www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অপেক্ষা

মেয়েটি ১০৪ নাম্বার রুমের সামনে বসে আছে। গায়ে কালো বোরখা, মাথায় ওড়না। গায়ের রঙ শ্যামলার চেয়ে আর একটু বেশি উজ্জ্বল। নাক ফুটো করা কিন্তু নাকফুল নেই, মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেউ খুলে নিয়েছে। বিবাহিত মেয়েদের জন্য নাকফুল একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। মেয়েটির ঠোঁটের বাম পাশে ছোট একটা তিল। নাকটা হালকা বোঁচা হলেও তাকে মোটামুটি সুন্দরীর দলে ফেলা যায়। চোখ টা একটু বড় হওয়ার কারণে টিপ আর কাজলে তাকে দেবীর মতো লাগার কথা।

মেয়েটির কোলে ফুটফুটে একটা শিশু। প্রায় আধাঘণ্টা আগে সে এখানে এসেছে। অপেক্ষা সব সময়ই বিরক্তিকর কিন্তু বিশেষ একটা কারণে আজ সে ইচ্ছে করেও বিরক্ত হতে পারছে না। তাছাড়া একঘেয়েমি ব্যাপারটা তার রক্তের সাথে মিশে গেছে। সে বাচ্চাটাকে কাঁধের সাথে হেলিয়ে নিলো। মাথার উপর শো শো শব্দে ফ্যান ঘুরছে। সে বাচ্চার কাপড় একটু ভালোভাবে মুড়িয়ে ফ্যান থেকে একটু দুরে গিয়ে বসলো। রুমের দরকার সামনে একটা মাঝবয়সী লোক বসে আছে। লোকটা খোঁচা দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করার চেষ্টায় রত। তার সামনে টেবিলে কিছু ফাইল, একটা কলম আর একটা ময়লা খাতা অগোছালো ভাবে পড়ে আছে। মমেনার ইচ্ছে করছে টেবিলটা সুন্দর করে গুছিয়ে দিতে।
সেকি গিয়ে বলবে- ভাই আপনার টেবিলটা গুছিয়ে দিতে পারি?
কি হাস্যকর হবে ব্যাপারটা। তার আশেপাশে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। সবাই ভাববে মেয়েটার উন্মাদ নাকি? কিন্তু সত্যিই তার খুব ইচ্ছে করছে ভদ্রলোকের টেবিলটা গুছিয়ে দিতে। ক্রিং ক্রিং শব্দে বেল বেজে উঠল। দাঁত খোঁচানো লোকটা হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। মমেনা হঠাৎ দাঁড়িয়ে বসে পড়ল। সে কি জন্য উঠল সেটা সে ছাড়া আর কেউ জানবে না কোনদিন। তার উঠার কথা না, কেবল বার চলছে। তার পঁয়ত্রিশ ।

খুব সুন্দর ছিমছাম একটা অফিস পেলো মমেনা। হঠাৎ করেই হল সবকিছু। অনেক দিন ধরেই একটা চাকরি খুঁজছিল সে। যেকোনো একটা চাকরি তার খুব দরকার ছিল। শেষে তার বড় মামার এক বন্ধুর রেফারেন্সেই চাকরিটা হল। অফিস থেকে তাকে একটা আরএফএল এর চেয়ার আর একটা ফোলডিং টেবিল দেয়া হল। তার জায়গা হল ১০৪ নাম্বার রুমের দরজার ডান পাশটায়। এটাই তার অফিস। অন্যান্য অফিসের সাথে তারটার পার্থক্য হল এটার কোন কিছু দিয়ে ঘেরা না। এখানে কাউকে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হয়না। সামনে দিয়ে সারাদিন মানুষ আসা যাওয়া করে। এখানে নিরিবিলি বলে কোন ব্যাপার নেই। এমন না যে ইচ্ছে হল যে রুম লক করে এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়া যায়।

