মানবতা যেখানে ভূলুণ্ঠিত
বছর না ঘুরতেই রাখাইন অঞ্চলে ফের শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা নিধন। 'আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভ্যাশন আর্মি'র কথিত হামলার প্রতিশোধ গ্রহণে মরিয়া হয়ে উঠেছে সেখানকার সামরিক বাহিনী। গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলিম নর-নারীর উপর। বর্বর নির্যাতন ও গুলির ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পালাচ্ছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সুচি এই নৃশংস গণহত্যাকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে 'ক্লিয়ারেন্স অপারেশন' হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানকেও তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এ থেকেই এটা স্পষ্ট যে দেশটির সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী রাষ্ট্রীয় মদদেই পরিকল্পিতভাবে নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। শান্তিতে নোবেলজয়ীর দেশেই আজ শান্তির বড় অভাব! আতঙ্ক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত যেন তাদের গায়ে স্থায়ী ছাচ ঢালাই করে দিয়েছে মিয়ানমার সেনাসদস্য।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কফি আনানের নেতৃত্বে নয় সদস্য বিশিষ্ট 'অ্যাডভাইজরি কমিশন' ২৪ আগস্ট একটি রিপোর্ট পেশ করে। কমিশনের মতে, বিশ্বের একক বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায় হল রোহিঙ্গা মুসলিম। রিপোর্টে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত ও অবাধ চলাচলের সুযোগসহ মোট ৮৮ টি সুপারিশ করা হয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়। কমিশনের প্রতিটি সুপারশই বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়ন জরুরি। কিন্তু সেখানে যা ঘটছে তাতে মনে হয় না মিয়ানমার সরকার কমিশনের সুপারিশকে গুরুত্বসহ নিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, বর্তমানে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর 'ভয়াবহ' নিপীড়ন চলছে। জাতিসংঘ শরনার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হল রোহিঙ্গা মুসলিম। এতেই অনুমেয়, রোহিঙ্গা সঙ্কট সৃষ্টি ও কৃত্রিম শরনার্থী সঙ্কট তৈরিতে মিয়ানমার সেনা বেশ সিদ্ধহস্ত।
ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, আরাকানের প্রাচীন নাম রূহ্ম জনপদ। সেখানে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫'শ অব্দে পূর্ব ভারত হতে অষ্ট্রিক জাতির একটি শাখা 'কুরুখ' নৃগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন করে। ক্রমান্বয়ে বাঙালি হিন্দু (পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত মুসলিম), পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। এ সকল নৃগোষ্ঠীর শংকরজাত জনগোষ্ঠী হলো এই রোহিঙ্গা। অথচ ইতিহাসকে অস্বীকার করে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের 'বাঙ্গালি' বলা হচ্ছে। বস্তুত রোহিঙ্গারা হল আরাকানের একমাত্র 'ভূমিপুত্র' জাতি। ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কট্টর বৌদ্ধ বর্মীরাজা 'আনাওহতা' আরাকান রাজ্য দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান 'স্বাধীন রাজ্য' ছিল। ১৭৮৫ সালে বর্মীরাজা 'বোদাওফায়া' এই রাজ্য দখল করার পর পুনরায় বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৮২ সালে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১২ সালে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন তাদের বিতাড়নকেই একমাত্র সমাধান বলে উল্লেখ করে। ২০১৫ সালে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বঞ্চিত হতে থাকে একের পর এক সামাজিক ও মৌলিক অধিকার থেকে। ২০১৬ সালের সংঘাতকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অসংখ্য বসতবাড়ি জ্বলসে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। আর এবারের হামলার পর ইতোমধ্যে ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৭৭ সাল থেকে এদেশে প্রায় ৫ লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। বছরের পর বছর এই জাতিগত নিধনের নীতি পরিস্থিতেকে আরও সঙ্কটের দিকে ধাবিতে করছে। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা হাজার বছরের নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। আর রোহিঙ্গাদের এ অস্তিত্ব সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশকে। কিন্তু এই সমস্যার কারণে বাংলাদেশ যে ক্ষতির মুখে পড়েছে, তা বেশিদিন চলতে দেওয়া যায় না।
সাম্প্রতিক এক তথ্যমতে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশা ইয়াবা পাচারেও তাদের বেশ সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও নির্বিচারে বন উজাড় ও পাহাড় কাটার স্পষ্ট অভিযোগও রয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়া জরুরি মনে হচ্ছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ ও তাদের ফিরিয়ে দিয়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রয়োজন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। মিয়ানমার সরকারকেও বোঝা উচিত, আক্রমণাত্মক সামরিক হামলায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সঙ্কট নিরসনে সমস্যার গোড়ায় গিয়ে সমধান খুঁজতে হবে।
