পাইপের ফাঁদে
‘এই সড়েন, আমাকে একটু জায়গা দিন তো।’
‘আপনাকে জায়গা দিলে আমরা দাঁড়াবো কোথায়? দেখছেন না এখানে এক বিন্দু পরিমাণ জায়গা নেই?’
‘তাতে কি? আপনি একাই নিউজ কাভার করবেন আর আমরা বসে বসে আঙ্গুল চুষবো? এমনিতেই আমাদের অনেক দর্শককে আপনারা ভাগায় নিছেন।’
‘কি যা তা বলছেন!’
চ্যানেল ২৫ আর ময়না টিভির এই দুই সাংবাদিকের মধ্যে বাকবিতন্ডা দেখে এগিয়ে এলেন সিভিসি চ্যানেলের সিনিয়র সাংবাদিক। কোন মতে সামলালেন দুইজনকে। এর মধ্যে নিজের ছেড়ে আসা জায়গাটি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।
‘ও ভাই, আমার জায়গায় আপনি দাঁড়ালেন কেন?’
‘ক্যান? এই জায়গাকি আপনে কিন্না নিছেন? নাকি আপনার বাপে আপনার নামে উইল কইরা গ্যাছে?
বাপ তুলে কথা বলেছে শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেছে, কিন্তু কিছু করার নাই। নিজেকে সামলালেন এই সিনিয়র সাংবাদিক। সাংবাদিকতার ঠেলা কেমন সেটা শুধু সাংবাদিকরাই বুঝে। এর মধ্যে শ’খানেক কামড় খেতে হয়েছে মশার। আল্লাহ্র এই অপরূপ সৃষ্টিটির জন্য মসজিদে কিছু টাকা দান করবেন, ভাবলেন। আল্লাহ্র গুণগান করলেন, নাকি বিদ্রুপ, সেটা ঠিক বুঝা গেলো না। আগের জায়গা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে কোনমতে একটু চিপার মধ্যে নিজে দাঁড়ালেন। পিছনে দাঁড়ানো-না দাঁড়ানো অবস্থা ক্যামেরাম্যানের। যে কোনভাবেই হোক, একেবারে টাটকা এবং ক্লোজ নিউজ সংগ্রহ করতে হবে। চ্যানেলের স্ক্রলে অলরেডি ব্রেকিং নিউজ দেখানো হচ্ছে। মন্ত্রী পাইপের ভিতর পড়ে গেছেন বলে কথা! এ খবর নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আগেভাগে কাভার করতে হবে।
‘এই ক্যামেরাম্যান।’
একজন আনাড়ি লোক ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরা টানতে টানতে বললো।
‘কি হয়েছে? ক্যামেরা ধরে টানাটানি করছেন কেন?’
‘আমারে একটু ভিডিও করবেন, স্যার? আমার খুব ইচ্ছা, আমারেও একদিন টিভিতে দেখাইবো। আমারে একটু ভিডিও করেন না, পিলিজ।’
কি উত্তর দেবেন, ক্যামেরাম্যান ভেবে পেলেন না। কিন্তু রাগ সামলাতে পারলেন না তিনি।
‘আপনেও একটা পাইপের ভিতর পড়েন। ভিডিও করে টিভিতে দেখাবো আপনারে।’
‘হাছা?’
‘হুম।’
‘খাঁড়ান, আপনি তাইলে দেইখা আহি, কোনখানে খোলা পাইপ আছে কিনা।’
‘শালা!’ নিজের মুখকে সামলাতে পারলেন না ক্যামেরাম্যান।
‘মামুন’, সিনিয়র সাংবাদিক লোকটা সামনে থেকে একটা হাঁক দিলেন।
‘জি ভাই।’
‘ক্যামেরা রেডি করো। টিভিতে কানেকশান দেয়া হয়েছে। লাইভ ফুটেজ যাবে এখন।’
সাংবাদিক নিজের পজিশনটা কোন মতে ঠিক করে নিলেন। এক্সিডেন্ট স্পট ঠিকমত আসতেছে না ক্যামেরাতে, মানুষের মাথাই বেশী দেখা যাচ্ছে মনিটরে। মোবাইলের ওপাশ থেকে অনবরত কথা আসতেছে, ‘হ্যালো, মুস্তুফা সুরুজ, আপনি কি আপনাকে শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো, হ্যালো। মুস্তুফা সুরুজ... হ্যালো হ্যালো।’
‘জি, ইথিলা সানজানা, আমি আপনাকে শুনতে পাচ্ছি।’
এই কথা শুনার পর পিছন দিক থেকে একজন ধাক্কা মারলো সাংবাদিককে, “ধুর মিয়া, আমরা কেউ শুনতে পাচ্ছি না, আর আপনি শুনতে পেলেন?’
‘বুঝলাম না’, সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। তাঁর চোখে মুখে প্রচণ্ড বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। কত কষ্ট করে স্টুডিওর সাথে সংযোগটা পেয়েছিলেন, এখন সেটাও আর পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু শোঁ শোঁ আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে স্টুডিওতে সিডর বয়ে যাচ্ছে।
‘হ্যালো, ইথিলা, ইথিলা, আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?’
নাহ। ইথিলাকে আর পাওয়া গেলো না। নিউজরুমে কি হচ্ছে সেটা আল্লাহ্ই জানে।
সাংবাদিক, উৎসুক সাধারণ জনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যগণ এবং রাজনৈতিক নেতা-পাতি নেতায় ভরে গেছে পুরো এলাকা। কেউ কেউ দেখতে এসেছেন অনেকদূর থেকে। এরকম একটি ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়াটা কম কথা নয়। কেউ কেউ মোবাইলে ফটো আর ভিডিও নেবার জন্য রীতিমত লড়াই করছে। কে কাকে ডিঙিয়ে আগে ফটো নেবে, ভিডিও নেবে তার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছে। আগে অডিও, ভিডিও, ফটো নিতে পারলেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ্সে আপলোড করতে পারবে।
কিছু সাংবাদিক তাদের মধ্যে কারও কারও সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।
‘কি ভাই, আপনারা কি করছেন?’
‘ওহ (মাথার চুল স্টাইল করতে করতে)! আমরা ভিরফি নিচ্ছি।’
‘মানে?’
‘হোয়াট মানে মানে?’ এক ছেলে এগিয়ে এসে পাল্টা প্রশ্ন করলো।
‘যান মিয়া, ভিরফি মানে বুঝেন না?’
‘না, ভাই। একটু বুঝায় বলবেন?’ এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন।
‘ওকে, ওকে, ভিরফি মানে হইল গিয়া ভিরফি।’
‘বুঝলাম না’, আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন।
‘ওহ নো! ভীরের মধ্যে পিক তুললে সেটাকে ভিরফি বলে। এইবার বুঝছেন? খালি ডিস্টার্ব করে।’
সাংবাদিকেরা উত্তর পেলেন বটে, কিন্তু চমকে গেলেন তার চেয়ে অনেক বেশী। একজন মন্ত্রী পাইপের মধ্যে পড়ে গেছেন, সেটা এদের জন্য খুব আনন্দের বিষয়!
কোন এক সাংবাদিক তাঁদেরকে ইশারা করছে দেখে তাঁরা স্থান ত্যাগ করলেন। লোকদের ঠেলে সেখানে যেয়ে জানতে পারলেন, একজন সিনিয়র মন্ত্রী সেখানে এসেছেন। এখন তাঁকে প্রোটোকল দেয়া হচ্ছে। তিনি সচক্ষে ঘটনাস্থল দেখার জন্য ছটফট করছেন। দেশের প্রযুক্তির উপর ভরসা করতে পারছেন না। বিদেশ থেকে রেস্কু টিম আসতেছে। তারপরেও দেশী প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন, সেনাবাহিনী ও বুয়েটের এক্সপার্ট টিমের সঙ্গে উদ্ধারকাজ করছে। কিছুক্ষণ আগেও নাকি পাইপের ভিতর থেকে মন্ত্রী মহোদয় ‘বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেছিলেন। কিন্তু এখন কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শব্দের প্রতিফলন পরীক্ষা করার জন্য কেউ কেউ ইট পাথর, যা পেয়েছে পাইপের ভিতর ছুঁড়েছে। প্রথম দিকে কিছু শব্দ আসলেও এখন আর কোন শব্দই মিলছে না। অথচ যত মানুষ জড়ো হয়ে গেছে সেখানে পাইপের অত গভীর থেকে চিৎকার বাইরে আসলেও তা কি আর বুঝার উপায় আছে? টিভিতে শব্দবিজ্ঞানীদের খোঁজে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। শব্দের গতি, ধরণ, এসব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ করে হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো।
‘সড়ে যান, সড়ে যান, মাননীয় বিমান মন্ত্রী পাইপের মুখ দেখবেন।’
বিমান মন্ত্রী পাইপের মুখ দেখবেন! উপস্থিত সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকেরা অবাক হলেন। উৎসুক কিছু সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, পাইপের মুখ দেখে আপনি কি ব্যবস্থা নেবেন?’
‘আমি বিমান সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছি। আকাশ থেকে পাইপে পতিত মন্ত্রীর অবস্থান নির্ণয় করতে। কিছুক্ষণের মধ্যে কাজ শুরু হবে। দেখুন, এটা সত্যি খুব দুঃখজনক ঘটনা। আমরা আমাদের সকল শক্তি প্রয়োগ করছি। আমাদের বিমান এইমাত্র কাজ শুরু করলো বলে। আপনারা সবাই দুয়া করেন। আল্লাহ-ভগবান-ঈশ্বরকে ডাকেন। মাওলানা তাকাব্বুল আল ফারমানিকে বয়ান দিতে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।’
পাশে উপস্থিত একজন আমলা বলে উঠলেন, ‘মাননীয় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এক হাজার চারশ বিশটা মহিষ কোরবানির ব্যবস্থা করেছেন।’
‘ও খুব ভালো। আমিও দুই হাজার আটশ আশিটা বিমান কোরবানি দিবো ইনশা আল্লাহ্।’
পাশে উপস্থিত পুলিশের একজন কর্মকর্তা বিমান মন্ত্রীর কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, বিমান তো কোরবানি দেয়া যায় না।’
‘ওহ তাই নাকি! মিডিয়া শুনেছে কিনা দেখুন তো,” বিমান মন্ত্রী চারপাশ খেয়াল করলেন, মনে মনে বললেন, ‘বিমানের কোরবানি অনেক আগেই তো দিয়া দিছি।’
হঠাৎ করে বিমান মন্ত্রীর ফোন বেজে উঠলো। তাঁর পিএস ফোন রিসিভ করলেন। তাঁর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো, “স্যার।’
মন্ত্রী ফোনটা নিয়ে কানে লাগালেন।
‘কি! কি বলছো এসব!’
সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘিরে ধরলেন।
‘কি হয়েছে, মাননীয় মন্ত্রী?’ উপস্থিত সাংবাদিক আর জনগণের কৌতূহলের শেষ নেই। হুড়াহুড়ি শুরু হয়ে গেলো।
কেউ কেউ মন্ত্রীর সামনে মাইক্রোফোন ধরতে পারলেন, কেউ কেউ পারলেন না। মন্ত্রীর পিএস হাত ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন যে মন্ত্রী এখন মিডিয়ার সামনে কথা বলবেন। মন্ত্রী গলা ঠিক করে নিলেন, ‘দেখুন খুব ঠাণ্ডা পড়ছে, এখন মিডিয়াতে কথা বলার সময় নয়। একজন মন্ত্রী পাইপের ভিতর পড়ে গেছেন। এখানকার উন্নয়ন কাজ দেখতে এসে তিনি নিজেই অবনতির দিকে চলে গেলেন, এটা সত্যিই খুব দুঃখজনক। আমরা তিনদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করবো। আপনারা কাল কালো ব্যাজ ধারণ করে রাস্তায় নেমে পড়বেন।’
পাইপের ভিতর পতিত মন্ত্রীকে উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে আর বিমান মন্ত্রী হঠাৎ জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করার কথা কেন বললেন, সেটা কারো মাথায় ঢুকলোনা। সাংবাদিকেরাও সেটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না। সবাই বিমানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলো বিমান দিয়ে পাইপের ভিতর পর্যবেক্ষণ করা হবে কিনা। বিমান মন্ত্রীর মুখ কালো হয়ে গেলো।
‘দেখুন, আমি তো নির্দেশ দিয়েছিলাম এরকম কিছু করার জন্য। কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। সকাল হবার সাথে সাথেই অ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে।’
বিমান মন্ত্রী কথা শেষ করতে না করতেই সেখানে আবার হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো।
‘সড়েন সড়েন, মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসছেন।’
সাংবাদিকেরা খুব চমকে গেলেন।
‘এখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রী এসে কী করবেন?’ প্রশ্ন করলেন এক সাংবাদিক।
‘সহকর্মীর বিপদে ঝাঁপিয়ে পরাইতো মহৎ সহকর্মীর কাজ।’ বললেন অন্য এক সাংবাদিক।
দুই মন্ত্রী একসাথে হলেন। বিমান মন্ত্রীকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী। বিমান মন্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রী কাঁদো কাঁদো চোখে বললেন, “আমাদের শিক্ষা মন্ত্রী, এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন আমি ভাবতেও পারিনি।’
এক সাংবাদিক স্বাস্থ্য মন্ত্রীর ভুল ঠিক করে দিলেন, “স্যার, উনি শিক্ষামন্ত্রী নন।’
‘তবে কি তুমি শিক্ষামন্ত্রী?’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী খুব ক্ষেপে গেছেন মনে হলো।
বিমান মন্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রীর কানে কানে বললেন, “ভাইজান, উনি আসলে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।’
‘কে, কে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? এই ব্যাটা সাংবাদিক?’
‘আরে না। যিনি পাইপের ভিতর পড়ে গেছেন, তিনি।’
‘ওহ দেখুন দেখি কাণ্ড! আমি তো শিক্ষা মন্ত্রীর কথা ভেবেই তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম।’
‘কেনো? বাসায় কী করছিলেন?’ বিমান মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনার ভাবিসহ ‘রাগে অনুরাগে’ সিরিয়াল দেখছিলাম।’
‘ইশ! আমি মিস করলাম। কি আর করা! মন্ত্রী হলে এরকম স্যাক্রিফাইস করতেই হয়। চলুন এখন ঘটনাস্থলে যাওয়া যাক।’
দুজন মন্ত্রী একসাথে ঘটনাস্থলের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। ভীর আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। বিমান মন্ত্রী খুব ক্ষেপে গেলেন।
‘এই পুলিশ করছেটা কী? পুলিশ কমিশনার কোথায়?’
উপস্থিত পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মন্ত্রীর কানের কাছে মুখ রেখে বললেন, ‘স্যার, উনার প্রচণ্ড সর্দি লেগেছে। উনি হাঁটতেই পারছেন না।’
মন্ত্রী আরোও রেগে গেলেন, ‘ওনাকে কালকেই ছটিকফড়িতে ট্র্যান্সফার করা হবে।’
‘স্যার ওটা ছটিকফরি নয়, ফটিকছড়ি,’ পুলিশ কর্মকর্তা মন্ত্রীর ভুল ধরিয়ে দিলে মন্ত্রী আরও রেগে যান।
‘আপনি আমাকে বানান শেখাবেন!’
‘সরি স্যার।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিমান মন্ত্রী শান্ত হলেন। দুজন আবার হাঁটা শুরু করলেন। সাংবাদিক আর জনগণ তাঁদের পিছু নিলো।
এক লোক এক ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরা টেনে ধরার চেষ্টা করছে। ক্যামেরাম্যান পিছনে তাকাতেই তাঁর দুচোখ ছানাবড়া অবস্থা।
‘এই তুমি! আবার আসছো?’
‘হ সার। আমি সেইসম থাইকা একটা খোলা পাইপ খুজতাছিলাম।’
‘তো পেয়েছো একটাও?’
‘পাইনাই। কিন্তু আমি নিজেই একটা পাইপের মুখ খুইলা ফালাইছি। সেই পাইপ এই পাইপের চাইতে বড়। আমি পড়লেও আমারে তুলোন যাইবো। আপনে আহেন, আমি অইহানে লাফ দেই, আপনে ভিডিও করেন। আহেন।’
‘এখন না। এখানকার কাজ শেষ হোক। এরপর শুধু তোমাকেই ভিডিও করবো।’
‘হাছা কইতাসেন, সার?’
‘হ্যাঁ রে বাবা।’
‘আইচ্ছা। তাইলে আমি আপনের পিছে পিছে থাকি?
‘ওকে। থাকো।’
কথা বলতে বলে এই ক্যামেরাম্যান পিছনে পড়ে গেছেন। সাংবাদিককে দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। ভীর বেড়েই চলেছে। আশে পাশের এলাকা, জেলা, উপজেলা থেকে লোকজন আশা শুরু করেছে। কেউ কেউ মাথার উপর, কাঁধের উপর করে ছোট ছোট বাচ্চাকে তুলে দেখানোর চেষ্টা করছেন।
মধ্যবয়স্ক এক লোক কাঁধের উপর বসিয়েছেন তাঁর ছেলেকে, ‘ঐ জিহাদ, কিছু দেখিবার পারছস?’
‘না আব্বা, খালি মানুষ দেখি। মন্ত্রীরে তো দেখিবার পারছি না। ও আব্বা। আব্বা।’
মাইকে ঘোষণা এলো। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসতেছেন। মেক-আপ নিতে যতটুকু টাইম লাগে, এই আর কি।
বিরোধীদলীয় কিছু নেতাও এসে গেছেন। এখানে আসার আগেই তাঁরা সপ্তাহব্যাপী হরতাল ঘোষণা করে এসেছেন। এ আন্দোলন দেশকে পাইপমুক্ত করার আন্দোলন। এ কর্মসূচি নিয়ে তাঁরা উপস্থিত সাংবাদিকগণের নিকট বিবৃতি দিচ্ছেন।
কিছু সময়ের জন্য উদ্ধারকার্য স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের নিরাপত্তার জন্য এটা করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানালেন ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা।
বিমান মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রী পাইপের কাছে চলে গেছেন। দুজন দুজনকে শক্ত করে ধরে আছেন। যেন ভুলেও তাঁরা পা পিছলে পাইপে না পড়ে যান। দুজনেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নাম ধরে ডাকলেন। সাড়া এলো না। দুজনই হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। মিডিয়াকে তাঁদের সামনে আসতে বলা হলো। এবার তাঁদের সাথে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলাগণ কান্না শুরু করলেন।
‘ভাইজান, আপনার চোখে কিন্তু কোন পানি দেখছি না’ স্বাস্থ্য মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বিমান মন্ত্রী বললেন।
‘টিভিতে সিরিয়াল দেখার সময় আপনার ভাবিসহ অনেকক্ষণ কেঁদেছি। তাই হয়তো...।’
‘ওহ! তাও, এখানে মিডিয়া আছে তো। চোখে পানি না থাকলে কেমন দেখায়? মুখটা একটু নিচু করেন তো।’
‘কেনো?’
‘একটু থুথু লাগায় দেই।’
‘হায় হায়! এইটা কী করেন?’
‘চুপ করেন। এখন চোখে পানি না থাকলে কাল মন্ত্রীত্ব খোয়াতে পারেন।’
‘আচ্ছা। তাইলে একটু বেশী করে দেন।’
এবার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ শুরু হয়ে গেলো। ক্রন্দনরত দুই সিনিয়র মন্ত্রীর অনেক ছবি নেয়া হলো। ভিডিও ক্যামেরা চলছে।
তাঁরা দুজন এখন পাইপের দিকে তাকাচ্ছেন। আর কাঁদছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রী পাইপের ভিতর কিছু ফ্রুট জুস আর জেলি ফেলে দিতে বললেন।
মন্ত্রীর নির্দেশমত ফ্রুট জুস আর জেলি নিয়ে আসা হলো। সেগুলো দুই মন্ত্রী একসাথে পাইপের ভিতর ফেলে দিলেন। বিমান মন্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো কিছু লোক হাত তালি দিলে দিতে শুরু করলে তিনি ক্ষেপে যান, ‘মিয়ারা এখানে কি আমরা কিছু উদ্বোধন করতে এসেছি?’
সবাই চুপ হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রী অনেকক্ষণ পাইপের ভিতরে তাকালেন। তাঁকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন বিমান মন্ত্রী। ইতিমধ্যে মাইকে ঘোষণা এলো যে সেখানে আরও একজন সিনিয়র মন্ত্রী আসছেন। হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে অর্থ মন্ত্রী এসে হাজির হলেন। তিনিও পাইপের মুখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। অন্য দুই মন্ত্রী এই কান্নায় শামিল হলেন। অর্থ মন্ত্রী উদ্ধারকার্য সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এতগুলো ঘণ্টা পার হবার পরও হতভাগ্য মন্ত্রীকে উদ্ধার করা যায় নি, এটা তাঁকে খুব ক্ষুব্ধ করলো।
‘যত্তসব রাবিশ! ইউ আর গুড ফর নাথিং। সিমপ্লি রাবিশ!’
তিনমন্ত্রী একটু আলাদা আলাপ করতে চাইলে চারপাশ ফাঁকা করা হলো। উপস্থিত লোকেরা সড়তে না চাইলে তাদের উপর লাঠিচার্জ, শেষে টিয়ার গ্যার ছুঁড়া হলো। মন্ত্রীত্রয় ঘণ্টা আধেকের মত আলাপ করলেন। তিনজন একসাথেই পাইপের কাছে এলেন। শুধু সাংবাদিকদের ডেকে আনা হলো। অর্থমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করলেন মিডিয়ার সামনে।
‘দেখুন। ইট’জ সিমপ্ল টু সে দ্যাট এতক্ষণ ধরে কাজ করেও যখন ভিক্টিমের সন্ধান মিললো না। তখন আই অ্যাম ড্যাম শিওর, এখানে মন্ত্রী পড়েন নাই। ইট ইজ কোয়াইট ক্লিয়ার। তোমরা খালি টাইম কিল করো। রাবিশ!’
‘তাও আমাদের উদ্ধারকাজ চলবে। ওখানে ব্যাঙ, টিকটিকি আটকা পড়ে থাকতে পারে। তাদেরকে উদ্ধার করতে হবে। আমাদের সরকার পরিবেশ বিপন্ন হতে দিতে পারে না’, বিমান মন্ত্রী কথা গুলো বললেন।
এরপর তিনমন্ত্রী মিলে আবার কিছুক্ষণ কানাকানি করলেন। মিনিট পাঁচেক পর স্বাস্থ্য মন্ত্রী নিজেই এক সাংবাদিকের হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিলেন।
‘দেখুন, ভাইয়েরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে ওনার শ্বশুরের বনিবনা হচ্ছিলো না কিছুদিন ধরে। আমরা মনে করি ওনার শ্বশুরই ওনাকে অপহরণ করিয়েছেন। আমরা কাল সকালেই চিরুনি অভিযান শুরু করবো। আমিও নিশ্চিত এই পাইপের ভিতর কেউ পড়েনি। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তো পড়তেই পারেন না। খুব শীঘ্রই ওনার শ্বশুরের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করা হবে। আর কদিন ধরে ওনার স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিলো না। আমি প্রায় ওনাকে সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে বলি। সুস্বাস্থ্য আমাদের জন্য খুবই দরকার। আমাদের সরকার সুস্বাস্থ্যের সরকার। ভাইয়েরা আমার, বোনেরা তোমার, আসুন আমরা বাংলাদেশকে স্বাস্থ্যবান করে গড়ে তুলি। আপনাদের যা যা আছে তাই নিয়ে স্বাস্থ্য গড়ে তুলুন। দরকার হলে আরও রক্ত দেবো, তাও বাংলাদেশকে মোটাতাজা করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ্।’
পাশে উপস্থিত স্বাস্থ্য মন্ত্রীর পিএস নিজে হাততালি দিলেন এবং অন্য সবাইকে হাততালি দিতে বলার সাথে সাথে বিমান মন্ত্রী তাঁর ডান গালে কষে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলেন। হতচকিত পিএস ‘ও মশা!’ ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রীর কাছ থেকে মাইক কেড়ে নিলেন বিমান মন্ত্রী।
‘আপনার মাথা ঠিক আছে তো? মানুষ মশকরা ভাববে।’
‘ওহ! আমি ভাবলাম, সবাইকে একটু স্বাস্থ্য সচেতন করি।’
‘এখন না, পরে। চলেন আমরা একটু দুয়া করি।’
‘দুয়া! কার জন্য, কিসের জন্য?’
‘পাইপের ভিতর পতিত মন্ত্রী মহোদয়ের জন্য।’
‘পাইপের ভিতর মন্ত্রী পরে গেছে নাকি?’
