www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মানুষ হিসেবে আমাদের চিন্তাহীনতা এবং অসচেতনতার পরিণতি কী

আমরা যখন আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিকগুলো বুঝতে চাই না, ভাবতে চাই না তখনই জন্ম নেয় আড়ষ্টতার, নির্লিপ্ততার। চিন্তাহীন স্থবির মস্তিষ্ক মরিচাধরা-মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা অল্প সময়েই বুড়িয়ে যাওয়া মৌলের মতো আমাদের অন্তর্নিহিত বোধকে করে জরাগ্রস্ত, নির্জীব । সক্রেটিস থেকে হেগেল, আল ফারাবি থেকে নিৎসে আমাদের কাছে তুচ্ছ মনে হয়, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। আমাদের মনে হয় মার্ক্স, এঙ্গেলো, নিউটন, আইনস্টাইন সবার উর্ধ্বে উঠে গিয়েছি আমরা। আর শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ তো আমাদের প্রাগৈতিহাসিক হাসির খোরাক, যাদের লেখা হালকা রুচির প্যারোডির উৎস আর যারা নিজেরা অট্টহাসির পাত্র। আমাদের মধ্যে অসুখের মতো জেগে ওঠে হিংস্রতা, বর্বরতা আর বিবেকহীনতা।

দ্বিমতকারীরা বলতে পারেন যে আমরা তো জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন, বরং একটু বেশিই! এইযে ভালো খাবার, ভালো পোশাক, সুন্দর থাকার জায়গা নিয়ে আমরা বেশ সচেতন। সবচেয়ে বড় কথা এসবের জন্য যা অপরিহার্য - অর্থকড়ি বা টাকা, তা নিয়ে তো আমরা বেশ আগ্রহী। আমরা যেভাবে পারি টাকা তো কামাই! আমরা বড় বড় বিল্ডিং করছি, বাহারি কলকারখানা, নানান পণ্যের উৎপাদনকেন্দ্র (ভূমি,আবহাওয়া,জলবায়ু তো 'জীবন' নয়, তাদের বারোটা বাজুক!)। নিজেদেরকে সাজাচ্ছি দামি দামি পোশাকে। বিচিত্র ধরণ আর স্বাদের খাবারে আমাদের পাকস্থলী হচ্ছে টইটম্বুর। খাবারগুলোর মধ্যে সুদ এবং ঘুষ আবার আমাদের পছন্দের শীর্ষে। তবে, যারা এইদুটো খান তারা ঠিক চিবিয়ে খান নাকি গিলে খান এই বিষয়ে আমার সুস্পষ্ট ধারণা নেই। জীবন সম্পর্কে যে আমরা খুব সচেতন সেটার প্রমাণ আমরা খুব সহজেই পেয়ে যাই প্রতিদিনকার খবরের কাগজে। কীভাবে নিজের জীবন সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে আমরা অন্যকে করছি প্রতিনিয়ত বঞ্চিত, খুন, ধর্ষণ, অসম্মান। কীভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছি আমরা প্রতিনিয়ত! পারমানবিক বোমা যেন আমাদের হাতের খেলনা। অন্তর্নিহিত আবেদনকে (মানব মনের পবিত্রতা সাধন -তাযকিয়াহ) নির্দ্বিধায় অবহেলা করে কীভাবে পবিত্র ধর্মকে ঘিরেও ব্যবসা করে হাসিল করছি নিজেদের স্বার্থ! নিজেদের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করছি তথাকথিত সুখ আর সাফল্যের তাগিদে। আমাদের কাছে নিরাপদ নয় কেউ; ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বাবা-মামা। আমাদের জীবনের কামনা বাসনার জন্য আমরা সমাজে বৈধতা দিয়েছি অনাচারকে, কপটতাকে। নক্ষত্রও হয়তো আমাদেরকে আর নৈসর্গিক আলো দিতে চায় না, নিতান্ত অনিচ্ছায় দিতে বাধ্য হয়। এতকিছুর পরও আমরা ভাবছি না, আমাদের চেতনা অন্ধকারে নিমজ্জিত কীটের মতো পলায়িত, অনুপস্থিত মৃতদের মতো।

পিয়েরে জোসেফ প্রুঁধো বলেছিলেন, 'Property is theft.'

অথচ, আমাদের কাছে চোরেরাই প্রভূ। আর চুরিলব্ধ বস্তু (সম্পদ, সম্পত্তি, অর্থকড়ি) আমাদের পূজনীয় কিংবা একান্ত কাম্য। পাশাপাশি যশ,খ্যাতি আর ক্ষমতার অন্ধ মোহ তো আমাদের মজ্জায় ঐতিহাসিক কাল থেকে ব্যাপৃত।

আসলে, মানুষের জীবন কি এমনই হওয়ার কথা? পশু-পাখির মতো খাবার, থাকার জায়গা আর বেঁচে থাকার ভাবনাটাই কি শুধু জীবন ভাবনা?
অন্যের প্রাপ্য, অন্যের ভালোমন্দ, স্বাধিকার আর অন্যের অধিকার, নান্দনিকতা, সমাজের বিচিত্র ধারার অগ্রসরমান রূপ, জীবন মানের উন্নয়ন, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান-আবিষ্কার, নৈতিকতা সব কিছুই পণ্ড মনে হয় ঝিম ধরা মানুষের মস্তিষ্কের নীরব নিউরনগুলোর কাছে। শুধু প্রাণীর মতো বেঁচে থাকাটাই মানুষের কাছে হয়ে ওঠে আরাধ্য।

জীবনানন্দের ভাষায়,

'অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।'

তবে, কেন মানুষ এতটা অবুঝ হয়ে যাচ্ছে? ইচ্ছা-অন্ধ হয়ে যাচ্ছে? সে প্রশ্নের নানান উত্তর হয়তো আছে গবেষক আর চিন্তকদের কাছে, যারা এখনও স্রোতে গা ভাসান নি, বৈঠা দিয়ে খুব কষ্ট করে হাল ধরে রাখছেন চিন্তার, চেতনার। আর কতদিনই বা তারা এভাবে হাল ধরে রাখতে পারবেন?
আমার মতে, পুঁজিবাদের আগ্রাসন মানুষকে পণ্যের পর্যায়ে নামিয়ে এনে যাবতীয় প্রেমবোধ, জীবনবোধ আর চিন্তাশীলতা থেকে দূরে সরিয়ে ভোগ্যপণ্যের সুপ্রিয় খাদক আর কৃত্রিম চাহিদার সুপ্রিয় গ্রাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে পঙ্গু, বিকলাঙ্গ মানবসমাজের জন্ম দিচ্ছে। পাপেটের মতোই মানুষ হয়ে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন, পরাধীন আর অসহায়। সমাজের গুটিকয়েক মানুষ অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিকভাবে এতে লাভবান হলেও আমরা সাধারণেরা একেবারেই নেতিয়ে পড়েছি স্পর্শকাতর লজ্জাবতী পাতার মতো কিংবা তার চেয়েও বেশি। ঘুমন্ত, মাদকাসক্ত পুতুলের অপবিত্র গোরস্তানে পরিণত হচ্ছে মহামূল্যবান মানব সমাজ। এর দায় অবশ্য শুধু পুঁজিপতিদের নয়। স্বার্থান্বেষী ফাউল, সুবিধাবাদী, লোভী আর নানান মহলের দায় তো আছেই। দায় আছে আমাদেরও।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,

'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তবে ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।'

দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা না করলে যে কী ধ্বংসাত্মক পরিণতি হবে তা আমরা চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারি।

'আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।'

হুমায়ুন আজাদ কথাগুলো যে প্রেক্ষাপটেই বলে থাকুন না কেন, আমাদের সামগ্রিক চিন্তাশীলতা, দায়িত্বশীলতা আর চেতনার জাগ্রতচিত্তের অভাবে যে সমাজে দিন দিন অধঃপতনের ঘণ্টাই বাজবে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

~মো. রিদওয়ান আল হাসান
শিক্ষার্থী,
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৩১১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৭/১২/২০২৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • জে এস এম অনিক ২৮/০২/২০২৪
    দারুণ
  • অনন্য!
  • সুসঙ্গ শাওন ২৮/১২/২০২৩
    আমাদের ধ্বংস হবে আমাদের জন‍‍্যেই।।
    সুন্দর লিখেছেন লেখক। শুভকামনা রইলো।।
 
Quantcast