মাথার উপর এসি। টুপটাপ করে পানি পড়ে সারাক্ষণ। সে চেয়ারটা এগিয়ে নিয়েছিল বামে। ফোটা ফোটা পানি যখন মেঝেতে পড়ে তখন ছিটকে কিছুটা পায়ের উপর এসে পড়ে। খুব বিরক্তিকর ব্যাপার। অফিসে কমপ্লেইন করেও কিছু হয়নি। সে নিজ দায়িত্তে একটা প্লাস্টিকের গামলা কিনে এনেছে। মমেনাকে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে অফিসে আসতে হয়। রুমের দরজা খুলে চেয়ার টেবিল বের করে আনে। সবকিছু ঠিকঠাক করে বসে থাকে। চারটা থেকে ডাক্তার বসে।  
ডাক্তারের নাম মশিউর রহমান, বিসিএস, এফসিপিএস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। বয়স চল্লিসের কাছাকাছি। ভদ্রলোক অতি ভদ্র, বিনয়ী। এখানকার স্থানীয় হওয়ায় এলাকার রোগী বেশি। বেশির ভাগ সময় ভিজিট মিস হয়ে যায়। রোগী দেখার পর রোগী যখন ভিজিট বের করতে থাকেন তখন তিনি খুব লজ্জা পান এবং অমায়িক ভঙ্গিতে হাসেন। মমেনাকে তিনি আপনি ডাকেন। মমেনার মাঝে মাঝে অস্বস্তি লাগে। স্যার আমাকে তুমি বলবেন এটা তো বলা যায়না। মমেনার ধারণা তার স্যার হল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের মধ্যে একজন। প্রথম দিনে প্যাথলজি সেকশনের মজিদ সাহেব মমেনাকে পরিচয় করে দিয়েছিলো।
স্যার প্রথমেই বললেন—মমেনা, এর আগে আপনি কি অ্যাটেডেন্টের কাজ করেছেন?
মমেনা বলল—না স্যার।
--ঠিক আছে। অসুবিধা নাই। রোগীদের মেইন্টেইন করাটা জরুরী। ঠিক আছে আস্তে আস্তে শিখে যাবেন। আমি প্রতিদিন বিকাল চারটা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত এখানে বসবো। তারপর ফাতাহ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে আটটা।
--ঠিক আছে স্যার। আমাকে বলা হয়েছে এসব অফিস থেকে।
--গুড।

মমেনার পাশের রুমের সামনে বসে জামাল। ওখানে নাক কান গলার আসাদ স্যার বসেন। জামাল ছেলেটার বয়স সাতাশ আঠাশ হবে। গায়ের রঙ কালো। দাঁত অতিরিক্ত ঝকঝকে। খেলা নিয়ে তার বিশেষ একটা আগ্রহ আছে। কথা বেশি বলে। মমেনা ওর বকবক শুনতে শুনতে মহাবিরক্ত। সেই প্রথম দিন থেকেই।

--আপনি এখানে নতুন জয়েন করেছেন?
--জি।
--আমি দুই বছর ধরে আছি। এর আগে আই স্পেশালিষ্ট সাত্তার স্যারের আন্ডারে ছিলাম। আপনার বাসা কোথায়?
--জি, রহমতপুর।
--বলেন কি, ঐখানে তো আমার বড় ভাই জায়গীর থাকত। রহিম শেখের বাড়িতে, চেনেন?
মমেনার বিরক্ত লেগেছে তবু হাসি মুখে উত্তর দিয়েছে—জি না।
--কোন সমস্যা হলে বলবেন। ফাইলে প্রেসক্রিপশন পিনে দিতে শিখেছেন? কোন অসুবিধা হলে বলবেন। আপনি নতুন তো এজন্য বললাম।

বেশি কথা বলা লোক মমেনার পছন্দ না। বিরক্তে তার গা জ্বলে যায়। কিছু বলা যায় না। এর দুই দিন পরে জামাল হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে বসলো—কেউ আছে নাকি ফাঁকা?
মমেনার মেজাজ খারাপের মতো অবস্থা।
সে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল—আমি বিবাহিত।
সে হয়তো খেয়াল করেনি জামালের মুখটা সেই সময় দপ করে নিভে গিয়েছিলো। যাহোক এসব আগের কথা এখন জামালের প্রতি অতটা বিরক্ত নয় মমেনা। সে বুঝতে পেরেছে এরাই এখন তার বন্ধু। এদের সাথে মিলেমিশে থাকতে হবে। বিপদে এরাই পাশে দাঁড়াবে।

