ইয়োল কিডস্ কার্টুন থেকে ইয়োল জার্নালিজম
সকল ঘটনার শুরু থাকে, কোন এক গুরু থাকে। অতপর সময়ের সাথে বয়ে চলে। একই পানি নানা পাত্রে নানা রঙে।
আমাদের প্রতিদিনকার ব্যবহৃত পন্যের মধ্যে সংবাদও এখন একটি পন্য (অর্থশাস্ত্রে পণ্য বলতে মূল্য আরোপিত সকল কিছুই পণ্য)। আর সেই সংবাদকে জনপ্রিয় পন্যে তৈরী করার পেছনে জড়িয়ে আছে হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস। সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনই হলুদ সাংবাদিকতা। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের সময় জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠে, আর জন্ম নেয় নতুন অধ্যায়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্ট তাদের পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর স্বপ্নে অর্ধ সত্য, মনগড়া ও ভিত্তিহীন খবর ছাপানোর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু করেন। বলা যায় তারই ফসল হলুদ সাংবাদিকতা।
প্রচন্ড দারীদ্রতায় শৈশব কাটানো জোসেফ পুলিৎজার আমেরিকা এসেছিলেন হাঙ্গেরী থেকে। পুলিৎজার ছোটবেলায় রাস্তায় পত্রিকা বিলি করতেন। তার স্বপ্ন ছিল কোন এক সময় একটি পত্রিকা বের করবেন। আর তুলে ধরবেন তার দেখা নির্যাতিত নিপীড়িত দরীদ্রদের সংগ্রামের কথা। সংকল্পের দৃঢ়তা এক সময় পুলিৎজারকে সাংবাদিকতার পথ খুলে দেয় সেন্ট লুইস পত্রিকায়। সংগ্রামি পুলিৎজার সঠিক তথ্য আর দুর্দান্ত উপস্থাপন দিয়ে বেশ পরিচিতি পেয়ে যায়। সমাজের উচু শ্রেনীর ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি তুলে ধরতে থাকেন একের পর এক। এক পর্যায়ে মালিক হন সেন্ট লুইস পোষ্ট ডিসপ্যাথ নামে একটি পত্রিকার। ১৮৮৭ তে ততকালীন সংবাদপত্রের স্বর্গ আমারিকার নিউইয়র্ককে আসেন এবং নিউইয়র্ক ওয়াল্ড নামে একটি পত্রিকা কিনে নেন। সে সময় নিউইয়র্ককে প্রচুর অভিবাসী আসছিল এবং তাদের জীবনযাত্রা ছিল খুবই করুন। পুলিৎজার তার পত্রিকায় সেই সকল বিপদগ্রস্থদের দুংখ দুর্দশার সংবাদ দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। উল্লেখ্য যে সেই সময় পত্রিকা গুলো প্রচন্ড রাজনৈতীক ভাবে প্রভাবিত ছিল। আর ধারনা ছিল সংবাদ হবে সমাজের উচু শ্রেনীর মানুষ। এছাড়া তখনকার শিরানামহীন সংবাদ পরিবেশন পদ্ধতিও ছিল বেশ একঘেয়ে। সকল সংবাদ একই রকম হরফে একের এক দেয়া থাকতো। পুলিৎজার সেই বৃত্ত ভেঙ্গে বের হয়ে আসেন। হেডলাইন, বোল্ড, টাইপোগ্রাফি সহ নতুন হরফ যুক্ত করেন পত্রিকা প্রকাশনায়। পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের কাটতি বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সে সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তি বুনে যায়।
নিউইয়র্ক থেকে দুইশত মাইল দূরে কেমব্রিজে বসে এই সফলতা পর্যাবেক্ষন করছিলেন উইলিয়াম রুডলফ হার্স্ট। ধনী পরিবারে হার্স্ট সবসময় ছিলেন উচ্চ বিলাশী। পত্রিকা ব্যবসায় আগ্রহী হার্স্ট ১৮৮৭ তে তার বাবা পত্রিকা সানফ্রান্সিস্কো এক্সামিনারের দ্বায়িত্ব নেন। নিম্নমানের খবরে জন্য পত্রিকাটির ছিল বাজে পরিস্থিতি। হার্স্ট দ্বায়িত্ব নেবার পর পুলিৎজারের পথ ধরে নতুন রূপ দেন পত্রিকাটির। সাথে যুক্ত করেন মিথ্যা, মনগড়া নানা সংবাদ। সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলাম জুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম, ছবি আর কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার, ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, বিজ্ঞানমূলক সংবাদ আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনা। এরপর হার্স্ট নিউইয়র্ক আসেন তা আদর্শ গুরু পুলিৎজার সাথে প্রতিযোগিতা করতে।
জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। পুলিৎজার প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছেন, তবে খেটে খাওয়া মানুষদের কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু হার্স্টের ভাবনা ছিল শুধু নিজেকে নিয়ে, শুধু প্রভাবশালী হওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। হার্স্ট নিউইয়র্ক এসে নিউইয়র্ক জার্নাল নামে একটা সস্তা পত্রিকা কিনে নেয়। সাথে পুলিৎজার পত্রিকার সেরা কর্মীদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিজের পত্রিকায় নিয়ে আসেন। এদিকে সেই সময় পুলিৎজার নিউইয়র্কের বাইরে ছিলেন, তাই হার্স্টেরর জন্য কাজটি সহজ ছিল। হার্স্ট তার পত্রিকার হেডলাইনে নিয়ে আসেন আপরাধ ও স্কান্ডাল জাতীয় সংবাদ। সাথে যুক্ত করেন আবারও মিথ্যা, মনগড়া নানা সংবাদ, সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলাম জুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম, ছবি আর কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার, ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম ইত্যাদি। তিন মাসে পত্রিকাটি সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হার্স্ট তার পত্রিকার দাম কমিয়ে দেন। পুলিৎজারের আট পৃষ্ঠার পত্রিকা যখন দুই সেন্ট তখন হার্স্টের ষোল পৃষ্ঠার পত্রিকা এক সেন্ট। পুলিৎজারের পত্রিকা হার্স্টের পত্রিকার কাছে ধরাশায়ী হয়ে পরে। পুলিৎজার বেশ ভেঙ্গে পরেন হার্স্টের ধূর্তার কাছে।
সাংবাদিকরা তখন তারকার সমপর্যায়ের ছিলেন। পাঠকরা পত্রিকা কিনতো সেই তারকারা কি লিখছেন তা জানার জন্য। আরথার ব্রিজবেন ছিলেন সে সময় সেরা সাংবাদিকের একজন। যিনি কাজ করতেন পুলিৎজারে পত্রিকায়। সে সময় রিচার্ড ফেন্টো নামে একজন কার্টুনিষ্ট পুলিৎজারের পত্রিকার প্রথম পাতায় কার্টুন আঁকতো। যা ইয়োল কিটস্ বা হলুদ বালক নামে পরিচিত। এই কার্টুনের মাধ্যমে পুলিৎজার সমাজে অসংগতি সহ এমন কিছু বলিয়ে নেয়া শুরু করলেন যা খুব পক্ষপাত দুষ্ট। পরবর্তিতে হার্স্ট এই দুই সাংবাদিককে বড় অর্থের বিনিময়ে নিজ পত্রিকায় নিয়ে নেন। পুলিৎজার বাধ্য হয়ে জর্জ লুকাস নামে আর একজন কার্টুনিষ্টকে নিয়োগ দেন। এরপর থেকে দুজনের পত্রিকাতেই আকা শুরু হয়ে গেল ইয়োল কিটস্ কার্টুন। শুরু হলো দুটি পত্রিকার মধ্যে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব।
ইয়োল কিডস্ কার্টুনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা উদ্দেশ্য প্রণোদিত, মনগড়া, অর্ধ সত্য খবরই ইয়োল জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা নামে পরিচিত হতে থাকে। নষ্ট মানসিকতা সম্পন্ন পাঠক শ্রেনী লুফে নেয় এই সংবাদ। যারা সবসময় চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী, ভিত্তিহীন, অর্ধ সত্য সংবাদই পছন্দ করে এবং এ নিয়ে চর্চায় তৃপ্তি পায়। ১৮৯৮ সালে কিউবার হাভানায় নোঙ্গর ফেলা একটি ইউএস মেরিন জাহাজে আকর্ষিক বিস্ফোরনে প্রায় আড়াইশো আমেরিকান নাবিক মারা যায়। হার্স্ট তার পত্রিকায় ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই ঘটনাকে স্পেনের ষড়যন্ত্র হিসাবে প্রমান করেন। যার ফলে আমেরিকা এই সংবাদ প্রকাশের দুই মাসের মাথায় স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। তখন পুলিৎজারও নিরুপায় হয়ে হার্স্টের মত ভূয়া সংবাদের দিকে ঝুকে পরে। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ দুজনের জন্য একটি লাভজনক ঘটনায় পরিনত হয়। দুজনেরই গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
মূলত পত্রিকা বিলি করত পথ শিশুরা। তাদের ডাকা হতো নিউজি। যুদ্ধকালীন সময়ে নিউজিরা একশত পত্রিকা কিনতো পঞ্চাশ সেন্টে। যুদ্ধ শেষে পুলিৎজার এবং হার্স্ট একত্রে নিউজিদের বিপক্ষে কঠোর অবস্থানে যান। তারা সে সময় নিউজিদের অবিক্রিত পত্রিকার মূল্য ফেরত ব্যবস্থা বাতিল সহ, নিউজিদের কাছে একশ পত্রিকার বিক্রয় মূল্য নির্ধারন করেন ষাট সেন্ট। তারপর নিউজিরা আন্দলনে গেলে পত্রিকা দুটির বিলি ব্যাবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। দুই প্রভাবশালী পত্রিকা তাদের মালিকের লোভ আর নিষ্ঠুরতার জন্য থমকে দাড়ায়।
পরবর্তিতে পুলিৎজার অনুশোচিত হন, কারন তিনি এক সময় নিউজি ছিলেন। অবশেষে ১৮৯৯ তে দুইজনই অবিক্রিত পত্রিকার মূল্য নিউজিদের ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে আবার সচল অবস্থায় ফিরে আসে।
অর্থ আর ক্ষমতার লোভে পুলিৎজার যা করেছিলেন তার জন্য সে অনুতপ্ত হন। কলিম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দুই মিলিয়ন ডলার দান করেন সাংবাদিকতা বিষয়ে শিক্ষা দানের জন্য। কলাম্বিয়া স্কুল অফ জার্নালিজম পরবর্তিতে সাংবাদিকতা শিক্ষার প্রধান ক্ষেত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯১১ তে তার মৃত্যুর পর থেকে পুলিৎজার পুরস্কার প্রবর্তিত আছে।
হার্স্ট এদিকে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তিতে হলিউডেও প্রতিষ্ঠিত হন। সিটিজেন কেন হার্স্টের উপর নির্মিত চলচিত্র। ছবি বানিয়েছেন ওয়াটসন ওয়েলস।
এটা ঠিক যে, এই দুই মহারথীর লোভের কারনে তিক্ত লড়াইয়ের মাঝে সংবাদের বিপ্লব সাধিত হয়। আজকের যে আধুনিক গনমাধ্যম, তার রূপরেখা জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি।
আমাদের প্রতিদিনকার ব্যবহৃত পন্যের মধ্যে সংবাদও এখন একটি পন্য (অর্থশাস্ত্রে পণ্য বলতে মূল্য আরোপিত সকল কিছুই পণ্য)। আর সেই সংবাদকে জনপ্রিয় পন্যে তৈরী করার পেছনে জড়িয়ে আছে হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস। সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনই হলুদ সাংবাদিকতা। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের সময় জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠে, আর জন্ম নেয় নতুন অধ্যায়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্ট তাদের পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর স্বপ্নে অর্ধ সত্য, মনগড়া ও ভিত্তিহীন খবর ছাপানোর এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু করেন। বলা যায় তারই ফসল হলুদ সাংবাদিকতা।
প্রচন্ড দারীদ্রতায় শৈশব কাটানো জোসেফ পুলিৎজার আমেরিকা এসেছিলেন হাঙ্গেরী থেকে। পুলিৎজার ছোটবেলায় রাস্তায় পত্রিকা বিলি করতেন। তার স্বপ্ন ছিল কোন এক সময় একটি পত্রিকা বের করবেন। আর তুলে ধরবেন তার দেখা নির্যাতিত নিপীড়িত দরীদ্রদের সংগ্রামের কথা। সংকল্পের দৃঢ়তা এক সময় পুলিৎজারকে সাংবাদিকতার পথ খুলে দেয় সেন্ট লুইস পত্রিকায়। সংগ্রামি পুলিৎজার সঠিক তথ্য আর দুর্দান্ত উপস্থাপন দিয়ে বেশ পরিচিতি পেয়ে যায়। সমাজের উচু শ্রেনীর ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি তুলে ধরতে থাকেন একের পর এক। এক পর্যায়ে মালিক হন সেন্ট লুইস পোষ্ট ডিসপ্যাথ নামে একটি পত্রিকার। ১৮৮৭ তে ততকালীন সংবাদপত্রের স্বর্গ আমারিকার নিউইয়র্ককে আসেন এবং নিউইয়র্ক ওয়াল্ড নামে একটি পত্রিকা কিনে নেন। সে সময় নিউইয়র্ককে প্রচুর অভিবাসী আসছিল এবং তাদের জীবনযাত্রা ছিল খুবই করুন। পুলিৎজার তার পত্রিকায় সেই সকল বিপদগ্রস্থদের দুংখ দুর্দশার সংবাদ দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। উল্লেখ্য যে সেই সময় পত্রিকা গুলো প্রচন্ড রাজনৈতীক ভাবে প্রভাবিত ছিল। আর ধারনা ছিল সংবাদ হবে সমাজের উচু শ্রেনীর মানুষ। এছাড়া তখনকার শিরানামহীন সংবাদ পরিবেশন পদ্ধতিও ছিল বেশ একঘেয়ে। সকল সংবাদ একই রকম হরফে একের এক দেয়া থাকতো। পুলিৎজার সেই বৃত্ত ভেঙ্গে বের হয়ে আসেন। হেডলাইন, বোল্ড, টাইপোগ্রাফি সহ নতুন হরফ যুক্ত করেন পত্রিকা প্রকাশনায়। পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের কাটতি বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সে সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তি বুনে যায়।
নিউইয়র্ক থেকে দুইশত মাইল দূরে কেমব্রিজে বসে এই সফলতা পর্যাবেক্ষন করছিলেন উইলিয়াম রুডলফ হার্স্ট। ধনী পরিবারে হার্স্ট সবসময় ছিলেন উচ্চ বিলাশী। পত্রিকা ব্যবসায় আগ্রহী হার্স্ট ১৮৮৭ তে তার বাবা পত্রিকা সানফ্রান্সিস্কো এক্সামিনারের দ্বায়িত্ব নেন। নিম্নমানের খবরে জন্য পত্রিকাটির ছিল বাজে পরিস্থিতি। হার্স্ট দ্বায়িত্ব নেবার পর পুলিৎজারের পথ ধরে নতুন রূপ দেন পত্রিকাটির। সাথে যুক্ত করেন মিথ্যা, মনগড়া নানা সংবাদ। সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলাম জুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম, ছবি আর কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার, ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, বিজ্ঞানমূলক সংবাদ আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনা। এরপর হার্স্ট নিউইয়র্ক আসেন তা আদর্শ গুরু পুলিৎজার সাথে প্রতিযোগিতা করতে।
জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। পুলিৎজার প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছেন, তবে খেটে খাওয়া মানুষদের কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু হার্স্টের ভাবনা ছিল শুধু নিজেকে নিয়ে, শুধু প্রভাবশালী হওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। হার্স্ট নিউইয়র্ক এসে নিউইয়র্ক জার্নাল নামে একটা সস্তা পত্রিকা কিনে নেয়। সাথে পুলিৎজার পত্রিকার সেরা কর্মীদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিজের পত্রিকায় নিয়ে আসেন। এদিকে সেই সময় পুলিৎজার নিউইয়র্কের বাইরে ছিলেন, তাই হার্স্টেরর জন্য কাজটি সহজ ছিল। হার্স্ট তার পত্রিকার হেডলাইনে নিয়ে আসেন আপরাধ ও স্কান্ডাল জাতীয় সংবাদ। সাথে যুক্ত করেন আবারও মিথ্যা, মনগড়া নানা সংবাদ, সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলাম জুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম, ছবি আর কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার, ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম ইত্যাদি। তিন মাসে পত্রিকাটি সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হার্স্ট তার পত্রিকার দাম কমিয়ে দেন। পুলিৎজারের আট পৃষ্ঠার পত্রিকা যখন দুই সেন্ট তখন হার্স্টের ষোল পৃষ্ঠার পত্রিকা এক সেন্ট। পুলিৎজারের পত্রিকা হার্স্টের পত্রিকার কাছে ধরাশায়ী হয়ে পরে। পুলিৎজার বেশ ভেঙ্গে পরেন হার্স্টের ধূর্তার কাছে।
সাংবাদিকরা তখন তারকার সমপর্যায়ের ছিলেন। পাঠকরা পত্রিকা কিনতো সেই তারকারা কি লিখছেন তা জানার জন্য। আরথার ব্রিজবেন ছিলেন সে সময় সেরা সাংবাদিকের একজন। যিনি কাজ করতেন পুলিৎজারে পত্রিকায়। সে সময় রিচার্ড ফেন্টো নামে একজন কার্টুনিষ্ট পুলিৎজারের পত্রিকার প্রথম পাতায় কার্টুন আঁকতো। যা ইয়োল কিটস্ বা হলুদ বালক নামে পরিচিত। এই কার্টুনের মাধ্যমে পুলিৎজার সমাজে অসংগতি সহ এমন কিছু বলিয়ে নেয়া শুরু করলেন যা খুব পক্ষপাত দুষ্ট। পরবর্তিতে হার্স্ট এই দুই সাংবাদিককে বড় অর্থের বিনিময়ে নিজ পত্রিকায় নিয়ে নেন। পুলিৎজার বাধ্য হয়ে জর্জ লুকাস নামে আর একজন কার্টুনিষ্টকে নিয়োগ দেন। এরপর থেকে দুজনের পত্রিকাতেই আকা শুরু হয়ে গেল ইয়োল কিটস্ কার্টুন। শুরু হলো দুটি পত্রিকার মধ্যে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব।
ইয়োল কিডস্ কার্টুনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা উদ্দেশ্য প্রণোদিত, মনগড়া, অর্ধ সত্য খবরই ইয়োল জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা নামে পরিচিত হতে থাকে। নষ্ট মানসিকতা সম্পন্ন পাঠক শ্রেনী লুফে নেয় এই সংবাদ। যারা সবসময় চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী, ভিত্তিহীন, অর্ধ সত্য সংবাদই পছন্দ করে এবং এ নিয়ে চর্চায় তৃপ্তি পায়। ১৮৯৮ সালে কিউবার হাভানায় নোঙ্গর ফেলা একটি ইউএস মেরিন জাহাজে আকর্ষিক বিস্ফোরনে প্রায় আড়াইশো আমেরিকান নাবিক মারা যায়। হার্স্ট তার পত্রিকায় ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই ঘটনাকে স্পেনের ষড়যন্ত্র হিসাবে প্রমান করেন। যার ফলে আমেরিকা এই সংবাদ প্রকাশের দুই মাসের মাথায় স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। তখন পুলিৎজারও নিরুপায় হয়ে হার্স্টের মত ভূয়া সংবাদের দিকে ঝুকে পরে। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ দুজনের জন্য একটি লাভজনক ঘটনায় পরিনত হয়। দুজনেরই গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
মূলত পত্রিকা বিলি করত পথ শিশুরা। তাদের ডাকা হতো নিউজি। যুদ্ধকালীন সময়ে নিউজিরা একশত পত্রিকা কিনতো পঞ্চাশ সেন্টে। যুদ্ধ শেষে পুলিৎজার এবং হার্স্ট একত্রে নিউজিদের বিপক্ষে কঠোর অবস্থানে যান। তারা সে সময় নিউজিদের অবিক্রিত পত্রিকার মূল্য ফেরত ব্যবস্থা বাতিল সহ, নিউজিদের কাছে একশ পত্রিকার বিক্রয় মূল্য নির্ধারন করেন ষাট সেন্ট। তারপর নিউজিরা আন্দলনে গেলে পত্রিকা দুটির বিলি ব্যাবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। দুই প্রভাবশালী পত্রিকা তাদের মালিকের লোভ আর নিষ্ঠুরতার জন্য থমকে দাড়ায়।
পরবর্তিতে পুলিৎজার অনুশোচিত হন, কারন তিনি এক সময় নিউজি ছিলেন। অবশেষে ১৮৯৯ তে দুইজনই অবিক্রিত পত্রিকার মূল্য নিউজিদের ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে আবার সচল অবস্থায় ফিরে আসে।
অর্থ আর ক্ষমতার লোভে পুলিৎজার যা করেছিলেন তার জন্য সে অনুতপ্ত হন। কলিম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দুই মিলিয়ন ডলার দান করেন সাংবাদিকতা বিষয়ে শিক্ষা দানের জন্য। কলাম্বিয়া স্কুল অফ জার্নালিজম পরবর্তিতে সাংবাদিকতা শিক্ষার প্রধান ক্ষেত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯১১ তে তার মৃত্যুর পর থেকে পুলিৎজার পুরস্কার প্রবর্তিত আছে।
হার্স্ট এদিকে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তিতে হলিউডেও প্রতিষ্ঠিত হন। সিটিজেন কেন হার্স্টের উপর নির্মিত চলচিত্র। ছবি বানিয়েছেন ওয়াটসন ওয়েলস।
এটা ঠিক যে, এই দুই মহারথীর লোভের কারনে তিক্ত লড়াইয়ের মাঝে সংবাদের বিপ্লব সাধিত হয়। আজকের যে আধুনিক গনমাধ্যম, তার রূপরেখা জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ২০/১০/২০১৯নাইস