www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সেদিন বনাম আজকের শীতকাল

প্রচণ্ড হার কাঁপানো শীত,হাত চাদরের বাইরে বার করতে ইচ্ছা করছেনা। কাঁপতে কাঁপতে আমাদের পাড়ার বল্টু, হাবুদাকে ডাক দিলো,"ও হাবুদা; আজ পিফাতে 'ড্যানশ' হবে,কলকাতা থেকে 'অরগেস্টার' আসছে।'ফানশান' এবার জমে ক্ষীর, তাড়াতাড়ি বার হও সামনের দিকে জায়গা নিতে হবে।"

এভাবেই চলতে থাকে গ্রামবাংলায় বিনোদনের আসর।সময় বদলাচ্ছে,মানুষ ও বদলেছে সাথে সাথে মানুষের রুচিও বদলেছে।একটা সময় যে বাঙ্গালীর মেনুতে ছিল ভাত,ডাল,মাছের ঝোল,প্রস্ত ইত্যাদি; আজ সেই বাঙ্গালীর পাতে বিরিয়ানি,ফ্রাইড রাইস,দই কাতলা আরো কতো সব বাহারি মেনু।প্রকৃতির মুক্ত বাতাস ছেড়ে আজ আমরা শীত তাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঠাই নিয়েছি।মনে পড়ে গেলো কুমার বিস্বজিতের সেই বিখ্যাত গানটি, "তোমরা একতারা বাজায়োনা,দুতারা বাজায়োনা,তিনতারা বাজালে বন্ধু মনে পড়ে যায় একদিন বাঙ্গালী ছিলামরে"।আজ হয়তো একতারা দেখতে পাবো শুধু শান্তিনিকেতনে অথবা লালন ফকিরের বাড়িতে।বিষয়টি হাস্যকর মনে হলেও সত্য,গিটার -পিয়ানোর সুরে একতারা আজ ম্লান।আমরা ভারতবাসী সনাতনপন্থী উদার প্রকৃতির মানুষ ,তাইতো যুগ যুগ ধরে যতসব বিদেশি শক্তি ভারতে এসেছে সবাইকে আমরা আপন করে নিয়েছি।আপন করে নিয়েছি এইসব বিদেশীদের সংস্কৃতি,আচার অনুষ্টান,ভাষা এবং স্বীকার করেছি এদের আনুগত্য।আজ হইতো বিদেশি শক্তি আমাদের দেশে আক্রমন করেনা,কিন্ত তাদের সঙ্গীত,খাবার,পোশাকাদি আমাদের কে শক্ত শিকলে বেধে ফেলেছে,মুছে ফেলছে আমাদের চিরাচরিত ঐত্যিহবাহী সংস্কৃতি,রীতিনীতি।তাই তো আমরা বলে চলেছি, "Bro, I like justin beiber..বাংলা গান আমি ন্যাচারালি শুনিনা, I like pizza,bargar." রাস্তাঘাট,বাস-ট্রাম,ট্রেনে কখনোবা কাকিমা-মাসীমা দের ভুলবশত বলে ফেলি, "দিদি-বোন অনুগ্রহ করে একটু সরে দাঁড়াবেন।" আমি তোমাদের দোষী করছিনা,তোমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশুমন টি বারে বারে নতুনকে আহবান করতে চায়,বদলে ফেলতে চায় নিজেকে।আজকের 'মিস ক্যালকাটা' আগামী দিনে 'মিস ওয়ার্ল্ড' হতে চায়,তাইতো রঞ্জনা 'পপ-ডিস্কো' ছেড়ে ভারতন্যাট্টম শিখতে আসবেনা।জানিনা বাপু একে 'গ্লোবালাইজেশন' বলে কিনা,আমরা আধুনিক হতে হতে কোথাও যেন শিকড় কেটে ফেলছি।আর শিকড় কাটা গাছ দিনের পর দিন শুকিয়ে জ্বালানীতে পরিনত হবে,সেদিন ঐ জ্বালানী বায়ুমণ্ডল কে দূষিত গ্যাস উপহার দিয়ে পরিবেশ দূষণ করবে।