‘ওহ আল্লাহ্! তা না হলে এখানে এসেছেন কেনো?’
‘ওহ সরি, আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। আজ ঠিকমত খাওয়া হয়নি, তার উপর সিরিয়াল দেখার সময় অতিরিক্ত কেঁদে ফেলেছি। তাই এরকম হচ্ছে। আহারে! কোমলটাকে সবাই খালি ভুল বুঝে। ওর চোখের পানি দেখলেই আমার কান্না চলে আসে। আপনার ভাবি তো কাঁদতে কাঁদতে দুচোখ লাল করে ফেলেছে। আপনি কি ‘জি বাংলা’ নিয়মিত দেখেন নাকি পর্ব মিস করে ফেলেন?’
‘মাঝরাতে পুনঃপ্রচার দেখি। দুপুরেও দেখি কখনও কখনও।’
‘ওয়াও! আমিও দেখি। সচিবালয়ে আমার রুমে ৫২ ইঞ্চি সনি ব্রাভিয়া লাগিয়ে নিয়েছি। আপনার রুমে একটা লাগিয়ে নিতে পারেন।’
‘কিন্তু কিছু কিছু আইনজীবী ভারতীয় চ্যানেলের বিরুদ্ধে যেভাবে উঠে পরে লেগেছেন তাতে এই সিরিয়ালগুলো আর দেখা হবে কিনা সেটাই সন্দেহ।’
‘কিচ্ছু হবে না। আমি তথ্য মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। উনি বলেছেন, এই চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার এদেশে বন্ধ করে দিলে ওনার স্ত্রী ওনার সঙ্গে ঘর করা বন্ধ করে দেবে।’
‘ওয়াও! হোয়াট এ ওয়াইফ হি হ্যাজ। আচ্ছা ওনার ওয়াইফকে একদিন দেখতে গেলে ক্যামন হয়?’
‘খুব ভালো হয়। উনি নাকি দেখতে রাশির মতো। যাই হোক ভারতীয় চ্যানেল, অ্যাট লিস্ট, জি বাংলা আর স্টার জলসা বন্ধ করা যাবেনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয়রা আমাদের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলো, ভারতীয় সিরিয়াল দেখে তার ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করা যাবে।’
‘ঠিক বলেছেন আপনি। কেনো যে অনেকেই এটা বুঝতে চান না, আই সিম্পলি ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড। রাবিশ!’ অর্থ মন্ত্রী পাশ থেকে সায় দিলেন।
মন্ত্রীত্রয়ের কথা শেষ না হতেই আবার হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। অর্থমন্ত্রী নিজেই জিজ্ঞেস করলেন সবাই এত হট্টগোল করছে কেনো। সিনিয়র একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে জানালেন যে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী এখানে এসে পৌঁছাবেন। উদ্ধারকার্য এখনও শুরু করা হয়নি। দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে উদ্ধারকার্য সহজ করার জন্য কিছু খাঁচা আবিস্কার করার জন্য। মন্ত্রী যদি পাইপে পড়েও থাকেন, তাঁকে তোলাটা যেন খুব সহজ হয়। যত সময় লাগুক, একটা ভালোমানের খাঁচা নির্মাণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একজন মন্ত্রী যেনো তেনো খাঁচায় উঠতে পারেন না। প্রেস্টিজ ম্যাটারস।
মন্ত্রীত্রয়কে একটা নিরাপদ স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। পুলিশ সদস্যরা লাঠি পেঠা করে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিলো। পাশের একটি বহুতল ভবনের ছাঁদে মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁরা সেখানে কাঁদছেন। মাইকের মাধ্যমে সে কান্না সবাইকে শুনানোর ব্যবস্থা করা হলো। মন্ত্রী মহোদয়ের স্ত্রী আসেন নি। সব কটা সিরিয়াল শেষ হবার পরপরই তিনি চলে আসবেন বলে, মাইকে অনেকবার জানানো হয়েছে।
‘সড়ে দাঁড়ান সড়ে দাঁড়ান।’
দৌড়ে দৌড়ে সেখান কয়েকটা বিদেশী কুকুর চলে এলো। স্কটিশ ডগ ইয়ার্ডের সদস্য এরা। পুরো এলাকাটা নাক দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখলো। উপস্থিত জনগণ, সাংবাদিক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা কিছুটা অবাক হলো। মন্ত্রী পড়ে আছেন পাইপের ভিতর আর কুকুর দিয়ে পুরো এলাকা পরীক্ষা কেনো করা হচ্ছে, সেটা তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। মাইকে জানানো হলো, প্রধানমন্ত্রী আসছেন। তাঁর জন্য নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। উপস্থিত সবাইকে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। উপস্থিত মন্ত্রী তিনজন নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে যেন আলোচনা করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর আসার শব্দ শুনা গেলো।
পাশের ভবন থেকে আসা কান্নার আওয়াজ বন্ধ হলো। প্রধানমন্ত্রী গাড়ি থেকে নামার আগেই পুলিশ সদস্যগণ এবং প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষীরা নেমে পড়লেন। বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর আরও কিছু সদস্য প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির পাশে দাঁড়ালেন। আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশবাহিনীর কিছু সদস্য প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রথমদিকে কিছুটা ইতঃস্তত করলেও পরে সবার অনুরোধের মুখে গার্ড অব অনার নিলেন। চারদিক থেকে দলের সমর্থকেরা দলীয় স্লোগান দিতে শুরু করলেন। প্রধানমন্ত্রী হাসিমুখে তাদের দিকে হাত নাড়লেন। হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর চোখ পড়লো বাবার মাথার উপর বসা একটি ছেলের উপর। প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিএসকে দিয়ে লোকটিকে ডেকে পাঠালেন। লোকটা ভয়ে ভয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চলে এলো।
‘ম্যাডাম, আমাকে মাফ করে দেন। আমি কিছু করি নাই।’ লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বলে।
প্রধানমন্ত্রী লোকটার কথায় কান না দিয়ে ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
‘তোমার নাম কী, বাবু?’
‘জিহাদ।’
‘খুব ভালো। কী দেখতে এসেছো?’
‘পাইপ দেখতে।’
‘ওলে বাবা! দেখো। তুমি কিন্তু পাইপের ধারে কাছে কোনো দিন যেয়ো না। ঠিক আছে?’
‘আইচ্ছা।’
এরপর প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাথে থাকা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের নিয়ে সামনের দিকে এগোলেন। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মন্ত্রী তিনজনকেও ডাকা হলো। পাইপটা কত দূরে, প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন। একশ মিটারের মত হবে, একজন বলল। আরেকজন বলল, পঞ্চাশ মিটারের বেশী হবে না। সঠিক দূরত্ব কত হবে, এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেলো। প্রধানমন্ত্রী বেশ খানিকটা বিরক্ত হলেন। তাঁর সাথে আসা ভূমিমন্ত্রী আমিন ডেকে আনতে বললেন। মন্ত্রীর এপিএস ভূমি অফিসের এক আমিনকে ফোন করলেন। তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম আগমন। সংস্কৃতিমন্ত্রী এই মুহূর্তকে স্মরণীয় করতে চান। তিনি মাইকে ঘোষণা করলেন এখন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে সমবেতভাবে। যেমন কথা, তেমন কাজ। সুর-তাল-লয় ঠিক রাখার জন্য একজন সঙ্গীতশিল্পী দরকার। এখন তো তেমন কেউ নেই এখানে। মাইকে ঘোষণা দেয়া হলো জাতীয় সঙ্গীতের উপর ভালো দখল আছে এরকম কোন ব্যক্তি আশে পাশে উপস্থিত আছেন কিনা। মোটা করে এক মহিলা দৌড়ে চলে এলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাঁকে তাঁর পরিচয় মাইকে বলে দিতে বললেন। মহিলা যেন মাইকের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন।
‘আস সালাই মালাই কুম, আমি কুমকুম মুঙ্গেস্কার। জন্মের পর থেকে আমি গান করি। আমার আব্বা ছিলো গ্রামের বড় গাতক। আব্বা খুব ভালো আযান দিতো। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর...।’
প্রধানমন্ত্রীর দুচোখ রাগে ফেঁপে ফুলে উঠছে যেন। এটা খেয়াল করে আমলা টাইপের একজন মহিলাকে থামিয়ে দিলেন।
‘এই মহিলা, আপনাকে এখানে আযান দেবার জন্য আনা হয়েছে নাকি?’
‘তাইলে?’
‘তুমি জাতীয় সঙ্গীত জানো না?’
‘জানি তো।’
‘তাইলে সেইটাই গাও। আর তোমার নামে মুঙ্গেস্কার কেনো?
‘আইচ্ছা। আমি লতা মুঙ্গেস্কার হইতে চাইছিলাম। ওনার গান আমার খুব ভালো লাগে। ওনার নামের সাথে মিল রাইখা আমি আমার নাম রাখছি।’
‘এ মহিলা দেখি, নিজের আকিকা নিজেই করেছে। যতোসব!’ উপস্থিত একজন সাংবাদিক বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তবে সেটা কেউ খেয়াল করলো বলে মনে হয় না।
প্রধানমন্ত্রীর পাশে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা মহিলাকে জাতীয় সঙ্গীত ধরতে বললেন। মহিলা শুরু করে দিলেন। সবাই সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন। শুরু হলো জাতীয় সঙ্গীত।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
জাতীয় সঙ্গীত বেশিদূর এগুলো না। বুড়ো মতো একজন লোক একের পর এক কাঁশি শুরু করলো। সাথে হাঁচিও। দুইজন পুলিশ লোকটিকে ধরে ফেললো। একজন মন্ত্রী এ বুড়ো লোকটাকে বিরোধী দলের কোন দুষ্কৃতি মনে করে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর মামলা করতে বললেন। লোকটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো।
জাতীয় সঙ্গীত আর হলো না। প্রধানমন্ত্রী এবার আর দেরী না করে ঘটনাস্থলের কাছে যেতে চাইলেন। তাঁর কথামতো কাজ শুরু হলো। আবার লাঠিপেটা করে সাধারণ জনতাকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ এবং উপস্থিত কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সাথে নিয়ে পাইপের কাছে গেলেন। যে আমিনকে ডেকে পাঠানো হয়েছিলো। সে এসেছে। তাঁকে এখানে আসতে দেয়া হলো না।
সবাই সারিবদ্ধ হয়ে পাইপের কাছাকাছি দাঁড়ালেন। তবে পাইপের মুখের কাছে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা গেলেন না। তাঁদের জীবনের মূল্য অনেক। এভাবে ঝুঁকি নেয়া উচিত হবে না। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে চুপ থাকতে বললেন। তিনি গুটি গুটি পায়ে আর একটু এগুলেন। পাইপের ভিতরে পরে যাওয়া মন্ত্রী কোন সাড়া দেয় কিনা সেটা দেখার জন্য তিনি একটু গলা বাড়িয়ে মন্ত্রীকে ডাকা শুরু করলেন।
‘ও মন্ত্রী সাহেব, হ্যালো।’
কোন রকম সাড়া এলো না। প্রধান মন্ত্রী আর একটু কাছাকাছি চলে গেলেন।
‘হ্যালো, রেল মন্ত্রী, আপনি কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন?’
রেল মন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রীদের সাথেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখান থেকেই সাড়া দিলেন।
‘হ্যাঁ ম্যাডাম, আমি আফনাকে শুনতে ফাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রীর আনন্দ যেন উপছে পড়ছে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে সবাইকে বললেন, ‘দেখেছেন, দেখেছেন, রেল মন্ত্রী পাইপের ভিতর থেকে আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন।’
‘আমি তো এইখানে, ম্যাডাম। আমি তো এইখানে। আমি ফাইফের ভিতর না তো।’ রেল মন্ত্রী অবাক হয়ে কথা গুলো বললেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ডাকলেন কেনো, তিনি বুঝতে পারলেন না। অবাক দৃষ্টিতে অন্যান্য মন্ত্রীদের দিকে তাকালেন। সবার অবস্থা এক।
রেল মন্ত্রীকে দেখে প্রধানমন্ত্রীর আনন্দ আরও বেড়ে গেলো।
‘আপনি পাইপের ভিতর থেকে উঠে এসেছেন। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ্। আর এরকম করবেন না। এভাবে পাইপের ভিতর লুকিয়ে থেকে আমাদের টেনশন দেবেন না। জাতি এটা আপনার কাছ থেকে আশা করে না।’
সংস্কৃতি মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর ভুল ধরিয়ে দিলেন।
‘ম্যাডাম। যিনি পাইপের ভিতর পড়ে গেছেন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, রেল মন্ত্রী নন।’
‘বলেন কী! আপনারা কখনও আমাকে সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। যত্তসব! আচ্ছা আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যেন কে?’
