্যায় আবার রুগী হইলো ক্যামনে?’
‘হ, তুমি ঠিকি কইছো। বাড়ির বাইর আইলে হ্যায় ঠিক থাহে। আর বাড়িত ঢুকলে বিছানায় হুইয়া পরে। মইরা যাইবো। বাঁচবো না বেশীদিন।’
‘তাইলে আমারে নাকফুল কিন্যা না দিয়া আপনার বউয়েরে ডাক্তার দেহান, চিকিৎসা করান।’
‘আরে, ময়না ভাবি! তুমি সহজ কথা বুঝবার চাওনা ক্যান? ক্যান্সার রোগ সাড়ে না। অইডা হইলো গিয়া মরণব্যাধি। ওষুধ, ডাক্তারে কোন কাজ হয়না।’
কথা বলতে বলতে আকরাম মুন্সী ময়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। ময়না আর এগুনোর পথ পায় না। এপাশ ওপাশ সড়ে এগুতে চাইলেও আকরাম পথ আগলে ধরে।
‘কী হইলো, আমার পথ আটকাইতাছো ক্যান? আমারে যাইবার দ্যান।’
আকরাম বেশী বাড়াবাড়ি করে না। বেশী বাড়াবাড়ি করলে ময়না চিৎকার করে লোক জড়ো করবে, বুঝতে পারে না। তাই ময়নাকে আরও কিছু লোভ দেখানোর চেষ্টা করে সে।
‘ময়না ভাবি, তোমার বিল্ডিং বাড়িতে থাকোনের ইচ্ছা করে না? দাসি বান্দি থাকবো, টিভি থাকবো, ভিসিআর থাকবো। তোমার হাতে মোবাইল থাকবো। মোবাইলে গান হুনবা। ছাপা টাঙ্গাইল শাড়ি পরবা। আলতা চুরি পরবা। ইচ্ছা করে না?’
‘ইচ্ছা করলেই কী আর না করলেই কী? ক্যাডা আমার ইচ্ছা পূরণ করবো?’
‘আমি, আমি করুম গো ময়না ভাবি। ইশি রে, তোমার গলা, হাত দ্যাহি একদম খালি। মাইয়া মাইনষের গলা হাত নাক খালি থাকলে ভালা লাগে? তুমিই কও।’
ময়না কোন উত্তর দেয় না। আকরাম সামনে থেকে সড়ে যেতেই হনহন করে হাঁটতে থাকে সে। আকরাম হাল ছাড়ার পাত্রই নয়। শেষ কৌশলটা প্রয়োগ করে সে।
‘ময়না ভাবি, শেষবারের মত একখান কথা কই, তুমি চিন্তা কইরা দ্যাখো।’
‘কী?’
‘তুমি যদি এই অবস্থায় বাপের বাড়িত যাও। তোমার মাও-বাপের ইজ্জত থাকবো? গাঁওয়ের লোকজন থুথু দিবো না? বাপের বাড়িত থাইকা পলাইয়া মোতালেবরে বিয়া করলা। সেই নিয়া তোমার মাও-বাপরে তো গাঁওয়ের লোক কম কথা হুনায় নাই। এইবার এইভাবে স্বামী ছাইড়া বাপের বাড়ি ফিরা আইছো, এইডা হুনলে গাঁওয়ের লোকজন এমন কইরা থুথু দিবো যে লজ্জায়, শরমে তোমার মাও, তোমার বাপ গলায় দড়ি দিবো না? কও।’
মোতালেবের শেষ কথাগুলো ময়নার মনে গেঁথে যায়। সত্যিই তো, আমার জন্য যদি মায়, আব্বার গলায় দড়ি দেয়! ময়না ভাবে। কী করবে সে এখন? কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে আকরামকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনেই কন, আকরাম ভাই, আমি অহন কী করমু?’
‘ময়না ভাবির ব্রেন দেহি খুইলা গ্যাছে! আরে ময়না ভাবি, আমি হইলাম তোমার দেওর। আমি কি তোমার খারাপ চাইতে পারি, কও? তোমার মাও-বাপের ইজ্জত মানেই তোমার ইজ্জত। তোমার ইজ্জত আমার ইজ্জত না?’
এই কথাগুলো শুনে ময়নার মন আকরামের প্রতি একটু দুর্বল হয়। আকরাম বুঝুতে পারে ওষুধে কাজ হচ্ছে। এবার সে শেষ চালটা চালে।
‘ময়না ভাবী।’
‘হ, কন।’
‘তুমি আমার লগে শহরে চলো।’
‘শহরে ক্যান?’
‘ইশি রে! তোমার তো দেহি খুবই ভোলা মন। কইলাম না, আমি তোমারে হীরার নাকফুল কিন্যা দিমু?’
‘হ, কইছেন।’
‘খালি নাকফুল না গো, ময়না ভাবি। আমি তোমার খালি গলা, খালি হাত হীরার গয়নায় ভরায় দিমু।’
‘এতো কিছু!’
‘ময়না ভাবি, তুমি মানুষখান খুবই ভালা। মোতালেবের কপাল, তোমারে বউ বানাইতে পারছে। হ্যায় তোমার মর্মখান বুঝবার পারলো না। আমি পারছি গো, ময়না ভাবী, আমি পারছি। তোমারে খালি গয়না ক্যান, তোমার লাইগা আমি এই জীবনখানও দিয়া দিমু।’
ময়না আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। আকরামের প্রত্যেকটা কথা মধুর মতো লাগছে। এভাবে কখনও মোতালেবও বলেনি। সেই মোতালেবের হাত ধরে মাও-বাপের ঘর ছেড়েছে সে। নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে ময়নার। মোতালেবের আগে কেনো আকরাম মুন্সীর সাথে দেখা-পরিচয় হলো না, ময়না ভাবে। আকরামকে ময়নার মনে ধরেছে। বাপের বাড়ি যাওয়া মানে আরও গঞ্জনা। গ্রামের লোকের কথায় টেকা যাবে না। মাও-বাপ হয় বিষ খাবে, নয় গলায় দড়ি দেবে। তার চেয়ে বড় কথা, কসাই বাপ, হাতের চাপাতি দিয়ে সত্যি তাকে জবাই করেও ফেলতে পারে। মনে মনে ভয় পেয়ে যায় ময়না। একটাই উপায়, আকরামের প্রস্তাব গ্রহণ করা।
‘সত্যই তো, আকরাম ভাইয়ের মনটা অনেক বড়। তার সাথে গেলে আমার সুখ আর সুখ। হাতে বালা, গলায় হার, তাও আবার সোনার নয়, হীরার। আর আমার অনেক সাধের নাকফুল!’ নিজে নিজে এ কথাগুলো বলে ময়না।
আকরাম তার হাতদুটো একসাথে করে ময়নার করুণা প্রার্থনা করছে যেন। ময়না আকরামের মুখের দিকে তাকাতেই আকরামের দুচোখ যেন অশ্রুতে ভেসে যেতে শুরু করে। ময়না নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না।
‘আপনে আমারে বিয়া করবেন, আকরাম ভাই?’
ময়নার এই প্রশ্ন আকরাম আশা করেনি। ময়না নিজ থেকেই এভাবে প্রশ্ন করাতে সে যেন মেঘের আগেই বৃষ্টি পেয়ে যায়। আকরামের গুলতিতে পাখি মরেছে। ময়না সাড়া দিয়েছে। যেভাবে আকরাম চেয়েছে ঠিক সেভাবে।
‘ইশি রে! ময়না ভাবী, তোমারে ক্যাডা বিয়া করবো না কও দেহি? পত্তম যে দিন দ্যাখছি ঐ দিন থাইকাই তোমারে বিয়া করতে ইচ্ছা করে। ময়না ভাবী গো, ময়না ভাবী, আমার ইচ্ছাখান পূরণ করতে দিবা তো?’
‘হ দিমু। তয় আপনার কথাগুলা রাখোন লাগবো কিন্তু। আপনেও মোতালেবের লাকান ওয়াদার খেলাপ করেন না যেন।’
‘ইশি রে! ময়না ভাবী, মোতালেব একটা মানুষ হইলো? হ্যায় তো একটা পশু, শুঁয়ার। তুমি ওর লগে আমার তুলনা করলা, ময়না ভাবী? এই কষ্টখান কইযে রাখি!’
