www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শ্রাবন্তী ও তার বোধগম্যতা


সকালের সময়টা কতদ্রুত চলে যায় বুঝে উঠতে পারি না। খাওয়া দাওয়া শেষে কাপড়চোপড় পরার সময়ই আমার আড়াই বছরের মেয়েটা কথা বলতে শুরু করে। কথা শেখার পর থেকে সে সারাদিনই কথা বলে।
: আব্বু তুমি অফিসে যাবা, না?
: হ্যাঁ আম্মু আমাকে অফিসে যেতে হবে।
: আমিও অফিসে যাব।
: তুমি বড় হলে অফিসে যেতে পারবে।
: না, এখনই যেতে পারব। তোমার সাথে যেতে পারব। …. আচ্ছা আব্বু অফিসে তুমি কি কর?
: কাজ করি আম্মু।
: কাজ কর কেন? বাসায় থাকবা আমার সাথে। এইযে আমার আম্মু, এইযে আমার আব্বু আর আমি বাসায় থাকবো, খাবো, টিভি দেখব আর ঘুরতে যাব।
: কিন্তু খাবার কিনতে হলে তো টাকা দরকার, টাকা পাবো কোথায় আম্মু?
: আব্বু তুমি কোথায় টাকা পাও?
: আমি অফিসে কাজ করলে টাকা পাই।
: না, অফিসে না। তুমিতো মেশিনে টাকা পাও। তোমার একটা কার্ড আছে না, ওটা মেশিনে ঢুকালেইতো মেশিন তোমাকে টাকা দেয়।
: হ্যাঁ টাকা মেশিনে দেয়, তবে তার জন্য অফিসে কাজ করতে হয়। অফিসে কাজ করলেইতো মেশিনে টাকা জমা হবে।
: আচ্ছা তাহলে অফিসে যাও। আমি একটুও কাঁদব না, আম্মুর কাছে থাকব আর টিভিতে মটু পাতলু দেখব। তাড়াতাড়ি আসবা কিন্তু।
: আচ্ছা আম্মু তাড়াতাড়িই আসব। তাহলে আসি আম্মু?
: যাও, তাড়াতাড়ি অফিসে যাও, টাটা বাই বাই।
: বাই বাই।

 সন্ধেয় অফিস থেকে বাসায় ফিরে কলিং বেল চাপলেই মেয়েটা এক দৌড়ে দরজার কাছে এসে লাফালাফি করতে শুরু করে আর চিৎকার করে বলে, আব্বু এসে গেছে, আব্বু এসে গেছে। আম্মু তাড়াতাড়ি দরজা খোল। দরজা খোলার সাথে সাথেই মেয়েটা লাফিয়ে আমার কোলে উঠে। এরপর রাতে ঘুমানো অবধি আমার পিছু ছাড়ে না। বাথরুমে গেলেও দরজার বাইরে দাড়িয়ে থাকে আর আমি কাজ সেরে দরজা খোলার সাথে সাথেই হিহি করে হেসে ওঠে।

 রাতে ঘুমানোর সময় শ্রাবন্তী কথা বলতেই থাকে, থামে না।
: আব্বু আমি ক্যামনে বড় হবো?
: তুমি আগে স্কুলে যাবে, পড়ালেখা করবে তারপর বড় হবে।
: আমাকে আরো বই কিনে দিবা। আমি সবগুলো মহিষ, ভেড়া, বাঘ, সিংহ, ঈগল পাখি, বাবুই পাখি সব পড়ে ফেলেছি। আমার ভাল আরো একটা ব্যাগ লাগবে। আমার ছড়ার বই লাগবে। আচ্ছা আব্বু তুমি একটা ছড়া বল না!
 আমি বলি, “ওখানে কেরে?”
: আমি খোকা
: মাথায় কিরে?
: আমের ঝাঁকা,
: খাসনে কেনরে?
: দাঁতে পোঁকা।
 এভাবে আমাকে অনেক গুলো ছড়া বলতে হয়। আমি প্রথম লাইন বলি আর শ্রাবন্তী পরের লাইনটি বলে। কোন ছড়াই একা সম্পূর্ণটা  বলতে পারে না।
 এর পর শুরু হয় গান। আমিতো গান জানি না, তবুও গাইতে হবে, তানা হলে তো উপায় নাই। কিন্তু আমি একটা গান শুরু করলেই বলে, ওটা না সেইটা। অন্যটা শুরু করলে আবার বলে ওটা না, ওটা না সেইটা। কিন্তু কোন গানটাযে সে শুনতে চায় তা জানতে অনেক সময় লেগে যায়।

