রাখী
প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল করনার বদৌলতে একদম ঘরে বসেই নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছি। কারো সাথে কোনো দেখা সাক্ষাত নেই, কেউ আমার বাড়িতে আসে না, আসে না মানে কেউ আসুক তেমনটিও মনে আসে না। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ছেলেদের বউদের প্রবল আপত্তি -তুমি বাড়ি থেকে একদম বের হবে না। না জানি করনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি।
তবে সময় যে একদম বিশ্রীভাবে কাটছিল তা নয়। টেলিভিশনের ইউটিউবে সেই পুরাতন দিনের বেতার নাটক আর সিনেমার গান এসব দেখেশুনে সময় কখন যে সকাল থেকে রাত্রি হয়ে যেত তা খুব একটা মালুম হতো না। এই অবিমিশ্র দিন- রাত্রিতে কখনো সংগীত অনুশীলন করে, কখনো কবিতা লিখে সময় পার হচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ করে ছেলেরা, বউ'মারা আমায় কবিতা গল্প লেখার উৎসাহ দেয়ায় জীবন পঞ্জিতে হাতরাচ্ছিলাম কোন গল্পের সূত্রপাত বা কাহিনী নিয়ে। কিন্তু কিছুতেই সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খাচ্ছিলাম, হাঁটছিলাম, বাথরুম করছিলাম- কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই একটা ঘোর ছিল কোন একটা গল্পের প্লট পাওয়ার দারুণ অন্বেষণে।
মনে পড়ে গেল অনেক কাল আগের একটা ঘটনার কথা। ১৯৭১ সাল। আমি তখন তরুণ বয়সের ছাত্র। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেব, এর মধ্যে দেশে শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাকিস্তানি বর্বর মিলিটারিরা এককোটি লোকজনকে দেশ ছাড়ার মত্তখেলায় মেতে উঠল। আমরা সপরিবারে জলপাইগুড়িতে জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে গিয়ে একদম কপর্দকহীন অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নিলাম। সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ আগুনে ভষ্মিভূত হওয়ার বেদনায় বাবার চোখে যখন সজল মেঘ ঘনিয়েছে আমার মনে তখন আনন্দ এই ভেবে যে এবার নতুন দেশ দেখা হবে। স্বপ্নের উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখা যাবে। যখন পূর্ব পাকিস্তান বর্ডার অতিক্রম করলাম তখন মনে দারুন এক পুলক অনুভব করলাম।
এখন এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে বেশ ভালই লাগে। বেদনা কখনো মধুর হয় - কষ্টের দিনগুলিতেও প্রিয় ভাবনার অনুষঙ্গ হয় স্মৃতির পাতা গুলো। স্মৃতির পাতাগুলো ধূসরতার রূপ নিলেও যে একাকী মুহূর্তে সেই স্মৃতির পাতা এমন ঔজ্জলতায় ভরে ওঠে যে সেই মলিন পাতাগুলির কাতরতায় মন বারবার কেঁপে উঠে।
আমার জ্যাঠামশায় পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর ভারতবাসী হন। সেখানে মুদির দোকান করে সংসার চালান। আমাদের এই পরিবারের ভরণ পোষণ করা তার খুব একটা সাধ্যের মধ্যে ছিল না। না থাকলেও ভাতৃত্বের কোন কমতি ছিল না। আমার বাবাকে খুবই ভালবাসতেন, পছন্দ করতেন খুবই। দুই ভাই এক বিছানায় ঘুমোতেন- দুই ভাই একসাথে দোকানে বসে ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। রাতে ঘুমানোর আগে তাদের পূর্ব ইতিহাস গল্প করে আমাদের শোনাতেন । এভাবে গল্প শোনানোর এক রাত্রিতে জ্যাঠামশাই বাবা কে উদ্দেশ্য করে বললেন , 'আর বাংলাদেশে গিয়ে কাজ নেই এখানেই থেকে যা, ব্যবসাপাতি শুরু করে দে। বাড়ির পাশেই কয়েক শতক জমি পড়ে আছে ওখানে ঘরবাড়ি করে নে।' জ্যাঠামশায় দীর্ঘ ২৩ বছর ভারতবাসী হলেও বাংলাদেশের ভাষা ভোলেন নাই । বাবা একটু বিচলিত হয়ে বললেন
-'এখানে থেকে আমি কি করবো? টাকা পয়সা কিছুই নেই, কি দিয়ে ব্যবসা শুরু করব? দেশে ফিরে গেলে অন্তত সবার সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করতে পারব। এখানে থেকে গেলে জীবন নতুন করে শুরু করতে হবে। শুরু করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যাবে। আমার যা বয়স হয়েছে ওখানে গেলে আছাড় খাওয়ার অবস্থা থেকেও জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। আমি হিন্দু হলেও মুসলমানরা আমাকে খুব মান্য করে।'
দুই ভাইয়ের আন্তরিকতার মধ্যে দিনগুলি ভালই কাটছিল। আমিও জেঠাতো ভাই বোনদের স্নেহ ভালবাসায় গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়ে সপ্তাহে একদিন শরনার্থীদের জন্য ভারত সরকারের সাহায্য রেশন তুলে দিন পার করছিলাম।
ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েক মাস পার হয়েছে। নিত্য নতুন সাফল্যের খবর ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অতি আসন্ন এ কথা চাউর হয়েছে ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে। কোথাও ভারতীয়রা বসে আড্ডা দিলেই কথা ওঠে
- ' দাদা বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। তা দাদা ইলিশ পাবতো!'
