www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

তারা একটি দুটি তিনটি করে এলো

মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ
হয়ে জন্মালে বোধ হয় ভালো হতো। আর যাই হোক অন্তত
জীবনের দুর্যোগের
দিনগুলোতে প্রিয়জনকে কাছে পেতাম।
মানুষ যখন অসুস্থ
হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকে তখন তার আত্মীয়
স্বজনেরা একে একে তাকে দেখতে আসে। তাদের
হাতে থাকে হরেক রকমের খাবার। যদিও রোগীর
পক্ষে সেসব খাওয়া প্রায় সম্ভব হয়না তবু এটার
মধ্যে আত্মীয় স্বজনদের প্রতি দিলখোশ হয়ে যাওয়ার
একটা ব্যাপার থাকে।

এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার মনে হয়-
আহা, এরা আমাকে বড় ভালবাসে।

আমাদের সমাজে এধরনের
ভালোবাসা প্রদর্শনের কোন নিয়ম বা সুযোগ কোনটাই
নেই। জন্মের কিছুদিন পরপরই আমাদের নিজের পথ
নিজেদেরই মাপতে হয়।

আমি ছিলাম ভীষণ অলস। পিতামাতার
ছায়াতলে যে কয়দিন ছিলাম, সেসব দিন কেটেছে রাজার
হালে। খাবার সংগ্রহ করতে যাইনি কখনো। ভাইদের সঞ্চিত খাবার
থেকে চুরি করে খেয়েছি। অন্যকে বোকা বানিয়ে খুব
সুখেই কাটছিল দিন আমার।

২২ শে শ্রাবণ সন্ধ্যায় আমি প্রথম
আলো জ্বেলে বের হয়েছিলাম। বাবুলদের ডোবার
ধারে একটা স্বর্ণলতার উপর বসে ছিলাম। আমার দেহ
থেকে ঠিকরে বের হচ্ছিল আলো। লুসিফারেজ তৈরি করছিল
আলো আর সেটা ঠাণ্ডা করছিল লুসিফেরিন। যৌবনের
একটা অদ্ভুত তেজ আমাকে এখানে বলতে গেলে জোর
করেই ডেকে এনেছে।

জীবনের প্রথম
সঙ্গীনি খোঁজার দিন। ভয়, বিস্ময়, আনন্দের একটা অদ্ভুত
মিশ্রণ আমার মধ্যে কাজ করছিল। আমার আলোতে কেউ
কি আদৌ সাড়া দেবে। আমার ভাইয়েরা যদি আমার এই হাল
জানতে পারে তবে তো তারা চন্দ্রবিজয়ের আনন্দ পাবে।
আর যদি কেউ সাড়া দেয় তাহলে সে কেমন হবে।
তাকে কি আমার পছন্দ হবে। একবার ভাবলাম, আমাদের
সমাজে তো এক প্রজাতির
মেয়ে জোনাকি পোকা কখনো অন্য প্রজাতির ছেলের
সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে না, এটা ভারি সমাজে অন্যায়।
যদি নেহায়েত এমন দুর্ঘটনা কখনো ঘটে যায়,
তাহলে কাছে আসার পর
মেয়েটো ছেলে জোনাকিকে ফাঁদে ফেলে মেরে ফেলে।


ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল। মনে হল থেকে কাজ নেই,
চলে যায়। এমন সময় সে আলো জ্বেলে আমার আলোর
ডাকে সে সাড়া দিল। আমাদের সম্মিলিত
আলোতে ভরে গেল স্বর্ণলতাটা। আমাদের পরিচয় হল।


প্রথম দেখাতেই ভালো লাগার মতো মেয়ে জুনি সে ছিলনা।
কিন্তু তার কথা আমার খুব ভালো লাগলো। মন্ত্রমুগ্ধের
মতো শুনলাম আমি ওর কথা। আমরা একসাথে ঘুরলাম,
ঝোপে ঝাড়ে বেড়ালাম। তারপর আমাদের ভালো লাগলো।
তারপর আমরা কাছে আসলাম। আমি অলস। আগেই বলেছি।
বেশির ভাগ সময় ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে অনেক
তথ্যই আমি আবিস্কার করে ফেলেছি।