‘আইচ্ছা, আমার ভুল হইয়া গ্যাছে, আকরাম ভাই। মাফ কইরা দ্যান আমারে।’
‘তুমি চলো, আমার লগে চলো। আর দেরী করন যাইবো না। কেউ দেইখা ফালাইলে বড় কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবো।’
‘হ, চলেন।’
‘তুমি ঘোমটা টাইনা মুখটা ঢাইকা নাও। কেউ যেন দেইখবার না পারে। চিনবার না পারে তোমারে। তুমি আগে আগে হাডো। আমি পিছে পিছে।’
মোতালেবের কথা একবারের জন্যও ভাবলো না ময়না। আকরামের সাথে শহরে চলে যায় সে। বখশীবাজারের লোকজন দেখলে চিনতে পারে, তাই মোড়লগঞ্জ হয়ে মুন্সীগঞ্জের দিকে রওয়ানা দেয় তারা।
আজ বেশ খানিকটা সময় আগেই বাড়িতে ফিরে মোতালেব। অন্য দিনগুলোতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সকালে ময়নার গায়ে হাত তোলার পর থেকে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না সে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে হয় না। কাঁদলেই পুরুষত্ব থাকে না। মোতালেবও কাঁদতে চায় নি। আজ কেন যেন থেকে থেকে দুচোখ দিয়ে পানি ঝরেছে। ঘাড়ের গামছাটা দিয়ে সে পানি মুছেছে। চাতালে গেলেও কাজ করেনি আজ। বখশীবাজারে গিয়ে সাত্তার আলীর কাছে টাকা নিয়েছে। সারা গ্রামে সুদখোর হিসেবে খ্যাতি আছে সাত্তার আলীর। মোতালেব সুদের উপর হাজার দশেক টাকা চাইলেও তা দিতে রাজী হয়নি সাত্তার আলী। ঘরের পিছনের এক শতাংশ জমিটা বন্ধক রেখে টাকা চেয়েছে মোতালেব। সাত্তার আলী তাতেও রাজী হয় নি। মোতালেবের টাকা দরকার। জমির দরকার নেই। ময়নাকে যে কোনভাবেই হোক আজ নাকফুল কিনে দিতে হবেই। বাধ্য হয়ে জমিটা মাত্র দশ হাজার টাকাতেই সাত্তার আলীর কাছে বিক্রি করতে হলো। সাত্তার আলী শর্ত জুড়ে দিলো। দশ হাজার টাকাই সে দেবে যদি মোতালেব জমির সাথে তার বসতভিটাও তাকে দিয়ে দেয়। অবশ্য মোতালেবের বসতভিটা সাত্তার আলীর কাছে বন্ধক হিসেবে থাকবে। মোতালেবের মাথা কাজ করে না। চোখের সামনে বারবার ময়না মুখটা ভাসে। ময়নাকে খুব ভালোবাসে সে। সে ভালোবাসার কাছে জমি, বসতভিটা- এসব খুবই সামান্য। মোতালেব রাজী হয়ে যায়। বখশীবাজারে যাবার আগেই চাতালের ম্যানেজার শামসুল মিয়ার কাছে জমানো দুই হাজার টাকা ফিরত নেয় সে। বারো হাজার টাকা নিয়ে মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে রেডিমেড একটা সোনার নাকফুল কেনে সে। বাইশ ক্যারটের খাঁটি সোনার বারো আনায় বানানো নাকফুল। এর সাথে একটু নোলকমত অংশ আছে। ময়নার খুব পছন্দ হবে নাকফুলটা, মোতালেব ভাবে। আজ তার সোনার ময়না পাখির মুখে কথার বুলি ফুঁটবে। কিশোরী ময়নার অগোছালো কথাগুলো মোতালেবের খুব ভালো লাগে। যতই রাগ করুক, অভিমান করুক, ময়না যে তাকে খুব ভালোবাসে, এটা মোতালেব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। বিয়ের পর প্রায় একমাস হতে চলেছে। ময়না একবারের জন্যেও তার বাপের বাড়ি যেতে চায় নি। মোতালেবকে ছেড়ে ময়না কোথাও যেতে পারবেনা, থাকতেই পারবে না মোতালেবকে ছাড়া, এটা মোতালেবের বিশ্বাস। সেই সকাল থেকে মুখে এক-দুই গ্লাস পানি ছাড়া আর কিছুই পড়েনি। নাকফুল কিনে সোজা বাড়ি এসেছে সে। ময়নার নাকে নাকফুল পরিয়ে দিয়ে তার নাকফুল পরা কোমল মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাত খাবে সে। সেই আশা নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে মোতালেব। বাড়ির সদর দরজায় পা রাখার আগেই ‘ময়না, ময়না’ বলে চিৎকার শুরু করে। ময়নার সাড়া নেই। এখনও তাহলে অভিমান নিয়েই বসে আছে ময়না? মোতালেব নিজেকে প্রশ্ন করে। ঘরের ভিতরে ঢুকে ময়নাকে দেখতে পায় না সে। নিশ্চয়ই চাচির কাছে গিয়ে চুপ করে বসে আছে তার অভিমানী ময়না পাখি, মোতালেব ভাবে।
‘চাচি, ও চাচি।’
‘কি রে মোতা, তুই আইছস?’
‘হ, চাচি। ময়নারে ডাকো। কও যে, আমি ওর লাইগা নাকফুল আনছি। এক্কেরে বারো আনা খাঁটি সোনার নাকফুল। কই, ডাকো। ময়না, ও ময়না। আসো। দ্যাহো, তোমার লাইগা নাকফুল আনছি। আর গোসসা কইরা থাকতে হইবো না। আসো।’
‘ময়না, আমার কাছে যায় নাই তো রে মোতা।’
‘তাইলে? হ্যায় তো ঘরের ভিতরেই নাই, বাড়িত নাই তো, চাচি।’
‘তুই যাওনের পর আমিও গ্যাছি। হ্যায় তো ঘরেই আছিলো।’
‘তাইলে গ্যালো কই?’
‘দ্যাখ দেহি, মাইয়াডা গ্যালো কোনহানে। ময়না, ও ময়না। বাড়িত আয়। মোতা আইছে।’
ময়নার কোন সাড়া না পেয়ে মোতালেব বাড়ির বাইরে চিৎকার শুরু করে, ‘ময়না, ময়না।’ পিছনে পিছনে জমিলাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করে। ময়নার নাম ধরে সেও ডাকে। ময়নার কোন সাড়া মিলছে না। আশপাশের বাড়ি থেকে মহিলারা বেড়িয়ে এসেছে। মোতালেব তাদেরকেও জিজ্ঞেস করছে।
‘শেফালী ভাবী, ময়না কি তোমার বাড়িত আছে?’
‘না রে, মোতা।’
‘ও করিমন চাচি, ময়নারে দ্যাখছো?’
‘কই না তো। হ্যায় তো আমাগো বাড়িত কোনদিন আহে না।’
সকালের সেই ঘটনা নিয়ে কেউ কেউ কানাঘুষা করতে থাকে। মোতালেবের কান এড়াতে পারে না তা।
‘সকালে মাইয়াডারে যেই পিটানিটা দিলা। দ্যাখো গা, বাপের বাড়ি চইলা গ্যাছে হয় তো।’ আলালের বউ বলে।
মোতালেব সোজা বখশীবাজারে গিয়ে মোবাইল ফোনের দোকান থেকে ময়নার গ্রামে তার পরিচিত একজনকে ফোন করে। মোবাইলের দোকান থেকে সেই লোকের নাম্বার ম্যানেজ করে সে। ময়নার বাপের কাছেও মোবাইল ফোন আছে। সে নাম্বারও বাজারের একজনের কাছ থেকে ম্যানেজ করে মোতালেব। কিন্তু শ্বশুরকে ফোন দেয় না। কসাই শ্বশুর এই ঘটনা জানতে পারলে সারা দুনিয়াটাকেই জবাই করে ফেলতে পারে। ঘণ্টা খানিক পর আবার সেই লোককে ফোন দিয়ে জানতে পারে ময়না তার বাপের বাড়ি যায়নি। মোতালেবের মাথা ঘুরে যায়। দু চোখে যেন অন্ধকার দেখছে সে। তাহলে ময়না গেলো কোথায়? বখশীবাজার ছেড়ে আবার গ্রামের পথে পা বাড়ায় মোতালেব। গ্রামের গোটা পথ চিৎকার করতে করতে আসে মোতালেব। শরীরের শেষ শক্তিটুকুও যেন শেষ হতে চলেছে।
মাঝপথে এসে রাস্তার উপর বসে পড়ে মোতালেব। কেন ময়নার গায়ে হাত তুলতে গেলো সে? রাগটা কেন সামলাতে পারলো না? নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। দু হাত দিয়ে মাথার কোঁকড়া চুলগুলো টানতে শুরু করে। আবার উঠে পড়ে। নিস্তেজপ্রায় শরীরটা নিয়ে হাঁটা শুরু করে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। মোতালেব কাঁদে। ডুকরে ডুকরে কাঁদে।
‘ময়না, ময়না, আমার ময়না পাখি, কই গ্যালা তুমি? এই দ্যাহো, তোমার লাইগা নাকফুল কিন্যা আনছি। নাকফুল নিবা না? ময়না।’
ময়না সাড়া দেয় না। সে উড়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে থাকে মোতালেব। বেখেয়ালি হাত থেকে নাকফুলটা রাস্তায় পড়ে যায়। মোতালেব হাঁটতে থাকে আর চিৎকার করে, ‘ময়না, ময়না, তুমি কই গ্যালা ময়না?’
