রবিঠাকুরের চশমা
গুরুজি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল।বয়স প্রায় দেড়শোর কোঠায়।বেশ সুফি টাইপের চেহারা।
দীর্ঘদিন আগেই তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
আজ আকস্মিক তাঁর দেখা পেয়ে বেশ অভিভূতই হয়েছি।
আমি ছুটে গিয়ে রবিঠাকুরের সামনে দাঁড়ালাম।তিনি লম্বা সাইজের পাউরুটির পিস এক কাপ পানিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন।টং দোকানে ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে।রবিঠাকুর বলে কথা!তিনি যেখানে যাবেন সেখানে ভক্তবৃন্দের ভিড় জমবে না এমনটা ভাবাও যায়না।
আজকাল নাকি গুরুজি চা খাননা।ডায়াবেটিস হয়েছে।ব্লাডে সুগারের নৃত্য উর্দ্ধমুখী।তাই ডাক্তার চিনি নিষেধ করে দিয়েছেন।তিনি তাই ভক্তদের প্রায়শই বলেন,
"বুঝলে তোমরা,চিনি ছাড়া চা পান করা বড়ই বোকামো।চিনিবিহীন চা হলো অমিষ্ট মধু তথা ভেজাল মধুর মতো অখাদ্য।এর চেয়ে পরিষ্কার সাদা জল পান করাই ঢের উত্তম।"
শিষ্যরা ঘিরে রাখায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে দেখার ফুরসতই পান নি গুরুজি।
আমিই আগ বাড়িয়ে জটলা অতিক্রম করে কাছে চললাম।উনার অন্যান্য ভক্তরা আমার দিকে কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো।
এবার রবিঠাকুর আমার উপস্থিতি বোধহয় টের পেলেন।আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন।তবে চোখে বোধহয় ঠিকঠাক দেখেননা ইদানীং।চশমার ভেতর থেকে দেখেও আমাকে চিনলেননা।
"দাদা,আমি হাসান।আপনার পেছন পেছন বেশ কদিন থেকেছি।আপনার কাছ থেকে সাহিত্যপাঠ শিখেছি।"
আমি বেশ জোরেই বলে উঠি।
"ও তাই বলো।তো আছ কেমন?"
রবিঠাকুর আমাকে চিনতে পারলেন।
"ভালো,দাদা।"
"আমি বুড়িয়ে গেছি।চোখের জ্যোতিও খুব একটা ভাল নেই।দু'বার সার্জারি করিয়েছি,তবুও কোনো উন্নতি টের পেলুম না।তোমাকে প্রথম দেখায় ঠিক চিনে উঠতে পারিনি।"
"তা বলতে হবে না,গুরুজি।বয়স তো আর কম হলো না।আর কত জ্যোতি থাকবে চোখে?"
"তা যা বলেছ।খাসা বলেছ।"
"দাদাজি,বাতাসে খবর ভাসছে,আপনি নাকি গৃহত্যাগ করে এ বয়সে সন্নাসব্রতে নেমে পড়বেন?দেশ-বিদেশ ঘুরবেন?"
"ঠিক সন্ন্যাসব্রতে নাবছিনা।তবে একটা নিগূঢ় উদ্দেশ্যেই বিদেশ পাড়ি দেবো।"
"নর্থ আমেরিকায় নাকি যাবেন?"
পাশ থেকে গুরুজির এক ভক্ত বলে উঠলো,"আরে না না।ঠাকুরঝি তো বিলেত যাচ্ছেন।"
রবিদা কিছুক্ষণ কাশলেন,অতি বৃদ্ধরা যেভাবে কাশেন।এরপর লাঠিটা শক্ত করে মাটিতে ঠেক দিয়ে ধীরেধীরে উঠে দাঁড়ালেন।তারঁ শরীরের কাঁপুনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা বয়স হয়ে গেছে!
চশমাটা খুলে আমার হাতে দিলেন।দীর্ঘনিঃশ্বাস আর গম্ভীরতার পর্ব শেষ করে বেশ আবেগআপ্লুত কন্ঠে আকাশ পানে তাকিয়ে বললেন,
'জীবনে যেখানে গিয়েছি ভালবাসা দিয়েছি।ভালবাসার কথা বলেছি।প্রত্যুত্তরে ভালোবাসা পেয়েছিও।সব জায়গাতেই প্রেয়সী রয়ে গেছে আমার।ওরা আমাকে ভালবেসেছে।"
"তো দাদা।এখন যাবেন কোথায়?কার কাছে?"
"প্রথমে পাড়ি দেবো নর্থ আমেরিকায়।ওখানে এক প্রণয়িনী ছিল।"
"তারপর?"
"ইউরোপে এরপর আমার এক প্রিয়তমার সন্ধান করব।যার সাথে দেখা হয়েছিল বছর ষাটেক আগে,শ্রাবণ মাসের এক বরষায়।"
"গুরুজি,তা বুঝলাম।তবে আপনার ভালবাসার মানুষেরা কি আজো বেঁচে আছে?"
"কি বল তুমি?থাকবেনা কেন?জানোনা হে বৎস,ভালবাসা অমর,চিরন্তন?"