- 'পাবেন না কেন?' - বলে ওঠি।
- 'না এই যে কষ্ট করছি, আপনারা খুব সহজেই ভুলে যাবেন কিনা'
-' আপনারাও তো একসময় অনেকেই পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন আপনারা যদি ভুলে না নিয়ে থাকেন'
কথা সমাপ্ত হল না। চেপে গেলাম। এ মুহূর্তে পরিবেশ উত্তপ্ত করা সুবিবেচনার কাজ নয় তাই আর কথা বাড়ালাম না। তখন ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানকে তথা বাংলাদেশকে জয়বাংলা বলতো। কোন বাঙালি দেখলেই তাকে জয় বাংলা বলে সম্বোধন করত। যে পাড়াতে থাকতেম তা জলপাইগুড়ি শহরের শহরতলি এলাকা - মূল শহরের প্রান্তভাগে। ও পাড়ায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশ থেকে গিয়ে উঠেছে। আমি জয়বাংলা থেকে এসেছি শুনে আশেপাশের অনেক বাড়ির লোকজন আগ্রহ করে আমাকে ডেকে নিয়ে এখানকার অবস্থার কথা শুনতে চায়। পাক বাহিনীর লোকদের অত্যাচারের কথা শুনতে চায়। সে সময়ের বর্ণনায় তাদেরও মন ভারি হয়ে যেত। এভাবে মহিলা মহলে - অন্দরমহলে মহিলাদের কাছে আমি কিছুটা বাড়তি আদর স্নেহ পেতে থাকি। আমার জ্যাঠাতো দুই বোন যখন বিকেলে কোন পার্শ্ববর্তী বাড়িতে আড্ডা দিতে বেড়াতে যেত সঙ্গে করে আমাকে নিয়ে যেত। কারণ আমাকে নিয়ে গেলে জয় বাংলার গল্প হবে এবং আসর ও জমবে এই ভেবে।
কিছুদিন এভাবে সেভাবে যাওয়া আসার ফলে পাড়ার কিশোর বয়সের কয়েকজন মেয়েদের সাথে পরিচয় হয়ে গেল। এদের মধ্যে তনু, রিয়া, রাখী, সাথী। এ ছাড়াও আরও কয়েকজন যাদের নাম এখন আর মনে আসে না। এরা সকলেই কেউ আমার বয়সি, আবার কেউ আমার থেকে দুই এক বছরের ছোট হবে। এদের কেউই আমার নাম ধরে ডাকতো না। আমার বোনরা আমাকে 'ফুলভাই' - 'ফুলদা' বলে ডাকত বলে ওরাও কেউ আমাকে ফুল ভাই, কেউ ফুলদা বলে ডাকতো।
রাখি'রা এক ভাই এক বোন। এদের পৈত্রিক ভূমি বাংলাদেশে। বাবা ছাড়া সকলেই '৭১ পূর্ব ভারতবাসী হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা ও মা ভারতে চলে যায়। বাবা বাংলাদেশে থাকাকালে আমার জেলা, তখন মহুকুমা শহর গাইবান্ধাতে বাস করত সেই সূত্রে রাখীর পরিবার আমাকে বিশেষ খাতির করত। রাখীও আমাকে ফুলদা বলে ডাকত। আমিও রাখীর মধ্যে এক সহজাত টান অনুভব করলাম। ছিপছিপে গড়ন, খুব আকর্ষণীয় চেহারা না হলেও মুখমন্ডলে- চোখ দুটিতে মায়াভরা লক্ষনীয় ছিল ।
বিকেল হলেই আমার বোনদের সাথে নিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বৈকালিক হাঁটা ব্যায়াম আমার কিছুটা নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তখন মাঝে মধ্যে ওদের সাথে দেখা হয়ে যেত। এ বয়সের ছেলেরা মেয়েদের মধ্যে পড়লে গল্পগুজবে অনেকটা আরষ্ট হয়ে থাকে, ফলে মাঝেমধ্যেই মেয়েদের কাছ থেকে বাঁকা কথা, কখনো বা জয়বাংলার গোবেচারা লাজুক ছেলে বলে টিটকারি শুনতে হতো। তবে আমার পক্ষ নিয়ে আমার বোনেরা তার জবাব দিত কখনো কখনো। একদিন সকলে মিলে সিনেমা দেখতে যাবে বলে ঠিক করলো। আমার জেঠাতো বড় বোন নীলুদিকে আমাকে সাথে নিয়ে যাবার কথা বললে নিলুদি তাতে সম্মতি দেয় এবং আমাকে জানায় তারা আমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবে। হঠাৎ এই ধরনের প্রস্তাবে ভরতে গেলেও ভারতীয় সিনেমা দেখার আনন্দে রাজি হয়ে গেলাম। ততদিনে সবাই আমরা একে অপরকে তুমি বলে সম্বোধন করা শুরু করেছি।
সিনেমা দেখতে গিয়ে টিকিট কাটার সময় রিয়া বলে বসল - 'আজ ফুলদা আমাদের সকলের টিকিট কাটবে।' কথা শুনে সকলেই হাসিতে ফেটে পরলো। অনুভব করলাম অনেকগুলো বিড়াল যেমন একটি ইঁদুরকে নিয়ে খেলায় মত্ত হয় আমাকে একা পেয়ে ওরা সকলেই হেনস্থা করার, বোকা বানানোর খেলায় মেতে উঠেছে।
মুহুর্তেই আমার কান গরম হয়ে গেল। বোকা বনে যাওয়া এবং সকলের খেলার পাত্র হওয়ার লজ্জাতে আমার সিনেমা দেখার আনন্দে ভাটা পড়ে। ওই মুহূর্তে আমার কাছে সকলের টিকিট কাটার মত টাকাও ছিল না। বাস্তবতা হলো সবকিছু সহ্য করে যাওয়া। তাই নীরব থেকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলাম। ওদের ধমক দিয়ে আমার পক্ষ নিয়ে নিলুদি বলল-'ও জয়বাংলা থেকে এসেছে, পয়সা পাবে কোথা থেকে? তোরা এভাবে আমার ভাইকে ছোট করবি জানলে ওকে নিয়ে আসতাম না' দিদি এ কথা বলাতে সকলেই চুপ হয়ে গেল। শেষতক যে যার টিকিট কেটে হলে ঢুকলাম। সিনেমা দেখে সকলে মিলে গল্প করতে করতে হেঁটেই রওনা দিলাম। মাঝপথে রাখী আমাকে একা পেয়ে বলল,- ' তুমি রাগ করেছো? রিয়ার ওভাবে তোমাকে ও কথা বলা ঠিক হয় নাই তুমি কিছু মনে করো না'। আমি চুপ করে থাকলাম। কথায় কথা বাড়বে তাই নিশ্চুপ থাকলাম।
রাজপথে কয়েকজন মিলে কিশোরী মেয়েরা একত্রে হাঁটলে তাদের মধ্যে গল্পের ঝাঁপি খুলে যায়। রাস্তায় একসারিতে হাঁটতে থাকে। মনেই থাকে না অন্যকেউ ওই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করে। পিছন থেকে কোন পথচারী দ্রুত হেঁটে গিয়ে তাদের ক্রস করার চেষ্টা করেও দু-এক বারের চেষ্টায় সফল হয় না। বাধ্য হয়ে 'একটু রাস্তা দাও' - না বললে হুস 'ই হয় না একপাশ ছেড়ে চলতে হবে। রাস্তায় হাঁটতে কিশোরী মেয়েরা একটু বেশি বেপরোয়া থাকে। গল্পে গল্পে একে অন্যের উপর হাসতে হাসতে হুমরি খেয়ে পড়ে। উচ্ছলতায় সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। কখনো পায়ে পায়ে হোঁচট খেয়ে হুমরি খেয়ে পড়ার জোগাড় হলে চিৎকার করে 'ও মাগো' বলে অন্যের গায়ের উপর জড়িয়ে ধরে।
-'আচ্ছা ফুল দা তুমি তো কলেজে পড়ো কলেজ কতদূর গো'- রিয়া প্রশ্ন করে ।
-'খুব একটা দুর নয়, হেঁটেই কলেজে যাওয়া যায়'
-'তোমরা ছেলেরা মেয়েরা একসাথে ক্লাশ করো?'- জিজ্ঞাসা করে।
-'হ্যাঁ'
-'তোমার ক্লাসে কতজন মেয়ে গো?'
-' কখনো গুনে দেখিনি, তবে জনাবিশেক তো হবেই'।
-' মেয়েরা সামনে বসে না সাইডে বসে?' - প্রশ্নের মধ্যে একটা দুষ্টুমি হাসি জড়িয়ে আড়চোখে তাকিয়ে তনু জিজ্ঞাসা করে।
সাথে সাথে রিয়া বলে উঠলো,
-'আচ্ছা ফুলদা, তুমি নাকি ভালো ছাত্র, কবিতা লেখ, গান জান, বলতো - 'ঙ' এর মাথাটা অমন গোলমেলে পেঁচানো কেন'?
একথা শুনে আবার সকালে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
-'যাঃ তোরা ভারি ফাজিল। ওকে একা পেয়ে যা নয় তাই করছিস'।
নিলুদিএকটা চাপড় মেরে ধাক্কা দিল। ঠিক সেই সময় পিছন দিক থেকে এক সাইকেল এসে তনুকে ধাক্কা দিল। আর একটু হলেই হুমরি খেয়ে আঘাত পেতে পারতো। তনু রেগে গিয়ে -
-'দেখে সাইকেল চালাতে পারেননা? মেয়েদের গায়ে ধাক্কা লাগানো, বদমাইশি?'
ভারতীয় মেয়েরা তা সে মহিলা যুবতী কিংবা কিশোরী যেই হোক, ছেড়ে কথা বলতে কম জানেনা। মেয়েদের মধ্যে একটা প্রতিবাদী সত্তা আছে। শুনেছি, মেয়েদেরকে কেউ তেমন অশোভন আচরণ দেখালে পা থেকে চপ্পল খুলে অমনি মেরে বসে। তাই নিজেও এ ব্যাপারে একটু সজাগ থাকতাম। যতটা ওদের থেকে দূরে থাকা যায়। সাইকেল-আরোহী যুবক গোছের ছিল। অমনি সাইকেল থেকে নেমে পড়ল।
-' রাস্তা কি তোমার বাবার? সমস্ত রাস্তাজুড়ে হাঁটছো, ধাক্কাধাক্কি করছো, সিনেমার নাচ দেখাচ্ছ। আমি ধাক্কা লাগিয়েছি না তুমি আমার সাইকেলে ধাক্কা লাগিয়েছো? ভদ্রভাবে রাস্তা দেখে চলতে পারো না?'
এক নিঃশ্বাসে বলে মেজাজ দেখালো। বুঝলাম ছেলেটিও কম নয়। যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল। মনে মনে বেশ একটু আনন্দ পেলাম। আমাকে ঠাট্টা মশকরা করার একটা ফল পেয়েছে। ঘটনাটা আর বেশিদূর এগোতে পারলোনা। বড়দির হস্তক্ষেপে তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা মিটে গেল। কিন্তু সেই ঘটনার একটা ভালো ফল আমার ঝুলিতে এসে পড়ল। আমাকে নিয়ে হাসাহাসির পরিবেশটা চুপসে গেল। সকলেই প্রসঙ্গ বদল করে অন্য প্রসঙ্গ ধরল। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছে এসে পড়েছি। সেদিনের মত যে যার বাড়িতে চলে গেল।
এর কিছুদিন পরেই একদিন বিকেলে বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে হাটছি। অক্টোবরের বিকেল। গরমের তীব্রতা কমে গেছে। পাশের বাড়ির এক কোণে ঝোপের মধ্যে থেকে ফুলের সুবাস চারিদিকে ছড়িয়েছে। মনের অজান্তেই রবীন্দ্র সংগীতের সুর গুনগুন করছি। এমন সময় ফেরা পথে রাখীর সাথে দেখা। ওর বাড়ির সামনে খোলা গেটের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বোধহয় বিকেলের হাওয়া খাওয়ার জন্য বাড়ির বাহিরে এসেছে।
-' কেমন আছো ফুলদা?'
-' আছি, বেশ আছি, তুমি কেমন আছো?'
-' আর কেউ নেই সাথে কেন?'
-' আমি একাই বেরিয়েছি '
-' চল ওদিক থেকে হেঁটে আসি' - বলে আমার সাথে হাটতে শুরু করলো। আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। কে কী মনে করবে, সাত-পাঁচ ভেবে।
-' বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলে তোমরা তো দেশে চলে যাবে'
-' কেন তোমরা যাবে না?'
-' না, বাবা আর ফিরে যাবে না, এখানেই থেকে যাবে।'
আমরা ফিরে যাব একথা শুনে মুখের ভাব টা কেমন যেন এক বিষাদঘণ মলিনতায় ভরে গেল তা আমার চোখ এড়িয়ে গেল না।
-' কেন চলে গেলে তুমি কষ্ট পাবে?' - ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাটা। হঠাৎ এরকম কথা মুখে আসবে কখনো ভাবি নি। বাজে কোনো উত্তর শুনতে হয় কিনা লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল।
-' না, তা ঠিক নয়। তবে আমরা এক জায়গার কিনা। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। অনেকদিন গল্পগুজবে বেশ কাটছিল, চলে গেলে আর কোনদিন দেখা হবে না। ভিন্ন দেশ, আসা-যাওয়ার কত রেস্ট্রিকশন। আমাদের কথা আর কেন মনে রাখবে।'
-' না, তা ঠিক না।'
-' জান, গত পরশুদিন আমি, রিয়া, তনু মিলে গল্পে গল্পে তোমার কথা হচ্ছিল।'
-' লজ্জার কথা, আমাকে নিয়ে কি কথা হচ্ছিল!খারাপ কোন কিছু? তোমাদের সাথে কোন খারাপ কিছু হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।'
-' না- না, বাজে কিছু তো নয়'ই বরং ভাল কথাই হচ্ছিল। সকলে বলাবলি করছিল, জয় বাংলার ছেলে তো বেশ নরম, আর সরল। মুখ তুলে কথা বলতে জানে না।
সেদিন বয়স ছিল অল্প। সব কিছু বোঝার ক্ষমতা তখন আমার তেমন ছিল না। মানুষের মন সে তো কঠিন জটিল বিষয়। পড়ন্তু নারীদের মন।
রবীন্দ্রনাথ দেবযানীর মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছিলেন, 'রমনীর মন, সহশ্র বৎসরের সখা সাধনার ধন'। দিনরাত্রি হিসেব-নিকেশ করা যায় - চন্দ্র-সূর্যের মহাজাগতিক সম্পর্ক পরিগননা করা যায় - মহাবিশ্বের লক্ষ-কোটি বৎসরের দুরত্বের আপেক্ষিকতা নির্ণয় সম্ভব। কিন্তু সেদিনের সেই সামান্য দূরত্বটুকু পরিমাপ করার মত সাধ্য আমার ছিলনা। কারো জানা নেই। কেউ পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। পারা যায় না। কেউ পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস হয়না আবার কেউ কোনদিন পারবে তাও বিশ্বাস হয় না।
সন্ধ্যার গোধূলি আভা প্রকৃতির উপর ছড়িয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এসেছে। সামনে অদূরেই এক খেকি কুকুর কেউ-কেউ ঘেউ-ঘেউ করতে করতে এপাশ থেকে এক অনিবাসী কুকুরকে তাড়া করল। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে সন্ধ্যার ধূপ প্রদীপের মোহনীয় গন্ধ ভেসে আসছে। সঙ্খ আর উলুধ্বনিতে দিবসের বিদায় বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে। চারিদিকের ছোট ছোট ঝোপঝাড় থেকে - বাসের আঁরা থেকে ঝিঁঝিঁ পোকারা মনের আনন্দে উল্লাস শুরু করেছে।তখন আমার কানে এই ঝিঁ ঝিঁ ডাক বড়ই বেমানান লাগছে। এ যেন চিৎকার। কানে তালা লাগিয়ে দেয়া চিৎকার ধ্বনি কেবল'ই বেজে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন আমাকে উপহাস করছে। কিছু একটা বোঝার অবস্থা থাকলেও তা স্পষ্ট করে মনে আসছেনা। চোখের দৃষ্টি যেমন আবছা আবছা লাগে, মনের অবস্থাও তেমনই অনির্বচনীয় কুয়াশাঘন। একটু দূরে পাশের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা গানের টিচার রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাচ্ছে - ' মধুরও তোমার শেষ যে না পাই'। পিছনে এসে নিলুদি আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, 'চল, বাড়িতে চল।'
ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী পরাজিত হলো। এবার দেশে ফিরে যাব। দেশে ফিরে যাবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। কবে, কখন, কিভাবে, কে কে যাবে তার একটা পরিকল্পনা নিয়ে সকলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। আমার মনেও দেশে ফেরার আনন্দ-দোলা শুরু হয়েছে। তা সত্ত্বেও পিছনের দিনগুলির কথা ফিরে ফিরে মনে আসছে।
দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। নতুন বছরেরই বাংলাদেশে চলে আসবো। প্রথমে আমি আর বাবা পরে পরিবারের আর সকলে যাবে। নানাবিধ প্রস্তুতির মধ্যে দিন কাটছিল। কিছু কেনাকাটা আছে - তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা হলো। বাংলাদেশে আসার জন্য একটা ট্যাক্সি ঠিক হয়ে গেছে। তবে আমাদের সাথে আমার দুই জ্যাঠাতো দাদাও ওই ট্যাক্সিতেই বাংলাদেশে যাবে, আবার ওই ট্যাক্সিতেই ভারতে ফিরে আসবে। সেদিন ছিল ২ ফেব্রুয়ারি, বুধবার। সকাল সকাল রওনা দিতে হবে। অনেকটা পথ, তারপর বিধ্বস্ত দেশের রাস্তাঘাট- কোথায় কেমন কি অবস্থায় আছে তা জানা নেই। ডোমার-নীলফামারী-সৈয়দপুর রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরা। সকাল-সকাল ট্যাক্সি এসে গেছে। বাড়ির গেটে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড করানো। মালামাল তোলা হচ্ছে। বাড়ির লোকদের সকলের মন বিষাদঘন। জ্যাঠামশাই, জেঠিমা অন্যান্য ভাই-বোনদের কারো কারো চোখে জল। বাবা আমি জামা কাপড় পড়ে রেডি হয়ে গেছি। সেদিনটা রাখী পূর্ণিমার দিন ছিল না। বাড়ির গেট থেকে ১০০ বা ১৫০ গজ দূরেই একটা বাঁশ বাগানের নিচে রাখী দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে পেলাম। পরনে লাল স্কার্ট। হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে ডাক দিল। যন্ত্রচালিত হয়ে সামনে পা বাড়ালাম। এগিয়ে গেলাম। রাখীর সামনে দাঁড়ালাম। রাখীর মুখটা বিষাদ ঘন। হাতে কি যেন একটা বস্তু দেখতে পেলাম।
-' তুমি ডাকছিলে?'
-'হ্যাঁ'
-' কখন যাবে?'
-' এই তো সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, মালপত্র সব তোলা হয়ে গেছে।'
-'তোমার সাথে আর কখনো দেখা হবে না হয়তো'। আমাকে মনে রেখো। দেখি তোমার হাতটা।'
-' কেন বলতো?'
সংকোচ আর লজ্জায় আরষ্ট হওয়ার উপক্রম। এ মুহূর্তে এরকম দুজনকে একা দেখলে সকলেই কিছু না কিছু মনে করবে এই ভেবে এক পা পিছিয়ে গেলাম। রাখী এগিয়ে এলো। আমি যতটুকু পিছিয়ে ছিলাম ততটুকু এগিয়ে এলো। কেন জানি এই মুহূর্তে রাখীকে বেশি সাহসী মনে হল।
-' আহা, হাতটা দাওনা।'
ওর এগিয়ে আসা আর দ্বিতীয়বার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আজ্ঞাতে মাথায় কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। একটু দূরেই বাড়ির গেট। আরও কিছুটা দূরে রাস্তার উপর তনু, রিয়া মিলে আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে আমাদের বাংলাদেশে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে। ওরাও তো আমাদের দুজনের বাশ তলায় দাঁড়িয়ে গল্প করা দেখছে।
আবার প্রশ্ন করলাম, -'কেন? কি হবে?'
