পচা মাতুব্বর -উপন্যাস ১ম অধ্যায়
১
মোছন মাতুব্বরের প্রথম কন্যার জন্মের পর পাঁচ পাঁচটি সন্তান জন্মিয়া মরিয়া গেল। অবশেষে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করিয়া বাঁচিয়া রহিল। যদি এই সন্তানটিও মরিয়া যায় এই ভয়ে তিনি সন্তানের কোন নাম রাখিলেন না। প্রতিবেশীরা ছেলের কি নাম রাখিয়াছে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি হাতড়াইয়া একটা নাম বাহির করিয়া কহিলেন “পচা”। সুন্দর নাম লইয়া অকালমৃত্যুর চাইতে 'পচা' নাম লইয়া বাঁচিয়া থাকাও ভাল। সেই হইতে মোচন মাতুব্বরের বড় ছেলে পচা মাতুব্বর বলিয়াই সকলের নিকট পরিচিত হইয়া উঠিল।
পচার বয়স যখন তিন বছর তখন মোছন মাতুব্বরের আরো একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করিল। এইবার বাবা মা শখ করিয়া দ্বিতীয় পুত্রের নাম রাখিলেন ওহাব মাতুব্বর । মোচন মাতুব্বরের গায়ের রঙ তামাটে হইলেও ওহাবের গায়ের রঙ হইল তাহার দাদা মুলামদি মাতুব্বরের মতো কালো। তাই মোচন মাতুব্বর ওহাবকে দেখিয়া তাহার প্রয়াত পিতার কথা মনে করিয়া তাহাকে খুবই আদরযত্ম করিতেন ও ভালবাসিতেন। তিনি ওহাবকে “আব্বা” বলিয়াই ডাকিতেন। আর পচাকে ডাকিতেন বা'জান বলিয়া।
তখন গ্রামে খুবই অভাব যাইতেছিল। ক্ষেতের ফসল বন্যায় তলাইয়া গেল। ধান চালের দাম হুহু করিয়া বাড়িয়া উঠিল। দিনমজুরেরা কাজ না পাইয়া এবং চাল কিনিতে না পারিয়া অসহায় অবস্থায় নিপতিত হইল। যাহাদের গোলায় আগের বছরের ধান ছিল তাহারাই কেবল দুই বেলা দুইমুঠো খাইতে পাইল। অনেকেই জমি বিক্রি করিয়া ধান সংগ্রহ করিতে লাগিল। বড় গৃহস্থরা ধান বিক্রি করিয়া আরো জমি কিনিয়া আরো ধনী হইয়া উঠিল। অভাবের তাড়নায় অনেকেই লবন দিয়া শাক সিদ্ধ করিয়া, কঁচু রান্না করিয়া তাহা দ্বারাই উদর পূর্তি করিতে লাগিল। তাহাতেও শেষ রক্ষা হইল না। অপুষ্টিতে অনেক মানুষ মরিয়া গেল।
ইহা কোন দুভিক্ষের সময় ছিল না। তখনকার দিনে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটিয়া থাকিত। মধ্যবিত্ত গৃহস্থের লোকেরা ফসল নষ্ট হইয়া গেলে দিনমজুরের কাজ করিয়া সংসার চালাইত। ধান নষ্ট হইয়া যাওয়ার গ্রামে তখন কাজ ছিল না, তারা দিনমজুরদের সাথে অন্য অঞ্চলে কাজের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়িল। মোচন মাতুব্বরও লজ্জার মাথা খাইয়া অন্যান্যদের সাথে যাত্রা করিল।
নৌকা যাইতেছিল সিলেটের উদ্দেশ্যে। খবর পাওয়া গেল সেখানে হাওড়ে-বাওড়ে ধান পাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। মোচন মাতুব্বরদের নৌকাখানা পদ্মা নদীর কিনার দিয়া চলিতে লাগিল। ফরিদপুরের পাশ দিয়া পদ্মা নদী বহিয়া গেলেও জীবনে এইবারই প্রথম তিনি পদ্মা নদীতে নৌকায় চড়িয়াছেন। সদরপুরের পিয়াজখালী বাজারে ব্যবসার কাজে গিয়া তিনি পূর্বে বহুবার পদ্মানদী দেখিয়াছেন। ক্ষেতের ফসল দিয়া সংসার চালানো কষ্ট হওয়ায় তিনি মাঝে মাঝে আলু পটলের ব্যবসা করিতেন। নদীর তীব্র স্রোত ও ঢেউ দেখিয়া তার বুক মাঝে মাঝে কাঁপিয়া উঠিত। বিশাল এই নদী, বিশাল তার ক্ষমতা। তার ক্ষমতার বলে সে ধ্বংস করে গ্রাম জনপদ। আবার গড়িয়াও তোলে মাইলের পর মাইল ভু-খন্ড। এখানে পদ্মা নদীকে কীর্তিনাশা বলা হয়।
রাত্রের খাওয়া দাওয়া সারিয়া মোচন মাতুব্বর ও তার কয়েকজন বন্ধু নৌকার ছইয়ের উপরে উঠিয়া পান খাইতে বসিল। সেদিন আকাশে জোছনা ছিল বিধায় বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাইতেছিল। নদীর ঘোলা পানিকে সাদা বালুর চর বলিয়া মনে হইতেছিল। পানির গভীরতা সেখানে অনুমান করা কঠিন। মৃদুমন্দ বাতাসে চাঁদের আলোয় নদীর মাঝখানে নৌকার ছইয়ে বসিয়া থাকিয়া অনেকের মনে সাহিত্যের ভাব জাগিয়া উঠিল। আদেল খাঁ বেহুলা লক্ষিন্দরের গান আরম্ভ করিয়া দিল।
ঐ বাজারে যাইও না বেহুলা নিষুধ করি তোরে,
রামের বেটা দুলা লক্ষাই ধইর্যা নিবে তোরে-রে
ওকি আহারে কি সুন্দরও বেহুলা রে।
অন্যসবাই হাতে তালিসহকারে গানের সুর মিলাইতে লাগিল।
স্রোতের অনুকূলে চলিতে থাকায় নৌকা দ্রুতবেগে আগাইতে লাগিল। হেমন্তের হালকা ঠান্ডা পরশ পাইয়া গ্রাম গুলি ঘুমাইতেছিল। তাহাও একের পর এক পিছনে পড়িয়া যাইতে লাগিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই মোচন মাতুব্বরের চোখে ঘুম আসিয়া গেল। তিনি কাঁত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন।
মোছন মাতুব্বরের প্রথম কন্যার জন্মের পর পাঁচ পাঁচটি সন্তান জন্মিয়া মরিয়া গেল। অবশেষে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করিয়া বাঁচিয়া রহিল। যদি এই সন্তানটিও মরিয়া যায় এই ভয়ে তিনি সন্তানের কোন নাম রাখিলেন না। প্রতিবেশীরা ছেলের কি নাম রাখিয়াছে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি হাতড়াইয়া একটা নাম বাহির করিয়া কহিলেন “পচা”। সুন্দর নাম লইয়া অকালমৃত্যুর চাইতে 'পচা' নাম লইয়া বাঁচিয়া থাকাও ভাল। সেই হইতে মোচন মাতুব্বরের বড় ছেলে পচা মাতুব্বর বলিয়াই সকলের নিকট পরিচিত হইয়া উঠিল।
পচার বয়স যখন তিন বছর তখন মোছন মাতুব্বরের আরো একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করিল। এইবার বাবা মা শখ করিয়া দ্বিতীয় পুত্রের নাম রাখিলেন ওহাব মাতুব্বর । মোচন মাতুব্বরের গায়ের রঙ তামাটে হইলেও ওহাবের গায়ের রঙ হইল তাহার দাদা মুলামদি মাতুব্বরের মতো কালো। তাই মোচন মাতুব্বর ওহাবকে দেখিয়া তাহার প্রয়াত পিতার কথা মনে করিয়া তাহাকে খুবই আদরযত্ম করিতেন ও ভালবাসিতেন। তিনি ওহাবকে “আব্বা” বলিয়াই ডাকিতেন। আর পচাকে ডাকিতেন বা'জান বলিয়া।
তখন গ্রামে খুবই অভাব যাইতেছিল। ক্ষেতের ফসল বন্যায় তলাইয়া গেল। ধান চালের দাম হুহু করিয়া বাড়িয়া উঠিল। দিনমজুরেরা কাজ না পাইয়া এবং চাল কিনিতে না পারিয়া অসহায় অবস্থায় নিপতিত হইল। যাহাদের গোলায় আগের বছরের ধান ছিল তাহারাই কেবল দুই বেলা দুইমুঠো খাইতে পাইল। অনেকেই জমি বিক্রি করিয়া ধান সংগ্রহ করিতে লাগিল। বড় গৃহস্থরা ধান বিক্রি করিয়া আরো জমি কিনিয়া আরো ধনী হইয়া উঠিল। অভাবের তাড়নায় অনেকেই লবন দিয়া শাক সিদ্ধ করিয়া, কঁচু রান্না করিয়া তাহা দ্বারাই উদর পূর্তি করিতে লাগিল। তাহাতেও শেষ রক্ষা হইল না। অপুষ্টিতে অনেক মানুষ মরিয়া গেল।