"গুরু,মানুষ তো আর অমর নয়।"
"এইটেও ভুল ধারণা।মানুষের জীবনের শেষ নেই।মৃত্যুর পর তো আরেক জীবনই পায় মানুষ।"
"ঐ জীবনেও ভালবাসা আছে কি?"
"আছে বৈকি,পরজীবনের ভালবাসার গভীরতা ইহজগতের চেয়ে আরো বেশী।"
"আপনিই বা কদিন বাঁচবেন গুরুজি?"
"ওহে,তুমি কি জানোনা ভালবাসা সময়,স্থান,কাল,পাত্র অভেদ।ভালবাসাই তো জগতের ভিত্তি।ভালবাসাই ইহকাল-পরকালের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।আর এই ভালবাসার কাছেই আমার মৃত্যু হবে মিথ্যা।"
এরপর কিছুক্ষণ নিরবতার পর রহস্যময় গলায় আবৃত্তি করলেন,
"আমি জানি, যাব যবে
সংসারের রঙ্গভূমি ছাড়ি,
সাক্ষ্য দেবে পুষ্পবন ঋতুতে ঋতুতে
এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি।
এ ভালোবাসাই সত্য, এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।"
আমি শুনলাম।বরাবরের মত বিমুগ্ধ বনে গেলাম তার চেয়েও বেশী অভিভূত হলাম।আমার অন্তরের আদ্যোপান্তে জীবনের গভীরতমবোধের জোয়ার কিংবা মৌসুমি প্রবাহ বইল।আমি এ মনীষীর দিকে আর তাকালাম না।
নিরবে সরে এলাম।
ভক্তরা রবিঠাকুরের কবিতা মন দিয়ে শুনছে,কারো চোখে পানির ঝিলিকও দেখতে পারি।
আমি বেশ জোরেশোরেই হাঁটা শুরু করি।
একটু দূর যেতেই মনে পড়ে গুরুজির চশমাটার কথা।ভুলে,বিভ্রমে,অতি আবেগ আর বেখেয়ালে চশমাখানা হাতে করেই নিয়ে চলে এসেছি।গুরুজি হয়ত হন্যে হয়ে খুঁজবেন।পরে একটা নতুন নিয়েও নিতে পারবেন।থাক এটা আমার কাছেই।আমার কাছে না হয় ভালবাসার নিদর্শন হয়েই চশমাখানা রয়ে গেল"
----০-----
দীর্ঘদিন আগেই তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
আজ আকস্মিক তাঁর দেখা পেয়ে বেশ অভিভূতই হয়েছি।
আমি ছুটে গিয়ে রবিঠাকুরের সামনে দাঁড়ালাম।তিনি লম্বা সাইজের পাউরুটির পিস এক কাপ পানিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন।টং দোকানে ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে।রবিঠাকুর বলে কথা!তিনি যেখানে যাবেন সেখানে ভক্তবৃন্দের ভিড় জমবে না এমনটা ভাবাও যায়না।
আজকাল নাকি গুরুজি চা খাননা।ডায়াবেটিস হয়েছে।ব্লাডে সুগারের নৃত্য উর্দ্ধমুখী।তাই ডাক্তার চিনি নিষেধ করে দিয়েছেন।তিনি তাই ভক্তদের প্রায়শই বলেন,
"বুঝলে তোমরা,চিনি ছাড়া চা পান করা বড়ই বোকামো।চিনিবিহীন চা হলো অমিষ্ট মধু তথা ভেজাল মধুর মতো অখাদ্য।এর চেয়ে পরিষ্কার সাদা জল পান করাই ঢের উত্তম।"
শিষ্যরা ঘিরে রাখায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে দেখার ফুরসতই পান নি গুরুজি।
আমিই আগ বাড়িয়ে জটলা অতিক্রম করে কাছে চললাম।উনার অন্যান্য ভক্তরা আমার দিকে কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো।
এবার রবিঠাকুর আমার উপস্থিতি বোধহয় টের পেলেন।আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন।তবে চোখে বোধহয় ঠিকঠাক দেখেননা ইদানীং।চশমার ভেতর থেকে দেখেও আমাকে চিনলেননা।
"দাদা,আমি হাসান।আপনার পেছন পেছন বেশ কদিন থেকেছি।আপনার কাছ থেকে সাহিত্যপাঠ শিখেছি।"
আমি বেশ জোরেই বলে উঠি।
"ও তাই বলো।তো আছ কেমন?"
রবিঠাকুর আমাকে চিনতে পারলেন।
"ভালো,দাদা।"
"আমি বুড়িয়ে গেছি।চোখের জ্যোতিও খুব একটা ভাল নেই।দু'বার সার্জারি করিয়েছি,তবুও কোনো উন্নতি টের পেলুম না।তোমাকে প্রথম দেখায় ঠিক চিনে উঠতে পারিনি।"
"তা বলতে হবে না,গুরুজি।বয়স তো আর কম হলো না।আর কত জ্যোতি থাকবে চোখে?"
"তা যা বলেছ।খাসা বলেছ।"
"দাদাজি,বাতাসে খবর ভাসছে,আপনি নাকি গৃহত্যাগ করে এ বয়সে সন্নাসব্রতে নেমে পড়বেন?দেশ-বিদেশ ঘুরবেন?"
"ঠিক সন্ন্যাসব্রতে নাবছিনা।তবে একটা নিগূঢ় উদ্দেশ্যেই বিদেশ পাড়ি দেবো।"
"নর্থ আমেরিকায় নাকি যাবেন?"
পাশ থেকে গুরুজির এক ভক্ত বলে উঠলো,"আরে না না।ঠাকুরঝি তো বিলেত যাচ্ছেন।"
রবিদা কিছুক্ষণ কাশলেন,অতি বৃদ্ধরা যেভাবে কাশেন।এরপর লাঠিটা শক্ত করে মাটিতে ঠেক দিয়ে ধীরেধীরে উঠে দাঁড়ালেন।তারঁ শরীরের কাঁপুনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা বয়স হয়ে গেছে!
চশমাটা খুলে আমার হাতে দিলেন।দীর্ঘনিঃশ্বাস আর গম্ভীরতার পর্ব শেষ করে বেশ আবেগআপ্লুত কন্ঠে আকাশ পানে তাকিয়ে বললেন,
'জীবনে যেখানে গিয়েছি ভালবাসা দিয়েছি।ভালবাসার কথা বলেছি।প্রত্যুত্তরে ভালোবাসা পেয়েছিও।সব জায়গাতেই প্রেয়সী রয়ে গেছে আমার।ওরা আমাকে ভালবেসেছে।"
"তো দাদা।এখন যাবেন কোথায়?কার কাছে?"
"প্রথমে পাড়ি দেবো নর্থ আমেরিকায়।ওখানে এক প্রণয়িনী ছিল।"
"তারপর?"
"ইউরোপে এরপর আমার এক প্রিয়তমার সন্ধান করব।যার সাথে দেখা হয়েছিল বছর ষাটেক আগে,শ্রাবণ মাসের এক বরষায়।"
"গুরুজি,তা বুঝলাম।তবে আপনার ভালবাসার মানুষেরা কি আজো বেঁচে আছে?"
"কি বল তুমি?থাকবেনা কেন?জানোনা হে বৎস,ভালবাসা অমর,চিরন্তন?"
"গুরু,মানুষ তো আর অমর নয়।"
"এইটেও ভুল ধারণা।মানুষের জীবনের শেষ নেই।মৃত্যুর পর তো আরেক জীবনই পায় মানুষ।"
"ঐ জীবনেও ভালবাসা আছে কি?"
"আছে বৈকি,পরজীবনের ভালবাসার গভীরতা ইহজগতের চেয়ে আরো বেশী।"
"আপনিই বা কদিন বাঁচবেন গুরুজি?"
"ওহে,তুমি কি জানোনা ভালবাসা সময়,স্থান,কাল,পাত্র অভেদ।ভালবাসাই তো জগতের ভিত্তি।ভালবাসাই ইহকাল-পরকালের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।আর এই ভালবাসার কাছেই আমার মৃত্যু হবে মিথ্যা।"
এরপর কিছুক্ষণ নিরবতার পর রহস্যময় গলায় আবৃত্তি করলেন,
"আমি জানি, যাব যবে
সংসারের রঙ্গভূমি ছাড়ি,
সাক্ষ্য দেবে পুষ্পবন ঋতুতে ঋতুতে
এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি।
এ ভালোবাসাই সত্য, এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।"
আমি শুনলাম।বরাবরের মত বিমুগ্ধ বনে গেলাম তার চেয়েও বেশী অভিভূত হলাম।আমার অন্তরের আদ্যোপান্তে জীবনের গভীরতমবোধের জোয়ার কিংবা মৌসুমি প্রবাহ বইল।আমি এ মনীষীর দিকে আর তাকালাম না।
নিরবে সরে এলাম।
ভক্তরা রবিঠাকুরের কবিতা মন দিয়ে শুনছে,কারো চোখে পানির ঝিলিকও দেখতে পারি।
আমি বেশ জোরেশোরেই হাঁটা শুরু করি।
একটু দূর যেতেই মনে পড়ে গুরুজির চশমাটার কথা।ভুলে,বিভ্রমে,অতি আবেগ আর বেখেয়ালে চশমাখানা হাতে করেই নিয়ে চলে এসেছি।গুরুজি হয়ত হন্যে হয়ে খুঁজবেন।পরে একটা নতুন নিয়েও নিতে পারবেন।থাক এটা আমার কাছেই।আমার কাছে না হয় ভালবাসার নিদর্শন হয়েই চশমাখানা রয়ে গেল"
----০-----
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মাহমুদুর রহমান চৌধুরী ফাহিম ০৪/০৮/২০২০কি যে সুন্দর লেখনী
-
কুমারেশ সরদার ০১/০৮/২০২০চমৎকার
-
আব্দুর রহমান আনসারী ৩১/০৭/২০২০উপভোগ্য
-
অভিজিৎ জানা ৩১/০৭/২০২০খুব সুন্দর!
-
ফয়জুল মহী ৩০/০৭/২০২০অসাধারণ l