www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মেঘেভেজা দিন

আমি ত্রিরা।আমার নাম শুনে অনেকেই কিছুটা অবাক হয়।কারন আমার ভালোনাম বা ডাকনাম বলতে কিছু নেই।নামের সামনে অথবা পেছনে উপাধি বা অন্যকিছুও নেই।তাছাড়া ত্রিরা নামটা শুনতেও হয়তো অদ্ভূত।আর কারো নাম সম্ভবত এমন হয়না।এই নাম আমার মায়ের রাখা।নামটা রাখার পেছনে কোন কারন আছে কি না জানিনা।কারন আমার বাবা এবং মা দুজনেই আমার দুবছর বয়সের সময় গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান।তাই এরকম নাম রাখার কারন টা আর জানা হয়নি।
পরিবারের সবার কাছে শুনেছি মা কিছুটা অদ্ভূত মহিলা ছিলেন।কি কারনে তিনি আমার নামটা এমন তার সঠিক কারন না জানলেও এটুকু ধরে ফেলেছি যে আমার নাম আসলে রাত্রি শব্দের ঠিক উলটো।মা নিজেও তার নাম সবার কাছে উল্টো করে বলতেন।যাই হোক, সব মায়েরাই তাদের সন্তানদের অসম্ভব আদর যত্নে লালন পালন করেন।আমার মায়ের সবচেয়ে অদ্ভূত দিক ছিলো তিনি জন্মের পর কখনোই আমাকে স্পর্শ করেননি।জন্মের পরপরই আমাকে তিনি আলাদা ঘরে পাঠিয়ে দেন।অবশ্য আমাকে দেখাশোনার জনয একজন আয়া রাখা হয়েছিল।আয়াই আমার দেখাশোনা করতেন।মা আমাকে প্রতিদিন দেখতে আসতেন কিন্তু কখনো ছুঁয়ে দেখতেন না।মুখে গভীর দুঃখবোধ নিয়ে কিছুক্ষণ আমাকে অপলক দেখেই ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন।আমার প্রতি মায়ের ভালোবাসা মমতা যাই বলিনা কেন এটুকুই শুধু ছিল।
বাবাও যে এমন করতেন তা নয়।তবে মায়ের কারনেই হয়তো তিনিও আমাকে অনেকখানি এড়ীয়ে চলতেন।শুধু মাঝেমধ্যে এসে গভীর ভালোবাসায় কপালে চুমু খেতেন।গভীর রাতে যখন শিশুসুলভ কারনে ঘুম থেকে জেগে কান্নাকাটি করতাম তখন ছুটে এসে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে নিজের ঘরে ফিরে যেতেন।বাবা-মা সম্বন্ধে এসব সব কথাই আমার আয়া নিনান্টির কাছে শোনা।তার পুরো নাম রেবেকা সুলতানা নিনা।জন্মের পর থেকে এখনো আমি তার কাছেই লালিত পালিত হয়েছি।পিত্রৃসূত্রে এবং মাতৃসূত্রে দুদিক থেকেই আমি বিশাল ধন-সম্পত্তির মালিক।অঢেল বিত্ত-বৈভবের মধ্য দিয়ে আমি এতকাল লালিত পালিত হয়ে আসছি।এসবের পাশাপাশি যোগ হয়েছে দাদুবাড়ি এবং নানুবাড়ির সবার অঢেল ভালোবাসা আর স্নেহ-মমতা।তাদের কারনে আমি কখনোই বাবা মায়ের অভাব টের পাইনি।মেডিকেলে কলেজে ভর্তি হবার পর পরই আমি বাবা মায়ের ফ্ল্যাটে এসে উঠেছি।এখানে আমি আর নিনান্টি থাকি।মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।কয়েকবছর পরই ডাক্তার হয়ে বেরুব।সবদিক বিবেচনা করলে আমি কানায় কানায় পূর্ণ একজন মানবী।কিন্তু মাঝেমধ্যেই আমার মনে হয় সত্যিই কি তাই?
