নর্তকী
এফডিসির ৪ নম্বর ফ্লোর। জাজ ফিল্মসের নতুন ছবি ‘নর্তকী’র শুটিং চলছে। পরিচালক খলিল ভাই ডিরেকশান দিচ্ছেন। তাঁর বড় ছেলে খোরশেদ চেয়ারে বসে দেখছেন। আমি বসেছি খোরশেদের পাশের চেয়ারে। খোরশেদ খলিল ভাইয়ের প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করছে। খলিল ভাই সরে গেলে খোরশেদ ক্যামেরায় চোখ রাখছে। ফাইনাল টেক নেয়ার দায়িত্ব তার নয়। সেটা নৃত্য পরিচালকের দায়িত্ব। ঢালিউডি ছবির আবশ্যক অঙ্গ হিসেবে ‘নাচ-গান’ দৃশ্যগ্রহণ চলছে। প্রায় পঁচিশ-তিরিশ জন নর্তকীর তালে তালে নৃত্য। তাদের সামনে নায়িকা নাচছেন। নায়ক সামনে বসে নায়িকার নাচ উপভোগ করছেন, হাততালি দিচ্ছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে গীত-বাদ্য চলছে। লুপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মহড়ার পর মহড়া এবং নৃত্য পরিচালক মনতাজ আলীর মন মতন হলে ‘টেক’ নেয়া হচ্ছে। নৃত্য পরিচালক বাধ্য হয়েই ‘টেক’ বলছেন কিনা বোঝা গেলো না। ব্যাকগ্রাউন্ড গানের সাথে নাচের পুরোপুরি মিল পেলাম না। নর্তকীগুলোর তলপেটের অতিরিক্ত চর্বি আমার চোখে ভালো ঠেকলো না। নায়িকার শরীরেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাংস। একটু বেশি লাফালাফি করে কোনোমতে মানিয়ে নিলেন নিজেকে। প্রথম শিফটের শুটিং শেষ হলে ক্যান্টিনে খেতে গেলাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করছিলো। খলিল ভাই অবশ্য আমাকে তাঁর সাথে সাথেই থাকতে বলেছিলেন। চলচ্চিত্রে কয়েক বছর ধরে কাজ করছি। স্টুডিওভিত্তিক কাজ ছিলো সেগুলো। সম্পাদনার কাজও করেছি। সহকারী পরিচালকের কাজ করেছি। অতিরিক্ত সহকারী। ভবিষ্যতে পরিচালকের কাজ করবো শুনে খলিল ভাই প্রথমেই বলেছিলেন, ‘এখানে আগে দেখতে হয়, দেখে দেখে শিখতে হয়। প্রচন্ড ধৈর্যের কাজ। তুমি পারবে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খলিল ভাই। আমি পারবো। আমি এ পর্যন্ত যা করেছি তা দেখে দেখেই শিখেছি। হাত ধরে ধরে কেউ শেখায়নি আমাকে। আমি পারবো।’
ক্যান্টিনে খাওয়া সেরে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কক্ষে গিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমিয়েছি। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখি প্রায় দুটা বেজে গেছে। সর্বনাশ! সহকারী শিল্পীদের সেটে হাজির করবার দায়িত্ব আমার। ওরা সময় মতো চলে না এলে তো খলিল ভাইয়ের কথা শুনতে হবে। খলিল ভাই খুবই পাংকচুয়াল মানুষ। সময় ধরে ধরে কাজ করেন বলেই আজ বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পরিচালক তিনি। খোদ হলিউড থেকে ডাক পরেছে ওনার জন্য। জেমস ক্যামেরন, রিডলি স্কট, রব মার্শেলের মতো জগত বিখ্যাত হলিউডি পরিচালকেরা খলিল ভাইকে তাঁদের সাথে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খলিল ভাই রাজি হননি। খলিল ভাই একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। দেশের চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করে করে চুলে পাক ধরিয়েছেন। এই এফডিসিতেই যেনো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সেটাই প্রায়ই বলেন আমাদেরকে। এই রকম একজন মানুষের সাথে কাজ করতে পেরে আমি সত্যি গর্বিত। সেটে খলিল ভাই চলে আসার আগেই আমাকে শিল্পীদের সেখানে হাজির করাতে হবে। আমি দ্রুতগতিতে ৭ নম্বর ফ্লোরে চলে গেলাম। পরের শুটিং ৭ নম্বর ফ্লোরেই হবে। ফ্লোরে সেট সাজানো হয়েছে। শিডিউলের শিল্পীরা সবাই চলে এসেছেন। আমি লিস্ট থেকে নাম ধরে ধরে নিশ্চিত হলাম। আমার বারোটা বাজলো না। ঘড়িতে দুইটা বাজলো।
সেকেন্ড শিফটের শুটিং শুরু হতে যাচ্ছে। দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত একটানা শুটিং চলবে। দু’টি ‘টেক’ হতে বিকেল চারটা সাড়ে চারটা বেজে গেল। উঠি উঠি করছি। সায়েম জামান এসে হাজির। ভদ্রলোক বেশ স্মার্ট। সব স্তরেই চেনাজানা। যে কোনও স্টুডিও চত্বরে, এফডিসিতে বেশ মিশুক ও মজাদার বলে সবখানেই তিনি পাত পান। বয়স আন্দাজে তিরিশ থেকে পঞ্চাশের যে কোনও জায়গায় হতে পারে। গোঁফ-দাড়ি নিখুঁত কামানো। চুলে কলপ করা। হয়তো কয়েকটা চুলে পাক ধরেছে। সেটাও ঢেকে রাখার চেষ্টা ভালোই করেছেন। কাছে বসলে বেশ ফুরফুরে আতরের গন্ধ। সব মিলিয়ে মিশিয়ে বোঝা কষ্টকর নয় যে মানুষটি বেশ শৌখিন। চাকরি করেন না। প্রেস-ট্রাস্ট ইত্যাদির সূত্রে ও বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার। পকেটে প্রেসকার্ড রয়েছে, তা ছাড়পত্র। দুই কাঁধে ঝোলানো দামি ক্যামেরা দু-তিনটি। স্টিল ফটোগ্রাফার। স্বাধীন ফটোগ্রাফার তিনি। রসিক মানুষ। ৭ নম্বর ফ্লোরে ঢুকে হন্তদন্তভাবে বসেই গম্ভীর মুখে নৃত্য পরিচালককে উদ্দেশ্য করে সামনের দিকে চোখ পেতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত করে?’
নতর্কীদের ভীরের দিকেই চোখ রেখে ফের কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মনতাজ হেসে জবাব দিলেন, ‘কোনটা?’
বুঝতে পারলাম, ওনারা কিছুটা অশালীন রসিকতা করছেন। চুপ করে সেটার রস গ্রহণের চেষ্টা করলাম।
সায়েমের চটজলদি জবাব, ‘ওয়ান অফ দোজ! অ্যানি ওয়ান অফ দোজ?’
মনতাজ আলী হাসতে হাসতেই বললেন, “তুমি যাও। নিজেই জিজ্ঞেস করো কে তোমার সাথে যেতে চায়। হাহাহা...’
মনতাজ আলী পান খান নিয়মিত। হাসির জোরে কিছুটা পানের পিক টিশার্টের উপর গিয়ে পড়লো।
মনতাজ আলীর সায় পাবার সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ বগলের একটি ক্যামেরা বাগিয়ে সায়েম চললেন নর্তকীদের দিকে।
মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ফটোগ্রাফি ইন্সটিটিউট ‘শারি একাডেমী’র ছাত্র ছিলেন তিনি। শিক্ষা-সংস্কৃতির কোনও চিহ্ন নেই এমন কথা যেমন বলা যাবে না, ঠিক তেমনই, একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা বলা যাবে তাও নয়। লোকটাকে দেখে একজন মিশ্র প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে অনেকটা এদেশের সাধারণ ছাত্রদের মতো। মধ্য বয়সি একজন বাংলাদেশী যুবক হলে যেমন হওয়া উচিত, সায়েম জামানও যেনো তাই। সমাজ-সংস্কার টনটনে। অথচ ‘কৌতূহল’ পুরো মাত্রায়।
দুটি ‘টেক’-এর পর শুটিং থামিয়ে রিহার্সাল চলছে। মুভি ক্যামেরা বন্ধ। আমারও হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন সায়েম সাহেব। তিন সারিতে দশ জন করে মেয়ে। সবার বয়স ২০-২৫ এর মধ্যে হবে। সাজ-পোশাক, যেটুকু না পরলে সেন্সর আটকাবে, সেটুকু তো পরতেই হয়। তাও সব ঝলমলে। চোখ ধাঁধানো কাচুলি টাইপ বক্ষঃবন্ধনী। নিম্নাঙ্গে হাফ প্যান্ট জাতীয় আবরণ। হাঁটুর কাছাকাছি পর্যন্ত। প্যান্টগুলো মেয়েগুলোর কোমরের চামড়া কামড়ে রয়েছে যেনো। তলপেটে চর্বি বেশি থাকায় নাভি যেনো শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
শেষের দিকে তৃতীয় সারির কোণের দিকে তিন-চার জন যারা মুদ্রা প্র্যাক্টিস করছে, সায়েম তাদের দিকে ক্যামেরা বাগালেন, তাক করে ‘ক্লিক’ করলেন। নর্তকীগুলোও কাঁধ, কোমর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পোজ দিচ্ছে। কেউ কেউ অবনত বুকগুলোকে ইচ্ছে করেই একটু বেশি উন্নত করার চেষ্টা করছে। সায়েম সাহেব বেশ মজা পাচ্ছেন, মনে হলো। যাদের ফটো তোলা হলো তারা মুচকি হেসে ইশারায় জানালো ফটোর ‘কপি’ চাই তাদের। হাত উঠিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তাদের আশ্বাস দিলেন সায়েম জামান। হাসি মুখে বললেন, ‘পাবে, পাবে।’ তার পর আমাকে দেখিয়ে মুখে হাতের আড়াল দিয়ে চাপা কণ্ঠে জানালেন, ‘পরিচালক সাহেব, কেমন দেখলেন?’ আমি হাসি সামলাতে পারলাম না। খলিল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এখনও প্রধান সহকারীই হতে পারলাম না, আপনি আমাকে পরিচালক বলছেন!’