 কিছুক্ষণ পরে বলে, আব্বু আমাকে স্কুলে নিয়ে যাবা।
: আচ্ছা নিয়ে যাবো, এখন রাত হয়েছে, রাতে মানুষ ঘুমায়, ঘুমিয়ে থাকো আম্মু।
: আচ্ছা আব্বু পাখিরা রাতে ঘুমায় না? কার কাছে ঘুমায়, ওর আব্বু আম্মুর কাছে?
: হ্যাঁ।
: আব্বু সকালে আমাকে স্কুলে যেতে হবে। স্কুলে ম্যাডাম পড়াবে ক-তে কলম, খ-তে খরগোশ, আর আমি পড়ব।
: আচ্ছা, ঠিক আছে আম্মু, তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাবো।

কিছুদিন যাবৎ স্কুলে যাবে বলে বায়না ধরছে।

 কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, আবার বলে আচ্ছা আব্বু, তারপর কি করব, বল?
: তুমি বড় হয়ে যাবা।
: বড় হয়ে  কি হবো? ….....আব্বু আব্বু আমি পুলিশ হবো, রাস্তার পাশের সব দোকান সরিয়ে দিবো, গাড়ি বন্ধ করে দিবো, মানুষদের বলব এখান থেকে সরে যান, মানুষ আমাকে ভ....য় পাবে। কেউ দুষ্টুমি করলে লাঠি দিয়ে পিটুনি দিবো, ধরে থানায় নিয়ে যাব, আচ্ছা আব্বু থানায় নিয়ে কি করব?
: দুষ্ট লোকদের থানায় নিয়ে আটকিয়ে রাখবা।
: আমার নাহিদ ভাইকে কেউ মারলে থানায় নিয়ে আটিকিয়ে রাখব।

 একটু পরে আবার কথা বলতে শুরু করে। আচ্ছা আব্বু আমি বড় হয়ে আর কি হবো? ডাক্তার খালামনি হবো?
: হ্যাঁ আম্মু, আল্লাহ চাইলে তুমি ডাক্তার হতে পারবা।
: আমি ডাক্তার হব। …... মানুষের অসুখ হলে মুখ হাঁ করতে বলবো, মুখের মধ্যে ছোট লাইট দিয়ে দেখবো, জিহ্বার নিচে কাঁচের কাঠি ঢুকিয়ে দেখব জ্বর আছে নাকি? পেটে জোরে জোরে চাপ দিয়ে বলব এখানে ব্যাথা করে?..... একটা মেশিন আছে না আব্বু, ওটা কানে দিয়ে তারের মাথায় যেটা আছে না ওটা বুকের উপর চেপে চেপে দেখব কি অসুখ হয়েছে।....... অসুখ হলে কাগজে ওষুধ লিখে দিব, তেঁতো ওধুষের নাম লিখব না, মিষ্টি ওষুধের নাম লিখব। আর বলব, ওষুধ লিখে দিলাম, দোকানে টাকা দিয়ে কিনবেন। সকাল বিকাল খাবেন অসুখ ভাল হয়ে যাবে। …. বেশী অসুখ হলে সুই দিয়ে হাত ফুঁটো করে দিতে হবে, একটা তার দিয়ে জোড়া দিয়ে উপরে একটা ওষুধের ব্যাগ ঝুলিয়ে দিব। বলব ভয় পাবানা, বেশি ব্যাথা দিব না, অসুখ সেরে যাবে। …....... আর কখনো চিপস্ খাবা না, চকলেট খাবা না। আপেল খাবা, দুধ খাবা, শিং মাছ খাবা, মুরগির মাংস খাবা, অসুখ হবে না।

 রাত ১২টা বেঁজে যায়, আমার চোখে ঘুম আসে, কিন্তু শ্রাবন্তী কথা বলতেই থাকে।
: আব্বু আমি বড় হয়ে অফিসে কাজ করবো, কাজ করে মেশিনে কার্ড দিয়ে টাকা নিতে পারবো। আমি তোমার জন্য বাজারে যাবো, ইলিশ মাছ কিনব, মাংস কিনব, শাক কিনব, সবকিছুই কিনব।
: আচ্ছা কিনে দিয়ো আম্মু।
: আব্বু তোমাকে আমি মার্কেটে নিয়ে যাব। জামা, জুতো কিনে দিবো। চেয়ারে বসবা, ভাজা মাংস কিনে দিবো, তুমি খাবা আর আমিও খাবো।
: তোমার আম্মুকে সাথে নিবা না?
: আম্মু একা একা ঝাল ফুসকা কিনে খা....য়। আমাকে দেয় না। অনেক ঝাল। আব্বু তুমি আমাকে মিষ্টি ফুসকা আর মিষ্টি চটপটি কিনে দিবা।
: আচ্ছা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

: আব্বু তোমাকে আমি বই মেলায় নিয়ে যাবো। মোটা মোটা বই কিনে দিবো। বইমেলায় ছবি তুলে দিবো। আমাকে একটা বড় মোবাইল কিনে দিও। বই কেনার পর চেয়ারে বসবা। তোমাকে পিঠা কিনে দিবো, হাঁসের মাংস কিনে দিবো, রুটি দিয়ে খাবা।

 আমার একটু তন্দ্রা লেগে আসছিল। শ্রাবন্তী বিরক্ত বোধ করল।
: এই আব্বু, আব্বু, কথা বল, আমি আর কি করবো?
: তোমার দাদুকে কি দিবা?
: দাদুকে যাদুঘরে নিয়ে যাবো। বলব, দাদু এগুলা কেনা যাবে না, হাত দেয়াও যাবে না, শুধু দেখা যাবে। যাদুঘরের বাঘ দেখলে দাদু ভয় পাইতে পারে। বলব, দাদু ওগুলো মরা বাঘ, কামড়াতে পারবে না, ভয় পাবা না।

: তোমার দাদুকে আর কোথায় নিয়ে যাবা আম্মু?
: দাদুকে শিশুপার্কে নিয়ে যাবো। রেল গাড়ীতে ওঠাবো। কাঠের ঘোড়ায় চড়াবো, ঘোড়াগুলো ঘুরতে শুরু করবে আর গান হবে। কি গান হবে বলনা আব্বু?
: একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাবো, নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাবো।
  শ্রাবন্তী গান শুনে কল্পনায় শিশুপার্কে চলে যায়, গানের তালে তালে হাত তালি দেয় আর মাথা দোলায়।
: আব্বু শুনো, দাদুকে চিড়িয়াখানায়ও নিয়ে যাবো। বাঘ দেখাব, হাতি দেখাব, বানর দেখাব। দাদুকে বলব ভয় পাবানা, আমি আছি না!

 আমি বললাম আম্মু তুমি কেমন অফিসে কাজ করতে চাও?
: আমি কাজ করতে চাই “চল্ চল‌্ চল‌্” অফিসে। বলনা আব্বু চল্ চল্ চল্ ।
: চল্ চল্ চল্; চল্ চল্ চল্; উর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণী তল, অরুণ প্রাতের তরুণ দল চলরে চলরে চল।
 আমি গানটি গাইতে থাকলে শ্রাবন্তী খুবই মজা পায়, আর হাত তালি দেয়।
: আব্বু আমি অফিসার হবো, হাতে পিস্তল থাকবে। আব্বু আমাকে নতুন একটা পিস্তল কিনে দিও। আমার পিস্তল গুলো পুরান হয়ে গেছে।
: বললাম তোমার অফিস থেকেই তোমাকে ভাল পিস্তল দিবে।
: আমি সবাইকে ভয় দেখাব। বলব, লাইনে দাড়াও, সোজা হও, আরামে দাড়াও। …........ এবার ডানে ঘুরো, লেফট রাইট, লেফট রাইট...............
 একটু পর পর লেফট রাইট শব্দ শোনা যায়। এক সময় আর শব্দ পাওয়া যায় না। বুঝতে পারলাম ঘুমিয়ে পড়েছে এবার আমার চোখও বন্ধ করা যায়।




আজকাল শ্রাবন্তী আমাকে বলছে, আব্বু আমাকে একটা ভাল আম্মু কিনে দিবা। নতুন আম্মু আমাকে কোলে নিবে, স্কুলে নিয়ে যাবে। শয়তানি করবে না। তোমার সাথে ঝগড়া করবে না। নতুন আম্মুকে বলে দিব, সে মারুফ কাকার সাথে মারামারি করবে না, কাপড় খুলে আর শয়তানি করবে না। নতুন আম্মু ভাল হবে। সে তোমার আর আমার সাথে থাকবে, মারুফ কাকার সাথে থাকবে না।

শ্রাবন্তীর জন্মদাত্রী মা এখন অন্যকোথাও আছে, কোথায় তা আমি জানি না। এখন আমার মেয়ের হৃদয়ের "আম্মু"র তৃষ্ণাটা মিটানোর জন্য সে একটা নতুন আম্মুর স্বপ্ন দেখছে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩৩১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৬/০৫/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • খুব ভাল লিখছেন । একটা বাচ্চার স্বপ্ন-গাঁথাকে নিয়ে বাবা দিশেহারা । নতুন গল্প নতুন আঙ্গিকে আবার পরিবেশন করবেন বলে আশা রাখছি ।
  • ফাহিম খান ২৮/০৫/২০১৬
    ভাষাশৈলী চমৎকার
  • পরশ ২০/০৫/২০১৬
    সুন্দর
  • পরশ ১৯/০৫/২০১৬
    অসাধারন
  • অঙ্কুর মজুমদার ১৭/০৫/২০১৬
    সুন্দর
 
Quantcast