এবার নিজেই এগিয়ে এসে আমার হাতটা টেনে নিয়ে ডান হাতে একটা সুন্দর রাখী পরিয়ে দিল। রাখী যখন বেঁধে দিচ্ছিল তখন লক্ষ্য করলাম ওর মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
-' এই রাখী তোমার জন্য আগেই কিনে রেখেছি। সময়-সুযোগ করে উঠতে পারিনি। তোমাকে আজ ভাইয়ের বন্ধনে বেধে রাখলাম গো। কোনদিন ভুলে যেও না।'
বলে সামনে ঝুঁকে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো।
যে বন্ধনে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান দুটি জাতিকে ভাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন, সেই বন্ধনে দুটি তরুণ হৃদয় বাঁধা পড়লো কিনা তা জানি না। তবে, একটা গভীর ছাপ যে হৃদয়ে স্থিতি হয়ে গেল প্রতিবছর রাখী পূর্ণিমা আর ভাতৃ দ্বিতীয়া এলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
"বিষাদের অশ্রু জলে নিরবের মর্মতলে
গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নতুন বাণী ।
ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।।"
--- ::: ----
তবে সময় যে একদম বিশ্রীভাবে কাটছিল তা নয়। টেলিভিশনের ইউটিউবে সেই পুরাতন দিনের বেতার নাটক আর সিনেমার গান এসব দেখেশুনে সময় কখন যে সকাল থেকে রাত্রি হয়ে যেত তা খুব একটা মালুম হতো না। এই অবিমিশ্র দিন- রাত্রিতে কখনো সংগীত অনুশীলন করে, কখনো কবিতা লিখে সময় পার হচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ করে ছেলেরা, বউ'মারা আমায় কবিতা গল্প লেখার উৎসাহ দেয়ায় জীবন পঞ্জিতে হাতরাচ্ছিলাম কোন গল্পের সূত্রপাত বা কাহিনী নিয়ে। কিন্তু কিছুতেই সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খাচ্ছিলাম, হাঁটছিলাম, বাথরুম করছিলাম- কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই একটা ঘোর ছিল কোন একটা গল্পের প্লট পাওয়ার দারুণ অন্বেষণে।
মনে পড়ে গেল অনেক কাল আগের একটা ঘটনার কথা। ১৯৭১ সাল। আমি তখন তরুণ বয়সের ছাত্র। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেব, এর মধ্যে দেশে শুরু হয়ে গেল স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাকিস্তানি বর্বর মিলিটারিরা এককোটি লোকজনকে দেশ ছাড়ার মত্তখেলায় মেতে উঠল। আমরা সপরিবারে জলপাইগুড়িতে জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে গিয়ে একদম কপর্দকহীন অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নিলাম। সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ আগুনে ভষ্মিভূত হওয়ার বেদনায় বাবার চোখে যখন সজল মেঘ ঘনিয়েছে আমার মনে তখন আনন্দ এই ভেবে যে এবার নতুন দেশ দেখা হবে। স্বপ্নের উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখা যাবে। যখন পূর্ব পাকিস্তান বর্ডার অতিক্রম করলাম তখন মনে দারুন এক পুলক অনুভব করলাম।
এখন এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে বেশ ভালই লাগে। বেদনা কখনো মধুর হয় - কষ্টের দিনগুলিতেও প্রিয় ভাবনার অনুষঙ্গ হয় স্মৃতির পাতা গুলো। স্মৃতির পাতাগুলো ধূসরতার রূপ নিলেও যে একাকী মুহূর্তে সেই স্মৃতির পাতা এমন ঔজ্জলতায় ভরে ওঠে যে সেই মলিন পাতাগুলির কাতরতায় মন বারবার কেঁপে উঠে।
আমার জ্যাঠামশায় পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর ভারতবাসী হন। সেখানে মুদির দোকান করে সংসার চালান। আমাদের এই পরিবারের ভরণ পোষণ করা তার খুব একটা সাধ্যের মধ্যে ছিল না। না থাকলেও ভাতৃত্বের কোন কমতি ছিল না। আমার বাবাকে খুবই ভালবাসতেন, পছন্দ করতেন খুবই। দুই ভাই এক বিছানায় ঘুমোতেন- দুই ভাই একসাথে দোকানে বসে ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। রাতে ঘুমানোর আগে তাদের পূর্ব ইতিহাস গল্প করে আমাদের শোনাতেন । এভাবে গল্প শোনানোর এক রাত্রিতে জ্যাঠামশাই বাবা কে উদ্দেশ্য করে বললেন , 'আর বাংলাদেশে গিয়ে কাজ নেই এখানেই থেকে যা, ব্যবসাপাতি শুরু করে দে। বাড়ির পাশেই কয়েক শতক জমি পড়ে আছে ওখানে ঘরবাড়ি করে নে।' জ্যাঠামশায় দীর্ঘ ২৩ বছর ভারতবাসী হলেও বাংলাদেশের ভাষা ভোলেন নাই । বাবা একটু বিচলিত হয়ে বললেন
-'এখানে থেকে আমি কি করবো? টাকা পয়সা কিছুই নেই, কি দিয়ে ব্যবসা শুরু করব? দেশে ফিরে গেলে অন্তত সবার সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করতে পারব। এখানে থেকে গেলে জীবন নতুন করে শুরু করতে হবে। শুরু করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যাবে। আমার যা বয়স হয়েছে ওখানে গেলে আছাড় খাওয়ার অবস্থা থেকেও জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। আমি হিন্দু হলেও মুসলমানরা আমাকে খুব মান্য করে।'
দুই ভাইয়ের আন্তরিকতার মধ্যে দিনগুলি ভালই কাটছিল। আমিও জেঠাতো ভাই বোনদের স্নেহ ভালবাসায় গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়ে সপ্তাহে একদিন শরনার্থীদের জন্য ভারত সরকারের সাহায্য রেশন তুলে দিন পার করছিলাম।
ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েক মাস পার হয়েছে। নিত্য নতুন সাফল্যের খবর ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অতি আসন্ন এ কথা চাউর হয়েছে ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে। কোথাও ভারতীয়রা বসে আড্ডা দিলেই কথা ওঠে
- ' দাদা বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। তা দাদা ইলিশ পাবতো!'
- 'পাবেন না কেন?' - বলে ওঠি।
- 'না এই যে কষ্ট করছি, আপনারা খুব সহজেই ভুলে যাবেন কিনা'
-' আপনারাও তো একসময় অনেকেই পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন আপনারা যদি ভুলে না নিয়ে থাকেন'