আমার কাঁধে হাত রেখে সায়েম বললেন, ‘ওই হলো, পরিচালকই তো। আর হবেন হবেন, খুব তাড়াতাড়ি পরিচালকই হয়ে যাবেন। কিপ পেশেন্স।’
আমি তাড়াতাড়ি সরে এলাম ওখান থেকে। ফিল্মে কাজ করলেও ফিল্মের এই নর্তকীদের থেকে আমি একটু দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি। এরা সুবিধা পেতে চায়। নায়িকার পেছনে নেচে নেচে একটা সময় নায়িকা হবার জন্য পাগল হয়ে যায়। শুনেছি, পরিচালক-প্রযোজকদেরকে একান্ত সঙ্গ দিতেও এদের কোনো দ্বিধা হয় না।
আমাকে তাড়াতাড়ি করে ওখান থেকে সরে আসতে দেখে সায়েম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার পরিচালক সাহেব, পালিয়ে এলেন কেনো?’
আমি কথা বাড়ালাম না, শুধু বললাম, ‘আমি একটু ইন্ট্রোভার্ট।’
‘কী যে বলেন, সাহেব, ফিল্মের মানুষ ইন্ট্রোভার্ট! এটা কেউ বিশ্বাস করবে?’
সায়েম সাহেবের সাথে হেঁটে হেঁটে সেটের সামনে সাজানো চেয়ারগুলোর দিকে এগোচ্ছি। ওনার সম্পর্কে আরও কিছু জানতে চাইলে তিনি আমাকে অনেক কিছুই বললেন।
সায়েম জামানের বাবা বিহারের মানুষ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে থেকে গেছেন। বাবা বিহারি হলেও মা কিন্তু বাংলাদেশী। বাবা-মা সৈয়দপুরে থাকেন। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করে মুম্বাই চলে যান। কলেজে বন্ধুমহলে খুব খ্যাতি ছিলো ওনার।
দুজনে দুটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম। অনেকটা মুখোমুখি অবস্থায়। সায়েম সাহেব কিছুটা হেলে চেয়ারটা টেনে ঠিক আমার সামনে বসলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, জানেন? দেখা হলেই সবাই বলতো, ‘তুই তো একদম নায়ক রে। ছবি করে ফেল। কেউ কেউ বলতো, ‘কলেজে পড়ে করবি কী? কেরানি হবি, না স্কুল মাস্টার! শুনতে শুনতে কান পচে যেতো। মুম্বাই থেকে ফিরেই চলে এলাম এখানে। সেই থেকে স্ট্রাগল করছি। দু’ একটা ছোট রোল করেছি—ব্যাস এটুকুই।’
‘এখানে ক্যামেরা কাঁধে ঝোলালেন কবে থেকে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘সে আরেক গল্প। আরিফ জাহান কয়েকটা ছবি করলেন। একটা না দুটো চলেছিল, বাকি সব তো বিনিয়োগের টাকাটাই তুলতে পারেনি! তো, ওই আরিফ জামান সাহেবের থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে বছর দেড় দুই কাজ করেছিলাম। তখন ক্যামেরাতে ফটো তোলার অভ্যাসটা আবার শুরু করলাম। এখানে ফটো তোলার প্রয়োজনও আছে। আপনি তো জানেনই। কন্টিনিউটি রাখার জন্য। এক একটা শটের পর কে কোথায় আছে, কিভাবে আছে, বসে না দাঁড়িয়ে আছে, সেইগুলো নোট রাখার জন্য স্টিল ফটো তুলে রাখতে হতো। যাতে পরের সপ্তাহে পরের শট তুলতে গেলে যেনো গুলিয়ে না যায়। সেই কন্টিনিউটি রাখার স্ন্যাপ তুলে রাখতে হতো আমাকে।’
দশটা বেজে গেছে। সাথে সাথেই শুটিং প্যাকআপ হয়ে গেলো। এর পরে কাজ বন্ধ না করলে সকল কলাকুশলী, কর্মীদের ‘ওভারটাইম’ গুনতে হবে। জাজ ফিল্মস অন্তত এ জাতীয় এক্সট্রা নতর্কীদের সমবেত নাচের জন্য অতো ওভারটাইম গুনতে রাজি নয়। খলিল ভাই নৃত্য পরিচালক মনতাজ আলীকে একটু তাড়া দিলে দশটাতেই প্যাক-আপ হয়ে গেলো।পরিচালক এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘ওকে, আজ চলে যাও। গুড নাইট।’
আমি ইশারা করতেই সায়েম সাহেব বুঝিয়ে দিলেন তিনিও বের হবেন। এফডিসির গেট বরাবর একসাথে হাঁটা শুরু করলাম।
‘এখন তো কোনও কাজ নেই। আছে নাকি?’ সায়েম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
‘না না। আর কোনও কাজ নেই।’
‘তাহলে যাবেন কোথায়?’
‘যাবো আর কোথায়? বাসায় যাচ্ছি, উত্তরা।’
‘রাত দশটায় বাসায় ফিরবেন! ফিল্মের লোকদের এতো আর্লি বাসায় ফিরতে নেই। হাহাহা। চলেন গলা ভেজানো যাক।’
‘চা খাবেন?’
‘আরে না। এগুলোকে গলা ভেজানো বলে নাকি?’
‘তাহলে?’ আমি একটু অবাক হলেও বুঝতে পারলাম তিনি আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন।
সায়েম জামানের আহ্বানের মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকে। মন টানে। তাই ওনার অনুরোধটা ফেলতে পারলাম না।
‘তো কোথায় যাবেন?’
‘আমি তো টঙ্গীতে থাকি। সো, চলেন রিজেন্সিতে যাই। গলা ভিজবে, মনও ভরবে।’
মন ভরানোর ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো না ঠিকমতো। আমি আর কিছু বললাম না। ওনার সাথে এফডিসির বাইরে চলে আসলাম। অনেকেই বের হচ্ছেন। বাইরে ট্যাক্সি, অটোরিক্সাগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
‘রিজেন্সিতো খুব দূরে নয়। সো, অটোরিক্সাতেই যাই, কী বলেন?’
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম।
দুজনে অটোরিক্সায় উঠে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেল রিজেন্সির সামনে এসে দাঁড়ালো অটোরিক্সাটি। ভাড়া দিবো বলে হিপপকেটে হাত দিতেই ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিলেন। নিজেই ভাড়া গুনলেন। ‘রিজেন্সি’তে ‘ক্লাব ১৩’-এ গিয়ে ঢুকলাম দুজনে। আগে কখনও কোনও বারে আমার পা পরেনি। ‘ক্লাব ১৩’-এর নাম শুনেছি। এই প্রথম সেখানে আমার পা পড়ছে। আমার গাইড সায়েম সাহেব। সিগারেটের ধোঁয়া, অ্যালকোহল, সেন্ট-এর গন্ধ—সেরকম বিরক্তিকর গন্ধেই বারগুলো ভরে থাকে বলে জেনেছি। ‘ক্লাব ১৩’ কে সেরকম মনে হলো না। কিন্তু সিগারেটে আগুণ ঠিকই জ্বলছে। অনেকের মুখ থেকে ধোঁয়াও বের হচ্ছে। সেন্টের ব্যাপারটাও আছে। কী কারণে যেনো সেগুলো বিরক্তিকর মনে হলো না। ‘ক্লাব ১৩’ বেশ ঝকঝকে। আলোগুলো জ্বলছে তবুও একটা আলোআঁধারি ভাব আছে। লাল রঙের আলোকেই বেশি মনে হলো। লম্বা মতো ঘরটিতে এসি চলছে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই জোড়া জোড়া টেবিল চেয়ারের মাঝখানে একফালি যাতায়াতের পথ। টেবিলের সারি ও উক্ত পথটি শেষ হয়েছে একটি মঞ্চ টাইপের জায়গায়। সেখানে একজন মহিলা মাইক হাতে গান গাইছে। বারগুলোতে লাইভ এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থা থাকে। আর আমি এই প্রথম তা স্বচক্ষে দেখছি।
মহিলা গান ধরেছে, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ে, হাঁ, তেরে প্যার সে...’
‘হিন্দি গান কেনো?’ আমি সায়েম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘এখানে দেশি-বিদেশি সব ধরণের মানুষ আসে। তাই হিন্দি-ইংলিশ-বাংলার একটা মিশেল পাবেন এখানে।’
‘ওহ।’
সায়েম সাহেব একটা টেবিলের কাছে গিয়ে আমাকে সেখানে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। বললেন বললে ভুল হবে, ইশারা করলেন। আমি বসলাম। তিনিও বসলেন। হিন্দি গান আমার তেমন একটা ভালো লাগে না। বাংলা গানই আমার প্রাণ। ইংরেজি মাঝেমধ্যে চলে।
হিন্দি গান চলছেই। সাথে তিনজন মেয়ে নাচছে। যে মহিলা গান গাচ্ছে সেও একটু আধটু নাচনকোঁদন করছে। যারা বারে গান গায় তাদের ‘ক্রুনার’ বলা হয়। কেউ কেউ ‘বার সিঙ্গার’ও বলে থাকেন। সায়েম সাহেবের কাছে যতোটুকু জানতে পারলাম, এই রকম দু-তিন জন ক্রুনার আছে এখানে। তাদের মধ্যে চুমকি একজন। এখানে নর্তকীদের লিস্টে ওর নাম যদিও চুমকি, আসল নাম কিন্তু ‘শায়লা’।
শায়লা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুলিয়ে নাচতে নাচতে, গান গাইতে গাইতে আমাদের টেবিলের কাছে চলে এলো। বাজনার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খাবেন? হুইস্কি না ওয়াইন?’
আমি এসব খাইনা। জীবনে কখনও এলকোহল ছুঁইনি। সায়েম সাহেব ককটেল চাইলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করতেই আমি ‘না’ করে দিলাম। আমি সফট ড্রিংকের কথা বললাম। উনি হাসলেন, ‘এখানে এসে সফট ড্রিংক চাইলে লোকে শুনলে হাসবে। এখানে এগুলোই চলে।’
‘তাহলে আমার জন্য অন্য কিছু বলুন। আপনি এগুলো ধরলেন কবে?’
‘মুম্বাইতে। ক্লাশমেটরা জোর করে খাইয়েছিলো। শেষমেশ অভ্যাস হয়ে গেলো। তবে সিরিয়াস অভ্যাস না। মাঝেমধ্যে আর কি। তো ট্রাই করে দেখেন না এক গ্লাস।’
‘না না। প্লিজ। আপনি খান। আমি গান শুনছি, ভালো লাগছে। (ভালো লাগছে না ছাই!)’
‘ঠিক আছে। শুধু আমার জন্য এক গ্লাস ককটেল। আর কাবাব, চিকেন টিকা যা পারেন নিয়ে আসেন,’ মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন সায়েম সাহেব।
আমি শায়লার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সে অর্ডার নিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর এক গ্লাস ককটেল, পাত্তর, কাবাব আর চিকেন টিকা নিয়ে এলো। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো দুটা মেয়ের দিকে। খেয়াল করলাম, ওরা আজকের সেকেন্ড শিফটের শুটিংয়ের শেষ সারির মেয়েদের মধ্যে ছিলো। আমি অবাক হলাম, ‘ওরে বাবা! এরা এখানেও! একসাথেই তো কাজ শেষ করলাম। তাহলে ওরা এর মধেই এখানে হাজির হলো কী করে!’
পেছনের দরজা দিয়ে হয়তো ধারের গ্রিনরুমে ঢুকে এরই মধ্যে পোশাক পাল্টে মেক-আপ ঠিক করে মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছে। হেলে দুলে নাচছে। এখানে পার্ট টাইম কাজ করে বলে মনে হলো।
ওদের দিকে কিছুক্ষণ ভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। সায়েম সাহেবের কণ্ঠ শুনে সম্ভিত ফিরে পেলাম। সায়েম সাহেব বললেন, ‘ওই যে চুমকি বা শায়লা, আমাদের নীলফামারীর মেয়ে। ওর গ্রামের বাড়ী নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায়।
একজন নর্তকী সম্পর্কে তিনি এতোকিছু জানেন সেটা দেখে আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আপনার সঙ্গে খুব দহরম-মহরম আছে নাকি?’
“ছিঃ! ছিঃ! কী যে বলেন, ভাই। আপনার কি তাই মনে হয়? ফিল্মে কাজ করে তাই কথা হতে হতেই সব জানতে পেরেছি। সবাইকে সে এসব কথা বলে না। যখন জানতে পেরেছে আমার বাড়িও নীলফামারী তখনই বলেছে। মেয়েটা অনেকটা বাধ্য হয়েই এই পেশায় এসেছে। আমার মায়া লাগে- এই আর কি। এক এলাকার মানুষ হলে সময়ে অসময়ে পাশে পাওয়া যায়। প্রয়োজনে সহানুভূতি পাওয়া যায়। সেটা ভেবেই হয়তো আমার সাথে দেখা হলেই কথাবার্তা বলে। আপনি জানেন, ঠিক সময়ে বিয়ে হলে ওই শায়লার মতো দুই-তিনটা মেয়ে থাকতো আমার?’
আমি ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলাম। কথা ঘুরিয়ে বললাম, ‘আপনাকে দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই!’
শায়লাকে আমার বেশ লাগলো। ওর শরীরের গড়ন-পেটন ভালো। বেশ ফর্সা রং। নাসা উন্নত। চুলের স্টাইলটা মেরিলিন মনরোর মতো। মেদের নামগন্ধ নেই। বয়সটা ঠিক কতো সেটা বোঝা যায় না। ধীরে সুস্থে নাচ-গান দেখতে দেখতে দু-তিন পাত্তর ও কাবাব, চিকেন টিকা খাওয়া হয়ে গেলো। লাস্ট অর্ডার রাত বারোটায়। বারের ক্রুনার ও নর্তকীরা নিয়মমাফিক বারোটায় ‘নাচ-গান’ বন্ধ করে ঘরোয়া পোশাকে বেরিয়ে আসে। তারপর যে যার বাসা-হোস্টেল-মেসে চলে যায়।
শায়লাও বেরিয়ে এলো। সাথে অন্য একজন নর্তকী। ওর নাম জানা গেলো ‘সামিয়া’। এটা ওর আসল নাম না নকল- সেটা নিশ্চিত হতে পারলাম না। অতো কিছু নিশ্চিত হবার দরকারও মনে করলাম না। শায়লা সালোয়ার কামিজ পরেছে। এই পোশাকে আরও আকর্ষণীয় লাগছে ওকে।
‘ধুর! এই মেয়েটার কাছে অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহী, পরীমনিরা কিছু নয়,’ মনে মনে বললাম নিজেকে।
বাকি নর্তকীরাও সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরে বেরিয়ে এলো বারের বাইরে। টালমাটাল দু’একজন করে বেরিয়ে আসছে। একজন শায়লার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দু’বার টাল সামলে বললো, ‘যাবে না? চলো।’
আমি অবশ্য মনে মনে চাইলাম শায়লা সারারাত ওখানেই থাক আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
শায়লা কোনও কথা না বলে সায়েম সাহেবের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমার চোখে ভালো ঠেকলো না সেটা। সায়েম ওই নর্তকীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা আগে যাও।’
ওই নর্তকীর সাথে থাকা অন্য কয়েকজন নর্তকী হেসে ফেললো।
‘ও আচ্ছা, বুঝেছি। অন্য ব্যাপার-স্যাপার আছে। হাহাহাহা......,’ বলে টলায়মান মূর্তির মতো হাঁটতে লাগলো। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই হয়। হেড লাইট জ্বালিয়ে গাড়িগুলো শো শো করে চলে যাচ্ছে। রিজেন্সির সামনে তিন চারটে খালি রিক্সা, দু’টি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। রাতের ঢাকায় রিক্সাগুলো বাঁধাহীনভাবে হাইওয়েতে উঠে পড়ে। ওদের স্পীডও বেড়ে যায়। রাতের রিক্সায় চরলে মনে হয় সিএনজি বা ট্যাক্সিতেই চরেছি। আমি, সায়েম সাহেব, শায়লা আর সামিয়া দাঁড়িয়ে আছি। ততক্ষণে আরও তিন-চার জন নর্তকী গ্রিন রুম থেকে বেরিয়ে এসে সামনে আলো-অন্ধকারে গুছিয়ে দাঁড়ালো। রিক্সা, ট্যাক্সিওয়ালারা যেমন খদ্দের ধরার আশায় দাঁড়িয়ে, এই তিনটি মেয়েও কি তাই? হবে হয়তো। ওদের নীতি হচ্ছে, পয়সা আসলেই হলো, তা যেভাবেই আসুক না কেনো।
আমি সায়েম সাহেবকে বললাম, “আমি একটা রিক্সা ধরে এগোই? এই তো হাউজ বিল্ডিঙেই আমার বাসা। চার জনে তো ট্যাক্সিতে হবে না। অভয় দেবার মতো আমাকে হাত তুলে দেখিয়ে একটা ট্যাক্সিকে ইশারা করলেন সায়েম সাহেব। আমি থেমে গেলাম। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায়?’
‘টঙ্গী ষ্টেশন,’ সায়েম সাহেব উত্তর দিলেন।
‘আচ্ছা আসেন,’ বলে ড্রাইভার মিটারটা নিজের হাতে ডাউন করে পেছনের দরজা খুলে দিলো। যদিও মিটারের ব্যবহারটা জাস্ট একটা শো। রাতের ভাড়া দুশো টাকার নিচে নাই, সে আপনি একশো মিটার দূরত্ব যান না কেনো।
মেয়েরা উঠে পড়তেই, সায়েম সাহেব আমাকে ইশারা করে ট্যাক্সির ভিতর ঢুকতে বললেন।
‘সামিয়ার পাশে বসে পড়েন। জায়গা হবে। কোনো সমস্যা নেই। খাসা মেয়ে আছে। আপনার ভালো লাগবে।’
সায়েম সাহেবের মুখ একটু লাগামছাড়া, সেটা জানতাম। কিন্তু এতোটা লাগামছাড়া, সেটা জানতাম না। সামিয়া খাসা মেয়ে হলেও আমার ভালো লাগলো না ওর পাশে বসতে।
‘ইশ! যদি শায়লার পাশে বসতে পারতাম!’ মনে মনে আফসোস করলাম।
সায়েম সাহেব শায়লার পাশে বসে বেশ এঞ্জয় করছে বলে মনে হচ্ছে। আর আমার বুকের ভেতরটায় চাপ দিচ্ছে। ওই শায়লাকে আরও কিছুক্ষণ দেখতে পাবো ভেবেই রিক্সা না নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। সায়েম সাহেবের অনুরোধ মেনে ট্যাক্সিতে উঠতেই হবে, এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমি তো আর ওনার এসিস্ট্যান্ট না।
আমি এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে ঢুকে গেলাম। নিতম্ব দিয়ে ড্রাইভারকে একটু ঠেলে দিলাম। ড্রাইভারকে বললাম, ‘সমস্যা?’
ড্রাইভার মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সায়েম সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কী হলো, মিজান ভাই, এখানে বসলেন না যে? সামিয়াও চাইছে আপনি ওর পাশে বসে যান।
এবার সত্যি আমার একটু রাগ হলো এই সায়েম জামানের উপর। ‘উনি কি এই নর্তকীদের মনের ভিতর বিচরণ করেন নাকি যে কে কী চাইছে সেটা উনি আগে থেকেই জানেন?’ মনে মনে বললাম।
আর সায়েম সাহেবকে লক্ষ্য করে বললাম, ‘না, আপনি যান। আপনার এতো দিনের চেনাজানা মানুষ। আপনি সঙ্গ দিলেই ওনাদের জন্য ভালো। আপনার জন্যেও ভালো।’
ওরা তিনজন একসাথে হেসে উঠলো। এদিকে ভিতরে ভিতরে আমার পিত্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। ওরা কী যেনো সব আলোচনা করছে। হাসছে। মাঝেমাঝে আমাকেও কী যেনো জিজ্ঞেস করছে। আমি শুধু ‘হুম, হুম’ করছি।
কথা বলতে বলতে গাড়ি ছুটলো টঙ্গীর দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্যাক্সি হাউজ বিল্ডিঙে এসে পৌঁছালো। আমি কিছু বলার আগেই সায়েম সাহেবই ড্রাইভারকে বলে দিলেন গাড়ি থামাতে। ট্যাক্সি থামলো। আমি নামলাম। ভাবলাম, সায়েম সাহেব না হয় টঙ্গী ষ্টেশন যাবেন, কিন্তু শায়লা-সামিয়া নিশ্চয়ই এখানে নামবেন। শায়লার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনারা (সামিয়াসহ) নামবেন না?’
‘আরে না না। আমরাও তো টঙ্গীতেই থাকি। টঙ্গীবাজারের কাছে।’
‘আমি ঠোঁট কামড়িয়ে বললাম, ‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে, আপনারা যান। গুড নাইট। বাই। বাই চুমকি বাই, সামিয়া বাই। সায়েম ভাই, বাই।’
‘সায়েম’ নামটা মুখে আনতেই ভালো লাগছিলো না। শুধু সৌজন্যের খাতিরে মুখে আনতে হলো। খুব ইচ্ছে ছিলো শায়লার সাথে এই আলোআঁধারি রাতে অন্তত কিছু সময় কাটাই। সেটাও হলো না।
ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলো। ট্যাক্সির পেছনের লালবাতিগুলো জ্বলে উঠলো। বারের ভিতর ওর ঠোঁটগুলোর দিকে বেশ কয়েকবার তাকিয়ে ছিলাম। কি সুন্দর লাল দুটি ঠোঁট! লাল লিপস্টিক চকচক করছিলো। ট্যাক্সির ব্যাকলাইটের লাল রঙ দেখে শায়লার লাল ঠোঁট দুটির ছবি আমার মনের আয়নার প্রতিবিম্বিত হতে থাকলো।
ট্যাক্সির লাল আলোটা আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। দূরে, আরও দূরে। মনে হলো, আমার চোখ দুটো ভেজা ভেজা। ভেজা চোখেই ট্যাক্সির সেই বিলীনমান আলো দেখে মনে হলো, কী ভীষণ লাল!
কথা বলতে বলতে গাড়ি ছুটল আন্ধেরির দিকে, দক্ষিণে।
“লালি আমার যখন-তখন মডেল। সরলা, মানে, এখানে চুমকি আমার দেশের মেয়ে।”
সামনে বসে শরীর সামান্য পিছনে ঘুরিয়ে হাতজোর করে নমস্কার করলুম। ওরাও। যোগেশ্বরীতে নেমে গেলুম। ওরা এগিয়ে গেল। লালি ও চুমকি থাকে আন্ধেরির পূর্বে, ‘মরোল নাকার’ কাছে, পেয়িংগেস্ট।.......
অসীমের সাক্ষাত্কার নেবার ছিল। নর্তকীর দলের শুটিং শেষ হবে কালকে। পল এল। ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কি কথা বলে, দূর থেকে দেখেই আমার কাছে এসে বলল, “কী খবর? দাদার তবিয়ত ফাস্ কেলাস্?”
“হ্যাঁ। তোমার?”
“টপ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। সন্ধেবেলা চলে এস। ‘সংগীতা’য়। আড্ডা হবে। বলে, যেমন ধূমকেতুর মতো এসেছিল, তেমনই বেরিয়ে গেল।
সাক্ষাত্কার শেষে আমাকে এডিটিং টেবিলে ছবির ‘রাসেস’ দেখাল অসীম। স্টুডিও থেকে বেরোতে বেরোতে রাত ৯টা। ‘সংগীতা’ বারে গেলুম। পল দুটো পেগ নিয়ে টেবিল দখল করে রয়েছে। তখনও নাচা-গানা আরম্ভ হয়নি। ঠিক দশটায় শুরু হল। লালি চুমকিও এসে মঞ্চ অধিকার করল। কথায় কথায় পলের মুখে জানলাম, চুমকির বাবা-মা পলের খুব চেনা। নেচে নেচে ‘হিরোইন’ বা ‘আইটেম গার্ল’ হবে আশায় চুমকি বাড়ি থেকে ছ’বছর আগে চলে এসেছে এখানে। নানান ঘাটের জল খেয়ে, কোরামের নর্তকী হয়ে অবরে-সবরে কাজ পায়। পাঁচশো, হাজার, খুব বেশি হলে দু’হাজার করে পায়। তাতেই দিনগুজরান। ‘সংগীতা’য় নেচে একটা সামান্য মাইনে পায়। বখশিসের আধা বখরা মালিকের সঙ্গে। এই করে চলছিল।
‘‘খুচরো খদ্দের হয়ে আলাপ করেছিলুম বছর খানেক আগে। ক্রমে, ক্রমে টের পাই, ও আমাদের ঝাড়খণ্ডের মেয়ে। ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলুম।” পল গেলাস শেষ করে বলল, প্রথমে খুব ‘না না’ করেছিল। ‘পাড়ার লোক কী বলবে?’, ‘হেরো’ বলে ঠাট্টাও করবে। তা ছাড়া, বাব-মার বয়েস হয়েছে। ওঁরা মেয়ে ফিরে আসবে শুনে অলরেডি পাত্র সন্ধান শুরু করে দিয়েছেন। সরলা একলা যেতে ভয় পাচ্ছে। বাধো বাধো ঠেকছে। লেজুড় হয়ে যেতে হবে।
পর দিন ওদের নাচের শেষ দিন। দুটোয় শুটিং প্যাকআপ। ক্যাশ মজুরি নিয়ে সন্ধেবেলা ওরা ট্রেন ধরবে। পলের অনুরোধ ফেলতে পারলুম না। কুর্লায় ‘তিলক টার্মিনাসে’ গেলুম রাত এগারোটার পর। বারোয়াটায় ছাড়বে ‘হাতিয়া এক্সপ্রেস’। কাঁধের ফ্ল্যাক্সের জলে মোশানো সোমরস নিয়ে এসেছে পল। দু’বার ঢোক মারলুম দু’জনে। লালিও এসেছে সঙ্গিনীকে সি অফ করতে। চুমকিকে বললুম, “কেমন লাগছে? ”
“দাদা, কী রকম গা শিউরে উঠছে। ভয় ভয়। ‘হেরো’ মনে হচ্ছে নিজেকে। আবার বাবা-মায়ের ঝাপসা মুখ মনে পড়ছে। আনন্দ-ভয় সব মিলিয়ে মিশিয়ে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।”
ইঞ্জিন জুড়লো হয়তো। গোটা গাড়িটা নড়ে উঠল।
চুমকি আর লালি গলা জড়াজড়ি করে কী যেন বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল। পল বললে, “দু’ হপ্তা পর ফিরে আসব— সরলার বিয়ে খেয়ে— ওঠো, ছেড়ে দেবে—।”
সরলা হঠাত্ ঢিপ করে ঝুঁকে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে, বললে, “দাদা, আশীর্বাদ করুন। যেন ভাল থাকি। বাবা-মাকে”— বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল। শব্দ হারিয়ে গেল। লালির দু’চোখ লাল। কাঁদছে। আমার কেমন একটা অনুভূতি হল। লিখে বোঝানো যাবে না। সামান্য বেদনা হয়তো ছিল। মেয়েটা ভুল করে এসে, হেরে গেল। এবং আনন্দও হল, ‘মোহমুক্তি’। চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
রাতের রেলগাড়ির শেষ কামরার লাল আলোটা দূরে সরে যাচ্ছে। তবু, ভেজা চোখেও, কী ভীষণ লাল!
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খলিল ভাই। আমি পারবো। আমি এ পর্যন্ত যা করেছি তা দেখে দেখেই শিখেছি। হাত ধরে ধরে কেউ শেখায়নি আমাকে। আমি পারবো।’
ক্যান্টিনে খাওয়া সেরে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কক্ষে গিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমিয়েছি। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখি প্রায় দুটা বেজে গেছে। সর্বনাশ! সহকারী শিল্পীদের সেটে হাজির করবার দায়িত্ব আমার। ওরা সময় মতো চলে না এলে তো খলিল ভাইয়ের কথা শুনতে হবে। খলিল ভাই খুবই পাংকচুয়াল মানুষ। সময় ধরে ধরে কাজ করেন বলেই আজ বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পরিচালক তিনি। খোদ হলিউড থেকে ডাক পরেছে ওনার জন্য। জেমস ক্যামেরন, রিডলি স্কট, রব মার্শেলের মতো জগত বিখ্যাত হলিউডি পরিচালকেরা খলিল ভাইকে তাঁদের সাথে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খলিল ভাই রাজি হননি। খলিল ভাই একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। দেশের চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করে করে চুলে পাক ধরিয়েছেন। এই এফডিসিতেই যেনো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সেটাই প্রায়ই বলেন আমাদেরকে। এই রকম একজন মানুষের সাথে কাজ করতে পেরে আমি সত্যি গর্বিত। সেটে খলিল ভাই চলে আসার আগেই আমাকে শিল্পীদের সেখানে হাজির করাতে হবে। আমি দ্রুতগতিতে ৭ নম্বর ফ্লোরে চলে গেলাম। পরের শুটিং ৭ নম্বর ফ্লোরেই হবে। ফ্লোরে সেট সাজানো হয়েছে। শিডিউলের শিল্পীরা সবাই চলে এসেছেন। আমি লিস্ট থেকে নাম ধরে ধরে নিশ্চিত হলাম। আমার বারোটা বাজলো না। ঘড়িতে দুইটা বাজলো।
সেকেন্ড শিফটের শুটিং শুরু হতে যাচ্ছে। দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত একটানা শুটিং চলবে। দু’টি ‘টেক’ হতে বিকেল চারটা সাড়ে চারটা বেজে গেল। উঠি উঠি করছি। সায়েম জামান এসে হাজির। ভদ্রলোক বেশ স্মার্ট। সব স্তরেই চেনাজানা। যে কোনও স্টুডিও চত্বরে, এফডিসিতে বেশ মিশুক ও মজাদার বলে সবখানেই তিনি পাত পান। বয়স আন্দাজে তিরিশ থেকে পঞ্চাশের যে কোনও জায়গায় হতে পারে। গোঁফ-দাড়ি নিখুঁত কামানো। চুলে কলপ করা। হয়তো কয়েকটা চুলে পাক ধরেছে। সেটাও ঢেকে রাখার চেষ্টা ভালোই করেছেন। কাছে বসলে বেশ ফুরফুরে আতরের গন্ধ। সব মিলিয়ে মিশিয়ে বোঝা কষ্টকর নয় যে মানুষটি বেশ শৌখিন। চাকরি করেন না। প্রেস-ট্রাস্ট ইত্যাদির সূত্রে ও বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার। পকেটে প্রেসকার্ড রয়েছে, তা ছাড়পত্র। দুই কাঁধে ঝোলানো দামি ক্যামেরা দু-তিনটি। স্টিল ফটোগ্রাফার। স্বাধীন ফটোগ্রাফার তিনি। রসিক মানুষ। ৭ নম্বর ফ্লোরে ঢুকে হন্তদন্তভাবে বসেই গম্ভীর মুখে নৃত্য পরিচালককে উদ্দেশ্য করে সামনের দিকে চোখ পেতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত করে?’
নতর্কীদের ভীরের দিকেই চোখ রেখে ফের কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মনতাজ হেসে জবাব দিলেন, ‘কোনটা?’
বুঝতে পারলাম, ওনারা কিছুটা অশালীন রসিকতা করছেন। চুপ করে সেটার রস গ্রহণের চেষ্টা করলাম।
সায়েমের চটজলদি জবাব, ‘ওয়ান অফ দোজ! অ্যানি ওয়ান অফ দোজ?’
মনতাজ আলী হাসতে হাসতেই বললেন, “তুমি যাও। নিজেই জিজ্ঞেস করো কে তোমার সাথে যেতে চায়। হাহাহা...’
মনতাজ আলী পান খান নিয়মিত। হাসির জোরে কিছুটা পানের পিক টিশার্টের উপর গিয়ে পড়লো।
মনতাজ আলীর সায় পাবার সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ বগলের একটি ক্যামেরা বাগিয়ে সায়েম চললেন নর্তকীদের দিকে।
মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ফটোগ্রাফি ইন্সটিটিউট ‘শারি একাডেমী’র ছাত্র ছিলেন তিনি। শিক্ষা-সংস্কৃতির কোনও চিহ্ন নেই এমন কথা যেমন বলা যাবে না, ঠিক তেমনই, একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা বলা যাবে তাও নয়। লোকটাকে দেখে একজন মিশ্র প্রকৃতির মানুষ বলে মনে হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে অনেকটা এদেশের সাধারণ ছাত্রদের মতো। মধ্য বয়সি একজন বাংলাদেশী যুবক হলে যেমন হওয়া উচিত, সায়েম জামানও যেনো তাই। সমাজ-সংস্কার টনটনে। অথচ ‘কৌতূহল’ পুরো মাত্রায়।
দুটি ‘টেক’-এর পর শুটিং থামিয়ে রিহার্সাল চলছে। মুভি ক্যামেরা বন্ধ। আমারও হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন সায়েম সাহেব। তিন সারিতে দশ জন করে মেয়ে। সবার বয়স ২০-২৫ এর মধ্যে হবে। সাজ-পোশাক, যেটুকু না পরলে সেন্সর আটকাবে, সেটুকু তো পরতেই হয়। তাও সব ঝলমলে। চোখ ধাঁধানো কাচুলি টাইপ বক্ষঃবন্ধনী। নিম্নাঙ্গে হাফ প্যান্ট জাতীয় আবরণ। হাঁটুর কাছাকাছি পর্যন্ত। প্যান্টগুলো মেয়েগুলোর কোমরের চামড়া কামড়ে রয়েছে যেনো। তলপেটে চর্বি বেশি থাকায় নাভি যেনো শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
শেষের দিকে তৃতীয় সারির কোণের দিকে তিন-চার জন যারা মুদ্রা প্র্যাক্টিস করছে, সায়েম তাদের দিকে ক্যামেরা বাগালেন, তাক করে ‘ক্লিক’ করলেন। নর্তকীগুলোও কাঁধ, কোমর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পোজ দিচ্ছে। কেউ কেউ অবনত বুকগুলোকে ইচ্ছে করেই একটু বেশি উন্নত করার চেষ্টা করছে। সায়েম সাহেব বেশ মজা পাচ্ছেন, মনে হলো। যাদের ফটো তোলা হলো তারা মুচকি হেসে ইশারায় জানালো ফটোর ‘কপি’ চাই তাদের। হাত উঠিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তাদের আশ্বাস দিলেন সায়েম জামান। হাসি মুখে বললেন, ‘পাবে, পাবে।’ তার পর আমাকে দেখিয়ে মুখে হাতের আড়াল দিয়ে চাপা কণ্ঠে জানালেন, ‘পরিচালক সাহেব, কেমন দেখলেন?’ আমি হাসি সামলাতে পারলাম না। খলিল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এখনও প্রধান সহকারীই হতে পারলাম না, আপনি আমাকে পরিচালক বলছেন!’
আমার কাঁধে হাত রেখে সায়েম বললেন, ‘ওই হলো, পরিচালকই তো। আর হবেন হবেন, খুব তাড়াতাড়ি পরিচালকই হয়ে যাবেন। কিপ পেশেন্স।’
আমি তাড়াতাড়ি সরে এলাম ওখান থেকে। ফিল্মে কাজ করলেও ফিল্মের এই নর্তকীদের থেকে আমি একটু দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি। এরা সুবিধা পেতে চায়। নায়িকার পেছনে নেচে নেচে একটা সময় নায়িকা হবার জন্য পাগল হয়ে যায়। শুনেছি, পরিচালক-প্রযোজকদেরকে একান্ত সঙ্গ দিতেও এদের কোনো দ্বিধা হয় না।
আমাকে তাড়াতাড়ি করে ওখান থেকে সরে আসতে দেখে সায়েম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার পরিচালক সাহেব, পালিয়ে এলেন কেনো?’
আমি কথা বাড়ালাম না, শুধু বললাম, ‘আমি একটু ইন্ট্রোভার্ট।’
‘কী যে বলেন, সাহেব, ফিল্মের মানুষ ইন্ট্রোভার্ট! এটা কেউ বিশ্বাস করবে?’
সায়েম সাহেবের সাথে হেঁটে হেঁটে সেটের সামনে সাজানো চেয়ারগুলোর দিকে এগোচ্ছি। ওনার সম্পর্কে আরও কিছু জানতে চাইলে তিনি আমাকে অনেক কিছুই বললেন।
সায়েম জামানের বাবা বিহারের মানুষ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে থেকে গেছেন। বাবা বিহারি হলেও মা কিন্তু বাংলাদেশী। বাবা-মা সৈয়দপুরে থাকেন। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করে মুম্বাই চলে যান। কলেজে বন্ধুমহলে খুব খ্যাতি ছিলো ওনার।
দুজনে দুটা চেয়ার টেনে বসে পরলাম। অনেকটা মুখোমুখি অবস্থায়। সায়েম সাহেব কিছুটা হেলে চেয়ারটা টেনে ঠিক আমার সামনে বসলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, জানেন? দেখা হলেই সবাই বলতো, ‘তুই তো একদম নায়ক রে। ছবি করে ফেল। কেউ কেউ বলতো, ‘কলেজে পড়ে করবি কী? কেরানি হবি, না স্কুল মাস্টার! শুনতে শুনতে কান পচে যেতো। মুম্বাই থেকে ফিরেই চলে এলাম এখানে। সেই থেকে স্ট্রাগল করছি। দু’ একটা ছোট রোল করেছি—ব্যাস এটুকুই।’
‘এখানে ক্যামেরা কাঁধে ঝোলালেন কবে থেকে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘সে আরেক গল্প। আরিফ জাহান কয়েকটা ছবি করলেন। একটা না দুটো চলেছিল, বাকি সব তো বিনিয়োগের টাকাটাই তুলতে পারেনি! তো, ওই আরিফ জামান সাহেবের থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে বছর দেড় দুই কাজ করেছিলাম। তখন ক্যামেরাতে ফটো তোলার অভ্যাসটা আবার শুরু করলাম। এখানে ফটো তোলার প্রয়োজনও আছে। আপনি তো জানেনই। কন্টিনিউটি রাখার জন্য। এক একটা শটের পর কে কোথায় আছে, কিভাবে আছে, বসে না দাঁড়িয়ে আছে, সেইগুলো নোট রাখার জন্য স্টিল ফটো তুলে রাখতে হতো। যাতে পরের সপ্তাহে পরের শট তুলতে গেলে যেনো গুলিয়ে না যায়। সেই কন্টিনিউটি রাখার স্ন্যাপ তুলে রাখতে হতো আমাকে।’
দশটা বেজে গেছে। সাথে সাথেই শুটিং প্যাকআপ হয়ে গেলো। এর পরে কাজ বন্ধ না করলে সকল কলাকুশলী, কর্মীদের ‘ওভারটাইম’ গুনতে হবে। জাজ ফিল্মস অন্তত এ জাতীয় এক্সট্রা নতর্কীদের সমবেত নাচের জন্য অতো ওভারটাইম গুনতে রাজি নয়। খলিল ভাই নৃত্য পরিচালক মনতাজ আলীকে একটু তাড়া দিলে দশটাতেই প্যাক-আপ হয়ে গেলো।পরিচালক এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘ওকে, আজ চলে যাও। গুড নাইট।’
আমি ইশারা করতেই সায়েম সাহেব বুঝিয়ে দিলেন তিনিও বের হবেন। এফডিসির গেট বরাবর একসাথে হাঁটা শুরু করলাম।
‘এখন তো কোনও কাজ নেই। আছে নাকি?’ সায়েম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
‘না না। আর কোনও কাজ নেই।’
‘তাহলে যাবেন কোথায়?’
‘যাবো আর কোথায়? বাসায় যাচ্ছি, উত্তরা।’
‘রাত দশটায় বাসায় ফিরবেন! ফিল্মের লোকদের এতো আর্লি বাসায় ফিরতে নেই। হাহাহা। চলেন গলা ভেজানো যাক।’
‘চা খাবেন?’
‘আরে না। এগুলোকে গলা ভেজানো বলে নাকি?’
‘তাহলে?’ আমি একটু অবাক হলেও বুঝতে পারলাম তিনি আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন।
সায়েম জামানের আহ্বানের মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকে। মন টানে। তাই ওনার অনুরোধটা ফেলতে পারলাম না।
‘তো কোথায় যাবেন?’
‘আমি তো টঙ্গীতে থাকি। সো, চলেন রিজেন্সিতে যাই। গলা ভিজবে, মনও ভরবে।’
মন ভরানোর ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো না ঠিকমতো। আমি আর কিছু বললাম না। ওনার সাথে এফডিসির বাইরে চলে আসলাম। অনেকেই বের হচ্ছেন। বাইরে ট্যাক্সি, অটোরিক্সাগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
‘রিজেন্সিতো খুব দূরে নয়। সো, অটোরিক্সাতেই যাই, কী বলেন?’
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম।
দুজনে অটোরিক্সায় উঠে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেল রিজেন্সির সামনে এসে দাঁড়ালো অটোরিক্সাটি। ভাড়া দিবো বলে হিপপকেটে হাত দিতেই ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিলেন। নিজেই ভাড়া গুনলেন। ‘রিজেন্সি’তে ‘ক্লাব ১৩’-এ গিয়ে ঢুকলাম দুজনে। আগে কখনও কোনও বারে আমার পা পরেনি। ‘ক্লাব ১৩’-এর নাম শুনেছি। এই প্রথম সেখানে আমার পা পড়ছে। আমার গাইড সায়েম সাহেব। সিগারেটের ধোঁয়া, অ্যালকোহল, সেন্ট-এর গন্ধ—সেরকম বিরক্তিকর গন্ধেই বারগুলো ভরে থাকে বলে জেনেছি। ‘ক্লাব ১৩’ কে সেরকম মনে হলো না। কিন্তু সিগারেটে আগুণ ঠিকই জ্বলছে। অনেকের মুখ থেকে ধোঁয়াও বের হচ্ছে। সেন্টের ব্যাপারটাও আছে। কী কারণে যেনো সেগুলো বিরক্তিকর মনে হলো না। ‘ক্লাব ১৩’ বেশ ঝকঝকে। আলোগুলো জ্বলছে তবুও একটা আলোআঁধারি ভাব আছে। লাল রঙের আলোকেই বেশি মনে হলো। লম্বা মতো ঘরটিতে এসি চলছে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই জোড়া জোড়া টেবিল চেয়ারের মাঝখানে একফালি যাতায়াতের পথ। টেবিলের সারি ও উক্ত পথটি শেষ হয়েছে একটি মঞ্চ টাইপের জায়গায়। সেখানে একজন মহিলা মাইক হাতে গান গাইছে। বারগুলোতে লাইভ এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থা থাকে। আর আমি এই প্রথম তা স্বচক্ষে দেখছি।
মহিলা গান ধরেছে, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ে, হাঁ, তেরে প্যার সে...’
‘হিন্দি গান কেনো?’ আমি সায়েম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘এখানে দেশি-বিদেশি সব ধরণের মানুষ আসে। তাই হিন্দি-ইংলিশ-বাংলার একটা মিশেল পাবেন এখানে।’
‘ওহ।’
সায়েম সাহেব একটা টেবিলের কাছে গিয়ে আমাকে সেখানে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। বললেন বললে ভুল হবে, ইশারা করলেন। আমি বসলাম। তিনিও বসলেন। হিন্দি গান আমার তেমন একটা ভালো লাগে না। বাংলা গানই আমার প্রাণ। ইংরেজি মাঝেমধ্যে চলে।
হিন্দি গান চলছেই। সাথে তিনজন মেয়ে নাচছে। যে মহিলা গান গাচ্ছে সেও একটু আধটু নাচনকোঁদন করছে। যারা বারে গান গায় তাদের ‘ক্রুনার’ বলা হয়। কেউ কেউ ‘বার সিঙ্গার’ও বলে থাকেন। সায়েম সাহেবের কাছে যতোটুকু জানতে পারলাম, এই রকম দু-তিন জন ক্রুনার আছে এখানে। তাদের মধ্যে চুমকি একজন। এখানে নর্তকীদের লিস্টে ওর নাম যদিও চুমকি, আসল নাম কিন্তু ‘শায়লা’।
শায়লা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুলিয়ে নাচতে নাচতে, গান গাইতে গাইতে আমাদের টেবিলের কাছে চলে এলো। বাজনার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খাবেন? হুইস্কি না ওয়াইন?’
আমি এসব খাইনা। জীবনে কখনও এলকোহল ছুঁইনি। সায়েম সাহেব ককটেল চাইলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করতেই আমি ‘না’ করে দিলাম। আমি সফট ড্রিংকের কথা বললাম। উনি হাসলেন, ‘এখানে এসে সফট ড্রিংক চাইলে লোকে শুনলে হাসবে। এখানে এগুলোই চলে।’
‘তাহলে আমার জন্য অন্য কিছু বলুন। আপনি এগুলো ধরলেন কবে?’
‘মুম্বাইতে। ক্লাশমেটরা জোর করে খাইয়েছিলো। শেষমেশ অভ্যাস হয়ে গেলো। তবে সিরিয়াস অভ্যাস না। মাঝেমধ্যে আর কি। তো ট্রাই করে দেখেন না এক গ্লাস।’
‘না না। প্লিজ। আপনি খান। আমি গান শুনছি, ভালো লাগছে। (ভালো লাগছে না ছাই!)’
‘ঠিক আছে। শুধু আমার জন্য এক গ্লাস ককটেল। আর কাবাব, চিকেন টিকা যা পারেন নিয়ে আসেন,’ মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন সায়েম সাহেব।
আমি শায়লার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সে অর্ডার নিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর এক গ্লাস ককটেল, পাত্তর, কাবাব আর চিকেন টিকা নিয়ে এলো। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো দুটা মেয়ের দিকে। খেয়াল করলাম, ওরা আজকের সেকেন্ড শিফটের শুটিংয়ের শেষ সারির মেয়েদের মধ্যে ছিলো। আমি অবাক হলাম, ‘ওরে বাবা! এরা এখানেও! একসাথেই তো কাজ শেষ করলাম। তাহলে ওরা এর মধেই এখানে হাজির হলো কী করে!’
পেছনের দরজা দিয়ে হয়তো ধারের গ্রিনরুমে ঢুকে এরই মধ্যে পোশাক পাল্টে মেক-আপ ঠিক করে মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছে। হেলে দুলে নাচছে। এখানে পার্ট টাইম কাজ করে বলে মনে হলো।
ওদের দিকে কিছুক্ষণ ভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। সায়েম সাহেবের কণ্ঠ শুনে সম্ভিত ফিরে পেলাম। সায়েম সাহেব বললেন, ‘ওই যে চুমকি বা শায়লা, আমাদের নীলফামারীর মেয়ে। ওর গ্রামের বাড়ী নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায়।
একজন নর্তকী সম্পর্কে তিনি এতোকিছু জানেন সেটা দেখে আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আপনার সঙ্গে খুব দহরম-মহরম আছে নাকি?’
“ছিঃ! ছিঃ! কী যে বলেন, ভাই। আপনার কি তাই মনে হয়? ফিল্মে কাজ করে তাই কথা হতে হতেই সব জানতে পেরেছি। সবাইকে সে এসব কথা বলে না। যখন জানতে পেরেছে আমার বাড়িও নীলফামারী তখনই বলেছে। মেয়েটা অনেকটা বাধ্য হয়েই এই পেশায় এসেছে। আমার মায়া লাগে- এই আর কি। এক এলাকার মানুষ হলে সময়ে অসময়ে পাশে পাওয়া যায়। প্রয়োজনে সহানুভূতি পাওয়া যায়। সেটা ভেবেই হয়তো আমার সাথে দেখা হলেই কথাবার্তা বলে। আপনি জানেন, ঠিক সময়ে বিয়ে হলে ওই শায়লার মতো দুই-তিনটা মেয়ে থাকতো আমার?’
আমি ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলাম। কথা ঘুরিয়ে বললাম, ‘আপনাকে দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই!’
শায়লাকে আমার বেশ লাগলো। ওর শরীরের গড়ন-পেটন ভালো। বেশ ফর্সা রং। নাসা উন্নত। চুলের স্টাইলটা মেরিলিন মনরোর মতো। মেদের নামগন্ধ নেই। বয়সটা ঠিক কতো সেটা বোঝা যায় না। ধীরে সুস্থে নাচ-গান দেখতে দেখতে দু-তিন পাত্তর ও কাবাব, চিকেন টিকা খাওয়া হয়ে গেলো। লাস্ট অর্ডার রাত বারোটায়। বারের ক্রুনার ও নর্তকীরা নিয়মমাফিক বারোটায় ‘নাচ-গান’ বন্ধ করে ঘরোয়া পোশাকে বেরিয়ে আসে। তারপর যে যার বাসা-হোস্টেল-মেসে চলে যায়।
শায়লাও বেরিয়ে এলো। সাথে অন্য একজন নর্তকী। ওর নাম জানা গেলো ‘সামিয়া’। এটা ওর আসল নাম না নকল- সেটা নিশ্চিত হতে পারলাম না। অতো কিছু নিশ্চিত হবার দরকারও মনে করলাম না। শায়লা সালোয়ার কামিজ পরেছে। এই পোশাকে আরও আকর্ষণীয় লাগছে ওকে।
‘ধুর! এই মেয়েটার কাছে অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহী, পরীমনিরা কিছু নয়,’ মনে মনে বললাম নিজেকে।
বাকি নর্তকীরাও সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরে বেরিয়ে এলো বারের বাইরে। টালমাটাল দু’একজন করে বেরিয়ে আসছে। একজন শায়লার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দু’বার টাল সামলে বললো, ‘যাবে না? চলো।’
আমি অবশ্য মনে মনে চাইলাম শায়লা সারারাত ওখানেই থাক আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
শায়লা কোনও কথা না বলে সায়েম সাহেবের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমার চোখে ভালো ঠেকলো না সেটা। সায়েম ওই নর্তকীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা আগে যাও।’
ওই নর্তকীর সাথে থাকা অন্য কয়েকজন নর্তকী হেসে ফেললো।
‘ও আচ্ছা, বুঝেছি। অন্য ব্যাপার-স্যাপার আছে। হাহাহাহা......,’ বলে টলায়মান মূর্তির মতো হাঁটতে লাগলো। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই হয়। হেড লাইট জ্বালিয়ে গাড়িগুলো শো শো করে চলে যাচ্ছে। রিজেন্সির সামনে তিন চারটে খালি রিক্সা, দু’টি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। রাতের ঢাকায় রিক্সাগুলো বাঁধাহীনভাবে হাইওয়েতে উঠে পড়ে। ওদের স্পীডও বেড়ে যায়। রাতের রিক্সায় চরলে মনে হয় সিএনজি বা ট্যাক্সিতেই চরেছি। আমি, সায়েম সাহেব, শায়লা আর সামিয়া দাঁড়িয়ে আছি। ততক্ষণে আরও তিন-চার জন নর্তকী গ্রিন রুম থেকে বেরিয়ে এসে সামনে আলো-অন্ধকারে গুছিয়ে দাঁড়ালো। রিক্সা, ট্যাক্সিওয়ালারা যেমন খদ্দের ধরার আশায় দাঁড়িয়ে, এই তিনটি মেয়েও কি তাই? হবে হয়তো। ওদের নীতি হচ্ছে, পয়সা আসলেই হলো, তা যেভাবেই আসুক না কেনো।
আমি সায়েম সাহেবকে বললাম, “আমি একটা রিক্সা ধরে এগোই? এই তো হাউজ বিল্ডিঙেই আমার বাসা। চার জনে তো ট্যাক্সিতে হবে না। অভয় দেবার মতো আমাকে হাত তুলে দেখিয়ে একটা ট্যাক্সিকে ইশারা করলেন সায়েম সাহেব। আমি থেমে গেলাম। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায়?’
‘টঙ্গী ষ্টেশন,’ সায়েম সাহেব উত্তর দিলেন।
‘আচ্ছা আসেন,’ বলে ড্রাইভার মিটারটা নিজের হাতে ডাউন করে পেছনের দরজা খুলে দিলো। যদিও মিটারের ব্যবহারটা জাস্ট একটা শো। রাতের ভাড়া দুশো টাকার নিচে নাই, সে আপনি একশো মিটার দূরত্ব যান না কেনো।
মেয়েরা উঠে পড়তেই, সায়েম সাহেব আমাকে ইশারা করে ট্যাক্সির ভিতর ঢুকতে বললেন।
‘সামিয়ার পাশে বসে পড়েন। জায়গা হবে। কোনো সমস্যা নেই। খাসা মেয়ে আছে। আপনার ভালো লাগবে।’
সায়েম সাহেবের মুখ একটু লাগামছাড়া, সেটা জানতাম। কিন্তু এতোটা লাগামছাড়া, সেটা জানতাম না। সামিয়া খাসা মেয়ে হলেও আমার ভালো লাগলো না ওর পাশে বসতে।
‘ইশ! যদি শায়লার পাশে বসতে পারতাম!’ মনে মনে আফসোস করলাম।
সায়েম সাহেব শায়লার পাশে বসে বেশ এঞ্জয় করছে বলে মনে হচ্ছে। আর আমার বুকের ভেতরটায় চাপ দিচ্ছে। ওই শায়লাকে আরও কিছুক্ষণ দেখতে পাবো ভেবেই রিক্সা না নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। সায়েম সাহেবের অনুরোধ মেনে ট্যাক্সিতে উঠতেই হবে, এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমি তো আর ওনার এসিস্ট্যান্ট না।
আমি এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে ঢুকে গেলাম। নিতম্ব দিয়ে ড্রাইভারকে একটু ঠেলে দিলাম। ড্রাইভারকে বললাম, ‘সমস্যা?’