সংস্কৃতি মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর শারীরিক বর্ণনা দিলে প্রধানমন্ত্রী হাসতে শুরু করেন।
‘আরে, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তো সেই ছোট বেলা থেকে লুকোচুরি খেলার অভ্যাস। উনি নাকি এখনও ওনার স্ত্রী সন্তানদের সাথে লুকোচুরি খেলেন। খুব বেশী বার ‘টু’ না বললে উনি নাকি সাড়া দেন না। আপনারা আগে যদি বলতেন যে উনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, আমি তাহলে ‘হ্যালো’ না বলে ‘টু, টু’ বলতাম।
প্রধানমন্ত্রী আবার পাইপের কাছে গেলেন। এবার আরও একটু কাছে। তাঁর বাম হাত ধরে টেনে রেখেছেন সরকারের একজন মহিলা মন্ত্রী। তাঁর হাত ধরে রেখেছেন আর একজন মন্ত্রী।
‘এই আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখেন। আমি যেন পাইপের ভিতর পড়ে না যাই।’
‘আচ্ছা ম্যাডাম,’ মহিলা মন্ত্রী বললেন। তিনি শরীরের সব শক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাম হাত চেপে ধরেছেন।
‘উউউউফ! লাগে তো,’ প্রধানমন্ত্রী বললেন।
‘শক্ত করে ধরলে একটু লাগবেই তো ম্যাডাম।’
মহিলা মন্ত্রীর বাম হাত ধরেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই। মাঝে মাঝে একটু সুড়সুড়ি দিচ্ছেন তিনি।
‘এই আপনে এটা কী করছেন? সুড়সুড়ি দিচ্ছেন কেন?’ মহিলা মন্ত্রী রেগে গেলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপর।
প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন মহিলা মন্ত্রী তাঁকেই বলেছেন এই কথা। তিনি ক্ষেপে গেলেন একটু।
‘আমি আপনাকে সুড়সুড়ি দিতে যাবো কেন?’
‘না ম্যাডাম, আপনাকে বলিনি।’
‘তাহলে?’
‘স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে বলেছি।’
‘ওহ, আচ্ছা, এর বিচার পরে হবে। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে এখন ‘টু’ বলি?’
‘জী ম্যাডাম, বলেন।’
‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, আপনি পাইপে লুকিয়েছেন। আমি দেখতে পাচ্ছি, বুঝতে পাচ্ছি। আমাদের সাথেও লুকোচুরি খেলেন? টু............ টু............টু।’
কোন সাড়া এলো না। প্রধানমন্ত্রী অন্য সবার দিকে তাকালেন। তারপর আবার বললেন, ‘টু............ টু............... টু।’
তাও কোন সাড়া এলো না। প্রধানমন্ত্রী একটু রেগে গেলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর উপর। ‘স্ত্রী সন্তানেরা একটু টু বললেই আপনি ধরে ফেলেন, আর আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না? আপনার মন্ত্রিত্ব আজকেই শেষ’, নিজে নিজে বললেন তিনি।
‘উনি তো কোন সাড়া দিচ্ছেনই না,’ অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।
‘ম্যাডাম, ঠাণ্ডা পড়ছে তো, তাই হয়তো উনি গুটিসুটি মেরে বসে আছেন পাইপের ভিতর,’ বিমান মন্ত্রী বললেন।
‘তাহলে কী করা যায়, বলুন তো?’ প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
‘একটু গরম পানি ঢেলে দেয়া হোক।’
‘গরম পানি! গা পুড়ে যাবে তো,’ স্বাস্থ্য মন্ত্রী বললেন।
‘গরম পানি ঢাললে পাইপের ভিতর থেকে মন্ত্রী চিৎকার করে উঠবেন।’
প্রধানমন্ত্রী মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। কথা মতো কাজ হলো। পাইপের ভিতর এক বালতি গরম পানি ঢেলে দেয়া হলো, কিন্তু কোন কাজই হলো না। সাড়া এলো না এবারও।
রেগে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাইপের কাছে গিয়ে আবার বললেন, ‘খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। আপনি সাড়া দেবেন নাকি পুলিশ ডাকবো?’
প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে থাকা মহিলা মন্ত্রী বললেন, ‘ম্যাডাম, পুলিশ তো এখানেই আছে। আপনি পুলিশ ডেকে কী করবেন?’
‘ঐ ভয় দেখাচ্ছি আর কী।’
‘ওহ।’
রেল মন্ত্রী এগিয়ে এলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলেন।
‘ম্যাডাম, আমি বলি কি সবাই মিলে মাইকে ‘টু... টু’ বললে ক্যামন হয়?’
‘ওমা! খুব ভালো বুদ্ধি তো। ইদানিং মনে হচ্ছে আপনার বুদ্ধি অনেক খুলে গেছে।’
রেল মন্ত্রী মুচকি হেসে বললেন, ‘লজ্জা ফাচ্ছি, ম্যাডাম।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতো উপস্থিত সবাইকে ‘টু’ বলতে বলা হলো। মাইকের ব্যবস্থা করা হলো। সবাই ‘টু’ বলা শুরু করলো। মনে হচ্ছে, আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। ‘টু... টূ... টু’ শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে উঠছে যেন। প্রায় দশ মিনিট ধরে চলতে থাকলো। এতেও কাজ হলো না। এত বিশাল শব্দের মধ্যে পাইপের ভিতর থেকে মন্ত্রী সাড়া দিলেন কিনা, সেটা কিভাবে বুঝা যাবে এটাও কেউ খেয়াল করলো না। পদ্ধতি পাল্টানো হলো। এবার ‘টু’ এর পরিবর্তে কান্নার ব্যবস্থা করা হলো। সবাই কান্না শুরু করলো। খবর পাওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রীর স্ত্রী এখনও আসলেনই না। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে কান্না চললো। লাভ হলোনা। বিমান মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে এলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কানে কানে কী যেন বললেন। প্রধানমন্ত্রী পাইপের কাছ থেকে সড়ে এলেন। সব মন্ত্রীকে একসাথে করলেন। মাইকে ঘোষণা দেয়া হলো, পাইপের ভিতর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পড়েন নি। তাঁর স্ত্রী তাঁকে অপহরণ করেছেন।
সাংবাদিকেরা বললেন, ‘আগে তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে ওনার শ্বশুর ওনাকে অপহরণ করেছেন। আর এখন বলছেন, ওনার স্ত্রী!’
অর্থ মন্ত্রী একটু রেগে গেলেন, ‘প্রাইম মিনিস্টার যা বলবেন সেটাই ফুল অ্যান্ড ফাইনাল। হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দিস সিম্পল ম্যাটার? রাবিশ!’
প্রধানমন্ত্রীকে মাইক দেয়া হলো, ‘দেখুন, এটা সত্যিই দুঃখজনক, আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে। পুলিশ তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আমি এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির নির্দেশ দিলাম। বাংলাদেশের সব পাইপের উচ্চতা কোন মন্ত্রীর উচ্চতার চেয়ে বেশী করা যাবে না। আর সব পাইপের মুখ আজকেই বন্ধ করে দিতে হবে। কেউ যদি কোন পাইপের মুখ খুলে রাখে তাঁকে সর্বোচ্চ্য শাস্তি দেয়া হবে। আমি এই পাইপের মুখ বন্ধ করে দিয়েই আমার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করছি।’
প্রধানমন্ত্রী এখন ঐ পাইপের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছেন। পাইপ মিস্ত্রীকে ডেকে আনা হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্য করছেন। সেই দৃশ্য প্রত্যেক টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করছে।
এক ক্যামেরাম্যান এর মধ্যে ‘এই কে রে’ বলে উঠেন। পিছন ফিরে দেখেন সেই লোকটা।
‘এই তুমি আবার! স্যার, আমারে ভিডিও করবেন না?’
‘ভিডিও! তুমি এখনই গিয়ে ঐ পাইপের মুখ বন্ধ করে আসো। শুনলে না প্রধানমন্ত্রী কী বললেন? এখনি যাও। পাইপের মুখ বন্ধ করে আসো, নাইলে তোমার খবর আছে!’
ভয় পেয়ে লোকটা দৌড় দিলো। কিন্তু পাইপের অবস্থান সে ভুলে গেছে। এতো লোকের ভীরে তার মাথা কাজ না করারই কথা। তারপরেও সে পাইপটা খুঁজেই চলছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী পাইপের মুখ বন্ধ করে ফেলেছেন। এখন সবাই যার যার বাসা ফিরে যাবেন। প্রধানমন্ত্রী ভয়ে ভয়ে মাটিতে পা ফেলছেন যেন।
‘ম্যাডাম, কোন সমস্যা?’
‘হুম। এখানে আরও কোন মুখখোলা পাইপ আছে কিনা, এই ভয়টা পাচ্ছি একটু।’
‘তাহলে ম্যাডাম, চলুন, ঐ দিক দিয়ে ঘুরে যাই। আমারও একটু একটু ভয় লাগছে,’ মহিলা মন্ত্রী বললেন। প্রধানমন্ত্রীর হাত তখনও তাঁর হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মাথা নেড়ে সায় দিলেন। অন্যসবাইকে আগের পথ দিয়েই যেয়ে তাঁদের গাড়িতে উঠতে বলা হলো। প্রধানমন্ত্রী আর অন্যান্য মন্ত্রীরা একটু ঘুরে অন্য পথ দিয়ে যাচ্ছেন। আলো আঁধারের মিশ্রণ আছে পথটাতে। লাইটের ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয়। প্রধানমন্ত্রী গুটি গুটি পায়ে হাঁটছেন। সবাই যেন এলাকাটা ছেড়ে গেলেই বেঁচে যান, এভাবে হাঁটছেন। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেন না। একটা সময় মহিলা মন্ত্রীর হাত থেকে প্রধানমন্ত্রীর হাত বের হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী পিছিয়ে পড়লেন। ভয় যেনো তাঁকে আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরছে। কিছুদুর এগিয়ে সবাই প্রধানমন্ত্রীর খোঁজ করছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোথায়? সব মন্ত্রীই আছেন, প্রধানমন্ত্রী নেই। সবাই একটু সামনেই গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বলে কথা! তিনি হয়তো আগেভাগে গিয়ে গাড়িতে বসেছেন।
লোকটা এখনও পাইপ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীরা যাচ্ছিলেন বলে সে এই দিকে সে আসতে পারেনি এতক্ষণ। একটু এগুতেই সে পাইপটা খুঁজে পেলো। হঠাৎ করে পাইপের ভিতর থেকে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ শব্দ আসছে বলে মনে হলো। কিন্তু সেটা পাত্তা দেয়ার সময় নেই তার। পাইপের মুখ যদি খোলা থাকে, আর ক্যামেরাম্যান যদি সবাইকে বলে দেয় যে সে এই কাজ করেছে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে তাকে। সাংবাদিকেরা খুব ভয়ানক। তার পরিচয় খুঁজে বের করতে তাঁদের একটুও সময় লাগবে না। লোকটার সারা শরীরে যেন পৃথিবীর সব ভয় এসে ভর করেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে ঢাকনা দিয়ে পাইপের মুখটা বন্ধ করে দিলো। কিছু মাটি এনে ঢেকে দিলো ঢাকনাটা যেন কেউ বুঝতেও না পারে যে এই পাইপের ঢাকনা খোলা হয়েছিল। কিছু লতাপাতা ছিঁড়ে এনে এর উপর ফেলে দিলো।
কাজ শেষ হতেই দৌড় দেয়া শুরু করলো সে। তবে প্রধানমন্ত্রীর ‘টু’ শব্দটা মনে গেঁথে গেছে তার। তাই যতক্ষণ পারলো ‘টু......... টু ............... টু’ করতে করতেই দৌড় দিলো সে।
(বি. দ্র. এটি সম্পূর্ণরূপে একটি রূপক লেখা। এখানে কোন ব্যক্তি, ধর্ম, দল, প্রতিষ্ঠান বা বিশ্বাসকে আঘাত করা হয় নি। )
‘আপনাকে জায়গা দিলে আমরা দাঁড়াবো কোথায়? দেখছেন না এখানে এক বিন্দু পরিমাণ জায়গা নেই?’