ইহা কোন দুভিক্ষের সময় ছিল না। তখনকার দিনে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটিয়া থাকিত। মধ্যবিত্ত গৃহস্থের লোকেরা ফসল নষ্ট হইয়া গেলে দিনমজুরের কাজ করিয়া সংসার চালাইত। ধান নষ্ট হইয়া যাওয়ার গ্রামে তখন কাজ ছিল না, তারা দিনমজুরদের সাথে অন্য অঞ্চলে কাজের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়িল। মোচন মাতুব্বরও লজ্জার মাথা খাইয়া অন্যান্যদের সাথে যাত্রা করিল।
নৌকা যাইতেছিল সিলেটের উদ্দেশ্যে। খবর পাওয়া গেল সেখানে হাওড়ে-বাওড়ে ধান পাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। মোচন মাতুব্বরদের নৌকাখানা পদ্মা নদীর কিনার দিয়া চলিতে লাগিল। ফরিদপুরের পাশ দিয়া পদ্মা নদী বহিয়া গেলেও জীবনে এইবারই প্রথম তিনি পদ্মা নদীতে নৌকায় চড়িয়াছেন। সদরপুরের পিয়াজখালী বাজারে ব্যবসার কাজে গিয়া তিনি পূর্বে বহুবার পদ্মানদী দেখিয়াছেন। ক্ষেতের ফসল দিয়া সংসার চালানো কষ্ট হওয়ায় তিনি মাঝে মাঝে আলু পটলের ব্যবসা করিতেন। নদীর তীব্র স্রোত ও ঢেউ দেখিয়া তার বুক মাঝে মাঝে কাঁপিয়া উঠিত। বিশাল এই নদী, বিশাল তার ক্ষমতা। তার ক্ষমতার বলে সে ধ্বংস করে গ্রাম জনপদ। আবার গড়িয়াও তোলে মাইলের পর মাইল ভু-খন্ড। এখানে পদ্মা নদীকে কীর্তিনাশা বলা হয়।
রাত্রের খাওয়া দাওয়া সারিয়া মোচন মাতুব্বর ও তার কয়েকজন বন্ধু নৌকার ছইয়ের উপরে উঠিয়া পান খাইতে বসিল। সেদিন আকাশে জোছনা ছিল বিধায় বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাইতেছিল। নদীর ঘোলা পানিকে সাদা বালুর চর বলিয়া মনে হইতেছিল। পানির গভীরতা সেখানে অনুমান করা কঠিন। মৃদুমন্দ বাতাসে চাঁদের আলোয় নদীর মাঝখানে নৌকার ছইয়ে বসিয়া থাকিয়া অনেকের মনে সাহিত্যের ভাব জাগিয়া উঠিল। আদেল খাঁ বেহুলা লক্ষিন্দরের গান আরম্ভ করিয়া দিল।
ঐ বাজারে যাইও না বেহুলা নিষুধ করি তোরে,
রামের বেটা দুলা লক্ষাই ধইর্যা নিবে তোরে-রে
ওকি আহারে কি সুন্দরও বেহুলা রে।
অন্যসবাই হাতে তালিসহকারে গানের সুর মিলাইতে লাগিল।
স্রোতের অনুকূলে চলিতে থাকায় নৌকা দ্রুতবেগে আগাইতে লাগিল। হেমন্তের হালকা ঠান্ডা পরশ পাইয়া গ্রাম গুলি ঘুমাইতেছিল। তাহাও একের পর এক পিছনে পড়িয়া যাইতে লাগিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই মোচন মাতুব্বরের চোখে ঘুম আসিয়া গেল। তিনি কাঁত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সুব্রত সামন্ত (বুবাই) ১৬/১০/২০১৬parlam
-
প্রিয় ২২/০৭/২০১৬দুঃখিত,''পরের অধ্যায়টি কী লেখা আছে ''হবে।
-
প্রিয় ২২/০৭/২০১৬সুন্দর তব সৃষ্টি।পরের অধ্যায়টি কী লেখা না লিখছেন?
-
পরশ ১৯/০৬/২০১৬অসাধারন
-
মোনালিসা ১৮/০৬/২০১৬ভাল
-
অঙ্কুর মজুমদার ১৬/০৬/২০১৬vlo
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ১৬/০৬/২০১৬...:::চমৎকার...:::