কথা সমাপ্ত হল না। চেপে গেলাম। এ মুহূর্তে পরিবেশ উত্তপ্ত করা সুবিবেচনার কাজ নয় তাই আর কথা বাড়ালাম না। তখন ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানকে তথা বাংলাদেশকে জয়বাংলা বলতো। কোন বাঙালি দেখলেই তাকে জয় বাংলা বলে সম্বোধন করত। যে পাড়াতে থাকতেম তা জলপাইগুড়ি শহরের শহরতলি এলাকা - মূল শহরের প্রান্তভাগে। ও পাড়ায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশ থেকে গিয়ে উঠেছে। আমি জয়বাংলা থেকে এসেছি শুনে আশেপাশের অনেক বাড়ির লোকজন আগ্রহ করে আমাকে ডেকে নিয়ে এখানকার অবস্থার কথা শুনতে চায়। পাক বাহিনীর লোকদের অত্যাচারের কথা শুনতে চায়। সে সময়ের বর্ণনায় তাদেরও মন ভারি হয়ে যেত। এভাবে মহিলা মহলে - অন্দরমহলে মহিলাদের কাছে আমি কিছুটা বাড়তি আদর স্নেহ পেতে থাকি। আমার জ্যাঠাতো দুই বোন যখন বিকেলে কোন পার্শ্ববর্তী বাড়িতে আড্ডা দিতে বেড়াতে যেত সঙ্গে করে আমাকে নিয়ে যেত। কারণ আমাকে নিয়ে গেলে জয় বাংলার গল্প হবে এবং আসর ও জমবে এই ভেবে।
কিছুদিন এভাবে সেভাবে যাওয়া আসার ফলে পাড়ার কিশোর বয়সের কয়েকজন মেয়েদের সাথে পরিচয় হয়ে গেল। এদের মধ্যে তনু, রিয়া, রাখী, সাথী। এ ছাড়াও আরও কয়েকজন যাদের নাম এখন আর মনে আসে না। এরা সকলেই কেউ আমার বয়সি, আবার কেউ আমার থেকে দুই এক বছরের ছোট হবে। এদের কেউই আমার নাম ধরে ডাকতো না। আমার বোনরা আমাকে 'ফুলভাই' - 'ফুলদা' বলে ডাকত বলে ওরাও কেউ আমাকে ফুল ভাই, কেউ ফুলদা বলে ডাকতো।
রাখি'রা এক ভাই এক বোন। এদের পৈত্রিক ভূমি বাংলাদেশে। বাবা ছাড়া সকলেই '৭১ পূর্ব ভারতবাসী হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা ও মা ভারতে চলে যায়। বাবা বাংলাদেশে থাকাকালে আমার জেলা, তখন মহুকুমা শহর গাইবান্ধাতে বাস করত সেই সূত্রে রাখীর পরিবার আমাকে বিশেষ খাতির করত। রাখীও আমাকে ফুলদা বলে ডাকত। আমিও রাখীর মধ্যে এক সহজাত টান অনুভব করলাম। ছিপছিপে গড়ন, খুব আকর্ষণীয় চেহারা না হলেও মুখমন্ডলে- চোখ দুটিতে মায়াভরা লক্ষনীয় ছিল ।
বিকেল হলেই আমার বোনদের সাথে নিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বৈকালিক হাঁটা ব্যায়াম আমার কিছুটা নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তখন মাঝে মধ্যে ওদের সাথে দেখা হয়ে যেত। এ বয়সের ছেলেরা মেয়েদের মধ্যে পড়লে গল্পগুজবে অনেকটা আরষ্ট হয়ে থাকে, ফলে মাঝেমধ্যেই মেয়েদের কাছ থেকে বাঁকা কথা, কখনো বা জয়বাংলার গোবেচারা লাজুক ছেলে বলে টিটকারি শুনতে হতো। তবে আমার পক্ষ নিয়ে আমার বোনেরা তার জবাব দিত কখনো কখনো। একদিন সকলে মিলে সিনেমা দেখতে যাবে বলে ঠিক করলো। আমার জেঠাতো বড় বোন নীলুদিকে আমাকে সাথে নিয়ে যাবার কথা বললে নিলুদি তাতে সম্মতি দেয় এবং আমাকে জানায় তারা আমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবে। হঠাৎ এই ধরনের প্রস্তাবে ভরতে গেলেও ভারতীয় সিনেমা দেখার আনন্দে রাজি হয়ে গেলাম। ততদিনে সবাই আমরা একে অপরকে তুমি বলে সম্বোধন করা শুরু করেছি।
সিনেমা দেখতে গিয়ে টিকিট কাটার সময় রিয়া বলে বসল - 'আজ ফুলদা আমাদের সকলের টিকিট কাটবে।' কথা শুনে সকলেই হাসিতে ফেটে পরলো। অনুভব করলাম অনেকগুলো বিড়াল যেমন একটি ইঁদুরকে নিয়ে খেলায় মত্ত হয় আমাকে একা পেয়ে ওরা সকলেই হেনস্থা করার, বোকা বানানোর খেলায় মেতে উঠেছে।
মুহুর্তেই আমার কান গরম হয়ে গেল। বোকা বনে যাওয়া এবং সকলের খেলার পাত্র হওয়ার লজ্জাতে আমার সিনেমা দেখার আনন্দে ভাটা পড়ে। ওই মুহূর্তে আমার কাছে সকলের টিকিট কাটার মত টাকাও ছিল না। বাস্তবতা হলো সবকিছু সহ্য করে যাওয়া। তাই নীরব থেকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলাম। ওদের ধমক দিয়ে আমার পক্ষ নিয়ে নিলুদি বলল-'ও জয়বাংলা থেকে এসেছে, পয়সা পাবে কোথা থেকে? তোরা এভাবে আমার ভাইকে ছোট করবি জানলে ওকে নিয়ে আসতাম না' দিদি এ কথা বলাতে সকলেই চুপ হয়ে গেল। শেষতক যে যার টিকিট কেটে হলে ঢুকলাম। সিনেমা দেখে সকলে মিলে গল্প করতে করতে হেঁটেই রওনা দিলাম। মাঝপথে রাখী আমাকে একা পেয়ে বলল,- ' তুমি রাগ করেছো? রিয়ার ওভাবে তোমাকে ও কথা বলা ঠিক হয় নাই তুমি কিছু মনে করো না'। আমি চুপ করে থাকলাম। কথায় কথা বাড়বে তাই নিশ্চুপ থাকলাম।
রাজপথে কয়েকজন মিলে কিশোরী মেয়েরা একত্রে হাঁটলে তাদের মধ্যে গল্পের ঝাঁপি খুলে যায়। রাস্তায় একসারিতে হাঁটতে থাকে। মনেই থাকে না অন্যকেউ ওই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করে। পিছন থেকে কোন পথচারী দ্রুত হেঁটে গিয়ে তাদের ক্রস করার চেষ্টা করেও দু-এক বারের চেষ্টায় সফল হয় না। বাধ্য হয়ে 'একটু রাস্তা দাও' - না বললে হুস 'ই হয় না একপাশ ছেড়ে চলতে হবে। রাস্তায় হাঁটতে কিশোরী মেয়েরা একটু বেশি বেপরোয়া থাকে। গল্পে গল্পে একে অন্যের উপর হাসতে হাসতে হুমরি খেয়ে পড়ে। উচ্ছলতায় সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। কখনো পায়ে পায়ে হোঁচট খেয়ে হুমরি খেয়ে পড়ার জোগাড় হলে চিৎকার করে 'ও মাগো' বলে অন্যের গায়ের উপর জড়িয়ে ধরে।
-'আচ্ছা ফুল দা তুমি তো কলেজে পড়ো কলেজ কতদূর গো'- রিয়া প্রশ্ন করে ।
-'খুব একটা দুর নয়, হেঁটেই কলেজে যাওয়া যায়'
-'তোমরা ছেলেরা মেয়েরা একসাথে ক্লাশ করো?'- জিজ্ঞাসা করে।
-'হ্যাঁ'
-'তোমার ক্লাসে কতজন মেয়ে গো?'
-' কখনো গুনে দেখিনি, তবে জনাবিশেক তো হবেই'।
-' মেয়েরা সামনে বসে না সাইডে বসে?' - প্রশ্নের মধ্যে একটা দুষ্টুমি হাসি জড়িয়ে আড়চোখে তাকিয়ে তনু জিজ্ঞাসা করে।
সাথে সাথে রিয়া বলে উঠলো,
-'আচ্ছা ফুলদা, তুমি নাকি ভালো ছাত্র, কবিতা লেখ, গান জান, বলতো - 'ঙ' এর মাথাটা অমন গোলমেলে পেঁচানো কেন'?
