খোকাখুকি কল্যাণ সমিতি
ছোট ছোট খোকা খুকিদের চেঁচামেচিতে সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে। ওরা এতো চেঁচামেচি করে কেন! ওদের মনে খুব আনন্দ! ওদের কোন দুঃখ নাই। সারাদিন কেবল হেসে খেলেই বেড়ায়। আর আমি। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই মনমরা হয়ে থাকি। হাসি কাকে বলে ভুলে গেছি।
আমি আর আমার দাদী থাকি এখানে গ্রামের বাড়িতে। আব্বু থাকে ঢাকায়। অফিসে কাজ করে। ঢাকা কোন দিকে আমি জানি না। দাদীও ঢাকা শহর চিনে না। আব্বুর সাথে যেতে পারে। আব্বু ঢাকায় গেছে অনেকদিন হয়ে গেল। আসে না কেন! নাকি আব্বু এই গ্রামের বাড়ির পথ ভুলে গেছে! যদি আর আসতে না পারে!
আমার দাদীর অল্প টাকা আছে। আমাকে মজার কিছু কিনে দিতে পারে না। আমার খুব ইচ্ছে করে চিপস আর বাদাম কিনতে। কান্নাকাটি করলে দাদী কিনে দেয়। আমার খুব দুঃখ হয় দাদীর জন্য। আব্বুর তো অনেক টাকা আছে। দাদীকে দিতে পারে না!
দাদীকে আমি দাদু ডাকি। আমার তো দাদা নাই। অনেক আগেই নাকি মারা গেছে। দুনিয়াতে দাদুর কেউ নাই। আমারও কেউ নাই দাদু ছাড়া। আমার দাদু বুড়ো মানুষ। মাঝে মাঝেই তার মাথা ব্যাথা করে, পেট ব্যাথা করে, হাত-পা ব্যাথা করে। হঠাৎ করেই বিছানায় শুয়ে পড়ে কাৎরায়। মাঝে মাঝে কান্না করে। আমার খুব ভয় লাগে। যদি দাদু মারা যায়! তখন আমার কি হবে! আমাকে কে খাইয়ে দিবে? কে গোশল করিয়ে দিবে? কার কাছে ঘুমাবো?
আমি দাদুর মাথায় হাত রেখে বলি, দাদু ঔষুধ খাও। ভাল হয়ে যাবে। দাদু বুঝতে পারে যে, আমি ভয় পাই। আমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
আমার দাদু সারাদিন শুধু কাজ করে। উঠোন ঝাড়ু দেয়, রান্না করে, ময়লা পরিষ্কার করে। দাদু কাদা মাখিয়ে রান্নাঘর লেপ দেয়। আমি বলি, দাদু কাদা ধরো কেন, ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আসবে।
আমার মনে কেবল ভয়। যদি দাদু মারা যায়, আমার কি হবে? আমি তো ছোট মানুষ। মোবাইলে ফোন করতে পারি না। আব্বুকে কেমনে জানাবো!
আমার অনেক দুঃখ। আমার আম্মু নাই। তাই দাদুর কাছে গ্রামে থাকি।
আগে ঢাকায় থাকতাম। আমার আব্বু আম্মুর সাথে। কিছুদিন পর পর আব্বু আমাদের ঘোরাতে নিয়ে যেত। আমি শিশু পার্কে গিয়েছি, চিড়িয়াখানায় গিয়েছি, যাদুঘরে গিয়েছি, রমনা পার্কে গিয়েছি। আমি শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছি। সেখানে অনেক বেশি মানুষ ছিল। আমার অনেক ভয় লাগছিল।
আব্বু মাঝে মাঝে অফিসে যেত না। সেদিন নাকি ছুটি থাকতো। কিন্তু ছুটি হলে কি হবে! আব্বু তার ক্লাসে যেত। কবিতার ক্লাশ। আব্বু কবিতা পড়া শিখে। বাসাতেও সুন্দর করে কবিতা পড়তো। আমাকে শোনাত। খুব ভাল লাগতো।
আমি কিছু বুঝতাম না। আব্বু চলে যাওয়ার পরেই মারুফ কাকা আমাদের ঘরে আসতো। আম্মুর পাশে বসতো। আমার ভাল লাগতো না। আমি মারুফ কাকাকে সরিয়ে দিয়ে আম্মুর পাশে বসতাম। আম্মু আমাকে নানা কথা বলে, বুঝিয়ে শুনিয়ে অন্য ঘরে অনেকগুলো খেলনা দিয়ে খেলতে দিতো। আমি খেলতাম। কিন্তু একটু পর পর ঘরে গিয়ে দেখতাম আম্মু কি করে। আম্মু মারুফ কাকার সাথে কি করে বুঝি না। শয়তানি করে। আম্মু শয়তান হয়ে গেছে। আব্বুকে বলতে হবে।
একদিন আম্মুকে বললাম, তুমি মারুফ কাকার সাথে শয়তানি করো কেন?
আম্মু কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। বলল, এটা শয়তানি না। এটা একটা খেলা। বড়দের খেলা। তুমি এ কথা তোমার আব্বুকে বলবা না। আম্মু আমাকে দুইটি আইসক্রিম কিনে দিল। আমি আব্বুকে কিছু বললাম না।
আমি একদিন জামা প্যান্ট খুলে আব্বুকে বললাম, আব্বু আমি বড় হয়েছি। আমি খেলতে পারি।
আব্বু বলল, তুমি জামা প্যান্ট খুলেছ কেন?