মা-বাবার বেশকিছু ছবি আমার কাছে আছে।প্রায়ই আমি সেসব ছবিগুলো দেখি।মায়ের মাত্র দুখানা ছবি।ছবিতে অসম্ভব রোগা এবং অতি সাধারন চেহারার এক মহিলা আমার মা।না, মহিলা নয়।দেখতে অনেকটা কিশোরীদের মত।চোখমুখ খুবই সাধারন,বৈশিষ্ট্যহীণ কিন্তু তীক্ষ্ণ। মাথাভর্তি কালো লম্বা চুল,গায়ের রঙ শ্যামলা।দেখলে আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয়না ইনি আমার মা।মনে হয় সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হওয়া লাজুক কিশোরী,চোখমুখে উপচে পড়ছে ছেলেমানুষী।হঠাত বড় হওয়া ভাব যে চেষ্টা করেও নিজের চেহারায় আনতে পারছেনা।
বাবা মায়ের চেয়ে অনেক পরিণত এবং গম্ভীর।বড় বড় চোখ আর ফর্সা গায়ের রং।বাবা মা দুই পরিবারের সবার পছন্দে বিয়ে করেন।তবে বিয়েটা ছিলো হঠাত করে।শুনেছি মা কি কারনে যেন হঠাত জেদ ধরে বসেন বিয়ে করবেন। তার জেদের কারনে হঠাত করেই পরিবারের মধ্যস্থতায় তাদের বিয়ে হয়ে যায়।বিয়ের দেড়বছরের মধ্যে আমার জন্ম।
এখন আমার বয়স একুশ।আজকে আমার জন্মদিন।অবাক বযাপার হলো দুবছর বয়সে ঠিক আমার জন্মদিনের দিনই মা বাবা গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা যান।আজ তাদের ১৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী।
মা বাবা যে কয়দিন বেঁচে ছিলেন সে কয়দিন তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিলোনা।মা কারো সাথেই খুব একটা কথা বলতেননা।বিয়ের আগে স্বাভাবিক থাকলেও বিয়ের পর কথাবার্তা বলা আর অন্যদের সাথে মেলামেশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন।দিনরাত তিনি নিজের ঘরে চুপচাপ একা বসে থেকে সময় কাতীয়ে দিতেন।তার নিজের জগত বলতে শুধু নিজের ঘরটাই ছিলো।এখন আমি যে ঘরে বসে গল্প লিখছি এই সেই ঘর।।আমার মায়ের ঘর।এখানে মা কাউকে ঢুকতে দিতেননা।এমনকি বাবাকেও না।বাবা খুব প্রয়োজনে মায়ের সাথে যখন সময় কাটাতে চাইতেন তখন মা আরো বেশী নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতেন।এসব কারনেই দিনের পর দিন তিনি ভয়ানক রোগা হয়ে পড়েছিলেন।কিন্তু আমার দ্বীতিয় জন্মদিনে মা কি কারনে যেন খুব উতফুল্ল হয়ে বাবাকে নিয়ে লংড্রাইভে যাবার জন্যে গাড়ি নিয়ে বের হন।নিজেই তিনি সেদিন গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন।সেই যে বের হলেন আর ফিরে এলেননা। কখনো না।আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কি হয়েছিলো সেদিন?মা কেন হঠাত করে উতফুল্ল হয়ে বাবাকে নিয়ে বের হয়েছিলেন?এসব জানার আর কোন উপায় নেই।কোন উপায় নেই মায়ের অদ্ভূত আচরনের কারন খুজে বের করার।তার বৈবাহিক অবস্থার আগের কোন ছবি, ডায়েরী অথবা তার সম্বন্ধে জানা যায় এমন কোন সূত্রই নেই।সমস্ত ছবি তিনি নিজেই নষ্ট করে ফেলেছিলেন।মায়ের অদ্ভূত স্বভাবের কারনেই হয়তো তার কোন বন্ধুও ছিলোনা।যারা ছিলো তাদের সাথে তিনি কিছুই কখনো শেয়ার করেননি।তাই তার বযপারে জানার কোন উপায়ই রইলোনা।কেন আমি মায়ের কাছে অস্পৃশ্য এমন অনাকাংখিত ছিলাম তা জানার আর কোন উপায় রইলোনা।
