নিশিকন্যা
নদী পাড়ের এই রাস্তাটা একটু ঘুরপথ হয়ে যায়। তাই পোড়া বাড়ির পথটাই বেছে নিল শ্রাবণী। চালের পুটলিটাকে বুকে জড়িয়ে বেশ দ্রুত হাটছে সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি পৌঁছুতে হবে তাকে। ঘরে অসুস্থ মাকে একা রেখে এসেছে। তাছাড়া আজ এমনিতেও একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে।
শ্রাবণীর বাবা নেই। সে আর তার মা দুজনের সংসার। কিছুদিন আগেও মেয়েটা স্কুলে পড়ত। ছাত্রী হিসেবেও বেশ ভাল। তবে হঠাৎই তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বয়স খুব বেশি হয়নি মেয়েটার এইতো তের কি চৌদ্দ হবে। তবে শারীরিক গঠন ভাল হওয়ায় কিছু বেশিই মনে হয়। এখন সে গায়ের মেম্বার জমির শেখ এর বাড়িতে কাজ করে। প্রতিদিনের মত আজও সেখান থেকেই ফিরছে।
শ্রাবণীর মনে শুধু একটাই চিন্তা মা কেমন আছে। সেই সকালে দু মুঠো পান্তা খাইয়ে বের হয়েছে এখন সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে তার জন্য। আর কোনদিন দেরি করবে না। এসব ভাবছে আর মেম্বার সাহেবের বড় ছেলের স্ত্রীকে মনে মনে গাল দিচ্ছে। ঐ হতচ্ছাড়িটার জন্যই আজ এত দেরি হল।
হাটতে হাটতে একেবারে বনের মাথায় চলে এসেছে। বন বলতে বিশাল বন নয়। শেখ সাহেবের শখের বাগান এখন অযত্নে বনে পরিনত হয়েছে। শ্রাবণীদের বাড়িটা গায়ের একেবারে শেষ মাথায়। এই বনের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। একমুহুর্ত ভেবে বনের দিকে পা বাড়াল শ্রাবণী। তখনি চাঁদটা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ল। মুহুর্তের জন্য চারদিক আঁধার হয়ে গেল। আবার বিড়বিড় করে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছে হারিকেনটা বাড়িতে রেখে এসেছে বলে।
একঝাক দখিনা হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে গেল শ্রাবনীকে। একটু যেন কেঁপে উঠল শ্রাবণীর ছোট্ট বুকটা। এদিকে চাঁদটাও মেঘের ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আবার রূপালী আলোয় ভাসছে চারদিক। বনটা তেমন ঘন নয়। তাই চাঁদের আলোয় ও খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। ভাগ্যিস আজ পূর্ণিমা। আর খুব বেশি দূরে নয় ওদের বাড়িটা। বনের ভিতরে মেম্বার সাহেবের বাগান বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এখন নামেই বাগান বাড়ি। বেশ কয়েক বছর আগে আগুন লেগে প্রায় পুরো বাড়িটাই পুড়ে গেছে। এখন হয়ত মাঝে মধ্যে বখাটেদের আড্ডা বসে। এছাড়া কেউ আসেনা এদিকটায়। পোড়াবাড়ি পেরিয়ে একটু এগুলেই বন শেষ। তারপর কয়েকটা ধানের জমি। আর ধানের জমি পেরুলেই শ্রাবণীদের বাড়ি।
আজ শ্রাবণীর মনে হচ্ছে পোড়াবাড়ি থেকে কাদের যেন কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দিল সে। কে যেন ডাকল তার নাম ধরে। কারা যেন আসছে ওর দিকে। এবার ছুটতে শুরু করেছে শ্রাবণী। পিছন ফিরে দেখছেও না আসলেই কেউ আছে নাকি সব ভীত মনের অলীক কল্পনা। প্রাণপণে ছুটছে, ঐতো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। তাদের বাড়ি,যেখানে আছে তার নিরাপদ আশ্রয়। তার মা। চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে তার, মায়ের কথা মনে পড়তেই মনটা কেমন করে উঠল।
একটা স্বস্তি অনুভব করছে এখন। নিজের অজান্তেই গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে গেছে। ধাওয়াকারী পায়ের শব্দ এবার বেশ স্পষ্ট ভাবেই শুনতে পাচ্ছে শ্রাবণী। এই তো আর মাত্র দশ-পনেরো হাত দূরে তাদের বাড়িটা। বাড়ির আঙিনায় পা রাখবে এমন সময় হোচট খেল শ্রাবণী। হাতে থাকা চালের পুটলিটা ছিটকে পড়ল। পুটলির মুখ খুলে গেছে। চালগুলো সব আঙিনা জুড়্র ছড়িয়ে পড়েছে। ছলছল চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে শ্রাবণী। কোনমতে উঠে বসল।
দু'হাতে চাল গুলো জড়ো করছে। দুনিয়ার আর কোনকিছুতেই তার মন নেই। "আমার মায় কি খাইব? আমার মায় কি খাইব? মুখে শুধু এই একটাই কথা। দু চোখ ভেসে যাচ্ছে। চালগুলো জড়ো করে জামার ঝুলে উঠিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় পিছনে খুব কাছে কারো নড়াচড়ার শব্দ। তাড়াহুড়ো করে দৌড় দিতে গেল শ্রাবণী। কিন্তু একজোড়া হাত আকড়ে ধরল তাকে। চেপে ধরল মাটির সাথে। আরও কয়েকজন ঘিরে ধরল তাকে। ঝাপসা চোখে, রাতের এই আলো আঁধারিতেও মেম্বার সাহেবের ছোট ছেলেকে চিনতে অসুবিধা হলনা তার। আরও দুয়েক জনকে চিনতে পারল।
ওর মুখ চেপে ধরে রেখেছে কেউ। বহুকষ্টে মাথা নাড়িয়ে, হাতের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট একটা চিৎকার করতে পারল শ্রাবণী। তারপর সব আঁধার। শ্রাবনীর চিৎকার শুনে তার মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। "কি অইছেরে শাবু, অ শাবু কি... মুখের কথা মুখেই আটকে গেল। ঘটনাটা চোখের সামনে দেখে। তারপরও মা বলে কথা। ঝাপিয়ে পড়লেন দুবৃত্তদের উপর, "ছাড় কু** বাচ্চারা, ছাড় আমার শাবু রে ছাইড়া দে"। কিন্তু অসুস্থ মায়ের কি সাধ্য আছে একদল হায়নার হাত থেকে চোখের মনি কলিজার টুকরোকে ছিনিয়ে আনার? উল্টো মেয়ের পরিণতিই বরণ করতে হল তাকে।
মা ও মেয়ের রক্তাক্ত দেহের উপর দাড়িয়ে তখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে রাক্ষস গুলো। শুধু বাড়ির আশ্রিত কুকুরটা ছাড়া আর কেউ কাঁদল না। কেউ প্রতিবাদও করল না।
এই ঘটনার পর কেটে গেছে কয়েকটা বছর। শ্রাবণীর মা সেদিন রাতেই মারা গেছে। হাসপাতালে ভর্তি ছিল শ্রাবণী। কিভাবে বেঁচে গেছে সেটাই রহস্য। বিচার হয়নি, হবেই বা কি করে। বাবার টাকা আছে অপরাধীর। আছে ক্ষমতাও।
মেম্বার সাহেবের ছোট ছেলে এখন একজনের স্বামী। তার স্ত্রী বেশ সুন্দরী। আর শ্রাবনী?
সে এখন নিশিকন্যা...
শ্রাবণীর বাবা নেই। সে আর তার মা দুজনের সংসার। কিছুদিন আগেও মেয়েটা স্কুলে পড়ত। ছাত্রী হিসেবেও বেশ ভাল। তবে হঠাৎই তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বয়স খুব বেশি হয়নি মেয়েটার এইতো তের কি চৌদ্দ হবে। তবে শারীরিক গঠন ভাল হওয়ায় কিছু বেশিই মনে হয়। এখন সে গায়ের মেম্বার জমির শেখ এর বাড়িতে কাজ করে। প্রতিদিনের মত আজও সেখান থেকেই ফিরছে।
শ্রাবণীর মনে শুধু একটাই চিন্তা মা কেমন আছে। সেই সকালে দু মুঠো পান্তা খাইয়ে বের হয়েছে এখন সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে তার জন্য। আর কোনদিন দেরি করবে না। এসব ভাবছে আর মেম্বার সাহেবের বড় ছেলের স্ত্রীকে মনে মনে গাল দিচ্ছে। ঐ হতচ্ছাড়িটার জন্যই আজ এত দেরি হল।
হাটতে হাটতে একেবারে বনের মাথায় চলে এসেছে। বন বলতে বিশাল বন নয়। শেখ সাহেবের শখের বাগান এখন অযত্নে বনে পরিনত হয়েছে। শ্রাবণীদের বাড়িটা গায়ের একেবারে শেষ মাথায়। এই বনের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। একমুহুর্ত ভেবে বনের দিকে পা বাড়াল শ্রাবণী। তখনি চাঁদটা মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ল। মুহুর্তের জন্য চারদিক আঁধার হয়ে গেল। আবার বিড়বিড় করে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছে হারিকেনটা বাড়িতে রেখে এসেছে বলে।
