দায়িত্ব
গোধূলি বিকেল। কালবৈশাখীর নিদারুণ অভিঘাতে সন্ধ্যাটাও যেন মুখ ঢেকে চুপটি করে বসে থাকে! ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাখিগুলো অবিরত ডানা ঝাপটায় ---- প্রচন্ড ঝড়ের মুখে অস্তিত্ব বিপন্ন জেনেও তাদের ঘরে ফেরার অবাধ্য প্রয়াসে ডানার ঝটপটানি আরও দ্রুত তালে চলতে থাকে ...
প্রকৃতি-যৌবনকে সেই ঝড় যেন দুমড়ে-মুচড়ে পায়ের তলায় ফেলে মাততে চায় বিজয়ী উল্লাসে! তবুও, প্রকৃতি দাঁড়িয়ে থাকে আপন মর্যাদায়। নিঃশেষিত হতে হতেও আবার উঠে দাঁড়ায়। জগত সংসারকে বাঁচানোর এক দুরন্ত প্রতিশ্রুতিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে!
---- পশ্চিম দিকে খোলা জানালার পাশে বসে শিমূল ভাবতে থাকে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। সতের বছর আগে এইরকমই প্রচন্ড ঝড়ের একটা রাত ছিল। মায়ের মাথাটা কোলে রেখেই মা'কে হারিয়েছিল সে চিরতরে! ভাই তখন চার বছরের মাত্র। পুতুলের সংসার বসানোর জায়গায় বাস্তব সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল তার কাঁধে। চার বছরের একটা পুতুলকেই যেন একটু একটু করে বড়ো করতে লাগল। সমাজ-সংসারে সৎ মায়ের ভূমিকাটা যে কিরকম তা শিমূলের বাবা নিজের জীবনে দেখেছেন। তাই আর ওই নরক যন্ত্রনা তিনি দিতে চাননি শিমূল ও তার ভাইকে। পোষ্ট অফিসের পিওন নির্মল বাবু বহু কষ্টে তার ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছেন।
আজ শিমূল সাতাশ বছরের যুবতী। নির্মল বাবু রোগাগ্রস্থ- শয্যাগত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি শুধু শিমূলকে দেখেন আর ভাবেন- 'ছোট্ট শিমুটা আজ কত্ত বড়ো হয়ে গেছে!' এবার একটা ভালো ছেলে দেখে শিমূলের বিয়েটা দিতে পারলেই তাঁর শান্তি।
কিন্তু শিমূল, তার কি ইচ্ছে?
জীবন নদীর নৌকা সে একাই বয়ে নিয়ে চলেছে। এক একটা ঘাট এসেছে আর তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জীবনটা ঠিক কি!
একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে শিমূল।
মাসের শেষে ওই কটা টাকায় ভাইয়ের পড়াশোনা, বাবার ওষুধ, সংসারের যাবতীয় খরচ সত্যিই চলে না ---- চালিয়ে নেয় কোনোভাবে। সে যদি আজ বিয়ে করে চলে যায় তাহলে ভাইকে কে পড়াবে? বাবাকে কে দেখবে? মা চলে যাওয়া র আগে ছুঁয়ে কথা দিয়েছিল - ভাইকে সে মানুষের মতো মানুষ করবে। তাই স্বার্থপরের মতো চলে যেতে পারে না। মা'কে দেওয়া কথা শিমূল রাখবে।
মানব মনের জটিলতা কে বোঝে! মানুষ কি নিজেও জানে সে কি চায়? দায়িত্ব - কর্তব্য - ভালোবাসা - স্নেহ - রাগ - হিংসা - বিদ্বেষ ---- এসব কিছুর বাইরেও আরও একটা যেন কিছু থাকে! একটা অন্য কিছু, যেন অপর কেউ একজন, যেন অচেনা একটা জগত!!! মানবিকতার খাতিরেই আমরা যা কিছু ভালো তাকে সমর্থন করি ; আর খারাপকে জীবনে স্থান দিতে চাই না। কিন্তু একটু অনবধানতা - একটু অন্যমনস্কতা - একটু আবেগ - একটু ক্লান্তি যখন আসে তখন 'সে' যেন দরজায় এসে টোকা মারে! কাছটিতে বসে যেন 'অন্য' কোনো গল্প শোনায়।
শিমূলের দরজায় হয়তো আজ 'সে' কড়া নেড়েছে। পাশে বসে যেন গল্প বলা শুরু করেছে। বৃষ্টির ঝাপটা চোখে মুখে এসে লাগে। 'তার' বলা গল্পের হাত ধরে শিমূল চলে যায় 'অন্য' জগতটাতে। যেন শুনতে পায় সানাইয়ের আওয়াজ। তার নিজের বাড়িটা সেজে উঠেছে নানান রকমের রঙিন ফুলে। সারা বাড়িতে হইচই - আলো। ওই তো পাশের বাড়ির বিনু কাকিমা বরনডালা সাজাচ্ছে, রামু কাকু তদারকি করছে, এই তো সুলেখা রমা তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। ওই দূরের চেয়ারটায় বসে বাবা হাসিমুখে গল্প করছে। ভাই অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। ভাইটা কতো বড়ো হয়ে গেছে!
মণিপুরি হার, হাতে মায়ের দুটো বালা শাঁখা-পলা, আলতা-নুপূর, কানে কানপাশা, চোখে কাজল, কপালে চন্দন, ঠোঁটে লিপস্টিক ---- 'এই কি সেই আমি!' নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই আর বিস্ময়ে চোখ ফেরাতে পারে না শিমু। সম্পূর্ণ নতুন রূপে আজ সে রূপবতী।
হঠাত্ একটা গুঞ্জন ---- 'বর এসে গেছে-' বুকের ভেতরটা কেমন দুরদুর করে ওঠে শিমূলের। খানিকটা ভয় - কিছুটা আনন্দে কেমন যেন একটা শিহরন খেলে যায় সারা শরীর জুড়ে। রমা কাছে এসে ডাকতে থাকে ---- 'শিমু এবার ওঠ, ছাতনা তলায় যেতে হবে, শিমু ... শিমু ...'
---- 'শিমু ... কি রে, তখন থেকে ডাকছি তোকে। পুরো ভিজে গেছিস তো। উঠে জানালাটা বন্ধ করে জামাটা ছেড়ে নে। রান্না করবি না? তোর রান্নাঘরটা অন্ধকার দেখে আমি ছুটে এলাম। ভাবলাম তোর শরীর খারাপ করল নাকি! এসে দেখি তুই এখানে বসে আছিস। কি রে মা, তোর শরীর ঠিক আছে তো রে?'
---- 'হ্যাঁ গো বিনু কাকিমা, আমি ঠিক আছি। ওই চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল।'
---- 'বুঝি রে মা। আমি তো তোর মায়ের মতো, তোর অবস্থাটা আমি বুঝি। কিন্তু কি করবি বল! তোর উপর তোর বাবা আর ভাইয়ের দায়িত্ব যে মা। কি আর করবি!'
প্রকৃতি-যৌবনকে সেই ঝড় যেন দুমড়ে-মুচড়ে পায়ের তলায় ফেলে মাততে চায় বিজয়ী উল্লাসে! তবুও, প্রকৃতি দাঁড়িয়ে থাকে আপন মর্যাদায়। নিঃশেষিত হতে হতেও আবার উঠে দাঁড়ায়। জগত সংসারকে বাঁচানোর এক দুরন্ত প্রতিশ্রুতিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে!
---- পশ্চিম দিকে খোলা জানালার পাশে বসে শিমূল ভাবতে থাকে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। সতের বছর আগে এইরকমই প্রচন্ড ঝড়ের একটা রাত ছিল। মায়ের মাথাটা কোলে রেখেই মা'কে হারিয়েছিল সে চিরতরে! ভাই তখন চার বছরের মাত্র। পুতুলের সংসার বসানোর জায়গায় বাস্তব সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল তার কাঁধে। চার বছরের একটা পুতুলকেই যেন একটু একটু করে বড়ো করতে লাগল। সমাজ-সংসারে সৎ মায়ের ভূমিকাটা যে কিরকম তা শিমূলের বাবা নিজের জীবনে দেখেছেন। তাই আর ওই নরক যন্ত্রনা তিনি দিতে চাননি শিমূল ও তার ভাইকে। পোষ্ট অফিসের পিওন নির্মল বাবু বহু কষ্টে তার ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছেন।
আজ শিমূল সাতাশ বছরের যুবতী। নির্মল বাবু রোগাগ্রস্থ- শয্যাগত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি শুধু শিমূলকে দেখেন আর ভাবেন- 'ছোট্ট শিমুটা আজ কত্ত বড়ো হয়ে গেছে!' এবার একটা ভালো ছেলে দেখে শিমূলের বিয়েটা দিতে পারলেই তাঁর শান্তি।
কিন্তু শিমূল, তার কি ইচ্ছে?