ড্রাইভার মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সায়েম সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কী হলো, মিজান ভাই, এখানে বসলেন না যে? সামিয়াও চাইছে আপনি ওর পাশে বসে যান।
এবার সত্যি আমার একটু রাগ হলো এই সায়েম জামানের উপর। ‘উনি কি এই নর্তকীদের মনের ভিতর বিচরণ করেন নাকি যে কে কী চাইছে সেটা উনি আগে থেকেই জানেন?’ মনে মনে বললাম।
আর সায়েম সাহেবকে লক্ষ্য করে বললাম, ‘না, আপনি যান। আপনার এতো দিনের চেনাজানা মানুষ। আপনি সঙ্গ দিলেই ওনাদের জন্য ভালো। আপনার জন্যেও ভালো।’
ওরা তিনজন একসাথে হেসে উঠলো। এদিকে ভিতরে ভিতরে আমার পিত্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। ওরা কী যেনো সব আলোচনা করছে। হাসছে। মাঝেমাঝে আমাকেও কী যেনো জিজ্ঞেস করছে। আমি শুধু ‘হুম, হুম’ করছি।
কথা বলতে বলতে গাড়ি ছুটলো টঙ্গীর দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্যাক্সি হাউজ বিল্ডিঙে এসে পৌঁছালো। আমি কিছু বলার আগেই সায়েম সাহেবই ড্রাইভারকে বলে দিলেন গাড়ি থামাতে। ট্যাক্সি থামলো। আমি নামলাম। ভাবলাম, সায়েম সাহেব না হয় টঙ্গী ষ্টেশন যাবেন, কিন্তু শায়লা-সামিয়া নিশ্চয়ই এখানে নামবেন। শায়লার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনারা (সামিয়াসহ) নামবেন না?’
‘আরে না না। আমরাও তো টঙ্গীতেই থাকি। টঙ্গীবাজারের কাছে।’
‘আমি ঠোঁট কামড়িয়ে বললাম, ‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে তাহলে, আপনারা যান। গুড নাইট। বাই। বাই চুমকি বাই, সামিয়া বাই। সায়েম ভাই, বাই।’
‘সায়েম’ নামটা মুখে আনতেই ভালো লাগছিলো না। শুধু সৌজন্যের খাতিরে মুখে আনতে হলো। খুব ইচ্ছে ছিলো শায়লার সাথে এই আলোআঁধারি রাতে অন্তত কিছু সময় কাটাই। সেটাও হলো না।
ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলো। ট্যাক্সির পেছনের লালবাতিগুলো জ্বলে উঠলো। বারের ভিতর ওর ঠোঁটগুলোর দিকে বেশ কয়েকবার তাকিয়ে ছিলাম। কি সুন্দর লাল দুটি ঠোঁট! লাল লিপস্টিক চকচক করছিলো। ট্যাক্সির ব্যাকলাইটের লাল রঙ দেখে শায়লার লাল ঠোঁট দুটির ছবি আমার মনের আয়নার প্রতিবিম্বিত হতে থাকলো।
ট্যাক্সির লাল আলোটা আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। দূরে, আরও দূরে। মনে হলো, আমার চোখ দুটো ভেজা ভেজা। ভেজা চোখেই ট্যাক্সির সেই বিলীনমান আলো দেখে মনে হলো, কী ভীষণ লাল!
কথা বলতে বলতে গাড়ি ছুটল আন্ধেরির দিকে, দক্ষিণে।
“লালি আমার যখন-তখন মডেল। সরলা, মানে, এখানে চুমকি আমার দেশের মেয়ে।”
সামনে বসে শরীর সামান্য পিছনে ঘুরিয়ে হাতজোর করে নমস্কার করলুম। ওরাও। যোগেশ্বরীতে নেমে গেলুম। ওরা এগিয়ে গেল। লালি ও চুমকি থাকে আন্ধেরির পূর্বে, ‘মরোল নাকার’ কাছে, পেয়িংগেস্ট।.......
অসীমের সাক্ষাত্কার নেবার ছিল। নর্তকীর দলের শুটিং শেষ হবে কালকে। পল এল। ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে কি কথা বলে, দূর থেকে দেখেই আমার কাছে এসে বলল, “কী খবর? দাদার তবিয়ত ফাস্ কেলাস্?”
“হ্যাঁ। তোমার?”
“টপ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। সন্ধেবেলা চলে এস। ‘সংগীতা’য়। আড্ডা হবে। বলে, যেমন ধূমকেতুর মতো এসেছিল, তেমনই বেরিয়ে গেল।
সাক্ষাত্কার শেষে আমাকে এডিটিং টেবিলে ছবির ‘রাসেস’ দেখাল অসীম। স্টুডিও থেকে বেরোতে বেরোতে রাত ৯টা। ‘সংগীতা’ বারে গেলুম। পল দুটো পেগ নিয়ে টেবিল দখল করে রয়েছে। তখনও নাচা-গানা আরম্ভ হয়নি। ঠিক দশটায় শুরু হল। লালি চুমকিও এসে মঞ্চ অধিকার করল। কথায় কথায় পলের মুখে জানলাম, চুমকির বাবা-মা পলের খুব চেনা। নেচে নেচে ‘হিরোইন’ বা ‘আইটেম গার্ল’ হবে আশায় চুমকি বাড়ি থেকে ছ’বছর আগে চলে এসেছে এখানে। নানান ঘাটের জল খেয়ে, কোরামের নর্তকী হয়ে অবরে-সবরে কাজ পায়। পাঁচশো, হাজার, খুব বেশি হলে দু’হাজার করে পায়। তাতেই দিনগুজরান। ‘সংগীতা’য় নেচে একটা সামান্য মাইনে পায়। বখশিসের আধা বখরা মালিকের সঙ্গে। এই করে চলছিল।
‘‘খুচরো খদ্দের হয়ে আলাপ করেছিলুম বছর খানেক আগে। ক্রমে, ক্রমে টের পাই, ও আমাদের ঝাড়খণ্ডের মেয়ে। ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলুম।” পল গেলাস শেষ করে বলল, প্রথমে খুব ‘না না’ করেছিল। ‘পাড়ার লোক কী বলবে?’, ‘হেরো’ বলে ঠাট্টাও করবে। তা ছাড়া, বাব-মার বয়েস হয়েছে। ওঁরা মেয়ে ফিরে আসবে শুনে অলরেডি পাত্র সন্ধান শুরু করে দিয়েছেন। সরলা একলা যেতে ভয় পাচ্ছে। বাধো বাধো ঠেকছে। লেজুড় হয়ে যেতে হবে।
পর দিন ওদের নাচের শেষ দিন। দুটোয় শুটিং প্যাকআপ। ক্যাশ মজুরি নিয়ে সন্ধেবেলা ওরা ট্রেন ধরবে। পলের অনুরোধ ফেলতে পারলুম না। কুর্লায় ‘তিলক টার্মিনাসে’ গেলুম রাত এগারোটার পর। বারোয়াটায় ছাড়বে ‘হাতিয়া এক্সপ্রেস’। কাঁধের ফ্ল্যাক্সের জলে মোশানো সোমরস নিয়ে এসেছে পল। দু’বার ঢোক মারলুম দু’জনে। লালিও এসেছে সঙ্গিনীকে সি অফ করতে। চুমকিকে বললুম, “কেমন লাগছে? ”
“দাদা, কী রকম গা শিউরে উঠছে। ভয় ভয়। ‘হেরো’ মনে হচ্ছে নিজেকে। আবার বাবা-মায়ের ঝাপসা মুখ মনে পড়ছে। আনন্দ-ভয় সব মিলিয়ে মিশিয়ে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।”
ইঞ্জিন জুড়লো হয়তো। গোটা গাড়িটা নড়ে উঠল।
চুমকি আর লালি গলা জড়াজড়ি করে কী যেন বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল। পল বললে, “দু’ হপ্তা পর ফিরে আসব— সরলার বিয়ে খেয়ে— ওঠো, ছেড়ে দেবে—।”
সরলা হঠাত্ ঢিপ করে ঝুঁকে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে, বললে, “দাদা, আশীর্বাদ করুন। যেন ভাল থাকি। বাবা-মাকে”— বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল। শব্দ হারিয়ে গেল। লালির দু’চোখ লাল। কাঁদছে। আমার কেমন একটা অনুভূতি হল। লিখে বোঝানো যাবে না। সামান্য বেদনা হয়তো ছিল। মেয়েটা ভুল করে এসে, হেরে গেল। এবং আনন্দও হল, ‘মোহমুক্তি’। চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
রাতের রেলগাড়ির শেষ কামরার লাল আলোটা দূরে সরে যাচ্ছে। তবু, ভেজা চোখেও, কী ভীষণ লাল!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মশিউর ইসলাম (বিব্রত কবি) ২৩/১১/২০১৬ভাল লাগলো
-
জহির রহমান ১৭/১১/২০১৬বুকমার্ক করলাম, পরে পড়বো
-
তরীকুল ইসলাম সৈকত ১৭/১১/২০১৬দারুন!
-
আব্দুল মান্নান মল্লিক ১৭/১১/২০১৬বাঃ, অপূর্ব লিখনি
-
সোলাইমান ১৭/১১/২০১৬অসাধারণ
-
মোমিনুল হক আরাফাত ১৭/১১/২০১৬দারুণ
-
রাবেয়া মৌসুমী ১৭/১১/২০১৬সুন্দর!