‘তাতে কি? আপনি একাই নিউজ কাভার করবেন আর আমরা বসে বসে আঙ্গুল চুষবো? এমনিতেই আমাদের অনেক দর্শককে আপনারা ভাগায় নিছেন।’
‘কি যা তা বলছেন!’
চ্যানেল ২৫ আর ময়না টিভির এই দুই সাংবাদিকের মধ্যে বাকবিতন্ডা দেখে এগিয়ে এলেন সিভিসি চ্যানেলের সিনিয়র সাংবাদিক। কোন মতে সামলালেন দুইজনকে। এর মধ্যে নিজের ছেড়ে আসা জায়গাটি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।
‘ও ভাই, আমার জায়গায় আপনি দাঁড়ালেন কেন?’
‘ক্যান? এই জায়গাকি আপনে কিন্না নিছেন? নাকি আপনার বাপে আপনার নামে উইল কইরা গ্যাছে?
বাপ তুলে কথা বলেছে শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেছে, কিন্তু কিছু করার নাই। নিজেকে সামলালেন এই সিনিয়র সাংবাদিক। সাংবাদিকতার ঠেলা কেমন সেটা শুধু সাংবাদিকরাই বুঝে। এর মধ্যে শ’খানেক কামড় খেতে হয়েছে মশার। আল্লাহ্র এই অপরূপ সৃষ্টিটির জন্য মসজিদে কিছু টাকা দান করবেন, ভাবলেন। আল্লাহ্র গুণগান করলেন, নাকি বিদ্রুপ, সেটা ঠিক বুঝা গেলো না। আগের জায়গা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে কোনমতে একটু চিপার মধ্যে নিজে দাঁড়ালেন। পিছনে দাঁড়ানো-না দাঁড়ানো অবস্থা ক্যামেরাম্যানের। যে কোনভাবেই হোক, একেবারে টাটকা এবং ক্লোজ নিউজ সংগ্রহ করতে হবে। চ্যানেলের স্ক্রলে অলরেডি ব্রেকিং নিউজ দেখানো হচ্ছে। মন্ত্রী পাইপের ভিতর পড়ে গেছেন বলে কথা! এ খবর নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও আগেভাগে কাভার করতে হবে।
‘এই ক্যামেরাম্যান।’
একজন আনাড়ি লোক ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরা টানতে টানতে বললো।
‘কি হয়েছে? ক্যামেরা ধরে টানাটানি করছেন কেন?’
‘আমারে একটু ভিডিও করবেন, স্যার? আমার খুব ইচ্ছা, আমারেও একদিন টিভিতে দেখাইবো। আমারে একটু ভিডিও করেন না, পিলিজ।’
কি উত্তর দেবেন, ক্যামেরাম্যান ভেবে পেলেন না। কিন্তু রাগ সামলাতে পারলেন না তিনি।
‘আপনেও একটা পাইপের ভিতর পড়েন। ভিডিও করে টিভিতে দেখাবো আপনারে।’
‘হাছা?’
‘হুম।’
‘খাঁড়ান, আপনি তাইলে দেইখা আহি, কোনখানে খোলা পাইপ আছে কিনা।’
‘শালা!’ নিজের মুখকে সামলাতে পারলেন না ক্যামেরাম্যান।
‘মামুন’, সিনিয়র সাংবাদিক লোকটা সামনে থেকে একটা হাঁক দিলেন।
‘জি ভাই।’
‘ক্যামেরা রেডি করো। টিভিতে কানেকশান দেয়া হয়েছে। লাইভ ফুটেজ যাবে এখন।’
সাংবাদিক নিজের পজিশনটা কোন মতে ঠিক করে নিলেন। এক্সিডেন্ট স্পট ঠিকমত আসতেছে না ক্যামেরাতে, মানুষের মাথাই বেশী দেখা যাচ্ছে মনিটরে। মোবাইলের ওপাশ থেকে অনবরত কথা আসতেছে, ‘হ্যালো, মুস্তুফা সুরুজ, আপনি কি আপনাকে শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো, হ্যালো। মুস্তুফা সুরুজ... হ্যালো হ্যালো।’
‘জি, ইথিলা সানজানা, আমি আপনাকে শুনতে পাচ্ছি।’
এই কথা শুনার পর পিছন দিক থেকে একজন ধাক্কা মারলো সাংবাদিককে, “ধুর মিয়া, আমরা কেউ শুনতে পাচ্ছি না, আর আপনি শুনতে পেলেন?’
‘বুঝলাম না’, সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। তাঁর চোখে মুখে প্রচণ্ড বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। কত কষ্ট করে স্টুডিওর সাথে সংযোগটা পেয়েছিলেন, এখন সেটাও আর পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু শোঁ শোঁ আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে স্টুডিওতে সিডর বয়ে যাচ্ছে।
‘হ্যালো, ইথিলা, ইথিলা, আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?’
নাহ। ইথিলাকে আর পাওয়া গেলো না। নিউজরুমে কি হচ্ছে সেটা আল্লাহ্ই জানে।
সাংবাদিক, উৎসুক সাধারণ জনতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যগণ এবং রাজনৈতিক নেতা-পাতি নেতায় ভরে গেছে পুরো এলাকা। কেউ কেউ দেখতে এসেছেন অনেকদূর থেকে। এরকম একটি ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়াটা কম কথা নয়। কেউ কেউ মোবাইলে ফটো আর ভিডিও নেবার জন্য রীতিমত লড়াই করছে। কে কাকে ডিঙিয়ে আগে ফটো নেবে, ভিডিও নেবে তার জন্য ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছে। আগে অডিও, ভিডিও, ফটো নিতে পারলেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ্সে আপলোড করতে পারবে।
কিছু সাংবাদিক তাদের মধ্যে কারও কারও সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।
‘কি ভাই, আপনারা কি করছেন?’
‘ওহ (মাথার চুল স্টাইল করতে করতে)! আমরা ভিরফি নিচ্ছি।’
‘মানে?’
‘হোয়াট মানে মানে?’ এক ছেলে এগিয়ে এসে পাল্টা প্রশ্ন করলো।
‘যান মিয়া, ভিরফি মানে বুঝেন না?’
‘না, ভাই। একটু বুঝায় বলবেন?’ এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন।
‘ওকে, ওকে, ভিরফি মানে হইল গিয়া ভিরফি।’
‘বুঝলাম না’, আরেকজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন।
‘ওহ নো! ভীরের মধ্যে পিক তুললে সেটাকে ভিরফি বলে। এইবার বুঝছেন? খালি ডিস্টার্ব করে।’
সাংবাদিকেরা উত্তর পেলেন বটে, কিন্তু চমকে গেলেন তার চেয়ে অনেক বেশী। একজন মন্ত্রী পাইপের মধ্যে পড়ে গেছেন, সেটা এদের জন্য খুব আনন্দের বিষয়!
কোন এক সাংবাদিক তাঁদেরকে ইশারা করছে দেখে তাঁরা স্থান ত্যাগ করলেন। লোকদের ঠেলে সেখানে যেয়ে জানতে পারলেন, একজন সিনিয়র মন্ত্রী সেখানে এসেছেন। এখন তাঁকে প্রোটোকল দেয়া হচ্ছে। তিনি সচক্ষে ঘটনাস্থল দেখার জন্য ছটফট করছেন। দেশের প্রযুক্তির উপর ভরসা করতে পারছেন না। বিদেশ থেকে রেস্কু টিম আসতেছে। তারপরেও দেশী প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন, সেনাবাহিনী ও বুয়েটের এক্সপার্ট টিমের সঙ্গে উদ্ধারকাজ করছে। কিছুক্ষণ আগেও নাকি পাইপের ভিতর থেকে মন্ত্রী মহোদয় ‘বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেছিলেন। কিন্তু এখন কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শব্দের প্রতিফলন পরীক্ষা করার জন্য কেউ কেউ ইট পাথর, যা পেয়েছে পাইপের ভিতর ছুঁড়েছে। প্রথম দিকে কিছু শব্দ আসলেও এখন আর কোন শব্দই মিলছে না। অথচ যত মানুষ জড়ো হয়ে গেছে সেখানে পাইপের অত গভীর থেকে চিৎকার বাইরে আসলেও তা কি আর বুঝার উপায় আছে? টিভিতে শব্দবিজ্ঞানীদের খোঁজে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। শব্দের গতি, ধরণ, এসব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ করে হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো।
‘সড়ে যান, সড়ে যান, মাননীয় বিমান মন্ত্রী পাইপের মুখ দেখবেন।’
বিমান মন্ত্রী পাইপের মুখ দেখবেন! উপস্থিত সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকেরা অবাক হলেন। উৎসুক কিছু সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, পাইপের মুখ দেখে আপনি কি ব্যবস্থা নেবেন?’
‘আমি বিমান সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছি। আকাশ থেকে পাইপে পতিত মন্ত্রীর অবস্থান নির্ণয় করতে। কিছুক্ষণের মধ্যে কাজ শুরু হবে। দেখুন, এটা সত্যি খুব দুঃখজনক ঘটনা। আমরা আমাদের সকল শক্তি প্রয়োগ করছি। আমাদের বিমান এইমাত্র কাজ শুরু করলো বলে। আপনারা সবাই দুয়া করেন। আল্লাহ-ভগবান-ঈশ্বরকে ডাকেন। মাওলানা তাকাব্বুল আল ফারমানিকে বয়ান দিতে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।’
পাশে উপস্থিত একজন আমলা বলে উঠলেন, ‘মাননীয় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এক হাজার চারশ বিশটা মহিষ কোরবানির ব্যবস্থা করেছেন।’
‘ও খুব ভালো। আমিও দুই হাজার আটশ আশিটা বিমান কোরবানি দিবো ইনশা আল্লাহ্।’
পাশে উপস্থিত পুলিশের একজন কর্মকর্তা বিমান মন্ত্রীর কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, বিমান তো কোরবানি দেয়া যায় না।’
‘ওহ তাই নাকি! মিডিয়া শুনেছে কিনা দেখুন তো,” বিমান মন্ত্রী চারপাশ খেয়াল করলেন, মনে মনে বললেন, ‘বিমানের কোরবানি অনেক আগেই তো দিয়া দিছি।’
হঠাৎ করে বিমান মন্ত্রীর ফোন বেজে উঠলো। তাঁর পিএস ফোন রিসিভ করলেন। তাঁর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো, “স্যার।’
মন্ত্রী ফোনটা নিয়ে কানে লাগালেন।
‘কি! কি বলছো এসব!’
সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘিরে ধরলেন।
‘কি হয়েছে, মাননীয় মন্ত্রী?’ উপস্থিত সাংবাদিক আর জনগণের কৌতূহলের শেষ নেই। হুড়াহুড়ি শুরু হয়ে গেলো।
কেউ কেউ মন্ত্রীর সামনে মাইক্রোফোন ধরতে পারলেন, কেউ কেউ পারলেন না। মন্ত্রীর পিএস হাত ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন যে মন্ত্রী এখন মিডিয়ার সামনে কথা বলবেন। মন্ত্রী গলা ঠিক করে নিলেন, ‘দেখুন খুব ঠাণ্ডা পড়ছে, এখন মিডিয়াতে কথা বলার সময় নয়। একজন মন্ত্রী পাইপের ভিতর পড়ে গেছেন। এখানকার উন্নয়ন কাজ দেখতে এসে তিনি নিজেই অবনতির দিকে চলে গেলেন, এটা সত্যিই খুব দুঃখজনক। আমরা তিনদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করবো। আপনারা কাল কালো ব্যাজ ধারণ করে রাস্তায় নেমে পড়বেন।’
পাইপের ভিতর পতিত মন্ত্রীকে উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে আর বিমান মন্ত্রী হঠাৎ জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করার কথা কেন বললেন, সেটা কারো মাথায় ঢুকলোনা। সাংবাদিকেরাও সেটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না। সবাই বিমানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলো বিমান দিয়ে পাইপের ভিতর পর্যবেক্ষণ করা হবে কিনা। বিমান মন্ত্রীর মুখ কালো হয়ে গেলো।
‘দেখুন, আমি তো নির্দেশ দিয়েছিলাম এরকম কিছু করার জন্য। কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। সকাল হবার সাথে সাথেই অ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে।’
বিমান মন্ত্রী কথা শেষ করতে না করতেই সেখানে আবার হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো।
‘সড়েন সড়েন, মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসছেন।’
সাংবাদিকেরা খুব চমকে গেলেন।
‘এখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রী এসে কী করবেন?’ প্রশ্ন করলেন এক সাংবাদিক।
‘সহকর্মীর বিপদে ঝাঁপিয়ে পরাইতো মহৎ সহকর্মীর কাজ।’ বললেন অন্য এক সাংবাদিক।
দুই মন্ত্রী একসাথে হলেন। বিমান মন্ত্রীকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী। বিমান মন্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রী কাঁদো কাঁদো চোখে বললেন, “আমাদের শিক্ষা মন্ত্রী, এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন আমি ভাবতেও পারিনি।’
এক সাংবাদিক স্বাস্থ্য মন্ত্রীর ভুল ঠিক করে দিলেন, “স্যার, উনি শিক্ষামন্ত্রী নন।’
‘তবে কি তুমি শিক্ষামন্ত্রী?’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী খুব ক্ষেপে গেছেন মনে হলো।
বিমান মন্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রীর কানে কানে বললেন, “ভাইজান, উনি আসলে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।’
‘কে, কে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? এই ব্যাটা সাংবাদিক?’