একদিন মমেনা একটা দুর্নীতি করে ধরা খেয়ে গিয়েছিল। একটা মোটাসোটা মহিলা তার হাতে পঞ্চাশ টাকা জমা দিয়ে বলেছিল তার সিরিয়ালটা আগে দিতে। মমেনা লোভ সামলাতে পারেনি। তাছাড়া তার ধারণা ছিল না মানুষ এতো ক্ষেপে যেতে পারে। সবাই অ্যাটেন্ডেন্টের টাকা খাওয়ার কথা বলছিল। একটা মানুষ আগে গেলে কে বা কি মনে করবে। সিরিয়াল ব্রেক করে অন্য একজনকে ভেতরে যেতে দেখে কিছু সচেতন রোগীর অ্যাটেন্ডেন্ট ক্ষেপে আগুন। আস্তে আস্তে সব রোগী এই বিদ্রোহে যোগ দিল।

মমেনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল—উনার বাসা অনেক দূর। কি একটা জরুরী কাজ আছে তাই যেতে দিলাম।
লোকজন সমস্বরে বলে উঠল- আমাদেরও বাসা দুরে। আমাদেরও অনেক জরুরী কাজ আছে। ফাইজলামি করার জায়গা পান না। টাকা খেয়ে লোক ভেতরে ঢোকান।

জাঁদরেল জাঁদরেল ভদ্রলোক বিকট জোরে চিৎকার করছিলেন। মমেনা এই পরিবেশের সাথে পরিচিত নয়। সে নতুন এসেছে। আবেগটাও বেশি। নিজের বোকামির জন্য খুব খারাপ লাগছিল। এটাই ছিল তার প্রথম এবং শেষ দুর্নীতি। সেদিন সবার সামনে সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলেছিল।
শেষে জামাল এসে ব্যাপারটা সামলে নিয়েছিল।
--ভাই আপনারা অযথা চিৎকার করবেন না। এখানে আরও রোগী আছে। যে ভেতরে গেল সে মশিউর স্যারের আত্মীয়। মামী শাশুড়ি। স্যার উনাকে নিজে আগে যেতে বলেছেন। এখানে অ্যাটেন্ডেন্টের কি দোষ? বিশ্বাস না করলে স্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন। যান ভেতরে যান।

জামাল কথা গুলো খুব কনফিডেন্টের সাথে বলছিল। কেউ অবিশ্বাস করবে না। তার ধারণা ছিল কেউ চেম্বারের ভেতরে গিয়ে স্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করার সাহস পাবেনা। তারা রোগী নিয়ে এমনিতেই ঝামেলাই আছে, বাড়তি ঝামেলার মধ্যে জড়াবে না।
আর একদিন এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। মাস্তান টাইপ রাজনৈতিক এক নেতা জোর করে চেম্বারে ঢুকে পড়েছিল। সেদিন অবশ্য মমেনা একাই সামলেছিল।

প্রথম দিকে মমেনা সালওয়ার কামিজ পরে আসত। কপালে টিপ দিত ঠোঁটে লিপস্টিক দিতো। কয়েকদিনের মধ্যে সে খেয়াল করলো স্টাফদের অনেকেই তার আশে পাশে ঘুরঘুর করছে। পটানোর চেষ্টা করছে। গল্প শোনাবার ছলে অশ্লীল জোকস বলে টোপ দিচ্ছে। মমেনার এসব ভালো লাগেনা। সে পরদিন থেকে বোরখা পরে এসেছে। এরপর তাকে তেমন আর সাজগোছ করতে দেখা যায়নি।

সে এমন কোন অতি স্ট্রং পারসোনালিটি নয় যে সে এই দুশ্চরিত্র লোকের মুখে থুথু দিয়ে তার নিজের মতো চলবে। নিজের পছন্দ অপছন্দের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না নর্দমার কিছু কীটদের। সে অতি সাধারণ এক বাঙালি মেয়ে। যার স্বামী বেকার। ছোট এই চাকরিটা যার সম্বল।  ওত জিদ হলে চলেনা। তাকে গা বাঁচিয়েই চলতে হবে।