সেখানে সমস্যাটা জাতিগত এবং ক্রমেই এই সমস্যা আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানকেও তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এ থেকেই এটা স্পষ্ট যে দেশটির সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী রাষ্ট্রীয় মদদেই পরিকল্পিতভাবে নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। শান্তিতে নোবেলজয়ীর দেশেই আজ শান্তির বড় অভাব! আতঙ্ক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত যেন তাদের গায়ে স্থায়ী ছাচ ঢালাই করে দিয়েছে মিয়ানমার সেনাসদস্য।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কফি আনানের নেতৃত্বে নয় সদস্য বিশিষ্ট 'অ্যাডভাইজরি কমিশন' ২৪ আগস্ট একটি রিপোর্ট পেশ করে। কমিশনের মতে, বিশ্বের একক বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায় হল রোহিঙ্গা মুসলিম। রিপোর্টে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত ও অবাধ চলাচলের সুযোগসহ মোট ৮৮ টি সুপারিশ করা হয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়। কমিশনের প্রতিটি সুপারশই বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়ন জরুরি। কিন্তু সেখানে যা ঘটছে তাতে মনে হয় না মিয়ানমার সরকার কমিশনের সুপারিশকে গুরুত্বসহ নিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, বর্তমানে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর 'ভয়াবহ' নিপীড়ন চলছে। জাতিসংঘ শরনার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হল রোহিঙ্গা মুসলিম। এতেই অনুমেয়, রোহিঙ্গা সঙ্কট সৃষ্টি ও কৃত্রিম শরনার্থী সঙ্কট তৈরিতে মিয়ানমার সেনা বেশ সিদ্ধহস্ত।
ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, আরাকানের প্রাচীন নাম রূহ্ম জনপদ। সেখানে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫'শ অব্দে পূর্ব ভারত হতে অষ্ট্রিক জাতির একটি শাখা 'কুরুখ' নৃগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন করে। ক্রমান্বয়ে বাঙালি হিন্দু (পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত মুসলিম), পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। এ সকল নৃগোষ্ঠীর শংকরজাত জনগোষ্ঠী হলো এই রোহিঙ্গা। অথচ ইতিহাসকে অস্বীকার করে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের 'বাঙ্গালি' বলা হচ্ছে। বস্তুত রোহিঙ্গারা হল আরাকানের একমাত্র 'ভূমিপুত্র' জাতি। ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কট্টর বৌদ্ধ বর্মীরাজা 'আনাওহতা' আরাকান রাজ্য দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান 'স্বাধীন রাজ্য' ছিল। ১৭৮৫ সালে বর্মীরাজা 'বোদাওফায়া' এই রাজ্য দখল করার পর পুনরায় বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৮২ সালে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১২ সালে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন তাদের বিতাড়নকেই একমাত্র সমাধান বলে উল্লেখ করে। ২০১৫ সালে তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বঞ্চিত হতে থাকে একের পর এক সামাজিক ও মৌলিক অধিকার থেকে। ২০১৬ সালের সংঘাতকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অসংখ্য বসতবাড়ি জ্বলসে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। আর এবারের হামলার পর ইতোমধ্যে ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৭৭ সাল থেকে এদেশে প্রায় ৫ লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। বছরের পর বছর এই জাতিগত নিধনের নীতি পরিস্থিতেকে আরও সঙ্কটের দিকে ধাবিতে করছে। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা হাজার বছরের নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। আর রোহিঙ্গাদের এ অস্তিত্ব সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশকে। কিন্তু এই সমস্যার কারণে বাংলাদেশ যে ক্ষতির মুখে পড়েছে, তা বেশিদিন চলতে দেওয়া যায় না।
সাম্প্রতিক এক তথ্যমতে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশা ইয়াবা পাচারেও তাদের বেশ সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও নির্বিচারে বন উজাড় ও পাহাড় কাটার স্পষ্ট অভিযোগও রয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়া জরুরি মনে হচ্ছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ ও তাদের ফিরিয়ে দিয়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রয়োজন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। মিয়ানমার সরকারকেও বোঝা উচিত, আক্রমণাত্মক সামরিক হামলায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সঙ্কট নিরসনে সমস্যার গোড়ায় গিয়ে সমধান খুঁজতে হবে।
সেখানে সমস্যাটা জাতিগত এবং ক্রমেই এই সমস্যা আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন ২৮/০৯/২০১৭ইতিহাস ভিত্তিক লেখাটি পড়ে ভাল লাগলো । বাস্তবসম্মত উপলব্ধি । সবার সুমতি আসুক এই কামনা করি ।
-
আজাদ আলী ২৭/০৯/২০১৭Very good writing.Thanks
-
কামরুজ্জামান সাদ ২৭/০৯/২০১৭Good Article...Best Of Luck...