মা
কত মানুষ ঘর ছাড়ে, সংসার ছাড়ে, পরিবার ছাড়ে, দেশান্তরী হয়, সাধুসন্ন্যাসী সাজে। দূরে কোথাও হারিয়ে যায়। হাজারবার হাতরিয়ে এদের খোঁজ হয়তো মেলে, কিন্তু আগের সেই মানুষগুলোকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। কামালও চেয়েছিলো দূরে কোথাও চলে যেতে। মায়ের উপর রাগ করে প্রায়ই সে বলতো, “থাকবো না এই বাড়িতে, তোমরা থাকো, আমি দূরে কোথাও চলে যাবো। আর কখনও ফিরবো না। এই বলে রাখলাম। একদিন আমাকে খুঁজেও পাবে না তোমরা।”
“যাও। যার যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাও। আমি আর পারছিনে বাবা।” কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন কামরুন্নেসা।
সংসারের যন্ত্রণা তিনি সত্যি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। পারবেনই বা কেন? স্বামীহারা সংসারে ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে কোন নারী এত কষ্ট করতে পারে? মায়ের কষ্টটা না বুঝার মত ছেলে কামাল ছিল না। সবার ছোট হলেও কিশোর কামালের দুচোখ মায়ের কষ্ট দেখে অশ্রুতে ছলছল করতো। ভাগ্যিস কামালের বাবা তাঁর জীবদ্দশাতেই চার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তা না হলে যে কী হত! মা ‘মা’ বলেই হয়তো এত কষ্ট সহ্য করেছিলেন। কিন্তু কামালের সহ্যক্ষমতার একটা সীমা ছিল। ক্ষুধার অসীম কষ্ট পেট থেকে যেন গোটা পৃথিবীকে ঘিরে ধরতো। কামাল একদম সহ্য করতে পারছিলো না। উনুনে অনলের ছোঁয়া পরতো যখন, কামালের পেটে যেন তখন ক্ষুধার রাজ্য ভর করতো।
“আমাকে খাবার দাও, মা। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে।”
মুষ্টি তোলা সিকের চাল ভেজে, বোতলের তলায় জমে থাকা কিছু সরিষার তেল ঝেড়ে লবণমাখা করে ছোট তিন ছেলেমেয়ের সামনে দিলেন কামরুন্নেসা,
“নে, খা। রাতে ভাত খাইস। বিড়িটা ফ্যাক্টরিতে জমা দিয়ে চাল তরকারি কিনে আনিস। এখন এটা খা।”
রংপুরের যে অঞ্চলটাতে কামালদের বাড়ি সেখানে অনেকগুলো বিড়ি তৈরির কারখানা আছে। কৃষি কাজ নেই। জনবহুল এলাকা। আবাদের জমি নেই, বিড়ি কারখানার গাঢ় তামাটে ধোঁয়া আছে। অসহ্য কড়া রকমের গন্ধে তামাকের ধোঁয়া বাতাসে উড়ে। বাড়ির টিনের চালগুলোর রং পালটে বাদামী হয়ে থাকে। বাতাসের এই তামাকীয় গন্ধ এখানকার মানুষগুলোর কাছে অনেক আপন হয়ে গেছে। কারখানাগুলো খোলা থাকলে মানুষগুলোর মুখে হাসি থাকে। কাজ থাকলে উনুনে আগুন জ্বলে, হাড়িতে ভাত থাকে, পেটে খাবার পড়ে।
যারা গরীব, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা যাদের, তাদের জিহ্বায় জল আসে ফিন্নি পোলাওয়ের কথা শুনে নয়, শুধু ডাল–ভাতের কথা শুনে। রাতে ভাত রান্না হবে, এটা মনে করে খুব ভাল লাগছিলো কামালের। পরম আনন্দে অন্য ভাইবোনদের সাথে বিড়ি তৈরি করতে বসে সে। কামাল ভাল করেই জানতো, তারা যা তৈরি করছে তা মানুষকে নেশাগ্রস্থ করে, মৃত্যুমুখী করে। কিন্তু এ ছাড়া যে আর কোন উপায় নেই। বিড়ি তৈরি করেই তাদের জীবন চালাতে হতো। বিড়ি শ্রমিকদের শ্রমের মজুরী খুবই কম। দিন রাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেঁটে যা রোজগার হয় তা দিয়ে তিন বেলার খাবার যোগাতে খুব হিমশিম খেতে হয়। বিড়ি কারখানার মালিকেরা অঢেল বিত্তের অধিকারী, পাজেরো জীপে চেপে চলাফেরা তাদের। রাজধানীতে এক দুইটা বাড়িও রয়েছে। তাদের কেউ কেউ সংসদে বসে টেবিলও চাপড়ান। কিন্তু যাদের ঘাম ঝরানো শ্রমে তাদের বিলাসিতা, সেই শ্রমিকদের কদর নেই তাদের কাছে।
কারখানায় বিড়ি জমা দিয়ে আসে কামাল। আসার পথেই বাজার করে নিয়ে আসে সে। কামরুন্নেসা রান্না করেন। ছেলেমেয়েরা পড়তে বসে। পড়ার ফাঁকে মাঝে মাঝে রান্না ঘরে ঢুকে কামাল।
“মা, ও মা।”
“কী হল?”
“আর কতক্ষণ? গোস্তগুলা খুব ভাল আনছি। তাই না মা? চর্বি আছে, কলিজাও আছে। আমি কিন্তু কলিজা...”
“থাম!”
কামরুন্নেসা একটু রেগে যান। পরে আবার বুঝতে পারেন ছেলের আবেগ। রাগ থামান তিনি।
“যা, পড়তে যা। পড়া রেখে উঠেছিস কেন?”
“তোমার রান্না দেখতে আসছি, মা।”
“আমার রান্না কখনও দেখিস নাই তুই?”
“দেখি’তো, তোমার রান্নার গন্ধে পড়ায় মন থাকে না, মা। রান্না দেখতে ইচ্ছে করে।”
কামরুন্নেসা মুচকি হাসে। হাতে একটা লাকড়ি নিয়ে ছেলেকে তাড়া করেন। আঘাত করার জন্য নয়, রান্না ঘর থেকে বের করে দেবার জন্য। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে এই কষ্টের জীবন বদলে দেবে। এ আশায় বুক বাঁধেন তিনি। নেভা আগুনে ফুঁ দিয়ে আবার জ্বালান। এ আগুন নিভে যাবে কিন্তু কষ্টের আগুন যেন নিভতেই চায় না।
রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গোস্তের গন্ধ শুঁকে কামাল। কামরুন্নেসা মুখ ঘুড়িয়ে খেয়াল করেন সেটা। এবার চুলার সামনে থেকে উঠে এসে ছেলেকে তাড়িয়ে দেন।
“কী হল, যাস নাই পড়তে?”
“যাচ্ছি, মা। তুমি না...............!”