‘আরে না। যিনি পাইপের ভিতর পড়ে গেছেন, তিনি।’
‘ওহ দেখুন দেখি কাণ্ড! আমি তো শিক্ষা মন্ত্রীর কথা ভেবেই তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম।’
‘কেনো? বাসায় কী করছিলেন?’ বিমান মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনার ভাবিসহ ‘রাগে অনুরাগে’ সিরিয়াল দেখছিলাম।’
‘ইশ! আমি মিস করলাম। কি আর করা! মন্ত্রী হলে এরকম স্যাক্রিফাইস করতেই হয়। চলুন এখন ঘটনাস্থলে যাওয়া যাক।’
দুজন মন্ত্রী একসাথে ঘটনাস্থলের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। ভীর আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। বিমান মন্ত্রী খুব ক্ষেপে গেলেন।
‘এই পুলিশ করছেটা কী? পুলিশ কমিশনার কোথায়?’
উপস্থিত পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মন্ত্রীর কানের কাছে মুখ রেখে বললেন, ‘স্যার, উনার প্রচণ্ড সর্দি লেগেছে। উনি হাঁটতেই পারছেন না।’
মন্ত্রী আরোও রেগে গেলেন, ‘ওনাকে কালকেই ছটিকফড়িতে ট্র্যান্সফার করা হবে।’
‘স্যার ওটা ছটিকফরি নয়, ফটিকছড়ি,’ পুলিশ কর্মকর্তা মন্ত্রীর ভুল ধরিয়ে দিলে মন্ত্রী আরও রেগে যান।
‘আপনি আমাকে বানান শেখাবেন!’
‘সরি স্যার।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিমান মন্ত্রী শান্ত হলেন। দুজন আবার হাঁটা শুরু করলেন। সাংবাদিক আর জনগণ তাঁদের পিছু নিলো।
এক লোক এক ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরা টেনে ধরার চেষ্টা করছে। ক্যামেরাম্যান পিছনে তাকাতেই তাঁর দুচোখ ছানাবড়া অবস্থা।
‘এই তুমি! আবার আসছো?’
‘হ সার। আমি সেইসম থাইকা একটা খোলা পাইপ খুজতাছিলাম।’
‘তো পেয়েছো একটাও?’
‘পাইনাই। কিন্তু আমি নিজেই একটা পাইপের মুখ খুইলা ফালাইছি। সেই পাইপ এই পাইপের চাইতে বড়। আমি পড়লেও আমারে তুলোন যাইবো। আপনে আহেন, আমি অইহানে লাফ দেই, আপনে ভিডিও করেন। আহেন।’
‘এখন না। এখানকার কাজ শেষ হোক। এরপর শুধু তোমাকেই ভিডিও করবো।’
‘হাছা কইতাসেন, সার?’
‘হ্যাঁ রে বাবা।’
‘আইচ্ছা। তাইলে আমি আপনের পিছে পিছে থাকি?
‘ওকে। থাকো।’
কথা বলতে বলে এই ক্যামেরাম্যান পিছনে পড়ে গেছেন। সাংবাদিককে দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। ভীর বেড়েই চলেছে। আশে পাশের এলাকা, জেলা, উপজেলা থেকে লোকজন আশা শুরু করেছে। কেউ কেউ মাথার উপর, কাঁধের উপর করে ছোট ছোট বাচ্চাকে তুলে দেখানোর চেষ্টা করছেন।
মধ্যবয়স্ক এক লোক কাঁধের উপর বসিয়েছেন তাঁর ছেলেকে, ‘ঐ জিহাদ, কিছু দেখিবার পারছস?’
‘না আব্বা, খালি মানুষ দেখি। মন্ত্রীরে তো দেখিবার পারছি না। ও আব্বা। আব্বা।’
মাইকে ঘোষণা এলো। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসতেছেন। মেক-আপ নিতে যতটুকু টাইম লাগে, এই আর কি।
বিরোধীদলীয় কিছু নেতাও এসে গেছেন। এখানে আসার আগেই তাঁরা সপ্তাহব্যাপী হরতাল ঘোষণা করে এসেছেন। এ আন্দোলন দেশকে পাইপমুক্ত করার আন্দোলন। এ কর্মসূচি নিয়ে তাঁরা উপস্থিত সাংবাদিকগণের নিকট বিবৃতি দিচ্ছেন।
কিছু সময়ের জন্য উদ্ধারকার্য স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের নিরাপত্তার জন্য এটা করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানালেন ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা।
বিমান মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রী পাইপের কাছে চলে গেছেন। দুজন দুজনকে শক্ত করে ধরে আছেন। যেন ভুলেও তাঁরা পা পিছলে পাইপে না পড়ে যান। দুজনেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নাম ধরে ডাকলেন। সাড়া এলো না। দুজনই হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। মিডিয়াকে তাঁদের সামনে আসতে বলা হলো। এবার তাঁদের সাথে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলাগণ কান্না শুরু করলেন।
‘ভাইজান, আপনার চোখে কিন্তু কোন পানি দেখছি না’ স্বাস্থ্য মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বিমান মন্ত্রী বললেন।
‘টিভিতে সিরিয়াল দেখার সময় আপনার ভাবিসহ অনেকক্ষণ কেঁদেছি। তাই হয়তো...।’
‘ওহ! তাও, এখানে মিডিয়া আছে তো। চোখে পানি না থাকলে কেমন দেখায়? মুখটা একটু নিচু করেন তো।’
‘কেনো?’
‘একটু থুথু লাগায় দেই।’
‘হায় হায়! এইটা কী করেন?’
‘চুপ করেন। এখন চোখে পানি না থাকলে কাল মন্ত্রীত্ব খোয়াতে পারেন।’
‘আচ্ছা। তাইলে একটু বেশী করে দেন।’
এবার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ শুরু হয়ে গেলো। ক্রন্দনরত দুই সিনিয়র মন্ত্রীর অনেক ছবি নেয়া হলো। ভিডিও ক্যামেরা চলছে।
তাঁরা দুজন এখন পাইপের দিকে তাকাচ্ছেন। আর কাঁদছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রী পাইপের ভিতর কিছু ফ্রুট জুস আর জেলি ফেলে দিতে বললেন।
মন্ত্রীর নির্দেশমত ফ্রুট জুস আর জেলি নিয়ে আসা হলো। সেগুলো দুই মন্ত্রী একসাথে পাইপের ভিতর ফেলে দিলেন। বিমান মন্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো কিছু লোক হাত তালি দিলে দিতে শুরু করলে তিনি ক্ষেপে যান, ‘মিয়ারা এখানে কি আমরা কিছু উদ্বোধন করতে এসেছি?’
সবাই চুপ হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রী অনেকক্ষণ পাইপের ভিতরে তাকালেন। তাঁকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন বিমান মন্ত্রী। ইতিমধ্যে মাইকে ঘোষণা এলো যে সেখানে আরও একজন সিনিয়র মন্ত্রী আসছেন। হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে অর্থ মন্ত্রী এসে হাজির হলেন। তিনিও পাইপের মুখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। অন্য দুই মন্ত্রী এই কান্নায় শামিল হলেন। অর্থ মন্ত্রী উদ্ধারকার্য সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এতগুলো ঘণ্টা পার হবার পরও হতভাগ্য মন্ত্রীকে উদ্ধার করা যায় নি, এটা তাঁকে খুব ক্ষুব্ধ করলো।
‘যত্তসব রাবিশ! ইউ আর গুড ফর নাথিং। সিমপ্লি রাবিশ!’
তিনমন্ত্রী একটু আলাদা আলাপ করতে চাইলে চারপাশ ফাঁকা করা হলো। উপস্থিত লোকেরা সড়তে না চাইলে তাদের উপর লাঠিচার্জ, শেষে টিয়ার গ্যার ছুঁড়া হলো। মন্ত্রীত্রয় ঘণ্টা আধেকের মত আলাপ করলেন। তিনজন একসাথেই পাইপের কাছে এলেন। শুধু সাংবাদিকদের ডেকে আনা হলো। অর্থমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করলেন মিডিয়ার সামনে।
‘দেখুন। ইট’জ সিমপ্ল টু সে দ্যাট এতক্ষণ ধরে কাজ করেও যখন ভিক্টিমের সন্ধান মিললো না। তখন আই অ্যাম ড্যাম শিওর, এখানে মন্ত্রী পড়েন নাই। ইট ইজ কোয়াইট ক্লিয়ার। তোমরা খালি টাইম কিল করো। রাবিশ!’
‘তাও আমাদের উদ্ধারকাজ চলবে। ওখানে ব্যাঙ, টিকটিকি আটকা পড়ে থাকতে পারে। তাদেরকে উদ্ধার করতে হবে। আমাদের সরকার পরিবেশ বিপন্ন হতে দিতে পারে না’, বিমান মন্ত্রী কথা গুলো বললেন।
এরপর তিনমন্ত্রী মিলে আবার কিছুক্ষণ কানাকানি করলেন। মিনিট পাঁচেক পর স্বাস্থ্য মন্ত্রী নিজেই এক সাংবাদিকের হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিলেন।
‘দেখুন, ভাইয়েরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে ওনার শ্বশুরের বনিবনা হচ্ছিলো না কিছুদিন ধরে। আমরা মনে করি ওনার শ্বশুরই ওনাকে অপহরণ করিয়েছেন। আমরা কাল সকালেই চিরুনি অভিযান শুরু করবো। আমিও নিশ্চিত এই পাইপের ভিতর কেউ পড়েনি। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তো পড়তেই পারেন না। খুব শীঘ্রই ওনার শ্বশুরের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করা হবে। আর কদিন ধরে ওনার স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিলো না। আমি প্রায় ওনাকে সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে বলি। সুস্বাস্থ্য আমাদের জন্য খুবই দরকার। আমাদের সরকার সুস্বাস্থ্যের সরকার। ভাইয়েরা আমার, বোনেরা তোমার, আসুন আমরা বাংলাদেশকে স্বাস্থ্যবান করে গড়ে তুলি। আপনাদের যা যা আছে তাই নিয়ে স্বাস্থ্য গড়ে তুলুন। দরকার হলে আরও রক্ত দেবো, তাও বাংলাদেশকে মোটাতাজা করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ্।’
পাশে উপস্থিত স্বাস্থ্য মন্ত্রীর পিএস নিজে হাততালি দিলেন এবং অন্য সবাইকে হাততালি দিতে বলার সাথে সাথে বিমান মন্ত্রী তাঁর ডান গালে কষে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলেন। হতচকিত পিএস ‘ও মশা!’ ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রীর কাছ থেকে মাইক কেড়ে নিলেন বিমান মন্ত্রী।
‘আপনার মাথা ঠিক আছে তো? মানুষ মশকরা ভাববে।’
‘ওহ! আমি ভাবলাম, সবাইকে একটু স্বাস্থ্য সচেতন করি।’
‘এখন না, পরে। চলেন আমরা একটু দুয়া করি।’
‘দুয়া! কার জন্য, কিসের জন্য?’
‘পাইপের ভিতর পতিত মন্ত্রী মহোদয়ের জন্য।’
‘পাইপের ভিতর মন্ত্রী পরে গেছে নাকি?’
‘ওহ আল্লাহ্! তা না হলে এখানে এসেছেন কেনো?’