বললাম, খেলতে চাই। আম্মুর মতো।
আব্বু বলল, তোমার আম্মু কি খেলে।
আমি যা দেখেছি সবকিছুই আব্বুর কাছে বলে দিলাম।
হঠাৎ আব্বুর চেহারা ভয়ংকর হয়ে উঠল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
রাতে আব্বু আর কারো সাথে কথা বলে নাই। আমাকে আদর করে নাই। চুপ চাপ শুয়ে ছিল।
একদিন আব্বু বাইরে গেল। একটু পর মারুফ কাকা ঘরে এল। আব্বু ও একটু পরে এল। মারুফ কাকাকে আব্বু জোরে লাথি দিল। অনেক মারামারি করল। আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম।
পরদিন আমাকে আর আম্মুকে নানা বাড়ি দিয়ে এলেন।
নানা বাড়িতে কেউ আমাকে আর আগের মতো আদর করে নাই। মোবাইল ফোনে আম্মু আব্বুর সাথে ঝগড়া করতো। আর কান্নাকাটি করতো। আমি বলতাম, আম্মু তোমার আর আব্বুর কি হয়েছে? আমাকে খাইয়ে দিতো না। গোশল করিয়ে দিতো না। আমি একবালতি পানির ভিতর বসে একা একা গোশল করতাম। শরীর মুছতে পারতাম না। বাতাসে শুকিয়ে যেত।
আমার ভীষণ জ্বর হয়েছিল। আব্বু দেখতে এল না। আম্মু গুরুত্ব দিল না। মনে হলো এখানে কেউ আমার আপন না। আমার খুব খিদে লাগতো। কেউ খেতে দিতো না। আমি তখন কোন খাবারের নাম জানতাম। না। শুধু কান্নাকাটি করতাম আর নানীর কাছে গিয়ে বলতাম, নানী কিছু খাব, নানী কিছু খাব।
নানীও আমাকে আগের মতো আদর করতো না। শুধু কান্নাকাটি করলে ভাত খাইয়ে দিতো। আব্বু কেন যায় নাই! আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভাবতাম আমার কি দুনিয়াতে কেউ নাই!
কয়েকদিন পর আব্বু গেল নানাবাড়ি। নানার কাছে কি যেন বলল। সবাই আব্বুর সাথে চীৎকার করে ঝগড়া করল। আব্বু অনেক কান্নাকাটি করল। আমি অসহায়। আমার আব্বুও কাঁদে?
আব্বু আবারো চলে গেল। আমাকে কোলে নিয়ে অনেক কাঁদল। অনেক কিছু বলল। সবকিছু বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম, বলল, মা, আমার কথা ভাবি না। তোমার জন্যই আমার কষ্ট। তোমার কি হবে মা?
আমি এমনিতেই অসহায় অবস্থায় ছিলাম। আব্বুর কথায় আরো ভয় পেয়ে যাই। কি হবে আমার!
আমাকে নানাবাড়ির ছোট মানুষেরা মারতো। খামছি দিতো। লাঠি দিয়ে মারতো। আম্মু আমার কাছে থাকতো না। আমি শুধু কান্নাকাটি করতাম। কেউ আমাকে কোলে নিতো না। ওরা মারতে মারতে আমার মুখে, বুকে কয়েক যায়গায় রক্ত বের করে দিয়েছিল। একদিন হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আমার ডান হাতের একটি নখ থেতলে দিয়েছিল। পরে নখটি পড়ে যায়।
আমি কান্নাকাটি করলে, আম্মু বলতো, কান্দস ক্যান? তোর বাপ নাই? তোর বাপ মরছে নাকি? তোর বাপের কাছে যাইতে পারস না?
আমি তো আব্বুর কাছে যেতে পারি না। আমি তো ঢাকা শহর চিনি না। আমি শুধু কান্নাকাটি করতাম। ভাবতাম আমার আব্বু আর কখনো আমাকে নিতে আসবে না। আব্বু কি নানা বাড়ির পথ ভুলে গেছে! নাকি আম্মুর ভয়ে আসে না।
আম্মু বলেছে, আব্বুকে বটি দিয়ে কাটবে। জেলে ঢুকাবে। জেল কোথায় জানি না। সেখানে গেলে কি হয়!
একদিন শুনলাম আব্বু আসবে। মনে একটু সাহস লাগল। এবার আব্বুর সাথে চলে যাব। এখানে আর থাকবো না।
আব্বু আমাকেও নিল আম্মুকেও নিল। ঢাকার বাসায়। ভাবলাম সব ঠিক হয়ে গেছে।
কিন্তু কিছু ঠিক হয় নাই। ঢাকার বাসায় গিয়ে প্রতিদিন আব্বু আম্মু ঝগড়া করতো। আব্বু বলতো, শুধু আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তোকে রাখতে চাই। কিন্ত এরজন্য তোর বাপ-মা কে আসতে হবে। তোর বিচার করতে হবে।
আম্মু নাকি নানা-নানীর কাছে কিছু স্বীকার করবে না। কি স্বীকার করবে না জানি না। ঝগড়া চলতেই থাকে। আম্মু আমাকে আদর করে না। কোলে নেয় না। আব্বু আমাকে খাইয়ে অফিসে যায়। দিনে আমার খিদে লাগলে কান্নাকাটি করি। পাশের বাসার আন্টি ভাত এনে আমাকে খাইয়ে দেয়।
আমি ভয় পাই। কি হবে আমার! আব্বু আমাকে নিয়ে প্রতিদিন বাজারে ঘোরাতে নিয়ে যায়। আব্বুর মুখে হাসি নাই। হাসতে ভুলে গেছে। মুখটা কালো হয়ে থাকে। চোখদুটো পিটপিট করে। কিছু বললেই যেন কেঁদে ফেলবে। কি হবে আমাদের!
কি সমস্যা জানি না। আব্বু বলল, অনেক দিন যাবত তোমার আম্মু শয়তানি করছে।
বললাম কার সাথে? মারুফ কাকার সাথে?
আব্বু বলল, হ্যাঁ।
বললাম আম্মু শয়তান হয়ে গেছে?
আব্বু বলল, হ্যাঁ।
বললাম, তাহলে আম্মুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল। ডাক্তার ঔষুধ দিলে ভাল হয়ে যাবে।
আব্বু বলল, ঔষুধে শয়তানি ভাল হয় না।
একদিন আব্বু আমাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মা, তোমার আম্মু তো শয়তান হয়ে গেল। তোমার আম্মুকে তাড়িয়ে দিই?
আমি আম্মুর ব্যবহারে অতিষ্ট। এতটুকু বুঝতাম যে, মারুফ কাকার সাথে শয়তানি করে আম্মু শয়তান হয়ে গেছে। তাই এতো সমস্যা। বললাম, ঠিক আছে তাড়িয়ে দাও।
আব্বু বলল, তুমি আমার কাছে থাকতে পারবা?
বললাম, পারবো।
আম্মুকে তাড়িয়ে দিলে আব্বু সুস্থ হয়ে উঠবে। আবারো হাসবে। কবিতা পড়বে। গান শোনাবে। আমার ভাল লাগবে। আমার খুশি লাগছিল।
একদিন আমার মামা আরো দুইজন লোককে নিয়ে আমাদের বাসায় আসল। তারা আব্বুর সাথে চিৎকার করল। দরজায় আব্বুকে জোরে ধাক্কা দিল। আব্বু মাকে তাদের সাথে চলে যেতে বলল। মামা আমাকে কোলে নিয়ে মার হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইল। আব্বু বলল, আমার মেয়েকে নেয়া যাবে না। আব্বু জোর করে মামার কোল থেকে আমাকে টেনে নিলে। টানাটানিতে ভয় পেয়ে আমি চীৎকার করে কান্নাকাটি করেছিলাম।
এরপর আবারো ঝগড়া লেগে যায়। তারা সবাই আব্বুকে মারতে চায়। লোকজন এসে সব ঠান্ডা করে দেয়।
এর পর আব্বু আমাকে সেজ কাকার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে গ্রাম থেকে দাদী আসে। সেজ কাকী আসে। আমার একটু ভাল লাগে।
কিন্তু আব্বু পালিয়ে থাকে। পুলিশ নাকি আব্বুকে ধরে নিয়ে যাবে। তাই আব্বু আসে না। সেজ কাকা আমার জন্য অনেক কিছু কিনে আনে। আমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে।
একদিন আব্বুর কোলে করে কোর্টে গিয়েছিলাম। আম্মু নাকি পুলিশের কাছে মিথ্যে কথা বলেছে। আব্বু নাকি আম্মুর কাছে টাকা চেয়েছে। আমি তো কখনো দেখি নাই। আম্মুই তো আব্বুর কাছে টাকা চাইতো। আর আব্বু অনেক টাকা দিতো।
কোর্টে অনেক পুলিশ ছিল। তারা আব্বুকে জেলে ঢোকাবে। আমিও জেলে যাব আব্বুর সাথে। পুলিশ বলল, কোল থেকে বাচ্চা নামান। আমি আব্বুকে আরো শক্ত করে ধরে কেঁদে ফেললাম। পরে আমাকে আর আব্বুকে পুলিশ ছেড়ে দিল। আমাদের নাকি জামিন হয়ে গেল।
আমি আর আব্বু অসহায় ছিলাম। আমার আম্মু একটা শয়তান হয়ে গেছে। তাই মারুফ কাকার সাথে শয়তানি করেছে আর আব্বুর নামে মিথ্যা কথা বলেছে। পুলিশও শয়তান। উকিল ও শয়তান। জজও শয়তান।
তারা আম্মুকে জেলে দিতে পারে না! মারুফ কাকাকে জেলে দিতে পারে না! মারুফ কাকাই তো আম্মুর সাথে শয়তানি করেছে। এজন্যইতো এতো সমস্যা। দুনিয়াতে সব শয়তানেরা বাস করে।
আমাকে আরো বড় হতে হবে। আমি ভাত কম খাই বলে আব্বু রাগ করে। আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে আরো বেশি ভাত খেতে হবে। বড় হতে হবে। বড় হলে আমি সবাইকে মারব।
বড় হয়ে আমি পুলিশ হবো। সব শয়তান পুলিশকে মারবো। জেলে ঢুকাবো। কোর্টের জজকেও জেলে ঢুকাবো।
আমি বড় হয়ে আম্মুর চুল ছিড়ে ফেলব। সব চুল কেটে টাক করে জেলে ঢুকাবো।
মারুফ কাকাকে ধরে আনবো। বটি দিয়ে কেটে কেটে মুরগির মতো মাংস বানাবো। তারপর সেই মাংস ফ্রিজে রেখে রান্না করে খাব। মানুষের মাংস তো কোনদিন খাই নাই। মানুষের মাংস কি খাওয়া যায়? জানি না তো!
দুনিয়াতে সব খোকাখুকিদের জন্য আমার মায়া লাগে। তারা যদি আমার মতো কষ্ট পায়! মারুফ শয়তান। দুনিয়ার সব মানুষ শয়তান। তারা যদি অন্য বাবুদের আম্মুর সাথেও শয়তানি করে! তাহলে তো সেই বাবুদের আব্বু তার মাকে তাড়িয়ে দিবে। আর পুলিশ সেই বাবুর আব্বুকে ধরে নিয়ে যাবে।
দুনিয়াটা শয়তানদের। আমি এই দুনিয়াতে কেন এলাম? আব্বুর জন্য মায়া লেগেছে এই জন্য? তাহলে আব্বু ভুল করেছে। এই দুনিয়ায় আসা আব্বুর ঠিক হয় নাই।
এই দুনিয়াতে শয়তানেরা শয়তানি করে। আর অন্য শয়তানেরা তাকে বাঁচায়। শয়তানেরা আমাদেরকে মারধোর করে। জেলে পাঠায়। কেউ কি নাই তাদের মেরে ফেলতে পারে! বুঝেছি আমরা ভুল যায়গায় এসে পড়েছি। আব্বুকে বলতে হবে অন্য কোন দেশে যেতে। যেখানে সবাই ভাল।
তাহলে অন্য বাবুদের কি হবে?
কিছুদিন পর আব্বু এসেছে আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আব্বু বাড়িতে আসলে দাদু খুশি হয়। আমিও খুশি হই। আব্বুকে বলি, আব্বু তোমার সমস্যা কি শেষ হয়েছে?
আব্বু বলল, আর কোন সমস্যা নেই মা। তোমার শয়তান আম্মু আমার অনেক টাকা নিয়ে গেছে। এখন সে আর পুলিশকে মিথ্যে কথা বলবে না। পুলিশও আমাকে ধরবে না।
আমার খুব ভাল লাগল। আমার আব্বুকে ভাল লাগছিল। আমি বললাম, আব্বু চিন্তা করবা না, আমি বড় হয়ে তোমাকে অনেক টাকা দিবো।
আব্বু আমাকে আদর করে বলল, তুমি মানুষ হলেই আমার আনন্দ মা। তোমার কথা ভেবেই দেরি হয়ে গেল। নইলে অনেক আগেই শয়তানটাকে সহজে বিদেয় করতে পারতাম। তোমাকে আমি মা-হারা করতে চাইনি। কিন্তু আমি পারলাম না মা, আমি পারলাম না।
আমি বললাম, আব্বু আমাকে একটা ভাল আম্মু কিনে দিবা। ফরিদপুরে মার্কেটে অনেক আম্মু পাওয়া যায়। আমি দেখেছি। টাকা দিয়ে ভাল আম্মু কিনে দিও?