জীবন নদীর নৌকা সে একাই বয়ে নিয়ে চলেছে। এক একটা ঘাট এসেছে আর তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জীবনটা ঠিক কি!
একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে শিমূল।
মাসের শেষে ওই কটা টাকায় ভাইয়ের পড়াশোনা, বাবার ওষুধ, সংসারের যাবতীয় খরচ সত্যিই চলে না ---- চালিয়ে নেয় কোনোভাবে। সে যদি আজ বিয়ে করে চলে যায় তাহলে ভাইকে কে পড়াবে? বাবাকে কে দেখবে? মা চলে যাওয়া র আগে ছুঁয়ে কথা দিয়েছিল - ভাইকে সে মানুষের মতো মানুষ করবে। তাই স্বার্থপরের মতো চলে যেতে পারে না। মা'কে দেওয়া কথা শিমূল রাখবে।
মানব মনের জটিলতা কে বোঝে! মানুষ কি নিজেও জানে সে কি চায়? দায়িত্ব - কর্তব্য - ভালোবাসা - স্নেহ - রাগ - হিংসা - বিদ্বেষ ---- এসব কিছুর বাইরেও আরও একটা যেন কিছু থাকে! একটা অন্য কিছু, যেন অপর কেউ একজন, যেন অচেনা একটা জগত!!! মানবিকতার খাতিরেই আমরা যা কিছু ভালো তাকে সমর্থন করি ; আর খারাপকে জীবনে স্থান দিতে চাই না। কিন্তু একটু অনবধানতা - একটু অন্যমনস্কতা - একটু আবেগ - একটু ক্লান্তি যখন আসে তখন 'সে' যেন দরজায় এসে টোকা মারে! কাছটিতে বসে যেন 'অন্য' কোনো গল্প শোনায়।
শিমূলের দরজায় হয়তো আজ 'সে' কড়া নেড়েছে। পাশে বসে যেন গল্প বলা শুরু করেছে। বৃষ্টির ঝাপটা চোখে মুখে এসে লাগে। 'তার' বলা গল্পের হাত ধরে শিমূল চলে যায় 'অন্য' জগতটাতে। যেন শুনতে পায় সানাইয়ের আওয়াজ। তার নিজের বাড়িটা সেজে উঠেছে নানান রকমের রঙিন ফুলে। সারা বাড়িতে হইচই - আলো। ওই তো পাশের বাড়ির বিনু কাকিমা বরনডালা সাজাচ্ছে, রামু কাকু তদারকি করছে, এই তো সুলেখা রমা তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। ওই দূরের চেয়ারটায় বসে বাবা হাসিমুখে গল্প করছে। ভাই অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। ভাইটা কতো বড়ো হয়ে গেছে!
মণিপুরি হার, হাতে মায়ের দুটো বালা শাঁখা-পলা, আলতা-নুপূর, কানে কানপাশা, চোখে কাজল, কপালে চন্দন, ঠোঁটে লিপস্টিক ---- 'এই কি সেই আমি!' নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই আর বিস্ময়ে চোখ ফেরাতে পারে না শিমু। সম্পূর্ণ নতুন রূপে আজ সে রূপবতী।
হঠাত্ একটা গুঞ্জন ---- 'বর এসে গেছে-' বুকের ভেতরটা কেমন দুরদুর করে ওঠে শিমূলের। খানিকটা ভয় - কিছুটা আনন্দে কেমন যেন একটা শিহরন খেলে যায় সারা শরীর জুড়ে। রমা কাছে এসে ডাকতে থাকে ---- 'শিমু এবার ওঠ, ছাতনা তলায় যেতে হবে, শিমু ... শিমু ...'
---- 'শিমু ... কি রে, তখন থেকে ডাকছি তোকে। পুরো ভিজে গেছিস তো। উঠে জানালাটা বন্ধ করে জামাটা ছেড়ে নে। রান্না করবি না? তোর রান্নাঘরটা অন্ধকার দেখে আমি ছুটে এলাম। ভাবলাম তোর শরীর খারাপ করল নাকি! এসে দেখি তুই এখানে বসে আছিস। কি রে মা, তোর শরীর ঠিক আছে তো রে?'
---- 'হ্যাঁ গো বিনু কাকিমা, আমি ঠিক আছি। ওই চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল।'
---- 'বুঝি রে মা। আমি তো তোর মায়ের মতো, তোর অবস্থাটা আমি বুঝি। কিন্তু কি করবি বল! তোর উপর তোর বাবা আর ভাইয়ের দায়িত্ব যে মা। কি আর করবি!'
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০৫/১২/২০১৮বেশ তো!