আধারের গল্প
বড্ড শীত শীত লাগছে ঘরটায়।মাথার উপরের ফ্যান টি উদ্ভট আওয়াজে ক্রমাগত ঘুরেই চলছে।চারপাশটাও ঘুমোট অন্ধকারে নিমজ্জিত। দেয়ালের এক কোণে থাকা ঝুলন্ত ডিম লাইট টি যেন আধারের তীব্রতাকে কঠিনভাবে জানান দিচ্ছে।
সেদিকে কারো ভুরুক্ষেপ নেই। মেঝেতে বসে থাকা কিছু অবয়বের দীর্ঘশ্বাস, এগুলোই এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে নিশ্চুপতাকে।
ঘরটা মোটামুটি বড়-সড়ই। সারা ঘরে কোন জানালা নেই।একটি মাত্র দরজা। যার ফলে বাহিরের কোন আলো প্রবেশ করে না বহুদিন।হঠাৎ, সকলেই নীরবতা ভেঙ্গে চমকে উঠলো। দরজার ওপাশে ক্যাটকেটে এক ধরনের শব্দ।কেউ হয়ত তালা খুলছে।সাথে একজন তরুণীর গোঙ্গানোর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। একসময় সকলের চোখ ধাধিয়ে দরজা খোলা হল।আকস্মিক আলোর প্রভাবে ঘরেই সকলেই ঢেকে ফেললো তাদের চোখ।ওদিকে রাশভারী মোটা মানুষটি তরুণীটিকে প্রায় ধাক্কা মেরেই ছুড়ে দিল অন্ধকুটিরে। মূহুর্তেই বিকট শব্দে আলো মিলিয়ে পুনরায় জন্ম দিল আধারের।
এতক্ষন পরে অবয়ব গুলোর মাঝে প্রান ফিরে এসেছে যেন।হয়ত এভাবেই মাঝে মাঝে প্রান আসা যাওয়ার খেলা দেখে তারা। কয়েক জোড়া কাঙ্ক্ষিত চোখ তাকিয়ে আছে তরুণীটির দিকে। মেয়েটি তখনো মুক্তির আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে চিৎকার ও দরজায় করাঘাতের মাধ্যমে। অবশ্য বাকি অবয়ব গুলো হাসছে।তারা জানে, এ চেষ্টার কোন ফলনেই। এটা অন্ধকুটির। এক সময় তীব্র চিৎকারও মিশে যাবে আধারের নিশ্চুপতায়।
শীত ভাবটা বেড়েছে।ডিম লাইটটার ঠিক নিচে মেয়েটা। এখন আর কাতরাচ্ছে না। জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে তার ছায়াটার দিকে। হঠাৎ কে যেন হাত রাখলো কাধে। মেয়েটা ধরফর করে উঠলো। কেঁকিয়ে বললো - " কে???? কেডা আপনে!!! আমি কই!!!?? আমারে এখানে আনছে ক্যান?"
ডিমের আলোয় অবয়ব টাকে দেখা গেল এবার।রুক্ষ তেলতেলে নারীর মুখ। ঠোটের মাঝে ভরসার হাসি পাতা। সে বলে উঠলো " ভয় পাইয়ো না গো বইন। ভয় পায়া লাভ নাই এইহানে..
- আপনেরা কেডা? আমারে ক্যান আনছে এইহানে? আমি বাড়িত যামু!! আমারে বাড়িত যাইতে দেন!!
এবার মহিলাটি, কন্ঠে হতাশার মায়াটান এনে বললো, -" চাইলেই কি আর যাইতে পারবা, বইন?আংগোরে দেখ। আমরাও এইহানে কতদিন ধইরা পইরা আছি। সবই কপাল গো বইন "
- আমারে বাড়িত নিয়া যান! আমি বাড়িত যামু!! " পুনরায় কান্নায় ভেঙ্গে পরে মেয়েটা।বুকের মাঝে কেমন যেন, বদ্ধ হৃদপিন্ডে তীক্ষ্ণ সুঁইয়ের আঘাত অনুভব করছে সে। মহিলাটি মাথায় হাত রাখলো তার। সঙ্গে সঙ্গে গলা জড়িয়ে ধরলো মেয়েটি। বাকি আরো জোড়া সাতেক চোখ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।কেউ হয়ত চোখ বুজে ফেলছে দীর্ঘশ্বাস।
আস্তে আস্তে তরুণীটি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো। কারন, সে বুঝে গেছে। এখান থেকে মুক্তির আর কোন পথ নেই।সে নারী পাচারকারীর খুব শক্ত এক চক্রের পাল্লায় পড়েছে।সব কিছু মেনে নিতেই হবে তার। এছাড়া আর উপায় কি!
তাছাড়া এখানকার বাকি সবার সাথেও একই ঘটনাই ঘটেছে।
সে আরো জানতে পারলো। এঘরের মত পাশাপাশি আরো অনেক ঘর রয়েছে।সেখানে রয়েছে আরো মানুষ। তাদের মাঝেও কেউ হয়ত তরুন ছাত্রী, কেউ বাড়ির ঝিঁ, আবার কেউ হয়ত সহজ সরল গৃহবধু। সকলেরই ভাগ্য আজ একই সুতোয় গেথে দিয়েছেন রহস্যময়ী ঈশ্বর।
কেউ জানে না। এখানে তারা কতক্ষণ থাকবে। জীবন টা কেমন যেন আতঙ্কজনক চলমান পথে ধাবিত হচ্ছে তাদের। সারা দিনে একবার দরজা খুলে শুধু কিছু শুকনো খাবার দেয়া হয়। মাঝে মাঝে মোটা কাপড় বাধা বিশাল দেহী কিছু মানুষ কাউকে এনে ফেলে যায়,আবার হয়ত কোন অভাগিনী কে ভাসিয়ে দেয় অজানার নাঁয়ে। এটাই এখন নিয়তি। সব সময় কিছু অদৃশ্য কাঁটার আঘাত সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে তাদের।
মেয়েটাকে ঘিরে সকলে বসে রয়েছে। ডিমের আলোয় তার মুখ দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো। নাক চোখ বড্ড ফোলা। মেয়েটার হয়ত কাঁজল দেয়ার অভ্যাস আছে। কাঁজলে সারামুখ লেপ্টে রয়েছে। হঠাৎ একজন বলে উঠলো - তোমারে কেমনে পাইলো বইন?
মেয়েটা চুপ।কিছুক্ষন পর আরেকজন ক্ষানিকটা ধাক্কা মেরেই বললো, -কও না!!! রাইত ডা পার করি গপ শুইনা! এবার মেয়েটি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো। সকলের দিকে বুলিয়ে নিল শ্রান্ত বিস্মিত চোখ। বাকি সবাই কি এক যেন আকাঙ্ক্ষা ও তৃষ্ণা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটি বলা শুরু করলো -
"আমি শিউলি। শিউলি রানী। গেরামে থাকি। চড়ডাঙ্গা গ্রাম। ঐখানে আমার বুবুর শ্বশুর বাড়ি। আব্বায় মরণের পর বুবুর বাড়িতই উঠি।আমারে ঐখানেরই এক কলেজে ভর্তি কইরা দেয় দুলাবাই।"
এই বলে শিউলি থেমে গেল
কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার শুরু করলো সে। "বইনের সংসারে ভাল লাগতো না।সারাক্ষণ কোন না কোন কাম করা লাগতোই। শরীল কুলাক আর না কুলাক। একদিকে কলেজ। আবার অন্য দিক বাড়ির কাইজ। পান থাইকা চুন খসলেই খোটা।এমন খোটা দিত যে বাঁচতেই ইচ্ছা করতো না।খুব ছুডো মনে হইতো নিজেরে।ভাবতাম! আব্বায় যদি না মরতো। যদি টেকা থাকতো। নইলে বড় ভাই রা যদি মায়ের লগে আমারেও পালতে চাইতো!!
খরচা বেশি লাগবো জন্যে বিয়াও দেয় নাই। সারাদিন কাম । কলেজে যতটুকু সময় থাকতাম খুব ভালা লাগতো। যাইহোক, এমনেই চলতাছিল জীবন।মাইনাই লইছিলাম ভাগ্যডারে।হঠাৎ একদিন কলেজের সামনের একখান দোকানে যাই। মদি ভাইয়ের দোকান। কলম কিনতে হইবো। মদি ভাই আমারে বইন ডাকতো। দেহি উনি জানি কারে কইতাছে "এই দেখ,এইডা আমার বইন" লোকটা আমার দিকে তাকাইলো। চেহারাডা খুব মায়াবী। গাল দুইডা ফর্সা। আমারে কয় "কেমুন আছ" আমি কেন জানি লজ্জা পাইলাম। কলম লয়াই দৌড় দিলাম। সেইদিনের পর থাইকা মাঝে মাঝেই হামিদ ভাইয়ের লগে দেহা হইতো। ভালই লাগতো ঘুরতে।বাড়ির এত ঝামেলার পর সব তারে কইতাম। সেও খুব দুঃখ করতো। কইতো সে আমার লগে আছে। যহন কোন জিনিস দরকার ছিল,হেয় নিজেই কিন্না দিত।
এত টুকু বলেই থেমে গেল শিউলি। অনেকটা সময় বাকি সবাই যেন অন্য কোথাও ছিল। হঠাৎ থেমে যাওয়াতে হুশ ফিরলো তাদের। সকলেরই চোখ বুজে আসছিল ক্লান্তিতে। একজন বলে উঠলো-"অ্যাহন গুমাও বইন। কাইল হুনুম" বলেই তার মনে হল, কথাটাকি আসলেও ঠিক? আসলেও কি তারা জানে? কাল সকাল অবধি এখানে সবাই থাকতে পারবে কি না!
পরেরদিন যখন ঘুম ভাঙ্গলো শিউলির, চেয়ে দেখলো দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে ক্ষাণিক আলো এসে ভিড়েছে ঘরের মেঝেতে। সকলকেই মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। একজন তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল। আরেকজন বললো - "শুকনা কলা রুডি খায়া নাও গো বইন।" শিউলি খেয়াল করলো, এমন কঠিন সময়েও সকলেই যেন বড্ড আপন হয়ে গেছে তার।
খাওয়া শেষে বেশ কিছুক্ষন কাটলো হা হুতাশ আর পরিতাপে। কয়েকজন কথা বলছিল আজ কাউকে নিয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে। কেমন যেন এক আশঙ্ক্ষায় ঝিম ধরে ছিল তারা। এক কৃষ্ণ দেহি মহিলা জোর গলায় বলে ফেললো, তাকে যদি এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়,তবে সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে। এ কথা শুনে পাশের জন কৌতুক করে বললো "বিষ পাবি কইরে তুই? কাপড়ই থাহে নি দেখ!!" কথা টা শুনেই হো হো করে হেসে উঠলো সকলে। আবার নিস্তব্ধতা।
একসময় সকলেই জরো হল তার গল্প শুনতে। শিউলিও হয়ত কিছুটা জোর পেয়েছে। মনকে শক্ত করতেই শুরু করলো সে-
" হামিদ ভাই একদিন কইলো, হের নাকি আমারে বালা লাগছে। বিয়া করবো। তারপর ঢাকায় তার বাড়িত নিয়া রাখবে। হেয় ঐহানে বড় চাকরী করে। বেতন ও খুব বালা পায়। আমার এত কষ্ট তার সহ্য হয় না। কথা শুইনা আমারো খুব ভালা লাগলো। অন্তত এই দুনিয়ায় কেউতো আমারে ভাল দেখতে চায়! এদিকে বাড়ির ঝামেলা আর সহ্য করতে পারতেছিলাম না। কইলাম আমি রাজি। তয় বাড়ির বড় লগে তার কথা কওয়া লাগবো। এই কথা হুইনা হেয় কয়, বিয়ার কথা হুনলে বুবুরা রাজি হইবো না।তারা চায় আমারে আজীবন বান্দি বানায়া রাখবো। আমিও কথাডা ফেলাইতে পারলাম না। মনে হইলো ঠিকই কইছে। তাই একদিন সময় বুইঝা তার লগে পারি দিলাম ঢাকায়। ঢাকায় আইসা সে কইলো তার নাকি অফিস থাইকা ফোন আইছে। অনেকদিন কামাই দিছে।আজ যাইতেই হইবো। আমারে চিন্তা করতে দেইখা সে হাসলো। কয়, চিন্তা কইরো না। আমার বন্ধু তুমারে ফ্লাটে নিয়া রাইখা আইবো।সে গাড়ি নিয়া আইছে। আমিও তার হাসি দেইখা গইলা গেলাম। তহন কি আর জানতাম! হের মনে এই!!" বলেই গলাটা ধরে এলো শিউলির। ধরা গলাতেই বললো, তারপর আমারে বন্ধুর লগে মাইক্রোত উডায় দিল। জানলা দিয়া দেখলাম। হেয় তার কাছ থাইকা কি জানি নিল। আর তারপর তো এহানেই।"
সে এখন আর কাঁদছে না।তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। একদৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। অন্যরাও নিশ্চুপ। ঘটনার রেশ এখনো হয়ত কাটেনি তাদের মাঝে। এক সাথে সকলের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে গেল ঘুমোট পরিবেশ টা।
আস্তে আস্তে আবারো তাদের গ্রাস করে ফেলেছে নিস্তব্ধতা। ক্যাটকেটে আওয়াজে অবিরত ঘুড়ে চলছে ফ্যানটা। দরজার ওপাশে কেউ দাড়িয়ে আছে। দাড়িয়ে আছে কিছু আর্তচিৎকার। দাড়িয়ে আছে নতুন এক গল্প জন্ম দেয়ার অপেক্ষায়।
সেদিকে কারো ভুরুক্ষেপ নেই। মেঝেতে বসে থাকা কিছু অবয়বের দীর্ঘশ্বাস, এগুলোই এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে নিশ্চুপতাকে।
ঘরটা মোটামুটি বড়-সড়ই। সারা ঘরে কোন জানালা নেই।একটি মাত্র দরজা। যার ফলে বাহিরের কোন আলো প্রবেশ করে না বহুদিন।হঠাৎ, সকলেই নীরবতা ভেঙ্গে চমকে উঠলো। দরজার ওপাশে ক্যাটকেটে এক ধরনের শব্দ।কেউ হয়ত তালা খুলছে।সাথে একজন তরুণীর গোঙ্গানোর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। একসময় সকলের চোখ ধাধিয়ে দরজা খোলা হল।আকস্মিক আলোর প্রভাবে ঘরেই সকলেই ঢেকে ফেললো তাদের চোখ।ওদিকে রাশভারী মোটা মানুষটি তরুণীটিকে প্রায় ধাক্কা মেরেই ছুড়ে দিল অন্ধকুটিরে। মূহুর্তেই বিকট শব্দে আলো মিলিয়ে পুনরায় জন্ম দিল আধারের।
এতক্ষন পরে অবয়ব গুলোর মাঝে প্রান ফিরে এসেছে যেন।হয়ত এভাবেই মাঝে মাঝে প্রান আসা যাওয়ার খেলা দেখে তারা। কয়েক জোড়া কাঙ্ক্ষিত চোখ তাকিয়ে আছে তরুণীটির দিকে। মেয়েটি তখনো মুক্তির আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে চিৎকার ও দরজায় করাঘাতের মাধ্যমে। অবশ্য বাকি অবয়ব গুলো হাসছে।তারা জানে, এ চেষ্টার কোন ফলনেই। এটা অন্ধকুটির। এক সময় তীব্র চিৎকারও মিশে যাবে আধারের নিশ্চুপতায়।
শীত ভাবটা বেড়েছে।ডিম লাইটটার ঠিক নিচে মেয়েটা। এখন আর কাতরাচ্ছে না। জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে তার ছায়াটার দিকে। হঠাৎ কে যেন হাত রাখলো কাধে। মেয়েটা ধরফর করে উঠলো। কেঁকিয়ে বললো - " কে???? কেডা আপনে!!! আমি কই!!!?? আমারে এখানে আনছে ক্যান?"
ডিমের আলোয় অবয়ব টাকে দেখা গেল এবার।রুক্ষ তেলতেলে নারীর মুখ। ঠোটের মাঝে ভরসার হাসি পাতা। সে বলে উঠলো " ভয় পাইয়ো না গো বইন। ভয় পায়া লাভ নাই এইহানে..
- আপনেরা কেডা? আমারে ক্যান আনছে এইহানে? আমি বাড়িত যামু!! আমারে বাড়িত যাইতে দেন!!
এবার মহিলাটি, কন্ঠে হতাশার মায়াটান এনে বললো, -" চাইলেই কি আর যাইতে পারবা, বইন?আংগোরে দেখ। আমরাও এইহানে কতদিন ধইরা পইরা আছি। সবই কপাল গো বইন "
- আমারে বাড়িত নিয়া যান! আমি বাড়িত যামু!! " পুনরায় কান্নায় ভেঙ্গে পরে মেয়েটা।বুকের মাঝে কেমন যেন, বদ্ধ হৃদপিন্ডে তীক্ষ্ণ সুঁইয়ের আঘাত অনুভব করছে সে। মহিলাটি মাথায় হাত রাখলো তার। সঙ্গে সঙ্গে গলা জড়িয়ে ধরলো মেয়েটি। বাকি আরো জোড়া সাতেক চোখ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।কেউ হয়ত চোখ বুজে ফেলছে দীর্ঘশ্বাস।
আস্তে আস্তে তরুণীটি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো। কারন, সে বুঝে গেছে। এখান থেকে মুক্তির আর কোন পথ নেই।সে নারী পাচারকারীর খুব শক্ত এক চক্রের পাল্লায় পড়েছে।সব কিছু মেনে নিতেই হবে তার। এছাড়া আর উপায় কি!
তাছাড়া এখানকার বাকি সবার সাথেও একই ঘটনাই ঘটেছে।
সে আরো জানতে পারলো। এঘরের মত পাশাপাশি আরো অনেক ঘর রয়েছে।সেখানে রয়েছে আরো মানুষ। তাদের মাঝেও কেউ হয়ত তরুন ছাত্রী, কেউ বাড়ির ঝিঁ, আবার কেউ হয়ত সহজ সরল গৃহবধু। সকলেরই ভাগ্য আজ একই সুতোয় গেথে দিয়েছেন রহস্যময়ী ঈশ্বর।
কেউ জানে না। এখানে তারা কতক্ষণ থাকবে। জীবন টা কেমন যেন আতঙ্কজনক চলমান পথে ধাবিত হচ্ছে তাদের। সারা দিনে একবার দরজা খুলে শুধু কিছু শুকনো খাবার দেয়া হয়। মাঝে মাঝে মোটা কাপড় বাধা বিশাল দেহী কিছু মানুষ কাউকে এনে ফেলে যায়,আবার হয়ত কোন অভাগিনী কে ভাসিয়ে দেয় অজানার নাঁয়ে। এটাই এখন নিয়তি। সব সময় কিছু অদৃশ্য কাঁটার আঘাত সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে তাদের।
মেয়েটাকে ঘিরে সকলে বসে রয়েছে। ডিমের আলোয় তার মুখ দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো। নাক চোখ বড্ড ফোলা। মেয়েটার হয়ত কাঁজল দেয়ার অভ্যাস আছে। কাঁজলে সারামুখ লেপ্টে রয়েছে। হঠাৎ একজন বলে উঠলো - তোমারে কেমনে পাইলো বইন?
মেয়েটা চুপ।কিছুক্ষন পর আরেকজন ক্ষানিকটা ধাক্কা মেরেই বললো, -কও না!!! রাইত ডা পার করি গপ শুইনা! এবার মেয়েটি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো। সকলের দিকে বুলিয়ে নিল শ্রান্ত বিস্মিত চোখ। বাকি সবাই কি এক যেন আকাঙ্ক্ষা ও তৃষ্ণা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটি বলা শুরু করলো -
"আমি শিউলি। শিউলি রানী। গেরামে থাকি। চড়ডাঙ্গা গ্রাম। ঐখানে আমার বুবুর শ্বশুর বাড়ি। আব্বায় মরণের পর বুবুর বাড়িতই উঠি।আমারে ঐখানেরই এক কলেজে ভর্তি কইরা দেয় দুলাবাই।"
এই বলে শিউলি থেমে গেল
কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার শুরু করলো সে। "বইনের সংসারে ভাল লাগতো না।সারাক্ষণ কোন না কোন কাম করা লাগতোই। শরীল কুলাক আর না কুলাক। একদিকে কলেজ। আবার অন্য দিক বাড়ির কাইজ। পান থাইকা চুন খসলেই খোটা।এমন খোটা দিত যে বাঁচতেই ইচ্ছা করতো না।খুব ছুডো মনে হইতো নিজেরে।ভাবতাম! আব্বায় যদি না মরতো। যদি টেকা থাকতো। নইলে বড় ভাই রা যদি মায়ের লগে আমারেও পালতে চাইতো!!
খরচা বেশি লাগবো জন্যে বিয়াও দেয় নাই। সারাদিন কাম । কলেজে যতটুকু সময় থাকতাম খুব ভালা লাগতো। যাইহোক, এমনেই চলতাছিল জীবন।মাইনাই লইছিলাম ভাগ্যডারে।হঠাৎ একদিন কলেজের সামনের একখান দোকানে যাই। মদি ভাইয়ের দোকান। কলম কিনতে হইবো। মদি ভাই আমারে বইন ডাকতো। দেহি উনি জানি কারে কইতাছে "এই দেখ,এইডা আমার বইন" লোকটা আমার দিকে তাকাইলো। চেহারাডা খুব মায়াবী। গাল দুইডা ফর্সা। আমারে কয় "কেমুন আছ" আমি কেন জানি লজ্জা পাইলাম। কলম লয়াই দৌড় দিলাম। সেইদিনের পর থাইকা মাঝে মাঝেই হামিদ ভাইয়ের লগে দেহা হইতো। ভালই লাগতো ঘুরতে।বাড়ির এত ঝামেলার পর সব তারে কইতাম। সেও খুব দুঃখ করতো। কইতো সে আমার লগে আছে। যহন কোন জিনিস দরকার ছিল,হেয় নিজেই কিন্না দিত।
এত টুকু বলেই থেমে গেল শিউলি। অনেকটা সময় বাকি সবাই যেন অন্য কোথাও ছিল। হঠাৎ থেমে যাওয়াতে হুশ ফিরলো তাদের। সকলেরই চোখ বুজে আসছিল ক্লান্তিতে। একজন বলে উঠলো-"অ্যাহন গুমাও বইন। কাইল হুনুম" বলেই তার মনে হল, কথাটাকি আসলেও ঠিক? আসলেও কি তারা জানে? কাল সকাল অবধি এখানে সবাই থাকতে পারবে কি না!