আব্বু বলল, আচ্ছা কিনে দিব।
আমি আব্বুর সাথে বাজারে গেলে শুধু ভাল আম্মুর খোঁজ করতাম। ভাল কোন আন্টিকে দেখলেই আব্বুকে বলতাম, আব্বু ঐ আম্মু কিনে দাও।
বাজারের লোকেরা আমাদের দিকে তাকাতো। তারা বলতো বাচ্চাটার মা নাই, না?
আব্বু বলতে, না ওর মা নাই।
একদিন আব্বু বলল, একটা আন্টি তোমার মা হতে চায়। তাকে কি আনবো।
আমি তার নাম জানতে চাইলাম। মোবাইলে ছবি দেখে বললাম, আন্টির মুখে কিসের দাগ আব্বু?
আব্বু বলল, মুখে ফোঁড়া হয়েছে।
বললাম, ঔষুধ দিলে ভাল হবে?
আব্বু বলল, হ্যা ভাল হবে।
বললাম, তাহলে এই আম্মুই কিনে আনো। পরে ঔষুধ কিনে দিয়ো।
এখন আমার নতুন আম্মু এসেছে।
আমি তাকে মা বলি। আম্মু ডাকলে যদি সেও আবার শয়তান হয়ে যায়!
নতুন মাকে বলেছি, মা তুমি শয়তান আম্মুর মতো শয়তানি করবা না। আব্বুর কথা শুনবা।
মা হাসে।
নতুন মা অনেক ভাল। আমাকে অনেক ভাল বলে। নতুন নানা-নানীও ভাল। এই নানা বাড়িতে বিল্ডিং নাই। দেওয়াল আছে। ছাদ নাই। উপরে টিন।
আমার আব্বুও এখন ভাল আছে। আমি ও ভাল আছি। আমি সবসময় মা’র সাথে থাকি। মা যদি কোন আঙ্কেলের সাথে কথা বলে আমি মা কে বলি, কথা বলবা না। আঙ্কেলদের সাথে কথা বলা ভাল না। সবাই শয়তান।
আমি কোথাও গেলে ছোট বাবুদের সাথে কথা বলি। তারা ভাল আছে নাকি জানতে চাই। সব ছোট বাবুদের জন্য আমার মায়া লাগে।
সাড়ে চার বছর বয়সী এই ছোট মেয়েটার সবার জন্য মায়া লাগবে না কেন? সে তো জানে এই দুনিয়াতে ভাল মানুষ হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। শুধু মাত্র তার বাবা, নতুন মা, কাকা-কাকী, দাদু আর অন্যান্য সব ছোট বাবুরে আব্বুরাই ভাল মানুষ।
খোকাখুকিরা জন্ম নেয় মায়ের পেটে। আর সেই মা নিজের সন্তানকে মেরে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। মা নিজের সন্তানকে জবাই করে। বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া করে সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে। এতো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
পরকিয়া করেছে মা, সন্তান হয়েছে মা-হারা।
বড়রা নিজেদের ঝগড়াঝাটির কারণে শিশুদের জীবনে অভিশাপ নিয়ে আসে। শিশুর কি অপরাধ। তাকে বাবা হারা, মা হারা করার কি অধিকার আছে এই সমাজের?
মায়ের অপরাধের জন্য মায়ের তালাক হয়ে যায়। মা-কে বিশ্বাস করার অপরাধে বাবার নামে মামলা হয়, লক্ষ লক্ষ টাকা চলে যায়। কিন্তু শিশু তো কোন অন্যায় করে নাই। সে কেন বিচার পায় না?
মায়ের পরকিয়া প্রেমিকের কিছুই হয় না। তাদের বিচারের কোন আইন নাই দেশে। একটা ছেড়ে আরেকটা মেয়েকে খুজে নিবে তারা। তারা কোন অপরাধী না। তাদের পাশে দাড়ায় সমাজের সবাই। দেশটাতো এইসব লম্পটদেরই। উল্টো মামলা হয় স্বামীদের নামে।
এইসব প্রেমিক পুরুষদের পাশে দাড়ানোর লোকের অভাব নাই। তার বাবা-মা থেকে শুরু করে বন্ধু বান্ধব, অফিসের সহকর্মী, সমাজের সাধারণ মানুষ সবাই তার পাশে দাড়ায়। সে তো সুপুরুষ! তাই যে কোন মেয়ে তার কাছে আসতে পারে। তার দরজা সবার জন্য খোলা। সে তো সমাজের অমূল্য সম্পদ! তারা না থাকলে মেয়েরা যাবে কোথায়?
তাইতো এই ছোট্ট খুকি সব খোকা খুকির কথা ভাবে। শিশুদের পক্ষে কেউ নাই। সবাই ছেলে পক্ষ, মেয়ে পক্ষ আর লম্পট পক্ষ হয়ে যায়। লম্পট আর তাদের পুজারীরা দুরে থেকে হাসে। মজা নেয়।
ওরা নিজের বউটাকে সিন্দুকে বন্দি করে রাখে। বাইরের মানুষের বউ আর মেয়েদের সাথে খাতির করে। ওরা খুবই বুদ্ধিমান! হারতে জানে না ওরা কখনো, শুধুই জিতে। পুরনো দিনের ডাকাতদের মতো। নিজের গোলায় ধান ভরে রেখে তারা অন্যের বাড়িতে যায় ডাকাতি করতে। তাদের গোলার ধান লুটে নেওয়ার জন্য। পরের গোলার ধান লুটে নেওয়ার মধ্যেই সত্যিকারের আনন্দ। এটা তো অনেক গৌরবের!
চারিদিকে কেবল লম্পটদের ছড়াছড়ি। লম্পটেরা রক্ষা করে লম্পটদের। সবাই লম্পটের পুজারী। লম্পটদের জয় হোক!
জয় লম্পট! জয় শয়তান! জয় হোক শয়তান পুজারীদের!
শিশুরাতো আইন বোঝে না, আদালত চিনে না। তাদের জন্য দেশে কোন আইন পাশ হয় না। মামলা করার জন্য একটা বয়স লাগে। সেই বয়স তাদের হয় নাই। তারা শুধু নির্যাতিত হবে।
আজ সময় এসেছে পৃথিবীর সব খোকা খুকি মিলে একটি সমিতি করার। খোকাখুকি কল্যাণ সমিতি। (সমাপ্ত)
আমি আর আমার দাদী থাকি এখানে গ্রামের বাড়িতে। আব্বু থাকে ঢাকায়। অফিসে কাজ করে। ঢাকা কোন দিকে আমি জানি না। দাদীও ঢাকা শহর চিনে না। আব্বুর সাথে যেতে পারে। আব্বু ঢাকায় গেছে অনেকদিন হয়ে গেল। আসে না কেন! নাকি আব্বু এই গ্রামের বাড়ির পথ ভুলে গেছে! যদি আর আসতে না পারে!
আমার দাদীর অল্প টাকা আছে। আমাকে মজার কিছু কিনে দিতে পারে না। আমার খুব ইচ্ছে করে চিপস আর বাদাম কিনতে। কান্নাকাটি করলে দাদী কিনে দেয়। আমার খুব দুঃখ হয় দাদীর জন্য। আব্বুর তো অনেক টাকা আছে। দাদীকে দিতে পারে না!
দাদীকে আমি দাদু ডাকি। আমার তো দাদা নাই। অনেক আগেই নাকি মারা গেছে। দুনিয়াতে দাদুর কেউ নাই। আমারও কেউ নাই দাদু ছাড়া। আমার দাদু বুড়ো মানুষ। মাঝে মাঝেই তার মাথা ব্যাথা করে, পেট ব্যাথা করে, হাত-পা ব্যাথা করে। হঠাৎ করেই বিছানায় শুয়ে পড়ে কাৎরায়। মাঝে মাঝে কান্না করে। আমার খুব ভয় লাগে। যদি দাদু মারা যায়! তখন আমার কি হবে! আমাকে কে খাইয়ে দিবে? কে গোশল করিয়ে দিবে? কার কাছে ঘুমাবো?
আমি দাদুর মাথায় হাত রেখে বলি, দাদু ঔষুধ খাও। ভাল হয়ে যাবে। দাদু বুঝতে পারে যে, আমি ভয় পাই। আমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
আমার দাদু সারাদিন শুধু কাজ করে। উঠোন ঝাড়ু দেয়, রান্না করে, ময়লা পরিষ্কার করে। দাদু কাদা মাখিয়ে রান্নাঘর লেপ দেয়। আমি বলি, দাদু কাদা ধরো কেন, ঠান্ডা লাগবে, জ্বর আসবে।
আমার মনে কেবল ভয়। যদি দাদু মারা যায়, আমার কি হবে? আমি তো ছোট মানুষ। মোবাইলে ফোন করতে পারি না। আব্বুকে কেমনে জানাবো!
আমার অনেক দুঃখ। আমার আম্মু নাই। তাই দাদুর কাছে গ্রামে থাকি।
আগে ঢাকায় থাকতাম। আমার আব্বু আম্মুর সাথে। কিছুদিন পর পর আব্বু আমাদের ঘোরাতে নিয়ে যেত। আমি শিশু পার্কে গিয়েছি, চিড়িয়াখানায় গিয়েছি, যাদুঘরে গিয়েছি, রমনা পার্কে গিয়েছি। আমি শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছি। সেখানে অনেক বেশি মানুষ ছিল। আমার অনেক ভয় লাগছিল।
আব্বু মাঝে মাঝে অফিসে যেত না। সেদিন নাকি ছুটি থাকতো। কিন্তু ছুটি হলে কি হবে! আব্বু তার ক্লাসে যেত। কবিতার ক্লাশ। আব্বু কবিতা পড়া শিখে। বাসাতেও সুন্দর করে কবিতা পড়তো। আমাকে শোনাত। খুব ভাল লাগতো।
আমি কিছু বুঝতাম না। আব্বু চলে যাওয়ার পরেই মারুফ কাকা আমাদের ঘরে আসতো। আম্মুর পাশে বসতো। আমার ভাল লাগতো না। আমি মারুফ কাকাকে সরিয়ে দিয়ে আম্মুর পাশে বসতাম। আম্মু আমাকে নানা কথা বলে, বুঝিয়ে শুনিয়ে অন্য ঘরে অনেকগুলো খেলনা দিয়ে খেলতে দিতো। আমি খেলতাম। কিন্তু একটু পর পর ঘরে গিয়ে দেখতাম আম্মু কি করে। আম্মু মারুফ কাকার সাথে কি করে বুঝি না। শয়তানি করে। আম্মু শয়তান হয়ে গেছে। আব্বুকে বলতে হবে।
একদিন আম্মুকে বললাম, তুমি মারুফ কাকার সাথে শয়তানি করো কেন?
আম্মু কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। বলল, এটা শয়তানি না। এটা একটা খেলা। বড়দের খেলা। তুমি এ কথা তোমার আব্বুকে বলবা না। আম্মু আমাকে দুইটি আইসক্রিম কিনে দিল। আমি আব্বুকে কিছু বললাম না।
আমি একদিন জামা প্যান্ট খুলে আব্বুকে বললাম, আব্বু আমি বড় হয়েছি। আমি খেলতে পারি।
আব্বু বলল, তুমি জামা প্যান্ট খুলেছ কেন?
বললাম, খেলতে চাই। আম্মুর মতো।
আব্বু বলল, তোমার আম্মু কি খেলে।
আমি যা দেখেছি সবকিছুই আব্বুর কাছে বলে দিলাম।
হঠাৎ আব্বুর চেহারা ভয়ংকর হয়ে উঠল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
রাতে আব্বু আর কারো সাথে কথা বলে নাই। আমাকে আদর করে নাই। চুপ চাপ শুয়ে ছিল।
একদিন আব্বু বাইরে গেল। একটু পর মারুফ কাকা ঘরে এল। আব্বু ও একটু পরে এল। মারুফ কাকাকে আব্বু জোরে লাথি দিল। অনেক মারামারি করল। আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম।
পরদিন আমাকে আর আম্মুকে নানা বাড়ি দিয়ে এলেন।
নানা বাড়িতে কেউ আমাকে আর আগের মতো আদর করে নাই। মোবাইল ফোনে আম্মু আব্বুর সাথে ঝগড়া করতো। আর কান্নাকাটি করতো। আমি বলতাম, আম্মু তোমার আর আব্বুর কি হয়েছে? আমাকে খাইয়ে দিতো না। গোশল করিয়ে দিতো না। আমি একবালতি পানির ভিতর বসে একা একা গোশল করতাম। শরীর মুছতে পারতাম না। বাতাসে শুকিয়ে যেত।
আমার ভীষণ জ্বর হয়েছিল। আব্বু দেখতে এল না। আম্মু গুরুত্ব দিল না। মনে হলো এখানে কেউ আমার আপন না। আমার খুব খিদে লাগতো। কেউ খেতে দিতো না। আমি তখন কোন খাবারের নাম জানতাম। না। শুধু কান্নাকাটি করতাম আর নানীর কাছে গিয়ে বলতাম, নানী কিছু খাব, নানী কিছু খাব।
নানীও আমাকে আগের মতো আদর করতো না। শুধু কান্নাকাটি করলে ভাত খাইয়ে দিতো। আব্বু কেন যায় নাই! আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভাবতাম আমার কি দুনিয়াতে কেউ নাই!
কয়েকদিন পর আব্বু গেল নানাবাড়ি। নানার কাছে কি যেন বলল। সবাই আব্বুর সাথে চীৎকার করে ঝগড়া করল। আব্বু অনেক কান্নাকাটি করল। আমি অসহায়। আমার আব্বুও কাঁদে?
আব্বু আবারো চলে গেল। আমাকে কোলে নিয়ে অনেক কাঁদল। অনেক কিছু বলল। সবকিছু বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম, বলল, মা, আমার কথা ভাবি না। তোমার জন্যই আমার কষ্ট। তোমার কি হবে মা?
আমি এমনিতেই অসহায় অবস্থায় ছিলাম। আব্বুর কথায় আরো ভয় পেয়ে যাই। কি হবে আমার!
আমাকে নানাবাড়ির ছোট মানুষেরা মারতো। খামছি দিতো। লাঠি দিয়ে মারতো। আম্মু আমার কাছে থাকতো না। আমি শুধু কান্নাকাটি করতাম। কেউ আমাকে কোলে নিতো না। ওরা মারতে মারতে আমার মুখে, বুকে কয়েক যায়গায় রক্ত বের করে দিয়েছিল। একদিন হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আমার ডান হাতের একটি নখ থেতলে দিয়েছিল। পরে নখটি পড়ে যায়।
আমি কান্নাকাটি করলে, আম্মু বলতো, কান্দস ক্যান? তোর বাপ নাই? তোর বাপ মরছে নাকি? তোর বাপের কাছে যাইতে পারস না?
আমি তো আব্বুর কাছে যেতে পারি না। আমি তো ঢাকা শহর চিনি না। আমি শুধু কান্নাকাটি করতাম। ভাবতাম আমার আব্বু আর কখনো আমাকে নিতে আসবে না। আব্বু কি নানা বাড়ির পথ ভুলে গেছে! নাকি আম্মুর ভয়ে আসে না।
আম্মু বলেছে, আব্বুকে বটি দিয়ে কাটবে। জেলে ঢুকাবে। জেল কোথায় জানি না। সেখানে গেলে কি হয়!
একদিন শুনলাম আব্বু আসবে। মনে একটু সাহস লাগল। এবার আব্বুর সাথে চলে যাব। এখানে আর থাকবো না।
আব্বু আমাকেও নিল আম্মুকেও নিল। ঢাকার বাসায়। ভাবলাম সব ঠিক হয়ে গেছে।
কিন্তু কিছু ঠিক হয় নাই। ঢাকার বাসায় গিয়ে প্রতিদিন আব্বু আম্মু ঝগড়া করতো। আব্বু বলতো, শুধু আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তোকে রাখতে চাই। কিন্ত এরজন্য তোর বাপ-মা কে আসতে হবে। তোর বিচার করতে হবে।
আম্মু নাকি নানা-নানীর কাছে কিছু স্বীকার করবে না। কি স্বীকার করবে না জানি না। ঝগড়া চলতেই থাকে। আম্মু আমাকে আদর করে না। কোলে নেয় না। আব্বু আমাকে খাইয়ে অফিসে যায়। দিনে আমার খিদে লাগলে কান্নাকাটি করি। পাশের বাসার আন্টি ভাত এনে আমাকে খাইয়ে দেয়।
আমি ভয় পাই। কি হবে আমার! আব্বু আমাকে নিয়ে প্রতিদিন বাজারে ঘোরাতে নিয়ে যায়। আব্বুর মুখে হাসি নাই। হাসতে ভুলে গেছে। মুখটা কালো হয়ে থাকে। চোখদুটো পিটপিট করে। কিছু বললেই যেন কেঁদে ফেলবে। কি হবে আমাদের!
কি সমস্যা জানি না। আব্বু বলল, অনেক দিন যাবত তোমার আম্মু শয়তানি করছে।
বললাম কার সাথে? মারুফ কাকার সাথে?
আব্বু বলল, হ্যাঁ।
বললাম আম্মু শয়তান হয়ে গেছে?
আব্বু বলল, হ্যাঁ।
বললাম, তাহলে আম্মুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল। ডাক্তার ঔষুধ দিলে ভাল হয়ে যাবে।
আব্বু বলল, ঔষুধে শয়তানি ভাল হয় না।
একদিন আব্বু আমাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা মা, তোমার আম্মু তো শয়তান হয়ে গেল। তোমার আম্মুকে তাড়িয়ে দিই?
আমি আম্মুর ব্যবহারে অতিষ্ট। এতটুকু বুঝতাম যে, মারুফ কাকার সাথে শয়তানি করে আম্মু শয়তান হয়ে গেছে। তাই এতো সমস্যা। বললাম, ঠিক আছে তাড়িয়ে দাও।
আব্বু বলল, তুমি আমার কাছে থাকতে পারবা?
বললাম, পারবো।
আম্মুকে তাড়িয়ে দিলে আব্বু সুস্থ হয়ে উঠবে। আবারো হাসবে। কবিতা পড়বে। গান শোনাবে। আমার ভাল লাগবে। আমার খুশি লাগছিল।
একদিন আমার মামা আরো দুইজন লোককে নিয়ে আমাদের বাসায় আসল। তারা আব্বুর সাথে চিৎকার করল। দরজায় আব্বুকে জোরে ধাক্কা দিল। আব্বু মাকে তাদের সাথে চলে যেতে বলল। মামা আমাকে কোলে নিয়ে মার হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইল। আব্বু বলল, আমার মেয়েকে নেয়া যাবে না। আব্বু জোর করে মামার কোল থেকে আমাকে টেনে নিলে। টানাটানিতে ভয় পেয়ে আমি চীৎকার করে কান্নাকাটি করেছিলাম।
এরপর আবারো ঝগড়া লেগে যায়। তারা সবাই আব্বুকে মারতে চায়। লোকজন এসে সব ঠান্ডা করে দেয়।
এর পর আব্বু আমাকে সেজ কাকার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে গ্রাম থেকে দাদী আসে। সেজ কাকী আসে। আমার একটু ভাল লাগে।
কিন্তু আব্বু পালিয়ে থাকে। পুলিশ নাকি আব্বুকে ধরে নিয়ে যাবে। তাই আব্বু আসে না। সেজ কাকা আমার জন্য অনেক কিছু কিনে আনে। আমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে।
একদিন আব্বুর কোলে করে কোর্টে গিয়েছিলাম। আম্মু নাকি পুলিশের কাছে মিথ্যে কথা বলেছে। আব্বু নাকি আম্মুর কাছে টাকা চেয়েছে। আমি তো কখনো দেখি নাই। আম্মুই তো আব্বুর কাছে টাকা চাইতো। আর আব্বু অনেক টাকা দিতো।
কোর্টে অনেক পুলিশ ছিল। তারা আব্বুকে জেলে ঢোকাবে। আমিও জেলে যাব আব্বুর সাথে। পুলিশ বলল, কোল থেকে বাচ্চা নামান। আমি আব্বুকে আরো শক্ত করে ধরে কেঁদে ফেললাম। পরে আমাকে আর আব্বুকে পুলিশ ছেড়ে দিল। আমাদের নাকি জামিন হয়ে গেল।
আমি আর আব্বু অসহায় ছিলাম। আমার আম্মু একটা শয়তান হয়ে গেছে। তাই মারুফ কাকার সাথে শয়তানি করেছে আর আব্বুর নামে মিথ্যা কথা বলেছে। পুলিশও শয়তান। উকিল ও শয়তান। জজও শয়তান।
তারা আম্মুকে জেলে দিতে পারে না! মারুফ কাকাকে জেলে দিতে পারে না! মারুফ কাকাই তো আম্মুর সাথে শয়তানি করেছে। এজন্যইতো এতো সমস্যা। দুনিয়াতে সব শয়তানেরা বাস করে।
আমাকে আরো বড় হতে হবে। আমি ভাত কম খাই বলে আব্বু রাগ করে। আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে আরো বেশি ভাত খেতে হবে। বড় হতে হবে। বড় হলে আমি সবাইকে মারব।
বড় হয়ে আমি পুলিশ হবো। সব শয়তান পুলিশকে মারবো। জেলে ঢুকাবো। কোর্টের জজকেও জেলে ঢুকাবো।
আমি বড় হয়ে আম্মুর চুল ছিড়ে ফেলব। সব চুল কেটে টাক করে জেলে ঢুকাবো।
মারুফ কাকাকে ধরে আনবো। বটি দিয়ে কেটে কেটে মুরগির মতো মাংস বানাবো। তারপর সেই মাংস ফ্রিজে রেখে রান্না করে খাব। মানুষের মাংস তো কোনদিন খাই নাই। মানুষের মাংস কি খাওয়া যায়? জানি না তো!
দুনিয়াতে সব খোকাখুকিদের জন্য আমার মায়া লাগে। তারা যদি আমার মতো কষ্ট পায়! মারুফ শয়তান। দুনিয়ার সব মানুষ শয়তান। তারা যদি অন্য বাবুদের আম্মুর সাথেও শয়তানি করে! তাহলে তো সেই বাবুদের আব্বু তার মাকে তাড়িয়ে দিবে। আর পুলিশ সেই বাবুর আব্বুকে ধরে নিয়ে যাবে।
দুনিয়াটা শয়তানদের। আমি এই দুনিয়াতে কেন এলাম? আব্বুর জন্য মায়া লেগেছে এই জন্য? তাহলে আব্বু ভুল করেছে। এই দুনিয়ায় আসা আব্বুর ঠিক হয় নাই।
এই দুনিয়াতে শয়তানেরা শয়তানি করে। আর অন্য শয়তানেরা তাকে বাঁচায়। শয়তানেরা আমাদেরকে মারধোর করে। জেলে পাঠায়। কেউ কি নাই তাদের মেরে ফেলতে পারে! বুঝেছি আমরা ভুল যায়গায় এসে পড়েছি। আব্বুকে বলতে হবে অন্য কোন দেশে যেতে। যেখানে সবাই ভাল।
তাহলে অন্য বাবুদের কি হবে?
কিছুদিন পর আব্বু এসেছে আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আব্বু বাড়িতে আসলে দাদু খুশি হয়। আমিও খুশি হই। আব্বুকে বলি, আব্বু তোমার সমস্যা কি শেষ হয়েছে?
আব্বু বলল, আর কোন সমস্যা নেই মা। তোমার শয়তান আম্মু আমার অনেক টাকা নিয়ে গেছে। এখন সে আর পুলিশকে মিথ্যে কথা বলবে না। পুলিশও আমাকে ধরবে না।
আমার খুব ভাল লাগল। আমার আব্বুকে ভাল লাগছিল। আমি বললাম, আব্বু চিন্তা করবা না, আমি বড় হয়ে তোমাকে অনেক টাকা দিবো।
আব্বু আমাকে আদর করে বলল, তুমি মানুষ হলেই আমার আনন্দ মা। তোমার কথা ভেবেই দেরি হয়ে গেল। নইলে অনেক আগেই শয়তানটাকে সহজে বিদেয় করতে পারতাম। তোমাকে আমি মা-হারা করতে চাইনি। কিন্তু আমি পারলাম না মা, আমি পারলাম না।
আমি বললাম, আব্বু আমাকে একটা ভাল আম্মু কিনে দিবা। ফরিদপুরে মার্কেটে অনেক আম্মু পাওয়া যায়। আমি দেখেছি। টাকা দিয়ে ভাল আম্মু কিনে দিও?
আব্বু বলল, আচ্ছা কিনে দিব।
আমি আব্বুর সাথে বাজারে গেলে শুধু ভাল আম্মুর খোঁজ করতাম। ভাল কোন আন্টিকে দেখলেই আব্বুকে বলতাম, আব্বু ঐ আম্মু কিনে দাও।
বাজারের লোকেরা আমাদের দিকে তাকাতো। তারা বলতো বাচ্চাটার মা নাই, না?
আব্বু বলতে, না ওর মা নাই।
একদিন আব্বু বলল, একটা আন্টি তোমার মা হতে চায়। তাকে কি আনবো।
আমি তার নাম জানতে চাইলাম। মোবাইলে ছবি দেখে বললাম, আন্টির মুখে কিসের দাগ আব্বু?
আব্বু বলল, মুখে ফোঁড়া হয়েছে।
বললাম, ঔষুধ দিলে ভাল হবে?
আব্বু বলল, হ্যা ভাল হবে।
বললাম, তাহলে এই আম্মুই কিনে আনো। পরে ঔষুধ কিনে দিয়ো।
এখন আমার নতুন আম্মু এসেছে।
আমি তাকে মা বলি। আম্মু ডাকলে যদি সেও আবার শয়তান হয়ে যায়!
নতুন মাকে বলেছি, মা তুমি শয়তান আম্মুর মতো শয়তানি করবা না। আব্বুর কথা শুনবা।
মা হাসে।
নতুন মা অনেক ভাল। আমাকে অনেক ভাল বলে। নতুন নানা-নানীও ভাল। এই নানা বাড়িতে বিল্ডিং নাই। দেওয়াল আছে। ছাদ নাই। উপরে টিন।
আমার আব্বুও এখন ভাল আছে। আমি ও ভাল আছি। আমি সবসময় মা’র সাথে থাকি। মা যদি কোন আঙ্কেলের সাথে কথা বলে আমি মা কে বলি, কথা বলবা না। আঙ্কেলদের সাথে কথা বলা ভাল না। সবাই শয়তান।
আমি কোথাও গেলে ছোট বাবুদের সাথে কথা বলি। তারা ভাল আছে নাকি জানতে চাই। সব ছোট বাবুদের জন্য আমার মায়া লাগে।
সাড়ে চার বছর বয়সী এই ছোট মেয়েটার সবার জন্য মায়া লাগবে না কেন? সে তো জানে এই দুনিয়াতে ভাল মানুষ হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। শুধু মাত্র তার বাবা, নতুন মা, কাকা-কাকী, দাদু আর অন্যান্য সব ছোট বাবুরে আব্বুরাই ভাল মানুষ।
খোকাখুকিরা জন্ম নেয় মায়ের পেটে। আর সেই মা নিজের সন্তানকে মেরে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। মা নিজের সন্তানকে জবাই করে। বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া করে সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করে। এতো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
পরকিয়া করেছে মা, সন্তান হয়েছে মা-হারা।
বড়রা নিজেদের ঝগড়াঝাটির কারণে শিশুদের জীবনে অভিশাপ নিয়ে আসে। শিশুর কি অপরাধ। তাকে বাবা হারা, মা হারা করার কি অধিকার আছে এই সমাজের?
মায়ের অপরাধের জন্য মায়ের তালাক হয়ে যায়। মা-কে বিশ্বাস করার অপরাধে বাবার নামে মামলা হয়, লক্ষ লক্ষ টাকা চলে যায়। কিন্তু শিশু তো কোন অন্যায় করে নাই। সে কেন বিচার পায় না?
মায়ের পরকিয়া প্রেমিকের কিছুই হয় না। তাদের বিচারের কোন আইন নাই দেশে। একটা ছেড়ে আরেকটা মেয়েকে খুজে নিবে তারা। তারা কোন অপরাধী না। তাদের পাশে দাড়ায় সমাজের সবাই। দেশটাতো এইসব লম্পটদেরই। উল্টো মামলা হয় স্বামীদের নামে।
এইসব প্রেমিক পুরুষদের পাশে দাড়ানোর লোকের অভাব নাই। তার বাবা-মা থেকে শুরু করে বন্ধু বান্ধব, অফিসের সহকর্মী, সমাজের সাধারণ মানুষ সবাই তার পাশে দাড়ায়। সে তো সুপুরুষ! তাই যে কোন মেয়ে তার কাছে আসতে পারে। তার দরজা সবার জন্য খোলা। সে তো সমাজের অমূল্য সম্পদ! তারা না থাকলে মেয়েরা যাবে কোথায়?
তাইতো এই ছোট্ট খুকি সব খোকা খুকির কথা ভাবে। শিশুদের পক্ষে কেউ নাই। সবাই ছেলে পক্ষ, মেয়ে পক্ষ আর লম্পট পক্ষ হয়ে যায়। লম্পট আর তাদের পুজারীরা দুরে থেকে হাসে। মজা নেয়।
ওরা নিজের বউটাকে সিন্দুকে বন্দি করে রাখে। বাইরের মানুষের বউ আর মেয়েদের সাথে খাতির করে। ওরা খুবই বুদ্ধিমান! হারতে জানে না ওরা কখনো, শুধুই জিতে। পুরনো দিনের ডাকাতদের মতো। নিজের গোলায় ধান ভরে রেখে তারা অন্যের বাড়িতে যায় ডাকাতি করতে। তাদের গোলার ধান লুটে নেওয়ার জন্য। পরের গোলার ধান লুটে নেওয়ার মধ্যেই সত্যিকারের আনন্দ। এটা তো অনেক গৌরবের!
চারিদিকে কেবল লম্পটদের ছড়াছড়ি। লম্পটেরা রক্ষা করে লম্পটদের। সবাই লম্পটের পুজারী। লম্পটদের জয় হোক!
জয় লম্পট! জয় শয়তান! জয় হোক শয়তান পুজারীদের!
শিশুরাতো আইন বোঝে না, আদালত চিনে না। তাদের জন্য দেশে কোন আইন পাশ হয় না। মামলা করার জন্য একটা বয়স লাগে। সেই বয়স তাদের হয় নাই। তারা শুধু নির্যাতিত হবে।
আজ সময় এসেছে পৃথিবীর সব খোকা খুকি মিলে একটি সমিতি করার। খোকাখুকি কল্যাণ সমিতি। (সমাপ্ত)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
পরশ ১৫/০২/২০১৭বেশ বড়
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ১৪/০২/২০১৭ওহ!
চমৎকার!!!