www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ

মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়...
হুমায়ূন আহমেদ নেই দুই বছর হয়ে গেল। তার শোক আজো লালন করছে লক্ষ পাঠকের হূদয়। তার স্মরণে আয়োজন করা হয়েছে বইমেলা, পাঠকনন্দিত চরিত্র অবলম্বনে আয়োজন করা হয়েছে 'হিমু মেলা'। নেই শুধু তিনি।

আজ বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। চিকিত্সার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। বাংলাদেশে নানা অনুষ্ঠানে তার ভক্ত-শুভার্থীরা কামনা করেছিলেন তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন এই তেরোশ নদীর দেশে। কিন্তু মানুষের সেই প্রার্থনা পূরণ হয়নি। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

তার মৃত্যুতে গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। সেই শোক আজো কাটেনি ভক্ত-পাঠকদের হূদয় থেকে। হুমায়ূন নেই তিনি বেঁচে আছেন লক্ষ পাঠকের হূদয়ে। তাকে নিয়ে বইমেলায় আসছে বই। পাঠক পরম মমতায় সংগ্রহ করছেন সেই সব বই।

হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত লিখে যেতে চাই। লেখালেখিই আমার বিশ্রাম। লেখালেখি বন্ধ হলে আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে পড়বে, আমি বাঁচতে পারবো না। পাঠকদের উদ্দেশে তার আবেদন 'দোয়া করবেন, আমি যেন আমৃত্যু লিখে যেতে পারি।' তার সেই আশা পূরণ হয়েছিল। মৃতুর আগে পর্যন্ত লিখেছেন। নিউইয়র্কে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও তিনি 'দেয়াল' উপন্যাস লিখেছেন। যদিও শেষ করে যেতে পারেননি।

হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন বললেন, হুমায়ূন আহমেদ যে হারিয়ে যাননি তা বইমেলায় গেলে বোঝা যায়। মানুষের মন থেকে তাকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আর সব জায়গা থেকে হয়তো তিনি হারিয়ে যাবেন। কিন্তু পাঠকের হূদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি নেই এটা বাস্তবতা। কিন্তু তার বইয়ের ভেতর দিয়ে তিনি সবসময় বেঁচে থাকবেন।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। ১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' প্রকাশের পর পরই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। উপন্যাসে ও নাটকে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে 'হিমু', 'মিসির আলী', 'শুভ্র' তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। বলা হয়, তার লেখা পছন্দ করেন না এমন মানুষও তার নতুন লেখাটি 'গোপনে' পড়ে ফেলেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা তার অন্তত একটি নাটক দেখেনি কিংবা তার কোনো বই পড়েনি। জনপ্রিয়তার জগতে তিনি একক ও অনন্য। তিনিই তরুণ-তরুণীদের করেছেন বইমুখী। প্রত্যেক বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় হুমায়ূন আহমেদের বই কিনতে হামলে পড়ে তার ভক্ত-অনুরাগীরা।

হুমায়ূন আহমেদের শরীরে ২০১১ সালের সেপ্টেস্বর মাসে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর তিনি উন্নত চিকিত্সার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান। সেখানে ২০১২ সালে জুলাই মাসের ১৬ তারিখ তিনি চলে যান লাইফ সাপোর্টে। সে অবস্থাতেই ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে এগারোটায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এ লেখকের মৃত্যুতে পুরো দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিউইয়র্ক থেকে ২০১২ সালের ২৩ জুলাই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। বিমানবন্দর থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে। সেখানে লাখো মানুষের অশ্রু-পুষ্পতে সিক্ত হন তিনি। পর দিন তাকে সমাহিত করা হয় তার গড়ে তোলা নন্দনকানন নুহাশ পল্লীর লিচুতলায়। সেখানেই অসীম ঘুমে শায়িত হয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর আজকের নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আর মা গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোন তারা। খ্যাতিমান কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল তার ছোট ভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।

তিনি ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ও ১৯৭২ সালে মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাস্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। হুমায়ূন আহমেদের লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরিপুর জংশন, নৃপতি, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি।

তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমণি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা ও নয় নম্বর বিপদ সংকেত। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র 'ঘেটুপুত্র কমলা'ও জয় করেছে দর্শক ও সমালোচকদের মন। চলচ্চিত্রটি এ বছর অস্কার পুরস্কারের বিদেশি চলচ্চিত্র বিভাগে প্রাথমিক মনোনয়নও পেয়েছে।

টিভি নাট্যকার হিসাবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আশির দশকের মাঝামাঝি তার প্রথম টিভি নাটক 'এইসব দিনরাত্রি' তাকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তার হাসির নাটক 'বহুব্রীহি' এবং ঐতিহাসিক নাটক 'অয়োময়' বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক 'কোথাও কেউ নেই' এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে।

১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ । হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশ আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দুই ছেলে- নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক 'একুশে পদক' লাভ করেন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন। দেশের বাইরেও তাকে নিয়ে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তার প্রমাণ জাপানের টেলিভিশন 'এনএইচকে' তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছে পনের মিনিটের তথ্যচিত্র 'হু ইজ হু ইন এশিয়া'।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৯২০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৯/০৭/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast