মেছো
(ভুতের গল্প)
অনেক দিন হল মাছ ধরা হয় না। আজকের আবহাওয়াটা মাছ ধরার জন্য বড়ই চমৎকার। অন্তত আয়ারল্যান্ডের বৈরী আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত একটি দিন। তাই স্কাইলাইট জানালা দিয়ে বার বার নীলাম্বরের দিকে তাকিয়ে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছে। আমার যতগুল শখ আছে এই মাছ ধরা তার মধ্যে একটা। কাল বিলম্ব না করে সুমন কে ফোন দিলাম। সুমন আমার সহকর্মি এবং খুব ভাল বন্ধুও বটে ।
--হ্যাল কে? ফোনের ওপাশ থেকে সুমনের চার বছরের ছেলে, রাঈদের কণ্ঠ ভেসে এলো।
--আমি তোমার আর্ষ আংকেল, বাবা কোথায়?
--বাবা। he is in toilet.
প্রবাসের ছেলে মেয়েরা বাংলা কথা ভুলেই যাচ্ছে। নিহাত প্রয়োজন ছাড়া এরা বাংলায় কথা বলে না । বাঙ্গালী টিনেজার ছেলে মেয়েদেরকে কখনোই নিজেদের মধ্যে বাংলা ভাষায় কথা বলতে শুনি না। তাঁদের নাকি অড ফিল হয় বাংলা ভাষায় কথা বললে।
--আচ্ছা, বাবা বেড় হলে বলো আমায় ফোন করতে।,
হ্যাঁ, না কিছু না বলেই লাইন কেটে দিল। বাচ্চারা মোবাইল ফোন বেশিখন ব্যস্ত রাখতে চায় না । ওদের গেমস খেলায় নয়তো বা কার্টুন দেখায় বিলম্বিত হয়। একটু মুচকি হেসে তনু কে বললাম,
--এই তুমি যাবে মাছ ধরতে?
--না আমি যাব না,তুমি যাও। আমার শরীরটা ভাল না।
তনু যাবে না শুনে মনে মনে একটু খুশিই হলাম, কারণ ও সাথে গেলেই বাসায় আসার তাড়া, “এই চল সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, ভাল লাগছে না, দূর ছাই মাছ উঠেনা.........ব্লা...ব্লা...।”
--কেন কি হয়েছে? আরে তুমি না গেলে কি মজা হয়? প্লিজ চল,। একটু আহ্লাদের সুরে বললাম।
--তেমন কিছু না, মাথাটা ধরেছে, একটা সল্পারডিন খেয়ে শুয়ে থাকবো। তুমি তোমার বন্ধুকেই নিয়ে যাও।”
তনুর কথা শেষ হতে না হতেই ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরে বললাম,
--হ্যাল, সুমন কি অবস্থা?
--হ্যাল, ফোন করেছিলি? ফোনের অপর পাশ থেকে সুমনের কণ্ঠ ভেসে আসলো।
--হ্যাঁ করেছিলাম, মাছ ধরতে যাবি?
--যাব না মানে? তুই কি রেডি? রেডি হয়ে আমায় ফোনদে। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
আমি চটপট তৈরী হয়ে সুমনের ফোনের অপেক্ষা করতে থাকলাম। সুমনের যে কয় সেকেন্ডে এক মিনিট হয় তা ও নিজেই জানে। অপেক্ষার প্রহর শেষ করে ফোন বেজে উঠলো।
--হ্যাল এক মিনিট অপেক্ষা কর। আমি আসছি,। সুমনকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে বড়শিগুলো আর মাছ ধরার বাকি সরাঞ্জম নিয়ে রওনা দিলাম । সুমন ওর গাড়ি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। গাড়ির পিছে বড়শি আর বাকি জিনিস পত্র রেখে সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। আমায় দেখে সুমন বলল- “ আজ অনেক মাছ উঠবেরে। ওদের কাউকে নিয়ে আসি নি ভালই হয়েছে আজ অনেকক্ষণ থাকা যাবে।”
--হুম। গান ছাড়।
সুমন গান ছেড়ে নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে দ্রুত ছুটে চলছে আমদের গাড়িটি। লগবোরা অনেক সুন্দের একটি জায়গা। ওখানে মাছ ধরার জন্য দুটো অনেক বড় লেক আছে, সামনে আছে বিশাল পাহাড় আর চার পাশ ঘন গাছ গাছালি দিয়ে ভরা। লগবোরা একটি ঐতিহাসিক জায়গা এবং এটি আয়ারল্যান্ডের একটি জাতীয় উদ্যান। হঠাৎ সুমন ফুল ব্রেক কষলো। আমি সিটে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছিলাম। ওর হঠাৎ ব্রেকে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সিট বেল্ট বাঁধা না থাকলে সোজা উইন্ডশিল্ড এ গিয়ে বাড়ি খেতাম।
--কিরে কি হয়েছে এত জোড়ে ব্রেক কষলি কেন?
সুমনের হাত কাঁপছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। আমি আবার জিজ্ঞাস করলাম ,
--কিরে কি হয়েছে?
--গাড়ির নিচে একটা কাল বিড়াল এসে পড়েছে। বিড়ালটা মনে হচ্ছে পিষে গেছে।
আমরা ব্লুবল বার পার হয়ে ব্লুবল রোডে আছি। রোডটা অনেক সরু এবং উঁচু নিচু, আর এখানে বিড়াল আসবে কোথেকে ঠিক বুঝতে পারছি না। আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর নেই, আর এই সব দেশে স্ট্রিট বিড়াল দেখা যায় না বললেই চলে। সুমন গাড়ি থেকে নামতে চাইলো, কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে একটা গাড়ি আমদের গাড়িকে হর্ণ দিল। এই দেশে হর্ণ এর মানে বকা দেওয়ার সামিল। আমি সুমন কে বললাম –- গাড়ি স্টার্টদে।
--চল আজ ফিরে যাই। বিড়াল তাও আবার কাল, গাড়িতে চাপা পড়েছে। চল চলে যাই আজ আর দরকার নেই মাছ ধরার।” সুমন ধরা গলায় বলল।
--দূর ।। তুই দেখি একটা ভীতুর ডিম। এই সব কুসংস্কার তুই বিশ্বাস করিস? বাদদে তুই তো আর ইচ্ছা করে মারিস নি।
তারপর সুমন একটু স্থির হয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো। মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমরা। গাড়িটি পার্কিং লটএ পার্ক করে আমরা আমদের সরাঞ্জম নিয়ে লেকের চলে গেলাম। সুবিধামত জায়গায় বসে মাছ ধরা শুরু করে দিলাম। আজ লোক জন অনেক কম। দুই একজনকে দেখলাম সাইকেলিং করছে, আর তেমন কাউকে চোখে পরছে না। মাছ ধরার সবচাইতে বড় সূত্র হল ধৈর্য, যার ধৈর্য নেই সে মাছ ধরতে পারবে না। প্রায় ঘণ্টা দুই এক হয়ে গেল কিন্তু একটিও মাছ কপালে জুটলো না। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সূর্য ডুবোডুবো করছে।আজ মনে হচ্ছে ধৈর্যের সব সূত্র ভুল প্রমাণিত হবে। সন্ধ্যার পরপরই লগবোরা একে বাড়ে জনশূন্য হয়ে পড়ে, চারপাশ শুধু গাছ গাছালি আর দুরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে স্লিপব্লুম পাহাড়। একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ করলাম, লেকের আশেপাশে একটাও হাঁস নেই আজ। এই লেকে অনেকগুলো রাজহাঁস সহ পাতিহাঁস, বুনোহাঁস, ডাহুক বাস করে। ওদের জন্য লেকের মাঝে একটা মাঝারি সাইজের কৃত্তিম দ্বীপও আছে। হাসগুলো সারা দিন এই পারের কাছেই থাকে, পর্যাটকরা ওদের জন্য বিভন্ন খাবার দাবার দিয়ে যায়, রুটি, কলা, আপেল কত কি। হাসগুলোর খাবার পড়ে আছে কিন্তু একটা হাঁসতো দুরে থাক হাঁসের পলকও দেখতে পেলাম না আজ। সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু গোধূলি বেলার লালচে আভা এখনো রয়ে গেছে মনে হচ্ছে কোন শিল্পি তার রঙ তুলি দিয়ে বসে বসে আকাশ নামক ক্যানভাসে আচড় কেটে যাচ্ছে। দিনের আলো ফুরিয়ে যেতেই লগবোরার চেহারা পাল্টে গেল। দিনের চেহারার সাথে রাতের কোন মিল নেই। নির্মূল সজিব পরিবেশ কেমন যেন রহস্যময় আর ভৌতিকতায় ছেয়ে গেল, চারদিকে শুনশান নিরবতা হঠাৎ সেই নিরবতা ভেঙ্গে খুব কাছ থেকে একটা নেকড়ের ডাক ভেসে এলো। বুকটা ধক করে উঠলো। কলজে হিম হয়ে গেল। ক্রমশই পরিবেশটা ভাড়ি হয়ে উঠছে আর একটা অশুভ কোন কিছুর ইঙ্গিত করছে। মনে হচ্ছে বাতাসে কেউ ফিসফিস করে বলছে চলে যাও, নইলে বিপদে পড়বে। হতাশা নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় আমার বড়শি ভারী হয়ে গেল, জলের নিচ থেকে কে যেন আমার বড়শি টেনে ধরেছে। বুঝলাম মাছ ধরেছে, ধীরে ধীরে বড়শি টানতে শুরু করলাম। মাঝারি সাইজের একটা মাছ উঠেছে। মনটা খুশিতে ভরে গেল। আমি চেঁচাতে থাকলাম।
--এই সুমন দেখ কত বড় একটা মাছ ধরেছি। দেখ দেখ ...।
মাছটা পানি ভর্তি বকেটে রেখে আবারো বড়শিতে ওয়ার্ম গেঁথে ছুড়ে দিলাম গভির জলে। আরো একটা মাছ ধরেছে বড়শিতে। বড়শি তুলে মাছটি খুলে বকেটে রেখে আবার বড়শি জলে ছুড়ে দিলাম। সমুন আমার থেকে পনেরো কি বিশ গজ দুরে মাছ ধরছে। ওর দিকে একবার তাকিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। একের পর এক মাছ উঠেই চলছে। অমাবস্যা চলছে, তাই সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘন অন্ধকার গ্রাস করে ফেল্ল আমদের, তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই আমার। একটু আগেই চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর এখন যেন নেশায় পেয়ে গেছে। বড়শিতে যেন আঠা লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। বড়শি ফেলতে দেরি মাছ উঠতে দেরি হচ্ছে না, পরপর অনেক গুলো মাছ ধরে ফেল্লাম। আমার মাছের বকেট প্রায় ভরে গেছে। আরো একটি মাছ ধরেছে বড়শিতে, আমিতো খুশিতে আত্মহারা। মাছটি বড়শি থেকে ছাড়িয়ে বকেটে রাখতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার। আগের ধরা একটা মাছও নেই। কি ব্যপার আমার মাছ কোথায়? নিজের অজান্তেই সুমনের দিকে নজর ঘুরে গেল। অন্ধকারে ওর অবয় দেখা যাচ্ছে চেয়ারে বসে আছে মাথা হেলান দিয়ে। আমি ভ্রুকটি করে বললাম,
--এই সুমন আমার মাছ কোথায়? কি করেছিস? তুই নিয়েছিস?
সুমন যেন কানে শুনতে পেলো না কথা গুলো। কোন প্রতিক্রিয়াই করলো না আমার কথার। মনে হয় দুষ্টামি করছে আমার সাথে। আমায় রাগানোর জন্য এই রকম করছে। সমস্যা নেই। মাছগুলো মনে হয় ওর বকেটেই আছে। আমি মাছটা রেখে আবার বড়শি ছুড়ে দিলাম। সাথে সাথেই আর একটি মাছ বড়শিতে উঠলো। আমার মুখে খুশির একটা ঝলক বয়ে গেল আর সেই খুশি ছড়িয়ে গেল আমার হাসিতে। হাসতে হাসতে বড়শিটা উঠালাম। মোটামোটি দুই-তিন কেজির মত ওজনের একটা সিলভার কাপ মাছ উঠে আসলো। মাছটি প্রাণপণে চেষ্ঠা করে যাচ্ছে নিজেকে বড়শির হুক থেকে মুক্ত করে গভির জলে ছুটে যেতে। মাছটি বড়শির হুক থেকে খুলে বকেটে রাখতে গিয়ে আমার চোখ কপালে উঠলো। আমার বকেটে কোন মাছ নেই। আমি সিলভার কাপটা বকেটে রেখে সুমনের দিকে তাকালাম। সুমন আমার কাছ থেকে দশ কি পনেরো হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে, সুমন লেকের পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর বড়শি কোথায়? জাহান্নামে যাক ওর বড়শি। আমার মাছগুলোর চিন্তাই এখন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি এইবার একটু গলা উঁচিয়ে বললাম- সুমন আমার মাছ কোথায়? তুই নিয়েছিস? আর মাছ যদি চাসতো বলে কয়ে নে। আর দুষ্টামি করিস না দয়া করে”।
সুমন একটা কথাও বলল না এমনকি ফিরেও তাকালো না আমার দিকে। আমি একটু বিরক্ত হয়ে আবারো বড়শি তৈরী করতে থাকলাম। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, সুমনের আশে পাশে কোন বড়শি, বকেট বা মাছ ধরার কোন কিছুই নেই ইভেন চেয়ারটা পর্যন্ত নেই। কিন্তু একটু আগেওতো চেয়ারে বসে ছিল। আমি সাত পাঁচ না ভেবে মাছ ধরায় মন দিলাম। বড়শি ফেলতে না ফেলতেই বড়শিতে আবারো মাছ ঠোকর দিলো। আজ এত বছর ধরে মাছ ধরছি কোন দিনও এমন হয় নি। বড়শি ফেলতে দেরি হচ্ছে কিন্তু মাছ ধরতে দেরি হচ্ছে না। মাছ বড়শি থেকে খুলে বকেটে রাখতে গিয়ে এইবার আমার মেজাজ বখরে গেল। আমার সিলভার কাপ মাছটা নেই। বকেট থেকে একটু দুরে সুমন পিছমোড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রাগে গদ গদ করতে করতে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু রাগান্বিত স্বরে বললাম –“সুমন এই সব কি ধরণের ফাজলামি হচ্ছে?” সুমন কোন জবাব দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা খাচ্ছে। আমি সুমনের কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বললাম—“এই কি করছিস? আমার মাছ কোথায়?” সুমনের শরীর যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ওর কয়েকশ’ ডিগ্রি জ্বর। আমি হাতটা এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে নিলাম। সুমনের শরীর থেকে একটা বিশ্রী মাছ পঁচা গন্ধ আসছে। অনেকক্ষণ থেকেই নাকে এই গন্ধটা আসছিল, ভেবেছিলাম হাঁসদের খাবারের পঁচা গন্ধ। সুমন আমার দিকে ফিরে তাকাল, ওর চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বল জ্বল করছে। ও’দু হাতে আমার সিলভার কাপ মাছটা ধরে রেখেছে। আমার হাতের ফিশিং নিয়ন লাইটের অনুজ্জ্বল সবুজ আলোয় স্পষ্ট আমি দেখতে পেলাম, আধখাওয়া মাছটার তাজা রক্ত সুমনের মুখের চার পাশে লেগে আছে। আমার দিকে এমন হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো যেন ওকে সময় ডাকাডাকি করে খুব বিরক্ত করছি,ওর রক্ত চাহনি দেখে আমার কলজে হিম হয়ে গেল। মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে গেল ভয়ের শীতল শিহরণ । আমার পশমগুলো শজারুর কাঁটার মত দাঁড়িয়ে গেল। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম
—সু...মন। কি হয়েছে তোর।
আমার কথার জবাবে ওর চাহনি আরও কেমন যেন হয়ে গেল, ধীরে ধীরে সুমনের চেহারার অবয় পরিবর্তন হয়তে লাগলো এক ভয়ানক জন্তুর মত। আমি আর এক সেকেন্ড থাকতে পারলাম না। আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলেগেল। আমি এক দৌড় দিয়ে পীচঢালা সড়কে চলে আসলাম। রাস্তাটা লেক থেকে একটু উঁচুতে, তাই নিজেকে একটু নিরাপদ মনে হচ্ছে। এখন আমার কাজ হল গাড়ির দিকে ছুটে যাওয়া। রাস্তায় উঠে হাঁপাতে লাগলাম। আমার বরাবর উত্তর দিক থেকে একটি ছায়া মূর্তি দৌড়ে আসছে। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ছায়া মূর্তিটি আমার সামনে এসে বিষম খেয়ে থমকে গেল। আমিও ছায়া মুর্তিটিকে দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। ভয় কৌতুহলের রূপ নিল, যখন ছায়া মূর্তিটি সুমনের গলায় ভয়ার্ত কন্ঠে বলল – ক...কে...কে তুই...। আর্ষ...? আমায় কিছু করিস না... সব মাছ রেখে এসেছি...প্লিজ।”
--সুমন? তু...ই এখানে তো ঐখানে কে? আমি নিচের দিকে আঙ্গুল তুলে তাকাতেই দেখলাম ওখানে কেউ নেই! সামনে সুমন দাঁড়িয়ে। ওর হাত পা কাঁপছে। আমার কণ্ঠ শুনে একটু সাহস পেয়ে বলল,
--আর্ষ এর মানে কি? তু...ই ঠিক আছিস?
--সুমন সব কথা পড়ে হবে, এই জায়গা ঠিক না। তারা তাঁরই গাড়িতে উঠ।, এই কথা বলেই সুমনের হাত ধরে টান দিয়ে আমি দৌড় দিলাম। আমরা গাড়ির কাছে পৌঁছেই গাড়িতে উঠে বসলাম। সুমন এক সেকেন্ডও দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি পার্কিং লট থেকে রাস্তায় নামাতেই গাড়ির হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট আমরা দেখলাম একটা কাল ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, আর হাতে একটা মাছ। সুমন সাত,পাঁচ না ভেবে গাড়িছুটালো। এতজোড়ে ওকে কোন দিনও আমি গাড়ি চালাতে দেখি নি। অন্ধকার, তার উপর উঁচু নিচু নির্জন রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলছে দুই পাশে ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে। এখনো ভয়ে আমার বুক ধুকধুক করছে। লগবোরার রাস্তা পার হবার পড় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ভয়ে ভয়ে একবার গাড়ির লুকিং গ্লাস দিয়ে পিছনে তাকালাম। তার পর সুমনের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞাস করলাম,
--কি হয়েছিল তোর সাথে?
সুমন আমার কথার জবাব দিল না। চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাকলো। আমি ওকে চুপ থাকতে দেখে ভাবলাম ভয়ের রেস এখনো যায় নি, তাই পরিবেশ হালকা করার জন্য আবারও জিজ্ঞাস করলাম,
--কয়টা মাছ পেছিলি?
এইবারো চুপ, কোন জবাব আসলো না সুমনের কাছ থেকে। আমি ওর দিকে ভাল করে তাকালাম। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারের জন্য। তাই আমি গাড়ির লাইট জ্বালালাম, আর যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সুমনের মুখে তাজা মাছের রক্ত লেগে আছে, আর ওর চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, যেন জ্বলন্ত কোন অঙ্গার। আমার দিকে ফিরে তাকাল, মৃদু হেসে নাকি গলায় বলল,
--কিঁরেঁ আঁরঁ মাঁছঁ ধঁরঁবিঁ নাঁ? আঁমাঁরঁ ক্ষিঁধাঁ লাঁগঁছেঁ......।
সুমনের গাঁ থেকে বিশ্রী পঁচা মাছের গন্ধ আসছে। যে গন্ধটা আমি লগবোরায় পেয়েছিলাম। ভয়ে আমার কলজে বুকের খাঁচা ছেড়ে বের হবার জোগাড়। আমি চিৎকার করে উঠলাম নাআআআআআআ। সুমন হেসেই যাচ্ছে, আমি ভয়ে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলতে গেলাম। গাড়ির দরজা খুলে গেল এক ঝাটকাতেই, সুমন মনে হয় আমার মন ভাব বুঝতে পেরেই গাড়ির ব্রেক কষলো। আমি এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিলাম। কিন্তু একটু সামনে গিয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম পীচ ঢালা পথে। মাথা তুলে উঠতে গিয়ে চোখ পড়লো ওয়েল কাম টু লগবোরার সাইন বোর্ডের দিকে । সারা লগবোরা পার্কে এই একটি জায়গাতেই বাতি জ্বলছে। সাইন বোর্ডটা দেখেই আমার মাথা ঘুরে গেল। আমরাতো ছিলাম ন্যাশনাল রোড-এ তা হলে এই খানে কি করে এলাম? নাকের কাছে সেই বিশ্রী পঁচা মাছের গন্ধটা তীব্র থেকে তিব্রতর হতে লাগলো। জ্ঞান হারানোর আগে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলাম সুমন দৌড়ে আসছে উত্তর দিক থেকে, আর কিছু একটা বলছে আমকে ...।
--টোলামোড়, আয়ারল্যান্ড--
২১/০৮/২০১৬ইং
অনেক দিন হল মাছ ধরা হয় না। আজকের আবহাওয়াটা মাছ ধরার জন্য বড়ই চমৎকার। অন্তত আয়ারল্যান্ডের বৈরী আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত একটি দিন। তাই স্কাইলাইট জানালা দিয়ে বার বার নীলাম্বরের দিকে তাকিয়ে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছে। আমার যতগুল শখ আছে এই মাছ ধরা তার মধ্যে একটা। কাল বিলম্ব না করে সুমন কে ফোন দিলাম। সুমন আমার সহকর্মি এবং খুব ভাল বন্ধুও বটে ।
--হ্যাল কে? ফোনের ওপাশ থেকে সুমনের চার বছরের ছেলে, রাঈদের কণ্ঠ ভেসে এলো।
--আমি তোমার আর্ষ আংকেল, বাবা কোথায়?