‘ওহ সরি, আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। আজ ঠিকমত খাওয়া হয়নি, তার উপর সিরিয়াল দেখার সময় অতিরিক্ত কেঁদে ফেলেছি। তাই এরকম হচ্ছে। আহারে! কোমলটাকে সবাই খালি ভুল বুঝে। ওর চোখের পানি দেখলেই আমার কান্না চলে আসে। আপনার ভাবি তো কাঁদতে কাঁদতে দুচোখ লাল করে ফেলেছে। আপনি কি ‘জি বাংলা’ নিয়মিত দেখেন নাকি পর্ব মিস করে ফেলেন?’
‘মাঝরাতে পুনঃপ্রচার দেখি। দুপুরেও দেখি কখনও কখনও।’
‘ওয়াও! আমিও দেখি। সচিবালয়ে আমার রুমে ৫২ ইঞ্চি সনি ব্রাভিয়া লাগিয়ে নিয়েছি। আপনার রুমে একটা লাগিয়ে নিতে পারেন।’
‘কিন্তু কিছু কিছু আইনজীবী ভারতীয় চ্যানেলের বিরুদ্ধে যেভাবে উঠে পরে লেগেছেন তাতে এই সিরিয়ালগুলো আর দেখা হবে কিনা সেটাই সন্দেহ।’
‘কিচ্ছু হবে না। আমি তথ্য মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি। উনি বলেছেন, এই চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার এদেশে বন্ধ করে দিলে ওনার স্ত্রী ওনার সঙ্গে ঘর করা বন্ধ করে দেবে।’
‘ওয়াও! হোয়াট এ ওয়াইফ হি হ্যাজ। আচ্ছা ওনার ওয়াইফকে একদিন দেখতে গেলে ক্যামন হয়?’
‘খুব ভালো হয়। উনি নাকি দেখতে রাশির মতো। যাই হোক ভারতীয় চ্যানেল, অ্যাট লিস্ট, জি বাংলা আর স্টার জলসা বন্ধ করা যাবেনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয়রা আমাদের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলো, ভারতীয় সিরিয়াল দেখে তার ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করা যাবে।’
‘ঠিক বলেছেন আপনি। কেনো যে অনেকেই এটা বুঝতে চান না, আই সিম্পলি ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড। রাবিশ!’ অর্থ মন্ত্রী পাশ থেকে সায় দিলেন।
মন্ত্রীত্রয়ের কথা শেষ না হতেই আবার হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। অর্থমন্ত্রী নিজেই জিজ্ঞেস করলেন সবাই এত হট্টগোল করছে কেনো। সিনিয়র একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে জানালেন যে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী এখানে এসে পৌঁছাবেন। উদ্ধারকার্য এখনও শুরু করা হয়নি। দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে উদ্ধারকার্য সহজ করার জন্য কিছু খাঁচা আবিস্কার করার জন্য। মন্ত্রী যদি পাইপে পড়েও থাকেন, তাঁকে তোলাটা যেন খুব সহজ হয়। যত সময় লাগুক, একটা ভালোমানের খাঁচা নির্মাণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একজন মন্ত্রী যেনো তেনো খাঁচায় উঠতে পারেন না। প্রেস্টিজ ম্যাটারস।
মন্ত্রীত্রয়কে একটা নিরাপদ স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। পুলিশ সদস্যরা লাঠি পেঠা করে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিলো। পাশের একটি বহুতল ভবনের ছাঁদে মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁরা সেখানে কাঁদছেন। মাইকের মাধ্যমে সে কান্না সবাইকে শুনানোর ব্যবস্থা করা হলো। মন্ত্রী মহোদয়ের স্ত্রী আসেন নি। সব কটা সিরিয়াল শেষ হবার পরপরই তিনি চলে আসবেন বলে, মাইকে অনেকবার জানানো হয়েছে।
‘সড়ে দাঁড়ান সড়ে দাঁড়ান।’
দৌড়ে দৌড়ে সেখান কয়েকটা বিদেশী কুকুর চলে এলো। স্কটিশ ডগ ইয়ার্ডের সদস্য এরা। পুরো এলাকাটা নাক দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখলো। উপস্থিত জনগণ, সাংবাদিক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা কিছুটা অবাক হলো। মন্ত্রী পড়ে আছেন পাইপের ভিতর আর কুকুর দিয়ে পুরো এলাকা পরীক্ষা কেনো করা হচ্ছে, সেটা তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। মাইকে জানানো হলো, প্রধানমন্ত্রী আসছেন। তাঁর জন্য নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। উপস্থিত সবাইকে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। উপস্থিত মন্ত্রী তিনজন নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে যেন আলোচনা করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর আসার শব্দ শুনা গেলো।
পাশের ভবন থেকে আসা কান্নার আওয়াজ বন্ধ হলো। প্রধানমন্ত্রী গাড়ি থেকে নামার আগেই পুলিশ সদস্যগণ এবং প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষীরা নেমে পড়লেন। বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর আরও কিছু সদস্য প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির পাশে দাঁড়ালেন। আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশবাহিনীর কিছু সদস্য প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রথমদিকে কিছুটা ইতঃস্তত করলেও পরে সবার অনুরোধের মুখে গার্ড অব অনার নিলেন। চারদিক থেকে দলের সমর্থকেরা দলীয় স্লোগান দিতে শুরু করলেন। প্রধানমন্ত্রী হাসিমুখে তাদের দিকে হাত নাড়লেন। হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর চোখ পড়লো বাবার মাথার উপর বসা একটি ছেলের উপর। প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিএসকে দিয়ে লোকটিকে ডেকে পাঠালেন। লোকটা ভয়ে ভয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চলে এলো।
‘ম্যাডাম, আমাকে মাফ করে দেন। আমি কিছু করি নাই।’ লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বলে।
প্রধানমন্ত্রী লোকটার কথায় কান না দিয়ে ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
‘তোমার নাম কী, বাবু?’
‘জিহাদ।’
‘খুব ভালো। কী দেখতে এসেছো?’
‘পাইপ দেখতে।’
‘ওলে বাবা! দেখো। তুমি কিন্তু পাইপের ধারে কাছে কোনো দিন যেয়ো না। ঠিক আছে?’
‘আইচ্ছা।’
এরপর প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাথে থাকা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের নিয়ে সামনের দিকে এগোলেন। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মন্ত্রী তিনজনকেও ডাকা হলো। পাইপটা কত দূরে, প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন। একশ মিটারের মত হবে, একজন বলল। আরেকজন বলল, পঞ্চাশ মিটারের বেশী হবে না। সঠিক দূরত্ব কত হবে, এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেলো। প্রধানমন্ত্রী বেশ খানিকটা বিরক্ত হলেন। তাঁর সাথে আসা ভূমিমন্ত্রী আমিন ডেকে আনতে বললেন। মন্ত্রীর এপিএস ভূমি অফিসের এক আমিনকে ফোন করলেন। তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম আগমন। সংস্কৃতিমন্ত্রী এই মুহূর্তকে স্মরণীয় করতে চান। তিনি মাইকে ঘোষণা করলেন এখন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে সমবেতভাবে। যেমন কথা, তেমন কাজ। সুর-তাল-লয় ঠিক রাখার জন্য একজন সঙ্গীতশিল্পী দরকার। এখন তো তেমন কেউ নেই এখানে। মাইকে ঘোষণা দেয়া হলো জাতীয় সঙ্গীতের উপর ভালো দখল আছে এরকম কোন ব্যক্তি আশে পাশে উপস্থিত আছেন কিনা। মোটা করে এক মহিলা দৌড়ে চলে এলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাঁকে তাঁর পরিচয় মাইকে বলে দিতে বললেন। মহিলা যেন মাইকের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন।
‘আস সালাই মালাই কুম, আমি কুমকুম মুঙ্গেস্কার। জন্মের পর থেকে আমি গান করি। আমার আব্বা ছিলো গ্রামের বড় গাতক। আব্বা খুব ভালো আযান দিতো। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর...।’
প্রধানমন্ত্রীর দুচোখ রাগে ফেঁপে ফুলে উঠছে যেন। এটা খেয়াল করে আমলা টাইপের একজন মহিলাকে থামিয়ে দিলেন।
‘এই মহিলা, আপনাকে এখানে আযান দেবার জন্য আনা হয়েছে নাকি?’
‘তাইলে?’
‘তুমি জাতীয় সঙ্গীত জানো না?’
‘জানি তো।’
‘তাইলে সেইটাই গাও। আর তোমার নামে মুঙ্গেস্কার কেনো?
‘আইচ্ছা। আমি লতা মুঙ্গেস্কার হইতে চাইছিলাম। ওনার গান আমার খুব ভালো লাগে। ওনার নামের সাথে মিল রাইখা আমি আমার নাম রাখছি।’
‘এ মহিলা দেখি, নিজের আকিকা নিজেই করেছে। যতোসব!’ উপস্থিত একজন সাংবাদিক বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তবে সেটা কেউ খেয়াল করলো বলে মনে হয় না।
প্রধানমন্ত্রীর পাশে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা মহিলাকে জাতীয় সঙ্গীত ধরতে বললেন। মহিলা শুরু করে দিলেন। সবাই সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন। শুরু হলো জাতীয় সঙ্গীত।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
জাতীয় সঙ্গীত বেশিদূর এগুলো না। বুড়ো মতো একজন লোক একের পর এক কাঁশি শুরু করলো। সাথে হাঁচিও। দুইজন পুলিশ লোকটিকে ধরে ফেললো। একজন মন্ত্রী এ বুড়ো লোকটাকে বিরোধী দলের কোন দুষ্কৃতি মনে করে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর মামলা করতে বললেন। লোকটিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো।
জাতীয় সঙ্গীত আর হলো না। প্রধানমন্ত্রী এবার আর দেরী না করে ঘটনাস্থলের কাছে যেতে চাইলেন। তাঁর কথামতো কাজ শুরু হলো। আবার লাঠিপেটা করে সাধারণ জনতাকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ এবং উপস্থিত কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের সাথে নিয়ে পাইপের কাছে গেলেন। যে আমিনকে ডেকে পাঠানো হয়েছিলো। সে এসেছে। তাঁকে এখানে আসতে দেয়া হলো না।
সবাই সারিবদ্ধ হয়ে পাইপের কাছাকাছি দাঁড়ালেন। তবে পাইপের মুখের কাছে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা গেলেন না। তাঁদের জীবনের মূল্য অনেক। এভাবে ঝুঁকি নেয়া উচিত হবে না। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে চুপ থাকতে বললেন। তিনি গুটি গুটি পায়ে আর একটু এগুলেন। পাইপের ভিতরে পরে যাওয়া মন্ত্রী কোন সাড়া দেয় কিনা সেটা দেখার জন্য তিনি একটু গলা বাড়িয়ে মন্ত্রীকে ডাকা শুরু করলেন।
‘ও মন্ত্রী সাহেব, হ্যালো।’
কোন রকম সাড়া এলো না। প্রধান মন্ত্রী আর একটু কাছাকাছি চলে গেলেন।
‘হ্যালো, রেল মন্ত্রী, আপনি কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছেন?’
রেল মন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রীদের সাথেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখান থেকেই সাড়া দিলেন।
‘হ্যাঁ ম্যাডাম, আমি আফনাকে শুনতে ফাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রীর আনন্দ যেন উপছে পড়ছে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে সবাইকে বললেন, ‘দেখেছেন, দেখেছেন, রেল মন্ত্রী পাইপের ভিতর থেকে আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন।’
‘আমি তো এইখানে, ম্যাডাম। আমি তো এইখানে। আমি ফাইফের ভিতর না তো।’ রেল মন্ত্রী অবাক হয়ে কথা গুলো বললেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ডাকলেন কেনো, তিনি বুঝতে পারলেন না। অবাক দৃষ্টিতে অন্যান্য মন্ত্রীদের দিকে তাকালেন। সবার অবস্থা এক।
রেল মন্ত্রীকে দেখে প্রধানমন্ত্রীর আনন্দ আরও বেড়ে গেলো।
‘আপনি পাইপের ভিতর থেকে উঠে এসেছেন। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ্। আর এরকম করবেন না। এভাবে পাইপের ভিতর লুকিয়ে থেকে আমাদের টেনশন দেবেন না। জাতি এটা আপনার কাছ থেকে আশা করে না।’
সংস্কৃতি মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর ভুল ধরিয়ে দিলেন।
‘ম্যাডাম। যিনি পাইপের ভিতর পড়ে গেছেন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, রেল মন্ত্রী নন।’
‘বলেন কী! আপনারা কখনও আমাকে সঠিক তথ্য দিতে পারেন না। যত্তসব! আচ্ছা আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যেন কে?’
সংস্কৃতি মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর শারীরিক বর্ণনা দিলে প্রধানমন্ত্রী হাসতে শুরু করেন।
‘আরে, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তো সেই ছোট বেলা থেকে লুকোচুরি খেলার অভ্যাস। উনি নাকি এখনও ওনার স্ত্রী সন্তানদের সাথে লুকোচুরি খেলেন। খুব বেশী বার ‘টু’ না বললে উনি নাকি সাড়া দেন না। আপনারা আগে যদি বলতেন যে উনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, আমি তাহলে ‘হ্যালো’ না বলে ‘টু, টু’ বলতাম।
প্রধানমন্ত্রী আবার পাইপের কাছে গেলেন। এবার আরও একটু কাছে। তাঁর বাম হাত ধরে টেনে রেখেছেন সরকারের একজন মহিলা মন্ত্রী। তাঁর হাত ধরে রেখেছেন আর একজন মন্ত্রী।
‘এই আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখেন। আমি যেন পাইপের ভিতর পড়ে না যাই।’
‘আচ্ছা ম্যাডাম,’ মহিলা মন্ত্রী বললেন। তিনি শরীরের সব শক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাম হাত চেপে ধরেছেন।
‘উউউউফ! লাগে তো,’ প্রধানমন্ত্রী বললেন।
‘শক্ত করে ধরলে একটু লাগবেই তো ম্যাডাম।’
মহিলা মন্ত্রীর বাম হাত ধরেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই। মাঝে মাঝে একটু সুড়সুড়ি দিচ্ছেন তিনি।
‘এই আপনে এটা কী করছেন? সুড়সুড়ি দিচ্ছেন কেন?’ মহিলা মন্ত্রী রেগে গেলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপর।
প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন মহিলা মন্ত্রী তাঁকেই বলেছেন এই কথা। তিনি ক্ষেপে গেলেন একটু।
‘আমি আপনাকে সুড়সুড়ি দিতে যাবো কেন?’
‘না ম্যাডাম, আপনাকে বলিনি।’
‘তাহলে?’
‘স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে বলেছি।’
‘ওহ, আচ্ছা, এর বিচার পরে হবে। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে এখন ‘টু’ বলি?’
‘জী ম্যাডাম, বলেন।’
‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, আপনি পাইপে লুকিয়েছেন। আমি দেখতে পাচ্ছি, বুঝতে পাচ্ছি। আমাদের সাথেও লুকোচুরি খেলেন? টু............ টু............টু।’
কোন সাড়া এলো না। প্রধানমন্ত্রী অন্য সবার দিকে তাকালেন। তারপর আবার বললেন, ‘টু............ টু............... টু।’
তাও কোন সাড়া এলো না। প্রধানমন্ত্রী একটু রেগে গেলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর উপর। ‘স্ত্রী সন্তানেরা একটু টু বললেই আপনি ধরে ফেলেন, আর আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না? আপনার মন্ত্রিত্ব আজকেই শেষ’, নিজে নিজে বললেন তিনি।
‘উনি তো কোন সাড়া দিচ্ছেনই না,’ অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।
‘ম্যাডাম, ঠাণ্ডা পড়ছে তো, তাই হয়তো উনি গুটিসুটি মেরে বসে আছেন পাইপের ভিতর,’ বিমান মন্ত্রী বললেন।
‘তাহলে কী করা যায়, বলুন তো?’ প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
‘একটু গরম পানি ঢেলে দেয়া হোক।’
‘গরম পানি! গা পুড়ে যাবে তো,’ স্বাস্থ্য মন্ত্রী বললেন।
‘গরম পানি ঢাললে পাইপের ভিতর থেকে মন্ত্রী চিৎকার করে উঠবেন।’
প্রধানমন্ত্রী মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। কথা মতো কাজ হলো। পাইপের ভিতর এক বালতি গরম পানি ঢেলে দেয়া হলো, কিন্তু কোন কাজই হলো না। সাড়া এলো না এবারও।
রেগে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাইপের কাছে গিয়ে আবার বললেন, ‘খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। আপনি সাড়া দেবেন নাকি পুলিশ ডাকবো?’
প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে থাকা মহিলা মন্ত্রী বললেন, ‘ম্যাডাম, পুলিশ তো এখানেই আছে। আপনি পুলিশ ডেকে কী করবেন?’
‘ঐ ভয় দেখাচ্ছি আর কী।’
‘ওহ।’
রেল মন্ত্রী এগিয়ে এলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলেন।
‘ম্যাডাম, আমি বলি কি সবাই মিলে মাইকে ‘টু... টু’ বললে ক্যামন হয়?’
‘ওমা! খুব ভালো বুদ্ধি তো। ইদানিং মনে হচ্ছে আপনার বুদ্ধি অনেক খুলে গেছে।’
রেল মন্ত্রী মুচকি হেসে বললেন, ‘লজ্জা ফাচ্ছি, ম্যাডাম।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতো উপস্থিত সবাইকে ‘টু’ বলতে বলা হলো। মাইকের ব্যবস্থা করা হলো। সবাই ‘টু’ বলা শুরু করলো। মনে হচ্ছে, আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। ‘টু... টূ... টু’ শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে উঠছে যেন। প্রায় দশ মিনিট ধরে চলতে থাকলো। এতেও কাজ হলো না। এত বিশাল শব্দের মধ্যে পাইপের ভিতর থেকে মন্ত্রী সাড়া দিলেন কিনা, সেটা কিভাবে বুঝা যাবে এটাও কেউ খেয়াল করলো না। পদ্ধতি পাল্টানো হলো। এবার ‘টু’ এর পরিবর্তে কান্নার ব্যবস্থা করা হলো। সবাই কান্না শুরু করলো। খবর পাওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রীর স্ত্রী এখনও আসলেনই না। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে কান্না চললো। লাভ হলোনা। বিমান মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে এলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কানে কানে কী যেন বললেন। প্রধানমন্ত্রী পাইপের কাছ থেকে সড়ে এলেন। সব মন্ত্রীকে একসাথে করলেন। মাইকে ঘোষণা দেয়া হলো, পাইপের ভিতর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পড়েন নি। তাঁর স্ত্রী তাঁকে অপহরণ করেছেন।
সাংবাদিকেরা বললেন, ‘আগে তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে ওনার শ্বশুর ওনাকে অপহরণ করেছেন। আর এখন বলছেন, ওনার স্ত্রী!’
অর্থ মন্ত্রী একটু রেগে গেলেন, ‘প্রাইম মিনিস্টার যা বলবেন সেটাই ফুল অ্যান্ড ফাইনাল। হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দিস সিম্পল ম্যাটার? রাবিশ!’
প্রধানমন্ত্রীকে মাইক দেয়া হলো, ‘দেখুন, এটা সত্যিই দুঃখজনক, আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে অপহরণ করা হয়েছে। পুলিশ তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আমি এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির নির্দেশ দিলাম। বাংলাদেশের সব পাইপের উচ্চতা কোন মন্ত্রীর উচ্চতার চেয়ে বেশী করা যাবে না। আর সব পাইপের মুখ আজকেই বন্ধ করে দিতে হবে। কেউ যদি কোন পাইপের মুখ খুলে রাখে তাঁকে সর্বোচ্চ্য শাস্তি দেয়া হবে। আমি এই পাইপের মুখ বন্ধ করে দিয়েই আমার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করছি।’
প্রধানমন্ত্রী এখন ঐ পাইপের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছেন। পাইপ মিস্ত্রীকে ডেকে আনা হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্য করছেন। সেই দৃশ্য প্রত্যেক টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করছে।
এক ক্যামেরাম্যান এর মধ্যে ‘এই কে রে’ বলে উঠেন। পিছন ফিরে দেখেন সেই লোকটা।
‘এই তুমি আবার! স্যার, আমারে ভিডিও করবেন না?’
‘ভিডিও! তুমি এখনই গিয়ে ঐ পাইপের মুখ বন্ধ করে আসো। শুনলে না প্রধানমন্ত্রী কী বললেন? এখনি যাও। পাইপের মুখ বন্ধ করে আসো, নাইলে তোমার খবর আছে!’
ভয় পেয়ে লোকটা দৌড় দিলো। কিন্তু পাইপের অবস্থান সে ভুলে গেছে। এতো লোকের ভীরে তার মাথা কাজ না করারই কথা। তারপরেও সে পাইপটা খুঁজেই চলছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী পাইপের মুখ বন্ধ করে ফেলেছেন। এখন সবাই যার যার বাসা ফিরে যাবেন। প্রধানমন্ত্রী ভয়ে ভয়ে মাটিতে পা ফেলছেন যেন।
‘ম্যাডাম, কোন সমস্যা?’
‘হুম। এখানে আরও কোন মুখখোলা পাইপ আছে কিনা, এই ভয়টা পাচ্ছি একটু।’
‘তাহলে ম্যাডাম, চলুন, ঐ দিক দিয়ে ঘুরে যাই। আমারও একটু একটু ভয় লাগছে,’ মহিলা মন্ত্রী বললেন। প্রধানমন্ত্রীর হাত তখনও তাঁর হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মাথা নেড়ে সায় দিলেন। অন্যসবাইকে আগের পথ দিয়েই যেয়ে তাঁদের গাড়িতে উঠতে বলা হলো। প্রধানমন্ত্রী আর অন্যান্য মন্ত্রীরা একটু ঘুরে অন্য পথ দিয়ে যাচ্ছেন। আলো আঁধারের মিশ্রণ আছে পথটাতে। লাইটের ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয়। প্রধানমন্ত্রী গুটি গুটি পায়ে হাঁটছেন। সবাই যেন এলাকাটা ছেড়ে গেলেই বেঁচে যান, এভাবে হাঁটছেন। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেন না। একটা সময় মহিলা মন্ত্রীর হাত থেকে প্রধানমন্ত্রীর হাত বের হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী পিছিয়ে পড়লেন। ভয় যেনো তাঁকে আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরছে। কিছুদুর এগিয়ে সবাই প্রধানমন্ত্রীর খোঁজ করছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোথায়? সব মন্ত্রীই আছেন, প্রধানমন্ত্রী নেই। সবাই একটু সামনেই গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বলে কথা! তিনি হয়তো আগেভাগে গিয়ে গাড়িতে বসেছেন।
লোকটা এখনও পাইপ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীরা যাচ্ছিলেন বলে সে এই দিকে সে আসতে পারেনি এতক্ষণ। একটু এগুতেই সে পাইপটা খুঁজে পেলো। হঠাৎ করে পাইপের ভিতর থেকে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ শব্দ আসছে বলে মনে হলো। কিন্তু সেটা পাত্তা দেয়ার সময় নেই তার। পাইপের মুখ যদি খোলা থাকে, আর ক্যামেরাম্যান যদি সবাইকে বলে দেয় যে সে এই কাজ করেছে তাহলে নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে তাকে। সাংবাদিকেরা খুব ভয়ানক। তার পরিচয় খুঁজে বের করতে তাঁদের একটুও সময় লাগবে না। লোকটার সারা শরীরে যেন পৃথিবীর সব ভয় এসে ভর করেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে ঢাকনা দিয়ে পাইপের মুখটা বন্ধ করে দিলো। কিছু মাটি এনে ঢেকে দিলো ঢাকনাটা যেন কেউ বুঝতেও না পারে যে এই পাইপের ঢাকনা খোলা হয়েছিল। কিছু লতাপাতা ছিঁড়ে এনে এর উপর ফেলে দিলো।
কাজ শেষ হতেই দৌড় দেয়া শুরু করলো সে। তবে প্রধানমন্ত্রীর ‘টু’ শব্দটা মনে গেঁথে গেছে তার। তাই যতক্ষণ পারলো ‘টু......... টু ............... টু’ করতে করতেই দৌড় দিলো সে।
(বি. দ্র. এটি সম্পূর্ণরূপে একটি রূপক লেখা। এখানে কোন ব্যক্তি, ধর্ম, দল, প্রতিষ্ঠান বা বিশ্বাসকে আঘাত করা হয় নি। )
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
বাবুল বাদশা ০৮/১২/২০১৬খুবই ভাল
-
সহিদুল হক ০৪/১২/২০১৬বেশ।