www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কদম ফুলে ভালোবাসা

ভালোবাসার গল্প
গল্পের নামঃ কদম_ফুলে_ভালোবাসা
লেখকঃ নিরব আহমেদ রহিম

বৃষ্টি বানে ছেয়ে আছে চারদিক! হঠাৎ রিমঝিম ধারাতে আবার মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ব্যাঙ গুলো দিবানিশি ডেকেই চলেছে। সকাল গড়িয়ে বিকেল হলো কিন্তু বৃষ্টি কিছুতেই থামছেনা....

বৃষ্টি বাদলের বিকেলটা সত্যিই সুন্দর, অপরুপ সাজেঁ সেঁজে আছে। যদি ও কর্মতৎপরতা তেমন নেই বললেই চলে। তবে একটা দৃশ্য দেখলে সত্যিই আনন্দ লাগে....পাড়ার ছেলে মেয়ে গুলো হৈ চৈ কোলাহলে ব্যাস্ত.... বৃষ্টি যেনো তাদের কাছে মজার অনুভব!! তাদের কলকাকলিতে বৃষ্টি স্নাত বর্ষার বিকেলটা এক অপরুপ রুপে ধরা দিয়েছে সবুজ শ্যামলে ঘেরা পলাশপুর গ্রামে। গ্রামটা ছোট্ট হলেও আধুনিকতা আর সৌন্দর্যে পরিপুষ্ট। গ্রামের নাম পলাশ ফুলের নামে হলেও এখানে কদম ফুলের স্বর্গরাজ্য..
সারি সারি কদম গাছ, ফুলে পরিপূর্ন...
বৃষ্টির পানির ছোয়ায় যেনো নতুন রুপ নিয়েছে ফুলগুলো....

বৃষ্টি বাদল আর বর্ষার ধারাতে অবিরত ছুটে চলা ডজন খানেক ছেলেমেয়ের মধ্যে #রিয়াদ অন্যতম। রিয়াদ ছিলো এখানে সবার বড়। ক্লাস ফাইভে পড়তো স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যদিও এই বছর ই রিয়াদ এই গ্রামে পা রেখেছে, আর পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। রিয়াদের পলাশপুরে আগমন তার বাবার চাকুরীর বদলির সুবাধে। তার বাবা একটি বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত, তার মা গৃহিনী। ঢাকা থেকে বদলি হয়ে রিয়াদের বাবা পলাশপুর শাখায় চলে আসে। রিয়াদের কোন ভাই, বোন ছিলোনা।

তাই রিয়াদের বাবা #আশরাফ_চৌধুরী তার নিজ বাড়ি রেখে সপরিবারে পলাশপুর গ্রামে একটি বিল্ডিং এর ২য় তলা ভাড়া নেন।

রিয়াদ যদিও একজন ধনী বাবার একমাত্র সন্তান ছিলো তবুও তার বাবার মতই তার মধ্যে ছিলোনা কোন আভিজাত্য। সহজেই মিশে যেতেন সাধারন মানুষদের সাথে....

তাইতো এতো অল্প সময়েই গ্রামে তার সমবয়সী বা তার চেয়ে ছোট বড় সকল বন্ধুদের সাথে মিশে গেলো সহজেই।

রিয়াদ ছিলো খুবই মেধাবী ছাত্র। পড়াশোনায় খুবই ভালো। পড়াশোনার ফাঁকে সবটুকু সময় বন্ধু আর বান্ধবীদের সাথেই কাটাতো। খেলা-ধূলা , দৌড়া-দৌড়ি, পুকুরে সাতাঁর কাটা, ফুল কুড়ানো... এসব করেই বন্ধু বান্ধবের সাথে সময়টা খুব আনন্দেই কাটে রিয়াদের।

রিয়াদের বন্ধু আর বান্ধবীদের তালিকা খুব লম্বা কিন্তু ঐ বৃষ্টি ভেজা বিকেলে যারা ছিলো খেলার সাথী তাদের কথা না বললেই নয়.......

#জেরিন #রক্তিম #মেঘলা #বর্ষা #শিমু #শ্রাবন #রুপা #মৃদুল #রুমি #রাফসান #ফাল্গুনী
এরা সবাই #রিয়াদের বন্ধু আর বান্ধবী।
শুধু রিয়াদ ক্লাস ফাইভে, বাকীরা কেউ ফোরে কেউবা থ্রী তে পড়ে, সবাই একই স্কুলের ছাত্রছাত্রী।
বিকেলটা একটু গাঢ় হতে লাগলো। সব বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলো কদম ফুল পাড়বে কদম গাছ থেকে, তাই সবাই গাছের নিচে গিয়ে দাড়ালো।
কদম গাছ গুলো ছিলো সারি সারি, সবই এক সাইজ এর, কিন্তু একটি গাছ ছিলো ব্যতিক্রম। গাছটি ছিলো সবচেয়ে বড়, ঐ টাতে উঠার সাহস কেউ করেনা কিন্তু রিয়াদ ঐ গাছে উঠার জন্য সাহস করে বসলো। সব বন্ধুরা অবাক হয়ে গেলো রিয়াদের সিদ্ধান্তে! মেয়েগুলো ও কৌতুহলী হয়ে উঠলো রিয়াদের কথায়!! রিয়াদের বান্ধবীরা ও তাকে উৎসাহ দিতে লাগলো এতো বড় কদম গাছে উঠার জন্য ; সেই সাথে বিভিন্ন ঠেসঁমূলক কথাও বলতে লাগলো রিয়াদ কে...
তার বান্ধবীদের বিশ্বাস ছিলো রিয়াদ এতো বড় গাছ থেকে কখনোই কদম ফুল পেরে আনতে পারবেনা!!
মেয়ে বান্ধবীদের কথা একটু বলে নেই.. , সব বান্ধবীগুলোই ছিলো যার যার অবস্থান থেকে কিউট সুন্দরী। গ্রাম্য মেয়ে বলে কথা, অল্প বয়সেই পাকনামো পাকনামো ভাব! তাদের এই ১০ কিংবা ১১ বছর বয়সেই যেনো তাদের মধ্যে যৌবন উকিঁ মারছে... গ্রামটা যেমন ছিলো আধুনিক তেমনি মেয়ে বন্ধু গুলো ছিলো অল্প বয়সেই যৌবনে পরিপুষ্ট। প্রেম ভালোবাসা নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা ই হতো। না হলে কি আর এমন প্রস্তাব করে বসে!!!
কি সেই প্রস্তাব??
সব বান্ধবী গুলোই ছিলো একটু টেটনা স্বভাবের কিন্তু সবার মধ্যে #বর্ষা ছিলো একটু নিশ্চুপ টাইপের। শুধু সবার সাথে তাল মিলিয়ে যেতো।

কদম গাছ ছিলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে পিচ্ছিল, গাছে ওঠা ছিলো খুবই কষ্টসাধ্য, তবুও রিয়াদের এক কথা, সে গাছে উঠে ফুল পেরে আনবেই! এরই মধ্যে জেরিন, মেঘলা আর ফাল্গুনীরা রিয়াদ কে উদ্দেশ্য করে বললো, "যদি রিয়াদ উঠতে পারে এবং ফুল পেরে আনতে পারে, তবে সে যা চাইবে তাই পাবে "
এই কথা শুনে রিয়াদের চ্যালেন্জটা আরো বেড়ে গেলো। সব বান্ধবীরা প্রস্তাবে সুর মেলালো। কিন্তু বন্ধুরা রিয়াদের চ্যালেন্জে খুশি হতে পারলোনা। কারন আবেগের বশে রিয়াদ হয়তো পিছু হটবেনা কিন্তু কাজটা কত কঠিন তা রিয়াদের বন্ধু শ্রাবন আর রক্তিম রা ঠিক ই বুঝতে পারলো। তবুও রিয়াদ কে বাধা দেয়ার কোন উপায় নেই!!
যেই কথা সেই কাজ, রিয়াদ কদম গাছে উঠতে লাগলো। শত প্রতিকূলতা ভেঙে রিয়াদ মগডালে ওঠে বসলো। কিন্তু ফুল পারতে হলে আরো অনেক উপরে উঠতে হবে। উঠতে উঠতে রিয়াদ হাপিঁয়ে গেছে তবুও সে থেমে নেই, তার জেদের কাছে কেউ পেরে উঠেনা।

সব বন্ধু বান্ধবীদের লক্ষ্য কদম গাছের উপরে রিয়াদের দিকে, সবাই হা করে তাকিয়েয়ে আছে আর বন্ধুরা তার সফলতা কামনা করছে। হঠাৎ উপরের একটা ডাল ধরে রিয়াদ উপরে উঠার চেষ্টা করছে। কদম ফুল গুলো যে উপরেই দেখা যাচ্ছে, যখন গাছের ডাল ধরে উঠার জন্য টান দিলো তখন ই ঘটলো বিপত্ত্বি। কদমের ডাল এমনিতে মটকা, সহজেই ভেঙে যায়, এটা রিয়াদের মাথায় তখন ছিলোনা। যেই টান দিলো, সেই ডাল টা গাছ থেকে খুলে গেলো আর রিয়াদ সেই ডাল টা ই ধরে আছে। নিচের ডাল থেকে পা দুটো পিছলে গেলো!!
রিয়াদ শূন্যে ভাসছে..........

সবাই অপলক দৃষ্টিতে রিয়াদের ভূপতিত হবার দৃশ্য অবলোকন করতে লাগলো। মুহুর্তের মধ্যেই রিয়াদ কদমের ডাল টা হাতে ধরেই গাছ থেকে ধপাস করে পড়ে গেলো। সবাই চমকে উঠলো, নিশ্চুপ হয়ে রিয়াদ কে টেনে তুলতে ব্যাস্ত। #বর্ষা রিয়াদের হাতে ধরে টান দিলো, রিয়াদ অপলক দৃষ্টিতে বর্ষার চোখের দিকে তাকালো! কেমন যেনো একটা মায়াবী চাহনি বর্ষার। রিয়াদ বর্ষার হাতের স্পর্শ পেয়ে যেন মুহুর্তেই সব ব্যাথা ভূলে গেলো, বর্ষার হাতে কি যাদু আছে নাকি ! রিয়াদ এমন টা ভাবতে লাগলো।
অবশেষে রিয়াদ ওঠে দাড়ালো কিন্তু ব্যাথায় ছটফট করছিলো। ব্যাথায় সিক্ত অবস্থায় দেখতে লাগলো যে ডাল টি ভেঙে সে পড়লো সেটাতে কদম ফুলের আস্তিত্ত্ব আছে কিনা!! ভাগ্যের এ যেনো এক নিয়ামত! সেই ডালে ছিলো একটি ফুটন্ত কদম ফুল। কদম ফুলটা দেখে রিয়াদ খুশিতে আত্নহারা! শত ব্যাথার মাঝে ও সে আনন্দিত কারন সে ফুল পেরে আনতে পেরেছে। তখন ফুলটা ডাল থেকে ছিড়ে হাতে নিলো রিয়াদ, কিন্তু ততক্ষনে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে রিয়াদের এই দুর্ঘটনা দেখার জন্য! ! সবাই বলাবলি করছে রিয়াদকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য কিন্তু এদিকে রিয়াদ তার এই করুণ অবস্থার মধ্যেও তার বান্ধবীদের দেয়া প্রস্তাব ভূলতে পারেনি। সে বললো, "আমি এখন যেটা চাইবো সেটাই আমাকে দিতে হবে "
চারপাশে যে এতো মানুষ জমেছে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপপ নেই রিয়াদের.....
সবাইকে অবাক করে দিয়ে রিয়াদ কদম ফুলটা #বর্ষার দিকে এগিয়ে বলতে লাগলো, "আমি বর্ষাকে চাই "
সবাই হতবিহ্বল হয়ে গেলো, বর্ষা ও যেন সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছে!! মনের অজান্তে বর্ষা ও কদম ফুলটা হাতে নিলো। এদিকে সবাই তখন রিয়াদক। নিয়ে পাশের হাসপাতালে গেলো ; তার বাবা মা কে খবর দেয়া হলো। হাসপাতালে রিয়াদের পুরো শরীর এক্সরে করা হয়, তেমন কোন ক্ষতি হয়নি তবে কোমরের হাড় টা মচকে গিয়েছিলো।

হাসপাতালে চিকিৎসা চললো সাত দিন, এদিকে রিয়াদের বন্ধু বান্ধবীরা রিয়াদ কে দেখতে প্রতিদিন ই হাসপাতালে যাচ্ছে একমাত্র বর্ষা ছাড়া। বর্ষার মনে তখন এক অকল্পনীয় ঝড় খেলা করছে। বর্ষা যেন কেমন মলিন হয়ে গেছে আরো। রিয়াদের প্রতি তার অনুভূতিটা যেন আস্তে আস্তে আরো গাঢ় হচ্ছে। সাত দিন পর রিয়াদের বাবা রিয়াদকে বাড়ি নিয়ে আসলো।

এদিকে রিয়াদের বাবা মা ছেলের এই অখেয়ালীপনায় চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পরেন। তারা ভাবতে লাগলেন, এভাবে খোলামেলা পরিবেশে রিয়াদ হঠাৎ কোন বড় দুর্ঘটনায় পড়তে পারে ; তাই তারা রিয়াদকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তা করছে, ওখানে থেকে পড়াশোনা শেষ করেরে ফিরবে রিয়াদ। তার বাবা মার যতই কষ্ট হোক তবুও ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা এই সিদ্ধান্ত ই চূড়ান্ত করলো।।
রিয়াদ কিছুটা সুস্থ্যতা অনুভব করলো কয়েকদিন পর। বর্ষা রিয়াদ কে দেখতে গেলো তার বাড়িতে। তখন রিয়াদ বর্ষাকে তার ভালোবাসার কথা গুলো জানালো। রিয়াদ বলতে লাগলো, " বর্ষা তোমাকে আমার অনেক ভালো লাগে, তোমার হাতের স্পর্শ আমাকে শিহরিত করে, তোমাকে সত্যিই আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি, তুমি কি থাকবে আমার পাশে সারাজীবন? আমি তোমাকে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে চাই, তুমি কি হবে আমার জীবন সাথী? " বর্ষা নিরব নিশ্চুপ, মুখে কোন কথা নেই। শুধু নিরবতা আর নিরবতা... এ যেনো এক আবেগঘন মুহুর্ত। বর্ষার চোখে জল! বর্ষা জানেনা ভালোবাসা কি ! তবুও বুকের ভিতর কেমন যেন একটা অনুভূতি অনুভব করছে, মনের মধ্যে যেনো শুধু রিয়াদের হাত থেকে কদম ফুল নেওয়ার দৃশ্যটি বারবার চোখে পড়ছে.....
এদিকে রিয়াদের বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গেলে রিয়াদের বাবা রিয়াদ কে সব খুলে বলে যে, ওখানে গিয়ে পড়াশোনা করে তুমি সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার হবে, তারপর দেশে এসে দেশের মানুষের কল্যান করবে। রিয়াদ বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করবে শুনে খুব খুশি কিন্তু মুহুর্তেই সে খুশি কেটে গেলো। বর্ষাকে না দেখে সে কিভাবে থাকবে! বর্ষাকে যে সারাজীবন একসাথে থাকার সংকল্প করেছে!! আর বর্ষাকে না দেখে সে কিভাবে থাকবে এতোদিন!! সেটা ভাবতে যেন দু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো।

রিয়াদ ছুটে গেলো বর্ষাদের বাড়িতে, বর্ষার কাছে সবকিছু বললো। ওখান থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে আসবে, তারপর বর্ষাকে আপন করেরে নিবে, তখন দুজন ই বড় হবে। এসব শুনে বর্ষা কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা, শুধু মনের মধ্যে যেন একটা শূন্যতা এসে ভর করলো বর্ষার। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলোনা বর্ষা। চোখের জল যেন থামছেই না বর্ষার, মনের ভেতরে চাপা কান্না থামার নয়! বর্ষার বাবা মা কে রিয়াদ আন্টি আর আংকেল বলেই ডাকতো, তাদের কাছে ও রিয়াদ জানালো বিদেশ চলে যাবার কথা, কিন্তু বর্ষা আর রিয়াদের মধ্যে যে একটা বন্ধন গড়ে ওঠেছে সেটা তারা জানতোনা। রিয়াদের যাবার খবর শুনে তারা খুব খুশি হলো। বললো, "যাও বাবা, ওখানে গিয়ে ভালোকরে পড়াশোনা করে অনেক বড় হও ; আমরা গরীব মানুষ, যদি আমাদের টাকা পয়সা থাকতো তবে বর্ষাকে ও পাঠাতাম বিদেশে পড়াশোনার জন্য, কিন্তু আল্লাহ সে সম্বল দেয়নি " একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো বর্ষার বাবা আলফাজ মিয়া।

আজ রিয়াদ চলে যাবে.......
তার সকল বন্ধু এবং বান্ধবীরা রিয়াদের বাড়িতে আসলো রিয়াদ কে বিদায় জানানোর জন্য। সবাই একসাথে অনেকক্ষণ সময় কাটালো। বর্ষা ও ছিলো সবার সাথে...
বর্ষা রিয়াদকে বললো, "কদম ফুলটি আমি সযতনে রেখেছি হৃদয় গভীরে " এর সৌন্দর্য্য আমি সারাটাজীবন উপভোগ করতে চাই। আর বেশি কিছু বলতে চেয়ে ও থমকে গেলো বর্ষা, শুধু বললো "যেখানেই থাকো ভালো থেকো "
সব বন্ধু বান্ধবীদের চোখে বন্ধুকে হারানোর অশ্রু, বর্ষার চোখে একটু বেশিই ; কেননা, বর্ষার মনে রিয়াদের জন্য গড়ে উঠেছে সতিকার এক ভালোবাসার বন্ধন। যে বন্ধনে বর্ষা সারাটাজীবন কাটাতে চায়।

সবাইকে বিদায় জানাতে গিয়ে রিয়াদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ে, কান্নায় ভেঙে পড়ে রিয়াদ।
গাড়ি এসে গেছে, রিয়াদের ডাক পড়েছে ; রিয়াদ কে এখুনি বেরুতে হবে। বর্ষা রিয়াদ কে একটি বেগুনী রঙের কলম উপহার দিলো। রিয়াদ যতনে কলমটিতে একটি চুমো খেলো আর স্বযত্নে ব্যাগে ভরে রাখলো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে রিয়াদ কে নিয়ে গাড়ি চললো এয়ারপোর্টের দিকে....

#এর ই মাঝে কেটে গেছে ৬ বছর

বর্ষা দশম শ্রেনীতে পড়ে। সামনে তার এস এস সি পরীক্ষা। পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যাস্ত বর্ষা। এতো বছর কেটে গেলো কিন্তু রিয়াদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই বর্ষার। বর্ষা মাঝে মধ্যে কারো কাছ থেকে খবর নেয়, কিন্তু এছাড়া আর কি করবে সে! যোগাযোগ না থাকলেও বর্ষার মন প্রান জুড়ে শুধু রিয়াদের ই বসবাস।
পরীক্ষার বাকী মাত্র পাঁচ মাস। হঠাৎ করে বর্ষার বান্ধবী রুপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। পলাশপুর গ্রামেরই রোকনের সাথে। রোকন শহরে চাকরী করতো। রোকনের বড় চাচা করম আলী চৌধুরী পলাশপুরের চেয়ারম্যান। রুপার বাবা এতো অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলোনা কিন্তু করম আলী ছিলো খুব ক্ষমতাধর, তাই তার সাথে আর পেরে উঠেনি রুপার বাবা মফিজ মিয়া। রুপার সব বন্ধু এবং বান্ধবীদের দাওয়াত করা হলো। রুপার বাবা সবার বাড়িতে বিয়ের কার্ড পৌছে দিয়েছন। অক্টোবরের ২২ তারিখ বিয়ের দিন ধার্য্য করা হলো। পাত্রপক্ষের আশ্বাস ছিলো রুপা পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। কিন্তু বিয়ের আগে রুপার লেখাপড়ায় ছেদ পড়লো।
বিয়ের দিন রুপার বাবা মফিজ মিয়া বিরাট আয়োজন করলো বরযাত্রীদের আপ্যায়ন করার জন্য। পালের দুইটা গরু জবাই দিলো মফিজ মিয়া। বর্ষা সহ রুপার সকল বন্ধু বান্ধবীরা নিমন্ত্রন্ন খেতে বিয়েতে উপস্থিত হলো। বর যাত্রী এসে পৌছেছে, হৈ হৈ কলরব চারদিকে। বর্ষা, ফাল্গুনী, জেরিন, রুমি, শিমু, মেঘলা সহ সবাই গেট এ নতুন জামাই কে বরন করার জন্য উপস্থিত হলো।

এই বিয়ে বাড়িতে আসা টা এবং বান্ধবীদের সাথে গেট এ দাড়ানোটাই বর্ষার জীবনে এবং তার পরিবারের জন্য কাল হয়ে দাড়ায়।

রুপার স্বামী রোকনের চাচাতো ভাই রকির কু নজরে পড়লো বর্ষা। রকি ছিল চেয়ারম্যান করমআলী চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। রকি নামকরা বখাটে ছিলো। মদ, গাজাঁ, ইয়াবা, এমন কোন নেশা নেই যা রকি গ্রহন করতোনা। বাবার টাকা অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছেন বাজে সব নেশায়। নারী নেশা ছিলো আরো বেশি, টাকার জোরে এই রকি অনেক নারীর যৌবন নষ্ট করেছে। রকির বাবার ক্ষমতার বলে রকির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে রাজি হয়না।

বিয়ের দিন রকির নজর পড়লো বর্ষার দিকে। তাই বিভিন্ন কলা কৌশলে বর্ষাকে পেতে চাইলো রকি। রুপার কাছে রকি প্রস্তাব করলো বর্ষাকে বিয়ে করার জন্য, যেহেতু বর্ষা রুপার বান্ধবী ছিলো ; কিন্তু রুপা কি করবে বুঝতে পারছেনা, কি করে প্রস্তাব নিয়ে যাবে... তবুও রুপা নিরুপায় হয়ে বর্ষার বাবা আলফাজ মিয়ার কাছে প্রস্তাব টা পেশ করলো।

বর্ষার বাবা ছিলো খুব গরীব, জায়গা জমি তেমন ছিলোনা, শুধু বাড়িটা ই ছিলো সম্ভল। কিন্তু সততা, নিষ্ঠা আর মনুষত্ত্বে আলফাজ মিয়া ছিলো সমাজে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

করম আলীর ছেলের বিয়ের প্রস্তাবে আলফাজ মিয়া হতবাক। বর্ষা এখনো কৈশোর পার হয়নি। সামনে এস এস সি পরীক্ষা আর এমন একটা বদ গুনী ছেলে এসব ভাবতেই আলফাজ মিয়ার চোখে পানি চলে আসলো। উনার খুব ইচ্ছে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় অফিসার বানাবেন। এতো তারাতারি সে স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে যেতে পারেনা। নিজেরা না খেয়ে হলেও মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে চায় আলফাজ মিয়া।

এদিকে করম আলী প্রস্তাব নিয়ে আসলো আলফাজ মিয়ার কাছে। বললো এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হবে কিন্তু আলফাজ মিয়া রাজি না হওয়ায় রিতীমতো শাসিয়ে গেলো চেয়ারম্যান সাহেব। বলে গেলো বিয়ে দিতেই হবে আর যদি না দেয় তবে কলঙ্কিত করা হবে বর্ষাকে এবং আলফাজ মিয়ার পরিবারে কলঙ্কের কালি মেখে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হবে।
আলফাজ মিয়া ছিলো সত্য আর ন্যায়ের উজ্জ্বল এক উদাহরন। তাই বাবার অপমান বর্ষার হৃদয়কে ঘোলা করে দিলো। বর্ষার মনে প্রতিবাদের ঝড় বইছে, আর চিন্তার রেখা ও ফুটে ওঠলো বর্ষার মনে। সামনে তার পরীক্ষা আবার একটা বদমাইশ বখাটের পাল্লায় তার ও তার পরিবারের জীবন আজ বিপর্যস্ত।

বর্ষার বাবা নিরবে নির্জনে গভীর রাত পর্যন্ত ভাবলো কি করা যায়।
উনি ভাবলেন বর্ষাকে কখনোই এই বখাটে রকির হাতে তুলে দিতে পারবেন না তিনি। আর না দিলেও তার এতোদিনের তিল তিল করে অর্জন করা সম্মান দোলায় মিশিয়ে দেবে ঐ করম আলী চেয়ারম্যান। তাই আলফাজ মিয়া সিদ্ধান্ত নিলো রাতের আধারে পরিবার সহ গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন অচেনা, অজানা কোন গন্তব্যে। যেখানে থাকবেনা করম আলীর মত রক্তচোষা জোক, থাকবেনা রকির মত বদমাইশ....

যেই কথা সেই কাজ
ঐদিন শেষ রাতেই তারা নিজের ভিটেমাটি সম্বল ছেড়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি দিলেন অচেনা পথে.....

পলাশপুর রেলস্টেশন থেকে ভোর ৪ টার ট্রেনে করে চলে গেলেন অনেক দূরে। ট্রেন থেকে নামলেন দুপুর ১২ টায়। দীর্ঘ ৮ ঘন্টা ট্রেনে ভ্রমন করে নেমে দেখলেন " উদয়পুর জংশন "
আগে কখনো উদয়পুরে আসেন নি আলফাজ মিয়া। নতুন পরিবেশে কিভাবে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। জমানো সব টাকা পয়সা সাথে করে এনেছেন আলফাজ মিয়া। প্রথমেই একটি ভাড়া বাড়ি খুঁজতে লাগলেন। পুরোটা বিকেল ঘুরে ও মাথা গুজার ঠাঁই এর সন্ধান পেলেন না। তাই কি করবেন, কোথায় রাত কাটাবেন ভাবতে পারছেন না। এখানে তো সব অপরিচিত, কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। অবশেষে স্টেশনেই রাতটা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু স্টেশনে তো ভালো মানুষ থাকেনা। স্টেশন জুড়েই নেশা খোর দের আড্ডাখানা। তবুও ভয় ভয় বুকে নিয়েই একপাশে সবাই বসে আছে। রাত ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে.... পেটের ক্ষুধা ও সহ্যের বাইরে চলে গেছে... আলফাজ মিয়া বর্ষা আর বর্ষার মা কে বসিয়ে রেখে গেলেন কিছু খাবারের সন্ধানে....
পর মুহুর্তেই ভয়ংকর এক ঘটনার শিকার হলো আলফাজ মিয়ার পরিবার। যা কখনো কেউ ভাবেনি!! জীবনে এমন একটা মুহুর্ত আসবে এমনটা কখনোই ভাবেনি বর্ষার পরিবারের কেউ, কিন্তু কি আর করার ছিলো ওদের বাঘের থাবা থেকে বের হয়ে এসে যে সাপের ছোবলে পড়তে হবে কে জানতো!!!!

নেশাগ্রস্থ কতগুলো লোক লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো বর্ষার দিকে, যেনো বর্ষাকে এখনি ছিড়ে খাবে। বিভিন্ন অশালীন মন্তব্য করতে লাগলো বর্ষার কাছে এসে, বর্ষা চিৎকার করতে লাগলো। নরপিশাচ এই নেশাখোর দের কামনার্ত আক্রমন থেকে বর্ষাকে রক্ষা করার জন্য বর্ষার মা এগিয়ে আসে, কিন্তু পাষান্ড নেশাখোরের দল বর্ষার মা কে প্রচন্ড আঘাত করে! বর্ষার মা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে... বর্ষার চিৎকারে বর্ষার বাবা আলফাজ মিয়া দূর থেকে দৌড়ে আসতে লাগলো, এসে দেখে বর্ষার মা পড়ে আছে...
ততক্ষনে স্টেশনের অনেক গরীব দুঃখি মানুষ গুলো জড়ো হয় সেখানে। আলফাজ মিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই বর্ষার মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায় পরপারে!!! নরপিশাচগুলো দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে... আলফাজ মিয়া বর্ষার মাকে জড়িয়ে ধরে শুধু খুনিদের চলে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করতে লাগলো। বর্ষার স্বতিত্ত্ব রক্ষা করার জন্য আজ বর্ষার মা কে প্রান দিতে হলো।।
উদয়পুরে এসে মনে করেছিলো তাদের জীবনে নতুন সূর্য উদয় হবে, কিন্তু প্রথম দিন ই নিবে গেলো লক্ষ আশার প্রদীপ জ্বালানো "মা "। মা কে হারিয়ে বর্ষা পাগল প্রায়, বর্ষার চোখে মুখে হতাশার অশ্রু, শোকের ছায়া। আলফাজ মিয়া শোকে বিহ্বল।
উদয়পুর থানার পুলিশ ইন্সপেক্টর নিজ দ্বায়িত্ত্বে বর্ষার মায়ের দাফন কাফন সম্পন্ন করেন এছাড়া ওদের জন্য একটি বাসা ও ভাড়া নিয়ে দেন। শুরু হলো বর্ষার নতুন জীবন যুদ্ধ। মা বিহীন এই যুদ্ধে বর্ষা কি পারবে পড়াশোনা শেষ করে জীবনে নতুন করে বাচঁতে?
যে মা ছিলো বর্ষার জীবনের প্রতিটি কাজের সাথী, উৎসাহ দিতো বর্ষার বড় হয়ে উঠার আশায়। আজ মা নেই, মা চলে গেছে, মনে হয় বর্ষার জীবনে আজ কিছু নেই... তবুও জীবন চলতেই থাকবে আর মানুষ মরনশীল, মরতে যে একদিন হবেই.. কিন্তু এমন অকাল মৃত্যু, এমন ভাবে মরন বর্ষা মেনে নিতে পারছেনা... বর্ষা আজ নির্বিকার।।
বর্ষার এ বছর আর পরীক্ষা দেয়া হলোনা। পরের বছর বর্ষা পরীক্ষা দিলো। শত কষ্টের মাঝেও বর্ষা দুটি জিনিস কে ঠিক হৃদয়ে আকঁড়ে ধরে আছে। তার পড়াশোনা এবং হৃদয় গভীরে শুধু রিয়াদের নাম। কতদিন হয়ে গেলো রিয়াদের কোন ই খবর পাচ্ছেনা বর্ষা। রিয়াদ কেমন আছে, কোথায় আছে, তাকে মনে রেখেছে কিনা! কিছুই বুঝতে পারছেনা বর্ষা। তবুও আশায় বুক বেঁধে আছে।

বর্ষা A+ পেয়ে পাশ করলো এবং স্থানীয় একটি কলেজে ভর্তি হলো। দুই বছর পর সেখান থেকেও A+ পেয়ে ই পাশ করলো। এবার বর্ষা ভর্তি হলো বুয়েটে। সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলো। বর্ষার ভর্তিতে সামগ্রিক সহায়তা করলো পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেব। বর্ষা মোটামুটি বড় হইছে কিন্তু বর্ষা আরো অনেক বড় হতে চায়। একজন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার হতে চায় কেননা রিয়াদ একই বিষয়ে পড়াশোনা করতে বিদেশ গেছে তাই বর্ষার প্রচন্ড ইচ্ছা এই সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং।

এদিকে উদয়পুর থানার ঐ পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলো খুবই ভালো মনের মানুষ। এখনো বিয়ে করেনি, বয়স ত্রিশ এর মত হবে কিন্তু দেখতে তেমন খারাপ ছিলোনা। পুলিশ ইন্সপেক্টর বর্ষাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। কিন্তু বর্ষা কিভাবে মেনে নেবে এই প্রস্তাব?? বর্ষার জীবনে, মনে, প্রানে যে মিশে আছে রিয়াদের নাম।

বর্ষা নিজেও রিয়াদের মত সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার হতে চায়। তাই তার বাবাকে অনেক বুঝায়। সে এখন বিয়ে করবেনা, নিজের পায়ে দাড়াবে আগে তারপর বিয়ের চিন্তা। আলফাজ মিয়া ও বর্ষার একাগ্রতা দেখে মা মরা মেয়েটিকে আর জোর করলোনা।

এদিকে রিয়াদের বিদেশে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং পড়া শেষ হয়ে গেছে। বিদেশে একটা কোম্পানিতে চাকরী ও পেয়ে গেছে। কিন্তু দেশে আসতে খুব মন চায় রিয়াদের। কিন্তু ব্যাস্ততার কবলে পড়ে আর সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনা। কিন্তু এবার চিন্তা করলো দুই মাসের জন হলে ও দেশে আসবে রিয়াদ। বর্ষার কথা খুব মনে পড়ে রিয়াদের কিন্তু রিয়াদ তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বর্ষার কোন খবর দিতে পারেনি। তাই রিয়াদের মনটা হতাশাগ্রস্ত, দেশের প্রতি তার টান যেন মরে গেছে। কিন্তু তার জীবনের পুরনো স্মৃতি গুলো মনে করতেই তার হৃদয়পটে ভেসে উঠে বর্ষার মায়া ভরা আকুল চাহনি।।

