“কান্না”
.........বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছি বছর দুই হলো। এর মধ্যে পুরোদুস্তর চাকুরিজিবী হয়ে উঠতে না পারলেও নাম পরিচয়ের সাথে বেকার তকমাটা মাস দুয়েকের বেশি ঝুলে নাই। গেল মাসে একটা রিসার্চ সেন্টারে খন্ডকালীন গবেষনা সহযোগির চাকুরি জুটায় আপাতত নিজের ভরণপোষনের একটা ব্যাবস্থা হলো।
চাকুরী জীবনের প্রথম মাসের বেতন যে আকারেরই হউক তা পাওয়ার অনুভূতি শতভাগ স্বর্গীয় । সেই স্বর্গীয় অনুভূতির অভিজ্ঞতা হয়েছে দুই দিবসের প্রাক্কালে। বেতনের নগদ অর্থ হাতে আসার পর টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে সন্ধা ঘনিয়ে রওনা হলাম গ্রামের বাড়ি।
ঘন্টা দুইয়েকেই পৌছে গেলাম নিমসার বাজার বাস স্টান্ডে। স্টান্ড সংলগ্ন বাজার থেকে কিছু ফলমুল আর বাবার পছন্দের দই-মিষ্টি নিলাম । আর মায়ের জন্য… আলমের এক নম্বর জর্দ্দার কৌটা, চুন সুবাড়ি আর দশটাকার পান হলেই হয়, উনার নির্মল খুশির জন্য আর কিচ্ছু লাগেনা। সুতরাং মায়ের খুশি মাখা মুখ উপভোগের লোভে এই যাবতীয় কিনে বাড়ি গেলাম।
জীবনের প্রথম কামাই নিয়ে বাবা মার সাথে কাটানো প্রথম মুহূর্তের সুখ কখনো ভুলার নয়। ভুলতেও চাইনা।
বাড়ি পৌছে খাবারের ডজন খানেক আইটেমের স্বাদ নিয়ে রাতের আহার শেষ করে বিছানায় গেলাম বিশ্রামের জন্য । কিন্তু মিনিট দশ যেতে না যেতেই আম্মাজান কয়েক খানা মিষ্টি ভর্তি বাটি নিয়ে হাজির। ছেলের প্রথম কামাইয়ের আনন্দ বাটতে তার আর তর সইছিলনা।
- নে..রে বাটি কয়টা দিয়ে আয়। তারপর শোইছ। এই বাটিটা তোর পুব ঘরের বুবুরে(দাদিরে), অই বাটিটা উত্তর ঘরের চাচীর হাতে , আর এইটা দক্ষিণ ঘরে দিবি।
- কি আর করা, মায়ের আদেশ, বিনা বাক্যে পালনার্থে ছুটলাম ।
চাচাতো ভাই ইফতেখার, পড়াশোনায় আমি এক বছর এগিয়ে থাকলেও বয়সে আমরা দুজন প্রায় সমবয়সী।ফলে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি। তারও মাস তিনেক হলো বাংলালিংকের কল সেন্টারে জয়েন করেছে।সেও দুদিনের ছুটিতে দিন খানেক আগে বাড়ি এসেছে। তার বাড়ি আসার খবর অবশ্য সে আগেই ফোন করে আমায় জানিয়েছে।
উত্তর ও দক্ষিন ঘরের বাটি বিতরন করে সবশেষে আসলাম পূবের ঘরের দাদীর কাছে। এই দাদির (চাচাতো) তিন ছেলে এক মেয়ে।ইফতেখারের পিতা উনার বড় সন্তান। বাড়ির সবচেয়ে বয়জেষ্ঠ মুরুব্বি তিনি। তিনি ছাড়া বাড়ির আর বাকি দাদা-দাদি গত হয়েছেন বহু আগেই। পুব ঘরে ঢুকেই দেখি ঘরের সবাই আলাপ, বিলাপ, হাসি ঠাট্টায় মগ্ন।দাদি খাটের কিনারা ঘেসে বসে পান খাওয়ার বন্দোবস্ত করছেন। আর বাকিরা চেয়ার, মোড়া আর পিড়ি তে বসে আছে। আমার হঠাত প্রবেশ তাদের মগ্নতায় ছেদ পড়ল।আমি ঢুকেই সকল কে সালাম করে দাদির কাছে চলে গিয়ে পায়ের ধুলা নিয়ে মিষ্টি ভর্তি বাটিখানা তুলে দিলাম তার হাতে। ততক্ষনে সারা চেহারায় হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।অতপর…
কি রে…!! কখন আইলি?
এই তো বুবু… ঘন্টা আধেক হলো।
এই নেন … প্রথম কামাইয়ের …।
অহ…হো…পান মুখে দেমু এখন, সবাইরে দে আগে…
পান পরে খাইয়েন… আগে এইটা… হা করেন।
নিজ হাতে দাদির মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে খানিক কুশলাদি জেনে ও জানিয়ে ফিরে আসলাম নিজ ঘরে। এবং কালক্ষেপন না করে সরাসরি বিছানায়। কিন্তু বিছানায় গিয়েও শান্তি হলো না। হঠাত বাহির থেকে চিল্লা চিল্লি, বিলাপের অশনি ধ্বনি শুনে লাফিয়ে ছুটে উঠানে। সব সাউন্ডের উৎপত্তি ইফতেখারদের ঘরের দিক থেকে। অতপর সেদিকে ছুটলাম…।
অমানবিক পরিশ্রমের বিপরিতে আমানবিয় বেতন।দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে স্নাতক ও স্নাতক উত্তর শেষ করেও এমন চাকরি করতে হচ্ছে তাকে। তার বাবা মানে আমার কাকা জনাব নূরুন নবী, এক সময় সরকারি কর্মচারি ছিলেন। একটা অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনায় চাকুরি হারান।এখন চাষ গিরস্তি করে অভাবের সংসার টানছেন।তবে অভাব মেজাজ যেমনই থাকুক আত্মিয় স্বজন অতিথি আপ্যায়নে কোন ঘাটতি ঘটে না।
কাকার ইফতেখার সহ চার সন্তান।ইফতেখার ছাড়া সবাই পড়াশোনা রত। অভাব অনটনে কাকার মেজাজ হর হামেসা ই চড়া থাকে।আর চড়া মেজাজ সামলাতে প্রায়শই চড়াও হন চাচীর উপর। শ্রাব্য অশ্রাব্য ছেড়ে গালি গালাজ করে চাচীর গোষ্ঠী উদ্ধার করে প্রলাপ বকে ক্রমশ শান্ত হন।মাঝে মাঝে চাচির অসহ্য হয়ে প্রতি উত্তর করলে গায়ে হাত তুলবেন এমন ভাব নিয়ে তেড়ে যান। তবে কেন যেন কখনো হাত বা বেত তুলেন না।এমন পরিবেশ এই সংসারে নিত্তনৈমিত্তিক।হইহুল্লোড় শুনে ছুটেগিয়ে দেখলাম বরাবরের মত কাকা আজ আবার চড়া। তবে অন্য সময়ের চেয়ে আজকের অবস্থাটা ভিন্ন। অন্যদিন কেবল কাকাই তেতে থাকে বাকিরা চুপ। কিন্তু আজ সবাই তেতে।এই অবস্থার সুত্রপাত কি যেন পারিবারিক হিসেব নিকেশ সংক্রান্ত আলাপ তর্ক থেকে। যা একসময় অভাবনীয় ঝগড়ার রূপ নেয়। দিন রাত পরিশ্রম করে বেতন নিয়ে ইফতেখার বাড়িতে আসে একটু স্বস্থির জন্য। কিন্তু বাড়ি এসে সেই চিল্লা ফাল্লা, অন্যায় ভাবে মায়ের অশ্রাব্য খাওয়া মেনে নিতে পারেনাই । এবং এক পর্যায়ে বাবার সাথে টুকি টাকি জবাবের জের ধরে উভয়ে উত্তপ্ত হয়ে যায়। এবং আজ তার মাত্রা তার বাবাকেও ছাড়িয়ে চলতে থাকে। এমন অবস্থা দেখে আমি বাড়ির আরো কয়েকজনের সহযোগে পিতা পুত্রকে দুই দিকে টেনে নিয়ে আপতত পরিবেশ শান্ত করি। মুরব্বিরা তার বাবারে বুঝায়, পোলাপান বড় হইছে এখন যদি এমনে অশ্রাব্য করিস ত ক্যামনে হয়। কাকা উত্তর দেয়ঃ আমারে আর বোঝাইও না। হেতেরা অহন নাগর হইছে, দুই টেয়ার চাকরি কইরা সাব হইছে। অহন তারার বাফ লাগেনা।বাফেরে চেট বইল্লা জমা দেয়না।কইয়া দেন। আমার দিন শেষ হয়নাই। হেতেরার কামাইর লাইজ্ঞা বইয়া থাহিনা।
আর এদিকে ইফতেখার কে আমি ভৎসনা করে বলি, বাপের সাথে কেউ এমনে কথা বলে, দেখস না, সারাদিন পরিশ্রম করেও ঘরে অভাব যায়না। তুই কয় টেয়া কামাই করছ আর কয় টেয়া দেছ। এতে এতোবড় সংসারে কিছু অয়।
ইফতেখারঃ অভাবের কষ্ট কি হেবেডায় একলা ভোগেনি। আমরা কি কম ভোগি? সারাটা জিবন মায় এই সংসারে খাইট্টা মরল, এহনো সকাল সন্ধা পাহাল গুতায়, ধান গিরস্তে লাইজ্ঞা থাহে।কিন্তু কোন দিন মারে এবেডায় দুই টেয়ার দাম দিছেনি।উল্ডা ডেলি যা না তা শোনায়।
আমরা শুধাই, শোন ঠিক আছে, কাকায় যেইডা করতাছে অন্যায়ই করে, কিন্তু তার কি মানসিক অবস্থায় যাইতাছে হেইডাও তো ভাববি। যে দুশ্চিন্তায় থাকে সংসার সাম্লাইতে গিয়া। আরে গালি গালাজ করে কেবল নিজেরে সামলায়। নইলে এতোদিন স্টোক কইরা মরার কথা। তোর মারে গাইল্লায়, তোর মায় ত জবাব দেয়না, জানে মাইত্তা লাভ নাই। মাথা ঠান্ডা অইলে আফনেই ঠিক হইবো। এরপর ইফতেখার হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। আর এদিকে বেসামাল মেজাজের কুল কিনারা করতে না পেরে রাগে ক্ষোভে গর গরাইতে গর গরাইতে ইফতেখার যেখানে ছিল তার পাশ দিয়ে বাড়ি থেকে খানিক কালের জন্য হন হন করে বেড়িয়ে যেতে লাগল।
কিন্তু ইফতেখার হঠাৎ কি একটা ভেবে উঠে গিয়ে বাবার পায়ে জড়িয়ে ধরল। আর হাউ মাউ করে কাঁদতে কাদঁতে বলতে লাগল, আব্বা আমারে মাফ কইরা দেন। আমি অন্যায় করছি, আমারে মাফ করেদেন।
কাকাঃ সর, ছাড় বলতে বলতে পা ছড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করলো।
ইফতেখার আরো কাকুতি ঝেড়ে বলতে লাগল, ছাড়ুম না, আগে কন মাফ করছেন নি।
কাকা আর নিজেরে ধরে রাখতে পারল না, বসে গিয়ে ছেলেরে আঞ্জা করে ধরল। আর উভয়ে কাঁদতে লাগল।এই কান্না দুঃখ বা অভিমানের নয়, এই কান্না পিতৃত্ব সুখের।এই কান্না পিতৃস্নেহের, নির্মল আবেগের, দুঃখজয়ী ভালোবাসার। এই কান্নাই তো গ্রাম্য নিম্ন মধ্যবিত্ত অভাব অনটনি প্রতিটা সংসারের অলংকার এবং অহংকার। এই কান্না তৃপ্ত হয়ে ঘরে ফেরার।এই কান্না সুখ কাকে বলে সেই উপলব্ধির।
এইদিকে আমাদেরো গাল ভিজল।আমরাও আপ্লুত হলাম এমন কান্নার অংশ হয়ে।ঘরে ফিরলাম এমন সুখের সাক্ষি হয়ে। ঘরে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদলাম।এবং এভাবেই থাকলাম যতক্ষন না ভোরের আলো ফুটল।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,, ......মোশতাক সাব্বির
চাকুরী জীবনের প্রথম মাসের বেতন যে আকারেরই হউক তা পাওয়ার অনুভূতি শতভাগ স্বর্গীয় । সেই স্বর্গীয় অনুভূতির অভিজ্ঞতা হয়েছে দুই দিবসের প্রাক্কালে। বেতনের নগদ অর্থ হাতে আসার পর টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে সন্ধা ঘনিয়ে রওনা হলাম গ্রামের বাড়ি।
ঘন্টা দুইয়েকেই পৌছে গেলাম নিমসার বাজার বাস স্টান্ডে। স্টান্ড সংলগ্ন বাজার থেকে কিছু ফলমুল আর বাবার পছন্দের দই-মিষ্টি নিলাম । আর মায়ের জন্য… আলমের এক নম্বর জর্দ্দার কৌটা, চুন সুবাড়ি আর দশটাকার পান হলেই হয়, উনার নির্মল খুশির জন্য আর কিচ্ছু লাগেনা। সুতরাং মায়ের খুশি মাখা মুখ উপভোগের লোভে এই যাবতীয় কিনে বাড়ি গেলাম।
জীবনের প্রথম কামাই নিয়ে বাবা মার সাথে কাটানো প্রথম মুহূর্তের সুখ কখনো ভুলার নয়। ভুলতেও চাইনা।
বাড়ি পৌছে খাবারের ডজন খানেক আইটেমের স্বাদ নিয়ে রাতের আহার শেষ করে বিছানায় গেলাম বিশ্রামের জন্য । কিন্তু মিনিট দশ যেতে না যেতেই আম্মাজান কয়েক খানা মিষ্টি ভর্তি বাটি নিয়ে হাজির। ছেলের প্রথম কামাইয়ের আনন্দ বাটতে তার আর তর সইছিলনা।
- নে..রে বাটি কয়টা দিয়ে আয়। তারপর শোইছ। এই বাটিটা তোর পুব ঘরের বুবুরে(দাদিরে), অই বাটিটা উত্তর ঘরের চাচীর হাতে , আর এইটা দক্ষিণ ঘরে দিবি।
- কি আর করা, মায়ের আদেশ, বিনা বাক্যে পালনার্থে ছুটলাম ।
চাচাতো ভাই ইফতেখার, পড়াশোনায় আমি এক বছর এগিয়ে থাকলেও বয়সে আমরা দুজন প্রায় সমবয়সী।ফলে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি। তারও মাস তিনেক হলো বাংলালিংকের কল সেন্টারে জয়েন করেছে।সেও দুদিনের ছুটিতে দিন খানেক আগে বাড়ি এসেছে। তার বাড়ি আসার খবর অবশ্য সে আগেই ফোন করে আমায় জানিয়েছে।
উত্তর ও দক্ষিন ঘরের বাটি বিতরন করে সবশেষে আসলাম পূবের ঘরের দাদীর কাছে। এই দাদির (চাচাতো) তিন ছেলে এক মেয়ে।ইফতেখারের পিতা উনার বড় সন্তান। বাড়ির সবচেয়ে বয়জেষ্ঠ মুরুব্বি তিনি। তিনি ছাড়া বাড়ির আর বাকি দাদা-দাদি গত হয়েছেন বহু আগেই। পুব ঘরে ঢুকেই দেখি ঘরের সবাই আলাপ, বিলাপ, হাসি ঠাট্টায় মগ্ন।দাদি খাটের কিনারা ঘেসে বসে পান খাওয়ার বন্দোবস্ত করছেন। আর বাকিরা চেয়ার, মোড়া আর পিড়ি তে বসে আছে। আমার হঠাত প্রবেশ তাদের মগ্নতায় ছেদ পড়ল।আমি ঢুকেই সকল কে সালাম করে দাদির কাছে চলে গিয়ে পায়ের ধুলা নিয়ে মিষ্টি ভর্তি বাটিখানা তুলে দিলাম তার হাতে। ততক্ষনে সারা চেহারায় হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।অতপর…
কি রে…!! কখন আইলি?
এই তো বুবু… ঘন্টা আধেক হলো।
এই নেন … প্রথম কামাইয়ের …।
অহ…হো…পান মুখে দেমু এখন, সবাইরে দে আগে…
পান পরে খাইয়েন… আগে এইটা… হা করেন।
নিজ হাতে দাদির মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে খানিক কুশলাদি জেনে ও জানিয়ে ফিরে আসলাম নিজ ঘরে। এবং কালক্ষেপন না করে সরাসরি বিছানায়। কিন্তু বিছানায় গিয়েও শান্তি হলো না। হঠাত বাহির থেকে চিল্লা চিল্লি, বিলাপের অশনি ধ্বনি শুনে লাফিয়ে ছুটে উঠানে। সব সাউন্ডের উৎপত্তি ইফতেখারদের ঘরের দিক থেকে। অতপর সেদিকে ছুটলাম…।
অমানবিক পরিশ্রমের বিপরিতে আমানবিয় বেতন।দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে স্নাতক ও স্নাতক উত্তর শেষ করেও এমন চাকরি করতে হচ্ছে তাকে। তার বাবা মানে আমার কাকা জনাব নূরুন নবী, এক সময় সরকারি কর্মচারি ছিলেন। একটা অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনায় চাকুরি হারান।এখন চাষ গিরস্তি করে অভাবের সংসার টানছেন।তবে অভাব মেজাজ যেমনই থাকুক আত্মিয় স্বজন অতিথি আপ্যায়নে কোন ঘাটতি ঘটে না।
কাকার ইফতেখার সহ চার সন্তান।ইফতেখার ছাড়া সবাই পড়াশোনা রত। অভাব অনটনে কাকার মেজাজ হর হামেসা ই চড়া থাকে।আর চড়া মেজাজ সামলাতে প্রায়শই চড়াও হন চাচীর উপর। শ্রাব্য অশ্রাব্য ছেড়ে গালি গালাজ করে চাচীর গোষ্ঠী উদ্ধার করে প্রলাপ বকে ক্রমশ শান্ত হন।মাঝে মাঝে চাচির অসহ্য হয়ে প্রতি উত্তর করলে গায়ে হাত তুলবেন এমন ভাব নিয়ে তেড়ে যান। তবে কেন যেন কখনো হাত বা বেত তুলেন না।এমন পরিবেশ এই সংসারে নিত্তনৈমিত্তিক।হইহুল্লোড় শুনে ছুটেগিয়ে দেখলাম বরাবরের মত কাকা আজ আবার চড়া। তবে অন্য সময়ের চেয়ে আজকের অবস্থাটা ভিন্ন। অন্যদিন কেবল কাকাই তেতে থাকে বাকিরা চুপ। কিন্তু আজ সবাই তেতে।এই অবস্থার সুত্রপাত কি যেন পারিবারিক হিসেব নিকেশ সংক্রান্ত আলাপ তর্ক থেকে। যা একসময় অভাবনীয় ঝগড়ার রূপ নেয়। দিন রাত পরিশ্রম করে বেতন নিয়ে ইফতেখার বাড়িতে আসে একটু স্বস্থির জন্য। কিন্তু বাড়ি এসে সেই চিল্লা ফাল্লা, অন্যায় ভাবে মায়ের অশ্রাব্য খাওয়া মেনে নিতে পারেনাই । এবং এক পর্যায়ে বাবার সাথে টুকি টাকি জবাবের জের ধরে উভয়ে উত্তপ্ত হয়ে যায়। এবং আজ তার মাত্রা তার বাবাকেও ছাড়িয়ে চলতে থাকে। এমন অবস্থা দেখে আমি বাড়ির আরো কয়েকজনের সহযোগে পিতা পুত্রকে দুই দিকে টেনে নিয়ে আপতত পরিবেশ শান্ত করি। মুরব্বিরা তার বাবারে বুঝায়, পোলাপান বড় হইছে এখন যদি এমনে অশ্রাব্য করিস ত ক্যামনে হয়। কাকা উত্তর দেয়ঃ আমারে আর বোঝাইও না। হেতেরা অহন নাগর হইছে, দুই টেয়ার চাকরি কইরা সাব হইছে। অহন তারার বাফ লাগেনা।বাফেরে চেট বইল্লা জমা দেয়না।কইয়া দেন। আমার দিন শেষ হয়নাই। হেতেরার কামাইর লাইজ্ঞা বইয়া থাহিনা।
আর এদিকে ইফতেখার কে আমি ভৎসনা করে বলি, বাপের সাথে কেউ এমনে কথা বলে, দেখস না, সারাদিন পরিশ্রম করেও ঘরে অভাব যায়না। তুই কয় টেয়া কামাই করছ আর কয় টেয়া দেছ। এতে এতোবড় সংসারে কিছু অয়।
ইফতেখারঃ অভাবের কষ্ট কি হেবেডায় একলা ভোগেনি। আমরা কি কম ভোগি? সারাটা জিবন মায় এই সংসারে খাইট্টা মরল, এহনো সকাল সন্ধা পাহাল গুতায়, ধান গিরস্তে লাইজ্ঞা থাহে।কিন্তু কোন দিন মারে এবেডায় দুই টেয়ার দাম দিছেনি।উল্ডা ডেলি যা না তা শোনায়।
আমরা শুধাই, শোন ঠিক আছে, কাকায় যেইডা করতাছে অন্যায়ই করে, কিন্তু তার কি মানসিক অবস্থায় যাইতাছে হেইডাও তো ভাববি। যে দুশ্চিন্তায় থাকে সংসার সাম্লাইতে গিয়া। আরে গালি গালাজ করে কেবল নিজেরে সামলায়। নইলে এতোদিন স্টোক কইরা মরার কথা। তোর মারে গাইল্লায়, তোর মায় ত জবাব দেয়না, জানে মাইত্তা লাভ নাই। মাথা ঠান্ডা অইলে আফনেই ঠিক হইবো। এরপর ইফতেখার হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। আর এদিকে বেসামাল মেজাজের কুল কিনারা করতে না পেরে রাগে ক্ষোভে গর গরাইতে গর গরাইতে ইফতেখার যেখানে ছিল তার পাশ দিয়ে বাড়ি থেকে খানিক কালের জন্য হন হন করে বেড়িয়ে যেতে লাগল।
কিন্তু ইফতেখার হঠাৎ কি একটা ভেবে উঠে গিয়ে বাবার পায়ে জড়িয়ে ধরল। আর হাউ মাউ করে কাঁদতে কাদঁতে বলতে লাগল, আব্বা আমারে মাফ কইরা দেন। আমি অন্যায় করছি, আমারে মাফ করেদেন।
কাকাঃ সর, ছাড় বলতে বলতে পা ছড়ানোর ব্যার্থ চেষ্টা করলো।
ইফতেখার আরো কাকুতি ঝেড়ে বলতে লাগল, ছাড়ুম না, আগে কন মাফ করছেন নি।
কাকা আর নিজেরে ধরে রাখতে পারল না, বসে গিয়ে ছেলেরে আঞ্জা করে ধরল। আর উভয়ে কাঁদতে লাগল।এই কান্না দুঃখ বা অভিমানের নয়, এই কান্না পিতৃত্ব সুখের।এই কান্না পিতৃস্নেহের, নির্মল আবেগের, দুঃখজয়ী ভালোবাসার। এই কান্নাই তো গ্রাম্য নিম্ন মধ্যবিত্ত অভাব অনটনি প্রতিটা সংসারের অলংকার এবং অহংকার। এই কান্না তৃপ্ত হয়ে ঘরে ফেরার।এই কান্না সুখ কাকে বলে সেই উপলব্ধির।
এইদিকে আমাদেরো গাল ভিজল।আমরাও আপ্লুত হলাম এমন কান্নার অংশ হয়ে।ঘরে ফিরলাম এমন সুখের সাক্ষি হয়ে। ঘরে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদলাম।এবং এভাবেই থাকলাম যতক্ষন না ভোরের আলো ফুটল।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,, ......মোশতাক সাব্বির
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
হাদী মুহাম্মাদ রকিব উদ্দীন ০৩/০৯/২০১৮ভাল লাগল
-
ন্যান্সি দেওয়ান ১৫/০৮/২০১৮Beautiful
-
মধু মঙ্গল সিনহা ১৪/০৮/২০১৮ধন্যবাদ, ভালো লাগলো।
-
নৃ মাসুদ রানা ১৪/০৮/২০১৮Valo