মমেনার বরের নাম আব্দুল লতিফ। বরের সাথে তার বয়সের পার্থক্য দশ বছর। ভদ্রলোক বেকা্র তবে আত্মসম্মানে ভরপুর। হরিরাম পুর হাইস্কুলের পিয়ন পদে ঢুকে আছেন, এখনও বেতন আসেনি। কিছু জমি বেঁচে প্রায় দেড়লক্ষ টাকা দিয়ে বসে আছেন পদটার জন্য। বাড়ির সাথে লাগানো একটা মুদির দোকান চালান আপাতত। মমেনার চাকরি লতিফ কখনোই ভালোভাবে নেয়নি। তাই বলে নাও করতে পারেনা। সংসারে টাকার দরকার আছে। এক মুদির দোকানের ইনকামে কিছু হয়না।

মমেনা রাত নটার দিকে বাসায় ফিরে। লতিফ সব সময়ই মনে মনে ফুলে থাকে। ভালোভাবে কথাও বলেনা। মমেনা রান্না বসিয়ে দেয়। খেতে খেতে ওদের রাত সাড়ে দশটা বেজে যায়। মমেনার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে। মানুষের সাথে এতো চেঁচামেচি করে প্রায় দিনই ওর মাথা ধরে। লতিফ অতসব বুঝেনা। মমেনাকে জেগে থাকতে হয়।

মমেনার মাঝে মাঝে মনে হয় জামালের মতো কারো সাথে বিয়ে হলে খুব ভালো হতো। সারাদিন পাশাপাশি কাটত সময়। দুজনে রাতে একসাথে বাসায় ফিরত। দুজন দুজনকে ভালোভাবে বুঝত। সন্দেহের কোন অবকাশ থাকত না। জামাল ছেলেটা ভালোই। মমেনা জানে সুযোগ পেলে ও তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। পছন্দও করে হয়তো। কিন্তু কি লাভ? মমেনার ওত সাহস নেই।

একবার ডাঃ মশিউর রহমানের মেয়ের জন্মদিনে দাওয়াত পেয়েছিল মমেনা। সে এতোটা আশা করেনি। স্যার বললেন মমেনা, আমার মেয়ের জন্মদিন সামনের বুধবারে। তুমি এসো।

মমেনাকে এতো সম্মান করে কেউ কখনো দাওয়াত দেয়নি। গ্রামে অতি দরিদ্র ঘরে তার জন্ম। দাওয়াত যিয়াফত এর সাথে তেমন একটা পরিচিত নয়। সে মার্কেটে গিয়ে অনেক খুঁজে একটা ফ্রক কিনল। তার মতো অভাজনের দেয়া সস্তা জামা কি ডাক্তারের মেয়ে পড়বে। তবু সান্ত্বনা। খালি হাতে তো যাওয়া যায়না।

এরকয়েকদিন পরে স্যারের স্ত্রী-মেয়ে কোন এক কারণে চেম্বারে এসেছিল। মমেনা আশা করেনি এতোটা। পিচ্চি মেয়েটা তার দেয়া ফ্রক পরে এসেছে। মমেনার ধারণা ছিল জামাটা হয়তো কাজের বুয়ার মেয়েদের দিয়ে দেয়া হয়েছে। খুব কান্না পাচ্ছিলো মমেনার। সেদিন সে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
জামাল ছেলেটা অবাক হয়ে বলেছে—কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন? মমেনা ধমক দিয়ে বলেছে—চুপ করুন তো। আমি কাঁদলে আপনার কি?

একদিন হঠাৎ করেই চাকরিটা ছেড়ে দিল মমেনা। লতিফের বেতন হয়েছে। এখন আর তার চাকরি করার দরকার নাই। লতিফের এক কথা। বউ দিয়ে সে চাকরি করিয়ে নেবেনা। মমেনা অনেক বোঝাল। দুজনে ইনকাম করলে সংসার আরও ভালো চলবে। তাদের ভবিষ্যৎ অনেক ভালো হবে। কে শোনে কার কথা। অনেকেই শুয়ে বসে থাকতে পছন্দ করে। অনেকে আবার কাজের ভেতর আনন্দ পায়।
দিনগুলো কাটছিল না মমেনার।

বাড়ি থেকে খুব একটা বের হওয়া হয়না। তার চেয়ারটায় অন্য একজন এসে বসেছে হয়তো। টেবিলের উপর ফাইলগুলো হয়তো ছড়িয়ে আছে এলোমেলো ভাবে। টেবিলের উপর সে নিজে ফুল তোলা একটা কাপড় বিছিয়ে দিয়েছিলো। এখনও কি কাপড়টা আছে? নাকি ময়লা হয়ে বিশ্রী দেখাচ্ছে। দুপুরবেলা হঠাৎ রিকশার বেলে ঘুম ভেঙে যায় মমেনার। তার মনে হয় রোগী দেখা শেষ হয়েছে। স্যার বেল টিপেছেন।
সে অতকিছু না ভেবে ঘুমের ঘোরের মধ্যে বলে ১৪ নম্বর আসেন। ১৪ নম্বর। এই বেলের শব্দ তাকে নিয়ে যায় সেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দিনগুলোতে।
সে হয়তো আনমনে বসে আছে কোথাও, বেলের শব্দ কানে আসা মাত্রই সে আপনাআপনি দাঁড়িয়ে পড়ে। ভাবটা কাটলে নিজেই লজ্জা পায়। একটা বছর সে বেলের জন্য উন্মুখ হয়ে থেকেছে। কখন বেল পড়বে ঠিক তখনই তাকে ভেতরে যেতে হবে বা নতুন রোগী পাঠাতে হবে। হয়তো জামালের সাথে গল্প করছে কিন্তু তার কান থাকে এক দিকে। বেলটা কখন ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে ওঠে। এই শব্দের ভেতর আটকে গিয়েছিলো তার জীবন। এর হাত থেকে এতো সহজে ছাড়া পাওয়া যাবেনা।

মমেনার বাচ্চা হল। মেয়ে। মেয়ের গায়ের রঙ দেখে সে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। যাক বাবা ওর বাবার মতো হয়নি। আর যাই হোক অন্তত গায়ের রঙটা মায়ের মতো হয়েছে। এখন তার আর একাকী লাগেনা। সেই অফিস জীবনও আর খুব একটা মনে পড়েনা। মেয়েকে নিয়ে খুব আনন্দেই কাটছিল তার দিনগুলো। কিন্তু কালো ছায়া তার পিছু ছাড়ল না।
বাচ্চার নিউমোনিয়া। শ্বাসকষ্ট। হাসপাতালে অক্সিজেন দিতে হল। বেশ কিছু টাকা চলে গেল। ঋণও হয়ে গেল অনেকের কাছে। জামাল বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলো। ডাঃ মশিউরের কাছে একদিন গিয়েছিলো মমেনা। পায়নি। তিনি বদলি হয়ে চিটাগাং চলে গেছেন। তখন মমেনাদের খুব খারাপ অবস্থা। একদিকে বাচ্চার ওষুধ, সংসারের খরচ। কিছু করার ছিল না। মমেনা ফিরে গেল আগের জীবনে।

লতিফ একদিন বলল—মমেনা তোমার চাকরিটা থাকলে এখন ভালোই হতো। ক্লিনিকে একটু খোঁজ নিয়ে দেখো যদি কোন ব্যবস্থা হয়।
মমেনা বলল—এখন কি চাকরি করা সম্ভব, বাবুকে কে দেখবে?
--বাবুকে নিয়ে চিন্তা নেই। আমার ফুফাত বোনকে এনে রাখব।
মমেনা বলল—সংসারে একজন মানুষ বেড়ে যাবে। খরচ বেড়ে যাবে কত বুঝতে পারছ?
লতিফ বলল—তোমাকে ওত কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না, তুমি শুধু দেখো ক্লিনিকের চাকরিটা পাওয়া যায় কিনা।

মমেনা আর কথা বাড়ায় নি। কারণ তারও মনে হয়েছে সংসারে বাড়তি আয়ের দরকার। সে জামালের সাথে দেখা করলো। মশিউর স্যার চলে গেছেন। মমেনা চাচ্ছিল মশিউর স্যারের মতো যদি কাউকে পাওয়া যায়। জামাল চাকরির ব্যবস্থা করলো। জমজম হাসপাতাল। ডাঃ মোঃ জামিল খন্দকার। স্কিন অ্যান্ড সেক্স স্পেশালিষ্ট। মাই ডিয়ার টাইপ লোক। অনেক সময় নিয়ে রোগী দেখেন।

রোগীরা চেম্বার থেকে বের হয়ে শুধু বলে—ডাক্তার এতো আন্তরিক কিভাবে হয়? কিভাবে হয়? অসাধারণ লোক একটা। মমেনার স্যার ভাগ্য ভালোই বলা যায়। ডাক্তার রোগী চেম্বার বাচ্চা সংসার নিয়ে তার জীবন চলছে। লতিফের ফুফাত বোন ফিরোজা আসার জন্য, রাতের খাবার আর মমেনাকে রাঁধতে হয়না। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। কোন কোন দিন বাবু ঘুমিয়ে পড়ে। তবু মমেনার টেনশন হয়। যেকোনো মহিলার যেরকম টেনশন হয় সেরকম। বাড়িতে এক যুবতি মেয়ে আর লতিফ। সন্দেহ একটু হয়।
মাঝে মাঝে মনে হয় লতিফকে জিজ্ঞেস করবে—ফিরোজাকে নিয়ে তার অন্য কোন চিন্তা আছে কিনা? সাহস হয়না।

চাকরি করা মেয়েরা সাধারণত সংসারে আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করে। যেকোনো ব্যাপারে মতামত দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মমেনা চাকরি করলেও অতি ভীতু টাইপ একজন। যেকোনো মূল্যে সে এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চায়। তাছাড়া আজগুবি সন্দেহ করে কাউকে বিব্রত করতেও ইচ্ছে করেনা তার। হয়তো ফিরোজা কে নিয়ে লতিফের কোন পরিকল্পনা নেই। অযথা সংসারে ঝামেলা বাঁধানোর কিছু নেই। ঝামেলা আসবে জীবনে। ঝামেলা ছাড়া জীবন হয় না। এটা জীবনেরই একটা অংশ।

ডাঃ জামিল খন্দকারের স্ত্রী প্রায়ই চেম্বারে আসেন। ভদ্রমহিলার খুবই সন্দেহের বাতিক। মমেনাকে দেখার পর তার সন্দেহ আরও বেড়ে গেছে। কারণ মমেনা তার চেয়ে কয়েক গুণ সুন্দরী। এতো সুন্দরী অ্যাটেন্ডেন্টের লোভ কি সামলাতে পারবে তার স্বামী। এটা অনেক কঠিন ব্যাপার। কিন্তু ডাঃ জামিল এমন একজন মানুষ তিনি এটা পারেন। বহুগামিতা তার খুব অপছন্দের ব্যাপার। তিনি প্রচণ্ড ভাবে সৎ, ভদ্র, দয়ালু।
কিন্তু বিচিত্র কোন এক কারণে তার স্ত্রী তাকে রাতদিন সন্দেহের উপর রাখে। ব্যাপারটা বিরক্তিকর। জামিল সাহেব নিতান্ত ভালো মানুষ বলে এসব সহ্য করে যাচ্ছেন। তাছাড়া তার স্ত্রীর প্রচণ্ড ভালোবাসা এবং হারানোর ভয় এই সন্দেহের বীজ। তার চেহারা ভালো না যেকোনো সময় সুন্দরী মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতেই পারে। পুরুষ মানুষের উপর বিশ্বাস নাই।

মমেনার চাকরি চলে গেল। ডাঃ জামিল একদিন তার রুমে ডেকে নিয়ে বললেন—
মমেনা, আমি জানি তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে। কথা গুলো বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার স্ত্রীকে তো দেখছ, তার ধারণা তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক আছে। খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মহিলা। কদিন ধরে বাসায় খুব ঝামেলা হচ্ছে। তার এক কথা তোমাকে অ্যাটেন্ডেন্ট হিসাবে রাখা যাবে না। ইভেন কোন মেয়ে পর্যন্ত না। ও প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় কোন ঝামেলা করতে চাচ্ছি না। আমি আসলে তোমাকে রাখতে পারছি না, খুবই সরি। অফিসে খোঁজ নাও। কাজ পেয়ে যাবে। তোমার মঙ্গল হোক।

মমেনা তার ভাইয়ের বাসায় চলে এলো। তার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। তার একমাত্র বড় ভাই জসিম সংসারের মাথা। তার আট বছর বয়সী একটা ছেলে আছে। মমেনার মা বেঁচে আছেন। ভদ্রমহিলার হাড় জিরজিরে শরীর। বয়সের তুলনায় বেশি বৃদ্ধ দেখায়। জসিম সাইকেল মেকানিক।
কিছুদিন আগে পাশে একটা গ্যারেজও করছে। টানাটানির সংসারই বলা যায়। তার উপর মমেনা বাচ্চা সহ উঠে এসেছে। জসিম বোনকে অত্যন্ত ভালবাসে। সে যতক্ষণ বেঁচে আছে ততক্ষণ বোনকে আগলে রাখবে। মমেনার আগমনে সবচেয়ে বিরক্ত যে মহিলা সে হল জসিমের বউ জোছনা বানু। রাতে জসিমের ঘুম আসেনা, বউয়ের ফিতফিত শুনতে শুনতে। বউ যতই বকুক জসিম তার সিদ্ধান্তে অনড়। সে যতক্ষণ বেঁচে আছে মমেনা তার সাথে থাকবে। এতো আদরের বোনকে সে পথে ফেলে দিতে পারেনা।

এরমদ্ধে জসিম একদিন লতিফের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। ছেলে যে এতো জেদি আর গোঁয়ার সেটা আগে টের পায়নি। জসিম লতিফের চেয়ে অনেক বড়।
কিন্তু কথা গুলো খুব ছোট হয়ে বলছিল- লতিফ, দেখ তুমি এতো দিন ধরে মমেনার সাথে সংসার করছ। তুমি তো তাকে খুব ভালো করে চেন। সে কোন খারাপ কিছু করেনি। দরকার হলে তুমি ডাক্তারের কাছে চল। তাহলেই সবকিছু প্রমাণ হয়ে যাবে। তুমি এভাবে সম্পর্ক নষ্ট করোনা।

লতিফ খুব উদ্ধত ভাবে কথা বলেছে- ভাই দেখেন, ডাক্তার কি স্বীকার করবে এসব? সে পাগল না। ডাক্তারের বউ তো অশিক্ষিত মানুষ না। ব্যাপারটা গুরুতর পর্যায়ে গেছে বলেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি এই মহিলাকে নিয়ে সংসার করবো না। আমারে মাফ দিয়েন।

জসিম কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। লতিফ দাঁড়ায় নি। বেয়াদবের মতো চলে গেছে। মমেনার বারবার নিষেধ সত্ত্বেও জসিম আরও কয়েকবার লতিফের বাড়িতে গিয়েছে। কিন্তু তার দেখা পায়নি। হ্যাঁ মমেনা তখনো বেঁচে আছে। সংগ্রাম করে যাচ্ছে সে। লতিফ তাকে তালাক দিয়েছে। ফিরোজাকে বিয়ে করেছে নাকি এরকমই শোনে মমেনা।

বাচ্চার খরচ লতিফের বহন করার কথা। প্রথম দিকে নিয়মিত পাঠাতো। এখন অনিয়মিত হয়ে গেছে। সে চিন্তা করছে কোন নারী সংগঠনের সাহায্য নিবে কিনা। রাজারহাটে ওদের অফিস আছে। একদিন সময় করে যেতে হবে। বাচ্চার অসুখ সারলেই যাবে। বাচ্চার ঠাণ্ডা লেগে কফ বসে গেছে।

মমেনা ডাক্তারের কাছে এসেছে। সে ১০৪ নাম্বার রুমের সামনে বসে আছে। তার সিরিয়াল পঁয়ত্রিশ। এখানকার কেউ তেমন তার পরিচিত না। ফাতাহ তে গেলে বলে কয়ে ফ্রিতে দেখানো যেত। ওটা একটু দুরে। আজ হাতে সময় নেই। ডাক্তার দেখিয়ে কয়েকটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খোঁজ নিতে হবে। যদি কাজ পাওয়া যায়। এভাবেই চলছে দিনগুলো তার।

মমেনা আসার পর জোছনা বানুর ভালোই হয়েছে। সে এখন পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকে। সব কাজ মমেনায় করে। তবু বিড়বিড় করতে থাকে। প্লেটে ছাই লেগে আছে, তরকারিতে বেগুনের রঙ কালো হয়ে গেছে নানা যন্ত্রণা। মমেনার এসব ভালো লাগেনা। মনে হয় যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। কিন্তু বাচ্চার কি হবে? লতিফ নাকি মমেনাকে আবার নিতে চায়। সেদিন জসিমের সাথে দেখা বাজারে লতিফের দেখা হয়েছিল। সে আবার মমেনাকে চায়। মমেনা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি সে সতীনের ঘর করবে কি না। নাকি সারা জীবন ভাইয়ের বাসার কাজের লোক থেকে যাবে। একটা চাকরীর চেষ্টা করছে। একটা চাকরীর ব্যবস্থা হলেই হয়। কিন্তু তাও তো হচ্ছেনা।

কিছু একটা করা দরকার। নিজের জীবনটা তো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বাচ্চাটাকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দিতে চাই সে। লতিফের সাথে ছাড়াছাড়ির পর মমেনা একদিন জামালের সাথে দেখা করার জন্য গিয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা করা হয়নি। ক্লিনিকের গেটে ঢুকতেই দারোয়ান বলল—
আপা, অনেক দিন আপনার সাথে দেখা। জামাল ভাই তো বিয়ে করছে। সামনে বুধবারে।

মমেনা আর ভেতরে ঢুকেনি। কেন জানি তার ভালো লাগেনি। গেলে হয়তো বিয়ের দাওয়াত দিতো। তার মনে হল সেটাতে তার হয়ত ভালো লাগবে না। সে ফিরে এলো। জামালের সাথে আর দেখা হয়নি।
দাঁত খোঁচানো অ্যাটেন্ডেন্ট চিৎকার করছে—পঁয়ত্রিশ কে পঁয়ত্রিশ। রাব্বি হাসান। পঁয়ত্রিশ রেডি হন। নাই পঁয়ত্রিশ। ছত্রিশ।

মমেনার সম্বিত ফিরে এলো। পঁয়ত্রিশ তো সিরিয়াল। সে হম্বিতম্বি করে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে কি লাভ হল। ছত্রিশ ঢুকে গেছে ভেতরে।
--ভাই আমি পঁয়ত্রিশ।
--আপনি পঁয়ত্রিশ। কত বার ডাকলাম। এতো কাছে থেকেও শুনতে পাননি। ছত্রিশ ঢুকে গেছে। এরপর আপনি যান। একটু অপেক্ষা করেন বসেন। আপনার বাচ্চার ওজন নেয়া হয়েছে?
--জি।
মমেনা আবার এসে চেয়ারটায় বসলো, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। তাকে অপেক্ষা করতে হবে একটু সুখের জন্য, তার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, এই অপেক্ষার শেষ কোথায় কে জানে...
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৩৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/০৩/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ২৮/০৩/২০১৫
    ভালো ।।
  • তুষার রায় ২৩/০৩/২০১৫
    জীবন যেখানে যেমন............এগিয়ে যাচ্ছে লেখক, এগিয়ে যাচ্ছে
  • অন্তু নীল ২২/০৩/২০১৫
    সুন্দর লিখেছেন।
  • সবুজ আহমেদ কক্স ১৯/০৩/২০১৫
    গল্পটা মুগ্ধ হবার মতো
 
Quantcast