শহরের সাথে পা ফেলে বদলাচ্ছে গ্রামবাংলা। ছোট বেলায় দেখেছি শীতকালে রাত ৮ টা বাজলে চারিদিকে অন্ধকারে পা ফেলা যেতনা,কোন বাড়িতে আলো জ্বলতনা,সকলে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত।চোর ডাকাত গুলো এই সুযোগ ব্যবহার করে তাদের সংসার চালাত,আমাদের ঠাম্মারা লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পড়ে সব রুপকথার রাজরানী,ডাকুদের বিরত্বের গল্প শোনাত।আজ গ্রামের প্রতিটি ঘরে সদা জাগ্রত প্রহরীর ন্যায় পাহারা দিচ্ছে কিরণমালা,খোকাবাবু। বেচারা চোর ডাকাত গুলো আজ চুরি ছেড়ে দিয়ে পেটের জ্বালায় দলবাজি শুরু করেছে বিভিন্ন ছাতার তলায়,আর বেচারি বৃদ্ধ ঠাম্মারা শেষ বয়সে ব্যস্ত নাতিপুতির সঙ্গে কথা বলার সু্যোগ না পেয়ে ঘরের এক কোণে বিদায়ের দিন গুনতে থাকে।মাঝে মাঝে পাড়ায় শীতের সময় পালাযাত্রা,মেলা,ম্যাজিক শো ইত্যাদির আসর বসত আবার কখনোবা আমরা বাড়ি থেকে চাল-মশলা নিয়ে চড়ুইভাতি করতাম।ভোরবেলা খেঁজুরের রস খাওয়ার জন্য ছুটে চলে যেতাম মাঠে,চুরি করতাম গাছে ঝোলানো মাটির হাড়িগুলো।খেজুরের পাটালি দিয়ে নলেন গুঁড়,পিঠা, এসব খেতাম কিন্ত আজ পাটালি বলে কিছুই নেই।বাঙ্গালি খেঁজুর গাছে উঠতে ভুলে গেছে,ভুলে গেছে চড়ুইভাতি। ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে আধুনিক মদ্যপান আর 'ডিজে' গানের পিকনিকে কাতলা হয়েছে 'দই কাতলা',ডাল হয়েছে 'মুড়োঘণ্ট',সিদ্ধভাত হয়েছে 'ভাজাভাত'।যাত্রাপালার আসর তো কবে বন্ধ হয়েগেছে 'অর্কষ্টা','ওয়েস্টার্ন-ভোজপুরী ড্যান্সের' চাপে।পাড়ার বল্টু-হাবুরা ভোজপুরী,হরিয়ানি ড্যান্স করতে করতে বাড়ি ফেরার পথে পথদিয়ে যাওয়া মেয়েগুলোকে ভোজপুরী ভাষায় 'ইভটিসিং' করতে করতে বাড়ি ফেরে।মেলাগুলোতে জিলিপি,বাদামভাজার সাথে যুক্ত হয়েছে 'চাইনিজ','পাপড়িচাট' প্রভৃতি।প্রতিটি মেলা কতৃপক্ষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে 'সিরিয়ালের' কলাকুশলীতে ভরিয়ে দিচ্ছে, জমজমাট হচ্ছে মেলা।আমাদের মত তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা বলেযাচ্ছি এসব 'ট্রেণ্ড',দিন বদলেছে দেশ ডিজিটাল হচ্ছে এসবতো 'আম ব্যাত হে'।তাইতো কবি কেঁদে বলেছে, " সেদিন ছিল শীতের কাঁপুন,গরম হতাম জ্বালায় আগুন।আজ বিলিতি চুমুকে, 'ডার্লিং' ডাকি মা কে।"
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ১১৬২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/১১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast