আতঙ্ক
অনেকক্ষণ যাবত লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। কেমন যেন ভাবলেস চেহারা।সেই তখন থেকে একের পর এক সিগারেট টেনেই যাচ্ছেন। আর কিছুক্ষণ পরপর বলছেন - " ধোয়ায় সমস্যা হচ্ছে না তো?"
- জ্বী না।
- তা কিছু মনে করতে পারলেন? মানে আপনার, সমস্যা কি এখন খুলে বলতে পারবেন?
- জ্বী, মানে না। আর একটু সময় লাগবে।
- আচ্ছা। নিন। যত খুশি সময় নিন।যত খুশি সময় নিন।
এই বলে আবার সিগারেট ধরালেন তিনি। লোকটা হয়ত কফি খান না। অথবা হতে পারে এখন খেতে চাইছেন না। সেই তখন থেকে কফির মগ তার জায়গাতেই পরে আছে।
আমি এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। এখন হয়ত বুঝিয়ে বলতে পারবো। ঘরে এসি থাকা সত্ত্বেও ঘেমে জামা পিঠের সাথে লেগে গেছে। তিনি চশমা টা খুলতে খুলতে বললেন, শুরু করুন তাহলে।
- আসলে ঘুমুতে ভয় পাই।
লোকটি হাসছে। হাসিটা সুন্দর। ঠোট দুটো খানিক টা বাকা করে হাসে। গালে টোল পরে।যার ফলে ব্যাঙ্গাচি ভাব টা বোঝা যায় না।
- তা ঘুমুতে ভয় পান কেন?
- জানি না।তবে ভয় পাই।উদ্ভট সব স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এগুলা উদ্ভট নয়।
- ঠিক বুঝলাম না। স্বপ্ন দেখে ভয়? উদ্ভট আবার উদ্ভট না? ইন্টারেস্টিং তো!
- সেটাই।
- স্বপ্ন গুলো তো তাহলে যুক্তিহীন অবশ্যই।
- জ্বী না। আগে মনে হত যুক্তি নেই। এখন মনে হয় যথেষ্ট যুক্তি নির্ভর।
- তা, স্বপ্নের কিছু কি মনে আছে? বলতে পারবেন?
- হুম।
- তাহলে বলুন আপনার স্বপ্নের গল্প। ডিটেইলস ভাল ভাবে বলুন।
- ডিটেইলস বলার মত কিছু নয়। তবে প্রতিটা স্বপ্নেরই মূল একটা জিনিস থাকে। সেটাই ভাবায়।
- কি সে জিনিস?
-মৃত্যু। প্রতিটা স্বপ্নই মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত।
- What!!!! হা.. হা...হা..। মৃত্যু? তা কে মারা যায় শুনি। আপনি? নাকি অন্য কেউ!
-অন্য কেউ।
-হুম, চিন্তার কোন কারন নেই। আপনি মানসিক ভাবে এখন একটু দুর্বল। প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। এমন কিছু না। তখন দেখবেন, মৃত্যুর বদলে ঘরে ঘরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হা..হা..হা।।
আমি চুপ করে আছি।সাইক্রিয়াটিস্ট রা এরকম হয় বলে জানতাম না। লোকটা অন্যরকম। তবে, মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে।বমি আসছে।
-সমস্যা কবে থেকে?
- মাস তিনেক।
- ভয়ের কিছু কি আদৌ আছে? কমন ব্যাপার। আপনি সারাদিন হয়ত এসব নিয়েই চিন্তা করেন।অথবা খুব বেশি সিনেমা দেখেন। আবারভ হতে পারে আপনার প্রিয় মানুষদের খুব ভালবাসেন। যার দরুন আপনি চান না তারা অকালে কেউ চলে যাক। তখন আপনার অবচেতন মন এসকল দুর্বলতা গুলোকে কিছু ছকে বেধে ফেলে। যার ফলে মস্তিষ্ক জিনিসটি নিয়ে অবসরে কাজ করে এবং আপনি স্বপ্নে মৃত্যু দেখেন।
- ঘটনা সেরকম নয়। আর স্বপ্নে আমার প্রিয় মানুষ গুলোকে দেখি না।আমার সব থেকে অপ্রিয় কিছু মানুষগুলোকেই স্বপ্নে দেখি।
- তা তো ভালই। বাস্তবে না মেরে স্বপ্নে মারছেন। ভয়ের কি আছে? তাছাড়া জানেন তো দুর্বল মানুষেরা সচারচর তাই করে। শক্তিধরের সামনে ভক্তি আর পিছে কটুক্তি। হা..হা...হা।
আমি রেগে যাচ্ছি। প্রচুর ব্যথা করছে মাথায়। মনে হচ্ছে মাথার এপাশ থেকে ওপাশ ব্রেইন ভেদ করে তীক্ষ্ণ সুঁই ছুটে চলছে ক্রমাগত। তবুও নিজেকে সংযত করলাম।ঠান্ডা গলায় বললাম
- ভয়ের কারন আছে। কারন আমি যাদের স্বপ্নে দেখি, বাস্তবেও তাদের মৃত্যু ঘটে।
লোকটা চুপ হয়ে যায়। হয়ত এধরণের কথার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। একটু হাসি মুখে, টেবিলে দুহাত দিয়ে ঝুকে বসলেন।
-" সত্যিই কি এরকম ঘটেছে? " বলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভ্রু দুটো কুচকালেন। তবুও ঠোটের কোণে হাসি খেলা করছে।
- হয়েছে।
- তা এ পর্যন্ত কয়জন কে মারলেন? আপনি তো ভাই ড্রিমকিলার। হা হা হা।
কথা গায়ে মাখালাম না। এনার ডাক্তার হওয়ার যোগ্যতা নেই।সামান্য সৌজন্যতাবোধ ও নেই।আমি বললাম।
- চারজন।
সো, কিভাবে হল। কারা ছিল? খুলে বলুন তো মশায়।
আমি মাথা ঠান্ডা রাখলাম। অপদার্থ টা কিছুই বিশ্বাস করছে না। তাও কেন জানি একে বলতে ইচ্ছে করছে। এমনো তো হতে পারে, কোন সমাধান দিতে পারলো লোকটি। ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকিয়ে নম্রভাবে শুরু করলাম....
- প্রথম জনার নাম সাদেক। একসময় আমার প্রাইভেট টিউটির ছিলেন। ছোট বেলায় বিনা কারনে খুব মারতেন।শিখাতেন না প্রায় কিছুই। পান থেকে চুন খসলেই মার। তো সেদিনের কথা। কেন জানি তার নির্দয় অত্যাচারের কথা খুব মনে পড়লো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।ইচ্ছে করছিল যদি হাতির পায়ের নিচে ফেলে মারতে পারতাম!! সেদিন রাতেই উদ্ভট এক স্বপ্ন দেখি। স্যারের মাথায় একটা হাতি পা দিয়ে যাতা দিচ্ছে। স্যার চিৎকার করছেন খুব। আস্তে আস্তে মাথাটা মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। লাল হলুদ রং এ চারপাশ একাকার।তার পরের দিনই আমার এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলে স্যার মারা গেছেন।
- হাতির নিচে পরে?
-উহু। ট্রাকে কাঁটা পরে। চাকা পুরো মাথার উপর দিয়ে যায়।
লোকটা ঘটনা শুনলেন। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন - আপনি কি বুঝতে পারছেন যে, ঘটনা টা কাঁকতালিও? আর অবশ্যই একজন মানসিক রোগীর ক্ষেত্রেই এধরনের চিন্তা করা স্বাভাবিক।
- শুরুতে আমিও তাই ভাবতাম।তবে এর পরের কয়েক টা ঘটনার পর আমি বুঝতে পারি। এগুলো ভুল নয়।
এবার তিনি স্বাভাবিক ভাবে বসলেন।কিছুক্ষণ নীরবতা। এখন বড্ড শীত করছে।ঘাম শুকিয়ে গেছে।বলতেও আর সংকোচ বোধ হচ্ছে না।বরং ভালই লাগছে আমার।এতদিন পর কাউকে তো অন্তত বলতে পারছি।বিশ্বাস করুক আর না করুক। তাছাড়া এনাকে দোষ দিয়েই বা লাভ কি! এ ধরণের ঘটনা অন্যকেউ শুনলেও হয়ত বিশ্বাস করবে না।
দরজা ঠেলে নীল শার্ট পরা একজন লোক ঢুকলো। হাতে ট্রে।সেখানে দুটি কফির মগ। একটা মগ ঐ মোটা লোকটার সামনে রাখলেন।আরেকটা আমার। এখন অবশ্য খেতে ইচ্ছে করছে না। থাকুক পরে। নীলশার্ট যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই বেড়িয়ে গেল।
কফির মগে চুমুক দিয়ে লোকটি বললেন,
- তো, আপনি বলতে চাইছেন, আপনার স্বপ্ন গুলো মানুষ খেঁকো?
-জ্বী।
-এর পরের গুলিও কি একই রকম?
-জ্বী।
- হাতির নিচে পড়েছে?
-না, তবে অন্যকিছুর।
-বলুন।শুনি। থামবেন না। একটানা বলে ফেলুম।
- আচ্ছা।
তিনি আবার সিগারেট ধরালেন। এবার সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন।হয়ত বুঝতে চাইছেন যে কথা গুলো বানোয়াট কি না! আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলাম।
- পরের স্বপ্ন টি দেখি দুপুর বেলায়। অফিস থেকে সেদিন তাড়াতাড়ি ফিরে ছিলাম।আমার মেয়েটার পরীক্ষার ফিস এর জন্য টাকা দরকার। আমার হাতেও কিছু ছিল না। বসের কাছে দরখাস্ত করেছিলাম, যদি ফান্ড থেকে কিছু পাওয়া যায়! বস টাকা তো দিলেন না, বরং রাগারাগি করে কাজে যেতে বললেন। আমি বাড়ি ফিরেই সোফায় এলিয়ে পরি। চিন্তায় মাথা শেষ। এক সময় প্রচুর রাগ উঠে জাকির সাহেবের ওপর। এত টাকা! তাও কি সামান্য কটা টাকা দেয়া যায় নি!! ইচ্ছে করছিল যদি পুড়িয়ে মারতে পারতাম! কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের অবস্থাতেই দেখি সারা অফিসে আগুন।সবাই ছুটে পালাচ্ছে। জাকির সাহেবে রুম থেকে বেরুতে পারছেন না। পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন।
রাতে যখন টিভিতে খবর দেখছিলাম তখন হঠাৎ একটা জায়গায় আটকে গেলাম। ছোট্ট হেডলাইন দেখে। "বিশাল শিল্পপতি জাকির সাহেব গাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন"।
- প্লিজ চুপ করুন। আপনিকি সত্যি এমন টা দেখেছেন?নাকি মিডিয়ার চোখে পড়তে চাইছেন?
- আমার কখনই খ্যাতির লোভ ছিল না।আমি এ সমস্যার থেকে পরিত্রাণ চাই।
- কাল রাতে দেখেছেন?
-না।
- পরশু কি কিছু? বা এ সপ্তাহে?
- জ্বী না।দেখিনি।
-হুম। শুনুন রকিব সাহেব। আমি কিছু কথা বলছি। মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। ওকে?
-হুম।
-যেহেতু এখন আপনি কিছু দেখছেন না, সুতরাং ভেবে নিন সম্পূর্ন ঘটনাটাই কাঁকতালিও। অথবা এমন হতে পারে, ঘটনা ঘটার পর এধরনের স্বপ্ন আপনি দেখছেন।যা আপনার কাছে মনে হচ্ছে আপনি পূর্বেই এমন টা দেখেছেন। যেহেতু মৃত রা সকলেই আপনার অপ্রিয় মানুষ ছিল,তাই আপনার মস্তিষ্ক তা অন্যভাবে সাজিয়ে দিচ্ছে। যার কারনে, আপনি বিশ্বাস করছেন যে আপনার কাছে সুপার নেচারাল টাইপ কিছু পাওয়ার আছে।মানে, আপনি মানুষ খেঁকো স্বপ্ন দেখেন।
আপনি মানসিক ভাবে অসুস্থ রকিব সাহেব। আপনি কি আসলেও সুস্থ্য হতে চান?
-জ্বী। চাই।
- তাহলে আপনাকে যা বলি তাই করুন। আপনি মনে প্রানে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করুন যে, সকল কিছুই স্বাভাবিক আছে। আপনি অসুস্থ্য। আপনাকে সুস্থ্য হতে হবে।
- জ্বী।
- আর, সর্বপ্রথম যেটা জরুরী, তা হল ভাল ঘুম। ভাল ঘুম না হওয়ায় আপনি এধরনের সমস্যা বা উদ্ভট স্বপ্ন দেখছেন।সো আমি আপনাকে কিছু নার্ভ ঠান্ডা করার ওষুধ দিচ্ছি। ঘুমানোর আগে নিয়মিত এগুলো খেয়ে ঘুমাবেন। অকে?
- ঠিকাছে।
-আর, সামনের সপ্তাহে আবার আসবেন। চিন্তার কিছু নেই। আপনি এখন যেতে পারেন।
- আচ্ছা। স্লামালেকুম।
দরজা ঠেলে চলে এলাম আমি। সিড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে বেড়িয়ে পরলাম রাস্তায়। এখানে আর থাকা যাবে না।বাসায় যেতেই হবে। অফিসে ফোন দিয়ে কয়েকদিনের ছুটি চাওয়া যায়। না দিলেও আমার এখন দরকার। কারন যা হতে চলছে তা কোন ভাবেই হতে দেয়া যাবে না। অন্তত আমার মেয়ের জন্য তো নয়ই।
আমি রিক্সা ঠিক করলাম। সারাটাক্ষন কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে আমার।ডাক্তার সাহেব কে বলা হয় নি। কাল রাতেও স্বপ্ন দেখেছিলাম।আমার স্ত্রী রাবেয়া মারা গেছে। দুটি অবয়ব এক রুমে তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে।স্বপ্ন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছিল। আর তার জন্যই এখানে আসা।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোন আসলো। স্ক্রিনে নাম ভাসছে। ফোনটা রিসিভ করার সাহস পাচ্ছি না। রিংটন টাও বড্ড বুকে লাগছে। তবুও বেজে চলছে তা নিজের মতই। আর তিন অক্ষরের নামটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
- জ্বী না।
- তা কিছু মনে করতে পারলেন? মানে আপনার, সমস্যা কি এখন খুলে বলতে পারবেন?
- জ্বী, মানে না। আর একটু সময় লাগবে।
- আচ্ছা। নিন। যত খুশি সময় নিন।যত খুশি সময় নিন।
এই বলে আবার সিগারেট ধরালেন তিনি। লোকটা হয়ত কফি খান না। অথবা হতে পারে এখন খেতে চাইছেন না। সেই তখন থেকে কফির মগ তার জায়গাতেই পরে আছে।
আমি এবার একটু নড়েচড়ে বসলাম। এখন হয়ত বুঝিয়ে বলতে পারবো। ঘরে এসি থাকা সত্ত্বেও ঘেমে জামা পিঠের সাথে লেগে গেছে। তিনি চশমা টা খুলতে খুলতে বললেন, শুরু করুন তাহলে।
- আসলে ঘুমুতে ভয় পাই।
লোকটি হাসছে। হাসিটা সুন্দর। ঠোট দুটো খানিক টা বাকা করে হাসে। গালে টোল পরে।যার ফলে ব্যাঙ্গাচি ভাব টা বোঝা যায় না।
- তা ঘুমুতে ভয় পান কেন?
- জানি না।তবে ভয় পাই।উদ্ভট সব স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এগুলা উদ্ভট নয়।
- ঠিক বুঝলাম না। স্বপ্ন দেখে ভয়? উদ্ভট আবার উদ্ভট না? ইন্টারেস্টিং তো!
- সেটাই।
- স্বপ্ন গুলো তো তাহলে যুক্তিহীন অবশ্যই।
- জ্বী না। আগে মনে হত যুক্তি নেই। এখন মনে হয় যথেষ্ট যুক্তি নির্ভর।
- তা, স্বপ্নের কিছু কি মনে আছে? বলতে পারবেন?
- হুম।
- তাহলে বলুন আপনার স্বপ্নের গল্প। ডিটেইলস ভাল ভাবে বলুন।
- ডিটেইলস বলার মত কিছু নয়। তবে প্রতিটা স্বপ্নেরই মূল একটা জিনিস থাকে। সেটাই ভাবায়।
- কি সে জিনিস?
-মৃত্যু। প্রতিটা স্বপ্নই মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত।
- What!!!! হা.. হা...হা..। মৃত্যু? তা কে মারা যায় শুনি। আপনি? নাকি অন্য কেউ!
-অন্য কেউ।
-হুম, চিন্তার কোন কারন নেই। আপনি মানসিক ভাবে এখন একটু দুর্বল। প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। এমন কিছু না। তখন দেখবেন, মৃত্যুর বদলে ঘরে ঘরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হা..হা..হা।।
আমি চুপ করে আছি।সাইক্রিয়াটিস্ট রা এরকম হয় বলে জানতাম না। লোকটা অন্যরকম। তবে, মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে।বমি আসছে।
-সমস্যা কবে থেকে?
- মাস তিনেক।
- ভয়ের কিছু কি আদৌ আছে? কমন ব্যাপার। আপনি সারাদিন হয়ত এসব নিয়েই চিন্তা করেন।অথবা খুব বেশি সিনেমা দেখেন। আবারভ হতে পারে আপনার প্রিয় মানুষদের খুব ভালবাসেন। যার দরুন আপনি চান না তারা অকালে কেউ চলে যাক। তখন আপনার অবচেতন মন এসকল দুর্বলতা গুলোকে কিছু ছকে বেধে ফেলে। যার ফলে মস্তিষ্ক জিনিসটি নিয়ে অবসরে কাজ করে এবং আপনি স্বপ্নে মৃত্যু দেখেন।
- ঘটনা সেরকম নয়। আর স্বপ্নে আমার প্রিয় মানুষ গুলোকে দেখি না।আমার সব থেকে অপ্রিয় কিছু মানুষগুলোকেই স্বপ্নে দেখি।
- তা তো ভালই। বাস্তবে না মেরে স্বপ্নে মারছেন। ভয়ের কি আছে? তাছাড়া জানেন তো দুর্বল মানুষেরা সচারচর তাই করে। শক্তিধরের সামনে ভক্তি আর পিছে কটুক্তি। হা..হা...হা।
আমি রেগে যাচ্ছি। প্রচুর ব্যথা করছে মাথায়। মনে হচ্ছে মাথার এপাশ থেকে ওপাশ ব্রেইন ভেদ করে তীক্ষ্ণ সুঁই ছুটে চলছে ক্রমাগত। তবুও নিজেকে সংযত করলাম।ঠান্ডা গলায় বললাম
- ভয়ের কারন আছে। কারন আমি যাদের স্বপ্নে দেখি, বাস্তবেও তাদের মৃত্যু ঘটে।
লোকটা চুপ হয়ে যায়। হয়ত এধরণের কথার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। একটু হাসি মুখে, টেবিলে দুহাত দিয়ে ঝুকে বসলেন।
-" সত্যিই কি এরকম ঘটেছে? " বলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভ্রু দুটো কুচকালেন। তবুও ঠোটের কোণে হাসি খেলা করছে।
- হয়েছে।
- তা এ পর্যন্ত কয়জন কে মারলেন? আপনি তো ভাই ড্রিমকিলার। হা হা হা।
কথা গায়ে মাখালাম না। এনার ডাক্তার হওয়ার যোগ্যতা নেই।সামান্য সৌজন্যতাবোধ ও নেই।আমি বললাম।
- চারজন।
সো, কিভাবে হল। কারা ছিল? খুলে বলুন তো মশায়।
আমি মাথা ঠান্ডা রাখলাম। অপদার্থ টা কিছুই বিশ্বাস করছে না। তাও কেন জানি একে বলতে ইচ্ছে করছে। এমনো তো হতে পারে, কোন সমাধান দিতে পারলো লোকটি। ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকিয়ে নম্রভাবে শুরু করলাম....
- প্রথম জনার নাম সাদেক। একসময় আমার প্রাইভেট টিউটির ছিলেন। ছোট বেলায় বিনা কারনে খুব মারতেন।শিখাতেন না প্রায় কিছুই। পান থেকে চুন খসলেই মার। তো সেদিনের কথা। কেন জানি তার নির্দয় অত্যাচারের কথা খুব মনে পড়লো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।ইচ্ছে করছিল যদি হাতির পায়ের নিচে ফেলে মারতে পারতাম!! সেদিন রাতেই উদ্ভট এক স্বপ্ন দেখি। স্যারের মাথায় একটা হাতি পা দিয়ে যাতা দিচ্ছে। স্যার চিৎকার করছেন খুব। আস্তে আস্তে মাথাটা মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। লাল হলুদ রং এ চারপাশ একাকার।তার পরের দিনই আমার এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলে স্যার মারা গেছেন।
- হাতির নিচে পরে?
-উহু। ট্রাকে কাঁটা পরে। চাকা পুরো মাথার উপর দিয়ে যায়।
লোকটা ঘটনা শুনলেন। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন - আপনি কি বুঝতে পারছেন যে, ঘটনা টা কাঁকতালিও? আর অবশ্যই একজন মানসিক রোগীর ক্ষেত্রেই এধরনের চিন্তা করা স্বাভাবিক।
- শুরুতে আমিও তাই ভাবতাম।তবে এর পরের কয়েক টা ঘটনার পর আমি বুঝতে পারি। এগুলো ভুল নয়।
এবার তিনি স্বাভাবিক ভাবে বসলেন।কিছুক্ষণ নীরবতা। এখন বড্ড শীত করছে।ঘাম শুকিয়ে গেছে।বলতেও আর সংকোচ বোধ হচ্ছে না।বরং ভালই লাগছে আমার।এতদিন পর কাউকে তো অন্তত বলতে পারছি।বিশ্বাস করুক আর না করুক। তাছাড়া এনাকে দোষ দিয়েই বা লাভ কি! এ ধরণের ঘটনা অন্যকেউ শুনলেও হয়ত বিশ্বাস করবে না।
দরজা ঠেলে নীল শার্ট পরা একজন লোক ঢুকলো। হাতে ট্রে।সেখানে দুটি কফির মগ। একটা মগ ঐ মোটা লোকটার সামনে রাখলেন।আরেকটা আমার। এখন অবশ্য খেতে ইচ্ছে করছে না। থাকুক পরে। নীলশার্ট যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই বেড়িয়ে গেল।
কফির মগে চুমুক দিয়ে লোকটি বললেন,
- তো, আপনি বলতে চাইছেন, আপনার স্বপ্ন গুলো মানুষ খেঁকো?
-জ্বী।
-এর পরের গুলিও কি একই রকম?
-জ্বী।
- হাতির নিচে পড়েছে?
-না, তবে অন্যকিছুর।
-বলুন।শুনি। থামবেন না। একটানা বলে ফেলুম।
- আচ্ছা।
তিনি আবার সিগারেট ধরালেন। এবার সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন।হয়ত বুঝতে চাইছেন যে কথা গুলো বানোয়াট কি না! আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলাম।
- পরের স্বপ্ন টি দেখি দুপুর বেলায়। অফিস থেকে সেদিন তাড়াতাড়ি ফিরে ছিলাম।আমার মেয়েটার পরীক্ষার ফিস এর জন্য টাকা দরকার। আমার হাতেও কিছু ছিল না। বসের কাছে দরখাস্ত করেছিলাম, যদি ফান্ড থেকে কিছু পাওয়া যায়! বস টাকা তো দিলেন না, বরং রাগারাগি করে কাজে যেতে বললেন। আমি বাড়ি ফিরেই সোফায় এলিয়ে পরি। চিন্তায় মাথা শেষ। এক সময় প্রচুর রাগ উঠে জাকির সাহেবের ওপর। এত টাকা! তাও কি সামান্য কটা টাকা দেয়া যায় নি!! ইচ্ছে করছিল যদি পুড়িয়ে মারতে পারতাম! কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের অবস্থাতেই দেখি সারা অফিসে আগুন।সবাই ছুটে পালাচ্ছে। জাকির সাহেবে রুম থেকে বেরুতে পারছেন না। পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন।
রাতে যখন টিভিতে খবর দেখছিলাম তখন হঠাৎ একটা জায়গায় আটকে গেলাম। ছোট্ট হেডলাইন দেখে। "বিশাল শিল্পপতি জাকির সাহেব গাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন"।
- প্লিজ চুপ করুন। আপনিকি সত্যি এমন টা দেখেছেন?নাকি মিডিয়ার চোখে পড়তে চাইছেন?
- আমার কখনই খ্যাতির লোভ ছিল না।আমি এ সমস্যার থেকে পরিত্রাণ চাই।
- কাল রাতে দেখেছেন?
-না।
- পরশু কি কিছু? বা এ সপ্তাহে?
- জ্বী না।দেখিনি।
-হুম। শুনুন রকিব সাহেব। আমি কিছু কথা বলছি। মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। ওকে?
-হুম।
-যেহেতু এখন আপনি কিছু দেখছেন না, সুতরাং ভেবে নিন সম্পূর্ন ঘটনাটাই কাঁকতালিও। অথবা এমন হতে পারে, ঘটনা ঘটার পর এধরনের স্বপ্ন আপনি দেখছেন।যা আপনার কাছে মনে হচ্ছে আপনি পূর্বেই এমন টা দেখেছেন। যেহেতু মৃত রা সকলেই আপনার অপ্রিয় মানুষ ছিল,তাই আপনার মস্তিষ্ক তা অন্যভাবে সাজিয়ে দিচ্ছে। যার কারনে, আপনি বিশ্বাস করছেন যে আপনার কাছে সুপার নেচারাল টাইপ কিছু পাওয়ার আছে।মানে, আপনি মানুষ খেঁকো স্বপ্ন দেখেন।
আপনি মানসিক ভাবে অসুস্থ রকিব সাহেব। আপনি কি আসলেও সুস্থ্য হতে চান?
-জ্বী। চাই।
- তাহলে আপনাকে যা বলি তাই করুন। আপনি মনে প্রানে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করুন যে, সকল কিছুই স্বাভাবিক আছে। আপনি অসুস্থ্য। আপনাকে সুস্থ্য হতে হবে।
- জ্বী।
- আর, সর্বপ্রথম যেটা জরুরী, তা হল ভাল ঘুম। ভাল ঘুম না হওয়ায় আপনি এধরনের সমস্যা বা উদ্ভট স্বপ্ন দেখছেন।সো আমি আপনাকে কিছু নার্ভ ঠান্ডা করার ওষুধ দিচ্ছি। ঘুমানোর আগে নিয়মিত এগুলো খেয়ে ঘুমাবেন। অকে?
- ঠিকাছে।
-আর, সামনের সপ্তাহে আবার আসবেন। চিন্তার কিছু নেই। আপনি এখন যেতে পারেন।
- আচ্ছা। স্লামালেকুম।
দরজা ঠেলে চলে এলাম আমি। সিড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে বেড়িয়ে পরলাম রাস্তায়। এখানে আর থাকা যাবে না।বাসায় যেতেই হবে। অফিসে ফোন দিয়ে কয়েকদিনের ছুটি চাওয়া যায়। না দিলেও আমার এখন দরকার। কারন যা হতে চলছে তা কোন ভাবেই হতে দেয়া যাবে না। অন্তত আমার মেয়ের জন্য তো নয়ই।
আমি রিক্সা ঠিক করলাম। সারাটাক্ষন কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে আমার।ডাক্তার সাহেব কে বলা হয় নি। কাল রাতেও স্বপ্ন দেখেছিলাম।আমার স্ত্রী রাবেয়া মারা গেছে। দুটি অবয়ব এক রুমে তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে।স্বপ্ন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছিল। আর তার জন্যই এখানে আসা।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোন আসলো। স্ক্রিনে নাম ভাসছে। ফোনটা রিসিভ করার সাহস পাচ্ছি না। রিংটন টাও বড্ড বুকে লাগছে। তবুও বেজে চলছে তা নিজের মতই। আর তিন অক্ষরের নামটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জয়শ্রী রায় মৈত্র ০২/১১/২০১৫গল্প ভালো । কিন্তু গল্পে স্ক্রিপ্ট রাইটিং-এর প্রভাবটা বেশী বলে মনে হচ্ছে ।
-
নীল অপরাজিতা ২৮/১০/২০১৫কাহিনি নতুন না হলেও ভাল লাগল ।
-
সমরেশ সুবোধ পড়্যা ২৮/১০/২০১৫বেশ ভালো লাগলো ।
-
শান্তনু ব্যানার্জ্জী ২৮/১০/২০১৫কাহিনীটী বেশ ভালো লাগল ।
-
দেবব্রত সান্যাল ২৬/১০/২০১৫সম্পাদনা করুন ভাই। লিখে তারপর নিজে পড়ুন একবার। তাছাড়া প্লটের সাথে আসরে প্রকাশিত আরেকটি গল্পের প্লটের খুব মিল