এখন অনেক রাত।রাত প্রায় দেড়টা বাজছে হয়তো।আকাশভরা পুর্ণিমার চাঁদের মায়াবী জোছনায় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে।জন্মদিন উপলক্ষ্যেই আমি সেজেগুজে ছাদে এসেছি।কি অসম্ভব মন খারাপ করা সুন্দরের মেলা বসেছে আমাকে ঘিরে।পুর্ণিমা রাতের ভরা জোছনায়ও অসংখ্য তারা স্পষ্টভাবে ছড়ীয়েছিটিয়ে আছে আকাশের গায়ে।মাঝেমধ্যেই কিছু তারা যেন ছুটে দূরে চলে যাচ্ছে। সত্যিই কি যাচ্ছে না কি আমার চোখের ভুল।ঠিক বুঝতে পারছিনা।আমি সিগারেট ধরালাম।অনেক্ষন পর হটাত মোবাইলের রিং বেজে উঠল।হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে মোবাইল হাতে নিলাম।ইভানের কল।আমার চোখ হঠাত ভীষন জ্বালা করে উঠল।কতদিন দেখা হয়না,কথা হয়না ওর সাথে।প্রায় বছরখানেক তো হবেই।
-হ্যালো ত্রিরা।
-হ্যা,ইভান। বলো।
-শুভ জন্মদিন ত্রিরা।
-ধন্যবাদ।
-কেমন আছো তুমি?
-ভালো
-একটু বাড়ির বাইরে আসতে পারবে?
-না, তুমি ছাদে চলে এসো।
ফোন কেটে গেল।আমার বুকের ভিতর অসম্ভব অস্থিরতা দেখা দিল।ইভান কি সত্যিই এসেছে?ও কি এখন ছাদে আসবে? আআমার সারাশরীর আশা আর আকাঙ্ক্ষার ভাঙ্গনে ছিটকে পড়া কাচের গ্লাসের মত চুরমার হয়ে যাচ্ছে যেন।সমস্ত স্নায়ু ইতিমধ্যে অবশ হয়ে গেছে।আমি যেন আমি নই।কোন পাথরের মূর্তি।আর মাত্র কয়েকমিনিটের অপেক্ষা।
একমিনিট দুইমিনিট করে অনেকখকন কেটে গেল।কই কেঊ তো আসছে না।ছাদ থেকে গেটের সোজাসুজি দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলাম।চারপাশে সুনসান নীরবতা।কোথাও কেউ নেই, কোন সাড়াশব্দ নেই।তবে কি ইভান আসেনি?শুধুশুধুই আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে বলেছিল, মিথ্যে করে?ধুর কিসব হাবিজাবি চিন্তাভাবনা করছি আমি।ইভান এখানে কেন আসবে?তবু নিশ্চিত হবার জন্য ওর নাম্বার ডায়াল করলাম।যথারীতি বন্ধ।থাক বন্ধই থাক।ওর ফোন বন্ধ বা খোলা হওয়াতে আমার কি আসে যায়।ভালোই হয়েছে আসেনি।নয়তো আমাকে আবারো নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হত ওকে পুনরায় ভুলে যাবার জনযে।যা হয় ভালোর জনযই হয়।
নিজের ওপর অসম্ভব বিরক্ত হয়ে আমি আবারো সিগারেট ধরালাম।এতগুলো সিগারেট পোড়ানোর পর আমি শরীরের উপর নিয়ন্ত্রন হারাতে শুরু করেছি।মাথা খুব হালকা লাগছে।পেটের ভেতর থেকে কিছু একটা পাক দিয়ে গলাতে উঠে আসতে চাইছে।বমি করতে পারলে ভালো হত।কিন্তু বমি আসছে না।তবু আমার সিগারেট খাওয়া বন্ধ করতে ইচ্ছে করছেনা।সিগারেটের গন্ধটা আর কিছুতেই সহ্য হচ্ছেনা তবু যেন খেয়েই যেতে হবে।
ছাদে একটা বালিশ আর চাদর নিয়ে আসলে ভালো হত।এখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া যেত।বালিশ চাদর ছাড়াই ছাদে শুয়ে পড়লাম।শরীর ভাঙ্গা ক্লান্তি এসে গ্রাস করে নিল আমাকে।রাতের সাথে ঝিমিয়ে পড়া চাদের আলোতে তারাভরা সীমাহীন আকাশ অথবা তার চেয়েও বিশাল শূন্যতা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।যখন ঘুম ভাংল তখন মুখের উপর পানির ফোটার মৃদু ছোয়া টের পেলাম।চোখ খুলে দেখি ভোর হয়ে আসছে আর হালকা বৃষ্টি নেমেছে।ছাদ থেকে উঠে এসে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

