নীল গ্রহ
রিয়া রাফিকে টেক্সট করেই যাচ্ছে একের পর এক।
-এই ছেলে,সারাদিন কোনো খবর নাই কেন?
-এই হনুমান,বেশী বেড়ে গেছ,তাই না?
-তোমার সাথে আর কোনো কথা নাই।কখন থেকে মেসেজ দিচ্ছি!সাড়া-ই নেই।কার সাথে কথা বলছ লুকিয়ে লুকিয়ে?
-রাফি,তোমার কিছু হয়নি তো?
-তুমি কোথায়?
ফোনে কল করা সম্ভব হচ্ছেনা।কল করলে হয়তো রাফির মা বা বোন রিসিভ করতে পারে।ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে।
রিয়া দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।হঠাৎ রাফি রিপ্লাই দিলো।
-আরে মহারানী,আমি তো পাশের বাসায় গিয়েছিলাম।আফিফা ডেকেছিল।
এরপর শুরু হয় তাদের বিখ্যাত ঝগড়া।
-তা যাও আফিফার সাথেই বসে থাকো।আমার সাথে কথা বলতে হবেনা।
-কি বলো তুমি!তুমি আমার ময়না,টিয়া,ঘুঘু,ডাহুক,চড়ুই,ঈগল,চিল,ময়ুর,উটপাখি,কাক,কোকিল,বাবুই,চাতক,মাছরাঙা,হামিং বার্ড।তোমাকে রেখে আফিফার সাথে কি কথা বলবো!
-কি!আমি চিল?আমি কাক?
-না,আমি একচুয়েলি তা বলিনি।তুমি হলে পাখি।আমার মাথায় যতগুলো পাখির নাম আসছে সবগুলা বলছি।কাক ও তো পাখি,তাইনা?
-তারমানে আমি কাক?হ্যা,তাইতো।আমি তো কাকের মতো কা কা করি সারাদিন।সারাক্ষণ মেসেজ দিই।ডিস্টার্ব করি।অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলতে দিইনা।আর তোমার আফিফা তো খুব ভালো।ওর সাথেই থাকো।যাও।
-আফিফা আসছে কোত্থেকে!ও আমার ছোট বোনের মতো।একটা ম্যাথ বুঝতেছিল না,তাই ডাকছিল।
-হ্যা,এগুলা বুঝি বুঝি।ম্যাথ বুঝিতেছিলনা?কই!আমি যখন বলি-"এই টপিকটা একটু বুঝায়ে দাও" তখন তো বলো "না,পারবোনা"।আর আমি ডাকলেও তো ছুটে আসোনা।ও ডাকলো আর দৌড়ে চলে গেলা!
-আমাকে সকাল থেকে ডাকছিল।আমি এই দুপুরে একটু গিয়ে দেখিয়ে দিলাম।আর আফিফা পড়ে ক্লাস টেনে।আর তুমি ভার্সিটির স্টুডেন্ট।এগুলো ক্যালকুলাস,এনালিটিক জিওমেট্রি আমি পারিনা।আমি তো আর তোমার ডিপার্টমেন্টে পড়িনি।আমি বাংলা পড়েছি।
-তো বাংলাতে অনার্স করেছ তো আফিফার ম্যাথ বুঝাতে হয় কেন?ওর অন্য টিচার নেই?আমি বুঝিনা কিচ্ছু ভাবছো!
-ওর টিচার আজ আসেনি।আর আমি তো সাইন্সের স্টুডেন্টই ছিলাম ইন্টার পর্যন্ত।তাই যতটুকু পারি বুঝাইছি।
-টিচার না আসলেই তোমাকে ডাকতে হবে কেন!কি ওমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে একদিন না পড়লে!পাজি মেয়ে একটা
-তুমি পাজি বলছো কেনো ওকে?আজব!