‘ওরে আমার ময়না, কথা কেনো কয়না? ময়না, ময়না, ময়না।’
ময়না হাসে না একটুও। একটুতেই চটে যায়। কারণ লাগে না তার এই রাগের। কতটা বদলে গেছে সে! মোতালেব হাত ধরে। ময়না হাত ফসকে বের হয়ে যায়।
‘তুমি আমার গায়ে হাত দিবা না কইলাম।’
‘হায় হায়! আমার পরাণপাখি কয় কী! আমার বিয়া করা বউরে আমি ধরতে পারুম না। মাইনষে হুনলে হাসবো না?’
‘মাইনষে হাসলে আমার কী, আমার কী? তুমি আমার গায়ে হাত দিবা না, বাছ।’
‘ও আমার ময়না। বুকে আইতে চায় না। ও আমার ময়না।’
হনহন করে ঘরের বাইরে চলে যায় ময়না।
‘এরাম করবা না। আমার সহ্য হয় না।’
মোতালেব হাল ছাড়ে না।
‘ওহ আমার ময়না, এমন কথা কয় না।’
মেয়েটা বিয়ের আগে মোতালেব বলতে পাগল ছিল। মোতালেবকে দেখলেই বলতো, ‘মতু ভাই, আই লাভ ইউ।’
‘তুমি এই আই লাভ ইউ কথা শিখছো কই থাইকা, আমার ময়না?’
‘ওমা কী কও এইটা? সিনেমা, টিভিতে। নাইকা নাইওকরে জড়াই ধইরা এই কথাখান কয়।’
‘ও মোর টুকটুকি! তা তুমি তো আমারে জড়াই ধইরা কও না। খালি মতু ভাই, মতু ভাই করো। আমি কইছি না, আমার নাম মোতালেব, মতু না।’
‘ঐ একই কথা। আমার কাছে তোমারে মতু ডাকতে ভালো লাগে।’
দুই ঠোঁটের মাঝখানে ওড়নার পাড়টা চিবিয়ে ধরে কথাগুলো বলে সে। চোখে মুখে লজ্জা স্পষ্ট। মোতালেবকে খুব ভালোবাসে। লজ্জাটা সামাল দিতে হয়।
‘আইচ্ছা, মতুই ডাকো। কই আমারে তো জড়াই ধরলা না। একবার জড়াই ধইরা তোমার সুন্দর কথাখান আরেক একবার কওতো দেখি, আমার পরাণ পাখি ময়না।’
‘কোন কথাখান?’
‘ঐ যে, ঐ কথাখান।’
‘ঐ যে আবার কোন কথাখান?’
‘সিনেমায় নাইকা নাইওকরে জড়াই ধইরা আদর কইরা যে কথা খান কয়, ঐ কথাখান।’
‘তুমি মোটা। আটার বস্তা। তোমারে জড়াই ধরুম ক্যামনে?’
‘হায় খোদা! তুমি কী কইলা এইটা! আমি আটার বস্তা?’
‘হ, একখান না, দুইখান বস্তা একসাথে।’
‘থাউক, আমারে আর জড়াই ধরন লাগবো না। আমি যাইগা।’
মোতালেবের একটু অভিমান হয়। ময়না মজা পেয়ে দাঁত বের করে হাসে। কিশোরী ময়নার হাসি মোতালেবের মান ভাঙ্গাতে বেশী সময় নেয় না। মোতালেব হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় ময়নাকে। ময়না ধরা দেয় না। হাসতে হাসতে বাড়ির পথে দৌড়ে পা বাড়ায়।
‘মতু, আই লাভ ইউ।’
ক্লাশ টু পাশ মোতালেব আই লাভ ইউ-এর কী জবাব দিতে হয় জানে না। ইংরেজি বুঝে না। আই লাভ ইউ বুঝে। ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ময়নার নিষ্পাপ মুখটার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকে। ময়না অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে আগের জায়গাতেই। চোখের আড়ালে গেলে ময়না তার মনের ভিতর আরও বেশী তোলপাড় শুরু করে।
‘আই লাভ ইউ, ময়না। আমার ময়না পাখি। তুমি বিহালে এইহানে আইসো। কথা আছে।’
ময়নার কানে পৌঁছায় না এ কথা। বিদ্যুৎ গতিতে চলে যায় সে। প্রতিদিন সকাল সকাল মোতালেব শেখের চাতালে যায় কাজ করতে। মক্তবের পাশের রাস্তায় এসে অপেক্ষা করে ময়না। মোতালেবকে একনজর না দেখলে ভালো লাগে না। একটু কথা বললে ভালো লাগে, মন শান্ত হয়। নাহলে মন আনচান আনচান করে। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। মা বকে। মায়ে বাপরেও বকে।
‘তোমার মাইয়ার যে কী হইছে আইজকাল। আমি বুঝবার পারতাছি না। তুমি সামলাও। অহন বাগে না আইলে পরে ঠেলা বুঝবা।’
ময়নার বাপ মেয়েকে খুব আদর করেন। স্ত্রীর কথায় কান দেন না। এইটুকু মেয়ে। তাকে বাগে আনার কী আছে। যেমন ইচ্ছে তেমন করুক। পড়াশুনাটা ঠিকমত করলেই হলো।
মোতালেব চাতালের কাজ শেষে এই রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফেরে। ময়না স্কুল শেষে বাড়ি যায় না। রাস্তার কোণে দাঁড়িয়ে থাকে। ময়নাকে দেখেই মোতালেব খুশিতে ‘ময়না, ময়না’ করতে থাকে।
‘স্কুলে গেছিলা?’
‘হ।’
‘বাড়িত যাও নাই?’
‘না।’
‘আমার লাইগা খাড়ায় আছো? আমারে না দ্যাখলে বুঝি ভালা লাগে না?’
‘ঢং।’
ময়না লজ্জা পায়। মোতালেব সেটা ভালো করেই বুঝে। এই মেয়ে প্রেম বুঝে কিনা জানে না সে। মোতালেবের মায়া আছে তার প্রতি, এটা বুঝে।
‘ময়না।’
‘হুম-ম-ম।’
‘ওহ ময়না।’
‘কী হইলো? ময়না ময়না করো ক্যান খালি? কী কইবা কও?’
‘তোমারে আমি খুব ভালোবাসি।’
‘হ জানি। আমার লাইগা আইজ কিছু আনো নাই?’
‘আনছি তো, আমার ময়না পাখি।’
‘দেহি দেহি, কী আনছো দেহি।’
‘খাড়াও, খাড়াও, দেহাইতাছি।
মোতালেব পকেট থেকে কানের দুল বের করে। ময়না হাত থেকে সেটা ছোঁ মেরে নেয়। ডান হাত বাম হাত করে বাজিয়ে দেখে ওজন আছে কিনা। এই দুলের কথা সে অনেক আগেই মোতালেবকে বলেছিল। মোতালেব তার কথা রেখেছে। ময়নার খুশির বাঁধ যেনো ভেঙ্গে গেলো।
‘তুমি আমারে এতো ভালোবাসো, মতু ভাই?’
‘হ, ম্যালা ভালোবাসি তোমারে। দুল পছন্দ হইছে?’
‘হ। অনেক পছন্দ হইছে। ম্যালা দিন আগে চাইছিলাম। কিন্যা দিলা আইজ!’
‘টাকা আছিলো না। ব্যাপারীর নিকট টাকা জমাইছিলাম। আইজ সেইটা দিয়া কিন্যা আনছি। দুল জোড়া পরো। আমি দেহি।’
‘অহন না। কাইলকা দেইখো।’
‘আইজ পরলে কি হয়। পরো না, ময়না আমার।’
ময়না কানের পুরাতন দুল জোড়া খুলে। নতুন জোড়া পরে নেয়। খুব মানিয়েছে। আয়না নেই কাছে। নিজের চোখে দেখতেও পারছে না। অগত্যা মোতালেবকেই বলতে হলো।
‘এই মতু ভাই।’
মোতালেব বুঝতে পারে ময়না জানতে চাইছে নতুন দুল জোড়ায় তাকে দেখতে কেমন লাগছে। মোতালেব ময়নার হাত ধরে একটু আড়ালে যায়।
‘কী হইলো? টানতাছো ক্যান?’
‘এই দিকে আসো। মানুষ যাইতাছে ঐদিক দিয়া।’
‘মানুষ গেলে আমার কী?’
‘কেউ দেইখা ফালাইলে তোমার বাপেরে কইয়া দিবো।’
‘ও বুজছি। অহন কওতো আমারে ক্যামন লাগতাছে?’
‘এক্কেরে শাবনুরের লাহান।’
‘হাছা? না বানাই বানাই কইতাছো?’
‘হাছা। আমার ময়নার কছম।’
‘আইচ্ছা। কিন্তু.........।’
‘কিন্তু কী?’
‘আমার অপু বিশ্বাসের লাহান সাজবার ইচ্ছা করে।’
‘সাজো। তোমারে মানা করছে ক্যাডা?’
‘কিন্তু আমার যে নাকফুল নাই। নাকফুল পরলে আমারে অপু বিশ্বাসের মতন লাগবো। তুমি দেইখা নিও।’
‘আমি তোমারে নাকফুলও দিমু, ময়না।’
‘কবে দিবা?’
‘বিয়াতেই দিমু।’
‘বিয়া করবা কবে?’
‘বিয়া!’
বিয়ের কথা শুনে মোতালেবের মাথায় বাজ পড়ে যেন। বাপ-মা মরে এতিম করে গেছে। তেমন কিছু রেখে যায় নি। আছে বলতে একটা ছোট বসত ভিটা। ঘরের পিছনে এক শতাংশ জমি। শাকসবজি ফলে। শেখের চাতালে কাজ করে যা জোটে চাল-ডাল কিনতেই পকেট ফাঁকা। দূরসম্পর্কের চাচির ঘরে খায় সে। মাসের শেষে চাচিকে মাসোয়ারা না ধরে দিলেও হয় না। মোতালেবের জন্য এই বৃদ্ধ চাচি তো আর কম কিছু করেনি। টানাটানির সংসারে ময়নারে নিয়ে এলে ঠিকমত সংসার চলবে কিভাবে? ভাবতে থাকে মোতালেব।
‘কী হইলো? কইলা না তো আমারে কবে বিয়া করবা।’
‘হু-ম-ম-ম, করুম। তুমি জানি কয় ক্লাশ পাশ দিছো?’
‘সাত ক্লাশ। এই বছর জেএসসি দিমু।’
‘ও আমার ময়না, ম্যালা লেহাপড়া করছো দেহি। তোমার বাপে তো আমার লগে তোমারে বিয়া দিবো না।’
‘আমি বিয়া করুম। আব্বার কী? আব্বায় তো তোমারে বিয়া করতাছে না। আমি করমু। তুমি আমারে নাকফুল দিবা?’
‘হ দিমু তো। কছম কাটলাম না?’
‘হ। তুমি আব্বারে কও, তুমি আমারে বিয়া করতে চাও।’
‘তোমার বাপে আমারে কোপাইবো।’
‘ক্যান? কোপাইবো ক্যান? আমার বুঝি বিয়া করতে ইচ্ছা করে না?’
‘খুব ইচ্ছা করে, ময়না?’
‘হ, খুব। তোমার করে না?’
‘হ করে তো। আমি তো মুক্ষো। আমারে বিয়া করবা?’
‘মুক্ষো তো কী হইছে? তুমি আমারে কত্ত কিছু কিইন্যা দাও। আব্বায় দেয় না। মুকুল চাচার মাইয়া রুপালী কত সাইজা গুইজা স্কুলে আহে। আমি সাজমু না, কও? আব্বারে কইছি নাকফুল কিন্যা দিতে। আমারে বকা দিছে। তুমি আমারে বিয়া করবা, নাকফুল দিবা। আমি তোমারেই বিয়া করুম।’
‘ক্যামনে করবা? তোমার কসাই বাপে তো তোমারে বিয়া দিবো না। আমার লগেতো দিবোই না। তাইলে?’
‘পালামু তোমার লগে।’
‘পালাইবা!’
‘হ। কতজনই তো পালাইয়া বিয়া করে। আমার স্কুলের মল্লিকা পালাই বিয়া করলো না? ওর একটা পোলা হইছে। কি সুন্দর দ্যাখতে!’
‘তোমার বাপে খুইজা বাইর করবো। চাপাতি দিয়া আমাগো দুইজনরে টুকরা টুকরা করবো। এক্কেরে কিমা বানাইবো। বুঝলা?’
‘কোন বাপ তার নিজের মাইয়ারে কাটতে পারে?’
‘তোমারে না কাটলেও আমারে ছাইড়া দিবো না।’
‘তুমি কও যে আমারে বিয়া করবা না, তাইলেই তো হয়। এত চালাকি করো ক্যান? আমারে নাকফুল কিন্যা দিতে পারবা না, তাই বিয়াও করবা না। হাছা কইছি না?’
‘ওরে ময়না! আমার বুকখান কাইটা দেহাই? তুই অহনও বুঝলি না আমি তোরে কত ভালোবাসি।’
‘তাইলে কাইলকাই চলো।’
‘কই?’
‘পালামু।’
‘কাইলকাই!’
‘হ, কাইল। পালাইবা কিনা, হ্যাইডা কও।’
এই কয়দিনে ময়না বিয়ে পাগল না নাকফুল পাগল হয়ে গেছে মোতালেব ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এটা বুঝতে পারে যে এই মেয়েকে আর থামানো যাবে না। ওর কথামতো না পালালে হয়তো আর কথাই বলবে না। মোতালেবের মাথা কাজ করে না, হাতগুলো কেঁপে উঠে। ময়নার গালে হাত রেখে বলে, ‘আইচ্ছা, কাইলকাই পালামু। তুমি কিছু কাপড় চোপড় নিয়া ডিরেক্ট বকশীবাজার চইলা যাবা।’
‘আইচ্ছা। তুমি আইবা তো?’
‘আমু। সাবধানে বাড়িত থাইকা বাইর হইবা। ধরা পড়লে তোমার বাপে তোমার আস্ত রাখবো না।’
‘তুমি চিন্তা কইরো না। আমারে কেউ দেইখবার পারবো না।’
বাজারে বাপের গোস্তের দোকানের সামনে ময়না দাঁড়িয়ে আছে। কাঁক ডাকতে শুরু করেনি তখনও। কোন দোকান খোলে নাই। মোতালেব সত্যিই অনেক অবাক হয়ে যায়। ময়নাকে দেখে বুকটা কেঁপে উঠে। কত বিশ্বাস করে সে ঘর ছেড়ে এসেছে। এরকম অস্থির মেয়েকে ঘরে রাখতে পারবে তো? মোতালেব ভাবে। এখন আর এসব ভেবে লাভ কী। পিছনে ফিরে তাকানোর সময় সুযোগ কোনটিই নেই। ময়নার হাত ধরে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলো মোতালেব।
‘কই যাইবা?’
‘আগে চলো তো।’
‘বিয়া করবা না আমারে?’
‘করুম তো। কয়বার কমু আর?’
‘নাকফুল দিবা তো?
মোতালেব কথা বলে না। ময়না দাঁড়িয়ে যায়। মোতালেবের মুখের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবে।
‘কী হইলো? খাড়াই পরলা যে?’
‘যামু না তোমার লগে।’
‘ক্যান? কী হইলো আবার?’
‘তুমি আমারে নাকফুল দিবা না।’
‘ক্যাডায় কইলো?’
‘আমি বুঝবার পারছি।’
‘ক্যামনে?’
‘আমি জিগাইলাম, তুমি নাকফুল দিবা কিনা, তুমি জবাব দিলানা তো।’
‘ওহ আল্লাহ্! এই মাইয়ারে আমি ক্যামনে বুঝাই? তোমারে নাকফুল দিমু বইলাই তো বিয়া করতাছি। তুমি না গেলে নাকফুল দিমু ক্যামনে? যাইবা না?’
‘হাছা? দিবা তো?’
‘হ হাছা। তোমার কছম কাটছি না? এই যাও, আবার তোমার কছম। আমার পরাণ পাখি ময়নার কছম।’
‘হইবো না।’
‘ক্যান?’
‘তুমি তোমার মরা মাও-বাপের কছম কাইটা কও, আমারে নাকফুল দিবা?’
‘আইচ্ছা, আমার মরা মাও-বাপের কছম। হইছে এইবার?’
‘বারো আনা সোনার নাকফুল। দিবা তো?’
‘হ রে ময়না, তাই দিমু। এইবার চলো। দেরী হইলে লোকে ধইরা ফালাইবো।’
‘চলো। ’
নিজে একা হলে কোন সমস্যা ছিলো না কিন্তু ময়নাকে নিয়ে খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে যায় মোতালেব। শহরে যেয়ে বাসে করে সোজা মুন্সিগঞ্জ। দূর সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে ওঠে। সেখানেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। ততক্ষণে গ্রামে শোরগোল পড়ে গেছে। ময়না আর মোতালেবকে পাওয়া যাচ্ছে না। মোতালেব মোবাইলে তার চাচি আর ময়নার বাড়িতে খবর পাঠায়। প্রথম দিকে হুমকি ধামকি দিলেও দিন বিশেক পর ময়নার বাপ এ বিয়ে মেনে নেয়। অবশ্য মেনে নেয়া বলতে মোতালেব আর ময়না নিজেদের গ্রামে ফিরতে পেরেছে। ময়না এখনও বাপের বাড়ি যেতে পারেনি, বাপের বাড়ি থেকেও কেউ নিতে আসেনি। ময়নার মা মাঝে মাঝে এটা সেটা পাঠিয়ে দেয় মেয়ের কাছে। নিজের সংসারেই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে সেরকম সাহায্য করার ক্ষমতা তার নেই। নাকফুল দিতে পারেনি বলে বিয়ের পিড়ি থেকেই উঠে পড়েছিলো ময়না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিয়েটা পার করা গেছে। গ্রামে আসার পর থেকে আবার শুরু সেই নাকফুলের বায়না।
আজ বায়নার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে ময়না। ময়না মানেই বুঝি বায়না আর বায়না? মোতালেব ভাবে। দেরী হয়ে যাচ্ছে। কাজে যেতে হবে। দেরী করে চাতালে গেলে ম্যানেজারের ঝাড়ি গিলতে হয়। হজম হয় না, বুকে বেঁধে যায়। আজ নির্ঘাত আরও বেশী ঝাড়ি শুনতে হবে। গেলা যাবে কিনা সেটাই কথা। ময়নাকে সামাল দিতেই সকাল পার হয়ে যাচ্ছে।
‘ময়না, ও ময়না, আমার কথা হুনবানা?’
‘কইলাম না, আমার লগে কথা বলবা না?’
‘তুমি আর কয়টা দিন ধইরযো ধরো সোনা, আমি তোমার জন্য ভালো একখান নাকফুল বানাই আনমু।’
‘তোমারে আমি বিশ্বাস করি না। তুমি বিয়ার আগে কইছিলা বিয়ার সময় নাকফুল দিবা। দাও নাই। বিয়ার সময় হগগোলে মিলা কইলা বিয়ার দুই তিন পর নাকফুল কিন্যা দিবা তুমি। দ্যাও নাই তো। তুমি একটা মিথ্যুক, চামার। মরা মাও-বাপের কছম খাইছিলা না? তোমার মরা মাও-বাপ কবরে শান্তি পাইবো না, কইলাম।’
মোতালেব এবার নিজেকেই সামাল দিতে পারে না। মরা মা-বাবাকে নিয়ে ময়নার মুখে এরকম কথা শুনে মাথায় আগুন ধরে গেলো।
‘শালি! তুই আমার মরা মা-বাপ নিয়া কতা কছ!’
ময়নার চুল ধরে টেনে ধরে মোতালেব। মুখে কয়েকটা চর কষে দেয়। মাথায় আগুন ধরে গেছে।
‘ওরে, মাইরা ফালাইলো রে।’
ময়নার গলা যেন আকাশ পর্যন্ত পৌঁছালো।
আশপাশের বাড়ি থেকে সবাই ছুটে এলো। মোতালেবের বৃদ্ধ চাচি খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ে এলো। বেচারির এক পা ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। ব্যথায় বিছানায় পরে থাকার মত অবস্থা। তাতে চলবে কী করে? শরীরের এই অবস্থা নিয়েই ঘরের সব কাজ করতে হয়। মোতালেবের জন্য আগে রান্না করতে হতো। ময়না আসার পর আর রান্না করতে হচ্ছে না। ময়না নিজেই ঘর সামলাচ্ছে। দৌড়ে এসে দেখে ময়না কাঁদছে। মোতালেবের নাম করে গালি দিচ্ছে। তুই-তুকারি করে যা মুখে আসছে তাই বলছে। মোতালেব আবার ক্ষেপে যায়। ময়নাকে মারার জন্য একটা লাকড়ি হাতে নেয় সে।
‘ময়না!’
‘ঐ থাম। শক্তি দেখাইতাছস?’ মোতালেবের চাচি জমিলা বেওয়া থামিয়ে দেয় তাকে। মোতালেব ঘরের দরজার চৌকাঠে বসে মাথার চুল টানে। জমিলা ময়নার মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
‘কী হইছে রে, মা। এমন করছ ক্যান?’
‘ওহ অহন আমার দোষ?’
‘আমি কি কইছি যে তোর দোষ? মোতালেবের দোষ। ও তোরে মারছে।’
‘শয়তান একটা! আমারে কইছিলো নাকের ফুল কিন্যা দিবো। অহন নাকফুলের কথা কইলেই মাথা বিগড়া যায়। আমার গায়ে হাত তুলছোস না! আব্বারে কইয়া দিমু। তোরে হাসুয়া দিয়া কাইটা ধলেশ্বরীতে ভাসাই দিবো। দেইখা নিস।’
‘দে, তোর বাপরে কইয়া দে। তোর বাপতো কসাই না জল্লাদ।’ মোতালেব বসে থাকা অবস্থাতেই জবাব দেয়।
‘তুই কথা কইবি না। কইছি না চুপ কইরা বইয়া থাকতে? ঐ তোর চাতালে যাইতে হইবো না?’ জমিলা জিজ্ঞেস করে।
‘যামু না। কার লাইগা কাম করুম? আমার কেউ নাই। আমি না খাইয়া থাকুম। কাম করন লাগবো না আমার।’
‘আমি কইতাছি, তুই অহনি যাবি।’ জমিলা এমনভাবে কথাটা বললো যেন সে মোতালেবকে আদেশ করলো। মোতালেব অনড় থাকে।
‘কী হইলো? উঠছ না ক্যান? আমার কথা কানে যায় না? যা, চাতালে যা।’
এবার আর জমিলার কথা ফেলতে পারলো না মোতালেব। জমিলা মোতালেবের জন্য কম কিছু করেনি। এতিম মোতালেব ছোটবেলা থেকে এই চাচির কাছেই মানুষ হয়েছে। নাহলে কবেই বানের জলে ভেসে যেত। মোতালেব ঘরের ভিতর ঢুকলো। ঘাড়ের গামছা আর কী যেন একটা নিয়ে পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বাইরে বের হয় সে। যাবার সময় বলে, ‘চাচি ওরে কইয়া দাও, আইজকাই ওর নাকের ফুল বাড়িত আইবো। না আইলে আমার লাশ আইবো। কইয়া দাও, শালিরে।’
মোতালেব বাইরে চলে যায়। জমিলা ময়নাকে বুঝাতে থাকে। ময়না শান্ত হয়। আশপাশের বাড়ি থেকে যারা এ দৃশ্য দেখতে এসেছিলো তারাও কী সব কানাঘুষা করতে করতে যে যার বাড়িতে চলে যায়। শুধু একজন মোতালেবের ঘরের পিছনে লুকিয়ে থাকে। সে হলো আকরাম মুন্সী। মোতালেবের দূর সম্পর্কের ভাই। পাশেই বাড়ি। দুই বিয়ে করেছে। আগের বউ একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাপের চলে গেছে অনেক দিন হয়েছে। ছোট বউকে নিয়ে বর্তমান সংসার। গ্রামের মেয়ে-মহিলারা তাকে ভালো চোখে দেখেনা। আকরাম মুন্সীর স্বভাবে খুঁত আছে। মেয়ে-মহিলা দেখলে আড় চোখে তাকানোরস্বভাব জাত অভ্যাস তার। সে লুকিয়ে লুকিয়ে ময়নার দিকে নজর রাখে। ময়না কাপড় গোছাচ্ছে। একটা কাপড়ের পুঁটলি বেঁধে ফেলেছে। আকরাম মুন্সী ময়নার গতিবিধি লক্ষ্য করছে। ময়না এপাশ ওপাশ তাকিয়ে ঘরের পিছনদিক দিয়ে বের হয়। আকরাম মুন্সীকে সে দেখতে পায় না। হাঁটতে হাঁটতে ময়না রাস্তায় এসে পড়েছে। কেউ দেখতে পাচ্ছে কিনা খেয়াল করলো। আকরাম পিছু পিছু হাঁটা শুরু করেছে। ময়না পিছন ফিরে তাকালেই সে নিজেকে আড়াল করছে। একটু পর ময়না দেখতে পায় তাকে। আকরামকে দেখেই দ্রুত হাঁটতে শুরু করে ময়না। আকরাম আর লুকোচুরি খেলতে চায় না। এতদিনের লুকিয়ে রাখা সাধনা এবার পূরণ করতেই হবে। এখনই সুযোগ। ময়না আর পিছনে তাকায় না। পিছনে বিপদ বেশী, লাভ নেই। আকরাম পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। ময়নার পিছনে গিয়ে আসতে করে ময়নার নাম ধরে ডাকে।
‘ময়না ভাবি, ও ময়না ভাবি।’
মোতালেব বয়সে অনেক ছোট, অথচ তার স্ত্রীকে ‘ভাবি’ বলে ডাকা আকরামের একটা মতলব।
‘কী হইছে? আপনে আমার পিছে পিছে আসতাছেন ক্যান?’
‘কই যাইতাছো তুমি?’
‘জাহান্নামে।
‘ঐ দ্যাখো, ভাবি কয় কী! এইডা তো জাহান্নামের পথ না।’
‘তাইলে কিয়ের পথ?’
‘এইডা তো তোমার বাপের বাড়ি যাওনের পথ। মোল্লাটারি।’
‘হ, বাপের বাড়ি যাইতাছি। আপনি যান গা। আমারে যাইতে দ্যান।’
‘বাপের বাড়ি যাইবা?’
‘হ।’
‘ভাবি, এই কাম কইরো না।’
‘ক্যান? আমার বাপের বাড়ি আমি যামু। আপনের সমস্যাটা কী কোন দেহি।’
‘ঠাণ্ডা মাথায় আমার কথা হুনো।’
ময়না হাঁটতে থাকে। আকরাম পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলে।
‘কী কথা?’
‘তোমার বাপে কি তোমার বিয়া মাইনা নিছে?’
‘না।’
‘তাইলে তুমি যে বাপের বাড়ি যাইতাছো। তোমার বাপে কি তোমার আস্ত রাখবো মনে করতাছো?’
‘যা ইচ্ছা করুক। মারুক, কাটুক। আমি তাও যামু।
‘ভাবি, হুনো হুনো। মোতালেব তোমারে নাকফুল দেয়নাই বইলাইতো তুমি বাপের বাড়ি যাইতাছো। হাছা নি?’
‘হ্যায় আমারে মারছে।’
‘দ্যাখছি তো আমি। আহা রে, ময়না ভাবির সোনার লাহান শরিলডারে মাইরা ক্যামন তামা বানাই দিছে, পশুডা, চামারডা।’
‘এই জন্যি তো বাপের বাড়ি যাইতাছি। আমি আর কোনদিনও হ্যার কাছে আমু না। হ্যার মুখ পর্যন্ত দ্যাখমু না। কইলাম।’
‘আমি তো কইতাছি না, তুমি ঐ শুয়ারের মুখ আর দ্যাখো।’
‘তাইলে? আমি আব্বার কাছেই যামু। পা ধইরা কান্নাকাটি করমু। মাপ চামু। মায় আছে। আব্বারে সামাল দিবো। মাইয়ার কান্দনে বাপ মা মাপ না কইরা পারে? আপনেই কন, আকরাম ভাই।’
‘তুমি যত সহজ ভাবতাছো তত সহজ না গো, ময়না ভাবি। তোমার বাপের হাতে চাপাতি থাকে। ওইটা দিয়া সোজা কোপ দিয়া তোমার মুণ্ডুটা ধর থাইকা আলাদা কইরা ফালাইবো। তুমি দ্যাইখা নিও।’
ময়নার বুকের ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু হয়। বাপের বাড়ি যাবে কি যাবে না, ভাবে সে। ময়নাকে চিন্তাগ্রস্ত করতে পেরে আকরাম মনে মনে নিজেকে একধাপ সফল মনে করে। তার ঔষধে কাজ হচ্ছে। এইবার বড় টোপটা ফেলতে হবে। মাছ বড়শির কাছে এসে লাফালাফি করছে মনে হচ্ছে। আকরাম আরও আগ্রাসী হয়ে উঠে। ময়নাকে তার অনেক মনে ধরেছে। যে কোন কিছুর বিনিময়ে ময়নাকে তার চাই-ই চাই। মনের কথাটা আর আটকাতে পারলো না সে।
‘ময়না ভাবি, কিছু মনে না করো যদি, আমি একখান কথা কই তোমারে?’
‘হ, কন।’
‘সোনার নাকফুল চাও তো?’
‘হ, চাই। মতু দিলো না, মিথ্যাবাদী।’
‘আমি যদি তোমারে হীরার নাকফুল দেই, নিবা?’
‘হীরার নাকফুল!’
‘হ, খাঁটি হীরার। আমেরিকার হীরা।’
হীরা কোথা থেকে আসে, আকরাম সেটা জানেনা। ময়নাতো জানার কথাই না। আকরাম একটা দেশের নাম বলে দিলো আর কি। ময়নার মনে ধরেছে আকরামের প্রস্তাব। কিন্তু আকরামের কাছ থেকে সে নাকফুল নিতে যাবে কেনো? আকরাম তো তার কিছু হয় না। ময়না ভাবে। নাকফুলের প্রতি তার যেমন আগ্রহ, আকরামের প্রতি তার তেমনই বিরক্তি।
‘আপনার কাছ থাইকা আমি নাকফুল নিমু ক্যান? আপনে আমারে নাকফুল দিবেন ক্যান? আমি আপনার কী লাগি?’
‘ইশি রে! কী কথাখান কইলা গো, ময়না ভাবি। তুমি হইলা গিয়া আমাগো মোতালেবের বউ। আমার ভাবি। আমি তোমার দেওর লাগি না? কও, লাগিনা?’
‘হ, লাগেন। আমি তাও নিমু না। আপনার বউ আছে। হ্যার হাত গলাতো ফাঁকাই দেহি। কোনো গয়নাগাটি নাই। নিজের বউরে দ্যান গিয়া। আমার লাগবো না।’
‘ও ভাবি, তুমি দ্যাহো নাই। ওরে অনেক গয়না কিন্যা দিছি। হ্যায়তো ক্যান্সারের রুগী। কোন দিন যে মইরা যায়।’
‘রুগী! আমি তো তারে মরদের লাহাইন হাঁটা চলা করতে দ্যাহি। হ্যায় আবার রুগী হইলো ক্যামনে?’
‘হ, তুমি ঠিকি কইছো। বাড়ির বাইর আইলে হ্যায় ঠিক থাহে। আর বাড়িত ঢুকলে বিছানায় হুইয়া পরে। মইরা যাইবো। বাঁচবো না বেশীদিন।’
‘তাইলে আমারে নাকফুল কিন্যা না দিয়া আপনার বউয়েরে ডাক্তার দেহান, চিকিৎসা করান।’
‘আরে, ময়না ভাবি! তুমি সহজ কথা বুঝবার চাওনা ক্যান? ক্যান্সার রোগ সাড়ে না। অইডা হইলো গিয়া মরণব্যাধি। ওষুধ, ডাক্তারে কোন কাজ হয়না।’
কথা বলতে বলতে আকরাম মুন্সী ময়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। ময়না আর এগুনোর পথ পায় না। এপাশ ওপাশ সড়ে এগুতে চাইলেও আকরাম পথ আগলে ধরে।
‘কী হইলো, আমার পথ আটকাইতাছো ক্যান? আমারে যাইবার দ্যান।’
আকরাম বেশী বাড়াবাড়ি করে না। বেশী বাড়াবাড়ি করলে ময়না চিৎকার করে লোক জড়ো করবে, বুঝতে পারে না। তাই ময়নাকে আরও কিছু লোভ দেখানোর চেষ্টা করে সে।
‘ময়না ভাবি, তোমার বিল্ডিং বাড়িতে থাকোনের ইচ্ছা করে না? দাসি বান্দি থাকবো, টিভি থাকবো, ভিসিআর থাকবো। তোমার হাতে মোবাইল থাকবো। মোবাইলে গান হুনবা। ছাপা টাঙ্গাইল শাড়ি পরবা। আলতা চুরি পরবা। ইচ্ছা করে না?’
‘ইচ্ছা করলেই কী আর না করলেই কী? ক্যাডা আমার ইচ্ছা পূরণ করবো?’
‘আমি, আমি করুম গো ময়না ভাবি। ইশি রে, তোমার গলা, হাত দ্যাহি একদম খালি। মাইয়া মাইনষের গলা হাত নাক খালি থাকলে ভালা লাগে? তুমিই কও।’
ময়না কোন উত্তর দেয় না। আকরাম সামনে থেকে সড়ে যেতেই হনহন করে হাঁটতে থাকে সে। আকরাম হাল ছাড়ার পাত্রই নয়। শেষ কৌশলটা প্রয়োগ করে সে।
‘ময়না ভাবি, শেষবারের মত একখান কথা কই, তুমি চিন্তা কইরা দ্যাখো।’
‘কী?’
‘তুমি যদি এই অবস্থায় বাপের বাড়িত যাও। তোমার মাও-বাপের ইজ্জত থাকবো? গাঁওয়ের লোকজন থুথু দিবো না? বাপের বাড়িত থাইকা পলাইয়া মোতালেবরে বিয়া করলা। সেই নিয়া তোমার মাও-বাপরে তো গাঁওয়ের লোক কম কথা হুনায় নাই। এইবার এইভাবে স্বামী ছাইড়া বাপের বাড়ি ফিরা আইছো, এইডা হুনলে গাঁওয়ের লোকজন এমন কইরা থুথু দিবো যে লজ্জায়, শরমে তোমার মাও, তোমার বাপ গলায় দড়ি দিবো না? কও।’
মোতালেবের শেষ কথাগুলো ময়নার মনে গেঁথে যায়। সত্যিই তো, আমার জন্য যদি মায়, আব্বার গলায় দড়ি দেয়! ময়না ভাবে। কী করবে সে এখন? কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে আকরামকেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনেই কন, আকরাম ভাই, আমি অহন কী করমু?’
‘ময়না ভাবির ব্রেন দেহি খুইলা গ্যাছে! আরে ময়না ভাবি, আমি হইলাম তোমার দেওর। আমি কি তোমার খারাপ চাইতে পারি, কও? তোমার মাও-বাপের ইজ্জত মানেই তোমার ইজ্জত। তোমার ইজ্জত আমার ইজ্জত না?’
এই কথাগুলো শুনে ময়নার মন আকরামের প্রতি একটু দুর্বল হয়। আকরাম বুঝুতে পারে ওষুধে কাজ হচ্ছে। এবার সে শেষ চালটা চালে।
‘ময়না ভাবী।’
‘হ, কন।’
‘তুমি আমার লগে শহরে চলো।’
‘শহরে ক্যান?’
‘ইশি রে! তোমার তো দেহি খুবই ভোলা মন। কইলাম না, আমি তোমারে হীরার নাকফুল কিন্যা দিমু?’
‘হ, কইছেন।’
‘খালি নাকফুল না গো, ময়না ভাবি। আমি তোমার খালি গলা, খালি হাত হীরার গয়নায় ভরায় দিমু।’
‘এতো কিছু!’
‘ময়না ভাবি, তুমি মানুষখান খুবই ভালা। মোতালেবের কপাল, তোমারে বউ বানাইতে পারছে। হ্যায় তোমার মর্মখান বুঝবার পারলো না। আমি পারছি গো, ময়না ভাবী, আমি পারছি। তোমারে খালি গয়না ক্যান, তোমার লাইগা আমি এই জীবনখানও দিয়া দিমু।’
ময়না আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। আকরামের প্রত্যেকটা কথা মধুর মতো লাগছে। এভাবে কখনও মোতালেবও বলেনি। সেই মোতালেবের হাত ধরে মাও-বাপের ঘর ছেড়েছে সে। নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে ময়নার। মোতালেবের আগে কেনো আকরাম মুন্সীর সাথে দেখা-পরিচয় হলো না, ময়না ভাবে। আকরামকে ময়নার মনে ধরেছে। বাপের বাড়ি যাওয়া মানে আরও গঞ্জনা। গ্রামের লোকের কথায় টেকা যাবে না। মাও-বাপ হয় বিষ খাবে, নয় গলায় দড়ি দেবে। তার চেয়ে বড় কথা, কসাই বাপ, হাতের চাপাতি দিয়ে সত্যি তাকে জবাই করেও ফেলতে পারে। মনে মনে ভয় পেয়ে যায় ময়না। একটাই উপায়, আকরামের প্রস্তাব গ্রহণ করা।
‘সত্যই তো, আকরাম ভাইয়ের মনটা অনেক বড়। তার সাথে গেলে আমার সুখ আর সুখ। হাতে বালা, গলায় হার, তাও আবার সোনার নয়, হীরার। আর আমার অনেক সাধের নাকফুল!’ নিজে নিজে এ কথাগুলো বলে ময়না।
আকরাম তার হাতদুটো একসাথে করে ময়নার করুণা প্রার্থনা করছে যেন। ময়না আকরামের মুখের দিকে তাকাতেই আকরামের দুচোখ যেন অশ্রুতে ভেসে যেতে শুরু করে। ময়না নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না।
‘আপনে আমারে বিয়া করবেন, আকরাম ভাই?’
ময়নার এই প্রশ্ন আকরাম আশা করেনি। ময়না নিজ থেকেই এভাবে প্রশ্ন করাতে সে যেন মেঘের আগেই বৃষ্টি পেয়ে যায়। আকরামের গুলতিতে পাখি মরেছে। ময়না সাড়া দিয়েছে। যেভাবে আকরাম চেয়েছে ঠিক সেভাবে।
‘ইশি রে! ময়না ভাবী, তোমারে ক্যাডা বিয়া করবো না কও দেহি? পত্তম যে দিন দ্যাখছি ঐ দিন থাইকাই তোমারে বিয়া করতে ইচ্ছা করে। ময়না ভাবী গো, ময়না ভাবী, আমার ইচ্ছাখান পূরণ করতে দিবা তো?’
‘হ দিমু। তয় আপনার কথাগুলা রাখোন লাগবো কিন্তু। আপনেও মোতালেবের লাকান ওয়াদার খেলাপ করেন না যেন।’
‘ইশি রে! ময়না ভাবী, মোতালেব একটা মানুষ হইলো? হ্যায় তো একটা পশু, শুঁয়ার। তুমি ওর লগে আমার তুলনা করলা, ময়না ভাবী? এই কষ্টখান কইযে রাখি!’