পরেরদিন যখন ঘুম ভাঙ্গলো শিউলির, চেয়ে দেখলো দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে ক্ষাণিক আলো এসে ভিড়েছে ঘরের মেঝেতে। সকলকেই মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। একজন তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল। আরেকজন বললো - "শুকনা কলা রুডি খায়া নাও গো বইন।" শিউলি খেয়াল করলো, এমন কঠিন সময়েও সকলেই যেন বড্ড আপন হয়ে গেছে তার।
খাওয়া শেষে বেশ কিছুক্ষন কাটলো হা হুতাশ আর পরিতাপে। কয়েকজন কথা বলছিল আজ কাউকে নিয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে। কেমন যেন এক আশঙ্ক্ষায় ঝিম ধরে ছিল তারা। এক কৃষ্ণ দেহি মহিলা জোর গলায় বলে ফেললো, তাকে যদি এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়,তবে সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে। এ কথা শুনে পাশের জন কৌতুক করে বললো "বিষ পাবি কইরে তুই? কাপড়ই থাহে নি দেখ!!" কথা টা শুনেই হো হো করে হেসে উঠলো সকলে। আবার নিস্তব্ধতা।
একসময় সকলেই জরো হল তার গল্প শুনতে। শিউলিও হয়ত কিছুটা জোর পেয়েছে। মনকে শক্ত করতেই শুরু করলো সে-
" হামিদ ভাই একদিন কইলো, হের নাকি আমারে বালা লাগছে। বিয়া করবো। তারপর ঢাকায় তার বাড়িত নিয়া রাখবে। হেয় ঐহানে বড় চাকরী করে। বেতন ও খুব বালা পায়। আমার এত কষ্ট তার সহ্য হয় না। কথা শুইনা আমারো খুব ভালা লাগলো। অন্তত এই দুনিয়ায় কেউতো আমারে ভাল দেখতে চায়! এদিকে বাড়ির ঝামেলা আর সহ্য করতে পারতেছিলাম না। কইলাম আমি রাজি। তয় বাড়ির বড় লগে তার কথা কওয়া লাগবো। এই কথা হুইনা হেয় কয়, বিয়ার কথা হুনলে বুবুরা রাজি হইবো না।তারা চায় আমারে আজীবন বান্দি বানায়া রাখবো। আমিও কথাডা ফেলাইতে পারলাম না। মনে হইলো ঠিকই কইছে। তাই একদিন সময় বুইঝা তার লগে পারি দিলাম ঢাকায়। ঢাকায় আইসা সে কইলো তার নাকি অফিস থাইকা ফোন আইছে। অনেকদিন কামাই দিছে।আজ যাইতেই হইবো। আমারে চিন্তা করতে দেইখা সে হাসলো। কয়, চিন্তা কইরো না। আমার বন্ধু তুমারে ফ্লাটে নিয়া রাইখা আইবো।সে গাড়ি নিয়া আইছে। আমিও তার হাসি দেইখা গইলা গেলাম। তহন কি আর জানতাম! হের মনে এই!!" বলেই গলাটা ধরে এলো শিউলির। ধরা গলাতেই বললো, তারপর আমারে বন্ধুর লগে মাইক্রোত উডায় দিল। জানলা দিয়া দেখলাম। হেয় তার কাছ থাইকা কি জানি নিল। আর তারপর তো এহানেই।"
সে এখন আর কাঁদছে না।তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। একদৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। অন্যরাও নিশ্চুপ। ঘটনার রেশ এখনো হয়ত কাটেনি তাদের মাঝে। এক সাথে সকলের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে গেল ঘুমোট পরিবেশ টা।
আস্তে আস্তে আবারো তাদের গ্রাস করে ফেলেছে নিস্তব্ধতা। ক্যাটকেটে আওয়াজে অবিরত ঘুড়ে চলছে ফ্যানটা। দরজার ওপাশে কেউ দাড়িয়ে আছে। দাড়িয়ে আছে কিছু আর্তচিৎকার। দাড়িয়ে আছে নতুন এক গল্প জন্ম দেয়ার অপেক্ষায়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
দেবব্রত সান্যাল ২৬/১০/২০১৫আপনার লেখার হাত ভালো। বানান দেখে নিন। গল্পতে বিশেষত্ব নেই।