-হ্যা,আমি তো আজবই।আজব।ও পাজি না তো।সরি।ভুলে বলে ফেলছি।তোমার কত দরদ!আহারে!যাও ওকে ডেকে নিয়ে এসে আরো কয়েকটা ম্যাথ বোঝাও।
-রিয়া,ইউ আর ক্রসিং ইউর লিমিট।
-সরি,সরি।আমার তো কোনো অধিকার নেই তোমাকে কিছু জিজ্ঞাস করার।কিছু বলার।তুমি যা খুশি তা-ই করো।আমার সাথে কোনো কথা নেই।আমিও আর কখনো ডিস্টার্ব করবোনা। -এই রিয়া,এই,শোনো।
-না,কোনো শুনাশুনি নেই।ব্রেকাপ।আজ থেকে তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।ভালো থাকবে।
এরপর আরো কয়েকবার টেক্সট করলো রাফি।কিন্তু কোনো কাজে আসলো না।সবগুলোই ডেলিভারড হয়।কিন্তু রিয়া রিপ্লাই দেয়না।এরপর ফোন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
কিন্তু,দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রথমবার রিং বাজার সঙ্গেসঙ্গেই কল কেটে দিয়ে ফোন সুইচড অফ করে দেয় রিয়া।
পরেরদিন ক্লাস শেষে ভার্সিটির পাশের লেক ধরে হাঁটতে থাকে রিয়া।জায়গাটা সুন্দর।একটা আর্টিফিশিয়াল ঝর্ণা আছে।দেখলেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে যায়।কিন্তু রিয়ার কেন যেনো কিছুই ভালো লাগছেনা।হয়তো গতকাল একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে।মনের ছটফটানি কমছেই না।রাফি কি করছে!অন্যদিন হলে তো ঝগড়ার সাথে সাথেই ফোনে না পেয়ে দেখা করত চলে আসে।অথচ কাল এলোনা!আজ তো ফোন খোলাই ছিল।একটা টেক্সটও করেনি।কল করা বা দেখা করা তো দূরের কথা!তার মানে কি রাফিও ব্রেকাপ চায়!রিয়ার কান্না পাচ্ছে।এমন সময় লেকের বাম পাশের পাকুড় গাছের নিচে পাতা বেঞ্চটায় তাকালো সে।
দেখলো আফিফা বসে আছে।পাশে আরেকটা ছেলে।একইসাথে পড়ে ওরা।স্কুল ড্রেস একই।রিয়া ধারণা করলো এরা তো জিএফ-বিএফ ও হতে পারে!রিয়ার মনে মনে হাসি পেল।কোনো একটা অদ্ভুত কারণে তার কান্না দূরীভূত হয়ে গেলো।সে ভাবলো নিজেই এবার রাফিকে একটা ফোন দিবে।
অনেকবার ফোন করেও রাফিকে পাওয়া গেলো না।সুইচড অফ।এভাবে দুদিন কাটলো।এই দুদিনে রিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে।রাফির বাসায় ও গিয়েছিল সে।কিন্তু পায়নি।বাসায় তালা দেয়া।এমন কেন হচ্ছে তার সাথে!তীব্র অনুশোচনাবোধ জাগলো রিয়ার মাঝে।রাফির বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে।সবাই বলছে যে রাফি ভালোই আছে।কিন্তু কোথায় আছে,ফোন কেন বন্ধ এসব ব্যাপারে শত চেষ্টা করেও জানতে পারেনি রিয়া।কেউ কিছু বলছেনা তাকে।রিয়ার অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে।রাফির বন্ধুদেরকেও তার এখন নিজের শত্রু বলে মনে হচ্ছে।
তৃতীয়দিন থেকে রিয়ার শরীর কেঁপে প্রচন্ড জ্বর এলো।রীতিমতো অনেক কষ্ট হচ্ছে তার।একদিকে শরীরের ব্যথা-যন্ত্রনা আর অন্যদিকে রাফির ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা আর অব্যক্ত মনের যন্ত্রনা।এভাবে বেশ কিছুদিন কাটলো।
এরপর একদিন কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর রিয়া ভার্সিটি গেলো।কিন্তু বাসায় যখন ফিরলো তখন তার বিস্ময়ের সীমা রইলোনা।বাসায় কারা যেনো এসেছে তাকে দেখতে।যাকে বলে কণে দেখা।সে জানতো যে তার বিয়ের কথা চলছে।তবে আজই যে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তা সে জানতো না।বাবা মা কিছু বলেনি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিয়া পাত্রপক্ষের সামনে গেলো।পাত্রের নাম সোহেল।বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন গেজেটেড অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে।খুবই ভালো সেলারি পাবে।দেখতে শুনতেও খুব স্মার্ট।রিয়ার বাবা মা অলরেডি পছন্দ করেই ফেলেছে।রিয়া অবশ্য পাত্রকে দেখেনি।রিয়ার চোখের সামনে কেবল রাফির স্মৃতিই ভাসছে।সে চেষ্টা করছে অনেক তাকে ভুলে যেতে,কিন্তু পারছেনা।পাত্রের দিকে তাকালে হয়তো আবার রাফির স্মৃতি তাকে কাবু করে ফেলবে।তাই তাকায়নি সে।পাত্রপক্ষের কে কে আসলো সেটাও লক্ষ্য করেনি।পাত্রপক্ষও পছন্দ করে ফেল্লো।বিয়ের কথা অনেকটাই পাকাপাকি।রিয়া কিছুই বল্লোনা।তার প্রতিবাদ,প্রতিহত করার শক্তি নেই।মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছে না।রাফি তাকে ছেড়ে চলে গেছে।এতদিনের মায়াবী মধুর সম্পর্কের শেষটা যে এভাবেই বিচ্ছেদে কাটবে তা কখনো কল্পনাও করেনি রিয়া।রাফি এরকম করতে পারলো?একবারো যোগাযোগ করছেনা!
বিয়ের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেল।রিয়া অঝোরে কাঁদছে,যাকে বলে চোখের জল আর নাকের জলে একাকার হয়ে যাওয়া।
তবুও শপিং করতে হচ্ছে।শত হোক মা বাবাকে তো আর কষ্ট দেয়া যায় না।যেখানে রাফিরই খোঁজ নেই!সেখানে সে আর কি করতে পারে!বিয়ের পীড়িতে বসতেও এখন সে আর দ্বিধা করবেনা।প্রবল জেদ কাজ করলো তার মাঝে।
বিয়ে হয়ে গেল।দুজনের নতুন জীবনে কিংবা জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটলো।নতুন বর সোহেল এখনো বাসরঘরে প্রবেশ করেনি।রিয়ার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।রাফির সমস্ত স্মৃতি মস্তিষ্ক আর হৃদয়কে কাবু করে দিচ্ছে।এমন সময় ঘরের জানালায় টোকা পড়লো
-আপু,রিয়া আপু,আমি হাসান।প্লিজ জানালাটা খুলো।
রিয়া জানালা খুললো।হাসান একনাগাড়ে বললো
-তুমি চুপিচুপি পিছনের গেইট টা দিয়ে বাইরে আসো।রাফি ভাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।বাসের টিকিটসহ সমস্ত কিছু রেডি করা আছে।তোমরা প্রথমে ঢাকা যাবে।
রিয়া কিছুই বিশ্বাস করতে পাচ্ছে না।
তবুও কোনো এক অলৌকিক শক্তির বলে সবরকমের জড়তা,লজ্জা আর ভয় ভুলে গিয়ে এক দৌড়ে সে বাইরে বেরিয়ে আসলো।রাফি এক মুহূর্তও দেরি করলো না।রিয়ার হাতে জোরে একটা টান দিয়ে কাছে নিয়ে আসলো।রিয়ার মুখ আর রাফির মুখ খুব কাছাকাছি।তাদের চোখের দূরত্বও কম।দুজনের ঠোট নড়ছেনা।কেবল অপলক তাকিয়ে থেকে নিজেদের দেখে নিল কিছুক্ষণ।
পেছন থেকে হাসান ডাক দিল
-আরে ভাই,এখন দাঁড়িয়ে থাকার সময় নাই।গাড়িতে উঠেন।
ওরা পালিয়ে গেলো।
গাড়ির মধ্যে রিয়া আর রাফি আবার ঝগড়া করছে
-আমি ছিলাম না বলে বিয়ে বসে পড়লা!একবারও মনে পড়লোনা আমার কথা!
-তো,কি করবো!দেবদাসী সেজে বসে থাকবো!কোন দেশে গেছিলা তুমি?কম কষ্ট দিছ আমাকে?তোমার সাথে পালালাম কেন যে নিজেই বুঝলাম না!
-তুমি আমাকে কম কষ্ট দিছ?ব্রেকাপ করে দিছিলা!
-তো কি হইছে!আমি তো ওমন করি ই।তাই বলে তুমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবা!
-আমার ফোনটা গেছে চুরি হয়ে।আর আমি একটা বিশেষ কাজে চিটাগাং গিয়েছিলাম।তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি,ভাবছি একেবারে ঢাকায় ফিরে সারপ্রাইজ দিয়ে রাগ ভাঙাবো।
-হ্যা,হ্যা।আমার রাগ তো তোমার কাছে কিছুই না।আমার এদিকে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।আর আপনার কোনো…
হাসান হঠাৎ সামনে থেকে বলে উঠলো
-আরে তোমরা থামবে?নাকি এখানেই ছেড়ে দিবো দুজনকে?এই মাঝপথে!
রিয়া আদুরে গলায় নরম সুরে রাফিকে জিজ্ঞাসা করলো-
কি সারপ্রাইজ দিতা আমাকে?
রাফি জবাবা দিলো না।
-আমি যদি না বের হয়ে আসতাম আজ!বাসরঘর থেকে না পালাতাম!
-আমি জানি তুমি পালাইতা।
-কেন?কেমনে জানো?
-ভালোবাসো যে।এইজন্যে।
-হু।আমি একাই বাসি।তুমি তো বাসো না।
একথা বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো রিয়া।
রাফি আচমকা রিয়াকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বল্লো
-শুনেন,সারপ্রাইজ টা হলো আমার সাথেই আপনার বিয়ে হয়েছে।
-কিহ!তোমার সাথে বিয়ে হলো কিভাবে?বিয়ে তো হলো সোহেলের সাথে!
-উহু।আপনি ভালো করে ভেবে বলুন তো ঐ সোহেল টা কে?
-কে আবার!সোহেল।যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেন।আজ যার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসলাম।
-একটা গাধী!ঐদিন আমি আর আমার বাবা মা-ই গিয়েছিলাম তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে।আর আমি এর আগেরদিনই এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছি।আর আমার নামটা কি ভুলে গেছেন-সোহেল আরমান রাফি?আর তুমি কি শুনোনি-কাজী সাহেব আমার নাম,বাবার নাম সবকিছুই জোরে জোরে বললেন!
-আমি কিছুই শুনিনি ভালো করে,তোমার কথাই ভাবছিলাম আর কাঁদছিলাম।আর শুধু 'কবুল'বলার সময় অনেক কষ্ট করে মুখ খুললাম মা-বাবার কথাটা ভেবে।আমার মন তো তোমাকেই খুঁজছিল।
রিয়ার কিছু বিশ্বাস হচ্ছেনা।সে কেঁদে ফেললো।এইটা আনন্দের অশ্রু।অতিরিক্ত অবাক হওয়ার ফলে নির্গত অশ্রু।রিয়াও জড়িয়ে ধরলো রাফিকে।রাফির বুকে মুখ গুজে ফেললো।রাফিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
-তাহলে আমরা পালালাম কেনো?সবাই কি বলবে?তোমার মা বাবাই বা কি বলবে!
-মিসেস,শুনোন।সবাই জানে।আমি সবাইকে আগেই বলেছি।আর আপনি যে সত্যিই কিছু ধরতে পারেননি তা ভেবে অবাক হয়েছি।এত গাধী টাইপের একটা মেয়েকে নিয়ে কিভাবে সারাজীবন কাটাবো!
রিয়া আর কোনো কথা বলছেনা।সে যেনো তার হৃদস্পন্দন খুঁজে পেয়েছে।তার দেহের রক্তস্রোতে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে।সে কি করছিল!যদি সত্যি সত্যিই অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যেত!নাহ।হতো না।এই অদ্ভুত ছেলে রাফিই তার ভাগ্যে ছিল।সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
রাফি পরম আদরে রিয়াকে লুফে নিল বুকের ভিতর।অলৌকিক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার হৃদয় জুড়ে।গাড়ি চলছে ঢাকার পথে।জোছনা রাত।চারিদিকে চাঁদের রুপালী আলো।মায়াবী আলো।তারার নীল আলো।সমগ্র শহর উজ্জ্বল।পৃথিবী যেন একটা মায়াবী নীল গ্রহ,যেখানে মানুষ মানুষকে প্রচন্ড ভালোবাসতে জানে।
-এই ছেলে,সারাদিন কোনো খবর নাই কেন?
-এই হনুমান,বেশী বেড়ে গেছ,তাই না?
-তোমার সাথে আর কোনো কথা নাই।কখন থেকে মেসেজ দিচ্ছি!সাড়া-ই নেই।কার সাথে কথা বলছ লুকিয়ে লুকিয়ে?
-রাফি,তোমার কিছু হয়নি তো?
-তুমি কোথায়?
ফোনে কল করা সম্ভব হচ্ছেনা।কল করলে হয়তো রাফির মা বা বোন রিসিভ করতে পারে।ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে।
রিয়া দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।হঠাৎ রাফি রিপ্লাই দিলো।
-আরে মহারানী,আমি তো পাশের বাসায় গিয়েছিলাম।আফিফা ডেকেছিল।
এরপর শুরু হয় তাদের বিখ্যাত ঝগড়া।
-তা যাও আফিফার সাথেই বসে থাকো।আমার সাথে কথা বলতে হবেনা।
-কি বলো তুমি!তুমি আমার ময়না,টিয়া,ঘুঘু,ডাহুক,চড়ুই,ঈগল,চিল,ময়ুর,উটপাখি,কাক,কোকিল,বাবুই,চাতক,মাছরাঙা,হামিং বার্ড।তোমাকে রেখে আফিফার সাথে কি কথা বলবো!
-কি!আমি চিল?আমি কাক?
-না,আমি একচুয়েলি তা বলিনি।তুমি হলে পাখি।আমার মাথায় যতগুলো পাখির নাম আসছে সবগুলা বলছি।কাক ও তো পাখি,তাইনা?
-তারমানে আমি কাক?হ্যা,তাইতো।আমি তো কাকের মতো কা কা করি সারাদিন।সারাক্ষণ মেসেজ দিই।ডিস্টার্ব করি।অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলতে দিইনা।আর তোমার আফিফা তো খুব ভালো।ওর সাথেই থাকো।যাও।
-আফিফা আসছে কোত্থেকে!ও আমার ছোট বোনের মতো।একটা ম্যাথ বুঝতেছিল না,তাই ডাকছিল।
-হ্যা,এগুলা বুঝি বুঝি।ম্যাথ বুঝিতেছিলনা?কই!আমি যখন বলি-"এই টপিকটা একটু বুঝায়ে দাও" তখন তো বলো "না,পারবোনা"।আর আমি ডাকলেও তো ছুটে আসোনা।ও ডাকলো আর দৌড়ে চলে গেলা!
-আমাকে সকাল থেকে ডাকছিল।আমি এই দুপুরে একটু গিয়ে দেখিয়ে দিলাম।আর আফিফা পড়ে ক্লাস টেনে।আর তুমি ভার্সিটির স্টুডেন্ট।এগুলো ক্যালকুলাস,এনালিটিক জিওমেট্রি আমি পারিনা।আমি তো আর তোমার ডিপার্টমেন্টে পড়িনি।আমি বাংলা পড়েছি।
-তো বাংলাতে অনার্স করেছ তো আফিফার ম্যাথ বুঝাতে হয় কেন?ওর অন্য টিচার নেই?আমি বুঝিনা কিচ্ছু ভাবছো!
-ওর টিচার আজ আসেনি।আর আমি তো সাইন্সের স্টুডেন্টই ছিলাম ইন্টার পর্যন্ত।তাই যতটুকু পারি বুঝাইছি।
-টিচার না আসলেই তোমাকে ডাকতে হবে কেন!কি ওমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে একদিন না পড়লে!পাজি মেয়ে একটা
-তুমি পাজি বলছো কেনো ওকে?আজব!