একথা শুনে আবার সকালে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
-'যাঃ তোরা ভারি ফাজিল। ওকে একা পেয়ে যা নয় তাই করছিস'।
নিলুদিএকটা চাপড় মেরে ধাক্কা দিল। ঠিক সেই সময় পিছন দিক থেকে এক সাইকেল এসে তনুকে ধাক্কা দিল। আর একটু হলেই হুমরি খেয়ে আঘাত পেতে পারতো। তনু রেগে গিয়ে -
-'দেখে সাইকেল চালাতে পারেননা? মেয়েদের গায়ে ধাক্কা লাগানো, বদমাইশি?'
ভারতীয় মেয়েরা তা সে মহিলা যুবতী কিংবা কিশোরী যেই হোক, ছেড়ে কথা বলতে কম জানেনা। মেয়েদের মধ্যে একটা প্রতিবাদী সত্তা আছে। শুনেছি, মেয়েদেরকে কেউ তেমন অশোভন আচরণ দেখালে পা থেকে চপ্পল খুলে অমনি মেরে বসে। তাই নিজেও এ ব্যাপারে একটু সজাগ থাকতাম। যতটা ওদের থেকে দূরে থাকা যায়। সাইকেল-আরোহী যুবক গোছের ছিল। অমনি সাইকেল থেকে নেমে পড়ল।
-' রাস্তা কি তোমার বাবার? সমস্ত রাস্তাজুড়ে হাঁটছো, ধাক্কাধাক্কি করছো, সিনেমার নাচ দেখাচ্ছ। আমি ধাক্কা লাগিয়েছি না তুমি আমার সাইকেলে ধাক্কা লাগিয়েছো? ভদ্রভাবে রাস্তা দেখে চলতে পারো না?'
এক নিঃশ্বাসে বলে মেজাজ দেখালো। বুঝলাম ছেলেটিও কম নয়। যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল। মনে মনে বেশ একটু আনন্দ পেলাম। আমাকে ঠাট্টা মশকরা করার একটা ফল পেয়েছে। ঘটনাটা আর বেশিদূর এগোতে পারলোনা। বড়দির হস্তক্ষেপে তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা মিটে গেল। কিন্তু সেই ঘটনার একটা ভালো ফল আমার ঝুলিতে এসে পড়ল। আমাকে নিয়ে হাসাহাসির পরিবেশটা চুপসে গেল। সকলেই প্রসঙ্গ বদল করে অন্য প্রসঙ্গ ধরল। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছে এসে পড়েছি। সেদিনের মত যে যার বাড়িতে চলে গেল।
এর কিছুদিন পরেই একদিন বিকেলে বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে হাটছি। অক্টোবরের বিকেল। গরমের তীব্রতা কমে গেছে। পাশের বাড়ির এক কোণে ঝোপের মধ্যে থেকে ফুলের সুবাস চারিদিকে ছড়িয়েছে। মনের অজান্তেই রবীন্দ্র সংগীতের সুর গুনগুন করছি। এমন সময় ফেরা পথে রাখীর সাথে দেখা। ওর বাড়ির সামনে খোলা গেটের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বোধহয় বিকেলের হাওয়া খাওয়ার জন্য বাড়ির বাহিরে এসেছে।
-' কেমন আছো ফুলদা?'
-' আছি, বেশ আছি, তুমি কেমন আছো?'
-' আর কেউ নেই সাথে কেন?'
-' আমি একাই বেরিয়েছি '
-' চল ওদিক থেকে হেঁটে আসি' - বলে আমার সাথে হাটতে শুরু করলো। আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। কে কী মনে করবে, সাত-পাঁচ ভেবে।
-' বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলে তোমরা তো দেশে চলে যাবে'
-' কেন তোমরা যাবে না?'
-' না, বাবা আর ফিরে যাবে না, এখানেই থেকে যাবে।'
আমরা ফিরে যাব একথা শুনে মুখের ভাব টা কেমন যেন এক বিষাদঘণ মলিনতায় ভরে গেল তা আমার চোখ এড়িয়ে গেল না।
-' কেন চলে গেলে তুমি কষ্ট পাবে?' - ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাটা। হঠাৎ এরকম কথা মুখে আসবে কখনো ভাবি নি। বাজে কোনো উত্তর শুনতে হয় কিনা লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল।
-' না, তা ঠিক নয়। তবে আমরা এক জায়গার কিনা। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। অনেকদিন গল্পগুজবে বেশ কাটছিল, চলে গেলে আর কোনদিন দেখা হবে না। ভিন্ন দেশ, আসা-যাওয়ার কত রেস্ট্রিকশন। আমাদের কথা আর কেন মনে রাখবে।'
-' না, তা ঠিক না।'
-' জান, গত পরশুদিন আমি, রিয়া, তনু মিলে গল্পে গল্পে তোমার কথা হচ্ছিল।'
-' লজ্জার কথা, আমাকে নিয়ে কি কথা হচ্ছিল!খারাপ কোন কিছু? তোমাদের সাথে কোন খারাপ কিছু হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।'
-' না- না, বাজে কিছু তো নয়'ই বরং ভাল কথাই হচ্ছিল। সকলে বলাবলি করছিল, জয় বাংলার ছেলে তো বেশ নরম, আর সরল। মুখ তুলে কথা বলতে জানে না।
সেদিন বয়স ছিল অল্প। সব কিছু বোঝার ক্ষমতা তখন আমার তেমন ছিল না। মানুষের মন সে তো কঠিন জটিল বিষয়। পড়ন্তু নারীদের মন।
রবীন্দ্রনাথ দেবযানীর মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছিলেন, 'রমনীর মন, সহশ্র বৎসরের সখা সাধনার ধন'। দিনরাত্রি হিসেব-নিকেশ করা যায় - চন্দ্র-সূর্যের মহাজাগতিক সম্পর্ক পরিগননা করা যায় - মহাবিশ্বের লক্ষ-কোটি বৎসরের দুরত্বের আপেক্ষিকতা নির্ণয় সম্ভব। কিন্তু সেদিনের সেই সামান্য দূরত্বটুকু পরিমাপ করার মত সাধ্য আমার ছিলনা। কারো জানা নেই। কেউ পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। পারা যায় না। কেউ পেরেছে বলে আমার বিশ্বাস হয়না আবার কেউ কোনদিন পারবে তাও বিশ্বাস হয় না।
সন্ধ্যার গোধূলি আভা প্রকৃতির উপর ছড়িয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এসেছে। সামনে অদূরেই এক খেকি কুকুর কেউ-কেউ ঘেউ-ঘেউ করতে করতে এপাশ থেকে এক অনিবাসী কুকুরকে তাড়া করল। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে সন্ধ্যার ধূপ প্রদীপের মোহনীয় গন্ধ ভেসে আসছে। সঙ্খ আর উলুধ্বনিতে দিবসের বিদায় বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে। চারিদিকের ছোট ছোট ঝোপঝাড় থেকে - বাসের আঁরা থেকে ঝিঁঝিঁ পোকারা মনের আনন্দে উল্লাস শুরু করেছে।তখন আমার কানে এই ঝিঁ ঝিঁ ডাক বড়ই বেমানান লাগছে। এ যেন চিৎকার। কানে তালা লাগিয়ে দেয়া চিৎকার ধ্বনি কেবল'ই বেজে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রকৃতি যেন আমাকে উপহাস করছে। কিছু একটা বোঝার অবস্থা থাকলেও তা স্পষ্ট করে মনে আসছেনা। চোখের দৃষ্টি যেমন আবছা আবছা লাগে, মনের অবস্থাও তেমনই অনির্বচনীয় কুয়াশাঘন। একটু দূরে পাশের বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা গানের টিচার রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাচ্ছে - ' মধুরও তোমার শেষ যে না পাই'। পিছনে এসে নিলুদি আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, 'চল, বাড়িতে চল।'
ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী পরাজিত হলো। এবার দেশে ফিরে যাব। দেশে ফিরে যাবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। কবে, কখন, কিভাবে, কে কে যাবে তার একটা পরিকল্পনা নিয়ে সকলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। আমার মনেও দেশে ফেরার আনন্দ-দোলা শুরু হয়েছে। তা সত্ত্বেও পিছনের দিনগুলির কথা ফিরে ফিরে মনে আসছে।
দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। নতুন বছরেরই বাংলাদেশে চলে আসবো। প্রথমে আমি আর বাবা পরে পরিবারের আর সকলে যাবে। নানাবিধ প্রস্তুতির মধ্যে দিন কাটছিল। কিছু কেনাকাটা আছে - তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা হলো। বাংলাদেশে আসার জন্য একটা ট্যাক্সি ঠিক হয়ে গেছে। তবে আমাদের সাথে আমার দুই জ্যাঠাতো দাদাও ওই ট্যাক্সিতেই বাংলাদেশে যাবে, আবার ওই ট্যাক্সিতেই ভারতে ফিরে আসবে। সেদিন ছিল ২ ফেব্রুয়ারি, বুধবার। সকাল সকাল রওনা দিতে হবে। অনেকটা পথ, তারপর বিধ্বস্ত দেশের রাস্তাঘাট- কোথায় কেমন কি অবস্থায় আছে তা জানা নেই। ডোমার-নীলফামারী-সৈয়দপুর রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরা। সকাল-সকাল ট্যাক্সি এসে গেছে। বাড়ির গেটে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড করানো। মালামাল তোলা হচ্ছে। বাড়ির লোকদের সকলের মন বিষাদঘন। জ্যাঠামশাই, জেঠিমা অন্যান্য ভাই-বোনদের কারো কারো চোখে জল। বাবা আমি জামা কাপড় পড়ে রেডি হয়ে গেছি। সেদিনটা রাখী পূর্ণিমার দিন ছিল না। বাড়ির গেট থেকে ১০০ বা ১৫০ গজ দূরেই একটা বাঁশ বাগানের নিচে রাখী দাঁড়িয়ে আছে, দেখতে পেলাম। পরনে লাল স্কার্ট। হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে ডাক দিল। যন্ত্রচালিত হয়ে সামনে পা বাড়ালাম। এগিয়ে গেলাম। রাখীর সামনে দাঁড়ালাম। রাখীর মুখটা বিষাদ ঘন। হাতে কি যেন একটা বস্তু দেখতে পেলাম।
-' তুমি ডাকছিলে?'
-'হ্যাঁ'
-' কখন যাবে?'
-' এই তো সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, মালপত্র সব তোলা হয়ে গেছে।'
-'তোমার সাথে আর কখনো দেখা হবে না হয়তো'। আমাকে মনে রেখো। দেখি তোমার হাতটা।'
-' কেন বলতো?'
সংকোচ আর লজ্জায় আরষ্ট হওয়ার উপক্রম। এ মুহূর্তে এরকম দুজনকে একা দেখলে সকলেই কিছু না কিছু মনে করবে এই ভেবে এক পা পিছিয়ে গেলাম। রাখী এগিয়ে এলো। আমি যতটুকু পিছিয়ে ছিলাম ততটুকু এগিয়ে এলো। কেন জানি এই মুহূর্তে রাখীকে বেশি সাহসী মনে হল।
-' আহা, হাতটা দাওনা।'
ওর এগিয়ে আসা আর দ্বিতীয়বার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আজ্ঞাতে মাথায় কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। একটু দূরেই বাড়ির গেট। আরও কিছুটা দূরে রাস্তার উপর তনু, রিয়া মিলে আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে আমাদের বাংলাদেশে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে। ওরাও তো আমাদের দুজনের বাশ তলায় দাঁড়িয়ে গল্প করা দেখছে।
আবার প্রশ্ন করলাম, -'কেন? কি হবে?'
এবার নিজেই এগিয়ে এসে আমার হাতটা টেনে নিয়ে ডান হাতে একটা সুন্দর রাখী পরিয়ে দিল। রাখী যখন বেঁধে দিচ্ছিল তখন লক্ষ্য করলাম ওর মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
-' এই রাখী তোমার জন্য আগেই কিনে রেখেছি। সময়-সুযোগ করে উঠতে পারিনি। তোমাকে আজ ভাইয়ের বন্ধনে বেধে রাখলাম গো। কোনদিন ভুলে যেও না।'
বলে সামনে ঝুঁকে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো।
যে বন্ধনে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান দুটি জাতিকে ভাতৃত্বের বন্ধনে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন, সেই বন্ধনে দুটি তরুণ হৃদয় বাঁধা পড়লো কিনা তা জানি না। তবে, একটা গভীর ছাপ যে হৃদয়ে স্থিতি হয়ে গেল প্রতিবছর রাখী পূর্ণিমা আর ভাতৃ দ্বিতীয়া এলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
"বিষাদের অশ্রু জলে নিরবের মর্মতলে
গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নতুন বাণী ।
ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি।।"
--- ::: ----
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জানবক্স খান ০৯/০৭/২০২০ভাই-বোনের এই ভাতৃত্ববোধ যেন চীরকাল অটুট থাকে সেই কামনাই করি। খুবই উচ্চমানে স্মৃতিচারন মূলক জীবনে গল্প। মনটা ভরে গেল।
-
রেদোয়ান আহমেদ ০৯/০৭/২০২০বাহ্
-
জ্যোতি রমণ বিশ্বাস ০৩/০৭/২০২০সুন্দর,দুর্দিনের উষ্ণ স্মৃতি
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০২/০৭/২০২০ভালো লেগেছে।
পরে আবার পড়বো। -
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ০২/০৭/২০২০সুন্দর
-
নীহারেন্দ্র নাথ চৌধুরী ১৯/০৬/২০২০প্রিয় এ্যডমিন,
লেখাটি অপ্রকাশিত থাকার কারণ জানতে আগ্রহী।
ধন্যবাদ।