--বাবা। he is in toilet.
প্রবাসের ছেলে মেয়েরা বাংলা কথা ভুলেই যাচ্ছে। নিহাত প্রয়োজন ছাড়া এরা বাংলায় কথা বলে না । বাঙ্গালী টিনেজার ছেলে মেয়েদেরকে কখনোই নিজেদের মধ্যে বাংলা ভাষায় কথা বলতে শুনি না। তাঁদের নাকি অড ফিল হয় বাংলা ভাষায় কথা বললে।
--আচ্ছা, বাবা বেড় হলে বলো আমায় ফোন করতে।,
হ্যাঁ, না কিছু না বলেই লাইন কেটে দিল। বাচ্চারা মোবাইল ফোন বেশিখন ব্যস্ত রাখতে চায় না । ওদের গেমস খেলায় নয়তো বা কার্টুন দেখায় বিলম্বিত হয়। একটু মুচকি হেসে তনু কে বললাম,
--এই তুমি যাবে মাছ ধরতে?
--না আমি যাব না,তুমি যাও। আমার শরীরটা ভাল না।
তনু যাবে না শুনে মনে মনে একটু খুশিই হলাম, কারণ ও সাথে গেলেই বাসায় আসার তাড়া, “এই চল সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, ভাল লাগছে না, দূর ছাই মাছ উঠেনা.........ব্লা...ব্লা...।”
--কেন কি হয়েছে? আরে তুমি না গেলে কি মজা হয়? প্লিজ চল,। একটু আহ্লাদের সুরে বললাম।
--তেমন কিছু না, মাথাটা ধরেছে, একটা সল্পারডিন খেয়ে শুয়ে থাকবো। তুমি তোমার বন্ধুকেই নিয়ে যাও।”
তনুর কথা শেষ হতে না হতেই ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরে বললাম,
--হ্যাল, সুমন কি অবস্থা?
--হ্যাল, ফোন করেছিলি? ফোনের অপর পাশ থেকে সুমনের কণ্ঠ ভেসে আসলো।
--হ্যাঁ করেছিলাম, মাছ ধরতে যাবি?
--যাব না মানে? তুই কি রেডি? রেডি হয়ে আমায় ফোনদে। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
আমি চটপট তৈরী হয়ে সুমনের ফোনের অপেক্ষা করতে থাকলাম। সুমনের যে কয় সেকেন্ডে এক মিনিট হয় তা ও নিজেই জানে। অপেক্ষার প্রহর শেষ করে ফোন বেজে উঠলো।
--হ্যাল এক মিনিট অপেক্ষা কর। আমি আসছি,। সুমনকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে বড়শিগুলো আর মাছ ধরার বাকি সরাঞ্জম নিয়ে রওনা দিলাম । সুমন ওর গাড়ি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। গাড়ির পিছে বড়শি আর বাকি জিনিস পত্র রেখে সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। আমায় দেখে সুমন বলল- “ আজ অনেক মাছ উঠবেরে। ওদের কাউকে নিয়ে আসি নি ভালই হয়েছে আজ অনেকক্ষণ থাকা যাবে।”
--হুম। গান ছাড়।
সুমন গান ছেড়ে নিঃশব্দে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে দ্রুত ছুটে চলছে আমদের গাড়িটি। লগবোরা অনেক সুন্দের একটি জায়গা। ওখানে মাছ ধরার জন্য দুটো অনেক বড় লেক আছে, সামনে আছে বিশাল পাহাড় আর চার পাশ ঘন গাছ গাছালি দিয়ে ভরা। লগবোরা একটি ঐতিহাসিক জায়গা এবং এটি আয়ারল্যান্ডের একটি জাতীয় উদ্যান। হঠাৎ সুমন ফুল ব্রেক কষলো। আমি সিটে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছিলাম। ওর হঠাৎ ব্রেকে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সিট বেল্ট বাঁধা না থাকলে সোজা উইন্ডশিল্ড এ গিয়ে বাড়ি খেতাম।
--কিরে কি হয়েছে এত জোড়ে ব্রেক কষলি কেন?
সুমনের হাত কাঁপছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। আমি আবার জিজ্ঞাস করলাম ,
--কিরে কি হয়েছে?
--গাড়ির নিচে একটা কাল বিড়াল এসে পড়েছে। বিড়ালটা মনে হচ্ছে পিষে গেছে।
আমরা ব্লুবল বার পার হয়ে ব্লুবল রোডে আছি। রোডটা অনেক সরু এবং উঁচু নিচু, আর এখানে বিড়াল আসবে কোথেকে ঠিক বুঝতে পারছি না। আশেপাশে কোন বাড়ি ঘর নেই, আর এই সব দেশে স্ট্রিট বিড়াল দেখা যায় না বললেই চলে। সুমন গাড়ি থেকে নামতে চাইলো, কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে একটা গাড়ি আমদের গাড়িকে হর্ণ দিল। এই দেশে হর্ণ এর মানে বকা দেওয়ার সামিল। আমি সুমন কে বললাম –- গাড়ি স্টার্টদে।
--চল আজ ফিরে যাই। বিড়াল তাও আবার কাল, গাড়িতে চাপা পড়েছে। চল চলে যাই আজ আর দরকার নেই মাছ ধরার।” সুমন ধরা গলায় বলল।
--দূর ।। তুই দেখি একটা ভীতুর ডিম। এই সব কুসংস্কার তুই বিশ্বাস করিস? বাদদে তুই তো আর ইচ্ছা করে মারিস নি।
তারপর সুমন একটু স্থির হয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো। মিনিট কুড়ির মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমরা। গাড়িটি পার্কিং লটএ পার্ক করে আমরা আমদের সরাঞ্জম নিয়ে লেকের চলে গেলাম। সুবিধামত জায়গায় বসে মাছ ধরা শুরু করে দিলাম। আজ লোক জন অনেক কম। দুই একজনকে দেখলাম সাইকেলিং করছে, আর তেমন কাউকে চোখে পরছে না। মাছ ধরার সবচাইতে বড় সূত্র হল ধৈর্য, যার ধৈর্য নেই সে মাছ ধরতে পারবে না। প্রায় ঘণ্টা দুই এক হয়ে গেল কিন্তু একটিও মাছ কপালে জুটলো না। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সূর্য ডুবোডুবো করছে।আজ মনে হচ্ছে ধৈর্যের সব সূত্র ভুল প্রমাণিত হবে। সন্ধ্যার পরপরই লগবোরা একে বাড়ে জনশূন্য হয়ে পড়ে, চারপাশ শুধু গাছ গাছালি আর দুরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে স্লিপব্লুম পাহাড়। একটা আশ্চর্য বিষয় লক্ষ করলাম, লেকের আশেপাশে একটাও হাঁস নেই আজ। এই লেকে অনেকগুলো রাজহাঁস সহ পাতিহাঁস, বুনোহাঁস, ডাহুক বাস করে। ওদের জন্য লেকের মাঝে একটা মাঝারি সাইজের কৃত্তিম দ্বীপও আছে। হাসগুলো সারা দিন এই পারের কাছেই থাকে, পর্যাটকরা ওদের জন্য বিভন্ন খাবার দাবার দিয়ে যায়, রুটি, কলা, আপেল কত কি। হাসগুলোর খাবার পড়ে আছে কিন্তু একটা হাঁসতো দুরে থাক হাঁসের পলকও দেখতে পেলাম না আজ। সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু গোধূলি বেলার লালচে আভা এখনো রয়ে গেছে মনে হচ্ছে কোন শিল্পি তার রঙ তুলি দিয়ে বসে বসে আকাশ নামক ক্যানভাসে আচড় কেটে যাচ্ছে। দিনের আলো ফুরিয়ে যেতেই লগবোরার চেহারা পাল্টে গেল। দিনের চেহারার সাথে রাতের কোন মিল নেই। নির্মূল সজিব পরিবেশ কেমন যেন রহস্যময় আর ভৌতিকতায় ছেয়ে গেল, চারদিকে শুনশান নিরবতা হঠাৎ সেই নিরবতা ভেঙ্গে খুব কাছ থেকে একটা নেকড়ের ডাক ভেসে এলো। বুকটা ধক করে উঠলো। কলজে হিম হয়ে গেল। ক্রমশই পরিবেশটা ভাড়ি হয়ে উঠছে আর একটা অশুভ কোন কিছুর ইঙ্গিত করছে। মনে হচ্ছে বাতাসে কেউ ফিসফিস করে বলছে চলে যাও, নইলে বিপদে পড়বে। হতাশা নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় আমার বড়শি ভারী হয়ে গেল, জলের নিচ থেকে কে যেন আমার বড়শি টেনে ধরেছে। বুঝলাম মাছ ধরেছে, ধীরে ধীরে বড়শি টানতে শুরু করলাম। মাঝারি সাইজের একটা মাছ উঠেছে। মনটা খুশিতে ভরে গেল। আমি চেঁচাতে থাকলাম।
--এই সুমন দেখ কত বড় একটা মাছ ধরেছি। দেখ দেখ ...।
মাছটা পানি ভর্তি বকেটে রেখে আবারো বড়শিতে ওয়ার্ম গেঁথে ছুড়ে দিলাম গভির জলে। আরো একটা মাছ ধরেছে বড়শিতে। বড়শি তুলে মাছটি খুলে বকেটে রেখে আবার বড়শি জলে ছুড়ে দিলাম। সমুন আমার থেকে পনেরো কি বিশ গজ দুরে মাছ ধরছে। ওর দিকে একবার তাকিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। একের পর এক মাছ উঠেই চলছে। অমাবস্যা চলছে, তাই সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘন অন্ধকার গ্রাস করে ফেল্ল আমদের, তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই আমার। একটু আগেই চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আর এখন যেন নেশায় পেয়ে গেছে। বড়শিতে যেন আঠা লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। বড়শি ফেলতে দেরি মাছ উঠতে দেরি হচ্ছে না, পরপর অনেক গুলো মাছ ধরে ফেল্লাম। আমার মাছের বকেট প্রায় ভরে গেছে। আরো একটি মাছ ধরেছে বড়শিতে, আমিতো খুশিতে আত্মহারা। মাছটি বড়শি থেকে ছাড়িয়ে বকেটে রাখতে গিয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার। আগের ধরা একটা মাছও নেই। কি ব্যপার আমার মাছ কোথায়? নিজের অজান্তেই সুমনের দিকে নজর ঘুরে গেল। অন্ধকারে ওর অবয় দেখা যাচ্ছে চেয়ারে বসে আছে মাথা হেলান দিয়ে। আমি ভ্রুকটি করে বললাম,
--এই সুমন আমার মাছ কোথায়? কি করেছিস? তুই নিয়েছিস?
সুমন যেন কানে শুনতে পেলো না কথা গুলো। কোন প্রতিক্রিয়াই করলো না আমার কথার। মনে হয় দুষ্টামি করছে আমার সাথে। আমায় রাগানোর জন্য এই রকম করছে। সমস্যা নেই। মাছগুলো মনে হয় ওর বকেটেই আছে। আমি মাছটা রেখে আবার বড়শি ছুড়ে দিলাম। সাথে সাথেই আর একটি মাছ বড়শিতে উঠলো। আমার মুখে খুশির একটা ঝলক বয়ে গেল আর সেই খুশি ছড়িয়ে গেল আমার হাসিতে। হাসতে হাসতে বড়শিটা উঠালাম। মোটামোটি দুই-তিন কেজির মত ওজনের একটা সিলভার কাপ মাছ উঠে আসলো। মাছটি প্রাণপণে চেষ্ঠা করে যাচ্ছে নিজেকে বড়শির হুক থেকে মুক্ত করে গভির জলে ছুটে যেতে। মাছটি বড়শির হুক থেকে খুলে বকেটে রাখতে গিয়ে আমার চোখ কপালে উঠলো। আমার বকেটে কোন মাছ নেই। আমি সিলভার কাপটা বকেটে রেখে সুমনের দিকে তাকালাম। সুমন আমার কাছ থেকে দশ কি পনেরো হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে, সুমন লেকের পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর বড়শি কোথায়? জাহান্নামে যাক ওর বড়শি। আমার মাছগুলোর চিন্তাই এখন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি এইবার একটু গলা উঁচিয়ে বললাম- সুমন আমার মাছ কোথায়? তুই নিয়েছিস? আর মাছ যদি চাসতো বলে কয়ে নে। আর দুষ্টামি করিস না দয়া করে”।
সুমন একটা কথাও বলল না এমনকি ফিরেও তাকালো না আমার দিকে। আমি একটু বিরক্ত হয়ে আবারো বড়শি তৈরী করতে থাকলাম। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, সুমনের আশে পাশে কোন বড়শি, বকেট বা মাছ ধরার কোন কিছুই নেই ইভেন চেয়ারটা পর্যন্ত নেই। কিন্তু একটু আগেওতো চেয়ারে বসে ছিল। আমি সাত পাঁচ না ভেবে মাছ ধরায় মন দিলাম। বড়শি ফেলতে না ফেলতেই বড়শিতে আবারো মাছ ঠোকর দিলো। আজ এত বছর ধরে মাছ ধরছি কোন দিনও এমন হয় নি। বড়শি ফেলতে দেরি হচ্ছে কিন্তু মাছ ধরতে দেরি হচ্ছে না। মাছ বড়শি থেকে খুলে বকেটে রাখতে গিয়ে এইবার আমার মেজাজ বখরে গেল। আমার সিলভার কাপ মাছটা নেই। বকেট থেকে একটু দুরে সুমন পিছমোড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রাগে গদ গদ করতে করতে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু রাগান্বিত স্বরে বললাম –“সুমন এই সব কি ধরণের ফাজলামি হচ্ছে?” সুমন কোন জবাব দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা খাচ্ছে। আমি সুমনের কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বললাম—“এই কি করছিস? আমার মাছ কোথায়?” সুমনের শরীর যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ওর কয়েকশ’ ডিগ্রি জ্বর। আমি হাতটা এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে নিলাম। সুমনের শরীর থেকে একটা বিশ্রী মাছ পঁচা গন্ধ আসছে। অনেকক্ষণ থেকেই নাকে এই গন্ধটা আসছিল, ভেবেছিলাম হাঁসদের খাবারের পঁচা গন্ধ। সুমন আমার দিকে ফিরে তাকাল, ওর চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বল জ্বল করছে। ও’দু হাতে আমার সিলভার কাপ মাছটা ধরে রেখেছে। আমার হাতের ফিশিং নিয়ন লাইটের অনুজ্জ্বল সবুজ আলোয় স্পষ্ট আমি দেখতে পেলাম, আধখাওয়া মাছটার তাজা রক্ত সুমনের মুখের চার পাশে লেগে আছে। আমার দিকে এমন হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো যেন ওকে সময় ডাকাডাকি করে খুব বিরক্ত করছি,ওর রক্ত চাহনি দেখে আমার কলজে হিম হয়ে গেল। মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে গেল ভয়ের শীতল শিহরণ । আমার পশমগুলো শজারুর কাঁটার মত দাঁড়িয়ে গেল। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম
—সু...মন। কি হয়েছে তোর।
আমার কথার জবাবে ওর চাহনি আরও কেমন যেন হয়ে গেল, ধীরে ধীরে সুমনের চেহারার অবয় পরিবর্তন হয়তে লাগলো এক ভয়ানক জন্তুর মত। আমি আর এক সেকেন্ড থাকতে পারলাম না। আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলেগেল। আমি এক দৌড় দিয়ে পীচঢালা সড়কে চলে আসলাম। রাস্তাটা লেক থেকে একটু উঁচুতে, তাই নিজেকে একটু নিরাপদ মনে হচ্ছে। এখন আমার কাজ হল গাড়ির দিকে ছুটে যাওয়া। রাস্তায় উঠে হাঁপাতে লাগলাম। আমার বরাবর উত্তর দিক থেকে একটি ছায়া মূর্তি দৌড়ে আসছে। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ছায়া মূর্তিটি আমার সামনে এসে বিষম খেয়ে থমকে গেল। আমিও ছায়া মুর্তিটিকে দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। ভয় কৌতুহলের রূপ নিল, যখন ছায়া মূর্তিটি সুমনের গলায় ভয়ার্ত কন্ঠে বলল – ক...কে...কে তুই...। আর্ষ...? আমায় কিছু করিস না... সব মাছ রেখে এসেছি...প্লিজ।”
--সুমন? তু...ই এখানে তো ঐখানে কে? আমি নিচের দিকে আঙ্গুল তুলে তাকাতেই দেখলাম ওখানে কেউ নেই! সামনে সুমন দাঁড়িয়ে। ওর হাত পা কাঁপছে। আমার কণ্ঠ শুনে একটু সাহস পেয়ে বলল,
--আর্ষ এর মানে কি? তু...ই ঠিক আছিস?
--সুমন সব কথা পড়ে হবে, এই জায়গা ঠিক না। তারা তাঁরই গাড়িতে উঠ।, এই কথা বলেই সুমনের হাত ধরে টান দিয়ে আমি দৌড় দিলাম। আমরা গাড়ির কাছে পৌঁছেই গাড়িতে উঠে বসলাম। সুমন এক সেকেন্ডও দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি পার্কিং লট থেকে রাস্তায় নামাতেই গাড়ির হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট আমরা দেখলাম একটা কাল ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, আর হাতে একটা মাছ। সুমন সাত,পাঁচ না ভেবে গাড়িছুটালো। এতজোড়ে ওকে কোন দিনও আমি গাড়ি চালাতে দেখি নি। অন্ধকার, তার উপর উঁচু নিচু নির্জন রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলছে দুই পাশে ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে। এখনো ভয়ে আমার বুক ধুকধুক করছে। লগবোরার রাস্তা পার হবার পড় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ভয়ে ভয়ে একবার গাড়ির লুকিং গ্লাস দিয়ে পিছনে তাকালাম। তার পর সুমনের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞাস করলাম,
--কি হয়েছিল তোর সাথে?
সুমন আমার কথার জবাব দিল না। চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাকলো। আমি ওকে চুপ থাকতে দেখে ভাবলাম ভয়ের রেস এখনো যায় নি, তাই পরিবেশ হালকা করার জন্য আবারও জিজ্ঞাস করলাম,
--কয়টা মাছ পেছিলি?
এইবারো চুপ, কোন জবাব আসলো না সুমনের কাছ থেকে। আমি ওর দিকে ভাল করে তাকালাম। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারের জন্য। তাই আমি গাড়ির লাইট জ্বালালাম, আর যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সুমনের মুখে তাজা মাছের রক্ত লেগে আছে, আর ওর চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, যেন জ্বলন্ত কোন অঙ্গার। আমার দিকে ফিরে তাকাল, মৃদু হেসে নাকি গলায় বলল,
--কিঁরেঁ আঁরঁ মাঁছঁ ধঁরঁবিঁ নাঁ? আঁমাঁরঁ ক্ষিঁধাঁ লাঁগঁছেঁ......।
সুমনের গাঁ থেকে বিশ্রী পঁচা মাছের গন্ধ আসছে। যে গন্ধটা আমি লগবোরায় পেয়েছিলাম। ভয়ে আমার কলজে বুকের খাঁচা ছেড়ে বের হবার জোগাড়। আমি চিৎকার করে উঠলাম নাআআআআআআ। সুমন হেসেই যাচ্ছে, আমি ভয়ে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলতে গেলাম। গাড়ির দরজা খুলে গেল এক ঝাটকাতেই, সুমন মনে হয় আমার মন ভাব বুঝতে পেরেই গাড়ির ব্রেক কষলো। আমি এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিলাম। কিন্তু একটু সামনে গিয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম পীচ ঢালা পথে। মাথা তুলে উঠতে গিয়ে চোখ পড়লো ওয়েল কাম টু লগবোরার সাইন বোর্ডের দিকে । সারা লগবোরা পার্কে এই একটি জায়গাতেই বাতি জ্বলছে। সাইন বোর্ডটা দেখেই আমার মাথা ঘুরে গেল। আমরাতো ছিলাম ন্যাশনাল রোড-এ তা হলে এই খানে কি করে এলাম? নাকের কাছে সেই বিশ্রী পঁচা মাছের গন্ধটা তীব্র থেকে তিব্রতর হতে লাগলো। জ্ঞান হারানোর আগে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলাম সুমন দৌড়ে আসছে উত্তর দিক থেকে, আর কিছু একটা বলছে আমকে ...।
--টোলামোড়, আয়ারল্যান্ড--
২১/০৮/২০১৬ইং
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুল মান্নান মল্লিক ২২/০৯/২০১৬বাঃ, অপূর্ব লিখনি। ধন্যবাদ
-
সুকান্ত ১৮/০৯/২০১৬ভালো লাগলো...
-
প্রসূন রায় ১৩/০৯/২০১৬খুব ভালো লাগলো
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ১২/০৯/২০১৬ভূতের গল্প সুন্দর হয়েছে।
-
পরশ ১০/০৯/২০১৬মজা পাইলাম
-
মোনালিসা ০৬/০৯/২০১৬দারুন
-
সোলাইমান ০৪/০৯/২০১৬ভালো হয়েছে কবি।অনেক ভালো।
-
মোং নাজিম উদ্দিন ২৯/০৮/২০১৬চমৎকার
-
ধ্রুব রাসেল ২৫/০৮/২০১৬চমৎকার
-
স্বপ্নময় স্বপন ২৫/০৮/২০১৬ভালো লাগলো!
-
মোহাম্মাদ নেছার উদ্দিন ২৫/০৮/২০১৬দারুন লিখেছেন।