আজ রিয়াদ বাড়ি আসবে। তার বাবা এয়ারপোর্টে অপেক্ষমান। রিয়াদ এসে নামলো। কিন্তু তাকে দেখে চেনার উপায় নেই। রিয়াদ আজ কত বড় হয়ে গেছে। সত্যিকার একজন অফিসারের মত লাগছে।
রিয়াদ পলাশপুরে এসেই বর্ষাদের বাড়ির দিকে গেলো কিন্তু সেখানে কোন বাড়ি ছিলোনা। সেখানে মস্ত বড় এক পুকুর....
রিয়াদের শৈশবের বন্ধুরা রিয়াদ কে পেয়ে আনন্দে উদ্ভোলিত। কিন্তু বর্ষার কথা জিজ্ঞেস করতেই তারা সবাই নিশ্চুপ। কেউ বলতে পারেনা কোথায় গেছে...
রিয়াদ মর্মাহত হয়ে বর্ষাকে না পেয়ে এক মাস ছুটি কাটিয়েই ফিরে যেতে চাইলো।
রিয়াদের বাবা বাধ সাধলো। বললো, তুই এদেশের মানুষ, তুই কেন বিদেশে চাকরি করবি? তোর উচিৎ দেশে একটা চাকরি করা, ভালো একটা সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান তোকে পাওয়ার জন্য আগ্রহ জানিয়েছে। তখন রিয়াদ তার বাবার আগ্রহের কাছে হার মানে এবং তার বাবাকে আস্বস্ত করে এবার গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে ছয় মাসের মধ্যে চলে আসবে। শুনে রিয়াদের বাবা খুব খুশি হলো।

বর্ষার পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে, পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বর্ষা যেনো নিজেকে একটু হালকা ভাবছে। কিন্তু এতোকিছুর মধ্যেও রিয়াদের কোন খবর পেলোনা।।

রিয়াদ দেশে চলে আসলো এবং স্বনামধন্য সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলো ট্রেইনার অফিসার হিসেবে।
নতুন যারা কোম্পানিতে ট্রেইনি হিসেবে যোগ দেন তাদেরকে ছয় মাসের ট্রেনিং করান রিয়াদ।
এদিকে বর্ষার রেজাল্ট বের হলো। খুব ভালো করছে সে। একজন সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার হিসেবে নিজেকে আত্নপ্রকাশ করতে পেরেছে বর্ষা। বর্ষার বাবা আলফাজ মিয়ার স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। তিনি খুব খুশি।

রিয়াদ যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সে প্রতিষ্ঠানে কিছু সংখ্যক নতুন ইন্জিরিয়ার নিয়োগ দেওয়া হবে। সেখানে বর্ষা আবেদন করছিলো, টিকে ও গেলো বর্ষা। ৩০ জন নতুন ট্রেইনি নিয়োগ দেয়া হলো, বেশির ভাগ ই বুয়েট থেকে এ বছর বের হওয়া। রিয়াদের দ্বায়িত্ত্ব পড়লো এই ৩০ জন নতুন ট্রেইনির ট্রেইনিং করানোর।
প্রতিদিন ২ ঘন্টা করে এদের কে ট্রেনিং দেন রিয়াদ। বর্ষা ও ট্রেনিংরত কিন্তু কেউ কাউকে চিনেনা। বর্ষা তার সহকর্মী ৩০ জনের সাথে খুবই সখ্যতা গড়ে তুলেছিলো। কেননা বেশির ভাগ ই ছিলো বুয়েটের ক্লাশমেট। এখানে ৫ জন ছেলে আর ২৫ জন মেয়ে, সবাই ছিলো খুবই আন্তরিক।

সেদিন ছিলো এপ্রিলের ২৯ তারিখ। সেই দিনটির আজ ১২ বছর অর্থাৎ এক যুগ পূর্তি, যেদিন বর্ষার হাতে কদম ফুল তুলে দিয়েছিলো রিয়াদ। দেখতে দেখতে ১২ টা বছর পার করলো বর্ষা। শুধু রিয়াদের অপেক্ষায় একযুগ পার করে দিলো। প্রতি বছর এই দিনে বর্ষা তার কাছের মানুষ গুলোকে কদম ফুল বিলিয়ে দেয় ; আর রিয়াদের জন্য প্রার্থনা করে, যেখানেই থাকে রিয়াদ যেন ভালো থাকে।

আজ ও এর ব্যাতিক্রম হলোনা। সকাল বেলা বর্ষা অনেক দূর থেকে অনেক গুলো কদমফুল সংগ্রহ করে নিয়ে অফিসে গেলো। সবাইকে কদম ফুল বিলিয়ে দিলো। এমন কি অফিসের প্রতিটি ডেস্কে কদম ফুলে ছেয়ে দিলো। অফিস রুম যেনো এক কদম ফুলের রাজ্যে পরিনত হলো
তাদের অফিসার রিয়াদ সাহেব অফিসে ডুকেই অবাক!! এতো কদম ফুল দেখে...
বর্ষা রা সবাই যার যার ডেস্কে বসে আছে। রিয়াদের মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে এলো "" এতো কদম ফুল! এই কদম ফুলের সাথে আমার জীবনের মূল্যবান কিছু জড়িয়ে আছে, যা আজ আমি হারিয়ে ফেলেছি ""

সবাই রিয়াদ সাহেবের কথা শুনে চমকে গেলো, " কারন বর্ষা ও বললো এই কদম ফুলের সাথে তার সখ্যতা ১২ বছর ধরে "

সবাই রিয়াদ স্যারের মুখে আজ কাহিনী শুনতে চায়। সবাই আবদার করলো "" স্যার আজ ক্লাশ নিতে হবেনা, আজ সবাই অনেক মজা করবো, কদম ফুলের সাথে জড়িয়ে থাকা আপনার জীবন কাহিনী শুনবো ""

এদিকে বর্ষার চোখে জল ছলছল করছে। স্যার কিসের কদম ফুলের সাথে জড়ানো কাহিনী বলবে!! স্যারের নাম ও তো রিয়াদ!! কিন্তু চেহারা দেখে তো চেনার উপায় নেই ; তাহলে কি এই সেই রিয়াদ! এই কি সেই বর্ষার ছোট্টবেলার রিয়াদ? এই কি সেই রিয়াদ! যে কদম ফুল হাতে দিয়ে ভালোবাসার অধিকার চাইছিলো!! বর্ষা আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলো।।

রিয়াদ স্যার ওদিকে জীবনের চরম সত্য গুলো নির্দ্বিধায় বলতে শুরু করলেন। সবাই আকুল নয়নে স্যারের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনছে। স্যার জীবন কাহিনী বলতে বলতে চোখ জোড়া অশ্রু ধারায় প্রবাহিত করছেন। স্যারের গল্প বলা শেষ। এতোক্ষন স্যারের জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে কেউ বর্ষার দিকে খেয়াল করেনি। হঠাৎ বর্ষার কান্নার আওয়াজে সবাই বর্ষার দিকে তাকালো। বর্ষা কান্না ধরে রাখতে পারেনি। প্রচন্ড কাদঁতে লাগলো বর্ষা, কারন এই সেই রিয়াদ! বর্ষার ছোট্টবেলার ভালোবাসার রিয়াদ। আজ ও রিয়াদ বর্ষার ভালোবাসা বুকে পুষে রেখেছে। এতোদিন খুঁজে পায়নি তাই এখনে খুঁজে ফিরছে বর্ষাকে। বর্ষা ও রিয়াদের অপেক্ষায় আজ ও মনের মধ্যে ভালোবাসার স্বপ্ন জাল বুনে যাচ্ছে। কিন্তু আজ বর্ষার চোখ বেয়ে শুধু পানি পরছে, কিভাবে বলবে "" আমিই তোমার বর্ষা ""

গল্প বলা শেষে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, "এতো কদম ফুল কে আনলো? " সবাই বর্ষার দিকে ইশারা করলো। বললো স্যার বর্ষা এনেছে। বর্ষা তখনো কাদঁছে, কেঁদেই যাচ্ছে। এ কান্না তো দুঃখের নয়!! এ তো সুখের কান্না! কিছু হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়ার কান্না....

রিয়াদ তাকালো বর্ষার দিকে অবাক দৃষ্টিতে!! এই কি আমার সেই বর্ষা!!! যাকে এতোটা ভালোবেসেছি, এতোটা সময় যাকে খুঁজে ফিরেছি, আজ এতোটা বছর পর এভাবে ফিরে পাবো ভাবিনী... (সমস্ত আবেগ ঝড়ছে).....
সবাই রিয়াদ স্যারের কথা শুনে স্তম্বিত হয়ে গেলো। রিয়াদের চোখেও জল, অবাক পানে চেয়ে আছে বর্ষার দিকে...
রিয়াদের কথায় বা আচরনে আজ নেই কোন অফিসারিত্ত্ব ভাব...
রিয়াদ যেনো তার জীবনের সুর খুজে পেলো, চারদিকে সবাই তাকিয়ে আছে, রিয়াদ প্রচন্ড আবেগে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরলো। কোন কার্পন্য করেনি, ছোট্টবেলার সেই রিয়াদ যেমন ছিলো আজ ও ঠিক তেমন ই আছে, সেদিন যেমন সবার সামনেই কদম ফুল তুলে দিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ করেছিলো রিয়াদ, আজ যেনো সবার সামনে জড়িয়ে ধরে সেই ভালোবাসার পূর্নতা এনে দিলো। দুজন দুজনকে জড়িয়ে অজস্র ধারায় কাদঁতে লাগলো। তাদের ভালোবাসার এমন দূর্লব দৃশ্য দেখে, তাদের ভালোবাসার এমন করুন কাহিনী শুনে বর্ষার কলিগ রা ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। সবার চোখে আজ তৃপ্তির কান্না। রিয়াদ আর বর্ষা একে অপরকে জড়িয়ে কেদেঁই যাচ্ছে.... এ যেনো পরম সুখের কান্না। ভালোবাসার আবেশে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কান্না। যার শুরু হয়েছিলো কদম ফুলের সৌন্দর্য্যে আজ তার পূর্নতা পেলো কদমে ঘেরা এক কদম রাজ্যের মধ্যমনিতে।

অফিসের সকল অফিসার রা চলে আসলো তাদের এমন দৃশ্য দেখে। সবাই তাদের জীবন কাহিনী গুলো শুনলো।
এদিকে এমন মিলন দিনে মিষ্টিমুখ না করলে কি হয়?! তাই পিওন কে মিষ্টি আনতে পাঠালেন বস। সবাই মিষ্টি খেলো। রিয়াদ ও বর্ষা সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। বস এর উদ্যোগে পার্টির ব্যাবস্থা করা হলো। সেই পার্টিতে রিয়াদ আর বর্ষার সকল ছোট্টবেলার বন্ধুরা এসেছিলো, শুধু রুপা আসেনি, কারন রুপা ছিলো পঞ্চম বারের মত প্রেগন্যান্ট। রিয়াদের বাবা মা সবাই ছিলো পার্টিতে। আলফাজ মিয়া খুব খুশি মনে পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু আলফাজ মিয়া ভাবতে লাগলেন, বর্ষার মা আজ বেঁচে থাকলে কতনা খুশি হতো!!

সেই পার্টিতে রিয়াদ ও বর্ষা একে অপরকে রিং পড়িয়ে দিলো। শুরু হয়েছিলো তাদের জীবনের নতুন পথচলা।। সেই পার্টির চারপাশে কদম ফুলে পরিপূর্ন ছিলো... দেখে যেনো মনে হয় এ যেনো এক কদম ঘেরা সুরভিত স্বর্গ।। মিলন হলো এক যুগ আগে সৃষ্টি হওয়া এক অদম্য ভালোবাসার, স্থাপিত হলো ভালোবাসার বিরল দৃষ্টান্ত। পার্টির ব্যানারে সেই মিলনের নাম দেয়া হয়েছিলো "" কদম ফুলে ভালোবাসা ""
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৪৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/০১/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast