রাতের সূর্য
আমার একটা বড়সড় দোষ আছে। আমি যদি কোনও ভাবে, কোনও মতে, কোনও কারণে একা হয়ে পড়ি, তাহলে বিপুল পরিমাণে ভাবনা আমার মধ্যে উদিত হয়। একা যদি কোথাও যাবার থাকে, হয়তো বাজারে, হয়তো স্কুলে, হয়তো চরে বেড়াতেই, আমি "ভাবনা অরণ্যে পথহারা" হই। এবং এই ভাবনাই হচ্ছে আমার ইয়ে, মানে সমস্যা। হাবিজাবি, আজগুবি, গুলতানি, এমঙ্কি যা মাথায় আসে না, তা সবও আমি ভেবে ফেলি।
একদিন বাজারে যাচ্ছিলাম। হাতে ভাঁজ করা, "উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে"র একটা ব্যাগ নিয়ে। এগোচ্ছিলাম, জ্ঞানত রাস্তা পার না হয়ে। ভাবলাম-
এখন যদি আমার পথ বরাবর কেউ যায়, আর সে আমায় বলে, আমাকে সে উল্টো ফুটে চলার নামে জেলে পাঠাতে পারে, আমিও সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলব, আপনিও আমার বরাবর চলছেন, তারপর আমি হুহু করে ওর নামে থানায় ডায়রি করবো, তাতে পুলিস'কাকু' বলবে তুমি খুব ভালো নাগরিক, আমি সঙ্গে সঙ্গে সপ্তম স্বর্গে চলে যাব, হঠাৎ দেখব, স্বর্গ'র তেকোনা 'ব' ফলাটা খসে পড়লো, আর ওলটপালট খেয়ে,হিমালয়ের
আরেকটা পাহাড় বনে গেল, আর হঠাতই আমি মেঘদুতের সপ্তম সর্গে চলে এলাম আমার জিভ জড়িয়ে গেল অই সব সংস্কৃত স্লোক উচ্চারণ করতে করতে...
এই সবই আমার ভাবনা। একে না করা যায় পদ্য, না যায় গদ্য।
তবে কেন জানিনা, এগুলো আমার ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। যে রাস্তা দিইয়ে আমি স্কুলে যাই, বাড়ি থেকে বেরিয়েই রাস্তা পার করে দেখব সামনে একটা দোকান, ডিমের, সেই বরাবর হেঁটে গেলে পড়বে কলতলা, চো'মাথার মোড়, বেকার সমিতি, তারপর সিধে চলতে চলতে মায়ের ছাত্রের বাড়ি। সেইখেনে নাক বরাবর বাঁ দিকে একটা পাঁচিল ঘেরা বড় মাঠ। তাতে দুটো মেঠো পথ, একটা সোজা গেছে, আর একটা আর একটু
ঘুরে গিয়ে সোজার সঙ্গে মিলেছে। মনে হচ্ছে, ছোট হাতের ইংরিজি 'q'। সেখানে চলতে চলতে আমি হাঁ করে দেখি, "চোর কাঁটাতে মাঠ গিয়েছে ঢেকে, মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে-"
কেন জানিনা, এই মাঠটা দিয়ে গেলে আমার রীতিমতো কাব্যের উদ্রেক হয়। গতিময় চলা হয়ে ওঠে দুলকি; দৃষ্টি স্থিরতা থেকে হয়ে ওঠে মেলায় পথ হারান শিশুর মতো।
সামনে একটা পোড়ো মন্দির ছিল, সেটি কিছু মাস হল ভেঙে গিয়েছে। তার মধ্যে একটা ভিখিরি না পাগল গোছের কেউ শুতো, তাকে বাসস্থানহীন করেছে। তাকে রোজ একটা মহিলা দুট রুটি আর একটু তরকারি দিয়ে যেত তার মেয়েকে দিয়ে। পাছে তার বর না দেখে যে তার বউয়ের পরপুরুষের প্রতি পিরিত ও দয়া অসীম, আর তাকে রোজ রাতে মদ খেয়ে পিটুনি না দেয়।
আমি ভাবতাম হয়ত এই মন্দিরের ভেতরে নিশ্চই কোনও কোনে, ফাঁক-ফোকড়ে গুপ্তধন আছে। অন্ততঃ তার নকসা টুকু থাকাটা বাঞ্ছনিয়! আমি শত চেষ্টাতেও রাত ১২টা, ১টা র সময় সেখানে যেতে পারিনি।
এখন ওখানে একটা কুয়ো খোঁড়া হচ্ছে। (আমার মনে হয়ে, কোনো কুয়ো খোঁড়ার লক সেটা পেয়েছে, এখন সে হয়ত একটা অট্টালিকা বানাবে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে, হয়ত কোনো ব্যাবসা করছে। আমার কাছে এলে ওটা বইয়ের পেছনে খরচ হয়ে যেত।
কুয়োটা যেখানে খোঁড়া হচ্ছে, তার পাস দিয়ে একটা পাইপ কুয়োর নোংরা জলটাকে বের করছে। অনবরত। ইঁট খ্যাঁদা জায়গাটা দিয়ে, ধীরে-ধীরে জলটা ঝর্ণার মতো হয়ে পথটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এবং সেখানে তির-ধনুকের তিরের ল্যাজের মত ব্যাঁকা ব্যাঁকা ধারা হচ্ছে সেই 'নদীটাতে'। তারপর সেটা স্লথ গতি নিয়ে ধীরে-ধীরে মোহনা স্থিত হচ্ছে
আমার যে ব্যাপারটাকে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর মনে হত, তা বলাই বাহুল্য। আমি পথে যেতে যেতে দেখলাম, একটা প্ল্যাস্টিকের চামচ পড়ে। ওটাকে তুলে বসালাম নদীতে। কি সুন্দর করে ওটা বোটের মত ঘুরে ফিরে তেঁড়ে বেঁকে দুলকি চালে চলতে লাগল! তারপর মনে হল, তাতে দুটো পিঁপড়ে ছেড়ে দিলে মন্দ হত না। ধীরে ধীরে ওটা মোহনার দিকে এসে মাটিতে আটকে গেল। আনমনেই বললাম, "আহা কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও..."
