খেলনার বন্দুক
তখন আমার বয়স পাঁচ কিংবা ছয় । বয়সটি এমন যে বালকরা এই বয়সে টিভি চ্যানেলগুলোর সুপার হিরো দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয় । আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না । কিন্তু , তখন বাংলা সিনেমার প্রচলন বেশি ছিল । জসীম , রুবেলদের এ্যাকশন , গুলাগুলি আমি আমার চিন্তা চেতনায় লালন করতাম । আমি মনে করতাম , সিনেমায় গুলি খেলে আসলেই মানুষ মরে । মনে করাটাই স্বাভাবিক । সে বয়সে অভিনয় বলতে কিছু যে আছে তা কে জানে ? তাছাড়া , আসল বন্দুক আর খেলনার বন্দুকের মাঝে পার্থক্য করার মত বোধগম্যতা কার থাকে ঐ বয়সে ? সবই আমার বাস্তব মনে হত , প্রকৃত মনে হত । তাই তো , সিনেমায় ভিলিয়েনদের মরা দেখে হাসতাম আর নায়েকের মরা দেখে কান্না করতাম । কিন্তু , ঐ বাস্তব যে কেবল পর্দায় , আর পর্দার পিছনে জীবনের কত নাটিকা আছে তা জানতাম না ।
তেমন করেই একবার , আমার বন্দুক কেনার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল । অনেক আবদারের পর বাবা বন্দুক কিনে দিলেন । হাতে দিয়ে বললেন , কারও উপর যেন গুলি না করি । এই ধারণাটা আমাকে বাস্তবমুখী করে তোলে , বন্দুক দিয়ে গুলি করলেই মানুষ মরে । কিন্তু , খেলনার বন্দুক যে আসল বন্দুক না তা কে বুঝায় ?
আমি কখনও কোন প্রাণীর উপর গুলি চালাই নি । খুনি হবার শঙ্কায় । কিন্তু সব সময়ই মনে রুবেল , জসীমদের মত একটু ‘হিরু’ হওয়ার ইচ্ছা করত । কিন্তু , বিধাতা সবারই কিছু কিছু প্রত্যাশা পূরণ করেন । আমার এই প্রত্যাশাও ‘কিছু কিছু প্রত্যাশা’-এর মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
একবার আমাদের বাসার কাজের ছেলে এসে বলেছিল , “একটা ম্যাজিক দেখবে ?” সে বয়সে ম্যাজিক দেখার কৌতূহল কার না থাকে । আমিও বললাম , দেখাও । সে সুপার গ্লু বের করে আমার দুই আঙ্গুল এ লাগিয়ে চাপ দিল । আমার সেদিনই জীবনের প্রথম ‘সুপারগ্লু’ নামক অতি প্রয়োজনীয় ক্ষতিকারক বস্তুর সাথে মূলাকাত ঘটে । আমি বুঝতে পারি নি । সে গ্লু লাগিয়েই পালালো । আমি তো আঙ্গুল আলাদা করতেই পারছিলাম না । বহু বেদনাকে অতিক্রম করার পর আমি আঙ্গুল দুটি আলাদা করতে সক্ষম হই ।
কিন্তু , চামড়া কিছুটা উঠে যায় । কিছু রক্তও বের হচ্ছিল । আমার ব্যাথা হচ্ছিল । আমি রেগে উঠলাম । তখন আমার মাঝে ‘হিরুওয়ালা অ্যাকশন’ নেওয়ার মনোভাব জেগে উঠল । আমি আমার ড্রয়ার থেকে বন্দুক বের করলাম । গুনে গুনে চারটি গুলি লোড করলাম । লোড করেই তার সন্ধানে বাসার বাইরে থেকে বের হলাম । সেই রুবেলদের মত চিৎকার করে তাকে ডাক দিলাম , ‘ওই খালিক!’ দেখলাম সে আমাদের বাসার সামনের মাঠে কাপড় শুকাতে দিচ্ছিল । দেখে আমাকে কাপড়ের পিছনে লুকানোর চেষ্টা করল । আমি হুংকার দিয়ে উঠলাম , ‘সাহস থাকলে সামনে আয়’ । সে হালকা উঁকি দিল । দেওয়া মাত্রই আমি গুলি করলাম । গুলিটা তার কপালে গিয়ে লাগল । সে কপালে হাত দিয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগল । সাথে সাথে আমি আরেকটি গুলি তার বুকে করলাম । সে বুকে হাত দিয়ে আরও জোরে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল । তখন আমার হুশ ঠিক স্থানে আসল । সাথে সাথে ভয়ে শরীর কাঁপতে শুরু করল । আমি খুন করে ফেলেছি । তাহলে , ছায়াছবির ঘটনানুসারে আমাকেও জেলে যেতে হবে । আমার ফাঁসি হবে । কতক্ষণ অপেক্ষা করলাম তার সাড়া শব্দ পাই কি না । কিন্তু সে উঠে না । তখন ভয়ে আমি বন্দুক মাটিতে ফেলে দৌড় দিয়ে বাসার ছাঁদে গিয়ে এক কোণায় লুকিয়ে পড়ি । আমি সেখানে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করি ।