-হ্যা,আমি তো আজবই।আজব।ও পাজি না তো।সরি।ভুলে বলে ফেলছি।তোমার কত দরদ!আহারে!যাও ওকে ডেকে নিয়ে এসে আরো কয়েকটা ম্যাথ বোঝাও।
-রিয়া,ইউ আর ক্রসিং ইউর লিমিট।
-সরি,সরি।আমার তো কোনো অধিকার নেই তোমাকে কিছু জিজ্ঞাস করার।কিছু বলার।তুমি যা খুশি তা-ই করো।আমার সাথে কোনো কথা নেই।আমিও আর কখনো ডিস্টার্ব করবোনা। -এই রিয়া,এই,শোনো।
-না,কোনো শুনাশুনি নেই।ব্রেকাপ।আজ থেকে তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।ভালো থাকবে।
এরপর আরো কয়েকবার টেক্সট করলো রাফি।কিন্তু কোনো কাজে আসলো না।সবগুলোই ডেলিভারড হয়।কিন্তু রিয়া রিপ্লাই দেয়না।এরপর ফোন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।
কিন্তু,দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রথমবার রিং বাজার সঙ্গেসঙ্গেই কল কেটে দিয়ে ফোন সুইচড অফ করে দেয় রিয়া।
পরেরদিন ক্লাস শেষে ভার্সিটির পাশের লেক ধরে হাঁটতে থাকে রিয়া।জায়গাটা সুন্দর।একটা আর্টিফিশিয়াল ঝর্ণা আছে।দেখলেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে যায়।কিন্তু রিয়ার কেন যেনো কিছুই ভালো লাগছেনা।হয়তো গতকাল একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে।মনের ছটফটানি কমছেই না।রাফি কি করছে!অন্যদিন হলে তো ঝগড়ার সাথে সাথেই ফোনে না পেয়ে দেখা করত চলে আসে।অথচ কাল এলোনা!আজ তো ফোন খোলাই ছিল।একটা টেক্সটও করেনি।কল করা বা দেখা করা তো দূরের কথা!তার মানে কি রাফিও ব্রেকাপ চায়!রিয়ার কান্না পাচ্ছে।এমন সময় লেকের বাম পাশের পাকুড় গাছের নিচে পাতা বেঞ্চটায় তাকালো সে।
দেখলো আফিফা বসে আছে।পাশে আরেকটা ছেলে।একইসাথে পড়ে ওরা।স্কুল ড্রেস একই।রিয়া ধারণা করলো এরা তো জিএফ-বিএফ ও হতে পারে!রিয়ার মনে মনে হাসি পেল।কোনো একটা অদ্ভুত কারণে তার কান্না দূরীভূত হয়ে গেলো।সে ভাবলো নিজেই এবার রাফিকে একটা ফোন দিবে।
অনেকবার ফোন করেও রাফিকে পাওয়া গেলো না।সুইচড অফ।এভাবে দুদিন কাটলো।এই দুদিনে রিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে।রাফির বাসায় ও গিয়েছিল সে।কিন্তু পায়নি।বাসায় তালা দেয়া।এমন কেন হচ্ছে তার সাথে!তীব্র অনুশোচনাবোধ জাগলো রিয়ার মাঝে।রাফির বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে।সবাই বলছে যে রাফি ভালোই আছে।কিন্তু কোথায় আছে,ফোন কেন বন্ধ এসব ব্যাপারে শত চেষ্টা করেও জানতে পারেনি রিয়া।কেউ কিছু বলছেনা তাকে।রিয়ার অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে।রাফির বন্ধুদেরকেও তার এখন নিজের শত্রু বলে মনে হচ্ছে।
তৃতীয়দিন থেকে রিয়ার শরীর কেঁপে প্রচন্ড জ্বর এলো।রীতিমতো অনেক কষ্ট হচ্ছে তার।একদিকে শরীরের ব্যথা-যন্ত্রনা আর অন্যদিকে রাফির ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা আর অব্যক্ত মনের যন্ত্রনা।এভাবে বেশ কিছুদিন কাটলো।
এরপর একদিন কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর রিয়া ভার্সিটি গেলো।কিন্তু বাসায় যখন ফিরলো তখন তার বিস্ময়ের সীমা রইলোনা।বাসায় কারা যেনো এসেছে তাকে দেখতে।যাকে বলে কণে দেখা।সে জানতো যে তার বিয়ের কথা চলছে।তবে আজই যে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তা সে জানতো না।বাবা মা কিছু বলেনি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিয়া পাত্রপক্ষের সামনে গেলো।পাত্রের নাম সোহেল।বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন গেজেটেড অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে।খুবই ভালো সেলারি পাবে।দেখতে শুনতেও খুব স্মার্ট।রিয়ার বাবা মা অলরেডি পছন্দ করেই ফেলেছে।রিয়া অবশ্য পাত্রকে দেখেনি।রিয়ার চোখের সামনে কেবল রাফির স্মৃতিই ভাসছে।সে চেষ্টা করছে অনেক তাকে ভুলে যেতে,কিন্তু পারছেনা।পাত্রের দিকে তাকালে হয়তো আবার রাফির স্মৃতি তাকে কাবু করে ফেলবে।তাই তাকায়নি সে।পাত্রপক্ষের কে কে আসলো সেটাও লক্ষ্য করেনি।পাত্রপক্ষও পছন্দ করে ফেল্লো।বিয়ের কথা অনেকটাই পাকাপাকি।রিয়া কিছুই বল্লোনা।তার প্রতিবাদ,প্রতিহত করার শক্তি নেই।মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছে না।রাফি তাকে ছেড়ে চলে গেছে।এতদিনের মায়াবী মধুর সম্পর্কের শেষটা যে এভাবেই বিচ্ছেদে কাটবে তা কখনো কল্পনাও করেনি রিয়া।রাফি এরকম করতে পারলো?একবারো যোগাযোগ করছেনা!