নিনান্টির ডাকে দুপুরে ঘুম থেকে উঠে দেখি বড়মামা এসেছেন আমাকে নানুবাড়ী নিয়ে যাবার জনয।বাবা মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ নানুবাড়ি আর দাদুবাড়িতে আলাদা আলাদা করে মিলাদ হবে।।এসব আয়োজন আমার অসহ্য লাগে,তবু দুইবাড়ির সবার খুশি আর সামাজিকতার খাতিরে সবকিছুতেই হাসিমুখে যগ দিতে হয়।
সব আচার অনুষ্ঠান শেষ করে আমার বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল।সাথে এলেন মেঝফুপু।তিনি কয়েকদিন আমার সাথে থাকবেন।মেঝফুপুকে আমার দারুন ভালো লাগে।অত্যন্ত গল্পবাজ এই ফুপুর সাথে আগামী কয়েকদিন বেশ দারুন যাবে ভেবে আমি উল্লসিত।তার বিয়ে হয়েছে প্রায় ৫-৬ বছর হলো কিন্তু এখনো কোন ছেলেপুলে হয়নি বলেই তিনি আমাকে প্রপচন্ড ভালোবাসেন।মাঝে মাঝে তার আদর স্নেহের বাড়াবাড়িতে আমার অসহ্য লাগলেও খুব একটা খারাপ লাগেনা।মেঝফুপুর সাথে গ্লপ আড্ডায় আর ঘোরাঘুরিতে দশবারোদিন কিভাবে কেটে গেল টেরই পেলামনা।এরই মধযে একরাতে ফেসবুক নিয়ে বসেই দেখি একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে।কিছু না ভেবেই এক্সেপ্ট করে ফেললাম।যিনি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন তার প্রোফাইলে তার বযাপারে কোন ইনফর্মেশন নেই।গোল্লায় যাক ইনফর্মেশন।আমার কি তাতে।ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছে আমি এক্সেপ্ট করেছি ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেল।
তারপর প্রায় মাসদুয়েক হলো পড়াশোনা আর অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের চাপে ফেসবুক নিয়ে বসার সময় পেলামনা।যখন অবসর থাকে তখন আমার ফেসবুকে বসতে ইচ্ছেও করেনা।এর চেয়ে রাস্তায় নিজের মনে একাকি হাটাহাটি আর রাতের বেলা ছাদে বসে সিগারেট খেতেই আমার বেশী ভালো লাগে।মেয়ে হয়েও এরকম স্মোকার হওয়ার ব্যাপারটা আমার মোটেও খারাপ লাগেনা।যদিও অনেকেই বাকা চোখে তাকায়।আমার কাছে সিগারেট খাওয়াটা বেশ উপভোগ্য।

দিন যায়,আমি প্রতিদিন ভুলে থাকি বাবা মায়ের কথা।দৈনন্দিন ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে নিজের ভেতর লুকিয়ে ফেলি ইভান নামক অধ্যায়টাকে।সবকিছু নিজের নিয়মে চলে যায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের সাথে সাথে।
মাঝে মাঝে পথে চলতে গিয়ে রাস্তায় কোন অপরিচিত কোমলমতি মায়ের সন্তানের প্রতি অপরিসীম স্নেহ মমতার ছবি দেখে ভেতরে ভেতরে নিঃশব্দে পুড়ে ছাই হয়ে যাই।হৃতপিন্ডের সংকোচন প্রসারন যেন ক্রমেই বন্ধ করে দিতে চায় জীবনের সব স্পন্দন।আমার প্রতি মায়ের অস্পৃশ্যতার কথা ভেবে ভীষন মুষড়ে পড়ি।চারপাশ খুব ঝাপসা হয়ে আসে তখন।ভীষন জানতে ইচ্ছে করে আমি অতটা অস্পৃশ্য কেন ছিলাম তার কাছে?আমার অপরাধ কি ছিল?
আবার কখনো কখনো রিকশায় বসে গল্প করতে করতে চলে যাওয়া অথবা হাত ধরে রাস্তায় হাটা কোন প্রেমিকযুগল দেখে নিজের অজান্তেই বুকের ভেতর টের পাই মহাশূনযের মত শূন্যতা।সব অর্থহীন হয়ে যায় তখন।ইভান নিশচয়ই শাঈমার সাথে এভাবেই কোন রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে,ফুল কিনে দিয়ে মান ভাঙ্গাচ্ছে প্রিয়তমার।
ভাবতেই আমার চোখ জ্বলে উঠে।কখন যে চোখের কোল গড়িয়ে পড়ে পানি বুঝতেই পারিনা।একসময় সব সামলে নিই।ভুলে যাই আমি কি চাই কাকে চাই আর কি চাইতাম কাকে চাইতাম।

একরাতে কি ভেবে ফেসবুকে বসলাম।অনেক ম্যাসেজ নোটীফিকেশন জমে আছে।একটা একটা করে ম্যাসেজ চেক করছিলাম।হঠাত একটা মযাসেজ দেখে আমার অন্তরাত্মা কেপে উঠলো।কয়েকটা ছবি পাঠানো হয়েছে।সেই আইডি থেকে আমি না ভেবেই যার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছিলাম। মায়ের ছবি,আমার মায়ের ছবি।কোন ভুল নেই।সেই নাক সেই মুখ সেই চোখ।প্রত্যেকটাতেই পাশে একজন লোক।হাসি হাসি মুখে মাকে জড়িয়ে ধরে আছেন একটা ছবিতে।সুদর্শন লোকটা নিঃসন্দেহে মায়ের সমবয়সী হবেন।মায়ের চোখেমুখে হাসির ঝিলিক লেগে আছে।সত্যিকারের সুখী মানুষের চেহারার ছাপ দুজনের ছবিতে।একটা ছবিতে তাদের পেছনে বিশাল কাশবন।সম্ভবত শরতকালে তোলা ছবি।আরেকটাতে দুজন নৌকায় বসে আছেন ।ছবিগুলো দেখেই কৌতুহলের ধাক্কায় আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল।এ কেমন করে সম্ভব? মায়ের পাশে ইনিই বা কে?আমাকে কেন এইসব ছবি পাঠানো হলো?কে পাঠালো?আমি এই ব্যপারে অন্ধকার হাতে নিয়ে বসে রইলাম।বারবার নক করলাম ঐ আইডিতে।অনেকগুলো প্রশ্ন জড়ো করে পাঠিয়ে দিলাম।কিন্তু কোন সাড়া নেই কারো।কেউ ম্যাসেজ দেখছেও না।চরম অস্থিরতায় আমার দিন কাটতে লাগল। ঐ লোকের সাথে মায়ের হাসি হাসি সুখী মুখের ছবি দেখতে আমার ভালো লাগে।বারবার দেখি। অসম্ভব সহজ সরল দুজন মানুষের সুন্দর কোন স্মৃতিময় বিশেষ মুহুর্তের ছবি দেখতে কারই বা ভালো না লাগে।এই ছবিগুলো দেখলে কে বলবে এই মহিলাই অসম্ভব জটিলতার উদ্ভব ঘটিয়ে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে চিরঅস্পৃশ্য থেকেছেন তার সন্তানের কাছ থেকে ।
প্রতিদিন অপরিসীম প্রত্যাশাসহ আমি ফেসবুকে ঐ আইডির রহস্যময় আবির্ভাবের কারন জানতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি।একসময় আমার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে গেল।আমি ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম ছবিগুলোর কথা।আমার আইডি ও ডিএক্টিভেট করে দিলাম।যথারীতি ডুবে গেলাম প্রতিদিনের ব্যস্ততায়।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার।সন্ধ্যার দিকে একটা কুরিয়ার অফিস থেকে ফোনকল আসায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।আমার নামে একটা কুরিয়ার এসেছে।আমাকে কুরিয়ার করার মত তো কেউ নেই।তাহলে কোত্থেকে কুরিয়ার এলো?পরদিন কুরিয়ার রিসিভ করতে গেলাম। কাগজের র্যানপারে মোড়া ছোট্ট একটা বাক্স।ভেতরে কি আছে বোঝা যাচ্ছেনা। ওপরে একপাশে আমার নাম আর ফোন নম্বর,অন্যপাশে প্রেরকের নাম লেখা,মাত্র ইংরেজী এক শব্দে Ocean। শুধুই নাম আর কিছু লেখা নেই। নাম দেখে খুবই বিরক্ত হলাম কেউ কি আমার সাথে ঠাট্টা করছে?এইধরনের ঠাট্টার মানে কি হতে পারে কে জানে।
বাসায় ফিরে বাক্সের উপরের মোড়কটা খুললাম।ভেতরে আরেকটা সোনালী রঙের বাক্স।তার উপর একটা হলুদ খাম।ভিতরে চিঠি আছে বোঝা যাচ্ছে।ইতস্তত করেও কৌতুহলের বশে খামটা খুলে ফেললাম।একটা হলুদ কাগজের চিঠি পেলাম।এই প্রথম কোন চিঠি পেয়ে আমি বেশ শিহরিত।চিঠি খুলে পড়া শুরু করলাম

ত্রিরা,
আমি ওশান।আমাকে তুমি চিনবেনা।প্রথমেই বলে রাখি তোমাকে কুরিয়ার করার জন্য বহুকষ্টে তোমার ফোন নাম্বার জোগাড় করতে হয়েছে।সেসব বর্ণনা গুরুত্বহীন আর অপ্রয়োজনীয় বলে লেখার দরকার মনে করছিনা।ওশান আমার নাম নয়।আমার আসল নাম এখন তোমার জানার দরকার ও নেই।ওশান মানে মহাসাগর নিশ্চয়ই জানো।ওশান নামটা তোমার মা মানে রাত্রির রাখা নাম।তোমার মায়ের নাম রাত্রি শুনে অবাক হচ্ছো?অবাক হবার কিছু নেই।আমরা দুজনেই দুজনের নাম নিজেদের মত বদলে নিয়েছিলাম। আমাদের সম্পর্ক কি ছিল তা এখন তোমার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের পক্ষে না বোঝার কথা নয় আর।ফেসবুকে তোমাকে রাত্রি আর আমার ছবিগুলো আমিই পাঠিয়েছিলাম।এগুলোর মূলকপিগুলো আমি ইতোমধ্যেই নষ্ট করে ফেলেছি।তোমাকে স্ক্যান করা ছবি পাঠিয়েছি।
রাত্রির সাথে আমার সম্পর্কের শুরু হয়েছিলো একটা জটিলতা দিয়ে।দীর্ঘদিন এই জটিলতার কারনে রাত্রির সাথে আ্মার সম্পর্ক কখনো স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি।শেষ পর্যন্ত রাত্রি আমার ওপর জেদ করে তোমার বাবাকে বিয়ে করে।আমি ভেবেছিলাম রাত্রি হয়তো তাতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে আর আট দশটা মেয়ের মত।আমি সরে গিয়েছিলাম অনেক অনেক দূরে।তোমার জন্মের খবর পেয়ে আরো নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম হয়তো ও সুখেই আছে।তোমার বয়স যখন দুবছর তখন রাত্রির সাথে যোগাযোগ করি।খবর নিয়ে জানতে পারি রাত্রি মোটেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলনা।ওর সাথে দেখা করতে চাইলাম।বুঝাতে চাইলাম।কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।রাত্রি আমাকে আর স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলনা,ফিরতে পারলনা ওর স্বাভাবিক পৃথিবীতে।নিজেকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংসের জন্য বেছে নিল তোমার দ্বীতিয় জন্মদিনের দিনটি।কারন ওই একইতারিখে তোমার জন্মের প্রায় ৯ বছর আগে আমি আর রাত্রি জড়িয়ে গিয়েছিলাম নিজেদের জীবনের সবচেয়ে বড় জটিলতার সাথে।খুবই কাকতালীয় ভাবে একই তারিখে তোমারো জন্ম হয়।তোমার নাম আমি আর রাত্রি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যদিও তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল এই নাম ঠিক করার পেছনে।যাই হোক,রাত্রি সেদিন তোমার বাবাকে নিয়ে কেন বের হয়েছিলো আমি জানিনা।তোমার বাবাসহ গাড়ি নিয়ে বের হবার দিন সকালে রাত্রি আমাকে শেষ চিঠি পাঠিয়েছিল।তাতে শুধু বলেছিল সে আর ফিরবেনা কখনো। তোমাকে পাঠানো সোনালী বাক্সটা তোমাকে যেন পৌছে দেই আমি,যখন তুমি এই উপহারের মূল্য বুঝবে তখনি যেন এটা তোমাকে দেয়া হয়।এটাই তোমার প্রতি তোমার মায়ের ভালোবাসার একমাত্র চিহ্ন।এই বাক্সে যা আছে তা আমিই তোমার মা কে দিয়েছিলাম।তোমার মা নূপুর ভালোবাসত।আর সিগারেট খেতেও ভালোবাসত।
সেদিন আমি যখন রাত্রির কাছে পৌছাই ততক্ষণে সব শেষ।তারপরের ১৯ বছর আমার জীবন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে কেটেছে অবিশ্বাস্য ধীর গতিতে। আমি রাত্রির ভালোবাসার সম্মান রেখেছি,তার অস্বাভাবিকতা আর অকালে ঝরে যাবার দায়ভার নিজের কাধে নিয়েছি বলে জীবনে কখনো আর কোন নারীকে সংগীনি হিসেবে গ্রহন করিনি,ভালোবেসেছি একতরফা।
আজ অবশেষে তোমার মায়ের উপহার তোমাকে ফিরি্যে দেয়ার সময় এসেছে আর আমার রাত্রিবিহীন অসহ্য জীবনের অবসান ঘটানোর সময়ও এসেছে।তুমি যখন আমার চিঠি পড়বে তখন হয়তো আমার নাম মুছে যাবে পৃথিবী থেকে।তোমাকে কুরিয়ার করা শেষ হলেই আমি অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেব চিরতরে।ত্রিরা, আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমিই রাত্রির আত্মহত্যার জন্য দায়ী।আর তোমার বাবার অকাল মৃত্যুর জন্যে ও।পারলে তোমার মা কে ও ক্ষমা করে দিও।তোমার জন্য ভালোবাসা।
-ওশান

চিঠি পড়ে আমি বজ্রাহতের মত বসে রইলাম।চিঠির নিচে একটা ঠিকানা দেয়া।ওশান সাহেবের পূর্ণনামসহ বাড়ির ঠিকানা।আমি সোনালী রঙের বাক্সটা হাতে নিয়ে ওই ঠিকানার উদ্দেশ্যে বের হলাম তখনি।গাড়িতে বসে বাক্সটা খুললাম।ভেতরে একজোড়া রূপার নূপুর আর একটা রূপালী রঙের লাইটার। আমার হাতে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস।আমার মায়ের ভালোবাসা।আমার এতদিনের সমস্ত প্রশ্নের জবাব। বহুদিন পর নিজের ভিতরে জমানো সমস্ত দুঃখ যন্ত্রনা আজ জল হয়ে চোখ ফেটে বেরুল।আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।
ঐ ঠিকানায় পৌছে দেখলাম বাড়িতে প্রচন্ড ভিড়।ভেতর থেকে প্রিয়জনদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।আমি পুরোপুরি ভেতরে ঢুকলাম না। বাড়ির ভেতর কিছুদূর গিয়েই আবার বের হয়ে এলাম।থাক, আর কী দেখার আছে?যা দেখা হয়নি তা না দেখাই থাকুক।একটা সিগারেট ধরালাম।গাড়ি তে না উঠে রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করলাম।রাস্তা, আকাশ বাতাস সবকিছুতে যদি আমার যন্ত্রণা ছড়িয়ে দিয়ে নিজে কিছুটা হালকা হতে পারি।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৪৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৩/০৩/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রূপক বিধৌত সাধু ০৬/০৩/২০১৫
    লেখনী সুন্দর! পূর্ণচ্ছেদ এর আগে ও পরে স্পেস রাখলে দেখতে আরো সুন্দর লাগতো ।
    রাত্রি আর ওশানের চরিত্রটা অস্বাভাবিক ও অপরিণত ঠেকল । বাংলাদেশি ছবির মতো ।
    শুভ কামনা রইলো ।
  • হোসাইন ফরহাদ ০৬/০৩/২০১৫
    খুব মনোযোগ দিয়ে পরলাম।বেশ ভাল লেগেছে।
  • অভিজিৎ ব্ড়ুয়া ০৫/০৩/২০১৫
    বাপরে বাপ।
  • সিবগাতুর রহমান ০৫/০৩/২০১৫
    চমৎকার
  • স্বপ্নীল মিহান ০৪/০৩/২০১৫
    বেশ সাবলীল ভাষায় গল্পটা। ভালো লেগেছে।
  • ০৩/০৩/২০১৫
    বেশ ভালো লাগল ।
  • মোহাম্মদ রফিক ০৩/০৩/২০১৫
    সত্যিই জীবন থেকে নেয়া নাকি শুধুই গল্প বোঝা মুশকিল। অসম্ভব সুন্দর লেখার হাত। মনে হয় বেশ পুরোনো লেখিকা। মায়ের সাথে মেয়ের কি চমৎকার মিল রেখে সিগারেট খাওয়ার বিবরন দেয়া হয়েছে। গল্পের নায়িকার নাম ত্রিরা আর মায়ের নাম ঠিক উল্টো রাত্রি। চমৎকার বর্ণনা কৌশল। ইভানের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিত হলে ভাল হতো। নায়কের উপস্থিতি কম হলো যে; তাতে কি ! সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ। ডাক্তারকে যে ধুমপান ছাড়তেই হবে...............।।
    • নহাজা য়াজিনা ০৩/০৩/২০১৫
      অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য!!! আমি মাঝেমধ্যে লেখালেখি করি তবে এমনিতে লেখালেখিতে খুবই অনিয়মিত। নায়কের সাথে ব্যপারটা একটু চাপা রাখতে ইচ্ছে হলো।মনে হলো কিছুটা পাঠক নিজেরাই কল্পনা করে নিক, এজন্যেই নায়কের উপস্থিতি খুব কম রেখেছি।
  • সবুজ আহমেদ কক্স ০৩/০৩/২০১৫
    আসরে সু-স্বাগতম কবি ...............।
  • সবুজ আহমেদ কক্স ০৩/০৩/২০১৫
    ভেরি নাইস লিখা ..............................।
  • কপিল দেব ০৩/০৩/২০১৫
    ভাল লিখেছে !!!
  • আপনার প্রথম লেখা। তারুন্যে আপনাকে স্বাগতম। আমি তারুন‌্যে যাদের লেখা প্রথম বার প্রকাশ করেছি এত ভালো পেয়েছি কিনা সন্দেহ আছে। গল্পটি শুধুই গল্প কিনা সত্যি জানতে খুব ইচ্ছে করছে। আর গল্প পড়ে গল্পের লেখক কে দেখতে আরো বেশী ইচ্ছে করছে। শুভ কামনা থাকলো আপনার জন্য। আশা করি সামনে আরো অনেক সুন্দর সুন্দর লেখা পাবো। আর হ্যা লেখাটি প্রিয়তে রেখে দিলাম।
    • নহাজা য়াজিনা ০৩/০৩/২০১৫
      আমার লেখা কেউ প্রিয়তে রেখেছে এটা আমার জন্য বিশাল অনুপ্রেরণা।আমি লেখালেখিতে খুবই অনিয়মিত বলে হয়তো কমই লিখব।কিন্তু চেষ্টা করব ভালো লিখতে।আমার গল্প পড়ার জন্য আর এত সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। :)
 
Quantcast