শীতের একটা দিন, স্কুল থেকে ফিরছিলাম। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। অন্ধকার বোধহয় দোয়াতের কালির মত ছড়িয়ে পড়বে নীল আকাশে। আসার সময় ডান দিকে অনেকগুলো তালগাছ পড়ে।
হঠাৎ দেখলাম, সূর্যখানা তিনটে তালগাছের ফাঁক থেকে রাগত রক্তদৃষ্টিতে দেখছে, যেন তাকে আমি গরাদ-বন্দি করেছি।। তবে দৃশ্যটি দেখতে মন্দ লাগছিল না।
অধিকাংশ সময় এ সব ভাবনাকে আমি বাধ্য করে পদ্য করে রাখি। কাউকে বললে সে ত হেসে উড়িয়ে দেবে, নয়ত পাগল ভেবে অবহেলা করবে। অবিশ্যি এগুলো কাউকে বলে আমি পরিতৃপ্তি পাই না এ ব্যাপারে আমার দুটো লাইন মনে আসছে-
"সকলেই যদি সমান তালে হয়ে সবার সম্,
রহিত কি তবে পাতালপুরী, রহিত শুন্য ব্যোম।"
অবিশ্যি এই লাইন গুলো আমারই।
একদিন বাজারে যাচ্ছিলাম। হাতে ভাঁজ করা, "উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে"র একটা ব্যাগ নিয়ে। এগোচ্ছিলাম, জ্ঞানত রাস্তা পার না হয়ে। ভাবলাম-
এখন যদি আমার পথ বরাবর কেউ যায়, আর সে আমায় বলে, আমাকে সে উল্টো ফুটে চলার নামে জেলে পাঠাতে পারে, আমিও সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলব, আপনিও আমার বরাবর চলছেন, তারপর আমি হুহু করে ওর নামে থানায় ডায়রি করবো, তাতে পুলিস'কাকু' বলবে তুমি খুব ভালো নাগরিক, আমি সঙ্গে সঙ্গে সপ্তম স্বর্গে চলে যাব, হঠাৎ দেখব, স্বর্গ'র তেকোনা 'ব' ফলাটা খসে পড়লো, আর ওলটপালট খেয়ে,হিমালয়ের
আরেকটা পাহাড় বনে গেল, আর হঠাতই আমি মেঘদুতের সপ্তম সর্গে চলে এলাম আমার জিভ জড়িয়ে গেল অই সব সংস্কৃত স্লোক উচ্চারণ করতে করতে...
এই সবই আমার ভাবনা। একে না করা যায় পদ্য, না যায় গদ্য।
তবে কেন জানিনা, এগুলো আমার ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। যে রাস্তা দিইয়ে আমি স্কুলে যাই, বাড়ি থেকে বেরিয়েই রাস্তা পার করে দেখব সামনে একটা দোকান, ডিমের, সেই বরাবর হেঁটে গেলে পড়বে কলতলা, চো'মাথার মোড়, বেকার সমিতি, তারপর সিধে চলতে চলতে মায়ের ছাত্রের বাড়ি। সেইখেনে নাক বরাবর বাঁ দিকে একটা পাঁচিল ঘেরা বড় মাঠ। তাতে দুটো মেঠো পথ, একটা সোজা গেছে, আর একটা আর একটু
ঘুরে গিয়ে সোজার সঙ্গে মিলেছে। মনে হচ্ছে, ছোট হাতের ইংরিজি 'q'। সেখানে চলতে চলতে আমি হাঁ করে দেখি, "চোর কাঁটাতে মাঠ গিয়েছে ঢেকে, মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে-"
কেন জানিনা, এই মাঠটা দিয়ে গেলে আমার রীতিমতো কাব্যের উদ্রেক হয়। গতিময় চলা হয়ে ওঠে দুলকি; দৃষ্টি স্থিরতা থেকে হয়ে ওঠে মেলায় পথ হারান শিশুর মতো।
সামনে একটা পোড়ো মন্দির ছিল, সেটি কিছু মাস হল ভেঙে গিয়েছে। তার মধ্যে একটা ভিখিরি না পাগল গোছের কেউ শুতো, তাকে বাসস্থানহীন করেছে। তাকে রোজ একটা মহিলা দুট রুটি আর একটু তরকারি দিয়ে যেত তার মেয়েকে দিয়ে। পাছে তার বর না দেখে যে তার বউয়ের পরপুরুষের প্রতি পিরিত ও দয়া অসীম, আর তাকে রোজ রাতে মদ খেয়ে পিটুনি না দেয়।
আমি ভাবতাম হয়ত এই মন্দিরের ভেতরে নিশ্চই কোনও কোনে, ফাঁক-ফোকড়ে গুপ্তধন আছে। অন্ততঃ তার নকসা টুকু থাকাটা বাঞ্ছনিয়! আমি শত চেষ্টাতেও রাত ১২টা, ১টা র সময় সেখানে যেতে পারিনি।
এখন ওখানে একটা কুয়ো খোঁড়া হচ্ছে। (আমার মনে হয়ে, কোনো কুয়ো খোঁড়ার লক সেটা পেয়েছে, এখন সে হয়ত একটা অট্টালিকা বানাবে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে, হয়ত কোনো ব্যাবসা করছে। আমার কাছে এলে ওটা বইয়ের পেছনে খরচ হয়ে যেত।
কুয়োটা যেখানে খোঁড়া হচ্ছে, তার পাস দিয়ে একটা পাইপ কুয়োর নোংরা জলটাকে বের করছে। অনবরত। ইঁট খ্যাঁদা জায়গাটা দিয়ে, ধীরে-ধীরে জলটা ঝর্ণার মতো হয়ে পথটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এবং সেখানে তির-ধনুকের তিরের ল্যাজের মত ব্যাঁকা ব্যাঁকা ধারা হচ্ছে সেই 'নদীটাতে'। তারপর সেটা স্লথ গতি নিয়ে ধীরে-ধীরে মোহনা স্থিত হচ্ছে
আমার যে ব্যাপারটাকে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর মনে হত, তা বলাই বাহুল্য। আমি পথে যেতে যেতে দেখলাম, একটা প্ল্যাস্টিকের চামচ পড়ে। ওটাকে তুলে বসালাম নদীতে। কি সুন্দর করে ওটা বোটের মত ঘুরে ফিরে তেঁড়ে বেঁকে দুলকি চালে চলতে লাগল! তারপর মনে হল, তাতে দুটো পিঁপড়ে ছেড়ে দিলে মন্দ হত না। ধীরে ধীরে ওটা মোহনার দিকে এসে মাটিতে আটকে গেল। আনমনেই বললাম, "আহা কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও..."
শীতের একটা দিন, স্কুল থেকে ফিরছিলাম। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। অন্ধকার বোধহয় দোয়াতের কালির মত ছড়িয়ে পড়বে নীল আকাশে। আসার সময় ডান দিকে অনেকগুলো তালগাছ পড়ে।
হঠাৎ দেখলাম, সূর্যখানা তিনটে তালগাছের ফাঁক থেকে রাগত রক্তদৃষ্টিতে দেখছে, যেন তাকে আমি গরাদ-বন্দি করেছি।। তবে দৃশ্যটি দেখতে মন্দ লাগছিল না।
অধিকাংশ সময় এ সব ভাবনাকে আমি বাধ্য করে পদ্য করে রাখি। কাউকে বললে সে ত হেসে উড়িয়ে দেবে, নয়ত পাগল ভেবে অবহেলা করবে। অবিশ্যি এগুলো কাউকে বলে আমি পরিতৃপ্তি পাই না এ ব্যাপারে আমার দুটো লাইন মনে আসছে-
"সকলেই যদি সমান তালে হয়ে সবার সম্,
রহিত কি তবে পাতালপুরী, রহিত শুন্য ব্যোম।"
অবিশ্যি এই লাইন গুলো আমারই।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সুরজিৎ দাস ০৭/১১/২০১৬ভাবনা আর কল্পলোকের মেলবন্ধন
-
ডিবেটার সাদ্দাম হোসেন ০৭/০৯/২০১৪আজব তো......
-
একনিষ্ঠ অনুগত ২৯/০৮/২০১৪বেশ ভালো লাগলো।।
-
মঞ্জুর হোসেন মৃদুল ২৮/০৮/২০১৪বেশ গোছানো লেখা। ভাল লাগল।