যত সময় যাচ্ছিল , আমার ভয় তত বাড়ছিল । “আজ আমি আসামি”। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । তখন চাচা , দেখতে পারলেন মাঠে খালিক শুয়ে আছে । তাকে পানি দিয়ে তুললেন । পরে জানা গিয়েছিল যে , সে অভিনয় করছিল । কিন্তু ,এত রোদে থাকা সত্ত্বেও সে ঘন্টা খানেক মৃত থাকার অভিনয় করল কি করে ? চাচা যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন ,সে এরকম শুয়ে ছিল কেন সে কোন ধরনের ভূমিকা না বলে , মূল ঘটনাকে আড়ালে রেখে সরাসরি বলে উঠল , ছোট ঠাকুর আমাকে চোখে গুলি করেছেন ।
চাচা বলে উঠলেন , “সর্বনাশ”! তিনি আরেক কর্মী সাগরকে পাঠালেন আমাকে খুঁজে আনতে । বহু কষ্টের স্বীকার করার পর সে আমাকে খুঁজে পেল । সে অনুরোধ করল নিচে যাওয়ার জন্য । আমি নিচে যেতে অস্বীকার করলাম । বারবার অনুরোধের পর অবশেষে সে আমাকে কোলে তোলে নিচে নামতে শুরু করল । আমি জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করলাম , বলতে লাগলাম , “আমাকে বাচাও । আমার ভুল হয়ে গেছে । আমি জেলে যেতে চাই না” । অবশেষে আমাকে চাচার সামনে হাজির করা হল । আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো , “এই রকম কান্ড ঘটানোর কারণ কি” ? আমি খুলে বললাম সব । খালিকের রহস্য উন্মোচন হল ।
সে যে মিথ্যা বলেছিল চাচা তা জানতে পারলেন । শাস্তি হিসেবে , তাকে বেত্রাঘাত করা হল । আর আমাকে বারান্দায় আধা ঘন্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি জারি করা হল । তার সাথে বাসার আদালত কর্তৃক আমার বন্দুক ‘সিজ’ করা হল । খেলনার বন্দুক । আজও মনে পড়ে । ভাবি , আসলে ফলাফল জ্ঞান ছিল না বলেই হ্যাফ প্যান্ট পরা বালকের এত সাহস থাকে । ঝট করে সিদ্ধান্ত , ঝট করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ।
তেমন করেই একবার , আমার বন্দুক কেনার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল । অনেক আবদারের পর বাবা বন্দুক কিনে দিলেন । হাতে দিয়ে বললেন , কারও উপর যেন গুলি না করি । এই ধারণাটা আমাকে বাস্তবমুখী করে তোলে , বন্দুক দিয়ে গুলি করলেই মানুষ মরে । কিন্তু , খেলনার বন্দুক যে আসল বন্দুক না তা কে বুঝায় ?
আমি কখনও কোন প্রাণীর উপর গুলি চালাই নি । খুনি হবার শঙ্কায় । কিন্তু সব সময়ই মনে রুবেল , জসীমদের মত একটু ‘হিরু’ হওয়ার ইচ্ছা করত । কিন্তু , বিধাতা সবারই কিছু কিছু প্রত্যাশা পূরণ করেন । আমার এই প্রত্যাশাও ‘কিছু কিছু প্রত্যাশা’-এর মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিল ।
একবার আমাদের বাসার কাজের ছেলে এসে বলেছিল , “একটা ম্যাজিক দেখবে ?” সে বয়সে ম্যাজিক দেখার কৌতূহল কার না থাকে । আমিও বললাম , দেখাও । সে সুপার গ্লু বের করে আমার দুই আঙ্গুল এ লাগিয়ে চাপ দিল । আমার সেদিনই জীবনের প্রথম ‘সুপারগ্লু’ নামক অতি প্রয়োজনীয় ক্ষতিকারক বস্তুর সাথে মূলাকাত ঘটে । আমি বুঝতে পারি নি । সে গ্লু লাগিয়েই পালালো । আমি তো আঙ্গুল আলাদা করতেই পারছিলাম না । বহু বেদনাকে অতিক্রম করার পর আমি আঙ্গুল দুটি আলাদা করতে সক্ষম হই ।
কিন্তু , চামড়া কিছুটা উঠে যায় । কিছু রক্তও বের হচ্ছিল । আমার ব্যাথা হচ্ছিল । আমি রেগে উঠলাম । তখন আমার মাঝে ‘হিরুওয়ালা অ্যাকশন’ নেওয়ার মনোভাব জেগে উঠল । আমি আমার ড্রয়ার থেকে বন্দুক বের করলাম । গুনে গুনে চারটি গুলি লোড করলাম । লোড করেই তার সন্ধানে বাসার বাইরে থেকে বের হলাম । সেই রুবেলদের মত চিৎকার করে তাকে ডাক দিলাম , ‘ওই খালিক!’ দেখলাম সে আমাদের বাসার সামনের মাঠে কাপড় শুকাতে দিচ্ছিল । দেখে আমাকে কাপড়ের পিছনে লুকানোর চেষ্টা করল । আমি হুংকার দিয়ে উঠলাম , ‘সাহস থাকলে সামনে আয়’ । সে হালকা উঁকি দিল । দেওয়া মাত্রই আমি গুলি করলাম । গুলিটা তার কপালে গিয়ে লাগল । সে কপালে হাত দিয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগল । সাথে সাথে আমি আরেকটি গুলি তার বুকে করলাম । সে বুকে হাত দিয়ে আরও জোরে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল । তখন আমার হুশ ঠিক স্থানে আসল । সাথে সাথে ভয়ে শরীর কাঁপতে শুরু করল । আমি খুন করে ফেলেছি । তাহলে , ছায়াছবির ঘটনানুসারে আমাকেও জেলে যেতে হবে । আমার ফাঁসি হবে । কতক্ষণ অপেক্ষা করলাম তার সাড়া শব্দ পাই কি না । কিন্তু সে উঠে না । তখন ভয়ে আমি বন্দুক মাটিতে ফেলে দৌড় দিয়ে বাসার ছাঁদে গিয়ে এক কোণায় লুকিয়ে পড়ি । আমি সেখানে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করি ।
যত সময় যাচ্ছিল , আমার ভয় তত বাড়ছিল । “আজ আমি আসামি”। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । তখন চাচা , দেখতে পারলেন মাঠে খালিক শুয়ে আছে । তাকে পানি দিয়ে তুললেন । পরে জানা গিয়েছিল যে , সে অভিনয় করছিল । কিন্তু ,এত রোদে থাকা সত্ত্বেও সে ঘন্টা খানেক মৃত থাকার অভিনয় করল কি করে ? চাচা যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন ,সে এরকম শুয়ে ছিল কেন সে কোন ধরনের ভূমিকা না বলে , মূল ঘটনাকে আড়ালে রেখে সরাসরি বলে উঠল , ছোট ঠাকুর আমাকে চোখে গুলি করেছেন ।
চাচা বলে উঠলেন , “সর্বনাশ”! তিনি আরেক কর্মী সাগরকে পাঠালেন আমাকে খুঁজে আনতে । বহু কষ্টের স্বীকার করার পর সে আমাকে খুঁজে পেল । সে অনুরোধ করল নিচে যাওয়ার জন্য । আমি নিচে যেতে অস্বীকার করলাম । বারবার অনুরোধের পর অবশেষে সে আমাকে কোলে তোলে নিচে নামতে শুরু করল । আমি জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করলাম , বলতে লাগলাম , “আমাকে বাচাও । আমার ভুল হয়ে গেছে । আমি জেলে যেতে চাই না” । অবশেষে আমাকে চাচার সামনে হাজির করা হল । আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো , “এই রকম কান্ড ঘটানোর কারণ কি” ? আমি খুলে বললাম সব । খালিকের রহস্য উন্মোচন হল ।
সে যে মিথ্যা বলেছিল চাচা তা জানতে পারলেন । শাস্তি হিসেবে , তাকে বেত্রাঘাত করা হল । আর আমাকে বারান্দায় আধা ঘন্টা কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি জারি করা হল । তার সাথে বাসার আদালত কর্তৃক আমার বন্দুক ‘সিজ’ করা হল । খেলনার বন্দুক । আজও মনে পড়ে । ভাবি , আসলে ফলাফল জ্ঞান ছিল না বলেই হ্যাফ প্যান্ট পরা বালকের এত সাহস থাকে । ঝট করে সিদ্ধান্ত , ঝট করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
দেবব্রত সান্যাল ০৩/০২/২০১৬বিষয় , পরিবেশনা খুব চিত্তাকর্ষক। ভালো। আরও লিখুন।
-
ধ্রুব রাসেল ০৩/০২/২০১৬ভাল লেগেছে।
-
বিদ্রোহী ফাহিম খান ০২/০২/২০১৬ভালো লাগলো॥ শুভেচ্ছা॥