বিয়ের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেল।রিয়া অঝোরে কাঁদছে,যাকে বলে চোখের জল আর নাকের জলে একাকার হয়ে যাওয়া।
তবুও শপিং করতে হচ্ছে।শত হোক মা বাবাকে তো আর কষ্ট দেয়া যায় না।যেখানে রাফিরই খোঁজ নেই!সেখানে সে আর কি করতে পারে!বিয়ের পীড়িতে বসতেও এখন সে আর দ্বিধা করবেনা।প্রবল জেদ কাজ করলো তার মাঝে।
বিয়ে হয়ে গেল।দুজনের নতুন জীবনে কিংবা জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটলো।নতুন বর সোহেল এখনো বাসরঘরে প্রবেশ করেনি।রিয়ার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।রাফির সমস্ত স্মৃতি মস্তিষ্ক আর হৃদয়কে কাবু করে দিচ্ছে।এমন সময় ঘরের জানালায় টোকা পড়লো
-আপু,রিয়া আপু,আমি হাসান।প্লিজ জানালাটা খুলো।
রিয়া জানালা খুললো।হাসান একনাগাড়ে বললো
-তুমি চুপিচুপি পিছনের গেইট টা দিয়ে বাইরে আসো।রাফি ভাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।বাসের টিকিটসহ সমস্ত কিছু রেডি করা আছে।তোমরা প্রথমে ঢাকা যাবে।
রিয়া কিছুই বিশ্বাস করতে পাচ্ছে না।
তবুও কোনো এক অলৌকিক শক্তির বলে সবরকমের জড়তা,লজ্জা আর ভয় ভুলে গিয়ে এক দৌড়ে সে বাইরে বেরিয়ে আসলো।রাফি এক মুহূর্তও দেরি করলো না।রিয়ার হাতে জোরে একটা টান দিয়ে কাছে নিয়ে আসলো।রিয়ার মুখ আর রাফির মুখ খুব কাছাকাছি।তাদের চোখের দূরত্বও কম।দুজনের ঠোট নড়ছেনা।কেবল অপলক তাকিয়ে থেকে নিজেদের দেখে নিল কিছুক্ষণ।
পেছন থেকে হাসান ডাক দিল
-আরে ভাই,এখন দাঁড়িয়ে থাকার সময় নাই।গাড়িতে উঠেন।
ওরা পালিয়ে গেলো।
গাড়ির মধ্যে রিয়া আর রাফি আবার ঝগড়া করছে
-আমি ছিলাম না বলে বিয়ে বসে পড়লা!একবারও মনে পড়লোনা আমার কথা!
-তো,কি করবো!দেবদাসী সেজে বসে থাকবো!কোন দেশে গেছিলা তুমি?কম কষ্ট দিছ আমাকে?তোমার সাথে পালালাম কেন যে নিজেই বুঝলাম না!
-তুমি আমাকে কম কষ্ট দিছ?ব্রেকাপ করে দিছিলা!
-তো কি হইছে!আমি তো ওমন করি ই।তাই বলে তুমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবা!
-আমার ফোনটা গেছে চুরি হয়ে।আর আমি একটা বিশেষ কাজে চিটাগাং গিয়েছিলাম।তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি,ভাবছি একেবারে ঢাকায় ফিরে সারপ্রাইজ দিয়ে রাগ ভাঙাবো।
-হ্যা,হ্যা।আমার রাগ তো তোমার কাছে কিছুই না।আমার এদিকে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।আর আপনার কোনো…
হাসান হঠাৎ সামনে থেকে বলে উঠলো
-আরে তোমরা থামবে?নাকি এখানেই ছেড়ে দিবো দুজনকে?এই মাঝপথে!