আমাদের
জাতে মেয়েদের বাচ্চা হবার পরই তারা মারা যায়, ছেলেরা অবশ্য
তার আগেই মারা যায়। আমি বোধ হয় জুনিকে একটু
অন্যভাবে ভালোবেসেছিলাম। একটু অন্যভাবে। কারণ স্বাভাবিক
চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। আমি শুধু ভাবতাম যে ভাবেই হোক
বাচ্চা যেন না হয়। জুনির মারা যাওয়া ব্যাপারটা আমার কাছে এক
অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। সে মৃত্যুতে পরোক্ষ ভাবে হলেও
আমার হাত থাকবে এমনটা আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। এজন্য
প্রেমের মুহূর্ত গুলোতে আমি এড়িয়ে চলতাম জুনিকে।


অযথায় চলে যেত ঝুম বর্ষার দিন। জুনির আবার বাচ্চার শখ।
আসলে মেয়েরা জন্ম থেকেই মাতৃত্ব বিষয়টাকে অর্জন
করে। আমি তাকে মৃত্যুর বিষয়টা বুঝিয়েছিলাম। সে বোঝেনি।

বলেছে—তাই বলে আমাদের বাচ্চা হবে না?
আমি বলেছি—
বাচ্চা থাক সোনা। আমি পৃথিবীতে আরও অনেক দিন
তোমাকে পাশে পেতে চাই। তোমার সাথে আরও অনেক
বৃষ্টিতে ভিজতে চাই। তোমাকে কাছে পাওয়ার এ আনন্দ
এভাবে ম্লান করে দিওনা।

সে আমাকে নপুংশুক
বলে গালি দিয়েছে। আমি মনে মনে বলেছি তোমার মৃত্যুর
কারণের চেয়ে নপুংসুক অপবাদটা আমার
পক্ষে মেনে নেয়া সহজ। তারপর
সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি বাঁধা দিইনি। যাওয়াই
স্বাভাবিক। আমিই অস্বাভাবিক। জীবনটা তো আমার
ইচ্ছে মতো চলবে না। সবারই বিভিন্ন রকম চাওয়া পাওয়া আছে।


জুনি তার সঙ্গী খুঁজে পেয়েছিল। কোন এক ঝোপের
মাঝে, গাছের পাতায় সে হয়তো আমারই মতো ভয়,বিস্ময়,
আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করছিল কারো জন্য। যদি আমি কবি হতাম
তাহলে সেই সব দিনগুলিতে আমি হয়তো লিখে ফেলতাম-

আমি কি রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা জুনি এই
কি জোনাকি জন্ম? নাকি ব্যাঙ্গাচি-কঙ্কালের পাশা খেলা!
প্রতি সন্ধ্যা বেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে,
হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত;


গতকয়েকদিন আগে বাচ্চা হওয়ার
পর জুনি মারা যায়। খবরটা যখন আমি শুনলাম। তখন আমার মাথায় আর কিছু
ছিল না।

আমি কিচ্ছু ভাবিনি। কাউকে কিছু জানায় নি।
সন্ধ্যায় বাবুল
বাতি জ্বালিয়ে পড়ছিল। আমি খুব সাহস নিয়ে আগুনের ঝাঁপ
দিয়েছিলাম। আমার মৃত্যু হয়নি। পাখা গুলো পুড়ে ছুপ
করে নিচে পড়লাম। নড়াচড়ার মতো শক্তি ছিলনা গায়ে। সকাল
বেলা বাবুলের মা ঝাড়ু দিয়ে ধুলাবালির সাথে আমাকে আবর্জনার
স্তুপে ফেলে দিয়ে আসলো।

এখনও আমি সেই আবর্জনার
স্তুপে। পাখা পুড়ে গেছে। নড়ে কোথাও যেতে পারছি না।
গত দুইদিন কিছুই খাইনি। আমার মনে হচ্ছে খুব
তাড়াতাড়ি আমি মারা যাবো। গায়ের পোড়া জায়গা গুলো পচন
ধরতে শুরু করেছে। জীবনের এই অন্তিম
মুহূর্তে এসে মনে হয়, আমার এই সারা জীবনে কিছুই
তো করা হল না।

জুনি তবু পৃথিবীকে অনেক গুলো আলোর
পাখি দিয়ে গেল। কিছুটা ওরা আলোকিত করবে পৃথিবী।
কবিরা কবিতা লিখবে।

কোন এক প্রেমিকা আহ্লাদ
করে প্রেমিককে বলবে-দেখ দেখ, কি অপূর্ব লাগছে। শাল
মহুয়ার বনে হয়তো আবারো জ্বলে উঠবে জোনাকির
আলো। কিন্তু আমার যে কিচ্ছু দেয়া হল না।


সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমার আলোটা দপ করে জ্বলে উঠল।
আলোর উপর আমার আর নিয়ন্ত্রণ নেই। অযথায়
আলো জ্বেলে আবর্জনার ভেতর পড়ে ছিলাম। হঠাৎ একসময়
মনে হল-কিছু একটা আমাকে চেপে ধরেছে। আমার ঘাড়
মাথা এমনভাবে চেপে ধরা হয়েছে, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
শো শো করে ঠাণ্ডা বাতাস আমার সারা গা ছুঁয়ে যাচ্ছিলো।


মনে হচ্ছে আমি উড়ছি। আকাশের অনেক
উপরে উঠে এসেছি আমি। একবার মনে হল আমি মারা গেছি।
এসব বোধ হয় মৃত্যু পরবর্তী কার্যকলাপ। কিন্তু না। কিছুক্ষণ
পরে আমি যখন নিজেকে একটা বাবুই পাখির বাসায় আবিস্কার করলাম
তখন বুঝলাম তখনো আমি বেঁচে আছি।

বিশাল তালের গাছের
উপর বাসা। মাটি থেকে অনেক উপরে। অন্ধকারে বাবুই পাখির
বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে ঘাপটি মেরে এক কোণায় বসে ছিল।

মা বাবুই বের হয়েছিল আলোর খোঁজে। আমিই আজ তার
শিকার। মা বাবুইটি আগেই বাসায় গোবরের
একটা টুকরা এনে রেখেছিল।
আচমকাই সে আমার মাথা ঐ
গোবরের মধ্যে ঠেসে দিল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল
আমার। বাইরের কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। তবু
বুঝতে পারছি আলো পেয়ে ভয়
কেটে গেছে বাচ্চাগুলোর।

আনন্দে তারা লাফাচ্ছে। অদ্ভুত
অদ্ভুত সব আনন্দ ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। আজ
জীবনে প্রথমবারের মতো বাচ্চার জন্য জুনির
আকুলতা বুঝতে পারলাম। হাহাকার করে উঠল বুকের ভেতরটা।


আমি মারা যাচ্ছি।
মারা যাওয়ার পর আমার
আলো জ্বলে থাকবে তো? আহা, লুসিফারেজ, লুসিফারিন
তোমরা থাকো। এই রাতটার জন্য থাকো।
বাচ্চাগুলোর এই
অদ্ভুত সুন্দর সন্ধ্যাটাকে নষ্ট করে দিও না।


বিঃদ্রঃ গল্পের
কবিতাটি নেয়া হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
লেখা থেকে। এই গল্পটি উৎসর্গ করা হল সেইসব
জোনাকিদের যারা শুধু
আলো ছড়ালো বৃষ্টি ভেজা রাতে এবং চরম অভিমান নিয়ে বিদায়
নিলো।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৬৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/০২/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • স্বপ্নীল মিহান ২৮/০২/২০১৫
    ভাল :)
  • ২৮/০২/২০১৫
    সুন্দর ।।
  • সবুজ আহমেদ কক্স ২৮/০২/২০১৫
    ভালো লাগলো ............ভাল থাকুন
  • হমমমম। কিছু বলার নাই।
 
Quantcast