একঝাক দখিনা হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে গেল শ্রাবনীকে। একটু যেন কেঁপে উঠল শ্রাবণীর ছোট্ট বুকটা। এদিকে চাঁদটাও মেঘের ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আবার রূপালী আলোয় ভাসছে চারদিক। বনটা তেমন ঘন নয়। তাই চাঁদের আলোয় ও খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। ভাগ্যিস আজ পূর্ণিমা। আর খুব বেশি দূরে নয় ওদের বাড়িটা। বনের ভিতরে মেম্বার সাহেবের বাগান বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এখন নামেই বাগান বাড়ি। বেশ কয়েক বছর আগে আগুন লেগে প্রায় পুরো বাড়িটাই পুড়ে গেছে। এখন হয়ত মাঝে মধ্যে বখাটেদের আড্ডা বসে। এছাড়া কেউ আসেনা এদিকটায়। পোড়াবাড়ি পেরিয়ে একটু এগুলেই বন শেষ। তারপর কয়েকটা ধানের জমি। আর ধানের জমি পেরুলেই শ্রাবণীদের বাড়ি।
আজ শ্রাবণীর মনে হচ্ছে পোড়াবাড়ি থেকে কাদের যেন কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দিল সে। কে যেন ডাকল তার নাম ধরে। কারা যেন আসছে ওর দিকে। এবার ছুটতে শুরু করেছে শ্রাবণী। পিছন ফিরে দেখছেও না আসলেই কেউ আছে নাকি সব ভীত মনের অলীক কল্পনা। প্রাণপণে ছুটছে, ঐতো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। তাদের বাড়ি,যেখানে আছে তার নিরাপদ আশ্রয়। তার মা। চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে তার, মায়ের কথা মনে পড়তেই মনটা কেমন করে উঠল।
একটা স্বস্তি অনুভব করছে এখন। নিজের অজান্তেই গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে গেছে। ধাওয়াকারী পায়ের শব্দ এবার বেশ স্পষ্ট ভাবেই শুনতে পাচ্ছে শ্রাবণী। এই তো আর মাত্র দশ-পনেরো হাত দূরে তাদের বাড়িটা। বাড়ির আঙিনায় পা রাখবে এমন সময় হোচট খেল শ্রাবণী। হাতে থাকা চালের পুটলিটা ছিটকে পড়ল। পুটলির মুখ খুলে গেছে। চালগুলো সব আঙিনা জুড়্র ছড়িয়ে পড়েছে। ছলছল চোখে সেদিকে তাকিয়ে আছে শ্রাবণী। কোনমতে উঠে বসল।
দু'হাতে চাল গুলো জড়ো করছে। দুনিয়ার আর কোনকিছুতেই তার মন নেই। "আমার মায় কি খাইব? আমার মায় কি খাইব? মুখে শুধু এই একটাই কথা। দু চোখ ভেসে যাচ্ছে। চালগুলো জড়ো করে জামার ঝুলে উঠিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় পিছনে খুব কাছে কারো নড়াচড়ার শব্দ। তাড়াহুড়ো করে দৌড় দিতে গেল শ্রাবণী। কিন্তু একজোড়া হাত আকড়ে ধরল তাকে। চেপে ধরল মাটির সাথে। আরও কয়েকজন ঘিরে ধরল তাকে। ঝাপসা চোখে, রাতের এই আলো আঁধারিতেও মেম্বার সাহেবের ছোট ছেলেকে চিনতে অসুবিধা হলনা তার। আরও দুয়েক জনকে চিনতে পারল।
ওর মুখ চেপে ধরে রেখেছে কেউ। বহুকষ্টে মাথা নাড়িয়ে, হাতের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট একটা চিৎকার করতে পারল শ্রাবণী। তারপর সব আঁধার। শ্রাবনীর চিৎকার শুনে তার মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। "কি অইছেরে শাবু, অ শাবু কি... মুখের কথা মুখেই আটকে গেল। ঘটনাটা চোখের সামনে দেখে। তারপরও মা বলে কথা। ঝাপিয়ে পড়লেন দুবৃত্তদের উপর, "ছাড় কু** বাচ্চারা, ছাড় আমার শাবু রে ছাইড়া দে"। কিন্তু অসুস্থ মায়ের কি সাধ্য আছে একদল হায়নার হাত থেকে চোখের মনি কলিজার টুকরোকে ছিনিয়ে আনার? উল্টো মেয়ের পরিণতিই বরণ করতে হল তাকে।
মা ও মেয়ের রক্তাক্ত দেহের উপর দাড়িয়ে তখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে রাক্ষস গুলো। শুধু বাড়ির আশ্রিত কুকুরটা ছাড়া আর কেউ কাঁদল না। কেউ প্রতিবাদও করল না।
এই ঘটনার পর কেটে গেছে কয়েকটা বছর। শ্রাবণীর মা সেদিন রাতেই মারা গেছে। হাসপাতালে ভর্তি ছিল শ্রাবণী। কিভাবে বেঁচে গেছে সেটাই রহস্য। বিচার হয়নি, হবেই বা কি করে। বাবার টাকা আছে অপরাধীর। আছে ক্ষমতাও।
মেম্বার সাহেবের ছোট ছেলে এখন একজনের স্বামী। তার স্ত্রী বেশ সুন্দরী। আর শ্রাবনী?
সে এখন নিশিকন্যা...
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শ.ম. শহীদ ০৪/১১/২০২০খুব সুন্দর লিখেছেন সম্মানিত।
-
আব্দুর রহমান আনসারী ০২/১১/২০২০অপূর্ব