‘আইচ্ছা, আমার ভুল হইয়া গ্যাছে, আকরাম ভাই। মাফ কইরা দ্যান আমারে।’
‘তুমি চলো, আমার লগে চলো। আর দেরী করন যাইবো না। কেউ দেইখা ফালাইলে বড় কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবো।’
‘হ, চলেন।’
‘তুমি ঘোমটা টাইনা মুখটা ঢাইকা নাও। কেউ যেন দেইখবার না পারে। চিনবার না পারে তোমারে। তুমি আগে আগে হাডো। আমি পিছে পিছে।’
মোতালেবের কথা একবারের জন্যও ভাবলো না ময়না। আকরামের সাথে শহরে চলে যায় সে। বখশীবাজারের লোকজন দেখলে চিনতে পারে, তাই মোড়লগঞ্জ হয়ে মুন্সীগঞ্জের দিকে রওয়ানা দেয় তারা।
আজ বেশ খানিকটা সময় আগেই বাড়িতে ফিরে মোতালেব। অন্য দিনগুলোতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সকালে ময়নার গায়ে হাত তোলার পর থেকে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না সে। পুরুষ মানুষের কাঁদতে হয় না। কাঁদলেই পুরুষত্ব থাকে না। মোতালেবও কাঁদতে চায় নি। আজ কেন যেন থেকে থেকে দুচোখ দিয়ে পানি ঝরেছে। ঘাড়ের গামছাটা দিয়ে সে পানি মুছেছে। চাতালে গেলেও কাজ করেনি আজ। বখশীবাজারে গিয়ে সাত্তার আলীর কাছে টাকা নিয়েছে। সারা গ্রামে সুদখোর হিসেবে খ্যাতি আছে সাত্তার আলীর। মোতালেব সুদের উপর হাজার দশেক টাকা চাইলেও তা দিতে রাজী হয়নি সাত্তার আলী। ঘরের পিছনের এক শতাংশ জমিটা বন্ধক রেখে টাকা চেয়েছে মোতালেব। সাত্তার আলী তাতেও রাজী হয় নি। মোতালেবের টাকা দরকার। জমির দরকার নেই। ময়নাকে যে কোনভাবেই হোক আজ নাকফুল কিনে দিতে হবেই। বাধ্য হয়ে জমিটা মাত্র দশ হাজার টাকাতেই সাত্তার আলীর কাছে বিক্রি করতে হলো। সাত্তার আলী শর্ত জুড়ে দিলো। দশ হাজার টাকাই সে দেবে যদি মোতালেব জমির সাথে তার বসতভিটাও তাকে দিয়ে দেয়। অবশ্য মোতালেবের বসতভিটা সাত্তার আলীর কাছে বন্ধক হিসেবে থাকবে। মোতালেবের মাথা কাজ করে না। চোখের সামনে বারবার ময়না মুখটা ভাসে। ময়নাকে খুব ভালোবাসে সে। সে ভালোবাসার কাছে জমি, বসতভিটা- এসব খুবই সামান্য। মোতালেব রাজী হয়ে যায়। বখশীবাজারে যাবার আগেই চাতালের ম্যানেজার শামসুল মিয়ার কাছে জমানো দুই হাজার টাকা ফিরত নেয় সে। বারো হাজার টাকা নিয়ে মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে রেডিমেড একটা সোনার নাকফুল কেনে সে। বাইশ ক্যারটের খাঁটি সোনার বারো আনায় বানানো নাকফুল। এর সাথে একটু নোলকমত অংশ আছে। ময়নার খুব পছন্দ হবে নাকফুলটা, মোতালেব ভাবে। আজ তার সোনার ময়না পাখির মুখে কথার বুলি ফুঁটবে। কিশোরী ময়নার অগোছালো কথাগুলো মোতালেবের খুব ভালো লাগে। যতই রাগ করুক, অভিমান করুক, ময়না যে তাকে খুব ভালোবাসে, এটা মোতালেব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। বিয়ের পর প্রায় একমাস হতে চলেছে। ময়না একবারের জন্যেও তার বাপের বাড়ি যেতে চায় নি। মোতালেবকে ছেড়ে ময়না কোথাও যেতে পারবেনা, থাকতেই পারবে না মোতালেবকে ছাড়া, এটা মোতালেবের বিশ্বাস। সেই সকাল থেকে মুখে এক-দুই গ্লাস পানি ছাড়া আর কিছুই পড়েনি। নাকফুল কিনে সোজা বাড়ি এসেছে সে। ময়নার নাকে নাকফুল পরিয়ে দিয়ে তার নাকফুল পরা কোমল মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাত খাবে সে। সেই আশা নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে মোতালেব। বাড়ির সদর দরজায় পা রাখার আগেই ‘ময়না, ময়না’ বলে চিৎকার শুরু করে। ময়নার সাড়া নেই। এখনও তাহলে অভিমান নিয়েই বসে আছে ময়না? মোতালেব নিজেকে প্রশ্ন করে। ঘরের ভিতরে ঢুকে ময়নাকে দেখতে পায় না সে। নিশ্চয়ই চাচির কাছে গিয়ে চুপ করে বসে আছে তার অভিমানী ময়না পাখি, মোতালেব ভাবে।
‘চাচি, ও চাচি।’
‘কি রে মোতা, তুই আইছস?’
‘হ, চাচি। ময়নারে ডাকো। কও যে, আমি ওর লাইগা নাকফুল আনছি। এক্কেরে বারো আনা খাঁটি সোনার নাকফুল। কই, ডাকো। ময়না, ও ময়না। আসো। দ্যাহো, তোমার লাইগা নাকফুল আনছি। আর গোসসা কইরা থাকতে হইবো না। আসো।’
‘ময়না, আমার কাছে যায় নাই তো রে মোতা।’
‘তাইলে? হ্যায় তো ঘরের ভিতরেই নাই, বাড়িত নাই তো, চাচি।’
‘তুই যাওনের পর আমিও গ্যাছি। হ্যায় তো ঘরেই আছিলো।’
‘তাইলে গ্যালো কই?’
‘দ্যাখ দেহি, মাইয়াডা গ্যালো কোনহানে। ময়না, ও ময়না। বাড়িত আয়। মোতা আইছে।’
ময়নার কোন সাড়া না পেয়ে মোতালেব বাড়ির বাইরে চিৎকার শুরু করে, ‘ময়না, ময়না।’ পিছনে পিছনে জমিলাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করে। ময়নার নাম ধরে সেও ডাকে। ময়নার কোন সাড়া মিলছে না। আশপাশের বাড়ি থেকে মহিলারা বেড়িয়ে এসেছে। মোতালেব তাদেরকেও জিজ্ঞেস করছে।
‘শেফালী ভাবী, ময়না কি তোমার বাড়িত আছে?’
‘না রে, মোতা।’
‘ও করিমন চাচি, ময়নারে দ্যাখছো?’
‘কই না তো। হ্যায় তো আমাগো বাড়িত কোনদিন আহে না।’
সকালের সেই ঘটনা নিয়ে কেউ কেউ কানাঘুষা করতে থাকে। মোতালেবের কান এড়াতে পারে না তা।
‘সকালে মাইয়াডারে যেই পিটানিটা দিলা। দ্যাখো গা, বাপের বাড়ি চইলা গ্যাছে হয় তো।’ আলালের বউ বলে।
মোতালেব সোজা বখশীবাজারে গিয়ে মোবাইল ফোনের দোকান থেকে ময়নার গ্রামে তার পরিচিত একজনকে ফোন করে। মোবাইলের দোকান থেকে সেই লোকের নাম্বার ম্যানেজ করে সে। ময়নার বাপের কাছেও মোবাইল ফোন আছে। সে নাম্বারও বাজারের একজনের কাছ থেকে ম্যানেজ করে মোতালেব। কিন্তু শ্বশুরকে ফোন দেয় না। কসাই শ্বশুর এই ঘটনা জানতে পারলে সারা দুনিয়াটাকেই জবাই করে ফেলতে পারে। ঘণ্টা খানিক পর আবার সেই লোককে ফোন দিয়ে জানতে পারে ময়না তার বাপের বাড়ি যায়নি। মোতালেবের মাথা ঘুরে যায়। দু চোখে যেন অন্ধকার দেখছে সে। তাহলে ময়না গেলো কোথায়? বখশীবাজার ছেড়ে আবার গ্রামের পথে পা বাড়ায় মোতালেব। গ্রামের গোটা পথ চিৎকার করতে করতে আসে মোতালেব। শরীরের শেষ শক্তিটুকুও যেন শেষ হতে চলেছে।
মাঝপথে এসে রাস্তার উপর বসে পড়ে মোতালেব। কেন ময়নার গায়ে হাত তুলতে গেলো সে? রাগটা কেন সামলাতে পারলো না? নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। দু হাত দিয়ে মাথার কোঁকড়া চুলগুলো টানতে শুরু করে। আবার উঠে পড়ে। নিস্তেজপ্রায় শরীরটা নিয়ে হাঁটা শুরু করে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না। মোতালেব কাঁদে। ডুকরে ডুকরে কাঁদে।
‘ময়না, ময়না, আমার ময়না পাখি, কই গ্যালা তুমি? এই দ্যাহো, তোমার লাইগা নাকফুল কিন্যা আনছি। নাকফুল নিবা না? ময়না।’
ময়না সাড়া দেয় না। সে উড়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে থাকে মোতালেব। বেখেয়ালি হাত থেকে নাকফুলটা রাস্তায় পড়ে যায়। মোতালেব হাঁটতে থাকে আর চিৎকার করে, ‘ময়না, ময়না, তুমি কই গ্যালা ময়না?’
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোমিনুল হক আরাফাত ১৮/১২/২০১৬darun
-
সোলাইমান ১৫/১২/২০১৬বেশ তো, চমৎকার কথামালায় সুন্দর ছন্দে দারুণ লিখেছেন কবি। ভাল লিখুন ভাল থাকুন সবসময় প্রিয় কবি।