রিয়া আদুরে গলায় নরম সুরে রাফিকে জিজ্ঞাসা করলো-
কি সারপ্রাইজ দিতা আমাকে?
রাফি জবাবা দিলো না।
-আমি যদি না বের হয়ে আসতাম আজ!বাসরঘর থেকে না পালাতাম!
-আমি জানি তুমি পালাইতা।
-কেন?কেমনে জানো?
-ভালোবাসো যে।এইজন্যে।
-হু।আমি একাই বাসি।তুমি তো বাসো না।
একথা বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো রিয়া।
রাফি আচমকা রিয়াকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বল্লো
-শুনেন,সারপ্রাইজ টা হলো আমার সাথেই আপনার বিয়ে হয়েছে।
-কিহ!তোমার সাথে বিয়ে হলো কিভাবে?বিয়ে তো হলো সোহেলের সাথে!
-উহু।আপনি ভালো করে ভেবে বলুন তো ঐ সোহেল টা কে?
-কে আবার!সোহেল।যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেন।আজ যার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসলাম।
-একটা গাধী!ঐদিন আমি আর আমার বাবা মা-ই গিয়েছিলাম তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে।আর আমি এর আগেরদিনই এপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছি।আর আমার নামটা কি ভুলে গেছেন-সোহেল আরমান রাফি?আর তুমি কি শুনোনি-কাজী সাহেব আমার নাম,বাবার নাম সবকিছুই জোরে জোরে বললেন!
-আমি কিছুই শুনিনি ভালো করে,তোমার কথাই ভাবছিলাম আর কাঁদছিলাম।আর শুধু 'কবুল'বলার সময় অনেক কষ্ট করে মুখ খুললাম মা-বাবার কথাটা ভেবে।আমার মন তো তোমাকেই খুঁজছিল।
রিয়ার কিছু বিশ্বাস হচ্ছেনা।সে কেঁদে ফেললো।এইটা আনন্দের অশ্রু।অতিরিক্ত অবাক হওয়ার ফলে নির্গত অশ্রু।রিয়াও জড়িয়ে ধরলো রাফিকে।রাফির বুকে মুখ গুজে ফেললো।রাফিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
-তাহলে আমরা পালালাম কেনো?সবাই কি বলবে?তোমার মা বাবাই বা কি বলবে!
-মিসেস,শুনোন।সবাই জানে।আমি সবাইকে আগেই বলেছি।আর আপনি যে সত্যিই কিছু ধরতে পারেননি তা ভেবে অবাক হয়েছি।এত গাধী টাইপের একটা মেয়েকে নিয়ে কিভাবে সারাজীবন কাটাবো!
রিয়া আর কোনো কথা বলছেনা।সে যেনো তার হৃদস্পন্দন খুঁজে পেয়েছে।তার দেহের রক্তস্রোতে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে।সে কি করছিল!যদি সত্যি সত্যিই অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যেত!নাহ।হতো না।এই অদ্ভুত ছেলে রাফিই তার ভাগ্যে ছিল।সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
রাফি পরম আদরে রিয়াকে লুফে নিল বুকের ভিতর।অলৌকিক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার হৃদয় জুড়ে।গাড়ি চলছে ঢাকার পথে।জোছনা রাত।চারিদিকে চাঁদের রুপালী আলো।মায়াবী আলো।তারার নীল আলো।সমগ্র শহর উজ্জ্বল।পৃথিবী যেন একটা মায়াবী নীল গ্রহ,যেখানে মানুষ মানুষকে প্রচন্ড ভালোবাসতে জানে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
অচিন্ত্য সরকার [পাষাণভেদী] ২০/০৪/২০২১খুনসুটিতে শুরু করে উপভোগ্য উপসংহার.....
-
তরুন ইউসুফ ১৮/০৩/২০২১বাহ
-
সাখাওয়াত হোসেন ১৭/০৩/২০২১দারুণ ভাবনার বহিঃপ্রকাশ
-
ফয়জুল মহী ১৭/০৩/২০২১গভীর অনুভূতির অনন্য অসাধারণ প্রকাশ। পাঠে অপার মুগ্ধতা।