কামরুন্নেসা তাঁর এই ছোট সন্তানটিকে অন্যদের থেকে একটু বেশীই ভালোবাসতেন। অন্য ভাইবোনদের থেকে বেশী মেধাবী ছিল সে। পড়াশুনাটা মন থেকেই করতো। কামালও মাকে খুব বেশী ভালবাসতো। মায়ের গৃহস্থালি কাজে মাঝে মাঝে সে অনেক সাহায্য করতো। তাই পাড়ার কেউ কেউ মজা করে তাকে ‘মায়ের খুব আদরের মেয়ে’ বলেই ডাকতো। কামাল ভেংচিয়ে জবাব দিতো তাদেরকে।
“আমি মায়ের আদরের মেয়ে না, আদরের ছেলে।”
যেদিন এরকম ভাত-গোস্ত-ডাল কিম্বা মাছ-ভাত রান্না হতো সেদিন ছেলেমেয়েরা একটু বেশী মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতো। কামরুন্নেসা নামাজে বসে প্রার্থনা করতেন এরকম দিনের সমাপ্তির জন্য। প্রতিটি দিন যেন এক একটা অগ্নিপরীক্ষা। এ পরীক্ষায় গরীবেরা জেতে না খুব একটা। বিধাতাও যেন গরীবদের খেলিয়ে খুব মজা পান। গরীবদের বেঁচে থাকার লড়াইটা খুব করুণ। কবরে-শ্মশানে না যাওয়া অবধি এ লড়াইয়ের শেষ নেই।
পড়া শেষ করে খেতে বসতো ছেলেমেয়েরা। খাবার শেষ করে পড়তে বসতো। কেউ পড়ার টেবিলেই ঘুমকাতুরে ছোখে মাথাটা লেলিয়ে দিতো। কামরুন্নেসা ওদের কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিতেন।
দিনগুলো শুরু হতো সেই কাকডাকা ভোরে। মাঝে মাঝে কামাল যখন ঘুম থেকে উঠতেই চাইতো না, ওর বড় বোনটা হাত-পা ধরে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে দিত।
‘উউউউফফ! আপা, আরেকটু ঘুমাতে দেনা রে।”
“আরেকটু ঘুম! তাহলে মেঝেতেই ঘুমা।”
মাটির শীতল মেঝে। কামাল বিছানা থেকে পড়ে চিৎপটাং হয়ে যায়।
“ধুর।”
ঘুমঘুম চোখেই বাইরে বেরিয়ে যায় সে। নলকূপের পারে ততক্ষণে লাইন লেগে গেছে সব ভাইবোনের। কে কাকে সরিয়ে আগে হাত-মুখ ধোওয়ার কাজটা করবে তার একটা যুদ্ধ শুরু হয় যেন। একটু পর পর চিৎকার শোনা যাবে, “মা, দেখো, আমাকে মুখ ধুতে দিচ্ছে না, কাল্টু টা।” কারো গায়ের রং একটু শ্যামলা হলেও তাকে কাল্টু বললেই হয়। রেগে আগুন হয়ে যায় সে।
হাতমুখ ধুয়ে রান্না ঘরে খেতে আসতো সবাই। ছোট ছোট থালার মধ্যে কামরুন্নেসা বাসি কিছু ভাত তুলে দিতেন। দুটা কাঁচা মরিচ, এক চিমটি লবণ আর একটু সরিষার তেলে যেন ভালই মানাতো সে বাসি ভাতে। হাভাতেদের ভাত বাসি হলেই বা কী? নুন মরিচে মেখে সে বাসি ভাতকেই তারা অমৃতের মতো মনে করে। ছেলেমেয়েরা খাবার খেয়ে নিলে তাদেরকে পড়তে বসিয়ে দিয়ে গৃহস্থালির নানান কাজে লেগে পড়তেন কামরুন্নেসা। পড়া শেষে আবার বিড়ি তৈরির পালা। বেলা দশটা পর্যন্ত সবাই একসাথে বিড়ি তৈরি করতো। এরপর শুরু হতো স্কুলে যাবার প্রস্তুতি।
বাড়িতে একটা দেয়াল ঘড়ি ছিল কিন্তু কখনও ব্যাটারি নষ্ট হলেও কষ্টে পড়তে হতো না কামালদের। সূর্যের আলোর অবস্থান থেকে বুঝে নিতে হতো কখন কটা বাজতো। রাতের বেলা সময় নিয়ে অতটা সমস্যা হতো না। সকালের রোদ্দুর ঘরের দুয়ার হতে চার হাত দূরে থাকলেই বুঝা যেত সকাল দশটা বেজে গেছে। ছেলেমেয়েরা শীতলপাটিতে বসে বিড়ি তৈরি করতো। কামরুন্নেসা ছেলেমেয়েদের তুলে দিতেন স্কুলের জন্য তৈরি হতে। তৈরি হয়ে ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যাবার পথে পা বাড়াতো কামরুন্নেসা তাদের দিকে চেয়ে হাত বাড়াতেন, সবাইকে একটু আদর করে দিতেন। ছোখের সামনেই নিজের ছোটছোট ছেলেমেয়েদের কেন, যে কারো এরকম বয়সী ছেলেমেয়েকে এতো কষ্ট করতে দখলে মা হিসেবে তার বুক ফেটে যাবেই, দুচোখ ভেসে যাবে অশ্রুতে। চোখের পানিও শুকিয়ে যেত কিন্তু কষ্ট যেন শেষ হতেই চাইতো না। একটু দূর যেয়েই মুখটা ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাতো কামাল। একটু হাসতোও। হয়তো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতো, “মা, তোমার এই কষ্টের দিন বেশী দিন থাকবে না। তুমি দেখে নিও মা।”
কামরুন্নেসা ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া দেখতেন দূর থেকে। ওরা শুনতে পাবে কিনা জানতেন না তারপরেও একটু উঁচু গলায় চিৎকার করেই বলতেন, “দুষ্টামি করিস না যেন। স্যারদের কথা ঠিকমত শুনবি। ক্লাশে পড়া দিবি। ফাঁকি দিবি না। টিফিন টাইমে বাড়ি আসবি।”
শেষের কথাটা বলার সাথে সাথে কামরুন্নেসার মুখ মলিন হয়ে যেত। বেলা দেড়টায় স্কুলে টিফিনের বিরতি দিত। স্কুল থেকে বাড়ি বেশী দূরে ছিল না। পায়ে হেঁটে পাঁচসাত মিনিটের পথ। স্কুলে কিছু কিনে খাবার টাকা দিতে পারতেন না বলেই কামরুন্নেসা ওদের বাড়ি এসে টিফিন খেয়ে যেতে বলতেন। প্রতিদিন যে ভাত দিতে পারতেন, তাও নয়। যে দিন ভাত থাকতো না, পাতিল ভরে কাঁচা কলা সিদ্ধ করতেন। হলুদ লবণে সিদ্ধ কাঁচা কলা ক্ষুধা পেটে মন্দ লাগতো না। কামালেরা এসে তাই খেতো। ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা প্লেটে দু তিনটা সিদ্ধ কাঁচা কলা তুলে দিয়ে গোসল করতে যেতেন কামরুন্নেসা। মা খেয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য কামাল কলার থালা রেখে মায়ের পিছনে পিছনে হাঁটা শুরু করতো।
“কি রে, আমার পিছনে আসছিস কেন? কলা রাখা আছে। খেয়ে নে।”
“তুমি খাইছো, মা?”
“না। আমি গোসলই করিনাই এখনও। তোরা খেয়ে স্কুলে যা। দেরি করিস না। যা।”
“আচ্ছা।”
রান্না ঘরে এসে কামাল পাতিল খুলে দেখতো মায়ের জন্য খাবার আছে কিনা। অন্য ভাইবোনদের থেকে কামাল অনেকটা আলাদা। মায়ের জন্য ওর প্রাণটাই যেন খুব বেশী কাঁদতো। ছেলেমেয়েরা ভাত খেতে পারছে না, শুধু কলা খেয়েই আবার স্কুলে যাবে, এই দৃশ্য সহ্য করতে পারতেন না বলেই হয়তো গোসলের কথা বলে কামরুন্নেসা একটু আড়ালেই থাকতেন। খাবার খেয়েই স্কুলের দিকে দৌর দিতো ছেলেমেয়েরা।
স্কুল ফিরে ওরা যে যার ক্লাসে চলে যেতো। কেউ যদি ওদেরকে জিজ্ঞেস করতো, “কী খেলি রে?” কৌশলে এড়িয়ে যেতো সে প্রশ্ন। কখনও হয়তো সম্মান রক্ষায় মিথ্যে কথাও বলতে হতো। কেউ কেউ জোর করে উত্তর জানতে চাইতো।
“কি রে, বলবি না কী খেলি?”
“ভাত।”
“খালি ভাত!”
“যা ব্যাটা, খালি ভাত হতে যাবে কেন? খালি ভাত কেউ খায় নাকি?”
“তাইলে, কী দিয়ে খেলি বলবি তো?”
“ঐ সব্জি আর মাছ।”
মিথ্যে বলতে খুব কষ্ট হতো ওদের। মা বারবার মিথ্যা বলতে বারণ করতেন। তারপরেও মিথ্যে বলতে হতো। কে চায় বন্ধুদের কাছে, অন্য মানুষের কাছে নিজেদের, নিজের পরিবারকে ছোট করতে? কামালও চাইতো না। চাইতো না ওর অন্য ভাইবোনেরাও।
কোন কোন দিন টিফিন খেতে এসে স্কুলে ফেরা হতো না কামালের। অনেক কাজ থাকতো বাড়িতে। বিড়িগুলো হয়তো তখনও বাড়িতেই পড়ে ছিল। পাড়ার যে ছেলেটা এসে বিড়ি নিয়ে যেতো তামাক ভরাবার জন্য সে আসতো না মাঝে মাঝে। অগত্যা সেই বিড়ি নিয়ে কারখানায় ছুটতে হতো কামালকেই। অন্য ভাই বোনেরা স্কুলে চলে যেতো। কামাল যেতো কারখানায়। মায়ের কথা সেই মানতো বেশী। পরের দিন স্কুলে নির্ঘাত পিটুনি খেতে হতো আগেরদিনের অর্ধ দিবস ফাঁকি দেবার জন্য। কিন্তু যে কাজ না করলে খাবার মিলবে না, তা ফেলে কীভাবে স্কুলে যাবে সে? মায়ের চোখের কোণে জমে থাকা পানি আর কেউ না দেখুক, কামালের চোখ তা কিছুতেই এড়াতে পারে না। স্যারের বেতের আঘাত তাই কামালের কাছে খুবই সামান্য কিছু।
“মা, আমি তামার ভরে নিয়ে আসি?”
“তোর স্কুল আছে না? যা, স্কুলে যা।”
“স্কুলে যাবো না। শরিফ’তো আসেনি মা। বিড়িতে তামাক ভরবে কে?”
“থাক। ওগুলো পরেই থাক।”
“মা, রাগ করো না। আমিই তামাক ভরে নিয়ে আসি।”
এভাবে কতদিন যে কামাল টিফিনের পর স্কুলে যেতে পারেনি তা সে এখন নিজেও হিসেব করে বলতে পারবে না। জাপটে বসা কষ্ট ওদের সুখের স্বপ্নগুলোকে নষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু এ কষ্টের শেষ কোথায়? এই প্রশ্ন কামালকে খুব তাড়া করতো। কামরুন্নেসা ছেলেমেয়েদের সাহস যোগাতেন।
“কষ্ট কর, বাবা। দেখবি এই কষ্ট বেশিদিন থাকবে না।”
“এত কষ্ট ভালো লাগে না। আমার একদম সহ্যই হয় না।” কামালের বোন ভ্রু কুঁচকিয়ে উত্তর দেয়।
কামালের ঠিক আগের জন জামাল। বয়সে পিঠাপিঠি। পড়াশুনা করতে চাইতো না মাঝে মাঝে। ও ব্যবসায়ী হতে চাইতো। কিন্তু টাকা কোথায় যে ব্যবসা করবে। কামরুন্নেসা তাই রাগ করে বলতেন, “ব্যবসা করবি? টাকা দেবে কে? তোর বাবাতো মরণের সাথে সাথে সব সঙ্গে নিয়েই গেছে।” কামালের বাবা অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। বিড়ির পাতা, তামাক, তুঁতের এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যবসা। দুহাতে টাকা উপার্জন করতেন। সিন্দুক ভরা কাঁচা টাকা। আয় ছিল যেমন, ব্যয়ও কম ছিল না। দুহাতে বিলাতেনও অনেক। কিন্তু ক্যান্সারে ধরলে সে টাকা কি আর থাকে? যা ছিল তা চিকিৎসার পেছনে খরচ হল। রাজধানীর দামী হাসপাতালের খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হলো। এতগুলো ছেলেমেয়ের পরিবারের একমাত্র যোগানদাতার এত বড় অসুখ যতটা না ক্ষত ধরিয়েছিল তার শরীরে তার চেয়ে অনেক বড় ক্ষতের সৃষ্টি করলো পরিবারটিতে। মানুষটা তার নিজের সাথে তার কপালকেও সাথে নিয়ে গেলেন। পোড়া কপাল আঁকড়ে ধরলো বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে। যে বাড়িতে রান্নার চুলা থেকে হাড়ি নামতো না কর্তা মারা যাবার পর সে বাড়িতে যেন চুলা জ্বলতেই চাইতো না আর। তিনবেলা খাবার যোগার করতে পারাই যখন অসাধ্য ব্যাপার, ব্যবসার অতগুলো টাকা সেখানে আসবে কোথা থেকে?
“আমিতো বড় ব্যবসা করতে যাচ্ছি না। অল্প টাকা হলেই চলবে।”
“কিন্তু সেই অল্প টাকাটাই বা কে দেবে তোকে?”
কামরুন্নেসা এরকম ক্ষেত্রে একটু বেশীই রেগে যেতেন। টানাপোড়েনের সংসারে ছেলেমেয়েরা একটু সাহায্য করবে, তা নয়, উলটা ব্যবসার জন্য টাকা চেয়ে বসে! ছেলেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দিতেন। ছোট কামাল মাকে সমর্থন করতো।
স্বামী মারা যাবার পর তিন বছর কেটে গেল। সংসারটা তখনও গুছিয়েই তুলতে পারেননি। এর মধ্যেই বড় ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এলো। কামরুন্নেসা মেনে নিলেন। কিন্তু বড় ছেলে বউ নিয়ে আলাদা সংসার গড়লো। আড়ালে চোখের জল মুছলেন কিন্তু বড় ছেলেকে তা বুঝতেও দিতেন না। মায়ের কান্নার কোন অর্থ বড় ছেলের কাছে বোধ্য হতো কিনা, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কামরুন্নেসা ক্ষান্ত হননি। মেঝ ছেলে টিউশন করাতো। সেখান থেকে যা আয় হতো তার বেশিরভাগ মাকেই দিতো সে। কামাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। বয়স কম, কিন্তু ইচ্ছেগুলো অনেক বড় ছিল তার। মাঝে মাঝে তার মনে হতো, পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে কিছু একটা করে সংসারের কাজে লাগা। মাকে একথা বলেও ফেলতো। কামরুন্নেসা খুব রেগে যেতেন।
বছরের পর বছর চলে যেতো কিন্তু অভাব যাচ্ছিল না। অভাবের ছাপ পরিবারের কারো স্বভাবে পড়তে দেন নি কামরুন্নেসা। প্রতিদিনের মতই বিড়ি তৈরি করছিলো সবাই। হঠাৎ এক ডাকপিয়ন এলো। কামালদের বাড়িতে চিঠিপত্র আসতো না খুব একটা। কামাল দৌড়ে চলে গেলো ডাকপিয়নের কাছে।
“চিঠি!”
“হ্যাঁ, বাবা, চিঠি।”
“আমাদেরকে আবার কে চিঠি লিখতে যাবে? আপনি মনে হয় ভুল ঠিকানায় এসেছেন, পিয়ন চাচা।”
“এটা তোমাদের ঠিকানা না?”
“হ্যাঁ, আমাদেরই তো। আমাদের বাড়ি আমাদের ঠিকানা হবে না’তো কার?”
“তমাল তোমার কী হয়?”
“আমার মেঝো ভাইজান।”
“তাহলে আমি ঠিক ঠিকানাতেই আসছি। এটা ব্যাংকের চিঠি।”
“ব্যাংকের চিঠি!”
“হ্যাঁ।”
“ভাইজানের এত টাকা! ব্যাংক থেকে চিঠি আসে!” কামাল চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা আশ্চর্য ঐ চিঠিটার ভিতর। কামালের চোখই সরছেনা। বাকি ভাইবোনেরাও ততক্ষণে বাইরে চলে এসেছে চিঠির কথা শুনে।
“কি রে কামাল, কিসের চিঠি? কার চিঠি?”
কামালের বোন জিজ্ঞেস করে। কামালের কাছ থেকে কোন জবাব এলো না। অগত্যা ডাকপিয়নকেই জিজ্ঞেস করলো সে।
“পিয়ন চাচা, এটা কার চিঠি?”
“তোমার বড় ভাইয়ের চিঠি, ব্যাংক থেকে এসেছে।”
“ব্যাংক থেকে! দেখিতো।”
ডাকপিয়ন ওর হাতেও চিঠিটা দিলেন না। ভাইবোন মিলে পা উঠিয়ে দেখার চেষ্টা করলো চিঠিতে কী লেখা আছে।
“সত্যিই তো। এটাতো মেঝ ভাইজানের চিঠি। ঐ দেখ কামাল, মেঝ ভাইজানের নাম লেখা। আব্বার নামও লেখা।”
“আব্বার নাম! যাহ, মরা মানুষের নাম লেখা থাকবে কেনো?” দুচোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে কামাল।
“এটা কেয়ার অফ।”
“কেয়ার অফ মানে কী রে, আপা?”
“অভিভাবকের নাম।”
“ওহ।”
“ও চাচা, দাওনা চিঠিটা। ভাইজান কখন আসবে ঠিক নেই। আমাদেরকে দাও। আমরা ভাইজানকে এটা দিয়া দিবো।”
কামালের মেঝ ভাই টিউশন করাতে গিয়েছিলো। সেও তখন সাইকেলে করে বাড়িতে ফিরছিলো। ভাইকে দেখে কামাল তার দিকে দিলো ভো দৌর।
“ভাইজান, তোমার চিঠি আসছে ব্যাংক থেকে। তুমি ব্যাংকে টাকা জমাইছো আমাদের তো কখনও বলো নাই। চিঠির ভিতরে টাকা আছে ভাইজান?”
“ওহ, তুই থামবি?”
কামালের প্রশ্নের পর প্রশ্ন তমালকে কিছুটা বিরক্ত করে। কামাল সাইকেল থেকে নামলো না। সোজা চলে গেলো ডাকপিয়ন বরাবর।
“চাচা, আমার নামে চিঠি?”
“হ্যাঁ রে বাবা, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠাইছে।”
কবে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিলো সে, সেটাও মনে করতে পারছিলো না তমাল। ডাকপিয়নের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে খামটা ছিরে ফেললো। চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো সে। ডাকপিয়ন আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এটা হয়তো একটা নিয়োগপত্র। তিনিই প্রথম জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি এপয়েন্টমেন্ট লেটার?”
“হ্যাঁ চাচা। অনেকদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিলাম। জুনিয়র অফিসার পোস্ট। এটা সেটারই নিয়োগপত্র। চাকরিটা তাহলে হয়েই গেলো!”
“এ তো খুব ভালো খবর। মিষ্টি খাওয়ায়, বাবা।”
তমাল পকেটে হাত দিলো। বিশ টাকার মাত্র একটা নোট ছিলো। সেটাই দিয়ে দিলো ডাকপিয়নকে। চাকরির কথা শুনে তমাল ও অন্যরা আগেই লাপাত্তা। মাকে খবরটা কে আগে দেবে সেই প্রতিযোগিতায় জেতাই ছিলো ওদের কাছে অনেক বড় কিছু। এত বড় সুখবর শুনে বাড়ির ভিতরে আর থাকতে পারেননি কামরুন্নেসা। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারছিলেন। ততক্ষণে লোকজনে ভরে গেছে বাইরে। একটু পরপর প্রশ্ন উড়ে আসছিলো, “কিসের চাকরিরে, তমাল?”
“ব্যাংকের চাকরি, চাচা।”
“কোন ব্যাংক রে, তমাল?”
“বাংলাদেশ ব্যাংক, রশিদ ভাই।”
এভাবে একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলো তমাল। গোটা গ্রামে হিরো বনে গিয়েছিলো সে। সবচেয়ে বড় হিরো নিজের মায়ের কাছে। মায়ের কষ্টের আগুনে এবার কয়েক পশলা বৃষ্টি ঝরলো। তমালের মনে হলো যে মাকেই তখনো খবরটা দেয়নি সে। মুখ ঘুরিয়ে দেখলো মা দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির দরজায়। তাহলে এতক্ষণে কামালেরা মাকে খবরটা দিয়েই দিয়েছে! মায়ের সামনে এসে চিঠিটা পড়লো সে। ছেলে চাকরি পেয়েছে এটা শুনে কোন মা খুশি না হবেন? কামরুন্নেসাও অনেক খুশি হয়েছিলেন কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই ছেলে চাকরিতে ঢুকবে এটা তিনি চাইছিলেন না।
“তুই চাকরির আবেদন করেছিলি আমাকে বলিস নাইতো।”
“মা, আমি এমনি এমনি দরখাস্ত করছিলাম। লিখিত পরীক্ষা আর ভাইভাও দিয়া আসছি। আজকাল টাকা পয়সা আর মামা না থাকলে চাকরি হয় না, মা। তাই তোমাকে বলি নাই।”
“তোর মামারা’তো আছে।”
“ওহ মা, এই মামা সেই মামা নয়।”
“তাহলে?”
“পাওয়ারওয়ালা বড়লোক মামা, মা। চলো ভিতরে চলো।”
মাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে যায় কামাল। ছোট ভাইবোনগুলোর খুশিতে পা মাটিতে পরছিলো না যেন। কাম রুন্নেসা তমালের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, “চাকরিতে ঢুকলে পড়াশুনা চালাবি কি করে? তুই কি আর পড়বি না?”
“পড়বো মা, সময় বের করে নিয়ে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাবো।”
সহজ সরল কামরুন্নেসা নিজে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরুতে পারেননি বলেই হয়তো এতো কিছু বুঝেন নি। কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে ছেলে সংসারের হাল ধরতে চাচ্ছে। বড় ছেলেতো আর খোঁজ খবর পর্যন্ত নিতো না। যে মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো তারাও নিজেদের সংসার নিয়েই ব্যস্ত ছিল। মাঝে মাঝে দেখতে আসতো এখনও যেমনটা আসে। তমালের পড়ালেখা আর হলো না। ছোট পদে চাকরি বড় বড় আশা করা তাকে যেন আর মানালো না। চাকরিতে যোগ দেবার পর নিজের জন্য সে কোন টাকাই রাখতো না। বিড়ির কাজ বন্ধ করে দিলো। ছোট ভাই জামালকে কিছু টাকা দিলো ব্যবসা করার জন্য। জামালও পড়াশুনায় ভালো করছিলো না। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসলো না সে। টাকা নিয়ে কাপরের ব্যবসা শুরু করে দিলো। ছোট ব্যবসা কিন্তু লক্ষ্য ছিলো অনেক বড়। কিছুদিনের মধ্যেই সে প্রমাণ করলো যে ব্যবসাই তার কপালে লেখা ছিলো। বোনের বিয়ে হয়ে গেলো। কামাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। স্কুল, কলেজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও ভালো রেজাল্ট করলো সে। কামরুন্নেসার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে তার ছেলেমেয়েরা। ছোট মেয়েও সরকারী স্কুলে যোগ দিলো। কামালের চাকরি হলো বিসিএসে। কষ্টের দিনগুলো এখন আর নেই। কিন্তু স্মৃতিগুলো এখনও আছে। কামাল বাড়িতে আসলেই মায়ের হাতে টাকা ধরিয়ে দেয়। গ্রামের সবাইকে সেই টাকা বিলিয়ে দেন কামরুন্নেসা। কষ্টের ভয়ে কোন ছেলেমেয়েই বাড়ি ছাড়েনি, সাধু সন্ন্যাসীও হতে হয়নি কাউকে। কষ্টই ছেড়ে চলে গেছে তাদের। নিজের সংসারে আজ কষ্ট নেই বলে অন্যদের কষ্টকে বুঝতে পারবেন না, তাদের পাশে দাঁড়াবেন না, এটা মানতে পারেন না কামরুন্নেসা। গ্রামের গরীব মানুষগুলোর কাছে তিনি এখন একজন ত্রাণকত্রী। কামরুন্নেসার সংসার যুদ্ধ জয় অন্যদেরকেও প্রভাবিত করেছে। যে গ্রামে এক সময় বিড়ি শ্রমিক ছাড়া আর কাউকে মিলতো না এখন সেখানেই প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই শিক্ষিত ছেলেমেয়ে আছে। সবার দারিদ্র হয়তো দূর হয়নি এখনো। কিন্তু দূর হতে কতক্ষণ? যে পরিবারে কামরুন্নেসার মতো মা থাকে, সেখানে দারিদ্র থাকে না। মায়ের দুচোখে এখনও মাঝে মাঝে অশ্রু জমে কিন্তু সেটা আনন্দাশ্রু।
কামরুন্নেসা মুরগী পোলাও রান্না করছেন আজ। কামাল দরজায় দাঁড়িয়ে। মায়ের চোখ এড়াতে পারলো না সে।
“কি রে, ভিতরে আয়। পোলাও রান্না হচ্ছে।”
কামাল রান্না ঘরের ভিতরে ঢুকে। মায়ের পাশে বসে কথা বলতে বলতেই কখন যে মায়ের কাঁধে মাথা রেখেছে সে খেয়ালই করেনি। ছেলের আহ্লাদে মুখটার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন কামরুন্নেসা।
“তুই এখনও ছোট আছিস?”
কামাল দাঁত বের করে হাসে। আবার কাঁধে মাথা রেখে বলে, “মা।”
“যাও। যার যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাও। আমি আর পারছিনে বাবা।” কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন কামরুন্নেসা।
সংসারের যন্ত্রণা তিনি সত্যি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। পারবেনই বা কেন? স্বামীহারা সংসারে ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে কোন নারী এত কষ্ট করতে পারে? মায়ের কষ্টটা না বুঝার মত ছেলে কামাল ছিল না। সবার ছোট হলেও কিশোর কামালের দুচোখ মায়ের কষ্ট দেখে অশ্রুতে ছলছল করতো। ভাগ্যিস কামালের বাবা তাঁর জীবদ্দশাতেই চার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তা না হলে যে কী হত! মা ‘মা’ বলেই হয়তো এত কষ্ট সহ্য করেছিলেন। কিন্তু কামালের সহ্যক্ষমতার একটা সীমা ছিল। ক্ষুধার অসীম কষ্ট পেট থেকে যেন গোটা পৃথিবীকে ঘিরে ধরতো। কামাল একদম সহ্য করতে পারছিলো না। উনুনে অনলের ছোঁয়া পরতো যখন, কামালের পেটে যেন তখন ক্ষুধার রাজ্য ভর করতো।
“আমাকে খাবার দাও, মা। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে।”
মুষ্টি তোলা সিকের চাল ভেজে, বোতলের তলায় জমে থাকা কিছু সরিষার তেল ঝেড়ে লবণমাখা করে ছোট তিন ছেলেমেয়ের সামনে দিলেন কামরুন্নেসা,
“নে, খা। রাতে ভাত খাইস। বিড়িটা ফ্যাক্টরিতে জমা দিয়ে চাল তরকারি কিনে আনিস। এখন এটা খা।”
রংপুরের যে অঞ্চলটাতে কামালদের বাড়ি সেখানে অনেকগুলো বিড়ি তৈরির কারখানা আছে। কৃষি কাজ নেই। জনবহুল এলাকা। আবাদের জমি নেই, বিড়ি কারখানার গাঢ় তামাটে ধোঁয়া আছে। অসহ্য কড়া রকমের গন্ধে তামাকের ধোঁয়া বাতাসে উড়ে। বাড়ির টিনের চালগুলোর রং পালটে বাদামী হয়ে থাকে। বাতাসের এই তামাকীয় গন্ধ এখানকার মানুষগুলোর কাছে অনেক আপন হয়ে গেছে। কারখানাগুলো খোলা থাকলে মানুষগুলোর মুখে হাসি থাকে। কাজ থাকলে উনুনে আগুন জ্বলে, হাড়িতে ভাত থাকে, পেটে খাবার পড়ে।
যারা গরীব, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা যাদের, তাদের জিহ্বায় জল আসে ফিন্নি পোলাওয়ের কথা শুনে নয়, শুধু ডাল–ভাতের কথা শুনে। রাতে ভাত রান্না হবে, এটা মনে করে খুব ভাল লাগছিলো কামালের। পরম আনন্দে অন্য ভাইবোনদের সাথে বিড়ি তৈরি করতে বসে সে। কামাল ভাল করেই জানতো, তারা যা তৈরি করছে তা মানুষকে নেশাগ্রস্থ করে, মৃত্যুমুখী করে। কিন্তু এ ছাড়া যে আর কোন উপায় নেই। বিড়ি তৈরি করেই তাদের জীবন চালাতে হতো। বিড়ি শ্রমিকদের শ্রমের মজুরী খুবই কম। দিন রাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেঁটে যা রোজগার হয় তা দিয়ে তিন বেলার খাবার যোগাতে খুব হিমশিম খেতে হয়। বিড়ি কারখানার মালিকেরা অঢেল বিত্তের অধিকারী, পাজেরো জীপে চেপে চলাফেরা তাদের। রাজধানীতে এক দুইটা বাড়িও রয়েছে। তাদের কেউ কেউ সংসদে বসে টেবিলও চাপড়ান। কিন্তু যাদের ঘাম ঝরানো শ্রমে তাদের বিলাসিতা, সেই শ্রমিকদের কদর নেই তাদের কাছে।
কারখানায় বিড়ি জমা দিয়ে আসে কামাল। আসার পথেই বাজার করে নিয়ে আসে সে। কামরুন্নেসা রান্না করেন। ছেলেমেয়েরা পড়তে বসে। পড়ার ফাঁকে মাঝে মাঝে রান্না ঘরে ঢুকে কামাল।
“মা, ও মা।”
“কী হল?”
“আর কতক্ষণ? গোস্তগুলা খুব ভাল আনছি। তাই না মা? চর্বি আছে, কলিজাও আছে। আমি কিন্তু কলিজা...”
“থাম!”
কামরুন্নেসা একটু রেগে যান। পরে আবার বুঝতে পারেন ছেলের আবেগ। রাগ থামান তিনি।
“যা, পড়তে যা। পড়া রেখে উঠেছিস কেন?”
“তোমার রান্না দেখতে আসছি, মা।”
“আমার রান্না কখনও দেখিস নাই তুই?”
“দেখি’তো, তোমার রান্নার গন্ধে পড়ায় মন থাকে না, মা। রান্না দেখতে ইচ্ছে করে।”
কামরুন্নেসা মুচকি হাসে। হাতে একটা লাকড়ি নিয়ে ছেলেকে তাড়া করেন। আঘাত করার জন্য নয়, রান্না ঘর থেকে বের করে দেবার জন্য। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে এই কষ্টের জীবন বদলে দেবে। এ আশায় বুক বাঁধেন তিনি। নেভা আগুনে ফুঁ দিয়ে আবার জ্বালান। এ আগুন নিভে যাবে কিন্তু কষ্টের আগুন যেন নিভতেই চায় না।
রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গোস্তের গন্ধ শুঁকে কামাল। কামরুন্নেসা মুখ ঘুড়িয়ে খেয়াল করেন সেটা। এবার চুলার সামনে থেকে উঠে এসে ছেলেকে তাড়িয়ে দেন।
“কী হল, যাস নাই পড়তে?”
“যাচ্ছি, মা। তুমি না...............!”
কামরুন্নেসা তাঁর এই ছোট সন্তানটিকে অন্যদের থেকে একটু বেশীই ভালোবাসতেন। অন্য ভাইবোনদের থেকে বেশী মেধাবী ছিল সে। পড়াশুনাটা মন থেকেই করতো। কামালও মাকে খুব বেশী ভালবাসতো। মায়ের গৃহস্থালি কাজে মাঝে মাঝে সে অনেক সাহায্য করতো। তাই পাড়ার কেউ কেউ মজা করে তাকে ‘মায়ের খুব আদরের মেয়ে’ বলেই ডাকতো। কামাল ভেংচিয়ে জবাব দিতো তাদেরকে।
“আমি মায়ের আদরের মেয়ে না, আদরের ছেলে।”
যেদিন এরকম ভাত-গোস্ত-ডাল কিম্বা মাছ-ভাত রান্না হতো সেদিন ছেলেমেয়েরা একটু বেশী মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতো। কামরুন্নেসা নামাজে বসে প্রার্থনা করতেন এরকম দিনের সমাপ্তির জন্য। প্রতিটি দিন যেন এক একটা অগ্নিপরীক্ষা। এ পরীক্ষায় গরীবেরা জেতে না খুব একটা। বিধাতাও যেন গরীবদের খেলিয়ে খুব মজা পান। গরীবদের বেঁচে থাকার লড়াইটা খুব করুণ। কবরে-শ্মশানে না যাওয়া অবধি এ লড়াইয়ের শেষ নেই।
পড়া শেষ করে খেতে বসতো ছেলেমেয়েরা। খাবার শেষ করে পড়তে বসতো। কেউ পড়ার টেবিলেই ঘুমকাতুরে ছোখে মাথাটা লেলিয়ে দিতো। কামরুন্নেসা ওদের কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিতেন।
দিনগুলো শুরু হতো সেই কাকডাকা ভোরে। মাঝে মাঝে কামাল যখন ঘুম থেকে উঠতেই চাইতো না, ওর বড় বোনটা হাত-পা ধরে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে দিত।
‘উউউউফফ! আপা, আরেকটু ঘুমাতে দেনা রে।”
“আরেকটু ঘুম! তাহলে মেঝেতেই ঘুমা।”
মাটির শীতল মেঝে। কামাল বিছানা থেকে পড়ে চিৎপটাং হয়ে যায়।
“ধুর।”
ঘুমঘুম চোখেই বাইরে বেরিয়ে যায় সে। নলকূপের পারে ততক্ষণে লাইন লেগে গেছে সব ভাইবোনের। কে কাকে সরিয়ে আগে হাত-মুখ ধোওয়ার কাজটা করবে তার একটা যুদ্ধ শুরু হয় যেন। একটু পর পর চিৎকার শোনা যাবে, “মা, দেখো, আমাকে মুখ ধুতে দিচ্ছে না, কাল্টু টা।” কারো গায়ের রং একটু শ্যামলা হলেও তাকে কাল্টু বললেই হয়। রেগে আগুন হয়ে যায় সে।
হাতমুখ ধুয়ে রান্না ঘরে খেতে আসতো সবাই। ছোট ছোট থালার মধ্যে কামরুন্নেসা বাসি কিছু ভাত তুলে দিতেন। দুটা কাঁচা মরিচ, এক চিমটি লবণ আর একটু সরিষার তেলে যেন ভালই মানাতো সে বাসি ভাতে। হাভাতেদের ভাত বাসি হলেই বা কী? নুন মরিচে মেখে সে বাসি ভাতকেই তারা অমৃতের মতো মনে করে। ছেলেমেয়েরা খাবার খেয়ে নিলে তাদেরকে পড়তে বসিয়ে দিয়ে গৃহস্থালির নানান কাজে লেগে পড়তেন কামরুন্নেসা। পড়া শেষে আবার বিড়ি তৈরির পালা। বেলা দশটা পর্যন্ত সবাই একসাথে বিড়ি তৈরি করতো। এরপর শুরু হতো স্কুলে যাবার প্রস্তুতি।
বাড়িতে একটা দেয়াল ঘড়ি ছিল কিন্তু কখনও ব্যাটারি নষ্ট হলেও কষ্টে পড়তে হতো না কামালদের। সূর্যের আলোর অবস্থান থেকে বুঝে নিতে হতো কখন কটা বাজতো। রাতের বেলা সময় নিয়ে অতটা সমস্যা হতো না। সকালের রোদ্দুর ঘরের দুয়ার হতে চার হাত দূরে থাকলেই বুঝা যেত সকাল দশটা বেজে গেছে। ছেলেমেয়েরা শীতলপাটিতে বসে বিড়ি তৈরি করতো। কামরুন্নেসা ছেলেমেয়েদের তুলে দিতেন স্কুলের জন্য তৈরি হতে। তৈরি হয়ে ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে যাবার পথে পা বাড়াতো কামরুন্নেসা তাদের দিকে চেয়ে হাত বাড়াতেন, সবাইকে একটু আদর করে দিতেন। ছোখের সামনেই নিজের ছোটছোট ছেলেমেয়েদের কেন, যে কারো এরকম বয়সী ছেলেমেয়েকে এতো কষ্ট করতে দখলে মা হিসেবে তার বুক ফেটে যাবেই, দুচোখ ভেসে যাবে অশ্রুতে। চোখের পানিও শুকিয়ে যেত কিন্তু কষ্ট যেন শেষ হতেই চাইতো না। একটু দূর যেয়েই মুখটা ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাতো কামাল। একটু হাসতোও। হয়তো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতো, “মা, তোমার এই কষ্টের দিন বেশী দিন থাকবে না। তুমি দেখে নিও মা।”
কামরুন্নেসা ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া দেখতেন দূর থেকে। ওরা শুনতে পাবে কিনা জানতেন না তারপরেও একটু উঁচু গলায় চিৎকার করেই বলতেন, “দুষ্টামি করিস না যেন। স্যারদের কথা ঠিকমত শুনবি। ক্লাশে পড়া দিবি। ফাঁকি দিবি না। টিফিন টাইমে বাড়ি আসবি।”
শেষের কথাটা বলার সাথে সাথে কামরুন্নেসার মুখ মলিন হয়ে যেত। বেলা দেড়টায় স্কুলে টিফিনের বিরতি দিত। স্কুল থেকে বাড়ি বেশী দূরে ছিল না। পায়ে হেঁটে পাঁচসাত মিনিটের পথ। স্কুলে কিছু কিনে খাবার টাকা দিতে পারতেন না বলেই কামরুন্নেসা ওদের বাড়ি এসে টিফিন খেয়ে যেতে বলতেন। প্রতিদিন যে ভাত দিতে পারতেন, তাও নয়। যে দিন ভাত থাকতো না, পাতিল ভরে কাঁচা কলা সিদ্ধ করতেন। হলুদ লবণে সিদ্ধ কাঁচা কলা ক্ষুধা পেটে মন্দ লাগতো না। কামালেরা এসে তাই খেতো। ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা প্লেটে দু তিনটা সিদ্ধ কাঁচা কলা তুলে দিয়ে গোসল করতে যেতেন কামরুন্নেসা। মা খেয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য কামাল কলার থালা রেখে মায়ের পিছনে পিছনে হাঁটা শুরু করতো।
“কি রে, আমার পিছনে আসছিস কেন? কলা রাখা আছে। খেয়ে নে।”
“তুমি খাইছো, মা?”
“না। আমি গোসলই করিনাই এখনও। তোরা খেয়ে স্কুলে যা। দেরি করিস না। যা।”
“আচ্ছা।”
রান্না ঘরে এসে কামাল পাতিল খুলে দেখতো মায়ের জন্য খাবার আছে কিনা। অন্য ভাইবোনদের থেকে কামাল অনেকটা আলাদা। মায়ের জন্য ওর প্রাণটাই যেন খুব বেশী কাঁদতো। ছেলেমেয়েরা ভাত খেতে পারছে না, শুধু কলা খেয়েই আবার স্কুলে যাবে, এই দৃশ্য সহ্য করতে পারতেন না বলেই হয়তো গোসলের কথা বলে কামরুন্নেসা একটু আড়ালেই থাকতেন। খাবার খেয়েই স্কুলের দিকে দৌর দিতো ছেলেমেয়েরা।
স্কুল ফিরে ওরা যে যার ক্লাসে চলে যেতো। কেউ যদি ওদেরকে জিজ্ঞেস করতো, “কী খেলি রে?” কৌশলে এড়িয়ে যেতো সে প্রশ্ন। কখনও হয়তো সম্মান রক্ষায় মিথ্যে কথাও বলতে হতো। কেউ কেউ জোর করে উত্তর জানতে চাইতো।
“কি রে, বলবি না কী খেলি?”
“ভাত।”
“খালি ভাত!”
“যা ব্যাটা, খালি ভাত হতে যাবে কেন? খালি ভাত কেউ খায় নাকি?”
“তাইলে, কী দিয়ে খেলি বলবি তো?”
“ঐ সব্জি আর মাছ।”
মিথ্যে বলতে খুব কষ্ট হতো ওদের। মা বারবার মিথ্যা বলতে বারণ করতেন। তারপরেও মিথ্যে বলতে হতো। কে চায় বন্ধুদের কাছে, অন্য মানুষের কাছে নিজেদের, নিজের পরিবারকে ছোট করতে? কামালও চাইতো না। চাইতো না ওর অন্য ভাইবোনেরাও।
কোন কোন দিন টিফিন খেতে এসে স্কুলে ফেরা হতো না কামালের। অনেক কাজ থাকতো বাড়িতে। বিড়িগুলো হয়তো তখনও বাড়িতেই পড়ে ছিল। পাড়ার যে ছেলেটা এসে বিড়ি নিয়ে যেতো তামাক ভরাবার জন্য সে আসতো না মাঝে মাঝে। অগত্যা সেই বিড়ি নিয়ে কারখানায় ছুটতে হতো কামালকেই। অন্য ভাই বোনেরা স্কুলে চলে যেতো। কামাল যেতো কারখানায়। মায়ের কথা সেই মানতো বেশী। পরের দিন স্কুলে নির্ঘাত পিটুনি খেতে হতো আগেরদিনের অর্ধ দিবস ফাঁকি দেবার জন্য। কিন্তু যে কাজ না করলে খাবার মিলবে না, তা ফেলে কীভাবে স্কুলে যাবে সে? মায়ের চোখের কোণে জমে থাকা পানি আর কেউ না দেখুক, কামালের চোখ তা কিছুতেই এড়াতে পারে না। স্যারের বেতের আঘাত তাই কামালের কাছে খুবই সামান্য কিছু।
“মা, আমি তামার ভরে নিয়ে আসি?”
“তোর স্কুল আছে না? যা, স্কুলে যা।”
“স্কুলে যাবো না। শরিফ’তো আসেনি মা। বিড়িতে তামাক ভরবে কে?”
“থাক। ওগুলো পরেই থাক।”
“মা, রাগ করো না। আমিই তামাক ভরে নিয়ে আসি।”
এভাবে কতদিন যে কামাল টিফিনের পর স্কুলে যেতে পারেনি তা সে এখন নিজেও হিসেব করে বলতে পারবে না। জাপটে বসা কষ্ট ওদের সুখের স্বপ্নগুলোকে নষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু এ কষ্টের শেষ কোথায়? এই প্রশ্ন কামালকে খুব তাড়া করতো। কামরুন্নেসা ছেলেমেয়েদের সাহস যোগাতেন।
“কষ্ট কর, বাবা। দেখবি এই কষ্ট বেশিদিন থাকবে না।”
“এত কষ্ট ভালো লাগে না। আমার একদম সহ্যই হয় না।” কামালের বোন ভ্রু কুঁচকিয়ে উত্তর দেয়।
কামালের ঠিক আগের জন জামাল। বয়সে পিঠাপিঠি। পড়াশুনা করতে চাইতো না মাঝে মাঝে। ও ব্যবসায়ী হতে চাইতো। কিন্তু টাকা কোথায় যে ব্যবসা করবে। কামরুন্নেসা তাই রাগ করে বলতেন, “ব্যবসা করবি? টাকা দেবে কে? তোর বাবাতো মরণের সাথে সাথে সব সঙ্গে নিয়েই গেছে।” কামালের বাবা অনেক বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। বিড়ির পাতা, তামাক, তুঁতের এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যবসা। দুহাতে টাকা উপার্জন করতেন। সিন্দুক ভরা কাঁচা টাকা। আয় ছিল যেমন, ব্যয়ও কম ছিল না। দুহাতে বিলাতেনও অনেক। কিন্তু ক্যান্সারে ধরলে সে টাকা কি আর থাকে? যা ছিল তা চিকিৎসার পেছনে খরচ হল। রাজধানীর দামী হাসপাতালের খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হলো। এতগুলো ছেলেমেয়ের পরিবারের একমাত্র যোগানদাতার এত বড় অসুখ যতটা না ক্ষত ধরিয়েছিল তার শরীরে তার চেয়ে অনেক বড় ক্ষতের সৃষ্টি করলো পরিবারটিতে। মানুষটা তার নিজের সাথে তার কপালকেও সাথে নিয়ে গেলেন। পোড়া কপাল আঁকড়ে ধরলো বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে। যে বাড়িতে রান্নার চুলা থেকে হাড়ি নামতো না কর্তা মারা যাবার পর সে বাড়িতে যেন চুলা জ্বলতেই চাইতো না আর। তিনবেলা খাবার যোগার করতে পারাই যখন অসাধ্য ব্যাপার, ব্যবসার অতগুলো টাকা সেখানে আসবে কোথা থেকে?
“আমিতো বড় ব্যবসা করতে যাচ্ছি না। অল্প টাকা হলেই চলবে।”
“কিন্তু সেই অল্প টাকাটাই বা কে দেবে তোকে?”
কামরুন্নেসা এরকম ক্ষেত্রে একটু বেশীই রেগে যেতেন। টানাপোড়েনের সংসারে ছেলেমেয়েরা একটু সাহায্য করবে, তা নয়, উলটা ব্যবসার জন্য টাকা চেয়ে বসে! ছেলেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দিতেন। ছোট কামাল মাকে সমর্থন করতো।
স্বামী মারা যাবার পর তিন বছর কেটে গেল। সংসারটা তখনও গুছিয়েই তুলতে পারেননি। এর মধ্যেই বড় ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এলো। কামরুন্নেসা মেনে নিলেন। কিন্তু বড় ছেলে বউ নিয়ে আলাদা সংসার গড়লো। আড়ালে চোখের জল মুছলেন কিন্তু বড় ছেলেকে তা বুঝতেও দিতেন না। মায়ের কান্নার কোন অর্থ বড় ছেলের কাছে বোধ্য হতো কিনা, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। কামরুন্নেসা ক্ষান্ত হননি। মেঝ ছেলে টিউশন করাতো। সেখান থেকে যা আয় হতো তার বেশিরভাগ মাকেই দিতো সে। কামাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। বয়স কম, কিন্তু ইচ্ছেগুলো অনেক বড় ছিল তার। মাঝে মাঝে তার মনে হতো, পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে কিছু একটা করে সংসারের কাজে লাগা। মাকে একথা বলেও ফেলতো। কামরুন্নেসা খুব রেগে যেতেন।
বছরের পর বছর চলে যেতো কিন্তু অভাব যাচ্ছিল না। অভাবের ছাপ পরিবারের কারো স্বভাবে পড়তে দেন নি কামরুন্নেসা। প্রতিদিনের মতই বিড়ি তৈরি করছিলো সবাই। হঠাৎ এক ডাকপিয়ন এলো। কামালদের বাড়িতে চিঠিপত্র আসতো না খুব একটা। কামাল দৌড়ে চলে গেলো ডাকপিয়নের কাছে।
“চিঠি!”
“হ্যাঁ, বাবা, চিঠি।”
“আমাদেরকে আবার কে চিঠি লিখতে যাবে? আপনি মনে হয় ভুল ঠিকানায় এসেছেন, পিয়ন চাচা।”
“এটা তোমাদের ঠিকানা না?”
“হ্যাঁ, আমাদেরই তো। আমাদের বাড়ি আমাদের ঠিকানা হবে না’তো কার?”
“তমাল তোমার কী হয়?”
“আমার মেঝো ভাইজান।”
“তাহলে আমি ঠিক ঠিকানাতেই আসছি। এটা ব্যাংকের চিঠি।”
“ব্যাংকের চিঠি!”
“হ্যাঁ।”
“ভাইজানের এত টাকা! ব্যাংক থেকে চিঠি আসে!” কামাল চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা আশ্চর্য ঐ চিঠিটার ভিতর। কামালের চোখই সরছেনা। বাকি ভাইবোনেরাও ততক্ষণে বাইরে চলে এসেছে চিঠির কথা শুনে।
“কি রে কামাল, কিসের চিঠি? কার চিঠি?”
কামালের বোন জিজ্ঞেস করে। কামালের কাছ থেকে কোন জবাব এলো না। অগত্যা ডাকপিয়নকেই জিজ্ঞেস করলো সে।
“পিয়ন চাচা, এটা কার চিঠি?”
“তোমার বড় ভাইয়ের চিঠি, ব্যাংক থেকে এসেছে।”
“ব্যাংক থেকে! দেখিতো।”
ডাকপিয়ন ওর হাতেও চিঠিটা দিলেন না। ভাইবোন মিলে পা উঠিয়ে দেখার চেষ্টা করলো চিঠিতে কী লেখা আছে।
“সত্যিই তো। এটাতো মেঝ ভাইজানের চিঠি। ঐ দেখ কামাল, মেঝ ভাইজানের নাম লেখা। আব্বার নামও লেখা।”
“আব্বার নাম! যাহ, মরা মানুষের নাম লেখা থাকবে কেনো?” দুচোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে কামাল।
“এটা কেয়ার অফ।”
“কেয়ার অফ মানে কী রে, আপা?”
“অভিভাবকের নাম।”
“ওহ।”
“ও চাচা, দাওনা চিঠিটা। ভাইজান কখন আসবে ঠিক নেই। আমাদেরকে দাও। আমরা ভাইজানকে এটা দিয়া দিবো।”
কামালের মেঝ ভাই টিউশন করাতে গিয়েছিলো। সেও তখন সাইকেলে করে বাড়িতে ফিরছিলো। ভাইকে দেখে কামাল তার দিকে দিলো ভো দৌর।
“ভাইজান, তোমার চিঠি আসছে ব্যাংক থেকে। তুমি ব্যাংকে টাকা জমাইছো আমাদের তো কখনও বলো নাই। চিঠির ভিতরে টাকা আছে ভাইজান?”
“ওহ, তুই থামবি?”
কামালের প্রশ্নের পর প্রশ্ন তমালকে কিছুটা বিরক্ত করে। কামাল সাইকেল থেকে নামলো না। সোজা চলে গেলো ডাকপিয়ন বরাবর।
“চাচা, আমার নামে চিঠি?”
“হ্যাঁ রে বাবা, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠাইছে।”
কবে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিলো সে, সেটাও মনে করতে পারছিলো না তমাল। ডাকপিয়নের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে খামটা ছিরে ফেললো। চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো সে। ডাকপিয়ন আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এটা হয়তো একটা নিয়োগপত্র। তিনিই প্রথম জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি এপয়েন্টমেন্ট লেটার?”
“হ্যাঁ চাচা। অনেকদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিলাম। জুনিয়র অফিসার পোস্ট। এটা সেটারই নিয়োগপত্র। চাকরিটা তাহলে হয়েই গেলো!”
“এ তো খুব ভালো খবর। মিষ্টি খাওয়ায়, বাবা।”
তমাল পকেটে হাত দিলো। বিশ টাকার মাত্র একটা নোট ছিলো। সেটাই দিয়ে দিলো ডাকপিয়নকে। চাকরির কথা শুনে তমাল ও অন্যরা আগেই লাপাত্তা। মাকে খবরটা কে আগে দেবে সেই প্রতিযোগিতায় জেতাই ছিলো ওদের কাছে অনেক বড় কিছু। এত বড় সুখবর শুনে বাড়ির ভিতরে আর থাকতে পারেননি কামরুন্নেসা। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মারছিলেন। ততক্ষণে লোকজনে ভরে গেছে বাইরে। একটু পরপর প্রশ্ন উড়ে আসছিলো, “কিসের চাকরিরে, তমাল?”
“ব্যাংকের চাকরি, চাচা।”
“কোন ব্যাংক রে, তমাল?”
“বাংলাদেশ ব্যাংক, রশিদ ভাই।”
এভাবে একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলো তমাল। গোটা গ্রামে হিরো বনে গিয়েছিলো সে। সবচেয়ে বড় হিরো নিজের মায়ের কাছে। মায়ের কষ্টের আগুনে এবার কয়েক পশলা বৃষ্টি ঝরলো। তমালের মনে হলো যে মাকেই তখনো খবরটা দেয়নি সে। মুখ ঘুরিয়ে দেখলো মা দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির দরজায়। তাহলে এতক্ষণে কামালেরা মাকে খবরটা দিয়েই দিয়েছে! মায়ের সামনে এসে চিঠিটা পড়লো সে। ছেলে চাকরি পেয়েছে এটা শুনে কোন মা খুশি না হবেন? কামরুন্নেসাও অনেক খুশি হয়েছিলেন কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই ছেলে চাকরিতে ঢুকবে এটা তিনি চাইছিলেন না।
“তুই চাকরির আবেদন করেছিলি আমাকে বলিস নাইতো।”
“মা, আমি এমনি এমনি দরখাস্ত করছিলাম। লিখিত পরীক্ষা আর ভাইভাও দিয়া আসছি। আজকাল টাকা পয়সা আর মামা না থাকলে চাকরি হয় না, মা। তাই তোমাকে বলি নাই।”
“তোর মামারা’তো আছে।”
“ওহ মা, এই মামা সেই মামা নয়।”
“তাহলে?”
“পাওয়ারওয়ালা বড়লোক মামা, মা। চলো ভিতরে চলো।”
মাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে যায় কামাল। ছোট ভাইবোনগুলোর খুশিতে পা মাটিতে পরছিলো না যেন। কাম রুন্নেসা তমালের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, “চাকরিতে ঢুকলে পড়াশুনা চালাবি কি করে? তুই কি আর পড়বি না?”
“পড়বো মা, সময় বের করে নিয়ে পড়াশুনাটা চালিয়ে যাবো।”
সহজ সরল কামরুন্নেসা নিজে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরুতে পারেননি বলেই হয়তো এতো কিছু বুঝেন নি। কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে ছেলে সংসারের হাল ধরতে চাচ্ছে। বড় ছেলেতো আর খোঁজ খবর পর্যন্ত নিতো না। যে মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো তারাও নিজেদের সংসার নিয়েই ব্যস্ত ছিল। মাঝে মাঝে দেখতে আসতো এখনও যেমনটা আসে। তমালের পড়ালেখা আর হলো না। ছোট পদে চাকরি বড় বড় আশা করা তাকে যেন আর মানালো না। চাকরিতে যোগ দেবার পর নিজের জন্য সে কোন টাকাই রাখতো না। বিড়ির কাজ বন্ধ করে দিলো। ছোট ভাই জামালকে কিছু টাকা দিলো ব্যবসা করার জন্য। জামালও পড়াশুনায় ভালো করছিলো না। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসলো না সে। টাকা নিয়ে কাপরের ব্যবসা শুরু করে দিলো। ছোট ব্যবসা কিন্তু লক্ষ্য ছিলো অনেক বড়। কিছুদিনের মধ্যেই সে প্রমাণ করলো যে ব্যবসাই তার কপালে লেখা ছিলো। বোনের বিয়ে হয়ে গেলো। কামাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। স্কুল, কলেজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও ভালো রেজাল্ট করলো সে। কামরুন্নেসার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে তার ছেলেমেয়েরা। ছোট মেয়েও সরকারী স্কুলে যোগ দিলো। কামালের চাকরি হলো বিসিএসে। কষ্টের দিনগুলো এখন আর নেই। কিন্তু স্মৃতিগুলো এখনও আছে। কামাল বাড়িতে আসলেই মায়ের হাতে টাকা ধরিয়ে দেয়। গ্রামের সবাইকে সেই টাকা বিলিয়ে দেন কামরুন্নেসা। কষ্টের ভয়ে কোন ছেলেমেয়েই বাড়ি ছাড়েনি, সাধু সন্ন্যাসীও হতে হয়নি কাউকে। কষ্টই ছেড়ে চলে গেছে তাদের। নিজের সংসারে আজ কষ্ট নেই বলে অন্যদের কষ্টকে বুঝতে পারবেন না, তাদের পাশে দাঁড়াবেন না, এটা মানতে পারেন না কামরুন্নেসা। গ্রামের গরীব মানুষগুলোর কাছে তিনি এখন একজন ত্রাণকত্রী। কামরুন্নেসার সংসার যুদ্ধ জয় অন্যদেরকেও প্রভাবিত করেছে। যে গ্রামে এক সময় বিড়ি শ্রমিক ছাড়া আর কাউকে মিলতো না এখন সেখানেই প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই শিক্ষিত ছেলেমেয়ে আছে। সবার দারিদ্র হয়তো দূর হয়নি এখনো। কিন্তু দূর হতে কতক্ষণ? যে পরিবারে কামরুন্নেসার মতো মা থাকে, সেখানে দারিদ্র থাকে না। মায়ের দুচোখে এখনও মাঝে মাঝে অশ্রু জমে কিন্তু সেটা আনন্দাশ্রু।
কামরুন্নেসা মুরগী পোলাও রান্না করছেন আজ। কামাল দরজায় দাঁড়িয়ে। মায়ের চোখ এড়াতে পারলো না সে।
“কি রে, ভিতরে আয়। পোলাও রান্না হচ্ছে।”
কামাল রান্না ঘরের ভিতরে ঢুকে। মায়ের পাশে বসে কথা বলতে বলতেই কখন যে মায়ের কাঁধে মাথা রেখেছে সে খেয়ালই করেনি। ছেলের আহ্লাদে মুখটার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন কামরুন্নেসা।
“তুই এখনও ছোট আছিস?”
কামাল দাঁত বের করে হাসে। আবার কাঁধে মাথা রেখে বলে, “মা।”
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সোলাইমান ১৫/১২/২০১৬
-
বাবুল বাদশা ০৮/১২/২০১৬সুন্দর ।
-
রেজওয়ান উল হক জীবন ০৮/১২/২০১৬একটু সংক্ষেপণ প্রয়োজন....
-
কামরুজ্জামান টিটু ০৮/১২/২০১৬সুন্দর
ভাবতে পারেন এমন করেই প্রেমপিরিতি শিখি!
লাডডু খাবো, কোথায় পাবো? দিল্লি অনেক দূর!
ঝিমিয়ে পরা জীবন এখন শান্ত সমুদ্দূর!
ভাবনা কি আর ওসব মানে! লাগাম ছাড়া ছোটে।
তার ছোঁয়াতেই প্রেম-পিরিতি কাব্য কথায় ফোটে।
মা যে আমার ভাল একটি বন্ধু।